Thursday 31 October 2013

স্টপগ্যাপ

স্টাফরুম থেকে বেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামছি, তখনই সুতপার ফোনটা এল। আজ আগেও বেরোতে পারতাম। বৃহস্পতিবার লাস্ট পিরিয়ডে আমার ক্লাস থাকেনা। দেবেশদা আসেননি বলে ওনার ক্লাসে স্টপগ্যাপ হয়ে যেতে হল। বড়দের হলে ছেড়ে দেওয়া যেত, কিন্তু ক্লাস সিক্সের ছেলেদের স্কুল ছুটি হওয়ার আগে ছাড়া যায়না।

"হ্যাঁ বলো"
"তোমার ছুটি হয়েছে?"
"হ্যাঁ এই বেরোচ্ছি"
"তোমার এক বাল্যবান্ধবী এসেছেন, বাংলাদেশ থেকে"
আমার বাল্যবান্ধবী! তাও আবার বাংলাদেশ থেকে !!
"বাবার বন্ধুর মেয়ে, বারীনকাকা"
"বারীনকাকা! বল কি? ঠিক আছে আমি এক্ষুনি যাচ্ছি।"

ফোনটা হাতে নিয়েই কয়েক মিনিট সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে রইলাম। তারপর ভোলাদা কে চাবি নিয়ে আসতে দেখে সম্বিত ফিরল। নেমে গ্যারেজ থেকে সাইকেলটা বের করলাম। বাইক একটা কিনেছি, কিন্তু একা থাকলে সাইকেল নিয়েই বেরোই।

বারীনকাকা! কতদিন পর এই নামটা শুনলাম! পাঠকরা যদি ভেবে থাকেন বাল্যপ্রণয়ের তাড়নায় আমার হৃদয়ে ঝড় উঠেছে তাহলে ভুল করবেন। কারণ বারীনকাকার মেয়ের সঙ্গে আমার আদৌ আলাপই হয়নি, কোনদিন দেখিওনি। বারীনকাকারা যখন এখান থেকে চলে যান তখন আমার বয়স নয় কি দশ বছর। ওনার নামটা আর বিক্ষিপ্ত কিছু স্মৃতি ছাড়া বিশেষ কিছু মনে নেই। পরে অবশ্য মা ও দিদিদের কাছ থেকে বারীনকাকার সম্পর্কে অনেক কিছুই শুনেছি। বারীনকাকারা চট্টগ্রামের লোক, দেশভাগের সময় তাঁর বাবা-মা তিন ছেলেমেয়েকে নিয়ে এদিকে চলে এসেছিলেন। আমাদের বাড়ির কাছেই ভাড়া থাকতেন। বয়সের তফাত সত্ত্বেও বাবার সঙ্গে বারীনকাকার বন্ধুত্ব বেশ জমে গিয়েছিল। বাবা কমিউনিস্ট পার্টি করতেন আর বারীনকাকা সক্রিয় রাজনীতি করতেন না, তবে কংগ্রেস ঘেঁষা ছিলেন। সেই সময় অবশ্য রাজনৈতিক মতভেদ আজকের মত অস্পৃশ্যতায় শেষ হত না। দুই পরিবারে অত্যন্ত অন্তরঙ্গতা ছিল। বাবা যখন জেলে বা আন্ডারগ্রাউন্ডে থাকতেন, বারীনকাকাই আমাদের পরিবারের অভিভাবক হয়ে উঠতেন। খুব কমবয়সে বাধ্য হয়ে ভিটেত্যাগ করলেও নিজের দেশের প্রতি বারীনকাকার একটা অদ্ভুত আবেগ ছিল বলে শুনেছি। মুক্তিযুদ্ধের সময় না কি প্রচণ্ড অস্থির হয়ে পড়েছিলেন, সারাদিন রেডিওর খবরের জন্য অপেক্ষা করে বসে থাকতেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার বছর পাঁচেকের মধ্যেই তল্পিতল্পা গুটিয়ে স্ত্রী ও অবিবাহিতা বোনকে নিয়ে দেশে ফিরে যান। বারীনকাকার ভাই গিরীনকাকা এখানেই রয়ে গিয়েছিলেন। প্রথমদিকে বেশ কিছুদিন অবধি চিঠিপত্রের চালাচালি হত, তারপর আস্তে আস্তে যোগাযোগটা বন্ধ হয়ে যায়। শুনেছিলাম বারীনকাকার স্ত্রী মারা গেছেন সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে। তার কয়েকবছর পরে বারীনকাকার মৃত্যুর খবর পেয়ে বাবা বেশ ভেঙে পড়েছিলেন মনে আছে।

পুরনো কথা ভাবতে ভাবতে কখন যে কুড়ি মিনিটের রাস্তাটা সাইকেলে পেরিয়ে এসেছি খেয়ালই নেই। ঘরে ঢুকে দেখি দুজন ভদ্রমহিলা আর একজন বয়স্ক যুবক সুতপার সঙ্গে কথা বলছে। "যুবক"টিকে চিনতে পারলাম, গিরীনকাকার ছেলে পিলু।
পিলু আমার দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, "কেমন আছ গ্যাঁড়াদা?"
"ভালো, তোর সঙ্গে অনেকদিন পর দেখা হল।"
"তোমাকে অবশ্য রাস্তায় দেখি মাঝে মাঝে। আলাপ করিয়ে দিই, জ্যাঠামশাইয়ের মেয়ে পূরবী আর ওর মাসি।"

পূরবী নমস্কার করে বললেন, "আমাকে পূরবী বলেই ডাকতে পারেন। আমি চিটাগং ইউনিভার্সিটিতে স্যোসিওলজি পড়াই। আপনাদের ফ্যামিলির কথা অনেক শুনেছি বাবার কাছে। আজ এখানে আসতে পেরে খুব ভালো লাগছে। এসেছি অবশ্য একটা বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে। সত্যিকথা বলতে কি ইন্ডিয়াতেই এই প্রথম এলাম।"

কথায় কথায় পূরবীর ইন্ডিয়া সফরের বিশেষ উদ্দেশ্য জানা গেল। পূরবীর জন্মের দুদিন বাদে ওনার মা মারা যান। তারপর বারীনকাকা একই সঙ্গে মা ও বাবার ভূমিকা পালন করে মেয়েকে মানুষ করেন। অনেকেই দ্বিতীয়বার বিয়ে করার কথা বললেও তিনি রাজি হননি। কিন্তু পূরবীর যখন চোদ্দ বছর বয়স, আচমকা হার্ট আটাকে চলে যান বারীনকাকা। তারপর পিসির কাছে থেকে বড় হন। পিসি ও পিসেমশাই খুবই ভালোমানুষ, নিজের দুই ছেলের সঙ্গে পূরবীকে নিজের মেয়ের মতই মানুষ করেছিলেন। দুই দাদা বিদেশে সেটল করার পর পিসি-পিসেমশাই এখন পূরবীর তত্বাবধানেই থাকেন।

"পিসি-পিসেমশাইকে আমি মা-বাবার মতই দেখি। তবু নিজের মা-র অভাবটা কোনদিন বোধ করিনি তা বলতে পারবনা। আর বাবার কথা ভাবলে মনে হয় এই তো সেদিন। বাবা নিজে জজমানি করতেন। গ্রামে বেশিরিভাগই মুসলিম হলেও বেশ কয়েকঘর হিন্দু আছে। তাদের যেকোন পুজো বা অনুষ্ঠানে বাবার ডাক পড়ত। আর হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সবাই বাবাকে বেশ শ্রদ্ধা করত মনে আছে। বাবার ইচ্ছে ছিল আমি যেন অনেক পড়াশোনা করি, আনেক উঁচু জায়গায় যাই। একদিন মনে আছে মাঝরাত্তিরে ঘুম ভেঙে গেছে। দেখলাম বাবা বাইরের দাওয়ায় চুপ করে বসে আছেন। আমি আস্তে আস্তে বাবার পাশে গিয়ে বসলাম। সেদিন বোধহয় জ্যোৎস্না ছিল। সামনের বাগানটা চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছিল। বাবা আমার মাথাটা কোলে টেনে নিয়ে বললেন, লোকে বলে মানুষ মরে গেলে নাকি আকাশে চলে যায়। সত্যিমিথ্যে জানিনা, তবু মনে হয় যেন তোর মা দেখছে আমি তোকে কিভাবে মানুষ করছি। আমি তো বিশেষ লেখাপড়া করিনি, ঐ পুরুতগিরিটা জানি তাই চালিয়ে নিচ্ছি। তোর মা খুব বই পড়তে ভালোবাসত। তুই যখন পেটে, মা আমাকে বলত, ছেলে মেয়ে যাই হোক না কেন সে যেন অনেক পড়াশুনো করে, ডাক্তার বা বড় অধ্যাপক বা ওরকম কিছু হয়। দেখিস মায়ের স্বপ্ন যেন মিথ্যে না হয়।"

পূরবী একটু থেমে চশমা খুলে শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখটা মুছলেন। সবাই চুপ। তারপর পূরবী নিজেই শুরু করলেন। "আমাদের ভার্সিটিতে রাজু চাকমা বলে একটা ছেলে আছে। গেল বছর ওদের একটা পরবে বন্ধুদের সঙ্গে আমাকেও নেমন্তন্ন করেছিল। ওদের পাহাড়ি গ্রাম, বাড়ি সব ঘুরিয়ে দেখাল। ওর পড়ার টেবিলের সামনেই এক মহিলার অস্পষ্ট ফটো। জানতাম ওরও খুব কমবয়সে মা চলে গেছে। ওকে কিছু জিজ্ঞেস করিনি। কিন্তু তারপর থেকে মনে হল রাজুর তো তবু কিছু আছে, একটা ছবি আছে, হয়ত মনের মধ্যে সযত্নে ঢেকে রাখা কিছু স্মৃতিও আছে। আমার তো সেসব কিছুই নেই। তাই ঠিক করলাম এবার মা-কে খুঁজতে যেতেই হবে।"

"ইন্ডিয়াতে আসার ইচ্ছে অনেকদিনই, কিছুতেই হয়ে ওঠেনা। তবে পিলুদার সঙ্গে যোগাযোগটা ছিল, ও একবার ঢাকায় ঘুরেও এসেছে। এবার একরকম জোর করেই চলে এলাম। এই প্রথম মামারবাড়ি গেলাম। তিন মামার মধ্যে দুজন মারা গেছেন আর ছোটমামার জন্মের আগেই মা-র বিয়ে হয়ে গেছিল। একমাত্র এই মাসিরই মা-র কথা মনে আছে।"
মাসি আমাদের বাড়ির দুটো পুরনো ছবির আলবাম দেখছিলেন। এবার তিনি মুখ খুললেন। "দিদির চেয়ে আমি অনেকটাই ছোট, তবু আমরা খুব বন্ধু ছিলাম । যদিও দুজনের স্বভাব ছিল একেবারে উলটো। আমি ভীষণ দুরন্ত ছিলাম, সবাই বলে। আর দিদি ছিল শান্ত, অঙ্ক করতে খুব ভালোবাসত, সারাদিন বই মুখে নিয়ে বসে থাকত। আমি পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে মিশে বদমায়েসি করে বেড়াতাম আর সেসব খবর বাবার কাছে আসত। বাবা খুব রাগী ছিলেন, কিন্তু দিদিকে খুব ভালোবাসতেন। আমাকে যে দিদি কতবার বাবার হাতে মার খাওয়া থেকে বাঁচিয়েছে তার ঠিক নেই। পূরবীর সঙ্গে কথা বলতে বলতে কত কিছু যে মনে পড়ছে ..."

পিলু বলল "কিন্তু মুশকিলটা হচ্ছে, জেঠিমার কোন ছবি তো পাওয়া যাচ্ছে না। আমার কাছে নেই, পূরবীর মামারবাড়িতেও পাওয়া গেল না। সেইজন্যেই আরো তোর কাছে নিয়ে এলাম। তোদের বাড়িতে তো তখন খুবই যাতায়াত ছিল আর অনেক ছবিও তোলা হত মনে আছে।"
পূরবী বললেন, "বৌদি দুটো আলবাম দিয়েছেন। মাসি দেখছে, আমি তো মা কে চিনতে পারব না।"
বারীনকাকার স্ত্রী, কি নাম ছিল মনে নেই, চেহারাটাও মনে আসছেনা। তবে বারীনকাকার বিয়েতে আমরা সবাই বরযাত্রী গিয়েছিলাম সেকথা বেশ মনে আছে। বললাম, "আর একবছর আগে এলে খুব ভালো হত। কাকিমার কোন ছবি থাকলে মা অবশ্যই জানতেন। মা মারা গেছেন গতবছর।"
পিলু বলল, "তুষারজ্যাঠা মারা গেছেন তিন সালে, না?"
"না, টু থাউজ্যান্ড ফোরের মার্চ।"

পূরবী আমাকে ছোটবেলার দিনগুলোতে ফিরিয়ে দিলেন। মনে পড়ছে সেই সময়ের পরিবেশ, মানুষজন। ছোটবেলায় বাবাকে সেভাবে আমরা পাইনি। বাবা পার্টির কাজে বাইরে ঘুরে বেড়াতেন, সেই আর্থিক অনটনের দিনগুলোয় মা কিভাবে আমাদের সাত ভাইবোনকে মানুষ করেছেন তা এখন ভাবাই যায়না। তখন অবশ্য বাবা-মারা সন্তানদের ভবিষ্যত নিয়ে আজকের মত টেনশন করতেন না। মা রাজনীতি করতেন না, রাজনীতিকে খুব একটা পছন্দও করতেন না। কিন্তু যেকোন কারো বিপদ আপদে সব ফেলে ছুটে যেতেন। প্রায় রোজই এলাকার কোন না কোন মহিলা আসতেন তাঁদের পারিবারিক সমস্যা নিয়ে। মা তাদের বোঝাতেন, কখনও কখনও নিজে তাঁদের বাড়ি গিয়ে সমাধানের চেষ্টা করতেন। মা শিক্ষিত ছিলেন, কলেজেও পড়েছেন, কিন্তু চাকরি করেননি। পাড়ার ছোট ছেলেমেয়েদের পড়াতেন। তাতে কত আর রোজগার হত, বেশীরভাগই তো মাইনে দিতে পারত না। তাতে কি, সকল শিশুই ছিল মায়ের সন্তানের মত। মা আমার জীবনে কি ছিলেন, তা আগে কোনদিন এভাবে অনুভব করিনি। আজ পূরবীর কথা শুনে বুঝতে পারলাম যে আমি কত ভাগ্যবান।

সুতপা সবার জন্য চা, মিষ্টি, সিঙ্গাড়া নিয়ে ঘরে এল। ও বোধহয় ম্যাজিক জানে, এসবের ব্যবস্থা কিভাবে করল কে জানে। আমারই উচিৎ ছিল বাড়ি আসার সময় কিছু নিয়ে আসা। স্মৃতিমন্থনে ডুবে গিয়ে সেসব ভুলেই গিয়েছি। সুতপা বলল, "তুমি আসার আগে বড়দাকে ফোন করেছিলাম। কাকিমা মানে পূরবীদির মার কোন ছবি আছে বলে তো মনে করতে পারলেন না।"

পিলু বলল, "আমার যেন মনে হচ্ছে তুষারজ্যাঠার সঙ্গে জ্যাঠা-জেঠিমার একটা ফটো তোলা হয়েছিল, আমিও ছিলাম সেখানে। আমি অবশ্য তখন খুবই ছোট।"
"আলবামদুটোয় কিছু পেলেন না?" মাসিকে জিজ্ঞাসা করলাম। "অনেক পুরনো ছবি, বেশীরভাগই নষ্ট হয়ে গেছে।"
"এইটা একবার দেখুন তো", মাসি অ্যালবামটা এগিয়ে দিলেন।
ছোট্ট ছবি। দুজন পুরূষের মাঝখানে একজন মহিলা, মহিলার সামনে একটা বাচ্ছা। তবে ছবির বাঁদিকটা প্রায় নষ্ট হয়ে গেছে। ডানদিকের পুরূষটির ওপর আঙুল দেখিয়ে পিলু বলল, "এটা তো জ্যাঠা?"
সেবিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। আর বাঁদিকের পুরূষটি সম্ভবতঃ বাবা। "এটা সিওর আমি", বাচ্ছাটাকে দেখিয়ে বলল পিলু।

পূরবী উত্তেজিত হয়ে বললেন, "তাহলে কি ..."
"মনে তো হচ্ছে ... তবে ছবিটার যা অবস্থা, আপনার বোধহয় খুব একটা লাভ হবেনা" ছবিটা আলবাম থেকে খুলতে খুলতে বললাম।
পূরবী জলভরা চোখে বললেন, "যা পেয়েছি তাই যথেষ্ট। দেখি কোনভাবে রিকভার করা যায় কি না ... আপনাকে যে কি বলে ..."
"কিছুই বলতে হবেনা, শুধু কথা দিন যখনই এদেশে আসবেন আমাদের বাড়ি ঘুরে যাবেন।"

পূরবী কথা দিলেন এবং আমাদেরকেও বাংলাদেশে যাওয়ার জন্য নেমন্তন্ন করলেন। বললেন উনি পরশু ফিরে যাচ্ছেন। আগামীকাল কলকাতাটা একটু ঘুরে দেখবেন।

ওঁদের বিদায় জানিয়ে ঘরে এসে সুতপা জিজ্ঞাসা করল, "ছবিটা কি সত্যিই পূরবীদির মা-র ছিল?"
"নাহ, আমি ভালো করেই জানি ওটা মা-র ছবি। আর বাচ্ছাটাও পিলু নয়, স্বয়ং আমি। তবে পূরবী যদি আমার মা-র মধ্যেই ওঁর মা-কে খুঁজে পান তাহলে ক্ষতি কি?"
সুতপা কিছু না বলে চোখ দিয়ে সমর্থন জানাল। আমি আলবাম দুটো খুলে পাতা ওলটালাম। ধাপ্পাটা আশা করি পূরবী ধরতে পারবেন না।

প্রথম প্রকাশঃ অবকাশ, পুজো ১৪২০

Sunday 29 September 2013

ইচ্ছাপূরণ

সুবলচন্দ্রের ছেলেটির নাম সুশীলচন্দ্র। সকল সময় নামের মত মানুষটি হয়না বটে, কিন্তু ইহাদের ক্ষেত্রে নাম ও স্বভাবের আশ্চর্য্য সাদৃশ্য লক্ষ্য করা গেছে। সুশীলচন্দ্র শান্ত, নম্র ও লেখাপড়ায় অতিশয় মনোযোগী। অপরদিকে বয়সের কারণে নানা আধিব্যাধিতে ব্যতিব্যস্ত হইলেও যৌবনে সুবলচন্দ্র রীতিমত বলশালী ছিলেন। 

সুশীলচন্দ্র ইস্কুলে পড়ে। পড়াশোনায় সে যেমন মেধাবী, খেলাধূলায় তেমনি দড়। বাড়িতে তাহার বন্ধুবান্ধবদের অবারিত দ্বার। আজ সুবলবাবু তাঁহার দৈনন্দিন বৈকালিক আড্ডার পর বাড়ি আসিয়া দেখিলেন সুশীলচন্দ্রের সহিত একটি কিশোরী গল্প করিতেছে। টিউশন ইত্যাদির দৌলতে সুশীলচন্দ্রের বান্ধবীর সংখ্যা নেহাত অল্প নহে। এই মেয়েটিকে অবশ্য আগে দেখেননি। সে সুবলচন্দ্র কে প্রণাম করিয়া বলিল, "কাকু, আমি দামিনী, সুশীলের বন্ধু"। সুবলচন্দ্র তাহার মাথায় হাত রাখিয়া আশীর্বাদ করিলেন বটে কিন্তু তাহার স্কার্টের নীচ দিয়া প্রসারিত শ্বেতশুভ্র পদদ্বয় ও বক্ষের উপর প্রস্ফূটিত নিটোল স্তনযুগলের আভাসে সুবলচন্দ্রের শরীরে কেমন যেন অস্বস্তি হইতে লাগিল। সুশীলের অনেক বান্ধবীকে দেখিয়াই তাঁহার এমন দেহচাঞ্চল্য ঘটিয়া থাকে, তবে আজ আর পারিলেন না। তাড়াতাড়ি শৌচাগারে যাইয়া মনে মনে বলিলেন, "আবার যদি বয়সটা ফিরে পাই তবে মনের সুখে ফূর্তি করতে পারি।" 

ইচ্ছাঠাকরুন সেই সময় ঘরের বাহির দিয়া যাইতেছিলেন। পূর্বের ঘটনাক্রম তাঁহার গোচরে আসিলে কি করিতেন বলা শক্ত। তবে মোবাইল ফোনের টাওয়ার হইতে নির্গত তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গের প্রভাবে দেবতাদের চক্ষু-কর্ণের ব্যাপক ক্ষতি হইয়াছে। তিনি সুবলচন্দ্রের মনের কথাটিই খালি পড়িতে পারিলেন, কিন্তু "ফূর্তি"র সঠিক অর্থ তাঁহার বোধগম্য হইল না। সুবলচন্দ্রকে গিয়া বলিলেন, "তোমার ইচ্ছা পূর্ণ হইবে। কাল হইতে তুমি তোমার ছেলের বয়স পাইবে।"

বয়স হইলেও সুবলচন্দ্রের রাত্রে ঘুম ভালোই হইত। কিন্তু আজ উত্তেজনায় তাঁহার চোখের পাতা এক হইল না। ভোরের দিকে একটু ঘুম আসিয়াছিল। সকালে জাগিয়াই এক লাফ দিয়া মেঝেতে পড়িলেন। দেখিলেন চুল সব কালো হইয়া গেছে, পাকা গোঁফদাড়ির জায়গায় সদ্য ওঠা কচি গোঁফদাড়ি দেখা দিয়ছে, পড়া দাঁত সবগুলি উঠিয়াছে। যে গেঞ্জিটি পরিয়াছিলেন তাহা ঢিলা হইয়া গেছে, পাজামার দড়ি খুলিয়াছে। তাঁহার শরীরের তাজা রক্ত চনমন করিয়া উঠিল। 

সেদিন দামিনী যখন ইস্কুল হইতে ফিরিতেছিল, সুবলচন্দ্র তাহার পথ আটকাইলেন। সুশীলের চেহারা ও কন্ঠস্বরের সহিত ছেলেবেলার সুবলচন্দ্রের বেশ সাদৃশ্য ছিল। পড়ন্ত আলোয় দামিনী সুবলচন্দ্রকে সুশীল বলিয়া ভুল করিল। আগেও কয়েকবার সে ইস্কুল ফেরৎ সুশীলের বাড়ি গিয়াছে। শর্টকার্ট দিয়া বাড়ি যাইবার ছল করিয়া সুবলচন্দ্র তাহাকে হরি ঘোষের গোয়ালের দিকে লইয়া যাইলেন। হরিঘোষের মৃত্যুর পর ছেলেরা এখন কলিকাতাবাসী, তাঁহার বসতবাটি ও বিশাল গোয়াল পরিত্যক্ত পোড়োবাড়ির দশা পাইয়াছে। ফলতঃ দামিনী যখন নিজের ভুল বুঝিতে পারিল তখন চিৎকার করিয়াও কোন লাভ হইল না।

পরদিন ভোররাতে যখন দামিনীর নিরাবরণ, অচেতন দেহ আবিষ্কৃত হইল, সুবলচন্দ্র ততক্ষণে ইচ্ছাঠাকরুনের সাহায্যে নিজের বয়সে প্রত্যাবর্তন করিয়াছেন। দামিনীর মৃত্যুকালীন জবানবন্দী ও অন্যান্য সূত্রের মাধ্যমে কিভাবে সুবলচন্দ্র সনাক্ত হইলেন সে মহাভারত আর বর্ণনা করিলাম না, তবে দামিনীর যৌনাঙ্গের ভিতরে থাকা তাঁহার অতি পরিচিত টর্চটি এব্যাপারে বড় ভূমিকা পালন করিয়াছিল। এই ঘটনা লইয়া দেশজুড়ে শোরগোল পড়িয়া গেল। সংবাদমাধ্যম সরকারকে তুলোধোনা করিতে লাগিল, টেলিভিশনে ঘটনার কাল্পনিক নাট্যরূপ প্রদর্শিত হইল, বিরোধীদল দামিনীকে নিজেদের সমর্থক ও সুবলচন্দ্রকে শাসকদলের কর্মী বলিয়া আন্দোলন শুরু করিল, বিদ্বজনেরা সান্ধ্য বিতর্কে গলা ভাঙ্গিয়া ফেলিলেন, নাগরিক সমাজ সুবলচন্দ্রের ফাঁসির দাবীতে রাস্তায় মোমবাতি মিছিল ও ফেসবুকে লাইকের ঝড় তুলিল। সন্ধ্যাবেলায় দামিনী বাড়ির বাইরে কি করিতেছিল তাহা লইয়া মুখ্যমন্ত্রী সংশয় ব্যক্ত করিলেন এবং এই সামাজিক অবক্ষয়ের পিছনে পূর্বতন সরকারের দায়টা নিঃসংশয়ে ঘোষণা করিলেন।

পুলিসে হেফাজতে থাকাকালীন সুবলচন্দ্র কোন মন্তব্য করেননি। অবশেষে আদালতে শুনানির সময় আস্তিন হইতে তুরুপের তাসটি বাহির হইল। তাঁর আইনজীবি দাবী করিলেন যে ঘটনার সময় সুবলচন্দ্রের বয়স ছিল মাত্র সতের বছর। সরকারি আইনজীবি তার সহকর্মীর মস্তিস্কের সুস্থতা সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করিলে তিনি ইচ্ছাঠাকরুনকে সাক্ষী মানিলেন। ইচ্ছাঠাকরুন ইতিমধ্যে নারদের নিকট সকলই আবগত হইয়াছেন। তিনি নিজের কৃতকর্মের জন্য মাথা ঠুকিতেছেন কি না তা অবশ্য জানা যায়নি।

একুশ শতকে দেবতাদের প্রতিপত্তি বলিতে আর কিছু অবশিষ্ট নাই। মানুষের আদালতের সমন তাঁহারা উপেক্ষা করিতে পারেন না। তাই ইচ্ছেঠাকরুন সাক্ষীর কাঠগড়ায় দাঁড়াইয়া বলিতে বাধ্য হইলেন যে ঘটনার দিন তাঁহার আশীর্বাদে সুবলচন্দ্র সপ্তদশ বয়ঃপ্রাপ্ত হইয়াছিলেন কিন্তু এজন্য তাঁহার প্রাপ্য শাস্তিতে কোন ছাড় দেওয়া অনুচিৎ হইবে। সুবলচন্দ্রের আইনজীবি ধমক দিয়া বলিলেন, "আপনাকে সাক্ষ্য দিতে ডাকা হয়েছে, শাস্তি দেওয়া আদালতের দায়িত্ব।"

আদালত সংবিধানের প্রতি আনুগত্য বজায় রাখিয়া সে দায়িত্ব পালন করিল। দামিনীকে ধর্ষণ ও নৃশংস ভাবে হত্যার জন্য সুবলচন্দ্র দোষী সাব্যাস্ত হইলেও নাবালক হিসেবে তাঁহাকে তিন বছরের জন্য জুভেনাইল হোমে রাখার নির্দেশ দেওয়া হইল। সুবলচন্দ্রের আইনজীবি বলিলেন, ঘটনার সময় নাবালক হইলেও এখন তাঁহার বয়স পঞ্চাশের অধিক। এই বয়সের কোন ব্যক্তিকে কিভাবে জুভেনাইল হোমে রাখা যায়! সবদিক বিবেচনা করিয়া বিচারক সুবলচন্দ্রকে মুক্তি দিলেন। সুবলচন্দ্রের আইনজীবি ফের আবেদন জানাইলেন, অর্বাচীন জনতা আইনের বিচার বুঝিবে না, তাহাদের ক্রোধ হইতে তাঁহার মক্কেলকে নিরাপত্তা দেওয়া হউক। আদালত তাঁহার আর্জি মঞ্জুর করিলেন। জেড প্লাস নিরাপত্তা বলয় লইয়া ঘরে ফিরিলেন সুবলচন্দ্র।

ঋণঃ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
প্রথম প্রকাশঃ লেখালেখি ফেসবুক গ্রুপ

গদাইয়ের প্রতিশোধ

গদাই হচ্ছে এ পাড়ার সবচেয়ে ডানপিটে ছেলে। প্রায় প্রতিদিনই তার বাবার কাছে নানারকম নালিশ জমা পড়ে। কার জানলার কাঁচ ভেঙ্গেছে, কার ছেলেকে ধোলাই দিয়েছে, কার গাছ থেকে জামরুল চুরি করেছে, এই আর কি। আর স্কুলে! সেখানে তো সাতটা ক্লাসের মধ্যে চারতেতেই গদাইকে কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়।
সেদিন তো এক কাণ্ডই হয়ে গেল। গদাইয়ের অঙ্কের মাস্টারমশাই হচ্ছেন ছাত্রদের কাছে সাক্ষাৎ যম। তিনি যত না অঙ্ক ভালোবাসেন তার চেয়ে বেশী ভালোবাসেন পেটাতে।। এমন কি ক্লাস টুয়েলভের ছাত্ররাও তাঁরা হাত থেকে রেহাই পায় না। তার নাম গোবিন্দ চ্যাটার্জি হলেও গবু নামেই তিনি অধিক পরিচিত।
তা সেদিন গবু স্যারের কাছে গদাই বেধরক পেটানি খেল। সে এমন কিছু করেনি, খালি গণেশের সাদা জামাটা দেখতে বাজে লাগছিল বলে সেখানে পেন দিয়ে একটা হাতি এঁকে দিয়েছিল, কেষ্টর ব্যাগে দুটো জ্যান্ত আরশোলা ঢুকিয়ে দিয়েছিল আর গোবরের পেছনে একটা কাগজের ল্যাজ লাগিয়ে দিয়েছিল।
এই সামান্য কাজের জন্য তাকে পেটানোয় আর পরদিন বাবাকে ডেকে সব বলে দেওয়ায় গদাই ভারি অপমানিত বোধ করেছিল। তাছাড়া ওরাও তো গদাইএর চেয়ে ভালো কাজ কিছু করেনি! ক্লাস না করে মাঠে ফুটবল খেলছিল বলে গোবর যে স্যারকে বলে দিল? সংস্কৃত ক্লাসে ধাতুরূপ মুখস্থ বলে কেষ্ট যে গদাইকে কানমলা খাওয়াল? গদাই যে ধাতুরূপ পড়েনি তা কি ও জানত না! আর গনেশের জামায় ছবি আঁকায় তো সুন্দরই লাগছিল!
তবু কেন গদাইএর ওপর সব দোষ পড়ে? নাহ, এর একটা বিহিত না করলেই নয়। গবু স্যারের ওপরই প্রথম শোধটা নিতে হবে।
একবার সে সাইকেলের পাম্প খুলে রাখল। কিন্তু ওদের ক্লাসেরই এক বিশ্বাসঘাতক ছেলে দেখে ফেলল আর গদাই আগের বারের দ্বিগুন মার খেল হেডস্যারের কাছে। নাহ, এভাবে কিছু হবে না। অন্য ফন্দী আঁটতে হবে।

আজ সকাল থেকেই গোবিন্দবাবুর মেজাজটা বেশ ভালো ছিল। প্রথমতঃ বর্ধমান থেকে তাঁর ভাগনে এসেছিল। সঙ্গে বাক্সভর্তি সীতাভোগ-মিহিদানা। এদুটোই গোবিন্দবাবুর প্রিয় খাবার। তার ওপর পড়তে আসা চার-চারজন ছাত্রকে তিনি মনের সুখে ঠেঙাতে পেরেছেন। যেদিন তার মেজাজ ভালো থাকে সেদিন তিনি ছেলের মাথায় গাঁট্টা মারেন, মেয়ের কান মলে দেন আর বৌএর সঙ্গে ঝগড়া করেন। আজও তার ব্যতিক্রম হল না। ঝগড়া টগড়া করে, পাঁঠার মাঙ্গস দিয়ে ভাত খেয়ে পান চিবোতে চিবোতে বেরোতে যাচ্ছেন আর তক্ষুনি "ক্রিং ... ক্রিং...", ফোনটা বেজে উঠল-
"হ্যালো?"
"মিস্টার গোবিন্দ চ্যাটার্জি আছেন?"
"কথা বলছি"
"আমি টেলিফোন অফিস থেকে বলছি। আপনার প্রথম টেলিফোন বিলটা নিয়ে দুপুর আড়াইটের মধ্যে এখানে চলে আসুন। নয়ত টেলিফোনের লাইন তো কাটা যাবেই তার ওপর দশ হাজার টাকা জরিমানা হবে"
"কেন কেন? কি ব্যাপার? ... হ্যালো হ্যালো ..."
গোবিন্দবাবু টেলিফোন নিয়েছেন সাত বছর হল। সাত বছর আগের বিল খুঁজে পাওয়া কি সোজা কথা! কিন্তু খুঁজতে তো হবেই, নইলে দশ হাজার টাকা নিয়ে নেবে! চারতে প্রাণী মিলে বিসাল পৈতৃক বাড়িতে তন্ন তন্ন করে টেলিফোনের বিল খুঁজতে লাগলেন। কত কিছুই বেরোল, গোবিন্দবাবুর ফিফথ ক্লাস থেকে ফোর্থ ক্লাসে ওঠার রেজাল্ট, স্কুল পালিয়ে দেখা সিনেমার টিকিট, বাবা-মার বিয়ের কার্ড, পাঁচ বছর আগে হারানো গিন্নীর সোনার দুল, বাড়ির বিভিন্ন জায়গা থেকে মোট তেইশ টাকা পঁইয়ষট্টি পয়সা আর ... না থাক আর তালিকা বাড়িয়ে কাজ নেই।
শেষ পর্যন্ত প্রত্যাশিত বস্তুটি পাওয়া গেল ২টো বেজে পঁচিশে। আবিষ্কারক গোবিন্দবাবুর মেয়ে।
তাঁর বাড়ি থেকে টেলিফোন অফিস যেতে পনের-কুড়ি মিনিট লাগে। ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন ঝড়ের বেগে আর ফিরে এলেন আধঘন্টার মধ্যেই।
এসে বোমার মতই ফেটে পড়লেন। "কোন শয়তান এটা করল আমি তাকে দেখে নেব ... ওখানে বলে কি না, 'কে আপনাকে ফোন করেছিল? স্বপ্ন দেখেছেন!' ... হুঁহঃ"
বাইরে তখন হাসিতে গরাগড়ি যাচ্ছে গদাই আর তার সাঙ্গোপাঙ্গোরা।


হাত পাকাবার আসর, সন্দেশ (চৈত্র ১৪০৭) এ প্রকাশিত

Friday 9 August 2013

অনন্ত মৃগয়া

                জন্মলগ্ন থেকে মানুষ ছুটে বেড়িয়েছে কিছু স্বপ্নের পেছনে, কখনও তা ধরা দিয়েছে, কখনও বা দূরে সরে গেছে। মানুষ দিকভ্রান্ত হয়ে ঘুরে মরেছে, আবার ধাওয়া করেছে নতুন স্বপ্নের সন্ধানে। স্বপ্নকেই মৃগয়া করতে বেরিয়েছে সে। কি সেই স্বপ্ন? “হরেক রকম স্বপ্ন আছে আশা কিম্বা নিরাশার / জন্মভূমি মুক্ত করার কিম্বা প্রিয় প্রেমিকার” । দোর্দন্ডপ্রতাপ জমিদার সুদর্শন সিংহরায়ের নজরে থাকা প্রেমিকার সাথে ঘর বাধার যে স্বপ্ন নিয়ে প্রাণ হারায় চন্দ্রকান্ত পণ্ডিত। যে স্বপ্নের তাড়ায় দেশের স্বাধীনতার যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল অরিজিৎ, যে স্বপ্নের খোঁজে সিংহগড় ছেড়ে জনতার মাঝে চলে গিয়েছিল প্রিয়ব্রত, নিরক্ষর হয়েও প্রগাঢ় জ্ঞানী পরীক্ষিত বাউরি হয়ে উঠেছিল তেভাগা ও জলডুবি আন্দোলনের কিংবদন্তী। পাগল শিকারি স্বপ্ন দেখে চলে সুধন্য নামে তার এক বংশধর দুনিয়ার অনাচার দূর করবে। গান্ধীজি ও শত শত স্বাধীনতা সংগ্রামীর স্বপ্ন বিস্মিত না হবার অপরাধে দলে আপাংক্তেয় হয়ে পড়েন কংগ্রেস নেতা অনাথ রায়। নিজেদের উজ্জ্বল কেরিয়ার উপেক্ষা করে সরকারি চাকরি করতে গ্রামে আসে বুদ্ধদেব, অমলজ্যোতি। তেভাগা আন্দোলন নিয়ে গবেষণা করতে করতে নকশালবাড়ির সশস্ত্র বিপ্লবের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে সুরঞ্জনা। শ্রেণিহীন সমাজের চিরনবীন স্বপ্নে উদ্বুদ্ধ সুকুমার আচার্য্য দেখে শিব গড়তে গিয়ে তারা গড়ে ফেলেছে শোষণমূলক ব্যবস্থার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়া একটা বানর, যার নাম বামফ্রন্ট সরকার। সে স্বপ্ন দেখতে দেখতে পথভ্রষ্ট হয়ে পড়ে গোরাচাঁদ, বাঁশি বাউরি। বিরোধীদের, বুর্জোয়া, জমিদারদের বিদ্রুপ করে কবিতা লিখতে লিখতে চারণকবি চন্দন দাস আবিষ্কার করে নিজের অজান্তেই তার বিদ্রুপের বর্শামুখ ঘুরে গেছে নিজের পার্টির দিকেই।

               মানব সভ্যতার ইতিহাস আসলে দ্বন্দ্বের ইতিহাস।

গতির সঙ্গে স্থবিরত্বের, বিজ্ঞানের সঙ্গে অন্ধবিশ্বাসের, সমস্টিস্বার্থের সঙ্গে ব্যক্তিস্বার্থের। এ দ্বন্দ্ব যেমন চলে সমাজের মধ্যে, তেমনই ব্যক্তি মানুষের নিজের ভিতরেও।
সে স্বপ্ন দেখে, স্বপ্নভঙ্গ হয়, তবু আবার স্বপ্ন দেখে। এভাবেই এগোতে থাকে সমাজ, পৃথিবী। অগ্রগতি সরলরেখায় হয় না, থাকে নানা বাঁক, উত্থান, পতন, বিপ্লব, প্রতিবিপ্লব। দেশকাল ভেদে এই দ্বন্দ্ব ও আগ্রগতির চরিত্র বদলায়, কিন্তু বৃহত্তর সময় ও জগত থেকে বিচ্ছিন্ন হয় না। ভগীরথ মিশ্রের “মৃগয়া” উপন্যাসের ঘটনাস্থল বাঁকুড়ার চূয়ামসিনা গ্রাম। কিন্তু এখানে উঠে এসেছে গত একশতকে গ্রামবাংলার সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিবর্তনের খণ্ডচিত্র। স্বাধীনতার আগে ঔপনিবেশিক যুগে গ্রামসমাজ ও জমিদারতন্ত্রের দ্বন্দ্ব, স্বাধীনতার লড়াই, বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে দেশীয় সামন্ততন্ত্রের অম্লমধুর সম্পর্ক থেকে স্বাধীন ভারতে উদীয়মান দেশীয় বণিকশ্রেণি ও রাজনৈতিক দলের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ক্ষয়িষ্ণু জমিদারতন্ত্রের টিকে থাকার লড়াই ফুটে উঠেছে সিংহরায় জমিদার পরিবারটির মাধ্যমে। প্রবল অত্যাচারী সুদর্শন সিংহরায়, তার মেয়ে লাবণ্য, জামাই শংকরপ্রসাদ, মধ্যস্বত্বভোগ নয়, যার বিশ্বাস ছিল কর্মযোগে, আর নাতি প্রিয়ব্রত, উচ্চবর্ণ ও জমিদারি প্রথার বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃণা নিয়ে যে জড়িয়ে পড়েছিল প্রথমে স্বদেশী ও পরে তেভাগা আন্দোলনে, এরা সবাই প্রতিনিধিত্ব করেছে একটা সময়ের। হরবল্লভ ও কণকপ্রভা ক্ষয়িষ্ণু জমিদারতন্ত্রের দুই অংশের প্রতিনিধি। একটা অংশ বণিকতন্ত্র ও সংসদীয় গণতন্ত্রের সঙ্গে সমঝোতা করে নিজেদের প্রতিপত্তি কিছুটা হলেও বজায় রাখতে পারল আরেকটা অংশ বাস্তবের সাথে তাল মেলাতে না পেরে পরাস্ত হল। সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রাম, খাদ্য আন্দোলন, জমির লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে শ্রমিক-কৃষকের রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে উঠে এল কমিউনিস্ট পার্টি। যুক্তফ্রন্ট সরকার, নকশাল আন্দোলন, জরুরী অবস্থা ও আধা-ফ্যাসিবাদী সন্ত্রাসে উত্তাল হয়ে উঠল ৭০এর দশক। বিপুল প্রত্যাশা নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হল বামফ্রন্ট সরকার। অপারেশন বর্গা ও ত্রিস্তর পঞ্চায়েতের ধাক্কায় শেষ হতে চলল সামন্ততন্ত্রের অবশিষ্ট প্রভাব। কিন্ত পুরানো শোষকরা ইতিমধ্যে শিবির পরিবর্তন করেছে। হরবল্লভের পুত্র দেবীদাস হয়ে উঠল পার্টির মস্ত বড় নেতা। বাবা ভৈরবেশ্বরের থানকে কেন্দ্র করে জমজমাট হয়ে উঠল চূয়ামসিনা। গ্রামে বসল ভিডিও পার্লার, মদের ঠেক। দলতন্ত্র ও দূর্নীতি গ্রাস করল জীবনকে। তীব্র হল পার্টির আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব। এদিকে দ্রুত পাল্টাতে লাগল দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি। হিন্দু মৌলবাদী শক্তির উত্থানে বিপন্ন হল বহুত্ববাদী সংস্কৃতি। এসবের মধ্যেই স্রোতের বিরুদ্ধে লড়ে চলল সুকুমার আচার্য্য, তিলক বাউরি, হঠাৎ মুর্মূ, মকবুলরা, তাদের অধরা স্বপ্নের সন্ধানে।
               এই পটভূমিতেই এসেছে অরিজিৎ, লাবণ্য, কুন্তী, বুদ্ধদেব, অগ্নি, গোরাচাঁদের মত কতকগুলো বিচিত্র চরিত্র ও তাদের দ্বন্দ্ব, ভালবাসা, স্বপ্ন, স্বপ্নভঙ্গের কাহিনী। সে কাহিনী জানতে হলে পড়তেই হবে উপন্যাসটি।
প্রথম প্রকাশঃ পাঠাগার ব্লগ
পুনঃপ্রকাশঃ চর্যাপদ 

Sunday 23 June 2013

এই মিছিল


এই প্রথম মিছিলে হাঁটলাম। এই প্রথম সম্মিলিত প্রতিবাদের ঢেউয়ে রেজোন্যান্স হল। এই প্রথম হাজারো মানুষের ভিড়ে খুঁজে ফিরলাম নিজেকে।

এই মিছিল ছিল কামদুনির কলেজে পড়া হতভাগা মেয়েটার জন্য। এই মিছিল ছিল গাইঘাটার ধর্ষিতা শিশুটার জন্য। এই মিছিল ছিল দিল্লীর দামিনীর জন্য। এই মিছিল ছিল শারীরিক ধর্ষণের পরও বারবার সামাজিকভাবে ধর্ষিত হওয়া পার্ক স্ট্রীটের সুজেটের জন্য। এই মিছিল ছিল সিঙ্গুরের তাপসী মালিক, নন্দীগ্রামের রাধারাণী আড়ি, বানতলার অনীতা দেওয়ানের জন্য। এই মিছিল ছিল কাশ্মীর, মণিপুর, ছত্তিশগড়ে "নিরাপত্তা বাহিনী"র হাতে প্রাণ ও ইজ্জত খোয়ানো মা-বোনদের জন্য। এই মিছিল ছিল গুজরাটে মোদীবাহিনীর হাতে ধর্ষিতা মহিলাদের জন্য।

এই মিছিলে ছিল সেই মেয়েটা, যে রোজ পুরূষের লোভী দৃষ্টি ও কামুক হাতের নাগাল দিয়ে যাতায়াত করে। এই মিছিলে ছিল সেই বউটা, প্রতিরাতে যাকে দাম্পত্যের নামে ধর্ষিতা হতে হয়। এই মিছিলে ছিল সেই শিশুটা, সুযোগ পেলেই যার বাবা-কাকা-দাদা রা শরীরে হাত বুলোয়। এই মিছিলে ছিল সেই ছেলেটা, "মেয়েলি" হওয়ার অপরাধে যাকে বন্ধুরা টিটকিরি দেয়, আর সেই মেয়েটা, "পুরূষালি" ভাবের জন্য যার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের অবস্থান নিয়ে খবরের কাগজে গবেষণা চলে। এই মিছিলে ছিল সেই ছেলেটা যে তার ছেলেবন্ধুকে ভালবাসে আর সেই মেয়েটা যে তার মেয়েবন্ধুর সঙ্গে ঘর বাঁধতে চায়। এই মিছিলে ছিল সেই মেয়েটা, যাকে রোজ মুখে রঙ মেখে খদ্দেরের জন্য রাস্তায় দাঁড়াতে হয় পেটের দায়ে।

এই মিছিল মানে গলার শির ফুলিয়ে স্লোগান আর গলায় পোস্টার ঝুলিয়ে চুপচাপ হেঁটে যাওয়া। এই মিছিল মানে লাঠিহাতে বৃদ্ধ আর ব্যাগকাঁধে অফিসফেরতা কেরানী। এই মিছিল মানে নিরাপত্তার দাবী, এই মিছিল মানে সংবেদনশীলতার দাবী। এই মিছিল মানে ইনকিলাব জিন্দাবাদের পাশে সমকাম চুম্বনের ছবি। এই মিছিল মানে বঙ্কিমচন্দ্রের বাণী আর সলিল চৌধুরীর শপথ। এই মিছিলে হাঁটেন কন্ঠে গণসঙ্গীতের সুর, চোখে বিপ্লবের স্বপ্নমাখা রবিঠাকুর।

এই মিছিল কোন রাজনৈতিক দল ডাকেনি। এই মিছিলে কোন রাজনৈতিক দলের পতাকা ছিল না। এই মিছিলে কোন রাজনৈতিক নেতা নেতৃত্ব দেয়নি। এই মিছিলের জন্য কেউ গ্রামে গঞ্জে বাস-ট্রাক পাঠায়নি। তবু এই মিছিল ছিল পুরোদস্তুর রাজনৈতিক। কারণ রাজনীতিটা কোন নেতানেত্রীর ব্যক্তিগত জমিদারি নয়। কারণ রাজনীতিটা কোন দলের খিড়কির উঠোন নয়। কারণ রাজনীতিটা কোন কর্পোরেট মিডিয়ার জ্ঞান বিতরণের পাঠশালা নয়। রাজনীতিটা মানুষের, রাজনীতিটা মানুষের জন্য, রাজনীতিটা হবে মানুষের দ্বারা।


যারা ধর্ষণকে সাজানো ঘটনা বলে, প্রতিবাদীদের চোখ রাঙায়, যারা "ক্ষতিপুরণ" দিয়ে মুখ বন্ধ করতে চায়, যারা ভোটের জন্য মস্তান পোষে, এই মিছিল তাদের গালে একটা থাপ্পর। যারা ধর্ষিতার চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলে, যারা খাটো জামাকে ধর্ষণের কারণ হিসেবে তুলে ধরতে চায়, যারা মেয়েদের রাতবিরেতে না বেরোতে পরামর্শ দেয়, এই মিছিল তাদের গালে একটা থাপ্পর। যারা রাস্তার আন্দোলনকে মেঠো রাজনীতি বলে ব্যঙ্গ করে, যারা রাজনীতিকে মার্কিন মুলুকের মত টিভির টক শো তে পরিণত করতে চায়, এই মিছিল তাদের গালে একটা থাপ্পর। যারা কামদুনি নিয়ে চিৎকার করে, অথচ বানতলার কথা শুনলেই পেছন চুলকোয়, এই মিছিল তাদের গালেও একটা থাপ্পর।

এই মিছিল স্যালুট জানায় টুম্পা কয়ালের অকুতোভয় প্রতিবাদকে। এই মিছিল স্যালুট করে "ক্ষতিপুরণে"র টাকা প্রত্যাখ্যান করা ধর্ষিতার পরিবারগুলিকে। এই মিছিল স্যালুট করে ক্ষমতার দম্ভের বিরুদ্ধে সুজেটের লড়াইকে। এই মিছিল স্যালুট করে নন্দীগ্রাম, লালগড়ের লড়াকু মহিলাদের। এই মিছিল স্যালুট জানায় মণিপুরী মায়েদের নগ্ন প্রতিবাদকে। এই মিছিল মাথা নত করে একযুগ ধরে অনশনরত শর্মিলা চানুর সামনে।

এই মিছিল মানে সম অধিকারের দাবী, এই মিছিল মানে সম মর্যাদার দাবী। এই মিছিল দেখায় প্রতিবাদের পথ। এই মিছিল আনে সুন্দর ভবিষ্যতের স্বপ্ন। 

"প্রতিভা আর যশোদা মার রক্ত বীজ এই মিছিল,
 স্বামীহারা অনাথিনীর চোখের জল এই মিছিল; 
শিশুহারা মাতাপিতার অভিশাপের এই মিছিল, 
এই মিছিল সব হারায় সব পাওয়ার এই মিছিল।"



(ঋণঃ সলিল চৌধুরী)


রাজ্যজুড়ে নারী নির্যাতন, ধর্ষণ এবং প্রশাসন ও শাসকদলের কর্তাদের পক্ষ থেকে অপরাধীদের আড়াল করার চেষ্টার প্রতিবাদে ২০১৩ সালের ২১শে জুন কলকাতায় যেঁ মহামিছিল হয়েছিল সেই প্রসঙ্গেই এই লেখা। প্রথম প্রকাশঃ চর্যাপদ

Saturday 1 June 2013

একশো বছরে সন্দেশ


আমাদের বাড়িতে পিওন চিঠি বিলি করতে আসত বিকেল চারটের সময়। আমি স্কুল থেকে ফিরতাম মোটামুটি সাড়ে চারটেয় আর স্কুল থেকে ফিরে প্রথম কাজটাই ছিল কি কি চিঠি এসেছে খোঁজ করা, বিশেষ করে মাসের প্রথমদিকে। রোজই বাবার নামে প্রচুর চিঠিপত্র আসত, সেসব হাঁটকে আমি খুঁজতাম একটা দুভাঁজ করা পত্রিকা, গায়ে জড়ানো একফালি ব্রাউন কাগজ, যাতে লেখা থাকত, "অতনু কুমার, গ্রাহক সংখ্যা ৩৫০০, প্রযত্নে..."। বলা বাহুল্য বেশীরভাগ দিনই নিরাশ হতে হত; কখনও কখনও দুমাস বা তিনমাস অপেক্ষার পর তার দেখা পেতাম, যদিও মলাটের ওপর জ্বলজ্বল করত "ছোটদের সেরা মাসিকপত্র"। পুজোসংখ্যাটা আসত রেজিস্ট্রি ডাকে, সই করে নিতে হত। "বিশেষ সংখ্যা রেজিস্ট্রি ডাকে, সাধারণ সংখ্যা সাধারণ ডাকে", গ্রাহক চাঁদা ১৮০ টাকা। মেজপিসি আমাদের বাড়ির আরো অন্য অনেকের সঙ্গে প্রথমে দাদাকে, পরে আমাকে "সন্দেশে"র গ্রাহক করে দিয়েছিল। সেই শুরু, তারপর আর সন্দেশকে ছাড়তে পারিনি। এখন অবশ্য আর গ্রাহক নই, কিন্তু যাতায়াতের পথে স্টেশনের বুকস্টলটায় খেয়াল রাখি, নতুন সন্দেশ এলেই যাতে তুলে নেওয়া যায়, আর কোন সংখ্যা মিস হলে বইমেলার স্টল থেকে নিয়ে নিই। সেই সন্দেশ আজ একশো বছর পূর্ণ করল। এই অবকাশে ধূলো ঝেড়ে পুরনো সন্দেশ ঘাঁটতে বসলাম। কেননা পুরনো সন্দেশ তো নতুনের চেয়েও মিষ্টি! 


আজ থেকে দেড়শো বছর আগে, রবীন্দ্রনাথের চেয়ে ২ বছরের ছোট  কামদারঞ্জন রায়ের জন্ম হয় ময়মনসিংহের মসুয়া গ্রামে। ময়মনসিংহেরই জমিদার হরিকিশোর রায়চৌধুরী তাঁকে দত্তক নিয়ে নতুন নাম দেন উপেন্দ্রকিশোর। এন্ট্রান্স পাস করে তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়তে কলকাতায় আসেন। সেই সময়ের কলকাতা ছিল চাঁদের হাট, বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র, গিরিশ ঘোষরা তখনও বিদায় নেননি, তার সঙ্গে উঠে আসছেন নতুন তারকারা, রবীন্দ্রনাথ, জগদীশচন্দ্র, প্রফুল্লচন্দ্র, আরো কতজন। গ্রামে থাকতেই বোঝা গিয়েছিল উপেন্দ্রকিশোর সাধারণ ছেলে নন, কিন্তু কলকাতার আবহাওয়া তাঁর প্রতিভার পূর্ণ বিকাশের রাস্তা খুলে দেয়। একদিকে "সখা", "মুকুল" প্রভৃতি ছোটদের পত্রিকায় লেখা, আঁকা, অন্যদিকে ব্রাহ্ম আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ, ব্রাহ্মসঙ্গীত লেখা ও সুর দেওয়া - অচিরেই বাংলার নবজাগরণের অন্যতম চরিত্র হয়ে উঠলেন উপেন্দ্রকিশোর। শুধু শিল্প-সঙ্গীতে নয়, তাঁর সমান আগ্রহ ছিল বিজ্ঞান ও কারিগরি বিদ্যায়, বিশেষতঃ মুদ্রণশিল্প ও ফটোগ্রাফিতে। যোগীন্দ্রনাথ সরকারের সিটি বুক স্যোসাইটি থেকে প্রকাশিত "ছেলেদের মহাভারত" আর "ছেলেদের রামায়ণ" বইদুটোতে তাঁর নিজের আঁকা ছবিগুলোর দুর্দশা দেখে তিনি ঠিক করলেন নিজেই মুদ্রণ প্রযুক্তি নিয়ে চর্চা করবেন। লন্ডনের "পেনরোজ অ্যান্ড কোম্পানি" থেকে আধুনিক যন্ত্রপাতি নিয়ে এসে সুকিয়া স্ট্রীটের বাড়িতে "ইউ রায় আন্ড সন্স" নামে ছাপাখানা খুললেন। "হাফটোন ফটোগ্রাফি ও প্রিন্ট" নিয়ে গবেষণা চালিয়ে শুধু পদ্ধতিটার উন্নতি করলেন তাই নয়, এবিষয়ে সুনির্দিষ্ট বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব তুলে ধরলেন, যা এতদিন ছিল না।[১-৩]
     ১৩২০ সনের (১৯১৩ সাল) পয়লা বৈশাখ ইউ রায় আন্ড সন্স থেকেই প্রকাশিত হয় "ছেলেমেয়েদের সচিত্র মাসিকপত্র" সন্দেশের প্রথম সংখ্যা। সম্পাদক উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী, বি-এ। প্রথম পৃষ্ঠাতে সন্দেশের আগমনবার্তা জানিয়ে জ্যোতির্ময়ী দেবী লেখেন,
"নূতন বরষে ভাই আমাদের ঘরে,
সন্দেশ এসেছে আজ নব সাজ প'রে।
ডাকিয়া লইব তারে আদরে সবাই,
হাসিমুখে ত্বরা করে আয় তোরা ভাই।..."
"সন্দেশের কথা"য় বলা হয়েছিল, 
"... আমরা যে সন্দেশ খাই, তাহার দুটি গুণ আছে। উহা খাইতে ভাল লাগে আর উহাতে শরীরে বল হয়। আমাদের এই যে পত্রিকাখানি 'সন্দেশ ' নাম লইয়া আজ সকলের নিকট উপস্থিত হইতেছে, ইহাতেও যদি এই দুটি গুণ থাকে, -অর্থাৎ ইহা পড়িয়া সকলের ভাল লাগে আর কিছু উপকার হয় তবেই ইহার 'সন্দেশ' নাম সার্থক হইবে।" 
সেই অনুযায়ী ছড়া, কবিতা, পুরাণ ও  দেশবিদেশের গল্প, অনুবাদ, বিজ্ঞান, মহাকাশের কথা, জীনজন্তু, ভ্রমণকাহিনী, মনিষীদের জীবনকথা, ধাঁধা ইত্যাদিতে ভরে উঠল সন্দেশের পাতা। "সংবাদ" শিরোনামে পৃথিবীর নানা মজার ঘটনার খবর থাকত।  আর ছিল  রঙিন ও সাদাকালো প্রচুর ছবি। খগেন্দ্রনাথ মিত্র লিখেছেন,
 "...'সন্দেশে'র" বিষয়বস্তুতে নতুনত্ব ছিল না। ... কিন্তু রচনায়, পরিবেশনে, সাজসজ্জায়, ছাপায় 'সন্দেশ' ছিল অতুলনীয়। ছবিগুলি সূক্ষ্মরেখায় অঙ্কিত  হত যা পূর্বের ছবিগুলিতে দেখা যায় না। বিজ্ঞান, রসসাহিত্য ও চিত্রশিল্প - এই তিন মিলিয়ে নিপুণ হাতে 'সন্দেশ' তৈরী হত। ..." [৪] 
রায়পরিবারের সদস্যদের লেখায় লেখকের নাম থাকত না। অন্যান্য লেখকদের মধ্যে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, শিবনাথ শাস্ত্রী, প্রিয়ম্বদা দেবী, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কালিদাস রায়, অতুলপ্রসাদ সেন, প্রমথ চৌধুরী প্রমুখ। বেশীরভাগ লেখা ও আঁকা ছিল উপেন্দ্রকিশোরের। সন্দেশ প্রকাশের কয়েকমাস পরেই দেশে ফেরেন সুকুমার। তাঁর "আবোল তাবোল" ও অন্যান্য লেখা, ছবিসমেত সন্দেশেই প্রথম বেরোয়। জরীপের কাজে বন-জঙ্গলে ঘোরার সুবাদে রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার গল্প নিয়ে ধারাবাহিকভাবে ছাপা হত প্রমদারঞ্জন রায়ের "বনের খবর"।

 
দ্বিতীয় সংখ্যায় ইংল্যান্ডের রাজা পঞ্চম জর্জের জন্মদিন উপলক্ষে লেখা হয়, "ভগবানের নিকট প্রার্থনা করি , আমাদের প্রিয় সম্রাট দীর্ঘজীবী হইয়া আরো অনেক বৎসর সুখে রাজ্য ভোগ করুন" বাঙালী জর্জসাহেবকে "প্রিয় সম্রাট" বলে আহ্লাদ করত কি না সে বিষয়ে অবশ্য সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। এই বাঙালীদের বেআদবীতে অতিষ্ঠ হয়েই তো জর্জসাহেবের পেয়াদারা বছর আষ্টেক আগে দেশটাকে টুকরো করার চেষ্টা করেছিল, মাত্র দুবছর আগে তারা রণে ভঙ্গ দেয়। ইতিমধ্যে কিংসফোর্ডকে মারতে গিয়ে প্রাণ দিয়েছেন ক্ষুদিরাম, প্রফুল্ল চাকী, আলিপুর বোমা মামলায় কানাইলাল দত্তের ফাঁসি হয়েছে। বছর দুয়েক বাদেই বুড়িবালামের যুদ্ধে শহীদ হবেন বাঘাযতীন। কিন্ত তৎকালীন বাংলার নবজাগরণের প্রাণপুরূষরা অনেকেই ব্রিটিশ শাসনকে ভারতের পক্ষে আশীর্বাদস্বরূপ মনে করতেন। এমনকি জর্জসাহেব ভারতে এলে, তাকে প্রশস্তি করে গান গাওয়া হয় জাতীয় কংগ্রেসের কলকাতা অধিবেশনে। তাই সন্দেশের পাতায় এহেন রাজবন্দনায় খারাপ লাগলেও অবাক হবার কিছু নেই।
সন্দেশের আড়াই বছর বয়সে উপেন্দ্রকিশোরের মৃত্যুর পর "ইউ রায় অ্যান্ড সন্স" এবং সন্দেশের দায়িত্ব নেন সুকুমার। সুকুমারের হাতে পড়ে সন্দেশের চরিত্র খানিকটা বদলে যায়। 
"উপেন্দ্রকিশোর বিশেষ করে যে বয়সের পাঠকদের কথা চিন্তা করতেন, গড়ে তারা বড়জোর ১০/১২ বছরের বালক। কিন্ত সুকুমারের সম্পাদনায় ওই বয়সের ছেলেমেয়েদের পাঠ্য যথেষ্ট থাকলেও ১৫/১৬ বছরের পাঠকরাও প্রচুর চিন্তার খোরাক পেত।" [২] 
১৯২৩ সালে মাত্র ছত্রিশ বছরে মৃত্যুর আগে পৌনে আট বছর সন্দেশের সম্পাদনা করেছেন সুকুমার। সুকুমার রায় কে নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। বাঙালী যতদিন থাকবে, সুকুমার পুরানো হবেন না। আবোল তাবোল, খাই খাই, হযবরল ছাড়াও অজস্র ছোটগল্প, কবিতা, নাটক, জীবনকথা, বিজ্ঞান রচনা, ধাঁধা তিনি সন্দেশে লিখেছেন এই কটা বছরে। প্রায় সমস্ত ছবিই তিনিই আঁকতেন। সম্পাদনার কাজে তাঁকে সাহায্য করতেন বিশেষ করে কাকা কুলদারঞ্জন ও ভাই সুবিনয়। তাছাড়া অন্য পাঁচ ভাইবোন সুখলতা, পুণ্যলতা, সুবিমল আর শান্তিলতাও নিয়মিত লিখতেন সন্দেশে। এই সময়ে সম্পাদক ছাড়া সকলের লেখাতেই নাম ছাপা হত। সুকুমারের মৃত্যুর পর সুবিনয় রায় সম্পাদক হলেন।
 "সুবিনয় রায়ের সম্পাদনায় সন্দেশে আরো বেশী সংখ্যক বিজ্ঞান ও প্রকৃতি বিজ্ঞানের সরস সচিত্র প্রবন্ধ পাওয়া গেল। এই সময়ে প্রকাশিত ধাঁধা আর প্রতিযোগিতাগুলি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তবু এই সার্থকনামা সন্দেশ পত্রিকার প্রকাশ বন্ধ করে দিতে হল। কারণ ব্যবসায়িক কারণে ইউ রায় অ্যান্ড সন্স নামে বিখ্যাত প্রকাশনা সংস্থা  বন্ধ হয়ে গেল।"[৫]

   
সন্দেশ উঠে যাওয়াতে লেখক ও পাঠকরা খুবই দুঃখিত হয়েছিলেন আর সম্ভবতঃ সেটা বুঝতে পেরেই "ইউ রায় অ্যান্ড সন্সের" নতুন মালিকরা সন্দেশ আবার বের করার সিদ্ধান্ত নেন। পাঁচ বছর বন্ধ থাকার পর সুবিনয় রায়ের সঙ্গে সুধাবিন্দু বিশ্বাসের যুগ্ম সম্পাদনায় নবপর্যায়ের সন্দেশের প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয় ১৩৩৮ সনের (১৯৩১ সাল) আশ্বিন মাসে। উপেন্দ্রকিশোরের সন্দেশের অনুরাগী পাঠক ছিলেন কবি সুনির্মল বসু। নতুন সন্দেশের প্রথম পাতার কবিতাটা তিনিই লিখলেনঃ
"সন্দেশ এলো ফের, --মন খুশি খবরে--
সেই চিরপুরাতন--তবু অভিনব রে!
  সন্দেশ, সন্দেশ,--
ছিলি তুই কোন্ দেশ ?
এ যে রে মোহন বেশ
দেখি ফের তব রে !-- "
সত্যজিৎ রায় লিখছেন,  
"বাবা মারা যাবার পর বছর দুয়েকের মধ্যেই সন্দেশ উঠে যায়। তখনও আমার সন্দেশ পড়ার বয়স হয়নি। টাটকা বেরোনোর সঙ্গে সঙ্গে হাতে নিয়ে পড়ার অভিজ্ঞতা হল এই দ্বিতীয় পর্বে। মলাটে তিনরঙা ছবি, হাতি দাঁড়িয়ে আছে দু'পায়ে, শুঁড়ে ব্যালান্স করা সন্দেশের হাঁড়ি। এই সন্দেশেই ধারাবাহিকভাবে প্রথম সংখ্যা থেকে বেরোয় রবীন্দ্রনাথের 'সে', আর এই সন্দেশেই প্রথম গল্প লিখলেন লীলা মজুমদার। ওনার গল্পের সঙ্গে মজার ছবিগুলো উনি তখন নিজেই আঁকতেন। অন্য আঁকিয়েদের মধ্যে ছিলেন এখনকার নামকরা শৈল চক্রবর্তী, যাঁর হাতেখড়ি সম্ভবত হয় এই সন্দেশেই।"[৬] 
এখানে একটা কথা বলে রাখা ভালো, লীলা মজুমদারের (তখন রায়) প্রথম গল্প "লক্ষ্মী ছেলে" বেরিয়েছিল প্রথম পর্যায়ের সন্দেশে, তাঁর বড়দা সুকুমারের উৎসাহে। কিন্তু এই গল্পটি লেখিকার পছন্দ হয়নি বলে তিনি এটি কোন বইতে অন্তর্ভূক্ত করেননি। নবপর্যায়ের সন্দেশে রায়চৌধুরী পরিবারের ওপর নির্ভরতা অনেকটাই কমে গেল, লেখার বৈচিত্র্য বাড়ল এবং সন্দেশ ক্রমশ কিশোরদের পত্রিকা হয়ে উঠল। দুই সম্পাদক ছাড়া রবীন্দ্রনাথ, প্রিয়ম্বদা দেবী, সুনির্মল বসু, দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার, বন্দে আলি মিঞা, ক্ষিতীন্দ্রনারায়ণ ভট্টাচার্য্য, ননীগোপাল মজুমদার, শিবরাম চক্রবর্তী ও আরো অনেক লেখক-লেখিকা এই পর্যায়ে লিখেছেন। গ্রাহকদের পাঠানো নির্বাচিত লেখাও ছাপা হত। ধাঁধার উত্তর যাঁরা পাঠাতেন তাদের নাম, ঠিকানাসহ ছাপা হত পরের সংখ্যায়। এই নামের তালিকায় লক্ষ্য করলে দেখা যাবে সন্দেশের পাঠকরা ছড়িয়ে ছিল কলকাতা, ভাটপাড়া, কৃষ্ণনগর থেকে শুরু করে ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম, রাঁচী, ভাগলপুর, দিল্লী, শ্রীনগর পর্যন্ত। কিন্তু বেশীদিন সন্দেশ চালানো গেল না। চার বছর পর সন্দেশ আবার ঝাঁপ বন্ধ করল। শেষ দেড় বছর (বৈশাখ ১৩৪১-ভাদ্র ১৩৪২) সম্পাদক ছিলেন এককভাবে সুধাবিন্দু বিশ্বাস।
    
এরপরের সন্দেশ জানতে হলে লাফ দিয়ে পেরোতে হবে আঠাশটা বছর। মাঝখানে বাঙলা তথা পৃথিবীর ইতিহাস-ভূগোল ওলোট-পালোট হয়ে গেছে। ফ্যাসিবাদের উত্থান ও পতন, মহামারী, দাঙ্গা, দেশভাগের বিনিময়ে বহুপ্রতীক্ষিত স্বাধীনতা আর তার ধাক্কায় অগণিত মানুষের ভিটেমাটি ত্যাগ করে অজানা ভবিষ্যতের পথে যাত্রা। স্বাধীন দেশে খাদ্য চাইতে শহরে আসা মানুষকে মরতে হল লাঠির বাড়ি খেয়ে। হয়তো পথের ক্লান্তি কাটাতেই এক মার্কসবাদী কবি, তাঁর শিল্পী বন্ধুর কাছে সন্দেশ আবার বের করার প্রস্তাব দিলেন। সুকুমার রায়ের পুত্র এই শিল্পীবন্ধুটি তখন কমার্সিয়াল আর্টিস্টের কাজ ছেড়ে সিনেমা তৈরীতে নেমে পড়েছেন। বাংলা সাহিত্যের গোটাপাঁচেক মাস্টারপিসকে পর্দায় নামানোর পর রবীন্দ্রজন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে একটা তথ্যচিত্র আর তিনটে গল্প নিয়ে একটা কাহিনীচিত্র বানাতে ব্যস্ত। দায়িত্বগ্রহণে দ্বিধা থাকলেও মায়ের উৎসাহে রাজি হয়ে গেলেন। 
"ইউ রায় অ্যান্ড কোম্পানির স্বত্ব যাঁরা কিনেছিলেন-তাঁদের খুঁজে বার করা হল।তাঁদের কাছ থেকে 'সন্দেশ' প্রকাশের অনুমতি সংগ্রহ করা গেল। তবু নতুন এক বিপত্তি দেখা দিল। সন্দেশ পত্রিকার নাম স্বত্ব সংগ্রহ করেছিলেন হাওড়া জেলার তারাপদ সাঁতরা। ... তাঁর 'সন্দেশ' নামের সাপ্তাহিক পত্রিকায় শ্রমিক আন্দোলন বিষয়ে নিবন্ধ ও সংবাদ প্রকাশিত হত। ... সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে পুরনো রাজনৈতিক যোগাযোগের সুবাদে সহজে তাঁর কাছে পৌঁছানো গেল। ... ১৭২ নং ধর্মতলা স্ট্রিট (লেনিন সরণি)-এর দোতলায় অফিস ঘর ভাড়া নেওয়া হল। সম্পাদক হলেন সত্যজিৎ রায় ও সুভাষ মুখোপাধ্যায়। বিজ্ঞাপন দিয়ে গ্রাহক সংগ্রহ শুরু হয়ে গেল। ১৩৬৮র বৈশাখ (১৯৬১-র মে) মাসে এ বারের (তৃতীয় পর্যায়ের) সন্দেশের প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হল।"[৭]

সুভাষ মুখোপাধ্যায় অবশ্য বেশীদিন থাকেননি। দুবছর পর তাঁর বদলে সম্পাদক হলেন লীলা মজুমদার। প্রকাশক অশোকানন্দ দাশ। সন্দেশ চালানোর জন্য গঠিত হল "সুকুমার সাহিত্য সমবায় সমিতি"। ১৩৮২তে লীলা মজুমদার, সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে সম্পাদক হিসেবে যোগ দিলেন নলিনী দাশ। অবশ্য সন্দেশের অফিস তাঁর রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়ের বাড়িতে উঠে যাওয়ার পর থেকেই তিনি সন্দেশের পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত হয়ে গিয়েছিলেন।



সত্যজিৎ রায় সন্দেশের পুনর্জন্ম দিয়েছিলেন এটা যেমন ঠিক, তেমনি এটাও ঠিক, যে সন্দেশই সত্যজিতের হাতে আবার কলম ধরিয়েছিল। কুড়ি বছর আগে অমৃতবাজার পত্রিকার রবিবারের পাতায় প্রকাশিত দুটো ইংরেজি গল্পের কথা বাদ দিলে বলতে হয় সন্দেশের জন্যই তিনি লিখতে শুরু করেছিলেন। প্রথমে লুই ক্যারল আর লিয়রের কিছু ননসেন্স ছড়া আর লিমেরিক অনুবাদ করার পর ষষ্ঠ সংখ্যাতেই হাজির করলেন প্রোফেসর শঙ্কুকে। তারপর পর পর দুটো ছোটগল্প "বঙ্কুবাবুর বন্ধু" আর "টেরোডাকটিলের ডিম"। তারপর আর থামেননি। ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি শুরু হয় ছ বছর পরে। পরবর্তীকালের বেস্টসেলার লেখাগুলোর বেশীরভাগই সন্দেশে প্রথম বেরিয়েছিল। তাছাড়াও অজস্র প্রবন্ধ, স্মৃতিকথা, কমিক স্ট্রীপ, পাদপূরণ, ধাঁধা, শব্দজব্দ ইত্যাদি ছড়িয়ে আছে সন্দেশের পাতায়, যা এখনো বই হয়ে বেরোয়নি। আর বাবা ও ঠাকুরদার ধারা বজায় রেখে প্রচ্ছদ ও বেশীরভাগ অলঙ্করণ, হেডপিসও সত্যজিৎ নিজেই করতেন।
আরেক সম্পাদক লীলা মজুমদার অবশ্য তখনই জনপ্রিয় লেখিকা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। সন্দেশের প্রথম সংখ্যাতে শুরু হয় তাঁর ধারাবাহিক উপন্যাস "টংলিং"। গল্প, প্রবন্ধ, নাটক, উপন্যাসের পাশাপাশি থাকত তাঁর অননুকরনীয় ভাষায় "গল্পস্বল্পে"র মজলিশ। সুবিনয় রায়ের আমলেও "গল্পস্বল্প" নামে একটা বিভাগ ছিল, কিন্তু সেখানে মূলতঃ দেশ-বিদেশের মজার মজার খবর থাকত। এবারের গল্পস্বল্পে আড্ডার মেজাজে গল্প শোনানোর পাশাপাশি পাঠকদের নানা সামাজিক বিষয়ে সচেতন করারও চেষ্টা থাকত। একটা উদাহরণ দিলেই বোঝা যাবে।  
"...সমান অধিকার মানেই সমান দায়িত্ব। বিয়ের সময় বরপক্ষের এটা চাই ওটা চাই যে একেবারে বেআইনী একথা তোরা ভালো করেই জানিস, তবু মেনে নিস কেন? লেখাপড়া শেখ, নিজের পায়ে দাঁড়াতে শেখ। নইলে পুরুষরা মেয়েদের যত অসম্মান করে, তোরা নিজেরা তার চেয়ে ঢের বেশী করিস।..."[৮]
  
অধ্যাপনা থেকে অবসর নেওয়ার পর সন্দেশের কাজেই নিজেকে নিয়োগ করেছিলেন নলিনী দাশ। সম্পাদনার পাশাপাশি প্রুফ দেখা থেকে শুরু করে বিজ্ঞাপন, মার্কেটিং, কার্যালয়ের দৈনন্দিন খুঁটিনাটি কাজ তিনিই সামলাতেন কর্মী ও স্বেচ্ছাসেবকদের সঙ্গে নিয়ে। আর লেখালিখি তো ছিলই। চারটে স্কুলের মেয়ের আডভেঞ্চার নিয়ে তাঁর গোয়েন্দা গণ্ডালু সিরিজ সন্দেশীদের মধ্যে অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল।


   সেই সময়কার প্রতিষ্ঠিত লেখকরা তো লিখতেনই, তার সঙ্গে বাংলা সাহিত্যের উঠতি প্রতিভাকে লালন করার দায়িত্বও নিল সন্দেশ। তিন সম্পাদকের হাতে তৈরী হয়েছিল শিশিরকুমার মজুমদার, অজেয় রায়, রেবন্ত গোস্বামী, গৌরী ধর্মপালের মত অনেক আশ্চর্য লেখক। "তৈরী হয়েছিল" কথাটা যে অতিরঞ্জন নয় তার প্রমাণ রাখা আছে তিন সম্পাদকের নিজেদের মধ্যে এবং লেখকদেরকে লেখা চিঠি ও চিরকুটের মধ্যে।[৯-১১] একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন পরিচালক আর একজন ব্যস্ততম লেখিকা এক একটা লেখার পিছনে যে সময় ও মনোযোগ দিতেন, লেখাটিকে সংশোধন ও পরিমার্জন করে বা কখনও কখনও লেখকদেরকেই ভুলগুলো ধরিয়ে দিয়ে নতুন করে লেখার নির্দেশ দিতেন, তা ধরা আছে এই সমস্ত চিঠিতে, যার বেশীরভাগই অবশ্য এখনো সামনে আসেনি। একই কথা প্রযোজ্য শিল্পীদের ক্ষেত্রেও। "নামী শিল্পীদের ছবি তাঁদের যোগ্য পারিশ্রমিক দিয়ে সন্দেশে ব্যবহার করা সম্ভব ছিলনা। এর ফলে নতুনদের জন্য সন্দেশকে সর্বদাই দরজা খোলা রাখতে হত এবং আজও হয়।"[১২] সন্দেশের হাত ধরে যে সমস্ত শিল্পী উঠে এসেছেন তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য দেবাশীষ দেব ও শিবশঙ্কর ভট্টাচার্য। তাছাড়া প্রশান্ত মুখোপাধ্যায়, সিদ্ধার্থ মুখোপাধ্যায়, সুবীর রায় সন্দেশে প্রচুর অলংকরণ করেছেন। আর ছিলেন প্রসাদ রায়, ময়ূখ চৌধুরী নামে যিনি রোমাঞ্চকর ঐতিহাসিক ও অ্যাডভেঞ্চার কমিকস আঁকতেন।

তিন সম্পাদক কিভাবে কাজ করতেন তার একটা সুন্দর বর্ণনা দিয়েছেন রাহুল মজুমদার, "লেখা জমা পড়লে সেটাকে নথিভুক্ত করার পর সব লেখা প্রথম পড়তেন নলিনীদি। উনি দেখতেন লেখাটা সন্দেশের আদর্শ আর মানের উপযুক্ত হল কিনা। প্রাথমিক বাছাইয়ের পর সেই লেখাগুলো বিষয় অনুযায়ী ভাগ করে পাঠিয়ে দিতেন বিভিন্ন বিষয়ের বিশেষজ্ঞ সন্দেশীর কাছে। তাঁরা মন্তব্য আর প্রয়োজনীয় পরামর্শ লিখে ফেরৎ পাঠাতেন নলিনীদির কাছে। এরপর উনি বাছাই করা লেখাগুলো পাঠিয়ে দিতেন লীলাদির কাছে। লীলাদি মূলতঃ বিচার করতেন লেখার রস। দ্বিতীয় বাছাইয়ের পর লেখাগুলো আবার আসত নলিনীদির কাছে। এবার ভরতদা বা অশোকের হাত দিয়ে সেগুলো চলে যেত নলিনীদির ভাষায় বড় সম্পাদক অর্থাৎ সত্যজিৎ রায়ের কাছে চূড়ান্ত মনোনয়নের জন্য। তিনি মান, রস ছাড়াও দেখতেন লেখার কারিগরি বা টেকনিকাল দিকটাও। এতগুলো ছাঁকনির ভিতর দিয়ে ছেঁকে বেরিয়ে আসা লেখাগুলোর গুণগত মান সম্পর্কে কারও আর কোনও সন্দেহ থাকত না।" [১৩]
অন্যান্য পত্রিকার মতই সন্দেশে থাকত বেশ কিছু নিয়মিত বিভাগ যেমন বই চেনো, পত্রবন্ধু হতে চাই, বুনো রামনাথের দপ্তর, খেলাধুলা, বিজ্ঞানের আসর, হাত পাকাবার আসর, প্রকৃতি পড়ুয়ার দপ্তর ইত্যাদি। শেষোক্ত বিভাগটি ছিল
অভিনব। সত্যজিৎ রায় ও সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের উৎসাহে এবং বিজ্ঞানী গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য ও সত্যেন্দ্রনাথ বসুর পরামর্শে গড়ে ওঠা এই প্রকৃতি পড়ুয়ার দপ্তরের উদ্দেশ্য ছিল প্রকৃতিকে জানা, বোঝা ও ভালবাসা এবং তা বই পড়ে নয়, মাঠে ঘাটে ঘুরে। জীবন সর্দারের নেতৃত্বে প্রকৃতি পড়ুয়ারা মাসে একদিন সন্দেশের কার্যালয়ে পাঠশালায় বসত, অভিযানেও বেরোত।[১৪] হাত পাকাবার আসরে ১৭ বছরের কমবয়সী গ্রাহক-গ্রাহিকাদের লেখা ও আঁকা ছাপা হত এবং সংখ্যায় অনেক কমে গেলেও এখনও হয়।
সন্দেশের সম্পাদক থেকে শুরু করে লেখক, শিল্পী, গ্রাহক, এমনকি কার্যালয়ের কর্মীরা নিজেদের এক বিরাট পরিবারের অংশ বলে মনে করে। তারা নিজেদের নাম দিয়েছেন সন্দেশী। সন্দেশের প্রতি তাঁদের আবেগ আর ভালোবাসা তা বাইরের কারো পক্ষে অনুভব করা সম্ভব নয়। এই ভালোবাসার টানেই কঠিন আর্থিক সঙ্কটেও সন্দেশ বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি পরিচালকরা। প্রতিবছর সন্দেশীদের অনুষ্ঠান বা পৌষমেলা, কলকাতা বইমেলায় অংশগ্রহণের বিবরণ পড়লে খানিকটা বোঝা যায় সেই আবেগের চরিত্র।[১৫,১৬]
    নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিকে একের পর এক ইন্দ্রপতনে বিপর্যস্ত হল সন্দেশ। একে একে বিদায় নিলেন অশোকানন্দ দাশ, সত্যজিৎ রায়, নলিনী দাশ, শিশিরকুমার মজুমদার। অসুস্থতার জন্য দৈনন্দিন সম্পাদনার কাজ থেকে অবসর নিলেন লীলা মজুমদার। আমি যখন সন্দেশ পড়তে শুরু করি তখনও সম্পাদক হিসেবে ছাপা হত লীলা মজুমদার ও বিজয়া রায়ের নাম। কিন্তু ব্যাটনটা তখন চলে গেছে পরবর্তী প্রজন্ম অর্থাৎ সন্দীপ রায়, রেবন্ত গোস্বামী, প্রণব মুখোপাধ্যায়, জীবন সর্দারদের হাতে। প্রকাশকের দায়িত্ব নিয়েছেন অমিতানন্দ দাশ। উপরোক্ত পরিচালকরা ছাড়া নিয়মিত লেখক ও শিল্পীদের মধ্যে ছিলেন সলিল চট্টোপাধ্যায়, ভবানীপ্রসাদ মজুমদার, অরুণিমা রায়চৌধুরী, প্রসাদরঞ্জন রায়, হর্ষমোহন চট্টরাজ, পার্থ দাশ প্রমুখ। দেবাশিস সেনের খেলার গল্প আর অরুণিমা রায়চৌধুরীর রূপকথা খুব ভালো লাগত মনে আছে। গল্পস্বল্প লিখতেন সুজয় সোম ও রেবন্ত গোস্বামী। সুজয় সোম খানিকটা লীলা মজুমদার কে অনুসরণ করার চেষ্টা করলেও রেবন্ত গোস্বামী লিখতেন নিজস্ব ঢঙে। অমিতানন্দ দাশ লিখতেন বিজ্ঞানভিত্তিক লেখা আর খেলাধূলার দায়িত্বে ছিলেন বল বয়। ফেলুদা আর গুপী-বাঘার ছবিগুলোর চিত্রনাট্য ধারাবাহিকভাবে বেরিয়েছিল। পুরনো সন্দেশ থেকে প্রচুর লেখা থাকত। বেশীরভাগ সংখ্যায় সত্যজিৎ রায়ের আঁকা প্রচ্ছদগুলোই রঙ বদলে ব্যবহার করা হত, তবে মাঝে মাঝে সন্দীপ রায়ও প্রচ্ছদ আঁকতেন।  শারদীয়া সংখ্যায় বিখ্যাত লেখকরা লিখতেন, কিন্তু সাধারণ সংখ্যাগুলোয় লেখার মান পড়ে আসছিল। এর মধ্যে ফেলুদার ৩০ বছর, লীলা মজুমদারের ৯০ বছর আর আবোল তাবোলের ৭৫ বছর উপলক্ষ্যে বিশেষ সংখ্যাগুলো সুন্দর আর সংগ্রহযোগ্য হলেও খুব ছোটদের পক্ষে খানিকটা গুরুপাক হয়ে গিয়েছিল বলে মনে হয়।

হাত পাকাবার আসরটা তখনও বেশ জমজমাট ছিল। গল্প, কবিতা,
ছড়া, প্রবন্ধ, ভ্রমণ, এমনকি কমিকস পর্যন্ত আসত গ্রাহকদের কলম থেকে। যাদের লেখা ও আঁকা ভালো লাগত তাদের মধ্যে মনে পড়ছে হিমন মুখোপাধ্যায়, দীপাঞ্জন রায়, অন্তরীপ সেনগুপ্ত, তওফীক রিয়াজ, পরমা ঘোষ মজুমদার, শঙ্খশুভ্র মল্লিক আর রাকা দাশগুপ্তর নাম। একমাত্র শেষজনকে বাদ দিলে বাকিরা এখনও লেখালিখি চালিয়ে যাচ্ছে বলে জানিনা। এই লেখাটা তাদের কারো চোখে পড়লে সামনে এসে জানান দিতে অনুরোধ করছি। হিমনকে অবশ্য পাওয়া যাবে না, সে অনেকদূরে চলে গেছে। আর রাকা দাশগুপ্ত এখন বাংলা কবিতার জগতে অত্যন্ত পরিচিত একটা নাম। পাশাপাশি ছোটদের জন্য লেখালিখিও সমানতালে চালিয়ে যাচ্ছে সন্দেশ ও অন্যত্র।

এই সুযোগে নিজের ঢাকটা একটু পিটিয়ে নিই। ছোটবেলা থেকেই ডায়েরির পাতায় হিজিবিজি কাটতাম অন্য সকলের মত। সেরকমই একটা লেখা খামে ভরে সন্দেশের ঠিকানা লিখে একদিন ফেলে দিলাম লাল রঙের ডাকবাক্সে। তারপর হাত পাকাবার আসরে ছাপা হল "অভয়দাদুর বই"। গল্পটায় গুপিদা নামে একটা চরিত্র ছিল, যেটা আসলে কাঁচা হাতে করা টেনিদার কপি। তাতে কি! সেদিন নিজেকে মনে হয়েছিল একজন কেউকেটা, স্কুলে যাওয়ার সময় জামার কলারটা নামাতে ভুলে গেলাম। রাস্তায় মনে হল যেন সবাই আমার দিকেই দেখছে! পরে আরো গোটাতিনেক গল্প লিখেছি হাত পাকাবার আসরে, প্রতিবারই সন্দেশের পাতায় নিজের নাম দেখে একই রকম অনুভূতি হয়েছে।
উদার অর্থনীতি আর বিশ্বায়নের ধাক্কায় বাঙালী মধ্যবিত্তর রুচি ও সংস্কৃতি দ্রুত পাল্টে যেতে লাগল। কেরিয়ার সচেতনতা ও ইঁদুরদৌড় ছোটদের অবসর সময় অনেকটা কেড়ে নিল। যেটুকু ছিল তা দখল করতে এগিয়ে এল কেবল টিভি ও ইন্টারনেট। একদিকে পত্রিকা প্রকাশের খরচ ও ডাকমাশুল উর্ধমুখী হল, অন্যদিকে গ্রাহক সংখ্যা কমতে লাগল। এতসব প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই করার মত সাধ্য ও নেতৃত্ব সন্দেশের ছিলনা। এমন সময় টাকার থলি নিয়ে উদয় হল ফোর্ড ফাউন্ডেশন। সন্দেশকে ঢেলে সাজাতে উদ্যত হলেন সন্দীপ রায়।[১৭] দুবছর পর তাঁর সঙ্গে সম্পাদক হিসেবে যোগ দিলেন সুজয় সোম। ঝকঝকে ছাপা, তকতকে কাগজ, নামী দামী বুদ্ধিজীবিদের লেখা, কেরিয়ার ক্যাম্প, মনের কথা কই, মনে হল গৌরী সেন বুঝি বা সন্দেশে বিপ্লব আনল। নতুন স্লোগান উঠে এল, "বাঙালীর ছোটবেলা, চারপুরূষ ধরে"। কিন্তু হিসেব দাখিল করতে না পারায় টাকা পাঠানো বন্ধ করে দিল ফোর্ড ফাউন্ডেশন। আবার অথৈ জলে পড়ল সন্দেশ।[১৮,১৯]
    কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এটাই যে অনিয়মিত হয়ে পড়লেও সন্দেশ আর ঝাঁপ বন্ধ করেনি। শুধু তাই নয়, নতুন লেখকরা আবার উঠে আসছেন সন্দেশের পাতা থেকে। রাজেশ বসু, হিমাদ্রিকিশোর দাশগুপ্ত, অনন্যা দাশ, সুদীপ্ত দত্ত ও আরো অনেক লেখক-শিল্পীর কলরবে ভরে উঠছে সন্দেশের পাতা।
সুনির্মল বসু থেকে অনিতা অগ্নিহোত্রী হয়ে রাকা দাশগুপ্ত, পাঠক থেকে লেখক হয়ে ওঠার ট্রাডিশনও সমানে চলছে। যদিও এই সন্দেশের পাঠক কারা অর্থাৎ মোটামুটি ৮ থেকে ১৮ বছরের ছেলেমেয়েদের মধ্যে সন্দেশের চাহিদা কতটা তা নিয়ে প্রশ্নটা থেকেই যায়। কোথায় যেন পড়েছিলাম, "সন্দেশ আসলে ফিনিক্স পাখি, বারবার নিজের চিতার আগুন থেকে সে পুনর্জন্ম নেয়"। সেরা সন্দেশের ভূমিকায় লীলা মজুমদার লিখেছিলেন, 
"ছোটদের দেখাতে চাই এই জীবনটা কত ভালো। জানাতে চাই ব্রহ্মাণ্ডের কোথায় কি ঘটেছে, ঘটছে, ঘটতে যাচ্ছে। মানুষের মত মানুষ দেখাতে চাই। এমন মানুষ যারা ভালো কে ভাল আর মন্দকে মন্দ বলে। যারা দলাদলির বাইরে; যারা ঘৃণা করে শুধু মিথ্যাকে আর নিষ্ঠুরতাকে আর কুঁড়েমিকে। বাদ দেয় যত রাজ্যের ন্যাকামি আর ঢং। যারা বিশ্ব-প্রকৃতিকে তার ন্যায্য জায়গা দিতে প্রস্তুত। যাদের মন উদার। এত সবের সঙ্গে আমরা পাঠকদের খুশিও করতে চাই। খুশি করতে না পারলে আমাদের সব চেষ্টাই বৃথা।"[২০]
কোন গোরী সেন নয়, এই আদর্শ আর সন্দেশীদের মধ্যে অদৃশ্য ভালোবাসার সুতোটাই একশ বছর ধরে সন্দেশের প্রাণভোমরা। চিতার আগুনে আর সব পুড়ে গেলেও এগুলো পোড়ে না। বদলে যাওয়া দেশ ও সমাজের পটভূমিতে ফিনিক্স পাখির মত আবার উঠে দাঁড়ায় নতুন চেহারা নিয়ে।


তথ্যসূত্রঃ
[১] প্রেমেন্দ্র মিত্র, ভূমিকা, উপেন্দ্রকিশোর রচনাবলী, বঙ্গীয় সাক্ষরতা প্রকাশন
[২] লীলা মজুমদার, সুকুমার রায়, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি
[৩] দেবাশিস মুখোপাধ্যায়, মুদ্রণবিজ্ঞানী, আজকাল (রবিবাসরীয়, ১২ মে, ২০১৩)
[৪] খগেন্দ্রনাথ মিত্র, শতাব্দীর শিশু সাহিত্য, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি
[৫] নলিনী দাশ, সন্দেশ সম্পাদক সুবিনয় রায়, সন্দেশ (অগ্রহায়ণ ১৩৯৮)
[৬] সত্যজিৎ রায়, যখন ছোট ছিলাম, আনন্দ পাবলিশার্স
[৭] অশোককুমার মিত্র, এবারের সন্দেশ, সন্দেশ (বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ ১৪০৮)
[৮] লীলা মজুমদার, গল্পস্বল্প, সন্দেশ (জ্যৈষ্ঠ ১৩৯৮)
[৯] নলিনী দাশ, সন্দেশ সম্পাদক সত্যজিৎ রায়, সন্দেশ (সত্যজিৎ স্মরণ সংখ্যা, শ্রাবণ ১৩৯৯)
[১০] অজেয় রায় কে লেখা সত্যজিৎ রায়ের চিঠি, দেশ (শারদীয়া ১৪১৯)
[১১] লীলা মজুমদার, পত্রমালা, লালমাটি
[১২] দেবাশীষ দেব, সন্দেশের অলঙ্করণ, সন্দেশ (বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ ১৪০৮)
[১৩] রাহুল মজুমদার, সন্দেশের সেরা সম্পদ নলিনীদি, সন্দেশ (বৈশাখ-শ্রাবণ ১৪১৮)
[১৪] জীবন সর্দার, জবানবন্দী, সন্দেশ (বৈশাখ-জৈষ্ঠ ১৪০৩)
[১৫] সুজয় সোম, ফালতু খাতা, সন্দেশ (শারদীয়া ১৪১২)
[১৬] দেবাশিস সেন, সবার চেয়ে আলাদা, সন্দেশ (বৈশাখ-শ্রাবণ ১৪১৮)
[১৭] Labonita Ghosh, Legendary children magazine Sandesh goes in for a new look to revive old glory, India Today (June 23, 2003)
[১৮] Kalyan Moitra, Bitter days ahead of 'Sandesh', Times of India (Aug 30, 2006)
[১৯] Children’s treat in autumn, The Telegraph (October 14, 2007)
[২০] লীলা মজুমদার, ভূমিকা, সেরা সন্দেশ, আনন্দ পাবলিশার্স
এছাড়াও সন্দেশের শতবর্ষ ও উপেন্দ্রকিশোরের সার্ধশতবর্ষ উপলক্ষে বিভিন্ন খবরের কাগজের প্রতিবেদন ও সন্দেশের নানা পুরনো সংখ্যার সাহায্য নিয়েছি। উপেন্দ্রকিশোরের সন্দেশ বছর অনুযায়ী খণ্ডে খণ্ডে প্রকাশ করেছে পারুল প্রকাশনী। সুকুমার ও সুবিনয়ের সন্দেশের অনেকগুলো সংখ্যা জোগাড় করেছি ইন্টারনেট থেকে। যিনি বা যাঁরা এগুলো আপলোড করেছেন তাঁদেরকে অজস্র ধন্যবাদ। ছবি বেশীরভাগই ইন্টারনেট থেকে নেওয়া, বাকিগুলো নিজের সংগ্রহ থেকে স্ক্যান করেছি।  সত্যজিৎ রায়ের আঁকা প্রচ্ছদগুলো পেয়েছি Satyajit Ray Film and Study Centre এর ওয়েবসাইট থেকে। হাত পাকাবার আসর আর প্রকৃতি পড়ুয়ার দপ্তরের সত্যজিৎ কৃত লোগোদুটো নিয়েছি সন্দেশের ফেসবুক পেজ থেকে আর বৈশাখ ১৪২০ সংখ্যার প্রচ্ছদটা (সুকুমার রায়ের আঁকা) পেয়েছি  শ্রীদেবাশিস সেনের ফেসবুক প্রোফাইল থেকে। গ্রাহক কার্ডটা পেয়েছি অরিজিৎ কুমারের কাছ থেকে।

 প্রথম প্রকাশঃ অবকাশ জন্মদিন সংখ্যা ১৪২০
পুনঃপ্রকাশঃ চর্যাপদ

Saturday 25 May 2013

সব চরিত্র কাল্পনিক

কেউ শুধু কোড লেখে,
কেউ গুঁড়ো করে,
কেউ বা অঙ্ক কষে
খাতা গুলো ভরে।

কেউ রোজ পাতা ছোঁড়ে,
বাঘ হাতি মেরে,
কেউ বা চেয়ারে বসে
চুল গুলো ছেঁড়ে।

কেউ করে ফেসবুক,
দিনের বেলায়,
কেউ বা দরিদ্র, সে
ফিলিম নামায়।

কেউ থাকে ক্যান্টিনে,
কেউ জল ভরে,
কেউ বা ছাত্রী পেলে
নিয়ে যায় ঘরে।

কেউ ভাবে আমি দেব,
কেউ বলে আমি,
কেউ বা বহুবচন,
হয় সর্বগামী।

দেখে শুনে ছড়া কেটে,
কইছে অতনু,
আমরা যে হক্কলে
বিজ্ঞানী হনু।

Thursday 23 May 2013

তোমার সঙ্গে

তোমার সঙ্গে একটুকু রাগ,
                তোমার সঙ্গে আড়ি;
তোমার সঙ্গে সময়টা কাটে
                 বড্ড তাড়াতাড়ি।

তোমার সঙ্গে গ্রীস্ম বর্ষা,
                 বাজল পুজোর ঢাক;
তোমার চোখের তারায় তারায়
                      বসন্ত দেয় ডাক।

তোমার সঙ্গে ডাল ভাত মাছ,
                    বিরিয়ানি মোগলাই;
তোমার সঙ্গে বলাইয়ের ধাবা,
                   কবিরাজি ফিশফ্রাই।

তোমার জন্য কবীর সুমন
                  সুরের সলিলে মেশে;
তোমার কন্ঠে রবি ঠাকুর,
                  চিরনতুনের বেশে।

তোমার সঙ্গে ফেলু ব্যোমকেশ,
                   চাঁদের পাহাড় ডাকে;
তোমার চোখেই প্রথম আলো,
                   বইয়ের থাকে থাকে।

তোমার কথায় রাত্রি ঘনায়,
                   এলো যে ঘুমের ঘোর;
তোমার জন্যে আনবোই দেখো
                   লাল টুকটুকে ভোর।

হঠাৎ কখন এলোমেলো মন,
                   ফেসবুকে আঁকিবুকি।
তোমার হাতটা ধরতে পেলেই
                     মনখারাপের ছুটি।

তোমাতেই হাসি, তোমাতেই কাঁদি,
                 তোমাতে সারাটা বেলা;
তোমাকে নিয়েই ভাসাবো এবার
                    তেঁতুলপাতার ভেলা।

প্রথম প্রকাশঃ চর্যাপদ

Wednesday 1 May 2013

কাসবের ভাই

Photo0540
ছত্রপতি শিবাজি টার্মিনাস
ঠিক সাড়ে দশটায় দুরন্ত এসে দাঁড়ালো ছত্রপতি শিবাজি টার্মিনাসে। হাতে এখন বারো ঘন্টা সময়। রাত সাড়ে দশটায় আবার গোয়ার উদ্দেশ্যে গাড়ী ধরব। এই সময়টুকু মুম্বাইতেই কাটাতে হবে। এদিকে ঘাড়ে একটা জাম্বো ব্যাগ, দিনদশেকের সাজসরঞ্জাম। তাই প্রথমেই ক্লোক রুমে গিয়ে ভারমুক্ত হয়ে পিঠে একটা ব্যাগ নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়লাম। গন্তব্য আপাতত গেটওয়ে অফ ইন্ডিয়া। সেখান থেকে যাব এলিফ্যান্টা দ্বীপে। মুম্বাইয়ে বারো ঘন্টা কাটাতে হবে শুনে ইনস্টিটিউটের এক বন্ধু এই পরামর্শ দিয়েছিল, টিআইএফআর এ নিয়মিত যাতায়াতের সূত্রে সে বলতে গেলে বম্বে বিশারদ হয়ে গেছে।
Photo0543

 স্টেশন থেকে বেরিয়ে এক পুলিসকর্মীর কাছে পথনির্দেশ চাইতে তিনি বাসস্ট্যান্ডটা দেখিয়ে দিয়ে বললেন ওখানে দাঁড়াতে, এক্ষুনি বাস এসে যাবে। আমি যখন বললাম আমি হেঁটেই যেতে চাই, তিনি এমন ভাবে তাকালেন যেন এমন আহাম্মক তিনি জীবনে দেখেননি যে বাস থাকতে হেঁটে যেতে চায়। ভাবলাম তাঁকে বুঝিয়ে বলি আমার হাতে এখন অঢেল সময় আর গুগল ম্যাপে দেখে নিয়েছি গেটওয়ে অফ  ইন্ডিয়া সিএসটি থেকে খুব দূরে নয়। ফেলুদার সেই উপদেশটা, "কোন শহর ঘুরে দেখতে চাইলে হাঁটার চেয়ে ভালো কিছু হয়না", শুনিয়ে দেওয়া যায় কি না তাও ভাবছিলাম। কিন্তু আমার বিপুল হিন্দীজ্ঞানের কথা ভেবে আর সাহস পেলামনা। যাই হোক আমি নাছোড়বান্দা বুঝে তিনি রাস্তাটা দেখিয়ে দিলেন।
Photo0547
মহারাষ্ট্র পুলিস হেডকোয়ার্টার্সের সামনে কর্তব্যরত পুলিসকর্মীরা


বিন্দাস হাঁটতে লাগলাম, হাতে মোবাইল দিয়ে ফটাফট ছবি তুলছি। (মোবাইল আসার আগে কি জানতাম আমি এতবড় ফটোগ্রাফার!!) চারপাশের বাড়িগুলো সব যেন একই ধাঁচের। পরে জেনেছি একে বলে ভিক্টোরিয়ান আর্কিটেকচার। সেরকমই একটা বাড়ির সামনে কয়েকজন সাদা ইউনিফর্ম পরা পুলিস মোটরবাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। আমি ছবি তুলতেই তাঁরা শিরদাঁড়া টান করে সরু চোখ করে আমার আগাপাশতলা জরিপ করতে শুরু করলেন । ততক্ষণে আমিও দেখে নিয়েছি, বাড়িটার সামনে দেশ বড় করেই লেখা "মহারাষ্ট্র পুলিস হেডকোয়ার্টার্স"। বেশী কিছু না ভেবে সোজা ওনাদের দিকেই এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, "গেটওয়ে অফ ইন্ডিয়া টা কোনদিকে?" কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে একজন তেড়িয়া হয়ে বললেন, "গেটওয়ে অফ ইন্ডিয়া তো ওইদিকে, এখানে দাঁড়িয়ে কিসের ছবি তুলছো?!!" আমি দাঁত বার করে ওনাদের ধন্যবাদ জানিয়ে এগিয়ে গেলাম।



Photo0552
গেটওয়ে অফ ইন্ডিয়া 


খানিকদূর গিয়ে পিছন ফিরে দেখি তখনো ওনারা আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। আমি কাসবের কোন ভাই কিনা, পরবর্তী কর্মসূচীর ছক কষার জন্য মুম্বাইয়ের ছবি তুলতে এসেছি কি না সে বিষয়ে বোধহয় তখনো নিঃসংশয় হতে পারেননি।
Photo0556
তাজ হোটেল

Photo0566
আরব সাগর থেকে মুম্বাই

Photo0788
মেরিন ড্রাইভ

Photo0794
মেরিন ড্রাইভ

Photo0795
নরিম্যান পয়েন্ট
প্রথম প্রকাশঃ চর্যাপদ