একটা সময় প্রত্যেক ভোটের আগে বামফ্রন্টকে ভোট দেওয়ার আবেদন জানিয়ে একটা বিবৃতি বেরোত, যাতে সই থাকত বাংলার প্রায় সমস্ত প্রথম সারির শিল্পী-সাহিত্যিক-সঙ্গীতজ্ঞ-চলচিত্রকর্মীদের। বুদ্ধিজীবিরা তাঁদের স্বভাবজনিত সংবেদনশীলতার জন্য বামপন্থী মতাদর্শে বিশ্বাসী বলে ধরে নেওয়া হত। কখনো সখনো মৃদুমন্দ সমালোচনা করলেও যেকোন বড় ইস্যুতে তাঁরা বামফ্রন্ট তথা সিপিএমের পাশেই দাঁড়াতেন। অবশ্য বিরোধী ও নিন্দুকরা বারবারই অভিযোগ করত বুদ্ধিজীবিরা সিপিএমের পাশে আছেন কোন আদর্শের তাড়নায় নয় স্রেফ ক্ষমতার মধু চাটার জন্য। সংস্কৃতিবান বুদ্ধদেববাবু মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর বুদ্ধিজীবিদের বাম-ঘনিষ্ঠতা আরো নিবিড় হয়। নিন্দুকরা তাঁদের নাম দেন "বুদ্ধজীবি"। দ্বিখণ্ডিত নিষিদ্ধকরণের মত চরম বাকস্বাধীনতা বিরোধী পদক্ষেপের সমর্থনেও যুক্তি দিতে তাঁদের বাধেনি। একবার জনযুদ্ধ গোষ্ঠী ও তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল সমাজকর্মীদের ওপর রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সরব হলে "আমাদের সাহায্য নিয়ে ওদের মদত" করার জন্য বুদ্ধিজীবিদের কড়কে দিয়েছিলেন তৎকালীন সিপিএম সম্পাদক অনিল বিশ্বাস। বুদ্ধিজীবিদের বামপ্রেমে ধাক্কা লাগে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের সময় থেকে। পাবলিকের মারে সিপিএম যত বেসামাল হল, ততই দলে দলে বুদ্ধিজীবি শিবির ছাড়তে শুরু করলেন। তাঁদের মধ্যে স্পষ্ট দুটো ভাগ হল, "বুদ্ধজীবি" আর "পরিবর্তনপন্থী"। দ্বিতীয়গোষ্ঠীকে সুশীল সমাজ, নাগরিক সমাজ ইত্যাদি নামে ডাকা হত। চ্যানেলে চ্যানেলে দুপক্ষের তরজা আমজনতা গোগ্রাসে গিলল আর বাংলা সিরিয়ালগুলোর টিআরপি নেমে গেল। একদল তখনো শিল্পায়নের নামে সিঙ্গুরের বহুফসলী জমি জবরদখল, তাপসী মালিকের নৃশংস হত্যা, নন্দীগ্রামে পুলিস-ক্যাডার যৌথবাহিনীর অপারেশন সূর্যোদয়ের সমর্থনে সাফাই গাইছেন আর অন্যদল সরকারের পরিবর্তনের সওয়াল করছেন। ক্রমশ প্রথমদলের গলার আওয়াজ মিইয়ে এলো আর দ্বিতীয়দল "পরিবর্তনপন্থী" থেকে "মমতাপন্থী"তে উত্তীর্ণ হলেন। পরিবর্তনের পর দ্বিতীয়দল থেকে অনেকেই সাংসদ, বিধায়ক, মন্ত্রী বা বিভিন্ন সরকারি সংস্থা বা কমিটির পদাধিকারী হলেন। কবীর সুমন, সুনন্দ সান্যালের মত কয়েকটা অবাধ্য রাখাল অবশ্য সব জমানাতেই ছিল। তবে সুবোধ কবি, সুশীল অভিনেতা, সুবেশ গায়কদের মত গোপালের সংখ্যাই বেশী যারা চট করে বাপ বদলে ফেলতে পারে। এবারের লোকসভা ভোটে দেখা গেল সেইসব প্রাক্তন "বুদ্ধজীবি"রা কেউ সরাসরি তৃণমূলের টিকিট পেলেন, কেউ বা বন্ধুতার দোহাই পেড়ে প্রচারে নামলেন ভবিষ্যতের জমিটা তৈরী রাখার স্বার্থে। স্বনাম ও বাপের নামধন্য জাদুকর অবশ্য ছোট জায়গায় নাড়া বাঁধতে নারাজ। তিনি সাক্ষাৎ হনুমানের অবতার নরেন্দ্র মোদীর শরণাপন্ন হয়েছেন। এঁরা অনেকেই হয়ত পদ্মবিভূষণ বা বঙ্গবিভূষণে সন্মানিত হবেন। তবে সিপিএম তাঁদের বঙ্গবিভীষণ শিরোপা দেবে কি না জানা নেই।
গোপাল আর রাখালের গল্পটা কেবল বুদ্ধিজীবিদের মধ্যে খুঁজলে ভুল হবে। নন্দীগ্রাম যুদ্ধের আঁচ এসে পড়েছিল বামফ্রন্টের অন্দরেও। নীতিভ্রষ্টতার অভিযোগ তুলে সরব হয়েছিল ফরোয়ার্ড ব্লক, আরএসপির মত শরিকরা। তখন বাধ্য গোপালের মত ল্যাজ নেড়ে গেছিলেন কিরণময় নন্দ। পরিণামে ক্ষিতি গোস্বামীর মত নেতাদের তীব্র আক্রমণের মুখে পড়তে হয়েছিল। ফব, আরএসপিকে বাদ দিয়ে কিরণময়ের সমাজবাদী পার্টিকে ফ্রন্টের মেজ শরিক বানানোর তত্ত্ব হাজির করেছিল সিপিএম। ক্ষিতিবাবুরা এখনো ফ্রন্টেই আছেন। কিন্তু কিরণময়বাবুরা এখন ফেডারেল ফ্রন্টের গল্প শুনিয়ে তৃণমূল নেত্রীর কাছে আশ্রয় চাইছেন। তাঁদের নেতা মুলায়মের যা মতিগতি তাতে ভোটের পর কংগ্রেস এমন কি বিজেপির হাত ধরাটাও তাঁর পক্ষে খুব কঠিন নয়।
"দুঃখের দিনের বন্ধুই আসল বন্ধু", একথা সবাই জানি তবু কার্যক্ষেত্রে মনে রাখিনা। যেসব বামপন্থী রাজনীতিবিদ, অর্থনীতিবিদ, সমাজকর্মীরা বামফ্রন্ট সরকারের দক্ষিণপন্থীদের চেয়েও দক্ষিণপন্থী হওয়ার প্রচেষ্টার নিন্দা করেছিলেন তাঁরা আজ অনেকেই রাজ্য ও কেন্দ্রে স্বৈরাচারী ও ফ্যাসিবাদী শক্তিকে আটকাতে সেই "পচাগলা" বামপন্থীদেরই আঁকড়ে ধরতে চাইছেন। কিন্তু তোষামোদ কে বঙ্গোপসাগরে ফেলে দিয়ে যুক্তিসঙ্গত সমালোচনাকে সাদরে গ্রহণ করার সাহস আর সিপিএমের নেই। নীতিগত বিষয়ে প্রশ্ন তোলার জন্য প্রসেনজিৎ বসু, রেজ্জাক মোল্লার প্রতি, জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতাদের প্রতি যে আচরণ করা হল তা বোঝায় কূয়োর ব্যাং হয়ে থাকাকেই সিপিএম ভবিতব্য বলে ধরে নিয়েছে। আদ্যন্ত দক্ষিণপন্থী আম আদমি পার্টি যেভাবে বিভিন্ন সামাজিক আন্দোলনের শক্তিকে রাজনীতির ময়দানে নিয়ে আশার চেষ্টা করছে তা থেকে শিক্ষা নিয়ে ছোট বামপন্থী দল ও সংগঠনকে একত্রিত করার বদলে সুবিধাবাদী আঞ্চলিক দলগুলোকে নিয়ে তৃতীয় ফ্রন্টের অলীক মরীচিকার পেছনে দৌড়ানো হচ্ছে। তবে কি না এখনো সময় আছে। সুবোধ সুশীল ও কিরণময়দের কাপড় উন্মোচন থেকে কি সিপিএম শিক্ষা নেবে? গোপালদের ত্যাজ্যপুত্তুর করে রাখালদের বুকে টেনে নিতে পারবে? কূয়ো থেকে বেরিয়ে সমুদ্রে যাওয়ার হিম্মত কি হবে? প্রশ্নগুলো সহজ, উত্তরটা ...
চর্যাপদ লিঙ্ক
গোপাল আর রাখালের গল্পটা কেবল বুদ্ধিজীবিদের মধ্যে খুঁজলে ভুল হবে। নন্দীগ্রাম যুদ্ধের আঁচ এসে পড়েছিল বামফ্রন্টের অন্দরেও। নীতিভ্রষ্টতার অভিযোগ তুলে সরব হয়েছিল ফরোয়ার্ড ব্লক, আরএসপির মত শরিকরা। তখন বাধ্য গোপালের মত ল্যাজ নেড়ে গেছিলেন কিরণময় নন্দ। পরিণামে ক্ষিতি গোস্বামীর মত নেতাদের তীব্র আক্রমণের মুখে পড়তে হয়েছিল। ফব, আরএসপিকে বাদ দিয়ে কিরণময়ের সমাজবাদী পার্টিকে ফ্রন্টের মেজ শরিক বানানোর তত্ত্ব হাজির করেছিল সিপিএম। ক্ষিতিবাবুরা এখনো ফ্রন্টেই আছেন। কিন্তু কিরণময়বাবুরা এখন ফেডারেল ফ্রন্টের গল্প শুনিয়ে তৃণমূল নেত্রীর কাছে আশ্রয় চাইছেন। তাঁদের নেতা মুলায়মের যা মতিগতি তাতে ভোটের পর কংগ্রেস এমন কি বিজেপির হাত ধরাটাও তাঁর পক্ষে খুব কঠিন নয়।
"দুঃখের দিনের বন্ধুই আসল বন্ধু", একথা সবাই জানি তবু কার্যক্ষেত্রে মনে রাখিনা। যেসব বামপন্থী রাজনীতিবিদ, অর্থনীতিবিদ, সমাজকর্মীরা বামফ্রন্ট সরকারের দক্ষিণপন্থীদের চেয়েও দক্ষিণপন্থী হওয়ার প্রচেষ্টার নিন্দা করেছিলেন তাঁরা আজ অনেকেই রাজ্য ও কেন্দ্রে স্বৈরাচারী ও ফ্যাসিবাদী শক্তিকে আটকাতে সেই "পচাগলা" বামপন্থীদেরই আঁকড়ে ধরতে চাইছেন। কিন্তু তোষামোদ কে বঙ্গোপসাগরে ফেলে দিয়ে যুক্তিসঙ্গত সমালোচনাকে সাদরে গ্রহণ করার সাহস আর সিপিএমের নেই। নীতিগত বিষয়ে প্রশ্ন তোলার জন্য প্রসেনজিৎ বসু, রেজ্জাক মোল্লার প্রতি, জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতাদের প্রতি যে আচরণ করা হল তা বোঝায় কূয়োর ব্যাং হয়ে থাকাকেই সিপিএম ভবিতব্য বলে ধরে নিয়েছে। আদ্যন্ত দক্ষিণপন্থী আম আদমি পার্টি যেভাবে বিভিন্ন সামাজিক আন্দোলনের শক্তিকে রাজনীতির ময়দানে নিয়ে আশার চেষ্টা করছে তা থেকে শিক্ষা নিয়ে ছোট বামপন্থী দল ও সংগঠনকে একত্রিত করার বদলে সুবিধাবাদী আঞ্চলিক দলগুলোকে নিয়ে তৃতীয় ফ্রন্টের অলীক মরীচিকার পেছনে দৌড়ানো হচ্ছে। তবে কি না এখনো সময় আছে। সুবোধ সুশীল ও কিরণময়দের কাপড় উন্মোচন থেকে কি সিপিএম শিক্ষা নেবে? গোপালদের ত্যাজ্যপুত্তুর করে রাখালদের বুকে টেনে নিতে পারবে? কূয়ো থেকে বেরিয়ে সমুদ্রে যাওয়ার হিম্মত কি হবে? প্রশ্নগুলো সহজ, উত্তরটা ...
চর্যাপদ লিঙ্ক