Sunday 8 January 2017

অন্ধকারের রাজত্ব

কবি বলেছিলেন, "বিপুলা এ পৃথিবীর কতটুকু জানি?" প্রশ্নটা কোন জ্যোতির্বিদকে করা হলে তিনি জবাব দেবেন, "শতকরা পাঁচ ভাগ মাত্র"। তাঁর কাছে অবশ্য পৃথিবী মানে এই শস্য শ্যামলা বসুন্ধরা নয়; গ্রহ, নক্ষত্র, নীহারিকা, ছায়াপথ সম্বলিত এই বিপুল মহাবিশ্বই তাঁর জগৎ। সে যাই হোক, এই গভীর দার্শনিক প্রশ্নের জবাবে এমন নীরস গাণিতিক উত্তর নিশ্চয়ই কবির পছন্দ হবে না! যদিও তাঁর প্রশ্নের মধ্যেই স্পষ্ট নেতিবাচক উত্তর, কিন্তু একেবারে হিসেব কষে বলে দেওয়া পাঁচ ভাগ জানি আর পঁচানব্বই ভাগ জানি না! এটা কি বাড়াবাড়ি হয়ে গেল না? এ প্রশ্নের উত্তর পেতে ঘুরে আসা যাক ষাটের দশকের আমেরিকায়, ওয়াশিংটন ডিসির কার্নেগি ইনস্টিটিউশানে। সেখানে তখন বিভিন্ন ছায়াপথের মধ্যে তারাদের গতিবিধি নিয়ে গবেষণা করছেন এক তরুণী, ভেরা রুবিন।

ছোটবেলায় রুবিনকে জানলা দিয়ে হাঁ করে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে পেশায় ইলেকট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ার পিতা আনন্দ যেমন পেতেন তেমনি মাথায় চিন্তাও ঘুরত, মেয়েদের পক্ষে কি মহাকাশ নিয়ে পড়াশোনা করা সম্ভব! সংশয় সত্ত্বেও তিনি মেয়েকে একটা দূরবীন বানিয়ে দিয়েছিলেন এবং শখের জ্যোতির্বিদদের সম্মেলনে নিয়ে গেছিলেন। তাই রুবিনের পিতার মনোভাবকে দোষ দিলে আমরা ভুল করব যখন দেখব স্কুলের পাঠ শেষ করে রুবিন প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের দরজায় গিয়ে দাঁড়ালে সে দরজা এই কারণে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে যে "প্রিন্সটনে জ্যোতির্বিজ্ঞান পড়ার জন্য মেয়েদের নেওয়া হয় না!" এই নিয়ম প্রিন্সটনে ১৯৭৫ সাল অবধি চালু ছিল! শেষ অবধি রুবিন কর্ণেল ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হলেন এবং সেখান থেকে স্নাতক হয়ে জর্জ গ্যামোর অধীনে গবেষণা শুরু করলেন। পিএইচডি করে তিনি কার্নেগি ইনস্টিটিউশানে গিয়ে জুটি বাঁধলেন আরেক জ্যোতির্বিদ কেন্ট ফোর্ডের সঙ্গে। ফোর্ড তখন মহাকাশের কাণ্ডকারখানা দেখার জন্য অতি সূক্ষ্ম স্পেক্ট্রোমিটার (যা দিয়ে আলোর বর্ণালী বিশ্লেষণ করা হয়) তৈরীর কাজে ব্যস্ত।

গ্যালাক্সি বা ছায়াপথ ছায়াপথ তৈরী হয় অজস্র গ্রহ, নক্ষত্র, নক্ষত্রের মৃতদেহ, মহাজাগতিক ধূলো ইত্যাদি নিয়ে। এক একটা ছায়াপথে কয়েকশো কোটি থেকে কয়েক লক্ষ কোটি নক্ষত্র থাকে! ছায়াপথ গুলো সাধারণত চাকতি বা সর্পিল আকৃতির হয়। মধ্যাকর্ষণ টানের কারণে বেশীরভাগ তারা কেন্দ্রের দিকে থাকে, বাইরের দিকে নক্ষত্রের সংখ্যা অনেক কম। সৌরজগতে যেমন সূর্যকে কেন্দ্র করে গ্রহগুলো প্রদক্ষিণ করে, ছায়াপথের কেন্দ্রের চারদিকে ঠিক তেমনি ভাবে নক্ষত্র গুলো সপরিবারে পরিক্রমণ করে। সৌরজগতের ক্ষেত্রে আমরা দেখি গ্রহগুলো সূর্য থেকে যত দূরে রয়েছে, তারা তত আস্তে ঘুরছে। যেমন সূর্যের সবচেয়ে কাছের গ্রহ হল বুধ। একবার সূর্যকে পাক খেতে বুধের সময় লাগে পৃথিবীর হিসেবে মাত্র ৮৮ দিন। অন্যদিকে সবচেয়ে দূরের গ্রহ প্লুটো, যাকে এখন বামন গ্রহ তকমা দেওয়া হয়েছে, সূর্য কে পাক খেতে ৯০ হাজার দিন লাগিয়ে দেয়। আর পৃথিবী বুধের তুলনায় দূরে কিন্তু প্লুটোর তুলনায় সূর্যের কাছে। তাই পৃথিবীর ১ বছর হয় ৩৬৫ দিনে। পরিক্রমণ বেগের দিকে তাকালে দেখবো যে বুধ, পৃথিবী ও প্লুটোর বেগ যথাক্রমে সেকেন্ডে ৪৭.৪, ২৯.৮ ও ৪.৭ কিলোমিটার। যেহেতু সৌরজগতে গ্রহসমূহের গতি এবং ছায়াপথে নক্ষত্রসমূহের গতি পরিচালিত হচ্ছে একই নিয়ম, অর্থাৎ ভারী কেন্দ্রীয় অঞ্চলের মহাকর্ষীয় টানের কারণে, তাই ছায়াপথেও যত কেন্দ্র থেকে বাইরের দিকে যাওয়া যাবে তত নক্ষত্রগুলোর বেগ কমতে থাকা উচিৎ। 

কিন্তু রুবিন ও ফোর্ড একটা অদ্ভুত ঘটনা দেখলেন। যতই ছায়াপথের কেন্দ্র ছেড়ে সীমানার দিকে যাওয়া হোক, নক্ষত্রগুলোর পরিক্রমণ বেগ প্রায় একই থেকে যাচ্ছে। ষাটটি পেঁচাল ছায়াপথকে তাঁরা পর্যবেক্ষণ করেন এবং প্রতিটার ক্ষেত্রেই একই ফলাফল মেলে অর্থাৎ কেন্দ্র থেকে দূরত্বের সঙ্গে নক্ষত্রদের পরিক্রমণ বেগের কোন পরিবর্তন নেই। এটা ঘটতে পারে যদি ছায়াপথের ভর কেন্দ্রীয় অঞ্চলে সন্নিবিষ্ট না হয়ে গোটা ছায়াপথ জুড়ে বিস্তৃত থাকে। কিন্তু এই ভর আমাদের চেনাজানা কোন পদার্থের হতে পারে না, তা যদি হত তাহলে তো তাদের দেখাই যেত! এই অজানা ভরের নাম দেওয়া হল ডার্ক ম্যাটার। নক্ষত্রদের পরিক্রমণ বেগের হিসেব করে রুবিন ও ফোর্ড দেখলেন একটা গ্যালাক্সির মোট ভরের প্রায় নব্বই শতাংশই হল এই ডার্ক ম্যাটার। মাত্র দশ শতাংশ ভর আমাদের পরিচিত প্রোটন, নিউট্রন ইত্যাদি দিয়ে তৈরী। 

ডার্ক ম্যাটারের কথা যে রুবিন রা-ই প্রথম বলেছিলেন তা নয়। তিরিশের দশকে ডাচ বিজ্ঞানী জন ওর্ট, যাঁকে ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি "বিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ জ্যোতির্বিদ" বলে আখ্যায়িত করেছে, আকাশগঙ্গা ছায়াপথে ডার্ক ম্যাটারের অস্তিত্ব শনাক্ত করেন। আকাশগঙ্গা ছায়াপথ নিয়ে গবেষণায় পথিকৃত ছিলেন ওর্ট। তাঁর অন্যতম অবদান আকাশগঙ্গা ছায়াপথে সৌরমণ্ডলের অবস্থান চিহ্নিত করা। এদিক দিয়ে তাঁকে আধুনিক কোপারনিকাস বলা যেতে পারে। কোপারনিকাস যেমন দেখিয়েছিলেন আমাদের পৃথিবী আদৌ সৌরজগতের কেন্দ্রে নেই, ওর্ট তেমনি প্রচলিত মত খারিজ করে দেখালেন গ্রহমণ্ডলী সমেত সূর্যের অবস্থান আকাশগঙ্গা ছায়াপথের কেন্দ্রে নয়, কেন্দ্র থেকে তিরিশ হাজার আলোকবর্ষ দূরে একটি অপাংক্তেয় জায়গায়! ওর্ট যখন নেদারল্যান্ডের লেইডেন ইউনিভার্সিটিতে আকাশগঙ্গা নিয়ে গবেষণা করছেন তখন আটলান্টিকের ওপারে ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজিতে দাপট দেখাচ্ছিলেন এক বদরাগী ও তক্কবাজ সুইস জ্যোতির্বিদ ফ্রিৎজ জুইকি। সহকর্মীরা তাঁকে বলত স্ফেরিকাল বাস্টার্ড! স্ফিয়ার অর্থাৎ একটা নিটোল গোলককে যেদিক থেকেই দেখি না কেন একইরকম দেখাবে, তেমনি জুইকি কে যেভাবেই দেখা হোক না কেন তিনি না কি একজন বাস্টার্ড! তো এই জুইকি কাজ করছিলেন কোমা ক্লাস্টার নিয়ে। অজস্র তারা নিয়ে যেমন গ্যালাক্সি তেমনি অজস্র গ্যাল্যাক্সি নিয়ে ক্লাস্টার। ক্লাস্টারের মধ্যে গ্যালাক্সি গুলো একই রকম ভাবে পাক খাচ্ছে। জুইকি দেখলেন ক্লাস্টারের বাইরের দিকের গ্যালাক্সিগুলো এত জোরে ছুটছে যেন এক্ষুণি ছিটকে বেরিয়ে যাবে। কিন্তু কোন অদৃশ্য টান তাদের ক্লাস্টারের মধ্যে ধরে রেখেছে। আমরা যদি একটা পাথরকে একটা সুতোর একপ্রান্তে বেঁধে অন্য প্রান্তটা হাতে নিয়ে বনবন করে ঘোরাই তাহলে বাইরের দিকে একটা টান অনুভব করব। সুতোটা পোক্ত না হলে ছিঁড়ে গিয়ে পাথরটা ছিটকে বেরিয়ে যাবে। সেরকমই ব্যাপার। জুইকি এটাও দেখালেন, যে অদৃশ্য ভর এই টান যোগাচ্ছে, তার অনুপাত ক্লাস্টারের মোট ভরের ৯০ শতাংশ! মাত্র ১০ শতাংশ হল দৃশ্যমান ভর। 

ডার্ক ম্যাটারের অস্তিত্ত্বের পক্ষে আরেকটা বড় প্রমাণ পাওয়া গেছে মহাকর্ষীয় লেন্স থেকে। আমরা স্কুলের বইতেই পড়েছি আলো সরলরেখায় চলে। কিন্তু চলার মাধ্যম পরিবর্তন হলে আলোকরশ্মি দিক পরিবর্তন করে। এই ঘটনাকে বলা হয় প্রতিসরণ এবং এটাকে কাজে লাগিয়েই লেন্স তৈরী হয়। আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতার তত্ত্ব থেকে জানা গেছিল আলোকরশ্মি কোন ভারী বস্তুর পাশ দিয়ে যাওয়ার সময়ও বেঁকে যায়। ধরা যাক কোন আলোক উৎস (যেমন একটা নক্ষত্র বা গ্যালাক্সি) আর আমাদের চোখের মাঝে তেমন কোন একটা ভারী মহাজাগতিক বস্তু এসে পড়ল। তখন আমরা সরাসরি নক্ষত্র বা গ্যালাক্সিটা কে না দেখে তাদের এক বা একাধিক বিকৃত প্রতিবিম্ব দেখব। এটাই হল মহাকর্ষীয় লেন্স। এখন ঐ মহাজাগতিক বস্তুটি যদি ডার্ক ম্যাটার দিয়ে তৈরী হয় তবে তাকে দেখা যাবে না বটে কিন্তু ভরের জন্য সে যে লেন্স তৈরী করবে তার ফলে অন্য উজ্জ্বল নক্ষত্র বা গ্যালাক্সির প্রতিবিম্ব দেখা যাবে। এইরকম অনেক ডার্ক ম্যাটার দিয়ে তৈরী মহাকর্ষীয় লেন্সের সন্ধান পাওয়া গেছে।

ডার্ক ম্যাটারের অস্তিত্ত্ব যখন সন্দেহাতীত তখন পরের প্রশ্ন হল এর চরিত্র আসলে কি? এই প্রশ্নের উত্তর এখনো পাওয়া না গেলেও এটা নিশ্চিত এরা অন্যান্য সাধারণ পদার্থের সঙ্গে মেলামেশা করে খুব কম। যে মানুষ সবার সঙ্গে মেলামেশা করে তার নাড়ি নক্ষত্র জানা সহজ। কিন্তু যে চুপচাপ একলা থাকে তাকে বোঝা ভারী কঠিন। বস্তুজগতের বেলাতেও একই নিয়ম খাটে। বস্তুজগতে মেলামেশার উপায় হল চার ধরণের বল - মহাকর্ষ (যার জন্য পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘোরে, আপেল মাটিতে পড়ে), তড়িৎচুম্বকীয় (যার কারণে ইলেকট্রন নিউক্লিয়াসের বাঁধনে আটকা পড়ে পরমাণু তৈরী করে, আমরা চোখে দেখি, রেডিও টিভি থেকে শুরু করে ফোন, এসএমএস, ইন্টারনেট এ বার্তা পাঠানো যায়), দৃঢ় (যা পরমাণুর নিউক্লিয়াসে প্রোটন ও নিউট্রনকে আটকে রাখে, পরমাণু শক্তি থেকে বিদ্যুৎ বা বোমা বানানো যায়) এবং মৃদু (যা তেজস্ক্রিয়তার জন্য দায়ী)। এর মধ্যে ডার্ক ম্যাটারের অস্তিত্ব জানা গেছে সাধারণ পদার্থের সাথে মহাকর্ষীয় আকর্ষণের কারণে। নক্ষত্র গুলোতে যে অবিরাম নিউক্লিয় সংযোজন বিক্রিয়া নক্ষত্রের জ্বালানী জোগায়, তা ডার্ক ম্যাটারে ঘটে না। ঘটলে তারা অদৃশ্য থাকত না। এখন নক্ষত্রের জ্বালানী ফুরিয়ে গেলে তারা নিজের মহাকর্ষের টানে চুপসে গিয়ে শ্বেত বামন, নিউট্রন স্টার বা ব্ল্যাক হোলে পরিণত হয়। এই জাতীয় নক্ষত্রের মৃতদেহগুলো সম্ভাব্য ডার্ক ম্যাটার হতে পারে। সেক্ষেত্রে ডার্ক ম্যাটারের উপাদান আমাদের চেনা জানা নিউট্রন, প্রোটনই হতে পারে। কিন্তু বিভিন্ন মহাজাগতিক পর্যবেক্ষণ বলছে এই মহাবিশ্বে ডার্ক ম্যাটারের মোট পরিমাণের মধ্যে এই জাতীয় তারার মৃতদেহ টাইপের প্রোটন-নিউট্রন দিয়ে তৈরী বড় মহাজাগতিক বস্তু খুবই সামান্য। আরেকটা বিকল্প হল ডার্ক ম্যাটার আসলে সম্পূর্ণ অজানা কোন মৌলিক কণা, যারা মহাকর্ষীয় বলে সাড়া দেয় কিন্তু দৃঢ় বা তড়িৎচুম্বকীয় বলে সাড়া দেয় না। মৃদু বলে সাড়া দিতেও পারে। এধরণের কণার নাম দেওয়া হয়েছে উইকলি ইনটারাক্টিং ম্যাসিভ পার্টিকল বা উইম্প। এছাড়া আরেকটা সম্ভাবনার কথাও বলছেন কেউ কেউ। নিউটনের মহাকর্ষের যে নিয়ম সৌরজগতে খাটে, সেই নিয়ম ছায়াপথেও খাটবে তার নিশ্চয়তা কি? এমনিতেই জানা আছে মহাকর্ষীয় বল তীব্র হলে, যেমনটা নিউট্রন স্টার বা ব্ল্যাক হোলের কাছাকাছি হয়, নিউটনের নিয়ম কাজে লাগে না। সেখানে আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদের রাজত্ব। কাজেই হয়ত ছায়াপথের মধ্যে অন্য কোন নিয়ম বা কোন পঞ্চম বল কাজ করছে। আমরা নিউটনের নিয়ম দিয়ে বোঝার চেষ্টা করি বলেই অপ্রত্যাশিত ফল পাই আর ডার্ক ম্যাটারের কল্পনা করি। 

ডার্ক ম্যাটারের চরিত্র স্পষ্টভাবে জানা না গেলেও আধুনিক পর্যবেক্ষণ বলছে মহাবিশ্বের মোট ভরের মাত্র ছ ভাগের একভাগ হল আমাদের চেনাজানা পদার্থের ভর, বাকি পাঁচভাগই ডার্ক ম্যাটার। তাহলেও একদম শুরুতেই যে বলেছিলাম "মহাবিশ্বের মাত্র পাঁচ শতাংশ জানি" - সে হিসেবটা তো মিলছেনা? সেটার জন্য আবার ফিরে যেতে হবে একশ বছর আগে। আইনস্টাইন বাজারে ছেড়েছেন সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ নামে এক বৈপ্লবিক তত্ত্ব, যা মহাকর্ষ সম্পর্কে প্রচলিত নিউটনীয় ধারণার খোলনলচে পালটে দিয়েছে। এই তত্ত্বের সাহায্যে মহাবিশ্বের কার্যকলাপ বোঝার চেষ্টা করতে গিয়ে রুশ গণিতজ্ঞ ফ্রিডম্যান একটা অদ্ভুত ফল পেলেন। মহাবিশ্ব নাকি স্থির নেই, তা ক্রমাগত স্ফীত বা সংকুচিত হচ্ছে। এসব ব্যাপার আইনস্টাইনের মোটেও পছন্দ হল না। নিউটনের তত্ত্বের সীমাবদ্ধতা প্রমাণ করলেও অনাদি অনন্ত কাল ধরে বিরাজমান মহাবিশ্বের ধারণা তখনো তাঁর মাথায়। তিনি নিজের সমীকরণে একটা "মহাকর্ষীয় ধ্রুবক" নামে একটা পদ যোগ করে দিলেন যাতে সমীকরণের সমাধান করে স্থির মহাবিশ্বের ছবি পাওয়া যায়। কিন্ত শাক দিয়ে কি আর মাছ ঢাকা যায়? ১৯২৯ সালে আমেরিকান জ্যোতির্বিদ এডউইন হাবল টেলিস্কোপে চোখ রেখে দেখলেন মহাকাশের সমস্ত গ্যালাক্সি পরস্পরের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে এবং যেকোন দুটো গ্যালাক্সির দূরে সরার বেগ তাদের মধ্যেকার দূরত্বের সমানুপাতিক! এর একটাই অর্থঃ মহাবিশ্ব স্ফীত হচ্ছে। ফ্রিডম্যান সঠিক ছিলেন। ব্যাপারটা বোঝার জন্য একটা বেলুনের গায়ে কয়েকটা ফুটকি দিন। এবার বেলুনটাকে ফুলিয়ে দেখুন, ফুটকি গুলো একে অপরের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। আইনস্টাইন পরে স্বীকার করেছিলেন, তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল ছিল মহাকর্ষীয় ধ্রুবকের আমদানি!

এরপর প্রায় সত্তর বছর ধরে ফ্রিডম্যানের প্রসারমাণ মহাবিশ্বের মডেলের ওপর নানারকম গয়নাগাঁটি পরিয়েই দিব্যি চলছিল আধুনিক বিশ্বতত্ত্ব। যে মডেল অনুযায়ী ১৪শো কোটি বছর আগে আগে এক মহাবিস্ফোরণ বা বিগ ব্যাং -এর মধ্য দিয়ে জন্ম নিয়েছিল আমাদের মহাবিশ্ব আর সেই বিস্ফোরণের ধাক্কাতেই আজো প্রসারিত হয়ে চলেছে মহাবিশ্ব। কিন্তু মহাবিশ্বে ছেয়ে থাকা ভর ও শক্তির (আইনস্টাইনের তত্ত্ব অনুসারে ভর শক্তিরই একটা বিশেষ রূপ) মধ্যাকর্ষণের জন্য এই স্ফীতির হার কমতে বাধ্য। কারণ মহাকর্ষ বল চরিত্রানুসারে আকর্ষণমূলক। যে কারণে একটা ঢিল আকাশে ছুঁড়ে দিলে তার ওপরে ওঠার বেগ ক্রমশ কমতে থাকে আর একটা উচ্চতায় পৌঁছে আবার নীচের দিকে পড়তে শুরু করে, সেই একই কারণে মহাবিশ্বের স্ফীতির হার ক্রমশ কমতে থাকা উচিৎ। কিন্তু নব্বইয়ের দশকের শেষদিকে ব্রায়ান স্মিথ ও অ্যাডাম রিস যৌথভাবে এবং সোল পারমুটার পৃথকভাবে সুপারনোভা, অর্থাৎ মৃত্যুর আগে তারাদের শেষবারের মত জ্বলে ওঠার দৃশ্য, পর্যবেক্ষণ করে জানালেন - মহাবিশ্ব শুধু প্রসারিত হচ্ছে না, প্রসারণের হারও বাড়ছে! এই আবিষ্কারে জন্য ২০১১ সালে পারমুটার, স্মিথ ও রিস নোবেল পুরস্কারে সম্মানিত হন।

এই ক্রমবর্ধমান হারের প্রসারণের জন্য প্রয়োজন এমন পদার্থ বা শক্তি যার মধ্যাকর্ষণ বিকর্ষণমূলক। এই শক্তির নাম দেওয়া হল ডার্ক এনার্জি! ডার্ক, কারণ অন্য কোনভাবে এই শক্তির অস্তিত্ত্ব ধরা পড়ে না। ডার্ক এনার্জির চরিত্র ডার্ক ম্যাটারের মতই বা তার চেয়েও রহস্যজনক! ঋণাত্মক চাপবিশিষ্ট কোন ভুতুরে ফ্লুইড, স্পেসটাইমের নিজস্ব শক্তি বা আইনস্টাইনের সেই ফেলে দেওয়া মহাকর্ষীয় ধ্রুবক -- ডার্ক এনার্জিকে নানা ভাবে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা চলছে। আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদের বাইরে গিয়ে "ঋণাত্মক মহাকর্ষ" পাওয়া যায় কি না সেটাও রয়েছে তাত্ত্বিক পদার্থবিদদের চিন্তার মধ্যে। 
মহাবিশ্বের প্রসারণের হার থেকে জানা গেছে মহাবিশ্বে ভর ও শক্তির মোট পরিমাণের ৬৮ শতাংশই হল ডার্ক এনার্জি আর ২৭ শতাংশ ডার্ক ম্যাটার। তাহলে পড়ে রইল ৫ শতাংশ! আমাদের চেনাজানা পদার্থের অনুপাত এইটুকুই। এককথায় বলা যায় আজকের মহাবিশ্বে অন্ধকারের রাজত্ব চলছে। এই অন্ধকারে আলো ফেলাই এই সময়ে মৌলিক বিজ্ঞানের সামনে অন্যতম চ্যালেঞ্জ।

"জলসিরি" শারদ সংখ্যা ২০১৬ তে প্রকাশিত