Monday 1 June 2020

বয়কট চায়না

কদিন ধরে হঠাৎ স্যোসাল মিডিয়ায় চীনদেশের পণ্য বয়কট করার আবেদন জানিয়ে পোস্ট দেখতে পাচ্ছি৷ এরকম আবেদনের ঢেউ মাঝেমধ্যে ওঠে আবার মিলিয়েও যায়৷ চীনদেশের পণ্যের বাজার ক্ষতিগ্রস্থ হওয়া বা আমাদের দেশের উৎপাদন শিল্পের উন্নতির কোন লক্ষণ অবশ্য দেখা যায় না৷ তবে এবারে সমস্ত চীনা পণ্য বয়কটের বদলে স্মার্টফোনের চীনা অ্যাপ আনইনস্টল করার আবেদনই আসছে বেশী৷ সমস্ত চীনা পণ্য বয়কট করার আহ্বান যে বাস্তবসম্মত নয় তা অনেকে বুঝেছেন৷ সে যাই হোক এবারের ঢেউটাও মিলিয়ে যাওয়ার আগে চীনের শিল্পজাত পণ্য ছাড়া আরো কি কি বয়কট করা যেতে পারে তা একটু ভেবে দেখা যেতে পারে৷

এইমুহূর্তে হংকং এ সরকারবিরোধী আন্দোলনের খবর গোটা পৃথিবী জানে৷ ১৯৯৭ সালে হংকং ব্রিটিশ সরকারের থেকে চীনে হাতবদল হওয়ার সময় একটা চুক্তি হয়েছিল যে হংকং একটা বিশেষ স্বায়ত্তশাসন বজায় রাখতে পারবে৷ হংকং এর প্রশাসন, আইনসভা, বিচারব্যবস্থা সবই চীনের মূল ভূখণ্ডের থেকে আলাদা হবে৷ সম্প্রতি চীনের কেন্দ্রীয় সরকার মূল ভূখণ্ডের জাতীয় নিরাপত্তা আইনকে হংকং এ প্রয়োগ করার জন্য সংবিধান সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে৷ এতে স্বায়ত্তশাসন ক্ষুণ্ণ হওয়ার আশঙ্কা করে হংকং এর মানুষ পথে নেমেছে আর পুলিস নামিয়ে তাদের আন্দোলনকে দমন করার চেষ্টা হচ্ছে৷ আমাদের দেশেও ১৯৪৭ সালে জম্মু- কাশ্মীর নামের দেশীয় রাজ্যটি ভারতে অন্তর্ভূক্ত হয়েছিল তার বিশেষ স্বায়ত্তশাসন বজায় রাখার চুক্তি মেনে৷ তারপর ক্রমান্বয়ে ঐ রাজ্যের মানুষের নাগরিক অধিকার গুলো হরণ করা হয়েছে, অবশেষে গত বছর রাজ্যের বিধানসভার মতামত না নিয়েই ৩৭০ ধারায় জম্মু কাশ্মীরের স্বায়ত্তশাসন খারিজ করা হয়েছে৷ রাজ্যের মানুষ প্রতিবাদে নামলে সেনাবাহিনীর বুটের তলায় তাদের দমন করা হয়েছে৷ ভদ্রলোকের চুক্তি ভঙ্গ করা, রাজ্যের স্বায়ত্বশাসন কেড়ে নেওয়া, নাগরিকের প্রতিবাদের ওপর দমনপীড়ণ চালানোর চীনা মডেলটিকে আমরা বয়কট করতে পারি৷

আমরা জানি চীনে নিরপেক্ষ সংবাদমাধ্যমের অস্তিত্ব নেই৷ যে কটা সংবাদমাধ্যম আছে সেগুলো সরকার নিয়ন্ত্রিত৷ আমাদের দেশে অবশ্য বেসরকারী সংবাদমাধ্যমের একটা বড় ভূমিকা রয়েছে৷ এমনকি দূরদর্শন বা আকাশবানীর মত সরকারী সংস্থাগুলোও সরকারী মতের পাশাপাশি বিরোধী মতও প্রচার করত৷ কিন্তু এখন সরকারী সংবাদমাধ্যমগুলো তো বটেই, প্রায় সমস্ত বেসরকারী সংবাদমাধ্যমও অন্ধভাবে সরকারকে সমর্থন করতে বাধ্য৷ যে কজন সাহসী সাংবাদিক সত্যানুসন্ধানে ব্রতী, তাঁদের নানাবিধ হুমকি, গ্রেফতার, এমনকি প্রাণসংশয়েরও মুখোমুখি হতে হচ্ছে৷ গ্লোবাল প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্সে ভারত ২০১৩ সালের ১০৫তম অবস্থান থেকে ২০২০ তে ১৪২ তম অবস্থানে নেমে গেছে৷ সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব করার এই চীনা অভ্যাসটাকে আমরা বয়কট করতে পারি৷

চীনে শ্রমিকদের অধিকার অনেকটা কেড়ে নেওয়া হয়েছে বলে শোনা যায়৷ মালিকপক্ষ যখন খুশি ছাঁটাই করতে পারে, শ্রমিকরা ইউনিয়ন করতে পারেনা, ধর্মঘটের অধিকার নেই - এমন সব দাবী পশ্চিমের সংবাদপত্রগুলো করে থাকে৷ আমাদের দেশে অনেক লড়াইয়ের মাধ্যমে শ্রমিকরা তাঁদের অধিকার অর্জন করেছেন৷ কিন্তু কর্পোরেটদের চাপে ক্রমশ তাদের সেই অধিকার কেড়ে নেওয়া হচ্ছে৷ স্থায়ী কর্মীর তুলনায় ঠিকা কর্মীর অনুপাত বাড়ানো হচ্ছে, ন্যূনতম মজুরির আইন নেই, "হায়ার এন্ড ফায়ার" নীতি জোরদার হচ্ছে৷ এখন তো অনেক রাজ্যে কাজের সময় ৮ ঘন্টা থেকে বাড়িয়ে ১২ ঘন্টা হয়ে গেছে৷ ধর্মঘট ও আন্দোলন করতে গেলেও সরকার ও মালিকপক্ষের প্রতিহিংসার সম্মুখীন হতে হচ্ছে৷ শ্রমিকস্বার্থ বিরোধী এই কথিত চীনা মডেলটাকেও আমরা বয়কট করতে পারি৷

ছোটবেলায় শিখেছিলাম অপরের খারাপটাকে বর্জন আর ভালোটাকে গ্রহণ করা উচিৎ৷ সাম্প্রতিক করোনা অতিমারী চীনেই উৎপত্তি হলেও তারা অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে এই অসুখকে দমন করতে পেরেছে৷ উন্নত জনস্বাস্থ্য পরিকাঠামো এবং দক্ষ প্রশাসনিক ব্যবস্থার পাশাপাশি সরকার, দল ও সাধারণ মানুষের হাতে হাত মিলিয়ে কাজের মধ্য দিয়েই এই অসাধ্য সাধন সম্ভব হয়েছে৷ আরেকটা বিষয় হল চীনের দারিদ্র্য দূরীকরণ প্রকল্প৷ চীনের কমিউনিস্ট পার্টি ২০২০ সালের মধ্যে দেশকে দারিদ্র্যমুক্ত করার লক্ষ্য স্থির করেছে৷ বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের তথ্য অনুযায়ী গত চল্লিশ বছরে ৮০ কোটি মানুষকে দারিদ্র্যমুক্ত করা হয়েছে৷ গতবছরের হিসেব অনুযায়ী দেশে এখনও ৫০ লক্ষ দরিদ্র মানুষ আছেন৷ করোনা সঙ্কট সত্ত্বেও তাঁদের দারিদ্র্যসীমার ওপরে তুলতে তারা বদ্ধপরিকর৷

এখন যদি ভারত যদি চীনের ভালো অভিজ্ঞতাগুলো থেকে শিক্ষা নেয় এবং খারাপ জিনিসগুলো বয়কট করে তাহলে চীনা অ্যাপ আনইনস্টল করার থেকেও ভালো কাজ হবে৷ পাশাপাশি যদি বেসরকারীকরণের রাস্তা ছেড়ে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে উৎপাদন শিল্পের উন্নতি ঘটায় তাহলে হয়ত একদিন চীনের ওপর অতি নির্ভরশীলতা থেকে বেরিয়ে আসা যাবে৷


No comments:

Post a Comment