Friday 9 August 2013

অনন্ত মৃগয়া

                জন্মলগ্ন থেকে মানুষ ছুটে বেড়িয়েছে কিছু স্বপ্নের পেছনে, কখনও তা ধরা দিয়েছে, কখনও বা দূরে সরে গেছে। মানুষ দিকভ্রান্ত হয়ে ঘুরে মরেছে, আবার ধাওয়া করেছে নতুন স্বপ্নের সন্ধানে। স্বপ্নকেই মৃগয়া করতে বেরিয়েছে সে। কি সেই স্বপ্ন? “হরেক রকম স্বপ্ন আছে আশা কিম্বা নিরাশার / জন্মভূমি মুক্ত করার কিম্বা প্রিয় প্রেমিকার” । দোর্দন্ডপ্রতাপ জমিদার সুদর্শন সিংহরায়ের নজরে থাকা প্রেমিকার সাথে ঘর বাধার যে স্বপ্ন নিয়ে প্রাণ হারায় চন্দ্রকান্ত পণ্ডিত। যে স্বপ্নের তাড়ায় দেশের স্বাধীনতার যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল অরিজিৎ, যে স্বপ্নের খোঁজে সিংহগড় ছেড়ে জনতার মাঝে চলে গিয়েছিল প্রিয়ব্রত, নিরক্ষর হয়েও প্রগাঢ় জ্ঞানী পরীক্ষিত বাউরি হয়ে উঠেছিল তেভাগা ও জলডুবি আন্দোলনের কিংবদন্তী। পাগল শিকারি স্বপ্ন দেখে চলে সুধন্য নামে তার এক বংশধর দুনিয়ার অনাচার দূর করবে। গান্ধীজি ও শত শত স্বাধীনতা সংগ্রামীর স্বপ্ন বিস্মিত না হবার অপরাধে দলে আপাংক্তেয় হয়ে পড়েন কংগ্রেস নেতা অনাথ রায়। নিজেদের উজ্জ্বল কেরিয়ার উপেক্ষা করে সরকারি চাকরি করতে গ্রামে আসে বুদ্ধদেব, অমলজ্যোতি। তেভাগা আন্দোলন নিয়ে গবেষণা করতে করতে নকশালবাড়ির সশস্ত্র বিপ্লবের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে সুরঞ্জনা। শ্রেণিহীন সমাজের চিরনবীন স্বপ্নে উদ্বুদ্ধ সুকুমার আচার্য্য দেখে শিব গড়তে গিয়ে তারা গড়ে ফেলেছে শোষণমূলক ব্যবস্থার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়া একটা বানর, যার নাম বামফ্রন্ট সরকার। সে স্বপ্ন দেখতে দেখতে পথভ্রষ্ট হয়ে পড়ে গোরাচাঁদ, বাঁশি বাউরি। বিরোধীদের, বুর্জোয়া, জমিদারদের বিদ্রুপ করে কবিতা লিখতে লিখতে চারণকবি চন্দন দাস আবিষ্কার করে নিজের অজান্তেই তার বিদ্রুপের বর্শামুখ ঘুরে গেছে নিজের পার্টির দিকেই।

               মানব সভ্যতার ইতিহাস আসলে দ্বন্দ্বের ইতিহাস।

গতির সঙ্গে স্থবিরত্বের, বিজ্ঞানের সঙ্গে অন্ধবিশ্বাসের, সমস্টিস্বার্থের সঙ্গে ব্যক্তিস্বার্থের। এ দ্বন্দ্ব যেমন চলে সমাজের মধ্যে, তেমনই ব্যক্তি মানুষের নিজের ভিতরেও।
সে স্বপ্ন দেখে, স্বপ্নভঙ্গ হয়, তবু আবার স্বপ্ন দেখে। এভাবেই এগোতে থাকে সমাজ, পৃথিবী। অগ্রগতি সরলরেখায় হয় না, থাকে নানা বাঁক, উত্থান, পতন, বিপ্লব, প্রতিবিপ্লব। দেশকাল ভেদে এই দ্বন্দ্ব ও আগ্রগতির চরিত্র বদলায়, কিন্তু বৃহত্তর সময় ও জগত থেকে বিচ্ছিন্ন হয় না। ভগীরথ মিশ্রের “মৃগয়া” উপন্যাসের ঘটনাস্থল বাঁকুড়ার চূয়ামসিনা গ্রাম। কিন্তু এখানে উঠে এসেছে গত একশতকে গ্রামবাংলার সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিবর্তনের খণ্ডচিত্র। স্বাধীনতার আগে ঔপনিবেশিক যুগে গ্রামসমাজ ও জমিদারতন্ত্রের দ্বন্দ্ব, স্বাধীনতার লড়াই, বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে দেশীয় সামন্ততন্ত্রের অম্লমধুর সম্পর্ক থেকে স্বাধীন ভারতে উদীয়মান দেশীয় বণিকশ্রেণি ও রাজনৈতিক দলের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ক্ষয়িষ্ণু জমিদারতন্ত্রের টিকে থাকার লড়াই ফুটে উঠেছে সিংহরায় জমিদার পরিবারটির মাধ্যমে। প্রবল অত্যাচারী সুদর্শন সিংহরায়, তার মেয়ে লাবণ্য, জামাই শংকরপ্রসাদ, মধ্যস্বত্বভোগ নয়, যার বিশ্বাস ছিল কর্মযোগে, আর নাতি প্রিয়ব্রত, উচ্চবর্ণ ও জমিদারি প্রথার বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃণা নিয়ে যে জড়িয়ে পড়েছিল প্রথমে স্বদেশী ও পরে তেভাগা আন্দোলনে, এরা সবাই প্রতিনিধিত্ব করেছে একটা সময়ের। হরবল্লভ ও কণকপ্রভা ক্ষয়িষ্ণু জমিদারতন্ত্রের দুই অংশের প্রতিনিধি। একটা অংশ বণিকতন্ত্র ও সংসদীয় গণতন্ত্রের সঙ্গে সমঝোতা করে নিজেদের প্রতিপত্তি কিছুটা হলেও বজায় রাখতে পারল আরেকটা অংশ বাস্তবের সাথে তাল মেলাতে না পেরে পরাস্ত হল। সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রাম, খাদ্য আন্দোলন, জমির লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে শ্রমিক-কৃষকের রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে উঠে এল কমিউনিস্ট পার্টি। যুক্তফ্রন্ট সরকার, নকশাল আন্দোলন, জরুরী অবস্থা ও আধা-ফ্যাসিবাদী সন্ত্রাসে উত্তাল হয়ে উঠল ৭০এর দশক। বিপুল প্রত্যাশা নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হল বামফ্রন্ট সরকার। অপারেশন বর্গা ও ত্রিস্তর পঞ্চায়েতের ধাক্কায় শেষ হতে চলল সামন্ততন্ত্রের অবশিষ্ট প্রভাব। কিন্ত পুরানো শোষকরা ইতিমধ্যে শিবির পরিবর্তন করেছে। হরবল্লভের পুত্র দেবীদাস হয়ে উঠল পার্টির মস্ত বড় নেতা। বাবা ভৈরবেশ্বরের থানকে কেন্দ্র করে জমজমাট হয়ে উঠল চূয়ামসিনা। গ্রামে বসল ভিডিও পার্লার, মদের ঠেক। দলতন্ত্র ও দূর্নীতি গ্রাস করল জীবনকে। তীব্র হল পার্টির আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব। এদিকে দ্রুত পাল্টাতে লাগল দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি। হিন্দু মৌলবাদী শক্তির উত্থানে বিপন্ন হল বহুত্ববাদী সংস্কৃতি। এসবের মধ্যেই স্রোতের বিরুদ্ধে লড়ে চলল সুকুমার আচার্য্য, তিলক বাউরি, হঠাৎ মুর্মূ, মকবুলরা, তাদের অধরা স্বপ্নের সন্ধানে।
               এই পটভূমিতেই এসেছে অরিজিৎ, লাবণ্য, কুন্তী, বুদ্ধদেব, অগ্নি, গোরাচাঁদের মত কতকগুলো বিচিত্র চরিত্র ও তাদের দ্বন্দ্ব, ভালবাসা, স্বপ্ন, স্বপ্নভঙ্গের কাহিনী। সে কাহিনী জানতে হলে পড়তেই হবে উপন্যাসটি।
প্রথম প্রকাশঃ পাঠাগার ব্লগ
পুনঃপ্রকাশঃ চর্যাপদ