Sunday 23 June 2013

এই মিছিল


এই প্রথম মিছিলে হাঁটলাম। এই প্রথম সম্মিলিত প্রতিবাদের ঢেউয়ে রেজোন্যান্স হল। এই প্রথম হাজারো মানুষের ভিড়ে খুঁজে ফিরলাম নিজেকে।

এই মিছিল ছিল কামদুনির কলেজে পড়া হতভাগা মেয়েটার জন্য। এই মিছিল ছিল গাইঘাটার ধর্ষিতা শিশুটার জন্য। এই মিছিল ছিল দিল্লীর দামিনীর জন্য। এই মিছিল ছিল শারীরিক ধর্ষণের পরও বারবার সামাজিকভাবে ধর্ষিত হওয়া পার্ক স্ট্রীটের সুজেটের জন্য। এই মিছিল ছিল সিঙ্গুরের তাপসী মালিক, নন্দীগ্রামের রাধারাণী আড়ি, বানতলার অনীতা দেওয়ানের জন্য। এই মিছিল ছিল কাশ্মীর, মণিপুর, ছত্তিশগড়ে "নিরাপত্তা বাহিনী"র হাতে প্রাণ ও ইজ্জত খোয়ানো মা-বোনদের জন্য। এই মিছিল ছিল গুজরাটে মোদীবাহিনীর হাতে ধর্ষিতা মহিলাদের জন্য।

এই মিছিলে ছিল সেই মেয়েটা, যে রোজ পুরূষের লোভী দৃষ্টি ও কামুক হাতের নাগাল দিয়ে যাতায়াত করে। এই মিছিলে ছিল সেই বউটা, প্রতিরাতে যাকে দাম্পত্যের নামে ধর্ষিতা হতে হয়। এই মিছিলে ছিল সেই শিশুটা, সুযোগ পেলেই যার বাবা-কাকা-দাদা রা শরীরে হাত বুলোয়। এই মিছিলে ছিল সেই ছেলেটা, "মেয়েলি" হওয়ার অপরাধে যাকে বন্ধুরা টিটকিরি দেয়, আর সেই মেয়েটা, "পুরূষালি" ভাবের জন্য যার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের অবস্থান নিয়ে খবরের কাগজে গবেষণা চলে। এই মিছিলে ছিল সেই ছেলেটা যে তার ছেলেবন্ধুকে ভালবাসে আর সেই মেয়েটা যে তার মেয়েবন্ধুর সঙ্গে ঘর বাঁধতে চায়। এই মিছিলে ছিল সেই মেয়েটা, যাকে রোজ মুখে রঙ মেখে খদ্দেরের জন্য রাস্তায় দাঁড়াতে হয় পেটের দায়ে।

এই মিছিল মানে গলার শির ফুলিয়ে স্লোগান আর গলায় পোস্টার ঝুলিয়ে চুপচাপ হেঁটে যাওয়া। এই মিছিল মানে লাঠিহাতে বৃদ্ধ আর ব্যাগকাঁধে অফিসফেরতা কেরানী। এই মিছিল মানে নিরাপত্তার দাবী, এই মিছিল মানে সংবেদনশীলতার দাবী। এই মিছিল মানে ইনকিলাব জিন্দাবাদের পাশে সমকাম চুম্বনের ছবি। এই মিছিল মানে বঙ্কিমচন্দ্রের বাণী আর সলিল চৌধুরীর শপথ। এই মিছিলে হাঁটেন কন্ঠে গণসঙ্গীতের সুর, চোখে বিপ্লবের স্বপ্নমাখা রবিঠাকুর।

এই মিছিল কোন রাজনৈতিক দল ডাকেনি। এই মিছিলে কোন রাজনৈতিক দলের পতাকা ছিল না। এই মিছিলে কোন রাজনৈতিক নেতা নেতৃত্ব দেয়নি। এই মিছিলের জন্য কেউ গ্রামে গঞ্জে বাস-ট্রাক পাঠায়নি। তবু এই মিছিল ছিল পুরোদস্তুর রাজনৈতিক। কারণ রাজনীতিটা কোন নেতানেত্রীর ব্যক্তিগত জমিদারি নয়। কারণ রাজনীতিটা কোন দলের খিড়কির উঠোন নয়। কারণ রাজনীতিটা কোন কর্পোরেট মিডিয়ার জ্ঞান বিতরণের পাঠশালা নয়। রাজনীতিটা মানুষের, রাজনীতিটা মানুষের জন্য, রাজনীতিটা হবে মানুষের দ্বারা।


যারা ধর্ষণকে সাজানো ঘটনা বলে, প্রতিবাদীদের চোখ রাঙায়, যারা "ক্ষতিপুরণ" দিয়ে মুখ বন্ধ করতে চায়, যারা ভোটের জন্য মস্তান পোষে, এই মিছিল তাদের গালে একটা থাপ্পর। যারা ধর্ষিতার চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলে, যারা খাটো জামাকে ধর্ষণের কারণ হিসেবে তুলে ধরতে চায়, যারা মেয়েদের রাতবিরেতে না বেরোতে পরামর্শ দেয়, এই মিছিল তাদের গালে একটা থাপ্পর। যারা রাস্তার আন্দোলনকে মেঠো রাজনীতি বলে ব্যঙ্গ করে, যারা রাজনীতিকে মার্কিন মুলুকের মত টিভির টক শো তে পরিণত করতে চায়, এই মিছিল তাদের গালে একটা থাপ্পর। যারা কামদুনি নিয়ে চিৎকার করে, অথচ বানতলার কথা শুনলেই পেছন চুলকোয়, এই মিছিল তাদের গালেও একটা থাপ্পর।

এই মিছিল স্যালুট জানায় টুম্পা কয়ালের অকুতোভয় প্রতিবাদকে। এই মিছিল স্যালুট করে "ক্ষতিপুরণে"র টাকা প্রত্যাখ্যান করা ধর্ষিতার পরিবারগুলিকে। এই মিছিল স্যালুট করে ক্ষমতার দম্ভের বিরুদ্ধে সুজেটের লড়াইকে। এই মিছিল স্যালুট করে নন্দীগ্রাম, লালগড়ের লড়াকু মহিলাদের। এই মিছিল স্যালুট জানায় মণিপুরী মায়েদের নগ্ন প্রতিবাদকে। এই মিছিল মাথা নত করে একযুগ ধরে অনশনরত শর্মিলা চানুর সামনে।

এই মিছিল মানে সম অধিকারের দাবী, এই মিছিল মানে সম মর্যাদার দাবী। এই মিছিল দেখায় প্রতিবাদের পথ। এই মিছিল আনে সুন্দর ভবিষ্যতের স্বপ্ন। 

"প্রতিভা আর যশোদা মার রক্ত বীজ এই মিছিল,
 স্বামীহারা অনাথিনীর চোখের জল এই মিছিল; 
শিশুহারা মাতাপিতার অভিশাপের এই মিছিল, 
এই মিছিল সব হারায় সব পাওয়ার এই মিছিল।"



(ঋণঃ সলিল চৌধুরী)


রাজ্যজুড়ে নারী নির্যাতন, ধর্ষণ এবং প্রশাসন ও শাসকদলের কর্তাদের পক্ষ থেকে অপরাধীদের আড়াল করার চেষ্টার প্রতিবাদে ২০১৩ সালের ২১শে জুন কলকাতায় যেঁ মহামিছিল হয়েছিল সেই প্রসঙ্গেই এই লেখা। প্রথম প্রকাশঃ চর্যাপদ

Saturday 1 June 2013

একশো বছরে সন্দেশ


আমাদের বাড়িতে পিওন চিঠি বিলি করতে আসত বিকেল চারটের সময়। আমি স্কুল থেকে ফিরতাম মোটামুটি সাড়ে চারটেয় আর স্কুল থেকে ফিরে প্রথম কাজটাই ছিল কি কি চিঠি এসেছে খোঁজ করা, বিশেষ করে মাসের প্রথমদিকে। রোজই বাবার নামে প্রচুর চিঠিপত্র আসত, সেসব হাঁটকে আমি খুঁজতাম একটা দুভাঁজ করা পত্রিকা, গায়ে জড়ানো একফালি ব্রাউন কাগজ, যাতে লেখা থাকত, "অতনু কুমার, গ্রাহক সংখ্যা ৩৫০০, প্রযত্নে..."। বলা বাহুল্য বেশীরভাগ দিনই নিরাশ হতে হত; কখনও কখনও দুমাস বা তিনমাস অপেক্ষার পর তার দেখা পেতাম, যদিও মলাটের ওপর জ্বলজ্বল করত "ছোটদের সেরা মাসিকপত্র"। পুজোসংখ্যাটা আসত রেজিস্ট্রি ডাকে, সই করে নিতে হত। "বিশেষ সংখ্যা রেজিস্ট্রি ডাকে, সাধারণ সংখ্যা সাধারণ ডাকে", গ্রাহক চাঁদা ১৮০ টাকা। মেজপিসি আমাদের বাড়ির আরো অন্য অনেকের সঙ্গে প্রথমে দাদাকে, পরে আমাকে "সন্দেশে"র গ্রাহক করে দিয়েছিল। সেই শুরু, তারপর আর সন্দেশকে ছাড়তে পারিনি। এখন অবশ্য আর গ্রাহক নই, কিন্তু যাতায়াতের পথে স্টেশনের বুকস্টলটায় খেয়াল রাখি, নতুন সন্দেশ এলেই যাতে তুলে নেওয়া যায়, আর কোন সংখ্যা মিস হলে বইমেলার স্টল থেকে নিয়ে নিই। সেই সন্দেশ আজ একশো বছর পূর্ণ করল। এই অবকাশে ধূলো ঝেড়ে পুরনো সন্দেশ ঘাঁটতে বসলাম। কেননা পুরনো সন্দেশ তো নতুনের চেয়েও মিষ্টি! 


আজ থেকে দেড়শো বছর আগে, রবীন্দ্রনাথের চেয়ে ২ বছরের ছোট  কামদারঞ্জন রায়ের জন্ম হয় ময়মনসিংহের মসুয়া গ্রামে। ময়মনসিংহেরই জমিদার হরিকিশোর রায়চৌধুরী তাঁকে দত্তক নিয়ে নতুন নাম দেন উপেন্দ্রকিশোর। এন্ট্রান্স পাস করে তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়তে কলকাতায় আসেন। সেই সময়ের কলকাতা ছিল চাঁদের হাট, বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র, গিরিশ ঘোষরা তখনও বিদায় নেননি, তার সঙ্গে উঠে আসছেন নতুন তারকারা, রবীন্দ্রনাথ, জগদীশচন্দ্র, প্রফুল্লচন্দ্র, আরো কতজন। গ্রামে থাকতেই বোঝা গিয়েছিল উপেন্দ্রকিশোর সাধারণ ছেলে নন, কিন্তু কলকাতার আবহাওয়া তাঁর প্রতিভার পূর্ণ বিকাশের রাস্তা খুলে দেয়। একদিকে "সখা", "মুকুল" প্রভৃতি ছোটদের পত্রিকায় লেখা, আঁকা, অন্যদিকে ব্রাহ্ম আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ, ব্রাহ্মসঙ্গীত লেখা ও সুর দেওয়া - অচিরেই বাংলার নবজাগরণের অন্যতম চরিত্র হয়ে উঠলেন উপেন্দ্রকিশোর। শুধু শিল্প-সঙ্গীতে নয়, তাঁর সমান আগ্রহ ছিল বিজ্ঞান ও কারিগরি বিদ্যায়, বিশেষতঃ মুদ্রণশিল্প ও ফটোগ্রাফিতে। যোগীন্দ্রনাথ সরকারের সিটি বুক স্যোসাইটি থেকে প্রকাশিত "ছেলেদের মহাভারত" আর "ছেলেদের রামায়ণ" বইদুটোতে তাঁর নিজের আঁকা ছবিগুলোর দুর্দশা দেখে তিনি ঠিক করলেন নিজেই মুদ্রণ প্রযুক্তি নিয়ে চর্চা করবেন। লন্ডনের "পেনরোজ অ্যান্ড কোম্পানি" থেকে আধুনিক যন্ত্রপাতি নিয়ে এসে সুকিয়া স্ট্রীটের বাড়িতে "ইউ রায় আন্ড সন্স" নামে ছাপাখানা খুললেন। "হাফটোন ফটোগ্রাফি ও প্রিন্ট" নিয়ে গবেষণা চালিয়ে শুধু পদ্ধতিটার উন্নতি করলেন তাই নয়, এবিষয়ে সুনির্দিষ্ট বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব তুলে ধরলেন, যা এতদিন ছিল না।[১-৩]
     ১৩২০ সনের (১৯১৩ সাল) পয়লা বৈশাখ ইউ রায় আন্ড সন্স থেকেই প্রকাশিত হয় "ছেলেমেয়েদের সচিত্র মাসিকপত্র" সন্দেশের প্রথম সংখ্যা। সম্পাদক উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী, বি-এ। প্রথম পৃষ্ঠাতে সন্দেশের আগমনবার্তা জানিয়ে জ্যোতির্ময়ী দেবী লেখেন,
"নূতন বরষে ভাই আমাদের ঘরে,
সন্দেশ এসেছে আজ নব সাজ প'রে।
ডাকিয়া লইব তারে আদরে সবাই,
হাসিমুখে ত্বরা করে আয় তোরা ভাই।..."
"সন্দেশের কথা"য় বলা হয়েছিল, 
"... আমরা যে সন্দেশ খাই, তাহার দুটি গুণ আছে। উহা খাইতে ভাল লাগে আর উহাতে শরীরে বল হয়। আমাদের এই যে পত্রিকাখানি 'সন্দেশ ' নাম লইয়া আজ সকলের নিকট উপস্থিত হইতেছে, ইহাতেও যদি এই দুটি গুণ থাকে, -অর্থাৎ ইহা পড়িয়া সকলের ভাল লাগে আর কিছু উপকার হয় তবেই ইহার 'সন্দেশ' নাম সার্থক হইবে।" 
সেই অনুযায়ী ছড়া, কবিতা, পুরাণ ও  দেশবিদেশের গল্প, অনুবাদ, বিজ্ঞান, মহাকাশের কথা, জীনজন্তু, ভ্রমণকাহিনী, মনিষীদের জীবনকথা, ধাঁধা ইত্যাদিতে ভরে উঠল সন্দেশের পাতা। "সংবাদ" শিরোনামে পৃথিবীর নানা মজার ঘটনার খবর থাকত।  আর ছিল  রঙিন ও সাদাকালো প্রচুর ছবি। খগেন্দ্রনাথ মিত্র লিখেছেন,
 "...'সন্দেশে'র" বিষয়বস্তুতে নতুনত্ব ছিল না। ... কিন্তু রচনায়, পরিবেশনে, সাজসজ্জায়, ছাপায় 'সন্দেশ' ছিল অতুলনীয়। ছবিগুলি সূক্ষ্মরেখায় অঙ্কিত  হত যা পূর্বের ছবিগুলিতে দেখা যায় না। বিজ্ঞান, রসসাহিত্য ও চিত্রশিল্প - এই তিন মিলিয়ে নিপুণ হাতে 'সন্দেশ' তৈরী হত। ..." [৪] 
রায়পরিবারের সদস্যদের লেখায় লেখকের নাম থাকত না। অন্যান্য লেখকদের মধ্যে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, শিবনাথ শাস্ত্রী, প্রিয়ম্বদা দেবী, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কালিদাস রায়, অতুলপ্রসাদ সেন, প্রমথ চৌধুরী প্রমুখ। বেশীরভাগ লেখা ও আঁকা ছিল উপেন্দ্রকিশোরের। সন্দেশ প্রকাশের কয়েকমাস পরেই দেশে ফেরেন সুকুমার। তাঁর "আবোল তাবোল" ও অন্যান্য লেখা, ছবিসমেত সন্দেশেই প্রথম বেরোয়। জরীপের কাজে বন-জঙ্গলে ঘোরার সুবাদে রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার গল্প নিয়ে ধারাবাহিকভাবে ছাপা হত প্রমদারঞ্জন রায়ের "বনের খবর"।

 
দ্বিতীয় সংখ্যায় ইংল্যান্ডের রাজা পঞ্চম জর্জের জন্মদিন উপলক্ষে লেখা হয়, "ভগবানের নিকট প্রার্থনা করি , আমাদের প্রিয় সম্রাট দীর্ঘজীবী হইয়া আরো অনেক বৎসর সুখে রাজ্য ভোগ করুন" বাঙালী জর্জসাহেবকে "প্রিয় সম্রাট" বলে আহ্লাদ করত কি না সে বিষয়ে অবশ্য সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। এই বাঙালীদের বেআদবীতে অতিষ্ঠ হয়েই তো জর্জসাহেবের পেয়াদারা বছর আষ্টেক আগে দেশটাকে টুকরো করার চেষ্টা করেছিল, মাত্র দুবছর আগে তারা রণে ভঙ্গ দেয়। ইতিমধ্যে কিংসফোর্ডকে মারতে গিয়ে প্রাণ দিয়েছেন ক্ষুদিরাম, প্রফুল্ল চাকী, আলিপুর বোমা মামলায় কানাইলাল দত্তের ফাঁসি হয়েছে। বছর দুয়েক বাদেই বুড়িবালামের যুদ্ধে শহীদ হবেন বাঘাযতীন। কিন্ত তৎকালীন বাংলার নবজাগরণের প্রাণপুরূষরা অনেকেই ব্রিটিশ শাসনকে ভারতের পক্ষে আশীর্বাদস্বরূপ মনে করতেন। এমনকি জর্জসাহেব ভারতে এলে, তাকে প্রশস্তি করে গান গাওয়া হয় জাতীয় কংগ্রেসের কলকাতা অধিবেশনে। তাই সন্দেশের পাতায় এহেন রাজবন্দনায় খারাপ লাগলেও অবাক হবার কিছু নেই।
সন্দেশের আড়াই বছর বয়সে উপেন্দ্রকিশোরের মৃত্যুর পর "ইউ রায় অ্যান্ড সন্স" এবং সন্দেশের দায়িত্ব নেন সুকুমার। সুকুমারের হাতে পড়ে সন্দেশের চরিত্র খানিকটা বদলে যায়। 
"উপেন্দ্রকিশোর বিশেষ করে যে বয়সের পাঠকদের কথা চিন্তা করতেন, গড়ে তারা বড়জোর ১০/১২ বছরের বালক। কিন্ত সুকুমারের সম্পাদনায় ওই বয়সের ছেলেমেয়েদের পাঠ্য যথেষ্ট থাকলেও ১৫/১৬ বছরের পাঠকরাও প্রচুর চিন্তার খোরাক পেত।" [২] 
১৯২৩ সালে মাত্র ছত্রিশ বছরে মৃত্যুর আগে পৌনে আট বছর সন্দেশের সম্পাদনা করেছেন সুকুমার। সুকুমার রায় কে নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। বাঙালী যতদিন থাকবে, সুকুমার পুরানো হবেন না। আবোল তাবোল, খাই খাই, হযবরল ছাড়াও অজস্র ছোটগল্প, কবিতা, নাটক, জীবনকথা, বিজ্ঞান রচনা, ধাঁধা তিনি সন্দেশে লিখেছেন এই কটা বছরে। প্রায় সমস্ত ছবিই তিনিই আঁকতেন। সম্পাদনার কাজে তাঁকে সাহায্য করতেন বিশেষ করে কাকা কুলদারঞ্জন ও ভাই সুবিনয়। তাছাড়া অন্য পাঁচ ভাইবোন সুখলতা, পুণ্যলতা, সুবিমল আর শান্তিলতাও নিয়মিত লিখতেন সন্দেশে। এই সময়ে সম্পাদক ছাড়া সকলের লেখাতেই নাম ছাপা হত। সুকুমারের মৃত্যুর পর সুবিনয় রায় সম্পাদক হলেন।
 "সুবিনয় রায়ের সম্পাদনায় সন্দেশে আরো বেশী সংখ্যক বিজ্ঞান ও প্রকৃতি বিজ্ঞানের সরস সচিত্র প্রবন্ধ পাওয়া গেল। এই সময়ে প্রকাশিত ধাঁধা আর প্রতিযোগিতাগুলি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তবু এই সার্থকনামা সন্দেশ পত্রিকার প্রকাশ বন্ধ করে দিতে হল। কারণ ব্যবসায়িক কারণে ইউ রায় অ্যান্ড সন্স নামে বিখ্যাত প্রকাশনা সংস্থা  বন্ধ হয়ে গেল।"[৫]

   
সন্দেশ উঠে যাওয়াতে লেখক ও পাঠকরা খুবই দুঃখিত হয়েছিলেন আর সম্ভবতঃ সেটা বুঝতে পেরেই "ইউ রায় অ্যান্ড সন্সের" নতুন মালিকরা সন্দেশ আবার বের করার সিদ্ধান্ত নেন। পাঁচ বছর বন্ধ থাকার পর সুবিনয় রায়ের সঙ্গে সুধাবিন্দু বিশ্বাসের যুগ্ম সম্পাদনায় নবপর্যায়ের সন্দেশের প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয় ১৩৩৮ সনের (১৯৩১ সাল) আশ্বিন মাসে। উপেন্দ্রকিশোরের সন্দেশের অনুরাগী পাঠক ছিলেন কবি সুনির্মল বসু। নতুন সন্দেশের প্রথম পাতার কবিতাটা তিনিই লিখলেনঃ
"সন্দেশ এলো ফের, --মন খুশি খবরে--
সেই চিরপুরাতন--তবু অভিনব রে!
  সন্দেশ, সন্দেশ,--
ছিলি তুই কোন্ দেশ ?
এ যে রে মোহন বেশ
দেখি ফের তব রে !-- "
সত্যজিৎ রায় লিখছেন,  
"বাবা মারা যাবার পর বছর দুয়েকের মধ্যেই সন্দেশ উঠে যায়। তখনও আমার সন্দেশ পড়ার বয়স হয়নি। টাটকা বেরোনোর সঙ্গে সঙ্গে হাতে নিয়ে পড়ার অভিজ্ঞতা হল এই দ্বিতীয় পর্বে। মলাটে তিনরঙা ছবি, হাতি দাঁড়িয়ে আছে দু'পায়ে, শুঁড়ে ব্যালান্স করা সন্দেশের হাঁড়ি। এই সন্দেশেই ধারাবাহিকভাবে প্রথম সংখ্যা থেকে বেরোয় রবীন্দ্রনাথের 'সে', আর এই সন্দেশেই প্রথম গল্প লিখলেন লীলা মজুমদার। ওনার গল্পের সঙ্গে মজার ছবিগুলো উনি তখন নিজেই আঁকতেন। অন্য আঁকিয়েদের মধ্যে ছিলেন এখনকার নামকরা শৈল চক্রবর্তী, যাঁর হাতেখড়ি সম্ভবত হয় এই সন্দেশেই।"[৬] 
এখানে একটা কথা বলে রাখা ভালো, লীলা মজুমদারের (তখন রায়) প্রথম গল্প "লক্ষ্মী ছেলে" বেরিয়েছিল প্রথম পর্যায়ের সন্দেশে, তাঁর বড়দা সুকুমারের উৎসাহে। কিন্তু এই গল্পটি লেখিকার পছন্দ হয়নি বলে তিনি এটি কোন বইতে অন্তর্ভূক্ত করেননি। নবপর্যায়ের সন্দেশে রায়চৌধুরী পরিবারের ওপর নির্ভরতা অনেকটাই কমে গেল, লেখার বৈচিত্র্য বাড়ল এবং সন্দেশ ক্রমশ কিশোরদের পত্রিকা হয়ে উঠল। দুই সম্পাদক ছাড়া রবীন্দ্রনাথ, প্রিয়ম্বদা দেবী, সুনির্মল বসু, দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার, বন্দে আলি মিঞা, ক্ষিতীন্দ্রনারায়ণ ভট্টাচার্য্য, ননীগোপাল মজুমদার, শিবরাম চক্রবর্তী ও আরো অনেক লেখক-লেখিকা এই পর্যায়ে লিখেছেন। গ্রাহকদের পাঠানো নির্বাচিত লেখাও ছাপা হত। ধাঁধার উত্তর যাঁরা পাঠাতেন তাদের নাম, ঠিকানাসহ ছাপা হত পরের সংখ্যায়। এই নামের তালিকায় লক্ষ্য করলে দেখা যাবে সন্দেশের পাঠকরা ছড়িয়ে ছিল কলকাতা, ভাটপাড়া, কৃষ্ণনগর থেকে শুরু করে ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম, রাঁচী, ভাগলপুর, দিল্লী, শ্রীনগর পর্যন্ত। কিন্তু বেশীদিন সন্দেশ চালানো গেল না। চার বছর পর সন্দেশ আবার ঝাঁপ বন্ধ করল। শেষ দেড় বছর (বৈশাখ ১৩৪১-ভাদ্র ১৩৪২) সম্পাদক ছিলেন এককভাবে সুধাবিন্দু বিশ্বাস।
    
এরপরের সন্দেশ জানতে হলে লাফ দিয়ে পেরোতে হবে আঠাশটা বছর। মাঝখানে বাঙলা তথা পৃথিবীর ইতিহাস-ভূগোল ওলোট-পালোট হয়ে গেছে। ফ্যাসিবাদের উত্থান ও পতন, মহামারী, দাঙ্গা, দেশভাগের বিনিময়ে বহুপ্রতীক্ষিত স্বাধীনতা আর তার ধাক্কায় অগণিত মানুষের ভিটেমাটি ত্যাগ করে অজানা ভবিষ্যতের পথে যাত্রা। স্বাধীন দেশে খাদ্য চাইতে শহরে আসা মানুষকে মরতে হল লাঠির বাড়ি খেয়ে। হয়তো পথের ক্লান্তি কাটাতেই এক মার্কসবাদী কবি, তাঁর শিল্পী বন্ধুর কাছে সন্দেশ আবার বের করার প্রস্তাব দিলেন। সুকুমার রায়ের পুত্র এই শিল্পীবন্ধুটি তখন কমার্সিয়াল আর্টিস্টের কাজ ছেড়ে সিনেমা তৈরীতে নেমে পড়েছেন। বাংলা সাহিত্যের গোটাপাঁচেক মাস্টারপিসকে পর্দায় নামানোর পর রবীন্দ্রজন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে একটা তথ্যচিত্র আর তিনটে গল্প নিয়ে একটা কাহিনীচিত্র বানাতে ব্যস্ত। দায়িত্বগ্রহণে দ্বিধা থাকলেও মায়ের উৎসাহে রাজি হয়ে গেলেন। 
"ইউ রায় অ্যান্ড কোম্পানির স্বত্ব যাঁরা কিনেছিলেন-তাঁদের খুঁজে বার করা হল।তাঁদের কাছ থেকে 'সন্দেশ' প্রকাশের অনুমতি সংগ্রহ করা গেল। তবু নতুন এক বিপত্তি দেখা দিল। সন্দেশ পত্রিকার নাম স্বত্ব সংগ্রহ করেছিলেন হাওড়া জেলার তারাপদ সাঁতরা। ... তাঁর 'সন্দেশ' নামের সাপ্তাহিক পত্রিকায় শ্রমিক আন্দোলন বিষয়ে নিবন্ধ ও সংবাদ প্রকাশিত হত। ... সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে পুরনো রাজনৈতিক যোগাযোগের সুবাদে সহজে তাঁর কাছে পৌঁছানো গেল। ... ১৭২ নং ধর্মতলা স্ট্রিট (লেনিন সরণি)-এর দোতলায় অফিস ঘর ভাড়া নেওয়া হল। সম্পাদক হলেন সত্যজিৎ রায় ও সুভাষ মুখোপাধ্যায়। বিজ্ঞাপন দিয়ে গ্রাহক সংগ্রহ শুরু হয়ে গেল। ১৩৬৮র বৈশাখ (১৯৬১-র মে) মাসে এ বারের (তৃতীয় পর্যায়ের) সন্দেশের প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হল।"[৭]

সুভাষ মুখোপাধ্যায় অবশ্য বেশীদিন থাকেননি। দুবছর পর তাঁর বদলে সম্পাদক হলেন লীলা মজুমদার। প্রকাশক অশোকানন্দ দাশ। সন্দেশ চালানোর জন্য গঠিত হল "সুকুমার সাহিত্য সমবায় সমিতি"। ১৩৮২তে লীলা মজুমদার, সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে সম্পাদক হিসেবে যোগ দিলেন নলিনী দাশ। অবশ্য সন্দেশের অফিস তাঁর রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়ের বাড়িতে উঠে যাওয়ার পর থেকেই তিনি সন্দেশের পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত হয়ে গিয়েছিলেন।



সত্যজিৎ রায় সন্দেশের পুনর্জন্ম দিয়েছিলেন এটা যেমন ঠিক, তেমনি এটাও ঠিক, যে সন্দেশই সত্যজিতের হাতে আবার কলম ধরিয়েছিল। কুড়ি বছর আগে অমৃতবাজার পত্রিকার রবিবারের পাতায় প্রকাশিত দুটো ইংরেজি গল্পের কথা বাদ দিলে বলতে হয় সন্দেশের জন্যই তিনি লিখতে শুরু করেছিলেন। প্রথমে লুই ক্যারল আর লিয়রের কিছু ননসেন্স ছড়া আর লিমেরিক অনুবাদ করার পর ষষ্ঠ সংখ্যাতেই হাজির করলেন প্রোফেসর শঙ্কুকে। তারপর পর পর দুটো ছোটগল্প "বঙ্কুবাবুর বন্ধু" আর "টেরোডাকটিলের ডিম"। তারপর আর থামেননি। ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি শুরু হয় ছ বছর পরে। পরবর্তীকালের বেস্টসেলার লেখাগুলোর বেশীরভাগই সন্দেশে প্রথম বেরিয়েছিল। তাছাড়াও অজস্র প্রবন্ধ, স্মৃতিকথা, কমিক স্ট্রীপ, পাদপূরণ, ধাঁধা, শব্দজব্দ ইত্যাদি ছড়িয়ে আছে সন্দেশের পাতায়, যা এখনো বই হয়ে বেরোয়নি। আর বাবা ও ঠাকুরদার ধারা বজায় রেখে প্রচ্ছদ ও বেশীরভাগ অলঙ্করণ, হেডপিসও সত্যজিৎ নিজেই করতেন।
আরেক সম্পাদক লীলা মজুমদার অবশ্য তখনই জনপ্রিয় লেখিকা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। সন্দেশের প্রথম সংখ্যাতে শুরু হয় তাঁর ধারাবাহিক উপন্যাস "টংলিং"। গল্প, প্রবন্ধ, নাটক, উপন্যাসের পাশাপাশি থাকত তাঁর অননুকরনীয় ভাষায় "গল্পস্বল্পে"র মজলিশ। সুবিনয় রায়ের আমলেও "গল্পস্বল্প" নামে একটা বিভাগ ছিল, কিন্তু সেখানে মূলতঃ দেশ-বিদেশের মজার মজার খবর থাকত। এবারের গল্পস্বল্পে আড্ডার মেজাজে গল্প শোনানোর পাশাপাশি পাঠকদের নানা সামাজিক বিষয়ে সচেতন করারও চেষ্টা থাকত। একটা উদাহরণ দিলেই বোঝা যাবে।  
"...সমান অধিকার মানেই সমান দায়িত্ব। বিয়ের সময় বরপক্ষের এটা চাই ওটা চাই যে একেবারে বেআইনী একথা তোরা ভালো করেই জানিস, তবু মেনে নিস কেন? লেখাপড়া শেখ, নিজের পায়ে দাঁড়াতে শেখ। নইলে পুরুষরা মেয়েদের যত অসম্মান করে, তোরা নিজেরা তার চেয়ে ঢের বেশী করিস।..."[৮]
  
অধ্যাপনা থেকে অবসর নেওয়ার পর সন্দেশের কাজেই নিজেকে নিয়োগ করেছিলেন নলিনী দাশ। সম্পাদনার পাশাপাশি প্রুফ দেখা থেকে শুরু করে বিজ্ঞাপন, মার্কেটিং, কার্যালয়ের দৈনন্দিন খুঁটিনাটি কাজ তিনিই সামলাতেন কর্মী ও স্বেচ্ছাসেবকদের সঙ্গে নিয়ে। আর লেখালিখি তো ছিলই। চারটে স্কুলের মেয়ের আডভেঞ্চার নিয়ে তাঁর গোয়েন্দা গণ্ডালু সিরিজ সন্দেশীদের মধ্যে অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল।


   সেই সময়কার প্রতিষ্ঠিত লেখকরা তো লিখতেনই, তার সঙ্গে বাংলা সাহিত্যের উঠতি প্রতিভাকে লালন করার দায়িত্বও নিল সন্দেশ। তিন সম্পাদকের হাতে তৈরী হয়েছিল শিশিরকুমার মজুমদার, অজেয় রায়, রেবন্ত গোস্বামী, গৌরী ধর্মপালের মত অনেক আশ্চর্য লেখক। "তৈরী হয়েছিল" কথাটা যে অতিরঞ্জন নয় তার প্রমাণ রাখা আছে তিন সম্পাদকের নিজেদের মধ্যে এবং লেখকদেরকে লেখা চিঠি ও চিরকুটের মধ্যে।[৯-১১] একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন পরিচালক আর একজন ব্যস্ততম লেখিকা এক একটা লেখার পিছনে যে সময় ও মনোযোগ দিতেন, লেখাটিকে সংশোধন ও পরিমার্জন করে বা কখনও কখনও লেখকদেরকেই ভুলগুলো ধরিয়ে দিয়ে নতুন করে লেখার নির্দেশ দিতেন, তা ধরা আছে এই সমস্ত চিঠিতে, যার বেশীরভাগই অবশ্য এখনো সামনে আসেনি। একই কথা প্রযোজ্য শিল্পীদের ক্ষেত্রেও। "নামী শিল্পীদের ছবি তাঁদের যোগ্য পারিশ্রমিক দিয়ে সন্দেশে ব্যবহার করা সম্ভব ছিলনা। এর ফলে নতুনদের জন্য সন্দেশকে সর্বদাই দরজা খোলা রাখতে হত এবং আজও হয়।"[১২] সন্দেশের হাত ধরে যে সমস্ত শিল্পী উঠে এসেছেন তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য দেবাশীষ দেব ও শিবশঙ্কর ভট্টাচার্য। তাছাড়া প্রশান্ত মুখোপাধ্যায়, সিদ্ধার্থ মুখোপাধ্যায়, সুবীর রায় সন্দেশে প্রচুর অলংকরণ করেছেন। আর ছিলেন প্রসাদ রায়, ময়ূখ চৌধুরী নামে যিনি রোমাঞ্চকর ঐতিহাসিক ও অ্যাডভেঞ্চার কমিকস আঁকতেন।

তিন সম্পাদক কিভাবে কাজ করতেন তার একটা সুন্দর বর্ণনা দিয়েছেন রাহুল মজুমদার, "লেখা জমা পড়লে সেটাকে নথিভুক্ত করার পর সব লেখা প্রথম পড়তেন নলিনীদি। উনি দেখতেন লেখাটা সন্দেশের আদর্শ আর মানের উপযুক্ত হল কিনা। প্রাথমিক বাছাইয়ের পর সেই লেখাগুলো বিষয় অনুযায়ী ভাগ করে পাঠিয়ে দিতেন বিভিন্ন বিষয়ের বিশেষজ্ঞ সন্দেশীর কাছে। তাঁরা মন্তব্য আর প্রয়োজনীয় পরামর্শ লিখে ফেরৎ পাঠাতেন নলিনীদির কাছে। এরপর উনি বাছাই করা লেখাগুলো পাঠিয়ে দিতেন লীলাদির কাছে। লীলাদি মূলতঃ বিচার করতেন লেখার রস। দ্বিতীয় বাছাইয়ের পর লেখাগুলো আবার আসত নলিনীদির কাছে। এবার ভরতদা বা অশোকের হাত দিয়ে সেগুলো চলে যেত নলিনীদির ভাষায় বড় সম্পাদক অর্থাৎ সত্যজিৎ রায়ের কাছে চূড়ান্ত মনোনয়নের জন্য। তিনি মান, রস ছাড়াও দেখতেন লেখার কারিগরি বা টেকনিকাল দিকটাও। এতগুলো ছাঁকনির ভিতর দিয়ে ছেঁকে বেরিয়ে আসা লেখাগুলোর গুণগত মান সম্পর্কে কারও আর কোনও সন্দেহ থাকত না।" [১৩]
অন্যান্য পত্রিকার মতই সন্দেশে থাকত বেশ কিছু নিয়মিত বিভাগ যেমন বই চেনো, পত্রবন্ধু হতে চাই, বুনো রামনাথের দপ্তর, খেলাধুলা, বিজ্ঞানের আসর, হাত পাকাবার আসর, প্রকৃতি পড়ুয়ার দপ্তর ইত্যাদি। শেষোক্ত বিভাগটি ছিল
অভিনব। সত্যজিৎ রায় ও সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের উৎসাহে এবং বিজ্ঞানী গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য ও সত্যেন্দ্রনাথ বসুর পরামর্শে গড়ে ওঠা এই প্রকৃতি পড়ুয়ার দপ্তরের উদ্দেশ্য ছিল প্রকৃতিকে জানা, বোঝা ও ভালবাসা এবং তা বই পড়ে নয়, মাঠে ঘাটে ঘুরে। জীবন সর্দারের নেতৃত্বে প্রকৃতি পড়ুয়ারা মাসে একদিন সন্দেশের কার্যালয়ে পাঠশালায় বসত, অভিযানেও বেরোত।[১৪] হাত পাকাবার আসরে ১৭ বছরের কমবয়সী গ্রাহক-গ্রাহিকাদের লেখা ও আঁকা ছাপা হত এবং সংখ্যায় অনেক কমে গেলেও এখনও হয়।
সন্দেশের সম্পাদক থেকে শুরু করে লেখক, শিল্পী, গ্রাহক, এমনকি কার্যালয়ের কর্মীরা নিজেদের এক বিরাট পরিবারের অংশ বলে মনে করে। তারা নিজেদের নাম দিয়েছেন সন্দেশী। সন্দেশের প্রতি তাঁদের আবেগ আর ভালোবাসা তা বাইরের কারো পক্ষে অনুভব করা সম্ভব নয়। এই ভালোবাসার টানেই কঠিন আর্থিক সঙ্কটেও সন্দেশ বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি পরিচালকরা। প্রতিবছর সন্দেশীদের অনুষ্ঠান বা পৌষমেলা, কলকাতা বইমেলায় অংশগ্রহণের বিবরণ পড়লে খানিকটা বোঝা যায় সেই আবেগের চরিত্র।[১৫,১৬]
    নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিকে একের পর এক ইন্দ্রপতনে বিপর্যস্ত হল সন্দেশ। একে একে বিদায় নিলেন অশোকানন্দ দাশ, সত্যজিৎ রায়, নলিনী দাশ, শিশিরকুমার মজুমদার। অসুস্থতার জন্য দৈনন্দিন সম্পাদনার কাজ থেকে অবসর নিলেন লীলা মজুমদার। আমি যখন সন্দেশ পড়তে শুরু করি তখনও সম্পাদক হিসেবে ছাপা হত লীলা মজুমদার ও বিজয়া রায়ের নাম। কিন্তু ব্যাটনটা তখন চলে গেছে পরবর্তী প্রজন্ম অর্থাৎ সন্দীপ রায়, রেবন্ত গোস্বামী, প্রণব মুখোপাধ্যায়, জীবন সর্দারদের হাতে। প্রকাশকের দায়িত্ব নিয়েছেন অমিতানন্দ দাশ। উপরোক্ত পরিচালকরা ছাড়া নিয়মিত লেখক ও শিল্পীদের মধ্যে ছিলেন সলিল চট্টোপাধ্যায়, ভবানীপ্রসাদ মজুমদার, অরুণিমা রায়চৌধুরী, প্রসাদরঞ্জন রায়, হর্ষমোহন চট্টরাজ, পার্থ দাশ প্রমুখ। দেবাশিস সেনের খেলার গল্প আর অরুণিমা রায়চৌধুরীর রূপকথা খুব ভালো লাগত মনে আছে। গল্পস্বল্প লিখতেন সুজয় সোম ও রেবন্ত গোস্বামী। সুজয় সোম খানিকটা লীলা মজুমদার কে অনুসরণ করার চেষ্টা করলেও রেবন্ত গোস্বামী লিখতেন নিজস্ব ঢঙে। অমিতানন্দ দাশ লিখতেন বিজ্ঞানভিত্তিক লেখা আর খেলাধূলার দায়িত্বে ছিলেন বল বয়। ফেলুদা আর গুপী-বাঘার ছবিগুলোর চিত্রনাট্য ধারাবাহিকভাবে বেরিয়েছিল। পুরনো সন্দেশ থেকে প্রচুর লেখা থাকত। বেশীরভাগ সংখ্যায় সত্যজিৎ রায়ের আঁকা প্রচ্ছদগুলোই রঙ বদলে ব্যবহার করা হত, তবে মাঝে মাঝে সন্দীপ রায়ও প্রচ্ছদ আঁকতেন।  শারদীয়া সংখ্যায় বিখ্যাত লেখকরা লিখতেন, কিন্তু সাধারণ সংখ্যাগুলোয় লেখার মান পড়ে আসছিল। এর মধ্যে ফেলুদার ৩০ বছর, লীলা মজুমদারের ৯০ বছর আর আবোল তাবোলের ৭৫ বছর উপলক্ষ্যে বিশেষ সংখ্যাগুলো সুন্দর আর সংগ্রহযোগ্য হলেও খুব ছোটদের পক্ষে খানিকটা গুরুপাক হয়ে গিয়েছিল বলে মনে হয়।

হাত পাকাবার আসরটা তখনও বেশ জমজমাট ছিল। গল্প, কবিতা,
ছড়া, প্রবন্ধ, ভ্রমণ, এমনকি কমিকস পর্যন্ত আসত গ্রাহকদের কলম থেকে। যাদের লেখা ও আঁকা ভালো লাগত তাদের মধ্যে মনে পড়ছে হিমন মুখোপাধ্যায়, দীপাঞ্জন রায়, অন্তরীপ সেনগুপ্ত, তওফীক রিয়াজ, পরমা ঘোষ মজুমদার, শঙ্খশুভ্র মল্লিক আর রাকা দাশগুপ্তর নাম। একমাত্র শেষজনকে বাদ দিলে বাকিরা এখনও লেখালিখি চালিয়ে যাচ্ছে বলে জানিনা। এই লেখাটা তাদের কারো চোখে পড়লে সামনে এসে জানান দিতে অনুরোধ করছি। হিমনকে অবশ্য পাওয়া যাবে না, সে অনেকদূরে চলে গেছে। আর রাকা দাশগুপ্ত এখন বাংলা কবিতার জগতে অত্যন্ত পরিচিত একটা নাম। পাশাপাশি ছোটদের জন্য লেখালিখিও সমানতালে চালিয়ে যাচ্ছে সন্দেশ ও অন্যত্র।

এই সুযোগে নিজের ঢাকটা একটু পিটিয়ে নিই। ছোটবেলা থেকেই ডায়েরির পাতায় হিজিবিজি কাটতাম অন্য সকলের মত। সেরকমই একটা লেখা খামে ভরে সন্দেশের ঠিকানা লিখে একদিন ফেলে দিলাম লাল রঙের ডাকবাক্সে। তারপর হাত পাকাবার আসরে ছাপা হল "অভয়দাদুর বই"। গল্পটায় গুপিদা নামে একটা চরিত্র ছিল, যেটা আসলে কাঁচা হাতে করা টেনিদার কপি। তাতে কি! সেদিন নিজেকে মনে হয়েছিল একজন কেউকেটা, স্কুলে যাওয়ার সময় জামার কলারটা নামাতে ভুলে গেলাম। রাস্তায় মনে হল যেন সবাই আমার দিকেই দেখছে! পরে আরো গোটাতিনেক গল্প লিখেছি হাত পাকাবার আসরে, প্রতিবারই সন্দেশের পাতায় নিজের নাম দেখে একই রকম অনুভূতি হয়েছে।
উদার অর্থনীতি আর বিশ্বায়নের ধাক্কায় বাঙালী মধ্যবিত্তর রুচি ও সংস্কৃতি দ্রুত পাল্টে যেতে লাগল। কেরিয়ার সচেতনতা ও ইঁদুরদৌড় ছোটদের অবসর সময় অনেকটা কেড়ে নিল। যেটুকু ছিল তা দখল করতে এগিয়ে এল কেবল টিভি ও ইন্টারনেট। একদিকে পত্রিকা প্রকাশের খরচ ও ডাকমাশুল উর্ধমুখী হল, অন্যদিকে গ্রাহক সংখ্যা কমতে লাগল। এতসব প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই করার মত সাধ্য ও নেতৃত্ব সন্দেশের ছিলনা। এমন সময় টাকার থলি নিয়ে উদয় হল ফোর্ড ফাউন্ডেশন। সন্দেশকে ঢেলে সাজাতে উদ্যত হলেন সন্দীপ রায়।[১৭] দুবছর পর তাঁর সঙ্গে সম্পাদক হিসেবে যোগ দিলেন সুজয় সোম। ঝকঝকে ছাপা, তকতকে কাগজ, নামী দামী বুদ্ধিজীবিদের লেখা, কেরিয়ার ক্যাম্প, মনের কথা কই, মনে হল গৌরী সেন বুঝি বা সন্দেশে বিপ্লব আনল। নতুন স্লোগান উঠে এল, "বাঙালীর ছোটবেলা, চারপুরূষ ধরে"। কিন্তু হিসেব দাখিল করতে না পারায় টাকা পাঠানো বন্ধ করে দিল ফোর্ড ফাউন্ডেশন। আবার অথৈ জলে পড়ল সন্দেশ।[১৮,১৯]
    কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এটাই যে অনিয়মিত হয়ে পড়লেও সন্দেশ আর ঝাঁপ বন্ধ করেনি। শুধু তাই নয়, নতুন লেখকরা আবার উঠে আসছেন সন্দেশের পাতা থেকে। রাজেশ বসু, হিমাদ্রিকিশোর দাশগুপ্ত, অনন্যা দাশ, সুদীপ্ত দত্ত ও আরো অনেক লেখক-শিল্পীর কলরবে ভরে উঠছে সন্দেশের পাতা।
সুনির্মল বসু থেকে অনিতা অগ্নিহোত্রী হয়ে রাকা দাশগুপ্ত, পাঠক থেকে লেখক হয়ে ওঠার ট্রাডিশনও সমানে চলছে। যদিও এই সন্দেশের পাঠক কারা অর্থাৎ মোটামুটি ৮ থেকে ১৮ বছরের ছেলেমেয়েদের মধ্যে সন্দেশের চাহিদা কতটা তা নিয়ে প্রশ্নটা থেকেই যায়। কোথায় যেন পড়েছিলাম, "সন্দেশ আসলে ফিনিক্স পাখি, বারবার নিজের চিতার আগুন থেকে সে পুনর্জন্ম নেয়"। সেরা সন্দেশের ভূমিকায় লীলা মজুমদার লিখেছিলেন, 
"ছোটদের দেখাতে চাই এই জীবনটা কত ভালো। জানাতে চাই ব্রহ্মাণ্ডের কোথায় কি ঘটেছে, ঘটছে, ঘটতে যাচ্ছে। মানুষের মত মানুষ দেখাতে চাই। এমন মানুষ যারা ভালো কে ভাল আর মন্দকে মন্দ বলে। যারা দলাদলির বাইরে; যারা ঘৃণা করে শুধু মিথ্যাকে আর নিষ্ঠুরতাকে আর কুঁড়েমিকে। বাদ দেয় যত রাজ্যের ন্যাকামি আর ঢং। যারা বিশ্ব-প্রকৃতিকে তার ন্যায্য জায়গা দিতে প্রস্তুত। যাদের মন উদার। এত সবের সঙ্গে আমরা পাঠকদের খুশিও করতে চাই। খুশি করতে না পারলে আমাদের সব চেষ্টাই বৃথা।"[২০]
কোন গোরী সেন নয়, এই আদর্শ আর সন্দেশীদের মধ্যে অদৃশ্য ভালোবাসার সুতোটাই একশ বছর ধরে সন্দেশের প্রাণভোমরা। চিতার আগুনে আর সব পুড়ে গেলেও এগুলো পোড়ে না। বদলে যাওয়া দেশ ও সমাজের পটভূমিতে ফিনিক্স পাখির মত আবার উঠে দাঁড়ায় নতুন চেহারা নিয়ে।


তথ্যসূত্রঃ
[১] প্রেমেন্দ্র মিত্র, ভূমিকা, উপেন্দ্রকিশোর রচনাবলী, বঙ্গীয় সাক্ষরতা প্রকাশন
[২] লীলা মজুমদার, সুকুমার রায়, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি
[৩] দেবাশিস মুখোপাধ্যায়, মুদ্রণবিজ্ঞানী, আজকাল (রবিবাসরীয়, ১২ মে, ২০১৩)
[৪] খগেন্দ্রনাথ মিত্র, শতাব্দীর শিশু সাহিত্য, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি
[৫] নলিনী দাশ, সন্দেশ সম্পাদক সুবিনয় রায়, সন্দেশ (অগ্রহায়ণ ১৩৯৮)
[৬] সত্যজিৎ রায়, যখন ছোট ছিলাম, আনন্দ পাবলিশার্স
[৭] অশোককুমার মিত্র, এবারের সন্দেশ, সন্দেশ (বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ ১৪০৮)
[৮] লীলা মজুমদার, গল্পস্বল্প, সন্দেশ (জ্যৈষ্ঠ ১৩৯৮)
[৯] নলিনী দাশ, সন্দেশ সম্পাদক সত্যজিৎ রায়, সন্দেশ (সত্যজিৎ স্মরণ সংখ্যা, শ্রাবণ ১৩৯৯)
[১০] অজেয় রায় কে লেখা সত্যজিৎ রায়ের চিঠি, দেশ (শারদীয়া ১৪১৯)
[১১] লীলা মজুমদার, পত্রমালা, লালমাটি
[১২] দেবাশীষ দেব, সন্দেশের অলঙ্করণ, সন্দেশ (বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ ১৪০৮)
[১৩] রাহুল মজুমদার, সন্দেশের সেরা সম্পদ নলিনীদি, সন্দেশ (বৈশাখ-শ্রাবণ ১৪১৮)
[১৪] জীবন সর্দার, জবানবন্দী, সন্দেশ (বৈশাখ-জৈষ্ঠ ১৪০৩)
[১৫] সুজয় সোম, ফালতু খাতা, সন্দেশ (শারদীয়া ১৪১২)
[১৬] দেবাশিস সেন, সবার চেয়ে আলাদা, সন্দেশ (বৈশাখ-শ্রাবণ ১৪১৮)
[১৭] Labonita Ghosh, Legendary children magazine Sandesh goes in for a new look to revive old glory, India Today (June 23, 2003)
[১৮] Kalyan Moitra, Bitter days ahead of 'Sandesh', Times of India (Aug 30, 2006)
[১৯] Children’s treat in autumn, The Telegraph (October 14, 2007)
[২০] লীলা মজুমদার, ভূমিকা, সেরা সন্দেশ, আনন্দ পাবলিশার্স
এছাড়াও সন্দেশের শতবর্ষ ও উপেন্দ্রকিশোরের সার্ধশতবর্ষ উপলক্ষে বিভিন্ন খবরের কাগজের প্রতিবেদন ও সন্দেশের নানা পুরনো সংখ্যার সাহায্য নিয়েছি। উপেন্দ্রকিশোরের সন্দেশ বছর অনুযায়ী খণ্ডে খণ্ডে প্রকাশ করেছে পারুল প্রকাশনী। সুকুমার ও সুবিনয়ের সন্দেশের অনেকগুলো সংখ্যা জোগাড় করেছি ইন্টারনেট থেকে। যিনি বা যাঁরা এগুলো আপলোড করেছেন তাঁদেরকে অজস্র ধন্যবাদ। ছবি বেশীরভাগই ইন্টারনেট থেকে নেওয়া, বাকিগুলো নিজের সংগ্রহ থেকে স্ক্যান করেছি।  সত্যজিৎ রায়ের আঁকা প্রচ্ছদগুলো পেয়েছি Satyajit Ray Film and Study Centre এর ওয়েবসাইট থেকে। হাত পাকাবার আসর আর প্রকৃতি পড়ুয়ার দপ্তরের সত্যজিৎ কৃত লোগোদুটো নিয়েছি সন্দেশের ফেসবুক পেজ থেকে আর বৈশাখ ১৪২০ সংখ্যার প্রচ্ছদটা (সুকুমার রায়ের আঁকা) পেয়েছি  শ্রীদেবাশিস সেনের ফেসবুক প্রোফাইল থেকে। গ্রাহক কার্ডটা পেয়েছি অরিজিৎ কুমারের কাছ থেকে।

 প্রথম প্রকাশঃ অবকাশ জন্মদিন সংখ্যা ১৪২০
পুনঃপ্রকাশঃ চর্যাপদ