Tuesday 8 November 2016

দেশপ্রেমিক

জন্মেজয় কহিলেন, - হে মহর্ষে, আপনি বলিতেছিলেন কলিযুগে দেশপ্রেমিক নামক একজাতীয় মনুষ্যপ্রজাতির আবির্ভাব ঘটিবে। তাঁহারা কি প্রকার মনুষ্য হইবেন, এই ধরাধামে আবির্ভূত হইয়া তাঁহারা কি প্রকার কার্য করিবেন তাহা জানিবার বড় কোতূহল হইতেছে।

বৈশম্পায়ন কহিলেন, - হে রাজন, সেই বিচিত্রবুদ্ধি, সর্বববিদ্যা বিশারদ দেশপ্রেমিকগণ অতীব আশ্চর্য জীব হইবে। আমি সেই বাকপটু, বহুরূপধারী, হাফপ্যান্ট পরিহিত দেশপ্রেমিকদিগের কাহিনী বর্ণন করিতেছি, আপনি শ্রবণ করুন। যাঁহারা গরুকে মাতা, সাভারকরকে পিতা এবং মমতা ব্যানার্জীকে ভগিনী মানিবেন তাঁহারাই দেশপ্রেমিক। যাঁহারা মুসলমানের নিকট শার্দুল, হিন্দুর নিকট শাখামৃগ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিকট সারমেয়, তাঁহারাই দেশপ্রেমিক। যাঁহারা বকরি ঈদের সময় পশুপ্রেমিক, আজানের সময় পরিবেশ প্রেমিক এবং কালীপুজোর সময় উৎসবপ্রেমিক হইতে সক্ষম, তাঁহারাই প্রকৃত দেশপ্রেমিক হইবেন।

দেশের প্রতি ভালবাসা ইহাঁদের উর্বর মস্তিস্কে সদা জাগরূক থাকিবে। ইঁহারা চীনদেশে নির্মিত চলমান দূরভাষ যন্ত্রের মাধ্যমে চীনদেশীয় পণ্য বয়কটের আহ্বান জানাইবেন। ইঁহারা পাকিস্তানের চরদিগকে আপন সৈন্যঘাঁটি ঘুরাইয়া দেখাইবেন এবং সেই সৈন্যঘাঁটির চিত্র প্রদর্শনের অপরাধে দেশীয় সংবাদমাধ্যমকে নিষিদ্ধ করিবেন। ইঁহাদের দলপতি শত্রুরাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর জন্মদিবসে আলিঙ্গন করিতে যাইবেন এবং সেই রাষ্ট্রের শিল্পীকে চলচিত্রে লইবার জন্য পরিচালকের নিকট তোলা আদায় করিবেন। ইঁহারা কাশ্মীর ভূখণ্ডকে ভারতবর্ষের "অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ" বলিবেন এবং সেই ভূখণ্ডের আধিবাসীদিগের জীবন নরক করিয়া তুলিবেন। ইঁহারা ভারতবর্ষীয় সৈন্যদিগের জয়ধ্বনিতে গগন বিদীর্ণ করিবেন এবং আত্মঘাতী সৈন্যকে মানসিক ভারসাম্যহীন বলিয়া গাল দিবেন।

ইঁহারা ট্রল করিতে, ফটোশপ বানাইতে, গুজব রটাইতে এবং দাঙ্গা বাঁধাইতে যারপরনাই দক্ষতা অর্জন করিবেন। ইঁহারা ছাত্রকে অপহরণ করিবেন, দলিতকে প্রহার করিবেন, বুদ্ধিজীবির গলা কাটিবেন এবং খ্রিস্টান যাজককে জীবন্ত দগ্ধ করিবেন। ইঁহারা নিজরাষ্ট্রের সংখ্যালঘুকে সবক শেখাইবেন এবং প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সংখ্যালঘুর জন্য অশ্রু বর্জন করিবেন। নারীজাতির সন্মানরক্ষার্থে ইঁহারা রাত্রির নিদ্রা ত্যাগ করিবেন। ইঁহারা গোহন্তক যবন কিশোরীদিগকে ধর্ষণ করিবেন, আদিবাসী মহিলাদিগের স্তন মন্থন করিয়া মাওবাদীত্ব পরীক্ষা করিবেন, মহিলা মানবাধিকার কর্মীর যৌনাঙ্গে প্রস্তরখণ্ড গুঁজিয়া দিবেন এবং মুসলমান নারীদিগের পুরুষতন্ত্র বিরোধী লড়াইয়ে সংহতি জানাইয়া ফেসবুকে পোস্ট করিবেন।

মহারাজ, আমি যাঁহাদিগের কথা বলিলাম তাঁহাদিগের এরূপ বিশ্বাস জন্মিবে যে, বিধর্মীদের বিতাড়ন করিয়া, সাংবাদিককুলকে সন্ত্রস্ত করিয়া, বামাচারীদের নির্মূল করিয়া তাঁহারা ভারতবর্ষের বক্ষে হিন্দুরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করিতে সমর্থ হইবেন।

জনমেজয় কহিলেন, দেশপ্রেমিকদের জয় হউক। হে মুনিপ্রবর, আপনি অন্য প্রসঙ্গ আরম্ভ করুন।

Tuesday 1 November 2016

ল য ব র হ

মনটা খারাপ ছিল বলে মাঠের ধারে বসে ছিলাম৷ বেজায় গরম। গাছতলায় দিব্যি ছায়ার মধ্যে চুপচাপ শুয়ে আছি, তবু ঘেমে অস্থির। ঘাসের উপর গামছাটা ছিল, ঘাম মুছবার জন্য যেই সেটা তুলতে গিয়েছি অমনি গামছাটা বলল, “হাম্বাআআ!” কি আপদ! গামছাটা হাম্বা করে কেন?
চেয়ে দেখি গামছা তো আর গামছা নেই, দিব্যি মোটা-সোটা সাদা ধপধপে একটা গরু গলা ফুলিয়ে প্যাট্‌প্যাট্‌ করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।

আমি বললাম, “কি মুশকিল! ছিল গামছা, হয়ে গেল একটা গরু৷”
অমনি গরুটা বলে উঠল, “মুশকিল আবার কি? ছিল কট্টর সিপিএম, হয়ে গেল তিলক কাটা তৃণমূল। এ তো হামেশাই হচ্ছে।”
আমি খানিক ভেবে বললাম, “তা হলে তোমায় এখন কি বলে ডাকব? তুমি তো সত্যিকারের গরু নও, আসলে তুমি হচ্ছ গামছা।”
গরু বলল, “গরুও বলতে পার, গামছাও বলতে পার, আবার চাড্ডিও বলতে পার।”
আমি বললাম, “চাড্ডি কেন?”
শুনে গরুটা “তাও জানো না?” বলে শিং নেড়ে ‌খ্যাঁক খ্যাঁক করে বিশ্রীরকম হাসতে লাগল। আমি ভারি অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম। মনে হল, ঐ চাড্ডির কথাটা নিশ্চয় আমার বোঝা উচিত ছিল। তাই থতমত খেয়ে তাড়াতাড়ি বলে ফেললাম, “ও হ্যাঁ-হ্যাঁ, বুঝতে পেরেছি।”
গরুটা খুশি হয়ে বলল, “হ্যাঁ, এ তো বোঝাই যাচ্ছে—চাড্ডির চা, গামছার ম, গরুর চ-এ আকার—হল চামচা। কেমন, হল তো?”

আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না, কিন্তু পাছে গরুটা আবার সেইরকম বিশ্রী করে হেসে ওঠে, তাই সঙ্গে সঙ্গে হুঁ-হুঁ করে গেলাম। তার পর গরুটা খানিকক্ষণ আকাশের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ বলল, "ভালো না লাগে তো আচ্ছে দিন আনলেই পারো৷"

আমি বললাম, “বলা ভারি সহজ, কিন্তু বললেই তো আর আনা যায় না?”
গরু বলল, “কেন? সে আর মুশকিল কি?”
আমি বললাম, “কি করে আনতে হয় তুমি জানো?”
গরু এক গাল হেসে বলল, “তা আর জানি নে? গোমাতা, স্বচ্ছ ভারত, সার্জিকাল স্ট্রাইক, আচ্ছে দিন, ব্যাস্! সোজা মন্তর, আওড়ালেই হল৷”
আমি বললাম, “তা হলে মন্তরটা আমায় বাতলে দিতে পার?”
শুনে গরুটা হঠাৎ কেমন গম্ভীর হয়ে গেল। তার পর মাথা নেড়ে বলল, “উঁহু, সে আমার কর্ম নয়। আমার ফেকুদাদা যদি থাকত, তা হলে সে ঠিক-ঠিক বলতে পারত।”
আমি বললাম, “ফেকুদাদা কে? তিনি থাকেন কোথায়?”
গরু বলল, “ফেকুদাদা আবার কোথায় থাকবে? টিভির পর্দায় থাকে।” আমি বললাম, “কোথায় গেলে তার সঙ্গে দেখা হয়?”
গরুটা খুব জোরে মাথা নেড়ে বলল, “সেটি হচ্ছে না, সে হবার জো নেই।”
আমি বললাম, “কিরকম?”

গরুটা বলল, “সে কিরকম জানো? মনে কর, তুমি যখন যাবে বেজিংএ তার সঙ্গে দেখা করতে, তখন তিনি থাকবেন ন্যুইয়র্ক। যদি ন্যুইয়র্ক যাও, তা হলে শুনবে তিনি আছেন প্যারিসে। আবার সেখানে গেলে দেখবে তিনি গেছেন ইসলামাবাদ। কিছুতেই দেখা হবার জো নেই।”

আমি বললাম, “তা হলে তোমরা কি করে দেখা কর?”
গরু বলল, “সে অনেক হাঙ্গাম। আগে হিসেব করে দেখতে হবে, দাদা কোথায় কোথায় নেই , তার পর হিসেব করে দেখতে হবে, দাদা, কোথায় কোথায় থাকতে পারে, তার পর দেখতে হবে, দাদা এখন কোথায় আছে। তার পর দেখতে হবে, সেই হিসেব মতো যখন সেখানে গিয়ে পৌঁছবে, তখন দাদা কোথায় থাকবে। তার পর দেখতে হবে—”

আমি তাড়াতাড়ি বাধা দিয়ে বললাম, “সে কিরকম হিসেব?”
গরু বলল, “সে ভারি শক্ত। দেখবে কিরকম?” এই বলে সে একটা কাঠি দিয়ে ঘাসের উপর লম্বা আঁচড় কেটে বলল, “এই মনে কর ফেকুদাদা।” বলেই খানিকক্ষণ গম্ভীর হয়ে চুপ করে বসে রইল।
তার পর আবার ঠিক তেমনি একটা আঁচড় কেটে বলল, “এই মনে কর তুমি,” বলে আবার ঘাড় বাঁকিয়ে চুপ করে রইল।
তার পর হঠাৎ আবার একটা আঁচড় কেটে বলল, “এই মনে কর রোহিত ভেমুলা।” এমনি করে খানিকক্ষণ কি ভাবে আর একটা করে লম্বা আঁচড় কাটে, আর বলে, “এই মনে কর ২০০ টাকায় অড়হড় ডাল বিক্রী হচ্ছে—” “এই মনে কর আখলাকের খুনির লাশে জড়ানো তেরঙ্গা—” “এই মনে কর জেএনইউ এর ছাত্র নাজিবকে গুম করা হচ্ছে—”

এইরকম শুনতে-শুনতে শেষটায় আমার কেমন রাগ ধরে গেল। আমি বললাম, “দূর ছাই! কি সব আবোল তাবোল বকছে, একটুও ভালো লাগে না।”
গরু বলল, “আচ্ছা, তা হলে আর একটু সহজ করে বলছি। চোখ বোজ, আমি যা বলব, মনে মনে তার হিসেব কর।” আমি চোখ বুজলাম।
চোখ বুজেই আছি, বুজেই আছি, গরুটার আর কোনো সাড়া-শব্দ নেই। হঠাৎ কেমন সন্দেহ হল, চোখে চেয়ে দেখি গরুটা ল্যাজ খাড়া করে বাগানের বেড়া ভেঙে পালাচ্ছে আর ক্ৰমাগত খ্যাঁকখ্যাঁক‌ করে হাসছে।
........
হ্যাপি বার্থডে প্রফেট সুকুমার!
.........