Wednesday 18 June 2014

চার ধাম

মারদাঙ্গা নেই, খুন নেই, হট নায়িকা নেই, সৎ পুলিস অফিসার বা দুর্নীতিগ্রস্থ রাজনৈতিক নেতা নেই। এমনকি প্যানপ্যানে সুরে রবীন্দ্রসঙ্গীত বা অসংলগ্ন কথায় সাজানো আধুনিক গান, বা রদ্দিমার্কা আঁতলামি দিয়ে গল্পের দুর্বলতাকে ঢাকার চেষ্টা নেই। এককথায় বলা যায় সমাজচেতনা, যুগচেতনা আর যৌনচেতনার যথেষ্ট অভাব রয়েছে "চার" ছবিতে। কিন্তু যা আছে তা হল গল্প। সম্পূর্ণ আলাদা মেজাজের চারটে নিটোল ছিমছাম গল্প। রবিবাবুর কথায় "সহস্র বিস্মৃতিরাশি, প্রত্যহ যেতেছে ভাসি, তারই দু-চারিটি অশ্রুজল।" পরশুরামের "বটেশ্বরের অবদান", সত্যজিৎ রায়ের "দুই বন্ধু", "কাগ্তাড়ুয়া" আর শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের "পরীক্ষা"। চারটে গল্পই পড়া, গল্পের মোচড়গুলোও জানা। শুকনো পাতার ওপর টাইটেল কার্ড আর মন কেমন করা আবহ্সঙ্গীতে শুরুতেই স্মৃতিমেদুর হয়ে পড়লাম। ডায়েরির ভাঁজে রেখে দেওয়া পাতার মত বহুদিন আগে পড়া গল্পগুলো মনের পর্দায় ভেসে উঠল। ছোটগল্পকে পরদায় ফেলা সহজ কাজ নয়। একটা ছোট্ট গল্পকে অযথা টেনে বাড়িয়ে তিনঘন্টার সিনেমা বানালে তার রসটাই মাটি হয়ে যায়। সন্দীপ রায় তাই সেদিকে না গিয়ে চারটে গল্পকে পরপর বলে গেছেন মাত্র পৌনে দুইঘন্টায়। বাংলা সাহিত্যের তিন ডন পরশুরাম, সত্যজিৎ আর শরদিন্দু কাজটা আগেই গুছিয়ে রেখেছিলেন। পরিচালক আর কোন বাহাদুরির চেষ্টা করেননি। একদিক দিয়ে অবশ্য তাঁর সুবিধে আছে, তিনজনের লেখাই সিনেম্যাটিক। চলচ্চিত্র জগতের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত থাকা সত্যজিৎ আর শরদিন্দুর গল্পকে অনায়াসে চিত্রনাট্য বলে চালিয়ে দেওয়া যায়। পরিচালক আর অভিনেতারা কেরামতি দেখাতে গিয়ে কিভাবে অসাধারণ গল্পেরও সর্বনাশ করতে পারেন তা দেখা হয়ে গেছে "মিশর রহস্য" আর "চাঁদের পাহাড়"এ। এই ছবিতে নায়ক যদি কাউকে বলতে হয় তো সে হল মানবিক সম্পর্ক। তাই অভিনেতাদের কোন হিরোইজম দেখানোর সুযোগ নেই। মনে হচ্ছে তাঁরা একেবারে বইয়ের পাতা থেকেই উঠে এসেছেন। সঙ্গে বাড়তি পাওনা "পরীক্ষা" গল্পে পুরনো দিনের রোম্যান্টিক বাংলা ছবির আমেজ।

তবে দুটো কথা আছে। প্রথমতঃ "বটেশ্বরের অবদান" গল্পটিকে ২০১৩ তে না এনে "পরীক্ষা"র মত পিরিয়ড ফিল্ম করলেই ভালো হত। দ্বিতীয়ত "দুই বন্ধু" গল্পে দেখা যাচ্ছে দীর্ঘ ২৫বছর পর চুক্তি অনুযায়ী দেখা করতে চলেছে মহিম আর প্রতুল। এতদিন পর হঠাৎ করে চুক্তির কথা মনে পড়ল তা হতে পারেনা। সত্যজিত ও লিখেছেন, "মহিমের সন্দেহ হয়েছিল সে ব্যাপারটা এতদিন মনে রাখতে পারবে কি না; কিন্তু আশ্চর্য -এই বিশ বছরে একদিনের জন্যও সে চুক্তির কথাটা ভোলেনি"। অথচ সিনেমায় দেখা যাচ্ছে দেখা করতে যাওয়ার দিন সকালেই মহিম বৌ-কে বলছে ঘটনাটার কথা। তাছাড়া গল্পটাকে যখন ২০১৩ তে-ই আনা হয়েছে তখন মহিম ফেসবুকে একবারও প্রতুলকে খোঁজার চেষ্টা করলনা এটা খানিক বিস্ময়কর। সব মিলিয়ে বলতে পারি চারধাম যাত্রায় মন খুশি হয়ে গেল। বাংলা ছোটগল্পের আরো মণিমাণিক্য পর্দায় উঠে আসুক।

গল্পগুলো যাঁরা পড়েননি তাঁরা চটপট নীচের বইগুলো জোগাড় করে ফেলুন। তবে সিনেমাটা দেখার আগে পড়বেন না।
(১) পরশুরাম গল্পসমগ্র/ রাজশেখর বসু/ এম সি সরকার এন্ড সন্স
(২) গল্প ১০১/ সত্যজিৎ রায়/ আনন্দ পাবলিশার্স
(৩) গল্পসংগ্রহ/ শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়/ আনন্দ পাবলিশার্স