Wednesday 27 June 2018

বিষাদ গাথা

বিষাদ সিন্ধু বইটার কথা শুনেছি অনেকদিন আগেই, কিন্তু পড়ার সুযোগ হয়ে ওঠেনি। এবছরের বইমেলায় বাংলাদেশের স্টল থেকে কিনেছিলাম। বইয়ের র‍্যাকে পড়েই ছিল, অনেক বইই যেমন হয়। তারপর কি মনে হতে একদিন হাতে তুলে নিলাম। উনবিংশ শতকের এই আখ্যান যে এতটা টানটান উত্তেজনায় পাঠককে আটকে রাখতে পারে তা ভাবতেই পারিনি। অথচ এই আখ্যানের প্রেক্ষাপট সুদূর আরবদেশের কারবালা প্রান্তর। লেখকের কলমের গুণ সে বিষাদগাথাকে প্রোথিত করেছে বাংলার মাটিতে। অনেকটা যেমন রামায়ণ-মহাভারতকে বাঙালীর ঘরের কাব্য করে তুলেছেন কাশিরাম-কৃত্তিবাস থেকে শুরু করে উপেন্দ্রকিশোর-পরশুরাম রা। 

ঘটনার মূলে আছে হযরত মহম্মদের দুই দৌহিত্র ইমাম হোসেন ও ইমাম হাসানের সঙ্গে মহম্মদের শিষ্য ও দামেস্ক নগরের অধিপতি মোবিয়ার পুত্র এজিদ-এর ক্ষমতার দ্বন্দ্ব। এই দ্বন্দ্ব ভয়ঙ্কর শত্রুতায় পর্যবসিত হয় যখন এজিদের কামনার ধন জয়নাব ইমাম হাসানের পাণিগ্রহণ করে ফেলে। এজিদ প্রথমে হাসানকে বিষপ্রয়োগে হত্যা করে, তারপর কৌশলে হোসেনকে সপরিবারে মদিনা থেকে বের করে কারবালার প্রান্তরে নিয়ে আসে। সেখানেই এক মর্মান্তিক যুদ্ধে শহীদ হন তিন পুত্র সহ হোসেন এবং হাসানের পুত্র কাসেম। হোসেনের কনিষ্ঠ পুত্র জয়নাল আবেদিন এবং জয়নাব সহ ইমাম পরিবারের নারী রা। মহম্মদীয় বংশের সমস্ত উত্তরাধিকারীদের হাতের মুঠোয় পাওয়া গেছে ভেবে যখন এজিদ উল্লসিত, তখনই ঘটনা অন্য দিকে মোড় নেয়। ময়দানে অবতীর্ণ হন হযরত আলির আরেক পুত্র আম্বাজ অধিপতি মহাবীর মহম্মদ হনিফা। মহম্মদের অনুগামী অন্যান্য নৃপতিদের একত্রিত করে নানা নাটকীয় ও রোমাঞ্চকর ঘটনার মধ্য দিয়ে জয়নাল আবেদীন সহ ইমাম বংশের নারীদের উদ্ধার করেন। 

বইটি তিনটি পর্বে বিভক্ত। মহরম পর্ব, উদ্ধার পর্ব ও এজিদ বধ পর্ব। এর মধ্যে মহরম পর্বে খানিকটা ইতিহাসকে অনুসরণ করা হয়েছে। বাকি দুই পর্ব প্রায় পুরোপুরি কল্পনাশ্রয়ী। রামায়ণ-মহাভারতের সঙ্গে তুলনা না এসে পারে না। ঐ দুই মহাকাব্যকে যেমন বলা হয় ধর্ম ও অধর্মের লড়াইয়ের কাহিনী, বিষাদ সিন্ধুও তাই। রাম, পাণ্ডবদের মত ধর্মের ধ্বজাধারী হাসান ও হোসেন ও তাঁদের অনুগামীরা। রাবণ, কৌরব পক্ষের মত অধর্মের প্রতিমূর্তি এজিদ পক্ষ। মজার ব্যাপার হল লড়াইটা ধর্ম-অধর্মের হলেও তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে একটা নারী চরিত্র। সীতা হোক বা দ্রৌপদী কিংবা জয়নাব। মিল আরো আছে। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধপ্রান্তরে প্রায়সই স্বর্গ থেকে নেমে আসতেন দেবতারা। কারবালার যুদ্ধের পর লেখকের ভাষায়, "স্বর্গীয় দূতগণ স্বর্গসংস্রবী দেবগণ, সকলেই আসিয়া উপস্থিত হইলেন।" হযরত আদম থেকে শুরু করে ইব্রাহিম, ইসমাইল, ইউসুফ, মোজেস, যিশু, মহম্মদ "প্রভৃতি মহা মহা মহাত্মাগণের আত্মা অদৃশ্য শরীরে কারবালায় হসেনের দৈহিক শেষক্রিয়ার জন্য উপস্থিত হইলেন।" আরব্য ও পারস্য দেশের কাব্য অবলম্বনে মীর মোসাররফ হোসেন লিখেছেন ইসলামিক ইতিহাসের এক বিষাদঘন কাহিনী। অথচ তাঁর ভাষায় আরবি-ফারসির প্রভাব স্বাভবিকের চেয়ে এতটুকু বেশী নয়। "ঈশ্বর" কে "ঈশ্বর" বলেই উল্লেখ করা হয়েছে, আরবি প্রতিশব্দ "আল্লা" দিয়ে নয়। হযরত মহম্মদ সহ পয়গম্বর দের সম্বোধন করেছেন মহর্ষি বলে, ইমামা পরিবারের মহিলারা বন্দিত হয়েছেন "সতী সাধ্বী দেবিগণ" হিসেবে। এজন্য তাঁকে মূল্য একেবারে চোকাতে হয়নি তা নয়। "উদ্ধার পর্ব"এর শুরুর দিকে তিনি লিখেছেন, "বিষাদ সিন্ধুর প্রথম ভাগেই স্বজাতীয় মূর্খদল হাড়ে চটিয়া রহিয়াছেন। অপরাধ আর কিছুই নহে, পয়গম্বর এবং ইমামদিগের নামের পূর্বে বাংলা ভাষায় ব্যবহার্য শব্দে সম্বোধন করা হইয়াছে; মহাপাপের কার্যই করিয়াছি।" ভাগ্যিস করেছিলেন এই মহাপাপ! তাই তো "ইসলামিক সাহিত্য"এর গণ্ডী পেরিয়ে "বিষাদ সিন্ধু" হয়ে উঠেছে এক সার্বজনীন বিষাদ গাথা।


বিষাদ সিন্ধু, মীর মোসাররফ হোসেন,
অক্ষর প্রকাশনী, ঢাকা।