Saturday 28 April 2012

কাঁদরপাড়ি

সাইনবোর্ডটা না থাকলে বিশ্বাস করা মুশকিল হত যে এটা একটা স্টেশন। ফাঁকা মাঠের মধ্যে একটা কাঠের বেঞ্চ আর একটা সাইনবোর্ডে বাংলা, হিন্দি, ইংরেজিতে লেখা আহমেদপুর। প্ল্যাটফর্ম বা টিকিটঘরের কোন চিহ্ন নেই। চারপাশে শুধু চাষের ক্ষেত, একটা মানুষ নেই যে জিজ্ঞাসা করব। অনেকটা দূরে কিছু টালির ঘর দেখা যাচ্ছে। আমরা নজন বাদে ট্রেন থেকে আর কেউ নামেনি। আমরা সবাই রমেশের মুখের দিকে তাকালাম।
রমেশ বলল, “ওরা তো বলেছিল স্টেশন থেকে নেমে কাউকে বললেই দেখিয়ে দেবে কোদারমা গ্রামটা কোনদিকে”।
“আরে লোক কোথায় যে বলব! এদিকে খিদেতে পেট চুঁইচুঁই করছে” রাগত স্বরে বলল গোবিন্দ। “সেকি রে বর্ধমানে দেড় কেজি মিহিদানা তো তুই একাই ... ”
পটল শেষ করার আগেই খিঁচিয়ে উঠল গোবিন্দ, “দেড় কেজি তে কি হয় রে শালা? আর তুই যেন কিছু খাসনি!”
অমল বাধা দিয়ে বলল “অ্যাই তোরা থামত, একবার পৌঁছাতে পারলে তো আর খাওয়া দাওয়া নিয়ে চিন্তা থাকবে না। কিভাবে যাওয়া যায় সেটা ভাব।”
এখানে বলে রাখি যে সময়ের কথা বলছি, তখন মোবাইল ফোন দূরের কথা, কারো বাড়িতে ল্যান্ডফোন থাকা মানে তাকে কেউকেটা বলে গণ্য করা হত। আমি দূরের বাড়িগুলোর দিকে আঙুল দেখিয়ে বললাম, “ওইদিকে গিয়েই খোঁজ করতে হবে মনে হচ্ছে।” রমেশ সেদিকে তাকিয়ে কিছু বলতে যাবে, তার আগেই কেষ্ট চেঁচিয়ে উঠল, “ইউরেকা ইউরেকা”।
“তুই আবার কি পেলি?” বলে ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে দেখি, একজন লোক, আলের ধারে বোধহয় বোধহয় প্রাকৃতিক কাজ সারছে। আমরা হই হই করে তার দিকে এগিয়ে যেতেই সে ঘাবড়ে গিয়ে তাড়াতাড়ি কাজ শেষ করে উঠে দাঁড়ালো।
“ও কাকা, কোদারমা গ্রামটা কোথায় বলতে পারো?” “কোদারমা? হুউউউই দিকে সোজা হাঁটতে থাকুন” বলে উত্তর-পশ্চিম দিকে হাত দেখালো। “তা কোথা থেকে আসা হচ্ছে বাবুদের?”
ভোঁদা তড়বড় করে বলে উঠল, “আমরা আসছি চন্দননগর থেকে, মেয়ে দেখতে যাবো কোদারমায়”।
লোকটা দাঁত বার করে বললো “তাই বুঝি? তা কার বাড়ি যাবেন?”
ভোঁদা কিছু বলার আগেই রমেশ তার পেটে একটা রামচিমটি দিয়ে বললো, “সেসব ওখানে গিয়ে ঠিক করবো, এই তোরা চল, দেরি হয়ে যাচ্ছে। আচ্ছা দাদা অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।” লোকটার হাঁ হয়ে যাওয়া মুখের সামনে দিয়ে আমরা পা চালিয়ে এগিয়ে গেলাম।

আমরা সবাই ছোটবেলার বন্ধু, বুঝতেই পারছেন, একসাথে খেলেছি, বিড়ি খেয়েছি, লোকের বাগান লুঠ করেছি, অন্য পাড়ায় খেলতে গিয়ে মারপিট করেছি ইত্যাদি ইত্যাদি। আমাদের মধ্যে রমেশ সবে রেলে একটা চাকরি পেয়েছে আর অমল স্কুলে পড়ায়। বাকিরা সবাই বলতে গেলে যার যার বাপের হোটেলের নিয়মিত খদ্দের। আর বলাই বাহুল্য সবাই ব্যাচেলর। রমেশ প্রথম দলত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তার জন্যই আজ আমাদের অভিযান। ওর বাবা আর জ্যাঠা পাত্রী দেখে পছন্দ করে এসেছেন। কিন্তু তাতে কি, আমরা দেখবনা আর রমেশের বিয়ে ঠিক হয়ে যাবে তা তো হতে পারেনা!

“এই রে এবার কি হবে?” পটলের কথা শুনে সামনে তাকিয়ে দেখি সামনে একটা কাঁদর। কাঁদর একধরণের ছোট নদীর মত। দুটো ঢাল দুদিক থেকে এসে মিশলে মাঝখানে একটা খাদের সৃষ্টি হয়। সেখানে জল জমে তৈরি হয় কাঁদর। জল বেশি না থাকলে হেঁটেই পার হওয়া যায়, নয়তো ভেলা বা ছোট নৌকা-র দারকার হয়। আমাদের সামনের কাঁদরটায় ভালোই জল রয়েছে, হেঁটে যাওয়া যাবেনা, আর একটা ডিঙি রয়েছে ঠিকই, কিন্তু সেটা ওপারে বাঁধা। আর কোন লোকজনও দেখা যাচ্ছে না। সাঁতরে পার হওয়া যায়, কিন্তু রমেশের হবু শ্মশুরবাড়ি যাচ্ছি, সবাই বেশ ভালো জামাকাপড় পরেই এসেছি। আর উপায়ও তো দেখছি না। শেষ পর্যন্ত সবাই ধরাচুড়ো ছেড়ে, কেষ্ট আর যতীন সঙ্গে দুটো গামছা এনেছিলো সেই দুটো পরে দুজন দুজন করে পার হলাম।
ওপারে গিয়ে জামাকাপড় পড়তে যাবো, এমন সময় রমেশ বললো “এগুলো কি আর এখন পরার দরকার আছে?” গোবিন্দ চোখ তুলে বললো, “মানে? তোর শ্বশুরবাড়ি, তুই যদি আন্ডারওয়ার পরে যেতে চাস, আমাদের কিছু বলার নেই, তবে আমরা পারবনা, সরি”। “আরে বাবা আমি কি তাই বলেছি না কি? রাস্তায় আরো কতগুলো কাঁদর পড়বে কে জানে, তাই বলছিলাম একেবারে গ্রামের কাছাকাছি গিয়ে পরলেই তো হয়” অমল গম্ভীরভাবে বলল, “হুম, এটা ঠিক কথা।” 
সুতরাং আমরা জামাকাপড়গুলো পোঁটলার মতো করে পিঠে ঝুলিয়ে নিলাম। তারপর ওই অবস্থায় সারি বেঁধে এগিয়ে চললাম। আরো দুটো কাঁদর সাঁতার কেটে পার হতে হল। আমাদের দেখে লোকজন অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। আমরা জোরে পা চালাচ্ছিলাম, যাতে অতিরিক্ত কোউতূহলের মুখোমুখি হতে না হয়। তবু একজন জিগ্যেস করে বসল, “কোথায় যাচ্ছেন দাদা?” কেষ্ট উত্তর দিলো, “ফুটবল ম্যাচ আছে, দেখতে যাবেন” “ফুটবল! কোথায় ...” ততক্ষণে আমরা অনেকটা এগিয়ে গেছি, তাই জবাব দেওয়ার দরকার হলনা। এভাবে প্রায় ঘন্টা দেড়েক হাঁটার পর, পটল চেঁচিয়ে উঠল, “ওই দেখ” 
এবার আমরা সকলেই দেখতে পেলাম, একটা ছোট একতলা পাকাবাড়ির সামনে লেখা, “কোদারমা ১ নং গ্রাম পঞ্চায়েত”। এতক্ষণে দেখা গেল রমেশের মুখে একটা লজ্জা ভাব চলে এসেছে। আমরা তাড়াতাড়ি জামাকাপড় পরে নিলাম, এবার তিন কাঁদর পাড়ি দিয়ে যে রাজকন্যার সন্ধানে এসেছি তাকে দেখার পালা।


ঋণঃ সিমলের দাদু
প্রথম প্রকাশঃ পাঠাগার ব্লগ