Sunday 29 September 2013

ইচ্ছাপূরণ

সুবলচন্দ্রের ছেলেটির নাম সুশীলচন্দ্র। সকল সময় নামের মত মানুষটি হয়না বটে, কিন্তু ইহাদের ক্ষেত্রে নাম ও স্বভাবের আশ্চর্য্য সাদৃশ্য লক্ষ্য করা গেছে। সুশীলচন্দ্র শান্ত, নম্র ও লেখাপড়ায় অতিশয় মনোযোগী। অপরদিকে বয়সের কারণে নানা আধিব্যাধিতে ব্যতিব্যস্ত হইলেও যৌবনে সুবলচন্দ্র রীতিমত বলশালী ছিলেন। 

সুশীলচন্দ্র ইস্কুলে পড়ে। পড়াশোনায় সে যেমন মেধাবী, খেলাধূলায় তেমনি দড়। বাড়িতে তাহার বন্ধুবান্ধবদের অবারিত দ্বার। আজ সুবলবাবু তাঁহার দৈনন্দিন বৈকালিক আড্ডার পর বাড়ি আসিয়া দেখিলেন সুশীলচন্দ্রের সহিত একটি কিশোরী গল্প করিতেছে। টিউশন ইত্যাদির দৌলতে সুশীলচন্দ্রের বান্ধবীর সংখ্যা নেহাত অল্প নহে। এই মেয়েটিকে অবশ্য আগে দেখেননি। সে সুবলচন্দ্র কে প্রণাম করিয়া বলিল, "কাকু, আমি দামিনী, সুশীলের বন্ধু"। সুবলচন্দ্র তাহার মাথায় হাত রাখিয়া আশীর্বাদ করিলেন বটে কিন্তু তাহার স্কার্টের নীচ দিয়া প্রসারিত শ্বেতশুভ্র পদদ্বয় ও বক্ষের উপর প্রস্ফূটিত নিটোল স্তনযুগলের আভাসে সুবলচন্দ্রের শরীরে কেমন যেন অস্বস্তি হইতে লাগিল। সুশীলের অনেক বান্ধবীকে দেখিয়াই তাঁহার এমন দেহচাঞ্চল্য ঘটিয়া থাকে, তবে আজ আর পারিলেন না। তাড়াতাড়ি শৌচাগারে যাইয়া মনে মনে বলিলেন, "আবার যদি বয়সটা ফিরে পাই তবে মনের সুখে ফূর্তি করতে পারি।" 

ইচ্ছাঠাকরুন সেই সময় ঘরের বাহির দিয়া যাইতেছিলেন। পূর্বের ঘটনাক্রম তাঁহার গোচরে আসিলে কি করিতেন বলা শক্ত। তবে মোবাইল ফোনের টাওয়ার হইতে নির্গত তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গের প্রভাবে দেবতাদের চক্ষু-কর্ণের ব্যাপক ক্ষতি হইয়াছে। তিনি সুবলচন্দ্রের মনের কথাটিই খালি পড়িতে পারিলেন, কিন্তু "ফূর্তি"র সঠিক অর্থ তাঁহার বোধগম্য হইল না। সুবলচন্দ্রকে গিয়া বলিলেন, "তোমার ইচ্ছা পূর্ণ হইবে। কাল হইতে তুমি তোমার ছেলের বয়স পাইবে।"

বয়স হইলেও সুবলচন্দ্রের রাত্রে ঘুম ভালোই হইত। কিন্তু আজ উত্তেজনায় তাঁহার চোখের পাতা এক হইল না। ভোরের দিকে একটু ঘুম আসিয়াছিল। সকালে জাগিয়াই এক লাফ দিয়া মেঝেতে পড়িলেন। দেখিলেন চুল সব কালো হইয়া গেছে, পাকা গোঁফদাড়ির জায়গায় সদ্য ওঠা কচি গোঁফদাড়ি দেখা দিয়ছে, পড়া দাঁত সবগুলি উঠিয়াছে। যে গেঞ্জিটি পরিয়াছিলেন তাহা ঢিলা হইয়া গেছে, পাজামার দড়ি খুলিয়াছে। তাঁহার শরীরের তাজা রক্ত চনমন করিয়া উঠিল। 

সেদিন দামিনী যখন ইস্কুল হইতে ফিরিতেছিল, সুবলচন্দ্র তাহার পথ আটকাইলেন। সুশীলের চেহারা ও কন্ঠস্বরের সহিত ছেলেবেলার সুবলচন্দ্রের বেশ সাদৃশ্য ছিল। পড়ন্ত আলোয় দামিনী সুবলচন্দ্রকে সুশীল বলিয়া ভুল করিল। আগেও কয়েকবার সে ইস্কুল ফেরৎ সুশীলের বাড়ি গিয়াছে। শর্টকার্ট দিয়া বাড়ি যাইবার ছল করিয়া সুবলচন্দ্র তাহাকে হরি ঘোষের গোয়ালের দিকে লইয়া যাইলেন। হরিঘোষের মৃত্যুর পর ছেলেরা এখন কলিকাতাবাসী, তাঁহার বসতবাটি ও বিশাল গোয়াল পরিত্যক্ত পোড়োবাড়ির দশা পাইয়াছে। ফলতঃ দামিনী যখন নিজের ভুল বুঝিতে পারিল তখন চিৎকার করিয়াও কোন লাভ হইল না।

পরদিন ভোররাতে যখন দামিনীর নিরাবরণ, অচেতন দেহ আবিষ্কৃত হইল, সুবলচন্দ্র ততক্ষণে ইচ্ছাঠাকরুনের সাহায্যে নিজের বয়সে প্রত্যাবর্তন করিয়াছেন। দামিনীর মৃত্যুকালীন জবানবন্দী ও অন্যান্য সূত্রের মাধ্যমে কিভাবে সুবলচন্দ্র সনাক্ত হইলেন সে মহাভারত আর বর্ণনা করিলাম না, তবে দামিনীর যৌনাঙ্গের ভিতরে থাকা তাঁহার অতি পরিচিত টর্চটি এব্যাপারে বড় ভূমিকা পালন করিয়াছিল। এই ঘটনা লইয়া দেশজুড়ে শোরগোল পড়িয়া গেল। সংবাদমাধ্যম সরকারকে তুলোধোনা করিতে লাগিল, টেলিভিশনে ঘটনার কাল্পনিক নাট্যরূপ প্রদর্শিত হইল, বিরোধীদল দামিনীকে নিজেদের সমর্থক ও সুবলচন্দ্রকে শাসকদলের কর্মী বলিয়া আন্দোলন শুরু করিল, বিদ্বজনেরা সান্ধ্য বিতর্কে গলা ভাঙ্গিয়া ফেলিলেন, নাগরিক সমাজ সুবলচন্দ্রের ফাঁসির দাবীতে রাস্তায় মোমবাতি মিছিল ও ফেসবুকে লাইকের ঝড় তুলিল। সন্ধ্যাবেলায় দামিনী বাড়ির বাইরে কি করিতেছিল তাহা লইয়া মুখ্যমন্ত্রী সংশয় ব্যক্ত করিলেন এবং এই সামাজিক অবক্ষয়ের পিছনে পূর্বতন সরকারের দায়টা নিঃসংশয়ে ঘোষণা করিলেন।

পুলিসে হেফাজতে থাকাকালীন সুবলচন্দ্র কোন মন্তব্য করেননি। অবশেষে আদালতে শুনানির সময় আস্তিন হইতে তুরুপের তাসটি বাহির হইল। তাঁর আইনজীবি দাবী করিলেন যে ঘটনার সময় সুবলচন্দ্রের বয়স ছিল মাত্র সতের বছর। সরকারি আইনজীবি তার সহকর্মীর মস্তিস্কের সুস্থতা সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করিলে তিনি ইচ্ছাঠাকরুনকে সাক্ষী মানিলেন। ইচ্ছাঠাকরুন ইতিমধ্যে নারদের নিকট সকলই আবগত হইয়াছেন। তিনি নিজের কৃতকর্মের জন্য মাথা ঠুকিতেছেন কি না তা অবশ্য জানা যায়নি।

একুশ শতকে দেবতাদের প্রতিপত্তি বলিতে আর কিছু অবশিষ্ট নাই। মানুষের আদালতের সমন তাঁহারা উপেক্ষা করিতে পারেন না। তাই ইচ্ছেঠাকরুন সাক্ষীর কাঠগড়ায় দাঁড়াইয়া বলিতে বাধ্য হইলেন যে ঘটনার দিন তাঁহার আশীর্বাদে সুবলচন্দ্র সপ্তদশ বয়ঃপ্রাপ্ত হইয়াছিলেন কিন্তু এজন্য তাঁহার প্রাপ্য শাস্তিতে কোন ছাড় দেওয়া অনুচিৎ হইবে। সুবলচন্দ্রের আইনজীবি ধমক দিয়া বলিলেন, "আপনাকে সাক্ষ্য দিতে ডাকা হয়েছে, শাস্তি দেওয়া আদালতের দায়িত্ব।"

আদালত সংবিধানের প্রতি আনুগত্য বজায় রাখিয়া সে দায়িত্ব পালন করিল। দামিনীকে ধর্ষণ ও নৃশংস ভাবে হত্যার জন্য সুবলচন্দ্র দোষী সাব্যাস্ত হইলেও নাবালক হিসেবে তাঁহাকে তিন বছরের জন্য জুভেনাইল হোমে রাখার নির্দেশ দেওয়া হইল। সুবলচন্দ্রের আইনজীবি বলিলেন, ঘটনার সময় নাবালক হইলেও এখন তাঁহার বয়স পঞ্চাশের অধিক। এই বয়সের কোন ব্যক্তিকে কিভাবে জুভেনাইল হোমে রাখা যায়! সবদিক বিবেচনা করিয়া বিচারক সুবলচন্দ্রকে মুক্তি দিলেন। সুবলচন্দ্রের আইনজীবি ফের আবেদন জানাইলেন, অর্বাচীন জনতা আইনের বিচার বুঝিবে না, তাহাদের ক্রোধ হইতে তাঁহার মক্কেলকে নিরাপত্তা দেওয়া হউক। আদালত তাঁহার আর্জি মঞ্জুর করিলেন। জেড প্লাস নিরাপত্তা বলয় লইয়া ঘরে ফিরিলেন সুবলচন্দ্র।

ঋণঃ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
প্রথম প্রকাশঃ লেখালেখি ফেসবুক গ্রুপ

গদাইয়ের প্রতিশোধ

গদাই হচ্ছে এ পাড়ার সবচেয়ে ডানপিটে ছেলে। প্রায় প্রতিদিনই তার বাবার কাছে নানারকম নালিশ জমা পড়ে। কার জানলার কাঁচ ভেঙ্গেছে, কার ছেলেকে ধোলাই দিয়েছে, কার গাছ থেকে জামরুল চুরি করেছে, এই আর কি। আর স্কুলে! সেখানে তো সাতটা ক্লাসের মধ্যে চারতেতেই গদাইকে কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়।
সেদিন তো এক কাণ্ডই হয়ে গেল। গদাইয়ের অঙ্কের মাস্টারমশাই হচ্ছেন ছাত্রদের কাছে সাক্ষাৎ যম। তিনি যত না অঙ্ক ভালোবাসেন তার চেয়ে বেশী ভালোবাসেন পেটাতে।। এমন কি ক্লাস টুয়েলভের ছাত্ররাও তাঁরা হাত থেকে রেহাই পায় না। তার নাম গোবিন্দ চ্যাটার্জি হলেও গবু নামেই তিনি অধিক পরিচিত।
তা সেদিন গবু স্যারের কাছে গদাই বেধরক পেটানি খেল। সে এমন কিছু করেনি, খালি গণেশের সাদা জামাটা দেখতে বাজে লাগছিল বলে সেখানে পেন দিয়ে একটা হাতি এঁকে দিয়েছিল, কেষ্টর ব্যাগে দুটো জ্যান্ত আরশোলা ঢুকিয়ে দিয়েছিল আর গোবরের পেছনে একটা কাগজের ল্যাজ লাগিয়ে দিয়েছিল।
এই সামান্য কাজের জন্য তাকে পেটানোয় আর পরদিন বাবাকে ডেকে সব বলে দেওয়ায় গদাই ভারি অপমানিত বোধ করেছিল। তাছাড়া ওরাও তো গদাইএর চেয়ে ভালো কাজ কিছু করেনি! ক্লাস না করে মাঠে ফুটবল খেলছিল বলে গোবর যে স্যারকে বলে দিল? সংস্কৃত ক্লাসে ধাতুরূপ মুখস্থ বলে কেষ্ট যে গদাইকে কানমলা খাওয়াল? গদাই যে ধাতুরূপ পড়েনি তা কি ও জানত না! আর গনেশের জামায় ছবি আঁকায় তো সুন্দরই লাগছিল!
তবু কেন গদাইএর ওপর সব দোষ পড়ে? নাহ, এর একটা বিহিত না করলেই নয়। গবু স্যারের ওপরই প্রথম শোধটা নিতে হবে।
একবার সে সাইকেলের পাম্প খুলে রাখল। কিন্তু ওদের ক্লাসেরই এক বিশ্বাসঘাতক ছেলে দেখে ফেলল আর গদাই আগের বারের দ্বিগুন মার খেল হেডস্যারের কাছে। নাহ, এভাবে কিছু হবে না। অন্য ফন্দী আঁটতে হবে।

আজ সকাল থেকেই গোবিন্দবাবুর মেজাজটা বেশ ভালো ছিল। প্রথমতঃ বর্ধমান থেকে তাঁর ভাগনে এসেছিল। সঙ্গে বাক্সভর্তি সীতাভোগ-মিহিদানা। এদুটোই গোবিন্দবাবুর প্রিয় খাবার। তার ওপর পড়তে আসা চার-চারজন ছাত্রকে তিনি মনের সুখে ঠেঙাতে পেরেছেন। যেদিন তার মেজাজ ভালো থাকে সেদিন তিনি ছেলের মাথায় গাঁট্টা মারেন, মেয়ের কান মলে দেন আর বৌএর সঙ্গে ঝগড়া করেন। আজও তার ব্যতিক্রম হল না। ঝগড়া টগড়া করে, পাঁঠার মাঙ্গস দিয়ে ভাত খেয়ে পান চিবোতে চিবোতে বেরোতে যাচ্ছেন আর তক্ষুনি "ক্রিং ... ক্রিং...", ফোনটা বেজে উঠল-
"হ্যালো?"
"মিস্টার গোবিন্দ চ্যাটার্জি আছেন?"
"কথা বলছি"
"আমি টেলিফোন অফিস থেকে বলছি। আপনার প্রথম টেলিফোন বিলটা নিয়ে দুপুর আড়াইটের মধ্যে এখানে চলে আসুন। নয়ত টেলিফোনের লাইন তো কাটা যাবেই তার ওপর দশ হাজার টাকা জরিমানা হবে"
"কেন কেন? কি ব্যাপার? ... হ্যালো হ্যালো ..."
গোবিন্দবাবু টেলিফোন নিয়েছেন সাত বছর হল। সাত বছর আগের বিল খুঁজে পাওয়া কি সোজা কথা! কিন্তু খুঁজতে তো হবেই, নইলে দশ হাজার টাকা নিয়ে নেবে! চারতে প্রাণী মিলে বিসাল পৈতৃক বাড়িতে তন্ন তন্ন করে টেলিফোনের বিল খুঁজতে লাগলেন। কত কিছুই বেরোল, গোবিন্দবাবুর ফিফথ ক্লাস থেকে ফোর্থ ক্লাসে ওঠার রেজাল্ট, স্কুল পালিয়ে দেখা সিনেমার টিকিট, বাবা-মার বিয়ের কার্ড, পাঁচ বছর আগে হারানো গিন্নীর সোনার দুল, বাড়ির বিভিন্ন জায়গা থেকে মোট তেইশ টাকা পঁইয়ষট্টি পয়সা আর ... না থাক আর তালিকা বাড়িয়ে কাজ নেই।
শেষ পর্যন্ত প্রত্যাশিত বস্তুটি পাওয়া গেল ২টো বেজে পঁচিশে। আবিষ্কারক গোবিন্দবাবুর মেয়ে।
তাঁর বাড়ি থেকে টেলিফোন অফিস যেতে পনের-কুড়ি মিনিট লাগে। ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন ঝড়ের বেগে আর ফিরে এলেন আধঘন্টার মধ্যেই।
এসে বোমার মতই ফেটে পড়লেন। "কোন শয়তান এটা করল আমি তাকে দেখে নেব ... ওখানে বলে কি না, 'কে আপনাকে ফোন করেছিল? স্বপ্ন দেখেছেন!' ... হুঁহঃ"
বাইরে তখন হাসিতে গরাগড়ি যাচ্ছে গদাই আর তার সাঙ্গোপাঙ্গোরা।


হাত পাকাবার আসর, সন্দেশ (চৈত্র ১৪০৭) এ প্রকাশিত