Sunday 29 September 2013

গদাইয়ের প্রতিশোধ

গদাই হচ্ছে এ পাড়ার সবচেয়ে ডানপিটে ছেলে। প্রায় প্রতিদিনই তার বাবার কাছে নানারকম নালিশ জমা পড়ে। কার জানলার কাঁচ ভেঙ্গেছে, কার ছেলেকে ধোলাই দিয়েছে, কার গাছ থেকে জামরুল চুরি করেছে, এই আর কি। আর স্কুলে! সেখানে তো সাতটা ক্লাসের মধ্যে চারতেতেই গদাইকে কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়।
সেদিন তো এক কাণ্ডই হয়ে গেল। গদাইয়ের অঙ্কের মাস্টারমশাই হচ্ছেন ছাত্রদের কাছে সাক্ষাৎ যম। তিনি যত না অঙ্ক ভালোবাসেন তার চেয়ে বেশী ভালোবাসেন পেটাতে।। এমন কি ক্লাস টুয়েলভের ছাত্ররাও তাঁরা হাত থেকে রেহাই পায় না। তার নাম গোবিন্দ চ্যাটার্জি হলেও গবু নামেই তিনি অধিক পরিচিত।
তা সেদিন গবু স্যারের কাছে গদাই বেধরক পেটানি খেল। সে এমন কিছু করেনি, খালি গণেশের সাদা জামাটা দেখতে বাজে লাগছিল বলে সেখানে পেন দিয়ে একটা হাতি এঁকে দিয়েছিল, কেষ্টর ব্যাগে দুটো জ্যান্ত আরশোলা ঢুকিয়ে দিয়েছিল আর গোবরের পেছনে একটা কাগজের ল্যাজ লাগিয়ে দিয়েছিল।
এই সামান্য কাজের জন্য তাকে পেটানোয় আর পরদিন বাবাকে ডেকে সব বলে দেওয়ায় গদাই ভারি অপমানিত বোধ করেছিল। তাছাড়া ওরাও তো গদাইএর চেয়ে ভালো কাজ কিছু করেনি! ক্লাস না করে মাঠে ফুটবল খেলছিল বলে গোবর যে স্যারকে বলে দিল? সংস্কৃত ক্লাসে ধাতুরূপ মুখস্থ বলে কেষ্ট যে গদাইকে কানমলা খাওয়াল? গদাই যে ধাতুরূপ পড়েনি তা কি ও জানত না! আর গনেশের জামায় ছবি আঁকায় তো সুন্দরই লাগছিল!
তবু কেন গদাইএর ওপর সব দোষ পড়ে? নাহ, এর একটা বিহিত না করলেই নয়। গবু স্যারের ওপরই প্রথম শোধটা নিতে হবে।
একবার সে সাইকেলের পাম্প খুলে রাখল। কিন্তু ওদের ক্লাসেরই এক বিশ্বাসঘাতক ছেলে দেখে ফেলল আর গদাই আগের বারের দ্বিগুন মার খেল হেডস্যারের কাছে। নাহ, এভাবে কিছু হবে না। অন্য ফন্দী আঁটতে হবে।

আজ সকাল থেকেই গোবিন্দবাবুর মেজাজটা বেশ ভালো ছিল। প্রথমতঃ বর্ধমান থেকে তাঁর ভাগনে এসেছিল। সঙ্গে বাক্সভর্তি সীতাভোগ-মিহিদানা। এদুটোই গোবিন্দবাবুর প্রিয় খাবার। তার ওপর পড়তে আসা চার-চারজন ছাত্রকে তিনি মনের সুখে ঠেঙাতে পেরেছেন। যেদিন তার মেজাজ ভালো থাকে সেদিন তিনি ছেলের মাথায় গাঁট্টা মারেন, মেয়ের কান মলে দেন আর বৌএর সঙ্গে ঝগড়া করেন। আজও তার ব্যতিক্রম হল না। ঝগড়া টগড়া করে, পাঁঠার মাঙ্গস দিয়ে ভাত খেয়ে পান চিবোতে চিবোতে বেরোতে যাচ্ছেন আর তক্ষুনি "ক্রিং ... ক্রিং...", ফোনটা বেজে উঠল-
"হ্যালো?"
"মিস্টার গোবিন্দ চ্যাটার্জি আছেন?"
"কথা বলছি"
"আমি টেলিফোন অফিস থেকে বলছি। আপনার প্রথম টেলিফোন বিলটা নিয়ে দুপুর আড়াইটের মধ্যে এখানে চলে আসুন। নয়ত টেলিফোনের লাইন তো কাটা যাবেই তার ওপর দশ হাজার টাকা জরিমানা হবে"
"কেন কেন? কি ব্যাপার? ... হ্যালো হ্যালো ..."
গোবিন্দবাবু টেলিফোন নিয়েছেন সাত বছর হল। সাত বছর আগের বিল খুঁজে পাওয়া কি সোজা কথা! কিন্তু খুঁজতে তো হবেই, নইলে দশ হাজার টাকা নিয়ে নেবে! চারতে প্রাণী মিলে বিসাল পৈতৃক বাড়িতে তন্ন তন্ন করে টেলিফোনের বিল খুঁজতে লাগলেন। কত কিছুই বেরোল, গোবিন্দবাবুর ফিফথ ক্লাস থেকে ফোর্থ ক্লাসে ওঠার রেজাল্ট, স্কুল পালিয়ে দেখা সিনেমার টিকিট, বাবা-মার বিয়ের কার্ড, পাঁচ বছর আগে হারানো গিন্নীর সোনার দুল, বাড়ির বিভিন্ন জায়গা থেকে মোট তেইশ টাকা পঁইয়ষট্টি পয়সা আর ... না থাক আর তালিকা বাড়িয়ে কাজ নেই।
শেষ পর্যন্ত প্রত্যাশিত বস্তুটি পাওয়া গেল ২টো বেজে পঁচিশে। আবিষ্কারক গোবিন্দবাবুর মেয়ে।
তাঁর বাড়ি থেকে টেলিফোন অফিস যেতে পনের-কুড়ি মিনিট লাগে। ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন ঝড়ের বেগে আর ফিরে এলেন আধঘন্টার মধ্যেই।
এসে বোমার মতই ফেটে পড়লেন। "কোন শয়তান এটা করল আমি তাকে দেখে নেব ... ওখানে বলে কি না, 'কে আপনাকে ফোন করেছিল? স্বপ্ন দেখেছেন!' ... হুঁহঃ"
বাইরে তখন হাসিতে গরাগড়ি যাচ্ছে গদাই আর তার সাঙ্গোপাঙ্গোরা।


হাত পাকাবার আসর, সন্দেশ (চৈত্র ১৪০৭) এ প্রকাশিত

No comments:

Post a Comment