Friday 3 January 2014

পকেটমারের পাল্লায়

পকেটমারদের যে আমি খুব পেয়ার করি এমনটা নয়। কিন্তু ব্যাপার হল ইস্কুলের মাস্টারমশাই থেকে হবু অর্ধাঙ্গিনী সবারই মত আমি নাকি মারাত্মক রকমের অন্যমনস্ক আর ভুলো। তারা খুব ভুল কিছু বলে এমন দাবী আবার আমি জোরগলায় করতে পারিনা। ফলতঃ পকেটমাররা যে আমাকে বেজায় পছন্দ করবে তাতে আশ্চর্য্যের কিছু নেই। আর ট্রেনে বাসে নিত্য যাতায়াত করলে, তাদের সঙ্গে মোলাকাৎ না করে উপায় কি! প্রথম তাদের পাল্লায় পড়ি বাইপাসের ওপর ভূতল পরিবহনের ন্যানোবাসে। সেই প্রথম বাড়ি ছেড়ে হোস্টেলে থাকতে এসেছি। দাদা একটা নোকিয়া ১১০০ ফোন কিনে দিয়েছিল, সঙ্গে একটা ক্লিপ-ফিতে। "এটা দিয়ে মোবাইলটাকে জামার সঙ্গে আটকে রাখলে আর চিন্তা নেই"। চিন্তা যে পকেটমারদেরও নেই তা বুঝলাম যখন দেখলাম বুকপকেট থেকে ফোনবাবাজি ফিতেশুদ্দু নিরুদ্দেশ হয়েছেন। এপর্যন্ত আমি যা খুইয়েছি তার মধ্যে আছে দুটো মোবাইল, দুটো মানিব্যাগ, একটা পেনড্রাইভ আর হ্যাঁ একটা ল্যাপটপ। শেষোক্তটাকে অবশ্য পকেটমারি বলা যায়না। কিন্তু কি যে বলা যায় তা আজও রহস্য। ওটার কথায় পরে আসছি। তবে এটা ঠিক যে এখন আমি অনেক সতর্ক, বাসে যত ভীড়ই থাকুকনা কেন, রডটা ধরি একহাত দিয়েই, আর একটা হাত রাখি পকেটের কাছে, যেখানে মোবাইল, মানিব্যাগ ইত্যাদি থাকে। বলতে নেই, বছরদুয়েকের মধ্যে পকেটমাররা আমার কাছে নিরাশই হয়েছে। 
মোবাইল প্যান্টের পকেটে রাখতে শুরু করি অবশ্য প্রথম ফোনচুরির পর থেকেই। তবে তাতেও যে সবসময় পকেটমারদের টেক্কা দেওয়া যাবে এমন নয়। আমার দ্বিতীয় মোবাইলটা তো গেছিল প্যান্টের পকেট থেকেই। এল-২৩৮ বাসটা দৈত্যকুলে প্রহ্লাদবিশেষ, মানে প্রাইভেট বাস হয়েও জনগণের দাবীতে যেখানে সেখানে দাঁড়ায়না, ফলে ভীড়ও হয় তেমনি আর কে না জানে ভীড় মানেই পকেটমারদের পোয়াবারো। এমনকি ওরা কাজের সুবিধার্থে ইচ্ছাকৃতভাবে ভীড় তৈরী করে এমন একটা কথাও শোনা যায়। তাই পকেটমারদের দাপটের জন্যও এল-২৩৮এর খ্যাতি আছে। সেদিন কোনরকমে পা-দানি থেকে উঠে দরজায় দাঁড়িয়েছি, এমন সময় সিটের ধারে দাঁড়িয়ে থাকা একজন টাকমাথা বেঁটেখাটো নিরীহ ভদ্রলোক বললেন, "আপনি এখানে দাঁড়িয়ে যান, আমি নেমে যাই।" তাঁকে ধন্যবাদ দিয়ে এগিয়ে গেলাম আর তিনি ভীড়ের জন্যই হয়ত বা অনেকক্ষণ ধরে আমার গা ঘেঁষে বেরোলেন। উল্টোডাঙা আসতেই বাস হালকা, আমার পকেটও। আমার বন্ধু মৈনাকেরও একই অভিজ্ঞতা হয়েছিল। উল্টোডাঙায় পকেটে হাত দিয়ে হাহাকার করে উঠতে কন্ডাকটার রাস্তার দিকে আঙুল দেখিয়ে বলে, "আগে বলবেন তো, ঐ দেখুন চলে যাচ্ছে ..." তখন আর কে কাকে দেখে! মৈনাক তো হাঁ, "আপনি জানতেন বাসে পকেটমার আছে??" কন্ডাক্টারের উত্তর, "জলে নেমে কি কুমীরের সঙ্গে বিবাদ করা চলে দাদা!" কন্ডাক্টাররা সাধারণত পকেটমারদের চেনে, এবং তাদের দেখলে নানারকম ইঙ্গিত দিয়ে যাত্রীদের সাবধান করার চেষ্টা করে থাকে, কিন্তু কখনোই তাদের ধরিয়ে দেয় না।
বুঝতেই পারছেন আমি দেখে শেখার চেয়ে ঠেকে শেখাতেই বেশী আগ্রহী। তাই মানিব্যাগটাও রাখতাম প্যান্টের পেছনের পকেটে, যতদিন না ট্রেনে এক পকেটমার বাবাজি আমায় উচিৎ শিক্ষা দিলেন। তিনি যে কখন তাঁর কাজ করেছেন টের পাইনি, হুঁশ ফিরল যখন সামনে থেকে চিৎকার শুনলাম, "এখানে কার মানিব্যাগ? অতনু কুমার কার নাম?" বাবাজি ভদ্রলোক, টাকাপয়সা বের করে নিয়ে মান্থলি আর এটিএম কার্ডসমেত মানিব্যাগটা ট্রেনের দরজার মুখেই রেখে গেছিলেন। আরেকবার মানিব্যাগ খুইয়েও উদ্ধার করেছিলাম। সেটা ছিল চুঁচুড়া-শ্রীরামপুর রুটের ২নং বাসে। বসেছিলাম একবারে পিছনে। বিহারি মহিলাদের ক্যাচোড় ম্যাচোড় ঠেলে কোনরকমে বের হয়ে নামতে যাব, তখুনি খেয়াল করলাম পকেটে মানিব্যাগ নেই। সঙ্গে সঙ্গে ইউ টার্ন হয়ে বীরদর্পে পিছনদিকে এগিয়ে গেলাম, "আমার পার্স কই? পার্স কোথায় গেল?" একজন ভেটকি মাছের মত মুখ করে বলল, "এই তো তলায় পড়ে আছে"। তার দিকে তাচ্ছিল্যের দৃষ্টি হেনে মানিব্যাগ উদ্ধার করে বাস থেকে নামলাম।
কলেজে পড়ার সময় অভিযান পত্রিকায় এক পকেটমারকে নিয়ে একটা গল্প লিখেছিলাম। তখন অবশ্য ডেইলী প্যাসেঞ্জার ছিলাম না, তাই তাদের সঙ্গে সরারসরি মোলাকাৎ হয়নি। জানিনা সেই অতিক্ষুদ্র লিটল ম্যাগাজিনটা কোন আসল পকেটমারের চোখে পড়েছিল কি না আর তার জন্যেই আমার ওপর এত ভালবাসা কি না! 
শেষ গপ্পোটা অবশ্যই ল্যাপটপের। সেদিন একটু দেরি হয়ে গিয়েছিল। ৮টা ৪৭এর বর্ধমান লোকালে ফিরছি। বসার জায়গা পাইনি তাই ল্যাপটপের ব্যাগটা বাঙ্কারে তুলে দিলাম। কয়েকটা স্টেশন পার হল, গাড়ী ফাঁকা হল আর বাঙ্কারের দিকে তাকিয়ে দেখি পাখি ফুড়ুৎ। ঐ ব্যাগে ল্যাপটপ ছাড়াও ছিল এটিএম সমেত পার্স, পেনড্রাইভ, পেন, খাতা আর ছাতা। ব্যান্ডেল জিআরপিতে গিয়ে নালিশ করতে ওসি বললেন, "এত কিছু হারালেন আর মোবাইলটা রেখে দিলেন! মোবাইলটা হারালে বরং আমাদের ট্র্যাক করতে সুবিধে হত।" কেন যে মোবাইলটা চোরের হাতে তুলে দিলাম না সে নিয়ে আফশোস করতে করতেই দু দিন বাদে উত্তরটা পেয়ে গেলাম। আগের পেনড্রাইভটা হারানোর পর এটার খাপের ওপর আমার ফোন নাম্বারটা লিখে রেখেছিলাম। তার সূত্র ধরেই হারানো মাণিকের খোঁজ পেলাম। বর্ধমান থেকে এক পাঞ্জাবী ভদ্রলোক জানালেন তাঁর প্রতিবেশী একটি ছেলে ট্রেনে ব্যাগটা "কুড়িয়ে পেয়েছিল"। ব্যাগে যা টাকা ছিল তাই দিয়ে স্টেশনে বসে মিষ্টি খাওয়ার পর সেটাকে বাড়িতে নিয়ে আসে কিন্তু ব্যাগের ভেতরে বোম থাকতে পারে সন্দেহে বাড়ির লোক ওটাকে ঘরে ঢোকাতে দেয়নি। শেষে বোমাতঙ্ক দূর হলে ব্যাগ রহস্য ভেদ করা হয়। তারা না কি মালটা বেচে দেওয়ারই তাল করছিল, ঐ পাঞ্জাবী ভদ্রলোকই বুঝিয়ে সুঝিয়ে রাজি করিয়েছেন। এরপর বর্ধমান গিয়ে ল্যাপটপ উদ্ধার তো নেহাতই সময়ের ব্যাপার।অভিরূপ আর অনির্বাণ বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে রইল, আমি চোরমহল্লায় ঘেরাও হয়ে পড়লে উদ্ধার করার জন্য। আর কোন বিপত্তি হয়নি অবশ্য। খালি পিন্টুর (যে ল্যাপটপটা পেয়েছিল) মা যখন বলল, "আপনার বিবি তো বহুৎ খুবসুরৎ", এমন চমকে উঠলাম যে হাতের কাপ থেকে খানিকটা চা চলকে পড়ল! আমার বিবি আছে আমি নিজেই জানিনা, তো এরা কোত্থেকে জানল!! "বিয়ের ছবি দেখলাম তো!", হাঁফ ছাড়লাম "ওহ তাই বলুন, ওটা আমার এক বান্ধবীর বিয়ের ছবি।" 
গপ্পোটা এখানেই শেষ নয়। বাড়ি ফিরে ল্যাপটপ চালু করতেই চমকে চ! আমার আগের ওয়ালপেপারটার জায়গায় চমৎকার একটা বাঘের ছবি। উইন্ডোস এক্সপ্লোরারটা খুলতে তো ভিরমি খাবার জোগাড়। এসে গেছে দুটো হিন্দি সিনেমা, "দিল্লী বেল্লী" আর "মার্ডার ২" আর বেশ কয়েকটা গেম!