Thursday 31 October 2013

স্টপগ্যাপ

স্টাফরুম থেকে বেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামছি, তখনই সুতপার ফোনটা এল। আজ আগেও বেরোতে পারতাম। বৃহস্পতিবার লাস্ট পিরিয়ডে আমার ক্লাস থাকেনা। দেবেশদা আসেননি বলে ওনার ক্লাসে স্টপগ্যাপ হয়ে যেতে হল। বড়দের হলে ছেড়ে দেওয়া যেত, কিন্তু ক্লাস সিক্সের ছেলেদের স্কুল ছুটি হওয়ার আগে ছাড়া যায়না।

"হ্যাঁ বলো"
"তোমার ছুটি হয়েছে?"
"হ্যাঁ এই বেরোচ্ছি"
"তোমার এক বাল্যবান্ধবী এসেছেন, বাংলাদেশ থেকে"
আমার বাল্যবান্ধবী! তাও আবার বাংলাদেশ থেকে !!
"বাবার বন্ধুর মেয়ে, বারীনকাকা"
"বারীনকাকা! বল কি? ঠিক আছে আমি এক্ষুনি যাচ্ছি।"

ফোনটা হাতে নিয়েই কয়েক মিনিট সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে রইলাম। তারপর ভোলাদা কে চাবি নিয়ে আসতে দেখে সম্বিত ফিরল। নেমে গ্যারেজ থেকে সাইকেলটা বের করলাম। বাইক একটা কিনেছি, কিন্তু একা থাকলে সাইকেল নিয়েই বেরোই।

বারীনকাকা! কতদিন পর এই নামটা শুনলাম! পাঠকরা যদি ভেবে থাকেন বাল্যপ্রণয়ের তাড়নায় আমার হৃদয়ে ঝড় উঠেছে তাহলে ভুল করবেন। কারণ বারীনকাকার মেয়ের সঙ্গে আমার আদৌ আলাপই হয়নি, কোনদিন দেখিওনি। বারীনকাকারা যখন এখান থেকে চলে যান তখন আমার বয়স নয় কি দশ বছর। ওনার নামটা আর বিক্ষিপ্ত কিছু স্মৃতি ছাড়া বিশেষ কিছু মনে নেই। পরে অবশ্য মা ও দিদিদের কাছ থেকে বারীনকাকার সম্পর্কে অনেক কিছুই শুনেছি। বারীনকাকারা চট্টগ্রামের লোক, দেশভাগের সময় তাঁর বাবা-মা তিন ছেলেমেয়েকে নিয়ে এদিকে চলে এসেছিলেন। আমাদের বাড়ির কাছেই ভাড়া থাকতেন। বয়সের তফাত সত্ত্বেও বাবার সঙ্গে বারীনকাকার বন্ধুত্ব বেশ জমে গিয়েছিল। বাবা কমিউনিস্ট পার্টি করতেন আর বারীনকাকা সক্রিয় রাজনীতি করতেন না, তবে কংগ্রেস ঘেঁষা ছিলেন। সেই সময় অবশ্য রাজনৈতিক মতভেদ আজকের মত অস্পৃশ্যতায় শেষ হত না। দুই পরিবারে অত্যন্ত অন্তরঙ্গতা ছিল। বাবা যখন জেলে বা আন্ডারগ্রাউন্ডে থাকতেন, বারীনকাকাই আমাদের পরিবারের অভিভাবক হয়ে উঠতেন। খুব কমবয়সে বাধ্য হয়ে ভিটেত্যাগ করলেও নিজের দেশের প্রতি বারীনকাকার একটা অদ্ভুত আবেগ ছিল বলে শুনেছি। মুক্তিযুদ্ধের সময় না কি প্রচণ্ড অস্থির হয়ে পড়েছিলেন, সারাদিন রেডিওর খবরের জন্য অপেক্ষা করে বসে থাকতেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার বছর পাঁচেকের মধ্যেই তল্পিতল্পা গুটিয়ে স্ত্রী ও অবিবাহিতা বোনকে নিয়ে দেশে ফিরে যান। বারীনকাকার ভাই গিরীনকাকা এখানেই রয়ে গিয়েছিলেন। প্রথমদিকে বেশ কিছুদিন অবধি চিঠিপত্রের চালাচালি হত, তারপর আস্তে আস্তে যোগাযোগটা বন্ধ হয়ে যায়। শুনেছিলাম বারীনকাকার স্ত্রী মারা গেছেন সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে। তার কয়েকবছর পরে বারীনকাকার মৃত্যুর খবর পেয়ে বাবা বেশ ভেঙে পড়েছিলেন মনে আছে।

পুরনো কথা ভাবতে ভাবতে কখন যে কুড়ি মিনিটের রাস্তাটা সাইকেলে পেরিয়ে এসেছি খেয়ালই নেই। ঘরে ঢুকে দেখি দুজন ভদ্রমহিলা আর একজন বয়স্ক যুবক সুতপার সঙ্গে কথা বলছে। "যুবক"টিকে চিনতে পারলাম, গিরীনকাকার ছেলে পিলু।
পিলু আমার দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, "কেমন আছ গ্যাঁড়াদা?"
"ভালো, তোর সঙ্গে অনেকদিন পর দেখা হল।"
"তোমাকে অবশ্য রাস্তায় দেখি মাঝে মাঝে। আলাপ করিয়ে দিই, জ্যাঠামশাইয়ের মেয়ে পূরবী আর ওর মাসি।"

পূরবী নমস্কার করে বললেন, "আমাকে পূরবী বলেই ডাকতে পারেন। আমি চিটাগং ইউনিভার্সিটিতে স্যোসিওলজি পড়াই। আপনাদের ফ্যামিলির কথা অনেক শুনেছি বাবার কাছে। আজ এখানে আসতে পেরে খুব ভালো লাগছে। এসেছি অবশ্য একটা বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে। সত্যিকথা বলতে কি ইন্ডিয়াতেই এই প্রথম এলাম।"

কথায় কথায় পূরবীর ইন্ডিয়া সফরের বিশেষ উদ্দেশ্য জানা গেল। পূরবীর জন্মের দুদিন বাদে ওনার মা মারা যান। তারপর বারীনকাকা একই সঙ্গে মা ও বাবার ভূমিকা পালন করে মেয়েকে মানুষ করেন। অনেকেই দ্বিতীয়বার বিয়ে করার কথা বললেও তিনি রাজি হননি। কিন্তু পূরবীর যখন চোদ্দ বছর বয়স, আচমকা হার্ট আটাকে চলে যান বারীনকাকা। তারপর পিসির কাছে থেকে বড় হন। পিসি ও পিসেমশাই খুবই ভালোমানুষ, নিজের দুই ছেলের সঙ্গে পূরবীকে নিজের মেয়ের মতই মানুষ করেছিলেন। দুই দাদা বিদেশে সেটল করার পর পিসি-পিসেমশাই এখন পূরবীর তত্বাবধানেই থাকেন।

"পিসি-পিসেমশাইকে আমি মা-বাবার মতই দেখি। তবু নিজের মা-র অভাবটা কোনদিন বোধ করিনি তা বলতে পারবনা। আর বাবার কথা ভাবলে মনে হয় এই তো সেদিন। বাবা নিজে জজমানি করতেন। গ্রামে বেশিরিভাগই মুসলিম হলেও বেশ কয়েকঘর হিন্দু আছে। তাদের যেকোন পুজো বা অনুষ্ঠানে বাবার ডাক পড়ত। আর হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সবাই বাবাকে বেশ শ্রদ্ধা করত মনে আছে। বাবার ইচ্ছে ছিল আমি যেন অনেক পড়াশোনা করি, আনেক উঁচু জায়গায় যাই। একদিন মনে আছে মাঝরাত্তিরে ঘুম ভেঙে গেছে। দেখলাম বাবা বাইরের দাওয়ায় চুপ করে বসে আছেন। আমি আস্তে আস্তে বাবার পাশে গিয়ে বসলাম। সেদিন বোধহয় জ্যোৎস্না ছিল। সামনের বাগানটা চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছিল। বাবা আমার মাথাটা কোলে টেনে নিয়ে বললেন, লোকে বলে মানুষ মরে গেলে নাকি আকাশে চলে যায়। সত্যিমিথ্যে জানিনা, তবু মনে হয় যেন তোর মা দেখছে আমি তোকে কিভাবে মানুষ করছি। আমি তো বিশেষ লেখাপড়া করিনি, ঐ পুরুতগিরিটা জানি তাই চালিয়ে নিচ্ছি। তোর মা খুব বই পড়তে ভালোবাসত। তুই যখন পেটে, মা আমাকে বলত, ছেলে মেয়ে যাই হোক না কেন সে যেন অনেক পড়াশুনো করে, ডাক্তার বা বড় অধ্যাপক বা ওরকম কিছু হয়। দেখিস মায়ের স্বপ্ন যেন মিথ্যে না হয়।"

পূরবী একটু থেমে চশমা খুলে শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখটা মুছলেন। সবাই চুপ। তারপর পূরবী নিজেই শুরু করলেন। "আমাদের ভার্সিটিতে রাজু চাকমা বলে একটা ছেলে আছে। গেল বছর ওদের একটা পরবে বন্ধুদের সঙ্গে আমাকেও নেমন্তন্ন করেছিল। ওদের পাহাড়ি গ্রাম, বাড়ি সব ঘুরিয়ে দেখাল। ওর পড়ার টেবিলের সামনেই এক মহিলার অস্পষ্ট ফটো। জানতাম ওরও খুব কমবয়সে মা চলে গেছে। ওকে কিছু জিজ্ঞেস করিনি। কিন্তু তারপর থেকে মনে হল রাজুর তো তবু কিছু আছে, একটা ছবি আছে, হয়ত মনের মধ্যে সযত্নে ঢেকে রাখা কিছু স্মৃতিও আছে। আমার তো সেসব কিছুই নেই। তাই ঠিক করলাম এবার মা-কে খুঁজতে যেতেই হবে।"

"ইন্ডিয়াতে আসার ইচ্ছে অনেকদিনই, কিছুতেই হয়ে ওঠেনা। তবে পিলুদার সঙ্গে যোগাযোগটা ছিল, ও একবার ঢাকায় ঘুরেও এসেছে। এবার একরকম জোর করেই চলে এলাম। এই প্রথম মামারবাড়ি গেলাম। তিন মামার মধ্যে দুজন মারা গেছেন আর ছোটমামার জন্মের আগেই মা-র বিয়ে হয়ে গেছিল। একমাত্র এই মাসিরই মা-র কথা মনে আছে।"
মাসি আমাদের বাড়ির দুটো পুরনো ছবির আলবাম দেখছিলেন। এবার তিনি মুখ খুললেন। "দিদির চেয়ে আমি অনেকটাই ছোট, তবু আমরা খুব বন্ধু ছিলাম । যদিও দুজনের স্বভাব ছিল একেবারে উলটো। আমি ভীষণ দুরন্ত ছিলাম, সবাই বলে। আর দিদি ছিল শান্ত, অঙ্ক করতে খুব ভালোবাসত, সারাদিন বই মুখে নিয়ে বসে থাকত। আমি পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে মিশে বদমায়েসি করে বেড়াতাম আর সেসব খবর বাবার কাছে আসত। বাবা খুব রাগী ছিলেন, কিন্তু দিদিকে খুব ভালোবাসতেন। আমাকে যে দিদি কতবার বাবার হাতে মার খাওয়া থেকে বাঁচিয়েছে তার ঠিক নেই। পূরবীর সঙ্গে কথা বলতে বলতে কত কিছু যে মনে পড়ছে ..."

পিলু বলল "কিন্তু মুশকিলটা হচ্ছে, জেঠিমার কোন ছবি তো পাওয়া যাচ্ছে না। আমার কাছে নেই, পূরবীর মামারবাড়িতেও পাওয়া গেল না। সেইজন্যেই আরো তোর কাছে নিয়ে এলাম। তোদের বাড়িতে তো তখন খুবই যাতায়াত ছিল আর অনেক ছবিও তোলা হত মনে আছে।"
পূরবী বললেন, "বৌদি দুটো আলবাম দিয়েছেন। মাসি দেখছে, আমি তো মা কে চিনতে পারব না।"
বারীনকাকার স্ত্রী, কি নাম ছিল মনে নেই, চেহারাটাও মনে আসছেনা। তবে বারীনকাকার বিয়েতে আমরা সবাই বরযাত্রী গিয়েছিলাম সেকথা বেশ মনে আছে। বললাম, "আর একবছর আগে এলে খুব ভালো হত। কাকিমার কোন ছবি থাকলে মা অবশ্যই জানতেন। মা মারা গেছেন গতবছর।"
পিলু বলল, "তুষারজ্যাঠা মারা গেছেন তিন সালে, না?"
"না, টু থাউজ্যান্ড ফোরের মার্চ।"

পূরবী আমাকে ছোটবেলার দিনগুলোতে ফিরিয়ে দিলেন। মনে পড়ছে সেই সময়ের পরিবেশ, মানুষজন। ছোটবেলায় বাবাকে সেভাবে আমরা পাইনি। বাবা পার্টির কাজে বাইরে ঘুরে বেড়াতেন, সেই আর্থিক অনটনের দিনগুলোয় মা কিভাবে আমাদের সাত ভাইবোনকে মানুষ করেছেন তা এখন ভাবাই যায়না। তখন অবশ্য বাবা-মারা সন্তানদের ভবিষ্যত নিয়ে আজকের মত টেনশন করতেন না। মা রাজনীতি করতেন না, রাজনীতিকে খুব একটা পছন্দও করতেন না। কিন্তু যেকোন কারো বিপদ আপদে সব ফেলে ছুটে যেতেন। প্রায় রোজই এলাকার কোন না কোন মহিলা আসতেন তাঁদের পারিবারিক সমস্যা নিয়ে। মা তাদের বোঝাতেন, কখনও কখনও নিজে তাঁদের বাড়ি গিয়ে সমাধানের চেষ্টা করতেন। মা শিক্ষিত ছিলেন, কলেজেও পড়েছেন, কিন্তু চাকরি করেননি। পাড়ার ছোট ছেলেমেয়েদের পড়াতেন। তাতে কত আর রোজগার হত, বেশীরভাগই তো মাইনে দিতে পারত না। তাতে কি, সকল শিশুই ছিল মায়ের সন্তানের মত। মা আমার জীবনে কি ছিলেন, তা আগে কোনদিন এভাবে অনুভব করিনি। আজ পূরবীর কথা শুনে বুঝতে পারলাম যে আমি কত ভাগ্যবান।

সুতপা সবার জন্য চা, মিষ্টি, সিঙ্গাড়া নিয়ে ঘরে এল। ও বোধহয় ম্যাজিক জানে, এসবের ব্যবস্থা কিভাবে করল কে জানে। আমারই উচিৎ ছিল বাড়ি আসার সময় কিছু নিয়ে আসা। স্মৃতিমন্থনে ডুবে গিয়ে সেসব ভুলেই গিয়েছি। সুতপা বলল, "তুমি আসার আগে বড়দাকে ফোন করেছিলাম। কাকিমা মানে পূরবীদির মার কোন ছবি আছে বলে তো মনে করতে পারলেন না।"

পিলু বলল, "আমার যেন মনে হচ্ছে তুষারজ্যাঠার সঙ্গে জ্যাঠা-জেঠিমার একটা ফটো তোলা হয়েছিল, আমিও ছিলাম সেখানে। আমি অবশ্য তখন খুবই ছোট।"
"আলবামদুটোয় কিছু পেলেন না?" মাসিকে জিজ্ঞাসা করলাম। "অনেক পুরনো ছবি, বেশীরভাগই নষ্ট হয়ে গেছে।"
"এইটা একবার দেখুন তো", মাসি অ্যালবামটা এগিয়ে দিলেন।
ছোট্ট ছবি। দুজন পুরূষের মাঝখানে একজন মহিলা, মহিলার সামনে একটা বাচ্ছা। তবে ছবির বাঁদিকটা প্রায় নষ্ট হয়ে গেছে। ডানদিকের পুরূষটির ওপর আঙুল দেখিয়ে পিলু বলল, "এটা তো জ্যাঠা?"
সেবিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। আর বাঁদিকের পুরূষটি সম্ভবতঃ বাবা। "এটা সিওর আমি", বাচ্ছাটাকে দেখিয়ে বলল পিলু।

পূরবী উত্তেজিত হয়ে বললেন, "তাহলে কি ..."
"মনে তো হচ্ছে ... তবে ছবিটার যা অবস্থা, আপনার বোধহয় খুব একটা লাভ হবেনা" ছবিটা আলবাম থেকে খুলতে খুলতে বললাম।
পূরবী জলভরা চোখে বললেন, "যা পেয়েছি তাই যথেষ্ট। দেখি কোনভাবে রিকভার করা যায় কি না ... আপনাকে যে কি বলে ..."
"কিছুই বলতে হবেনা, শুধু কথা দিন যখনই এদেশে আসবেন আমাদের বাড়ি ঘুরে যাবেন।"

পূরবী কথা দিলেন এবং আমাদেরকেও বাংলাদেশে যাওয়ার জন্য নেমন্তন্ন করলেন। বললেন উনি পরশু ফিরে যাচ্ছেন। আগামীকাল কলকাতাটা একটু ঘুরে দেখবেন।

ওঁদের বিদায় জানিয়ে ঘরে এসে সুতপা জিজ্ঞাসা করল, "ছবিটা কি সত্যিই পূরবীদির মা-র ছিল?"
"নাহ, আমি ভালো করেই জানি ওটা মা-র ছবি। আর বাচ্ছাটাও পিলু নয়, স্বয়ং আমি। তবে পূরবী যদি আমার মা-র মধ্যেই ওঁর মা-কে খুঁজে পান তাহলে ক্ষতি কি?"
সুতপা কিছু না বলে চোখ দিয়ে সমর্থন জানাল। আমি আলবাম দুটো খুলে পাতা ওলটালাম। ধাপ্পাটা আশা করি পূরবী ধরতে পারবেন না।

প্রথম প্রকাশঃ অবকাশ, পুজো ১৪২০