Sunday 21 August 2016

হুতোম

তার নাম হুতোম। আমার খুব বন্ধু, যাকে বলে বেস্ট ফ্রেন্ড।
"সে কি তোমার ইস্কুলে পড়ে?" ... "না"
"তোমার বাড়ির পাশে থাকে বুঝি? বিকেলবেলায় তার সঙ্গে খেলো?" ... "ঊঁহু"
"তাহলে নিশ্চই তোমার আত্মীয় হয়?" ... "একেবারেই না"
আরে বন্ধু হলেই কেমন করে হয়েছে বলতে হবে না কি! সে যে আমার বন্ধু, এটাই তো সবচেয়ে বড় কথা। কোথায় থাকে? এই ধরে নাও পটলতলা। কি বলছ? পটলতলা কোন জায়গার নাম হতে পারে না? কেন? তালতলা হতে পারে, আমতলা হতে পারে আর পটলতলা হতে পারে না? আর না পারে তো বয়েই গেল, ধরে নিতে দোষ কি?
হুতোম সবসময় আমাকে সাহায্য করে। পড়ার সময়, খেলার সময়, ইস্কুল যাবার সময়, টিভি দেখার সময়। আমি ডাকলেই সে চলে আসে। তবে সাবধান, তোমাদের বিশ্বাস করে বলছি কিন্ত, কাউকে বলে দিওনা যেন, বিশেষ করে আমার বাবা মা কে। ওরা জানেই না হুতোমের কথা। জানেনা বললে অবশ্যি একটু ভুল হবে, জানতে চায় না, মানে বিশ্বাসই করে না।
এই তো সেদিন হুতোমের সঙ্গে পাঙ্খাটুলি গিয়েছিলাম, বাবার বন্ধু দেবেশকাকু দেখে ফেলেছে আর বাবাকে এসে রিপোর্ট করেছে।
বাবা চোখ পাকিয়ে বলল, "অতদূরে গিয়েছিলে কেন একা একা?"
"একা কোথায়! হুতোম ছিল তো সঙ্গে।"
"হুতোম আবার কে? কতবার বলেছি, ঐ সব বাজে ছেলেদের সঙ্গে মিশবে না?"
বোঝ কথা!! হুতোম না কি খারাপ ছেলে!! তাহলে ভালো ছেলে কারা? যারা সারাদিন বইমুখে বসে থাকে, সকাল বিকেল সেজেগুজে পড়তে যায়, বাসে বুড়োলোকেদের সিট ছেড়ে দেয়না, রাস্তায় আক্সিডেন্ট হলে পাশ কাটিয়ে চলে যায়, তারা? এসব কথা অবশ্যি বাবাকে বলিনি। বলে কোন লাভ নেই। বয়স হলে বুদ্ধিটা যে কেন কমে যায় কে জানে!

একদিন বাবা-মার সঙ্গে বিয়েবাড়ি গিয়েছিলাম ট্রেনে চেপে। ফেরার সময় কি ভীষণ ঝড়বৃষ্টি। ট্রেন থেকে নেমে তো মাথায় হাত। বাস, অটো, রিকশো, কিচ্ছু নেই। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর বাবা বলল, "বৃষ্টি থামার কোন লক্ষণ নেই, আর কিছু পাওয়া যাবে না। এবার হাঁটা লাগাতে হবে।" ঠিক সেই সময় একটা অটো এসে দাঁড়াল। তখন আর দরদাম করার সময় নেই, হুড়মুড় করে ভেতরে ঢুকে পড়লাম। সে অটো কোথায় যাব কিছু না শুনেই রাস্তায় নেমে পাঁইপাই করে ছুটতে লাগল। মা তো ভয়ে সিটিঁয়ে গেছে। বাবা যত বলে আস্তে চালাতে সে তত জোরে চালাতে থাকে। আধঘন্টার রাস্তা দশ মিনিটে পার করে পয়সা দেওয়ার আগেই আমাদের নামিয়ে দিয়ে হুউউস করে বেরিয়ে গেল। বাবা-মা তো অবাক। আমি অবশ্য অবাক হইনি, কারণ আগেই বুঝতে পেরেছিলাম কে অটো চালাচ্ছে, কিন্তু সে চোখ দিয়ে ইশারা করাতে কিছু বলিনি। তবে হুতোম যে অটো চালাতে পারে তা আগে জানতাম না।
পরে হুতোমকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, "তুমি অটো কিনলে না কি?"
"দ্যুৎ, তোমার যেমন বুদ্ধি! ওটা তো সামিরের অটো। সে ব্যাটা তো আর বেরোবে না, তাই আমিই নিয়ে এলাম। ও কিছু জানতেই পারেনি, কম্বলমুড়ি দিয়ে ঘুম দিচ্ছিল তো।"
"অ্যাঁ! তাহলে নিলে কিকরে? চুরি করেছ না কি?"
"চুরি করতে যাব কেন? আমি তো আবার রেখে এসেছি। তাছাড়া সামির আমার খুব ভালো বন্ধু, তোমার মতই।"


এই হল হুতোম। হুতোম পারেনা এমন কাজ বোধহয় নেই। কিন্তু সে যে কোন ক্লাসে পড়ে সেটা কিছুতেই বলবে না। তবে আমি যখনই ইস্কুলে যাই, তখন দেখি হুতোম জানলা দিয়ে থেকে বা গাছের ডাল থেকে উঁকি মারছে, কখনও বা আমার পাশে এসেও বসে পড়ে। কেবল আমিই ওকে দেখতে পাই, আর কেউ পায়না। তবে কোনদিন আমার হোমটাস্ক করে দেয়নি। যদিও আমি জানি ও অঙ্ক খুব ভালো পারে। কিন্তু সেকথা বললেই দুদিকে ঘাড় নেড়ে বলবে, "ওটি হচ্ছেনা, তোমার অঙ্ক তোমাকেই করতে হবে।"
আমাদের ইংরেজি স্যার সাংঘাতিক লোক। ছাত্রদের পেটাতেই তাঁর আনন্দ। তিনি ইচ্ছে করেই ভয়ংকর সব ট্রান্সলেশন দেন, বিচ্ছিরি সব শব্দের মানে জিজ্ঞেস করেন আর উত্তর অনুযায়ী বিভিন্ন রকম শাস্তি দেন। যারা মার খেল তাদের তবু ভাগ্য ভালো। কাউকে হয়ত বললেন চেয়ার, ব্যাস ক্লাস শেষ না হওয়া পর্যন্ত শূন্যে চেয়ার হয়ে বসে থাকতে হবে। কাউকে যদি বলেন এক পা, অমনি এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে।
একদিন তিনি ভবানীকে ধরেছেন, "বলত ফুলিজিনাস মানে কি?"
ভবানী অনেকটা ভেবেচিন্তে, খানিকটা কানটান চুলকে বলল, "ফুলিজিনাস মানে ফুলিশ মানে বোকা কিন্তু জিনিয়াস"
"বেশ বলেছিস, ঠিক তোর মতই। আয় জিনিয়াসগিরি কাকে বলে দেখিয়ে দিই", স্যার ভবানীর কানের দিকে হাত বাড়াতেই হুতোম স্যারের কানটাকেই পাকড়ে ধরল। স্যারের মুখ ভয়ে সাদা হয়ে গেল। এদিকে হুতোমকে আমি ছাড়া কেউ দেখতে পাচ্ছে না। সবাই তাজ্জব। হুতোম স্যারের কানে কি একটা বলে ছেড়ে দিল। ভবানী সাহস করে জিজ্ঞেস করল, "কি হয়েছে স্যার?"
স্যার কিছু না বলে পেনটাকে পকেটে পুরে রোলকলের খাতাটা টেবিলেই ফেলে ক্লাস থেকে বেরিয়ে গেলেন।
হুতোমকে জিজ্ঞেস করলাম, "স্যারকে কানে কানে কি বললে তখন?",
"কিছু না, বললাম আপনি আসার সময় যে দুধটা না খেয়ে নর্দমায় ফেলে দিয়েছেন, তা কিন্তু আপনার স্ত্রী দেখে ফেলেছেন"

এই যে এতক্ষণ হুতোমকে নিয়ে আবোল তাবোল বকলাম, তোমরা নিশ্চই ভাবছ, হুতোমটা আসলে কে? মানুষ? ভূত? রোবট? না কি অন্য গ্রহের জীব? তোমরা ভাবতে থাকো, আমি যাই, হুতোম ডাকছে।


এটা কবে লিখেছিলাম মনে নেই, পুরনো খাতাপত্তর ঘাঁটাঘাটি করতে গিয়ে বেরিয়ে পড়ল। লেখাটা পাতে দেওয়ার মত হয়নি জানি, কিন্তু ছোটবেলার লেখার প্রতি সবারই তো একটা দুর্বলতা থাকে, তাই চর্যাপদের বন্ধুদের সঙ্গে শেয়ার করছি। আর এটা যে খুব মৌলিক তাও আমি দাবী করছিনা। তবে কি না একজায়গা থেকে টুকলে সেটা হয় চুরি করা, আর অনেক জায়গা থেকে টুকলে গবেষণা। তাই কাঠগড়ায় তুললে আমি বলতেই পারি, ধর্মাবতার, আমি চোর নই, গবেষক হতে পারি বড্ডজোর। 
প্রথম প্রকাশঃ চর্যাপদ