Saturday 25 November 2017

কিষাণ মুক্তি আন্দোলন নিয়ে কিছু কথা

এই নভেম্বর মাসের ২০ ও ২১ তারিখ সমস্ত সংবাদমাধ্যম যখন পদ্মাবতীময় তখনই নয়াদিল্লীর রামলীলা ময়দানে সমবেত হয়েছিলেন দেশের নানা প্রান্ত থেকে আসা তিন লক্ষের বেশী কৃষক। পার্লামেন্ট স্ট্রীটে মহামিছিলেও সামিল হন তাঁরা। তাঁরা এসেছিলেন "কিষাণ মুক্তি সংসদ" এ যোগ দিতে, ১৮৪টি কৃষক ও ক্ষেতমজুর সংগঠনের যৌথ মঞ্চ "অল ইন্ডিয়া কিষান সংঘর্ষ কো-অর্ডিনেশান কমিটি"র ডাকে। দেশের সংসদ তাঁদের কথা শুনছে না, তাই নিজেরাই সংসদ বসালেন কৃষকরা। পার্লামেন্টের ৫৪৫ জন সদস্য সংখ্যার সঙ্গে মিলিয়ে ৫৪৫ জন আত্মঘাতী কৃষক পরিবারের সদস্য উপস্থিত ছিলেন সাংসদ হিসেবে। প্রতিটি ধারা ধরে দুদিন আলোচনার পর পাস হল দুটি বিলঃ (১) কৃষক যেন তাঁর পরিশ্রমের উপযুক্ত পারিশ্রমিক পান তা নিশ্চিত করতে হবে। সমস্ত ফসল, দুধ এবং কিছু বনজ দ্রব্যের মোট উৎপাদন খরচের ৫০% বেশী ন্যূনতম সহায়ক মূল্য ধার্য করতে হবে এবং উৎপাদক যাতে এই মূল্যে তাঁর পণ্য বিক্রয় করতে পারেন তার ব্যবস্থা করতে হবে। (২) কৃষককে ঋণের জাল থেকে মুক্ত করার জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে। শুধু ভোটের আগে ঋণ মকুব করা নয়, রাষ্ট্রকে ধারাবাহিকভাবে তার নাগরিকদের অন্নদাতা কৃষকদের পাশে থাকতে হবে।

কৃষক আত্মহত্যা, ঋণের জাল ও স্বামীনাথন কমিশন

এই দুটো দাবী আকাশ থেকে পড়া কিছু নয়, ১০ বছর আগে কৃষিক্ষেত্রের সংকট ও কৃষক আত্মহত্যার কারণ অনুসন্ধানের জন্য গঠিত স্বামীনাথন কমিটির সুপারিশের অঙ্গ এই দুই প্রস্তাব। ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে বিজেপি কৃষকদের দেড়গুণ রিটার্ন দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কৃষকদের অবস্থা শাঁখের করাতের মত। ফসল উৎপাদন কম হলেও সমস্যা, বিক্রি করে খরচ উঠবে না, আবার বেশী উৎপাদন হলেও দাম পড়ে গিয়ে লোকসান হয়ে যাবে। আমরা বাজার করতে গিয়ে টের পাই আজ আলু ৮ টাকা কেজি তো মাসখানেক বাদেই ২০ টাকা কেজি হয়ে গেল! দাম পড়ে গেলে কৃষকদের সর্বনাশ তো বটেই, দাম বাড়লেও যে তাঁরা খুব লাভবান হন তা নয়। ফসল ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই ঋণশোধ করার তাগিদে এবং ফসল সংরক্ষণে অপারগতার কারণে তাঁরা ফসল বিক্রি করে দিতে বাধ্য হন। আর দাম বাড়ে বিক্রি করে দেওয়ার পরেই। কৃষকদের দুর্দশার কারণ খুঁজতে গিয়ে স্বামীনাথন কমিটি দেখেছিল ভূমিবন্টনে বীভৎস বৈষম্য, প্রাচীন প্রযুক্তি, সেচ হীনতা, প্রাতিষ্ঠানিক ঋণের অপ্রতুলতা ও দীর্ঘসূত্রিতা ইত্যাদি। ঐ কমিটির সুপারিশগুলোর মধ্যে ছিল অসম্পূর্ণ ভূমিসংস্কার সম্পূর্ণ করা, জলসংরক্ষণ ও উন্নত প্রযুক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে আরো বেশী সংখ্যক জমিকে সেচের আওতায় আনা, সরকারি বিনিয়োগ বাড়ানো, কম ঝুঁকিপূর্ণ ও কমদামী প্রযুক্তির ব্যবহার উৎসাহিত করা, পর্যাপ্ত ঋণ ও বীমার ব্যবস্থা করা, সার্বজনীন গণবন্টন ব্যবস্থা, সামাজিক নিরাপত্তার জন্য নানাবিধ প্রকল্প যথা স্বাস্থ্যবীমা, বার্ধক্যভাতা ইত্যাদি। ২০০৬ সালে জমা পড়া এইসব সুপারিশ কংগ্রেস সরকারের হিমঘরেই পড়ে ছিল। আর বিজেপি? ৫০% লাভের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এসে তারা একদিকে সারের দাম বাড়িয়ে চলল অন্যদিকে এমন নিচু হারে সহায়ক মূল্য ধার্য করল যা উৎপাদন খরচের চেয়ে সামান্য বেশী, শস্যবিশেষে কম। দেখা গেছে হরিয়ানার এক চাষী তাঁর আড়াই হেক্টর জমিতে বাজরা চাষ করে যদি সরকার নির্ধারিত সহায়ক মূল্যে তাঁর উৎপাদিত এক কুইন্টাল বাজরা বিক্রি করেন তবে এক মরশুমে তাঁর লাভ দাঁড়ায় ২৯৪০ টাকা! সরকারের আশা এই টাকা দিয়ে তিনি ঋণের সুদ মিটিয়ে সংসার প্রতিপালন করবেন। বাস্তব অবশ্য আরো কঠিন, কারণ তিনি তাঁর ফসল বিক্রি করতে বাধ্য হন সহায়ক মূল্যের অনেক কম দামে, যার ফলে তাঁর লোকসান দাঁড়ায় ২৮০০ টাকা। এর ফল - সংসার চালানোর জন্যেই এবার তাঁকে ঋণ করতে হয় স্থানীয় মহাজনদের কাছে। ছোট চাষীরা অবশ্য এমনিতেই সরকারি ঋণের তুলনায় মহাজন দের ঋণের ওপরেই বেশী নির্ভরশীল। সরকারি ঋণের ওপর নির্ভর করতে পারেন মূলতঃ ধনী চাষীরা। ন্যাশনাল স্যাম্পল সার্ভে অর্গানাইজেশনের সমীক্ষা থেকে দেখা গেছে গ্রামীণ ঋণের ৪৪ শতাংশই অপ্রাতিষ্ঠানিক। আর এই অপ্রাতিষ্ঠানিক ঋণের সুদের হার ৩৬% থেকে শুরু করে ১০০% ও হয়ে যায়। পাঞ্জাব ও বিদর্ভের দুটি গ্রামে অজয় দাণ্ডেকর ও শ্রীদীপ ভট্টাচার্যের একটি ফিল্ড ওয়ার্কে দেখা গেছে এমনিতেই ব্যাঙ্ক যা ঋণ দেয় তা ক্রমবর্ধমান চাষের খরচের তুলনায় অপ্রতুল, তার ওপর কৃষকরা ব্যাঙ্কের ঋণ শোধ করার জন্য মহাজনের থেকে বা পরিবারের সদস্যদের থেকে ধার করেন। তাঁদের ধার আবার শোধ করেন ব্যাঙ্ক থেকে প্রাপ্ত পরের কিস্তির ঋণ থেকে। ফলতঃ চাষের খরচ চালানোর জন্য আবার ধার! ফলে শেষপর্যন্ত যা বিকল্প থাকে তা হল চাষের জন্য কিনে রাখা কীটনাশক গলায় ঢেলে দেওয়া। আত্মহননে অবশ্য ঋণের চক্র থেকে বেরিয়ে আসা যায় না। ঋণশোধের দায় এবার এসে পড়ে বাড়ির সদস্যদের ওপর।

সরকারের তথ্য অনুযায়ীই প্রতি বছর গড়ে ১২ হাজার কৃষক আত্মহননের পথ বেছে নেন। অর্থাৎ প্রতি ৩০ মিনিটে একজন করে কৃষক আত্মহত্যা করেন। এই কৃষক আত্মহত্যার ৮৭.৫% ঘটেছে সাতটি রাজ্যেঃ মহারাষ্ট্র, কর্নাটক, তেলেঙ্গানা, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড়, অন্ধ্রপ্রদেশ ও তামিলনাড়ু। পিছিয়ে নেই সবুজ বিপ্লবের রাজ্য পাঞ্জাবও। ১৯৯৫ থেকে ২০১৫ - দশ বছরে ৪৬৮৭ জন কৃষকের আত্মহত্যা নথিভুক্ত হয়েছে এই রাজ্যে। মোদির মডেল রাজ্য গুজরাতে ২০১৩ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে ১৪৮৩ জন কৃষক আত্মহত্যা করেছেন। পশ্চিমবঙ্গের শস্যভাণ্ডার বলে খ্যাত বর্ধমান জেলাতেও এখন কৃষক আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। শুধু ভাতার থানা এলাকায় ৬ মাসে ১০ জন কৃষক আত্মহত্যা করেছেন ঋণের জ্বালায় বা জলের অভাবে ফসল নষ্ট হতে দেখে। এই ঘটনা গুলো এখন এতই "স্বাভাবিক" হয়ে গেছে আমাদের কাছে যে খবরের কাগজের ভেতর দিকের পাতার দু-চার লাইনের বেশী বরাদ্দ হয় না। প্রশাসনিক তরফেও চেষ্টা থাকে ঘটনা অস্বীকারের। ২০১৫ সালের একটি লেখায় পি সাইনাথ দেখিয়েছিলেন ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর তথ্য জোগাড় ও বিশ্লেষণের পদ্ধতির পরিবর্তনের ফলে ২০১৪ সালে কৃষক আত্মহত্যার সংখ্যা দাঁড়ায় ২০১৩ সালের অর্ধেকেরও কম। কিন্তু ঐ বছরেই ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায় "অন্যান্য" কারণে আত্মহত্যার সংখ্যা। ২০০১ সালের অন্ধ্রপ্রদেশ জেলার ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর তথ্য থেকে দেখা গেছিল আগের তিন বছরে ঐ জেলায় কয়েকশ মানুষ পেটে প্রচণ্ড যন্ত্রণার কারণে অসুস্থ হয়ে মারা যান। পরে জানা যায় ওনাদের পেটের যন্ত্রণার কারণ হল আত্মহত্যার জন্য কীটনাশক খাওয়া!

লড়াইয়ের সংক্ষিপ্ত বৃত্তান্ত

কিন্তু ভারতীয় কৃষকদের রক্তে নীল বিদ্রোহ, সন্ন্যাসী বিদ্রোহ, ওয়াহাবি বিদ্রোহের রক্ত বইছে। তেভাগা, তেলেঙ্গানা, নকশালবাড়ির ইতিহাস যাঁরা রচনা করেছেন, তাঁদের উত্তরপুরুষরা নিজেদের জীবন শেষ করে দিয়ে অদৃষ্টের কাছে আত্মসমর্পণ করবেন এ হতেই পারে না। লড়াইয়ের জেদ সলতে পাকাচ্ছিল তাঁদের মধ্যে। ২০১৬ সালে বৃষ্টিপাত গত দুবছরের তুলনায় বেড়েছে এবং ২০১৬-১৭র কেন্দ্রীয় বাজেটে আগের তুলনায় কৃষিক্ষেত্রে বরাদ্দও কিছু বেড়েছে। কিন্তু কৃষকদের দুর্দশা লাঘবের জন্য এগুলো নগণ্য। তার ওপর খাঁড়ার ঘায়ের মত নেমে এসেছে গত বছরের নোট বাতিল। বেশীরভাগ লেনদেন নগদ টাকায় হওয়ার কারণে নোটবাতিলের কারণে বড়সড় ক্ষতির মুখে পড়েন কৃষক রা। এই বছরের মে-জুন মাস থেকেই মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, রাজস্থান প্রভৃতি রাজ্যে কৃষক বিক্ষোভ জ্বলে উঠতে থাকে। মহারাষ্ট্রে কিষাণসভার নেতৃত্বে একটা কিছু অঞ্চলে আন্দোলন শুরু হওয়ার পর সরকারি তরফে কিছু সংগঠনকে ডেকে আলোচনার নামে আন্দোলন ভাঙ্গার চেষ্টা হয়। মধ্যরাতে আলোচনা থেকে বেরিয়ে এসে কিষাণ সভার নেতৃত্ব জানিয়ে দেন ঋণ মকুব ও ন্যায্য দামের দাবীতে আন্দোলন চলবে। আরো ৩২টি সংগঠন সাড়া দেয় তাদের ডাকে। স্বাভিমানী শ্বেতকারি সংগঠনের নেতা রাজু শেট্টি এনডিএ সরকারের ওপর থেকে সমর্থন তুলে নেন। ১লা জুন থেকে সবকটি সংগঠনের যৌথ কমিটির ডাকে কৃষকরা শহরে দুধ সহ কৃষিজাত পণ্য পাঠানো বন্ধ করে "ধর্মঘট" শুরু করেন। দুধ, সবজির দাম হু হু করে বাড়তে থাকে। জেড ক্যাটাগরির নিরাপত্তা দিয়ে মুম্বাইয়ে দুধ পাঠানো হয়। ষাট হাজার কৃষক মহারাষ্ট্রের কৃষিমন্ত্রীকে ঘেরাও করেন। টানা ১০ দিন ধর্মঘট চলার পর মুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র ফড়নবিশ কৃষক সংগঠনগুলোর সঙ্গে আলোচনায় বসে ৩৪ হাজার কোটি টাকা ঋণ মকুবের ঘোষণা করেন। এর মধ্যেই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে মধ্যপ্রদেশে। সেরাজ্যের শিবরাজ সিং সরকার মন্দাসৌর জেলায় গুলি চালিয়ে আট কৃষককে হত্যা করলে আন্দোলন হিংসাত্মক চেহারা নেয়। রাজস্থানে অন্যান্য অংশের মানুষ যোগ দেওয়ায় কিষাণ সভার নেতৃত্বে কৃষক আন্দোলন গণ আন্দোলনের রূপ পরিগ্রহ করে। সেপ্টেম্বর মাসে রাজ্যের প্রত্যেক জেলার প্রশাসনিক অফিসের সামনে মহাপড়াও শুরু হয়। সেপ্টেম্বরের ৭ তারিখে সর্বাত্মক সাধারণ ধর্মঘট পালিত হয়। অবশেষে বসুন্ধরা রাজের সরকার আন্দোলনকারীদের বেশীরভাগ দাবী মানতে বাধ্য হয়। 

দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ঘটে চলা কৃষক আন্দোলনগুলোকে একসুতোয় বাঁধতে জুন মাসের শেষদিকে গঠিত হয় অল ইন্ডিয়া কিষাণ সংঘর্ষ কোঅর্ডিনেশন কমিটি। বামপন্থীদের পাশাপাশি এই কমিটিতে সামিল হয় রাজু শেট্টির স্বাভিমানি শ্বেতকারি সংগঠন, মেধা পাটকরের এন এ পি এম, যোগেন্দ্র যাদবের স্বরাজ্য অভিযান, দক্ষিণ ভারতের ন্যাশনাল সাউথ ইন্ডিয়ান রিভার লিঙ্কিং ফার্মারস অ্যাসোসিয়েশান সহ ১৮৪ টি সংগঠন। কমিটির উদ্যোগে ১০ হাজার কিলোমিটার পথ হাঁটে কিষাণ মুক্তি যাত্রা। তারপর রাজধানীতে এই সমাবেশ। সমাবেশে বিদর্ভের আত্মঘাতী কৃষকদের সন্তানদের সঙ্গেই ছিলেন পুলিসের হাতে খুন হওয়া মন্দাসৌরের কৃষকদের স্ত্রী রা। যন্তর মন্তরে নগ্নগাত্রে ধর্ণা চালানো তামিলনাড়ুর কৃষকদের সাথে মিলিত হলেন ভাঙড়ের জমি হাঙরদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধী কৃষকরা। অবস্থান মঞ্চে সম্বর্ধনা দেওয়া হয় মহারাষ্ট্র ও রাজস্থানের কৃষক আন্দোলনের দুই নেতা রাজু শেট্টি ও অমরা রাম কে। নিজেদের মধ্যে আদর্শগত, শ্রেণীগত ও অঞ্চলগত নানা পার্থক্যকে দূরে সরিয়ে রেখে এভাবে এতগুলো কৃষক ও ক্ষেতমজুর সংগঠনের এক মঞ্চে আসা যেমন নজিরবিহীন, তেমনি অভিনব নিজেরাই প্রতীকি সংসদ বসিয়ে বিল পাস করানো। এই দুটি বিলের কপি পার্লামেন্টের সমস্ত সাংসদের কাছে পাঠানো হবে, পাঠানো হবে কেন্দ্রীয় কৃষিমন্ত্রকেও। ২৬শে নভেম্বর থেকে ২৬শে জানুয়ারি, ভারতীয় সাধারণতন্ত্রের সংবিধান পাস হওয়া ও লাগু হওয়া কে মনে রেখে, এই দুটি বিল নিয়ে প্রচার চালাবে সংঘর্ষ কমিটি।

সরকার ও কর্পোরেট মেসিহা

আমরা স্কুলে পড়তাম, ভারতবর্ষ একটি কৃষিপ্রধান দেশ। এখানকার ৭০% মানুষ কৃষির ওপর নির্ভরশীল। অবস্থাটা খুব একটা বদলায় নি। অথচ কৃষির সংকট নিয়ে আমাদের, শহরের মানুষদের মধ্যে একটা অদ্ভুত ঔদাসীন্য কাজ করে। গুলিচালনা বা হিংসাত্মক ঘটনা না ঘটলে সংবাদমাধ্যমেও জায়গা পান না কৃষক রা। সরকারি প্রতিক্রিয়াও তথৈবচ। খরায় বিপর্যস্ত তামিলনাড়ুর কৃষকরা সরকারি ক্ষতিপূরণের দাবী নিয়ে কয়েকমাস ধরে পড়ে রইলেন দিল্লীর রাস্তায়, আত্মঘাতি হওয়া পরিজনদের মাথার খুলি নিয়ে। স্যোসাল মিডিয়ার কিছু ছবি ছাড়া না তাঁরা পেলেন জাতীয় মিডিয়ার অ্যাটেনশান, না পেলেন কোন সরকারের কোন মন্ত্রীর দেখা। উল্টে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের কাছে বিক্ষোভ দেখানোর জন্য পুলিস তাঁদের কয়েকজনকে গ্রেফতার করে নিয়ে গেল। মধ্যপ্রদেশের হত্যাকাণ্ডের পর অনশনে বসলেন মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ সিং চৌহান, আর কেন্দ্রীয় কৃষিমন্ত্রী রাধারমণ সিং কৃষকদের পরামর্শ দিলেন যোগাসন করতে। শাসকদলের ঘনিষ্ঠ এক হিন্দু ধর্মগুরু ঘোষণা করলেন কৃষকরা আত্মহত্যা করছে আধ্যাত্ম্যিকতার অভাবে। ভারতবর্ষের কৃষকরা শেষ হয়ে গেলেও বোধহয় শাসকগোষ্ঠীর কিছু এসে যায় না। কিংবা ভুল বললাম, বর্তমান শাসকগোষ্ঠী হয়ত চায় কৃষি অর্থনীতি ধ্বংস হয়ে যাক। তাহলেই বহুজাতিক কর্পোরেট সংস্থাগুলোর হাতের মুঠোয় বন্দী হবেন কৃষকরা। এই নভেম্বর মাসের গোড়াতেই "ওয়ার্ল্ড ফুড ইন্ডিয়া" নামক মেগা ইভেন্টের উদ্বোধন করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ভারতবর্ষে চুক্তি চাষের বিরাট সম্ভাবনা আছে। কর্পোরেটদের এই সুযোগ নষ্ট না করতে আহবান জানান তিনি। 

বহুজাতিক কর্পোরেটদের হাত পড়লে কৃষির কি সর্বনাশ হতে পারে তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে মনসান্টোর উপাখ্যান। স্থানীয় বীজ বৈচিত্র্য কে তছনছ করে জেনেটিকালি মডিফায়েড বিটি তুলো চালু করে কৃষকদের গলা কেটে "রয়ালটি"র টাকা আদায় করছে তারা। বিটি তুলো চালু করা হয়েছিল পোকামাকড়ের উতপাৎ কমানোর কথা বলে। বাস্তবে বিটি তুলোর প্রযুক্তি এমনই যে কিছু নির্দিষ্ট পোকামাকড়ের জন্য তা বানানো যায় এবং এর ফলে অন্য পোকামাকড়ের আক্রমণ বেড়ে যায়। শুধু তাই নয় ঐ নির্দিষ্ট পোকাগুলোও খুব তাড়াতাড়ি নিজেদের জিনে প্রয়োজনীয় মিউটেশন ঘটিয়ে ফের আক্রমণ শুরু করে। তখন আবার আমদানি হয় পরের প্রজন্মের বিটি তুলোর। বিটি তুলো ১ ও ২ এর ব্যর্থতার পর এখন বিটি তুলো ৩ বাজারে আনতে চলেছে মনসান্টো। আর এর মধ্যে কি হয়েছে? ৯৮ এ মনসান্টো এদেশে ব্যবসা শুরু করার পর তুলোর দাম বেড়েছে ৮০ শতাংশ আর লোকসানের বোঝা সামলাতে না পেরে দলে দলে আত্মহত্যা করেছেন কৃষকরা। শুধু তাই নয় দেশীয় বীজ প্রস্তুতকারী সংস্থাগুলোর অভিযোগ মনসান্টো যে রয়ালটি ও প্রযুক্তি ফি-র টাকা নেয় সেটাই বেআইনী। ভারতীয় পেটেন্ট আইন অনুযায়ী প্রাণী উদ্ভিদ বা তাদের কোন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নিয়ে জিনগত গবেষণা পেটেন্টের আওতায় পড়ে না। বিষয়টা এখন জাতীয় প্রতিযোগিতা কমিশনের বিচারাধীন।

এই লেখার কোন উপসংহার টানার মানে হয় না। কৃষকরা কোন পথে তাঁদের আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন, তাঁদের মধ্যে ঐক্য অটুট থাকবে কি না, সরকার এর মোকাবিলায় কি পদক্ষেপ নেবে, ধর্মীয় মেরুকরণ বা যুদ্ধোন্মাদনা তৈরী করে আন্দোলনকে ভাঙতে পারবে কি না, বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর কি ভূমিকা হবে, স্বামীনাথন কমিশনের সুপারিশ মানতে সংসদকে বাধ্য করা যায় কি না, সংবাদমাধ্যম ও নাগরিক সমাজ তাদের ঔদাসীন্য ঝেড়ে ফেলতে পারে কি না এ সব প্রশ্নের উত্তরই এখনো ভবিষ্যতের গর্ভে।

  

তথ্যসূত্রঃ

১। কৃষক আত্মহত্যা, চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম (১লা জুলাই ২০১৭)
২। Interview with Yogendra Yadav, Indian express, 23rd November, 2017
৩। "Sikar: No Longer Just a Farmers’ Movement, But a People’s Movement for Farmers", News Click, 12th September, 2017
৪। "How Long Can India’s Farmers Subsidise the Nation?", The Wire, 2oth November, 2017
৫। স্বামীনাথন কমিশনের রিপোর্ট, PRSLegislative Researchএর ওয়েবসাইট
৬। Interview with Ajit Nawale on farmers movement in Maharashtra, News Click, 6th October, 2017
৭। গণশক্তির রিপোর্ট, ২১/১১/১৭ ও ২২/১১/১৭
৮। ইন্টারনেট ও বিভিন্ন পত্রপত্রিকা থেকে প্রাপ্ত তথ্য।


Monday 16 October 2017

ঈশ্বরের লুডো আর ব্ল্যাকহোলের চুল

"ঝাউবাংলোর রহস্য"র সাতকড়ি সাঁতরা কে মনে আছে? প্যালারাম সেই সবুজ দাড়িওয়ালা বিজ্ঞানীকে তাঁর গবেষণার বিষয়বস্তু জানতে চাইলে তিনি বলেছিলেন "থিয়োরি অফ রিলেটিভিটির সঙ্গে অ্যাকোয়া টাইকোটিস যোগ করলে কি হয় বলতে পারো?" অ্যাকোয়া টাইকোটিস অর্থাৎ জোয়ানের আরকের সঙ্গে থিয়োরি অফ রিলেটিভিটির কি সম্পর্ক থাকতে পারে সে প্রশ্ন সঙ্গতভাবেই উদয় হয়েছিল ক্যাবলার মনে। এই প্রবন্ধের শিরোনাম দেখে পাঠকের মনেও একই রকম প্রশ্ন জাগতে পারে। ব্ল্যাকহোল এমনিতেই গোলমেলে জিনিস। তার ওপর সে টাকমাথা না চুল আছে এসব প্রশ্ন করলে তো ব্যাপারটা রীতিমত পুঁদুচেরি মানে ভীষণ গুরুতর হয়ে দাঁড়ায়! আর চুল যদি থেকেই থাকে তার সঙ্গে ঈশ্বর লুডো খেলেন কি না তার কি লেনদেন? গপ্পোটা তাই গোড়া থেকেই ফাঁদি।

বিংশ শতকের গোড়ার দিকেই যে তিনটে আবিষ্কার পদার্থবিজ্ঞানের সাবেকি ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিল সেই বিশেষ ও সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ এবং কোয়ান্টাম বলবিদ্যার মধ্যে কমন নামটা হল অ্যালবার্ট আইনস্টাইন। বিশেষ আপেক্ষিকতাবাদের (Special Theory of Relativity) সূত্রায়ণে প্রধাণ ভূমিকা ছিল আইনস্টাইনের। সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ (General Relativity) তো তাঁরই হাতে গড়া বলা যেতে পারে। তবে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের (Quantum Mechanics) সঙ্গে আইনস্টাইনের সম্পর্কটা ছিল অম্লমধুর। কোয়ান্টাম তত্ত্বের চারাগাছ যাঁরা রোপণ করেছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম আইনস্টাইন। তাঁর নোবেল প্রাপ্তিও কোয়ান্টাম তত্ত্বের জন্য। অথচ সে চারাগাছ যখন মহীরূহ হয়ে দাঁড়ালো তখন আইনস্টাইনই হয়ে উঠলেন তার সবচেয়ে বড় সমালোচক। ঈশ্বরের লুডো খেলার ব্যাপারটা জানতে হলে আইনস্টাইনের সঙ্গে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের এই দ্বন্দ্বটা বুঝতে হবে। 

"কোয়ান্টা" শব্দের অর্থ হল গুচ্ছ। কোয়ান্টাম মেকানিক্সের এহেন নামকরণের কারণ হল পদার্থবিজ্ঞানের এই বিপ্লবটি সাধিত হয়েছিল আলোর আঁটি পাকানোর দ্বারা। ধরা যাক আপনি জল দিয়ে ওষুধের ট্যাবলেট খাচ্ছেন। আপনি একটা, দুটো বা তিনটে ট্যাবলেট খেতে পারেন, কিন্তু দেড়খানা বা পৌনে তিনখানা খেতে পারবেন না যদি না ট্যাবলেটটা ভাঙা না হয়। কিন্তু জলের ক্ষেত্রে তেমন বাধ্যবাধকতা নেই। আপনি স্বচ্ছন্দে আড়াই গ্লাস বা পৌনে তিন গ্লাস জল খেতে পারেন। আলোকে মনে করা হত জলের মত। অর্থাৎ একটা পদার্থ যেকোন পরিমাণ আলো শোষণ বা বিকিরণ করতে পারেন। এই ধারণায় ঘা দিলেন ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক, অষ্টাদশ ও উনবিংশ শতকের সন্ধিক্ষণে।
ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক
তিনি দেখালেন কোন পদার্থ কে উত্তপ্ত করলে সে যে আলো বিকিরণ করে সেই বিকিরণ যেকোন পরিমাণে হয় না, হয় গুচ্ছ বা কোয়ান্টার আকারে। এই কোয়ান্টাগুলোর পরে নাম দেওয়া হবে ফোটন (photon)। এক একটা ফোটনের শক্তি সেই আলোর কম্পাঙ্কের সমানুপাতিক। এই সমানুপাতিক ধ্রুবককে "প্ল্যাঙ্ক ধ্রুবক" বলা হয়ে থাকে। অর্থাৎ একটা ফোটনকণার শক্তির মান প্ল্যাঙ্ক ধ্রুবক ও সংশ্লিষ্ট আলোর কম্পাঙ্কের গুণফলের সমান। দ্বিতীয় ঘা টা মেরেছিলেন আইনস্টাইন। কোন ধাতব পদার্থের ওপর আলো পড়লে সেই আলো থেকে শক্তি পেয়ে উত্তেজিত হয়ে ধাতবপৃষ্ঠের ওপর বিচরণশীল মুক্ত ইলেকট্রনগুলো বেরিয়ে আসতে থাকে। এই ঘটনাকে বলে আলোকতড়িৎ ক্রিয়া (photoelecric effect )। আইনস্টাইন দেখালেন আপতিত আলোক ইলেকট্রনগুলোকে শক্তি সরবরাহ করে গুচ্ছ বা কোয়ান্টার আকারে। অর্থাৎ আলোর শোষণ বা বিকিরণ দুইই হয় কোয়ান্টার আকারে। আরো কয়েক বছর পর এই দুই তত্ত্বের সাহায্যে নীলস বোর পরমাণুর কোয়ান্টাম মডেল বাজারে আনবেন। 


কিন্তু এসব করতে গিয়ে আলোর চরিত্র নিয়ে একটা গুরুতর প্রশ্ন উঠে গেল। সেই ষোড়শ শতকে আইজ্যাক নিউটন আলোকে কণিকা হিসেবে কল্পনা করে প্রতিফলন ও প্রতিসরণের সূত্রগুলো ব্যাখ্যা করেছিলেন। কিন্তু পরে দেখা গেল ব্যাতিচার (interference), অপবর্তনের (diffraction) মত বেশ কিছু ধর্ম কণিকাতত্ত্বের সাহায্যে ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে না। উনবিংশ শতকের মাঝামাঝি স্কটিশ গণিতজ্ঞ ও পদার্থবিদ জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল দেখালেন তড়িৎ ক্ষেত্র ও চৌম্বক ক্ষেত্রের পরস্পরের লম্বদিকে কম্পনের ফলে একধরণের তরঙ্গ সৃষ্টি হয় যাকে বলে তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ (electromagnetic wave)। আলোও একধরণের তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ। শুধু আলো নয়, এক্স রশ্মি, অতিবেগুনী রশ্মি, রেডিও তরঙ্গ সবই আসলে তড়ীৎচুম্বকীয় তরঙ্গ, পার্থক্য শুধু তরঙ্গদৈর্ঘ্যে। 

তো আলোর কোয়ান্টাম উত্থানের ফলে নিউটনের সেই কণিকা তত্ত্বই যেন ফিরে এলো। কিন্তু পরিস্থিতি ইতিমধ্যে অনেক জটিল হয়ে গেছে। আলোকে কণা ভাবলে ব্যাতিচার, অপবর্তনকে ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে না। আবার আলোকে তরঙ্গ ভাবলে কৃষ্ণবস্তু বিকিরণ, আলোকতড়িৎ ক্রিয়া বোঝা যাচ্ছে না। বিজ্ঞানীরা বুঝতে পারছিলেন যতই আজগুবি লাগুক, এই সমস্যার সমাধান একটাই, তা হল আলোর দ্বৈত চরিত্রকে মেনে নেওয়া। অর্থাৎ আলো (এবং অন্যান্য তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ) কোন কোন পরীক্ষায় দেখা দেয় তরঙ্গরূপে আবার কোন কোন পরীক্ষায় আবির্ভূত হয় কণা রূপে। কোন পরীক্ষায় কোন রূপ দেখা যাবে তা নির্ভর করছে পরীক্ষার যন্ত্রপাতির আকারের ওপর। যন্ত্রের আকার যদি পরীক্ষাধীন আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্যের চেয়ে অনেক বড় হয় তবে আলোর কণারূপ দেখা যাবে। আর যন্ত্রপাতির আকার তরঙ্গদৈর্ঘ্যের কাছাকাছি হলে দেখা যাবে তরঙ্গরূপ। 


আলোর দ্বৈতসত্ত্বা (wave particle duality) স্বীকার করে নেওয়ার সঙ্গে বলা যেতে পারে প্যান্ডোরার বাক্স খুলে গেল। প্রশ্ন উঠল আলোর যদি দুই রূপ থাকতে পারে তাহলে তখনো অবধি মৌলিক কণা বলে পরিচিত ইলেকট্রন, প্রোটনরা কি দোষ করল? তাদের কেন দ্বৈত সত্ত্বা থাকবেনা? এই প্রশ্নের উত্তর দিলেন ফ্রান্সের লুই ডি ব্রগলী। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ থেকে ফিরে তিনি ঘোষণা করলেন, হ্যাঁ মৌলিক কণাদেরও তরঙ্গরূপ আছে। এদের তরঙ্গদৈর্ঘ্য ভরবেগের (ভর ও গতিবেগের গুণফল) সঙ্গে ব্যাস্তানুপাতিক। চারবছর বাদে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বেল ল্যাবোরেটরিতে ইলেকট্রন তরঙ্গের অস্তিত্ব প্রমাণ করলেন জোসেফ ডেভিসন ও লেস্টর জার্মার। শুধু ইলেকট্রন নয়, সমস্ত কণা এবং দৃঢ় বস্তুরই (এমনকি আমাদেরও) দ্বৈত সত্ত্বা আছে। কিন্তু ইলেকট্রনের মত হালকা কণাগুলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য অনেক বেশী বলে ওদের তরঙ্গরূপকে পর্যবেক্ষণ করা তুলনায় সহজ।  

ইতিমধ্যে ময়দানে নেমে পড়েছেন আরউইন স্রোডিংগার, উলফগ্যাং পাউলি, ম্যাক্স বর্ন, ওয়ার্নার হাইজেনবার্গ এবং আরো অনেকে। কোয়ান্টাম তত্ত্ব যত গাণিতিক সূত্রায়ণের মাধ্যমে দৃঢ় অবয়ব ধারণ করতে লাগল ততই এটা স্পষ্ট হয়ে উঠল এই বিশ্ব সম্পর্কে আমাদের সাবেকি চিন্তাভাবনায় বড় রকমের পরিবর্তন প্রয়োজন। জানা গেল যে ইলেকট্রন তরঙ্গের কথা বলা হচ্ছিল তা আসলে সম্ভাবনা তরঙ্গ। বোঝা গেল পরমাণুর ভিতরে রাদারফোর্ড বা বোর যেমন বলেছিলেন, ইলেক্ট্রনগুলো মোটেই সেরকম কোন কক্ষপথে নিউক্লিয়াসকে প্রদক্ষিণ করেনা। ইলেকট্রনের তরঙ্গ পরমাণুর মধ্যে একধরণের মেঘের মত ছেয়ে থাকে। কোন স্থানে ইলেকট্রনের তরঙ্গরাশির বর্গ করলে সেই স্থানে ইলেকট্রনের থাকার সম্ভাবনা পাওয়া যায়। আরো জানা গেল কোন কণার অবস্থান এবং ভরবেগ একইসঙ্গে নিখুঁতভাবে মাপা যায়না। যদি অবস্থানকে নিখুঁতভাবে মাপার চেষ্টা করা হয় তাহলে ভরবেগ পুরোপুরি অনির্ণেয় হয়ে যাবে।  আবার ভরবেগ নিখুঁতভাবে মাপলে অবস্থান পুরোপুরি অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। আরেকটা মাঝামাঝি উপায় হল অবস্থান আর ভরবেগ কোনটাই নিখুঁত ভাবে মাপা হলনা, কিন্তু কোনটাই আবার পুরোপুরি অনিশ্চিত হয়ে পড়ল না। দুটো রাশিতেই কিছু কিছু অনিশ্চয়তা থাকল। ব্যাপারটা বোঝার জন্য ধরা যাক একটা পদার্থের পরমাণুর মধ্যে একটা ইলেকট্রনের অবস্থান নির্ণয় করার চেষ্টা করা হচ্ছে। তাহলে একটা আলোকরশ্মিকে ঐ ইলেকট্রনের ওপর ফেলতে হবে। কিন্তু আলোকরশ্মি অর্থাৎ ফোটন কণার স্রোতের সঙ্গে যেই ইলেকট্রনের সংঘর্ষ হবে অমনি ইলেকট্রনের ভরবেগ বদলে যাবে। অর্থাৎ অবস্থান মাপতে গিয়ে অনিশ্চিত হয়ে পড়ল ইলেকট্রনের ভরবেগ। গাণিতিক ভাষায় হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তা নীতি (Uncertainty principle) বলছে অবস্থান ও ভরবেগের অনিশ্চয়তার গুণফল কোনভাবেই প্ল্যাঙ্কের ধ্রুবকের চেয়ে কম হবেনা। 




এককথায় বলা যায় কোয়ান্টাম মেকানিক্স নিউটনের সময় থেকে চলে আসা "নির্দেশ্যবাদে"র (Determinism) গোড়ায় জোরালো আঘাত করল। "নির্দেশ্যবাদ" অনুযায়ী কোন একটা নির্দিষ্ট মূহুর্তে আমরা যদি কোন বস্তু বা বস্তুসমষ্টির অবস্থান ও ভরবেগ সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য জেনে থাকি এবং ঐ বস্তু বা বস্তসমষ্টির ওপর ক্রিয়াশীল সবরকম বাহ্যিক বল সম্পর্কিত ডিটেলস জানতে পারি তাহলে ভবিষ্যতের যেকোন মূহুর্তে ঐ বস্তু বা বস্তুসমষ্টির অবস্থান ও ভরবেগ নির্ণ্য করতে পারব। আরেকটু এগিয়ে বলতে পারি - আজ, এই মুহূর্তে মহাবিশ্ব সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য যদি আমাদের নাগালে থাকে, তবে আমরা যেকোন সময়ে মহাবিশ্ব সম্পর্কে নিখুঁত ভবিষ্যৎবাণী করতে পারব। আমরা ভবিষ্যৎবাণী করতে পারছিনা তথ্যসংগ্রহে অপারগতার জন্য, কিন্তু সবকিছুই আসলে পূর্বনির্ধারিত। এই দর্শনের সঙ্গে ঈশ্বরবিশ্বাসী বা ভাগ্যবিশ্বাসীদের "সবই ঈশ্বরের ইচ্ছা" বা "ভাগ্যে যা আছে তাই হবে" টাইপের ধারণার তুলনা করতে পারি। কোয়ান্টাম মেকানিক্সের এই অনিশ্চয়তার যদি ঠিক হয় তবে তার মানে দাঁড়ায় ঈশ্বর তাঁর জাবদা খাতায় সব ঘটনা লিখে রাখেননি। বরং তিনি লুডো খেলেন এবং লুডোর দান অনুযায়ী দুনিয়া চালান। এই ব্যাপারটাই আইনস্টাইনের পছন্দ হয়নি। প্রথাগত অর্থে ঈশ্বরে বিশ্বাসী না হলেও তিনি নির্দেশ্যবাদে আস্থাশীল ছিলেন। কোয়ান্টাম মেকানিক্সের জন্মের পিছনে তাঁর হাত ছিল, কিন্তু সন্তানের বিপথে যাওয়া তিনি মেনে নিতে পারেননি! তিরিশের দশকের শেষভাগে এনিয়ে নীলস বোরের সঙ্গে আইনস্টাইনের এক মহাবিতর্ক হয়। আইনস্টাইন নানারকম যুক্তি ও কাল্পনিক পরীক্ষার অবতারণা করে অনিশ্চয়তা নীতির অসারতা প্রমাণ করতে চেয়ে ব্যর্থ হন। বিজ্ঞানীমহল বোর, হাইজেনবার্গের মতই মেনে নেন। আইনস্টাইন এব্যাপারে উচ্চবাচ্য না করলেও জীবনের শেষদিন পর্যন্ত এই বিশ্বাসে অটল ছিলেন যে "ঈশ্বর লুডো খেলেন না"। এই বিখ্যাত উক্তির জের টেনে আইনস্টাইনের মৃত্যুর ১৫ বছর পর স্টিফেন হকিং বলবেন, "ঈশ্বর যে শুধু লুডো খেলেন তাই নয়, তিনি কখনো কখনো লুডোর ছক্কাটাকে এমন জায়গায় ছুঁড়ে ফেলেন যে সেটাকে আর খুঁজে পাওয়া যায় না।" এই "এমন জায়গা"টা হল একটা কৃষ্ণগহ্বর বা ব্ল্যাকহোল (black hole)। তাই হকিং কেন এই মন্তব্য করেছিলেন তা জানতে হলে ব্ল্যাকহোল কি সেটা বুঝতে হবে।

আমরা জানি হিমালয় পর্বত থেকে বাতাসের একটা নাইট্রোজেন অণু সবাই পৃথিবীর আশেপাশে আটকে রয়েছে পৃথিবীর মধ্যাকর্ষণ বলের জন্য। কিন্তু কোন বস্তু যদি সেকেন্ডে ১১.২ কিলোমিটারের চেয়ে বেশী বেগে ওপরের দিকে গতিশীল হয় তবে সে পৃথিবীর মধ্যাকর্ষণের প্রভাব কাটিয়ে বেরিয়ে যেতে পারবে। এই ১১.২ কিমি/সেকেন্ড হল পৃথিবী পৃষ্ঠের ওপর মুক্তিবেগ। চন্দ্রপৃষ্ঠের ওপর মুক্তিবেগ অনেক কম ৪.২ কিলোমিটার/সেকেন্ড। এই কারণে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে নাইট্রোজেন, অক্সিজেনের মত গ্যাস পাওয়া যায়, কিন্তু চাঁদের অত্যন্ত পাতলা বায়ুমণ্ডলে এদের পাওয়া যায় না। সূর্যের ওপর সূর্যের মধ্যাকর্ষণজনিত মুক্তিবেগ আরো বেশী, সেকেন্ডে ৬১৭.৫ কিমি। তা এমন কোন নক্ষত্র বা মহাজাগতিক বস্তু কি থাকতে পারে যার আকর্ষণ কাটিয়ে কোন বস্তুই বেরোতে পারবে না? পারে, যদি সেই নক্ষত্রটির ওপর মুক্তিবেগ সেকেন্ডে ৩ লক্ষ কিলোমিটারের বেশী হয়। কারণ এটাই শূণ্য মাধ্যমে আলোর গতিবেগ এবং বিশেষ আপেক্ষিকতাবাদ অনুযায়ী আলোর চেয়ে বেশী বেগে কোন বস্তু গতিশীল হতে পারে না। কিন্তু এত বিশাল মুক্তিবেগ থাকতে গেলে নক্ষটির ভর খুব বেশী আর আয়তন খুব কম হতে হবে অর্থাৎ নক্ষত্রের উপাদান আসীম ঘনত্বের হতে হবে। এইরকম আলোকেও বেরোতে দেয়না এমন তারকার অস্তিত্ত্ব উনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকেই কল্পনা করেছিলেন ব্রিটিশ বিজ্ঞানী জন মিচেল বা ফরাসী বিজ্ঞানী ল্যাপ্লাস। কিন্তু তাঁদের কল্পনা দৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে পারেননি, কারণ আলোর চরিত্র নিয়ে ধোঁয়াশা। আলো যদি তরঙ্গ হয় তার ওপর মহাকর্ষের প্রভাব কি হবে তা নিউটনের তত্ত্ব থেকে জানা ছিল না। আবার আলোকে বস্তুকণার মত ধরলেও মুশকিল। একটা ঢিলকে ওপরের দিকে ছুঁড়লে তার দ্রুতি মন্থরতর হবে। কিন্তু আলোর দ্রুতি ধ্রুবক, কোনরকম বলের প্রভাবেই আলোর দ্রুতি বদলায় না। কাজেই মহাকর্ষ কিভাবে আলোর ওপর কাজ করবে তা স্পষ্ট ছিল না।

পরিস্থিতির আমূল পরিবর্তন ঘটল যখন ১৯১৬ সালে মহাকর্ষণের এক নতুন ব্যাখ্যা আমদানি করলেন আইনস্টাইন। তাঁর সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদের তত্ত্ব অনুযায়ী মধ্যাকর্ষণ দুটো বস্তুর মধ্যে আকর্ষণ বল নায়, জ্যামিতির খেলা। জ্যামিতি মানে স্পেসটাইমের জ্যামিতি। এক দশক আগেই বিশেষ আপেক্ষিকতার তত্ত্বে তিনি দেখিয়েছেন যে দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, উচ্চতা নিয়ে আমাদের তিনমাত্রার স্পেস আর একমাত্রার সময় বা টাইমকে আলাদা করে না দেখে চারমাত্রার স্পেসটাইম (spacetime continuum) হিসেবে দেখাই ভালো। তো আশেপাশে যখন কোন ভারী বস্তু নেই তখন স্পেসটাইম সমতল থাকে। কিন্তু কোন ভারী বস্তু রাখলেই স্পেসটাইম আর সমতল থাকেনা, বক্রতল হয়ে যায়। যত ভারী বস্তু রাখা হবে, এই বক্রতলের বক্রতা তত বেশী হবে। এবার দ্বিতীয় আরেকটি বস্তুর কথা ভাবা যাক। দ্বিতীয় বস্তুটি সমতল স্পেসটাইমে থাকলে অর্থাৎ নিউটনের ভাষায় তার ওপর কোন বল প্রযুক্ত না হলে সে সমবেগে সরলরেখায় ছুটবে। যখনই ভারী বস্তুটাকে রাখা হবে সে দ্বিতীয় বস্তুর ওপর মধ্যাকর্ষণ বল প্রয়োগ করে তাকে একটা নির্দিষ্ট পথে চালাবে, যেমন সূর্য পৃথিবীকে উপবৃত্তাকার পথে চালাচ্ছে। আইনস্টাইনের মতে অবশ্য দ্বিতীয় বস্তুটা সেই পথেই চলবে যাতে তাকে সবচেয়ে কম দুরত্ব পেরোতে হয়। যেটা আমরাও করি, কোন জায়গায় যাওয়ার আগে জেনে নিই শর্টেস্ট রুটটা কি (যদি না হাঁটা বা বেড়ানোটাই উদ্দেশ্য হয়)। সমতল স্পেসটাইমে সরলরেখায় ছোটার কারণ ওভাবে চললেই ন্যূনতম দুরত্ব অতিক্রম করতে হয়। সমতল ব্ল্যাকবোর্ডে দুটো বিন্দু এঁকে তাদের অসংখ্য রেখা দিয়ে যোগ করতে পারি, কিন্তু সবচেয়ে কমদৈর্ঘের রেখাটা হবে সরলরেখা। এবার যদি একটা ফুটবলের ওপর দুটো বিন্দু দিই, তাহলে কিন্তু তাদের মধ্যের ক্ষুদ্রতম দৈর্ঘ্যের পথ সরলরেখা হবেনা। স্পেসটাইমের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। ভারী বস্তুটা স্পেসটাইমটাকে এমনভাবে বেঁকিয়ে চুড়িয়ে রাখবে যাতে দ্বিতীয় বস্তুটা সরলরেখার বদলে ন্যূনতম দুরত্বের পথে ছোটে, আমরা যেমন রাস্তায় খানাখন্দ থাকলে একটু ঘুরপথে যাই।  

মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রের এহেন জ্যামিতিক ব্যাখ্যায় আলোর প্রভাবিত হওয়ার পথে কোন বাধা রইলনা। বক্রতলে আলোর দ্রুতি একই থাকে বটে কিন্তু গতিপথ বেঁকে যায়। এ যে শুধু তত্ত্ব নয়, তিন বছরের মধ্যে তা হাতে নাতে দেখালেন আর্থার এডিংটনের নেতৃত্বে একদল ব্রিটিশ বিজ্ঞানী। বৃষরাশির কিছু নক্ষত্র থেকে পৃথিবীর দিকে ধেয়ে আসা আলোকরশ্মি সূর্যের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় কতটা বেঁকে যায় তা পর্যবেক্ষণ করে তাঁরা জানালেন আইনস্টাইনের গণনা এক্কেবারে সঠিক। 
সিঙ্গুলারিটিকে ঘিরে একটা বৃত্তাকার তল পাওয়া যাবে যে তলের ওপর মুক্তিবেগ আলোর বেগের সমান। ফলে বাইরে থেকে যেকোন বস্তু এই তল দিয়ে ভেতরে ঢুকতে পারে, কিন্তু ভেতর থেকে কোনকিছুই বাইরে বেরোতে পারবেনা। নক্ষত্রের এই অন্তিম অবস্থাই হল ব্ল্যাকহোল বা কৃষ্ণগহ্বর।

১৯২৮ সালে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে এই এডিংটনের কাছে গবেষণা করার উদ্দেশ্যে মাদ্রাজ থেকে জাহাজে চাপেন এক তামিল ব্রাহ্মণসন্তান, সুব্রহ্মনিয়ম চন্দ্রশেখর। জাহাজে দীর্ঘপথ পারি দেওয়ার সময় তিনি তিনি চিন্তা করছিলেন একটা নক্ষত্রের অন্তিম দশা নিয়ে। আমাদের সূর্য সমেত সমস্ত "জীবিত" নক্ষত্রে অবিরাম নিউক্লিয়ার সংযোজন (fusion) চুল্লী চালু থাকে। নক্ষত্রের আলো ও তাপের উৎস এই চুল্লী। আবার এই চুল্লীর তাপে যে বহির্মুখি চাপের সৃষ্টি হয় সেই চাপই নক্ষত্রটিকে ভরের জন্য চুপসে যাওয়া থেকে রক্ষা করে। কিন্তু চুল্লীর জ্বালানী যখন শেষ হয়ে যায় তখন? চন্দ্রশেখর অঙ্ক কষে দেখলেন পাউলির অপবর্জন নীতি (exclusion principle) (দুটি ইলেকট্রন একই অবস্থায় থাকতে পারে না) মহাকর্ষীয় সংকোচনকে ঠেকিয়ে রাখতে পারে, যদি তারাটির কেন্দ্রীয় অঞ্চলের ভর সূর্যের ভরে দেড়গুণের বেশী না হয়। এই ভরকে বলা হয় চন্দ্রশেখর সীমা। এক্ষেত্রে তারাটির অন্তিম দশা হবে শ্বেত বামন (white dwarf)। তারাটির কেন্দ্রীয় অঞ্চলের ভর যদি সূর্যের ভরের ১.৪ গুণ থেকে ৩ গুণের মধ্যে হয় তাহলে আরো সংকুচিত হয়ে নিউট্রন স্টারে (neutron star) পরিণত হবে। এক একটা নিউট্রন স্টারের ঘনত্ব এমন যে কয়েক কিলোমিটার ব্যাসার্ধের গোলকের মধ্যে গোটা কতক সূর্য ঢুকে যাবে।
সুব্রহ্মণিয়ম চন্দ্রশেখর
ভর আরো বেশী হলে নক্ষত্রটি চুপসে যেতে থাকবে এবং তার সমস্ত ভর অবশেষে একটা বিন্দুতে গিয়ে জমা হবে। এই বিন্দু হল একধরণের স্পেসটাইম সিঙ্গুলারিটি (singularity), কারণ এই বিন্দুতে ঘনত্ব এবং স্পেসটাইমের বক্রতা অসীম। সিঙ্গুলারিটিকে ঘিরে একটা বৃত্তাকার তল পাওয়া যাবে যে তলের ওপর মুক্তিবেগ আলোর বেগের সমান। ফলে বাইরে থেকে যেকোন বস্তু এই তল দিয়ে ভেতরে ঢুকতে পারে, কিন্তু ভেতর থেকে কোনকিছুই বাইরে বেরোতে পারবেনা। নক্ষত্রের এই অন্তিম অবস্থাই হল ব্ল্যাকহোল বা কৃষ্ণগহ্বর। "ব্ল্যাক", কারণ কালোরঙের বস্তু যেমন সমস্ত তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলোকে শোষণ করে, ব্ল্যাকহোল তেমনি যাবতীয় বস্তুকে টেনে নেয় নিজের ভেতর। ঐ বৃত্তাকার তলকে বলা হয় ঘটনা দিগন্ত (horizon)।


 "ব্ল্যাকহোল" নামটার উৎপত্তি অবশ্য অনেক পরে। ১৯৬৯ সালে জন হুইলার প্রথম এই শব্দটা ব্যবহার করেন। এর মধ্যেই ব্ল্যাকহোলের চরিত্র বেশ খানিকটা জানা গেছে। যেহেতু ঘটনা দিগন্তের মধ্য থেকে আলো বেরিয়ে আসতে পারে না, তাই ব্ল্যাকহোলের ভেতরে কি আছে না আছে তা জানা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। শুধুমাত্র বাইরের স্পেসটাইমের বক্রতা থেকে আমরা ব্ল্যাকহোলের ভর, আধান ও কৌণিক ভরবেগ নির্ণয় করতে পারি। ব্যাপারটা তাৎপর্য মারাত্মক। যে নক্ষত্রটা চুপসে গিয়ে ব্ল্যাকহোলে পরিণত হল তার উপাদান বা গঠনের কোন ছাপই আর ব্ল্যাকহোলের মধ্যে পাওয়া যাবে না। যে পদার্থগুলো ব্ল্যাকহোলের ভিতর গিয়ে পড়ছে তাদের মধ্যে সঞ্চিত তথ্যও চিরতরে হারিয়ে যাবে ব্ল্যাকহোলের মধ্যে। এই ব্যাপারটাকে হুইলার বলেছিলেন চারটি শব্দেঃ "ব্ল্যাকহোলের কোন চুল নেই" (blackholes have no hair)। চুল এখানে জটিলতার প্রতীক। ধরা যাক তিন যমজ ভাই, হুবহু একরকম দেখতে, শুধুমাত্র তাদের হেয়ার স্টাইল আলাদা। এবার যদি তিনজনকেই ধরে ন্যাড়া করে দেওয়া হয় তাহলে আর তাদের আলাদা করে চেনা যাবে না। সেরকমই একই ভর, আধান ও কৌণিক ভরবেগ বিশিষ্ট একাধিক ব্ল্যাকহোলকে পৃথক করার উপায় নেই। এতেও খুব সমস্যা ছিল তা নয়। গোল বাঁধল যখন স্টিফেন হকিং কোয়ান্টাম তত্ত্বকে বক্র স্পেসটাইমে প্রয়োগ করতে গেলেন। 
স্টিফেন হকিং 

হকিং ততদিনে বিরল মোটর নিউরোন ডিসিজে আক্রান্ত। হাঁটা চলা, কথা বলা কিছুই করতে পারছেন না। তবু শারীরিক প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই করার সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বতত্ত্ব ও সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদে একের পর যুগান্তকারী গবেষণা করে চলেছেন। ব্ল্যাকহোলের তাপগতিবিদ্যার চর্চা করতে গিয়ে তিনি একটা চমকপ্রদ ফল পেলেন। ব্ল্যাকহোল নাকি যতটা কালো ভাবা হচ্ছিল, ততটা কালো নয়! একটা বস্তুকে উত্তপ্ত করলে সে যেমন আলো ও তাপ বিকিরণ করে, ঠিক সেরকমই ব্ল্যাকহোল থেকেও শক্তির বিকিরণ ঘটে। এই ঘটনা কে বলা হয় হকিং বিকিরণ। আগেই বলেছি কোয়ান্টাম তত্ত্ব ধ্রুপদী নির্দেশ্যবাদের গোড়া ধরে টান দিয়েছিল। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এক ধরণের কোয়ান্টাম নির্দেশ্যবাদের জন্ম দিয়েছিল। এই নীতি অনুযায়ী আজকের তথ্য থেকে ভবিষ্যতে কোন কণার অবস্থান বা ভরবেগ নিখুঁত ভাবে বলা যাবেনা ঠিকই, কিন্তু ঐ কণার কোনো অবস্থান বা ভরবেগ থাকার সম্ভাবনা কতটা তা নিখুঁতভাবে বলা যাবে। এই সম্ভাবনা সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য জমা থাকে কণাটির তরঙ্গরাশি বা ওয়েভ ফাংশানে। এখন এই কণাটি যদি কোন ব্ল্যাকহোলে ঢুকে পড়ে তাহলে "নো হেয়ার থিয়োরেম" অনুযায়ী তার ওয়েভ ফাংশানে সঞ্চিত সমস্ত তথ্য মুছে যাবে! তাহলে হকিং বিকিরণের মাধ্যমে সেই কণাটা যদি আবার বাইরে বেরিয়ে আসে তাহলে তার তরঙ্গরাশিতে আর কোন পুরনো "স্মৃতি" থাকবে না। ফলতঃ আগের তথ্যের ভিত্তিতে কোনরকম ভবিষ্যতবাণীও করা যাবে না আর। এভাবেই হকিং বিকিরণ আর নো হেয়ার থিয়োরেম মিলে "কোয়ান্টাম নির্দেশ্যবাদে"র বারোটা বাজিয়ে দিলো। ব্যাপার যেটা দাঁড়ালো, ঈশ্বর শুধু লুডো খেলেন তাই নয়, কাছাকাছি ব্ল্যাকহোল থাকলে তিনি লুডোর ছক্কাটাকে হারিয়ে ফেলতে পারেন!   


তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানে এটা একটা ধাঁধার মত। এই ধাঁধা "ব্ল্যাকহোল ইনফরমেশান প্যারাডক্স" নামে পরিচিত। চারদশক ধরে বিজ্ঞানীরা এই ধাঁধার সমাধান করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। ৯০ এর দশক থেকে তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের নবীন শাখা স্ট্রিং থিয়োরির (string theory) গবেষণা "নো হেয়ার থিয়োরেম"এর ওপর সন্দেহ বাড়িয়ে দিলো। ব্ল্যাকহোল যে তথ্য গিলে ফেলে, বিকিরণের মাধ্যমে সেই তথ্য ফিরিয়ে দেয় এই ধারণা পোক্ত হতে থাকল বিজ্ঞানীমহলে। কিন্তু কিভাবে তা হতে পারে সেটা এখনো স্পষ্ট হয়নি। এই বছরের গোড়ায় একটা সমাধানের ইঙ্গিত দিয়েছেন হকিং স্বয়ং। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর সহকর্মী ম্যালকম পেরি ও হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অ্যান্ড্রু স্ট্রমিংগারের সঙ্গে যৌথভাবে লেখা একটি প্রবন্ধে তিনি জানিয়েছেন- ভর, আধান ও কৌণিক ভরবেগ ছাড়াও ব্ল্যাকহোলের অসংখ্য সংরক্ষিত "সুপার ট্রান্সলেশান চার্জ" থাকতে পারে। চার্জ অর্থে তড়িতাধান নয়, বিভিন্ন ধরণের সংরক্ষিত রাশিকে "চার্জ" বলা হয়। এই চার্জগুলো "নরম চুলে"র মত কাজ করে, অর্থাৎ কোন বস্তু ব্ল্যাকহোলের মধ্যে পড়লে তার তরঙ্গরাশিতে সঞ্চিত তথ্য ধরা থাকতে পারে এই নরম চুলে। ঠিক যেমন গোঁফদাড়িতে লেগে থাকা দুধ বা মাংসর টুকরো থেকে আন্দাজ করা যেতে পারে আমি কি খেয়েছি! 
এই তথ্য ধরে রাখার প্রক্রিয়া যে পুরোপুরি বোঝা গেছে তা নয়। "নরম চুল"কি ব্ল্যাকহোলের মধ্যে পড়া সমস্ত তথ্যই ধরে রাখতে পারে সেটাও স্পষ্ট নয়। এ নিয়ে কাজ এখনো চলছে। ব্ল্যাকহোলের চুল পাওয়া গেলে ঈশ্বরকে লুডো খেলা থেকে নিবৃত্ত করা যাবে না বটে, কিন্তু তাঁর লুডোর ছক্কাটা যাতে হারিয়ে না যায় সেই ব্যবস্থা করা যেতে পারে।

তথ্যসূত্রঃ
১। L Ponomarev, "The Quantum Dice", Mir Publishers Moscow (1988)
২। স্টিফেন ডব্লু  হকিং, "কালের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস", অনুবাদঃ শত্রুজিৎ দাশগুপ্ত, বাউলমন প্রকাশন (১৯৯৩)
৩। Gary T. Horowitz, "Black holes have soft quantum hair", APS Physics 9, 62 (2016)

* "আমি অনন্যা" পত্রিকার অক্টোবর-ডিসেম্বর ২০১৬ সংখ্যায় প্রকাশিত

Thursday 28 September 2017

কাকাবাবু, সাবা কাব্বানি আর সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ

কেমন আছেন কাকাবাবু? সন্তু, জোজো, দেবলীনা, ওরা সবাই ভালো আছে? এবারই প্রথম পুজোয় আপনার সঙ্গে দেখা হচ্ছে না।
নতুন কোন অভিযানে যাচ্ছেন না কি? গেলেও আমরা তো আর জানতে পারব না। তাই পুরনো কথাগুলো ভাবছিলাম।  আচ্ছা আপনার সাবা কাব্বানির কথা মনে আছে? আপনি আর সন্তু যখন ক্রাক দ্য শ্যাটেলিয়র দুর্গে বন্দি ছিলেন, তখন কাব্বানি আপনাদের পাহারা দিত। আপনি বলেছিলেন জেলখানার পাহারাদারের এমন ব্যবহার কোন গল্পের বইয়েও দেখা যায়না। তার ছেলে যখন মারা যায় সে ছিল সন্তুরই বয়সী। প্রচণ্ড শীতে সন্তুকে কাঁপতে দেখে সে ছেলের একটা কোট এনে জোর করে পরিয়ে দিয়েছিল। তার একটা কথা হঠাৎ মনে পড়ে গেল, "সিরিয়া দেশটা বেশ শান্তিপূর্ণ, যুদ্ধটুদ্ধ হয়না। তবে মানুষই তো মানুষের শত্রু।" কিম্বা বাঙালি ব্যবাসায়ী প্রোজ্জ্বল রায়? সেও তো বলেছিল "এ দেশের মানুষগুলো সত্যি ভালো। পাশের দেষগুলোতে কত যুদ্ধবিগ্রহ আর মারামারি চলছে। এ দেশটা কিন্তু শান্তিপুর্ণ। আপনাদের ভালো লাগবে।" বেশিদিন নয়, আমি এই বছর তিনেক আগের কথা বলছি। আপনারা যেবার ধনকুবের আবু-আল-ফিদা সালাদিনের আমন্ত্রণে সিরিয়া তারতুফ শহরে গিয়েছিলেন।[১] এখন নিশ্চয়ই ওই কথাগুলো এক একটা নির্মম রসিকতা বলে মনে হয় আপনার? আপনারা ফিরে আসার এক বছরও কাটেনি, ওই দেশে যে অশান্তি শুরু হল তা এখনো থামার তো কোন লক্ষণই নেই বরং তার ভয়াবহতা রোজই বেড়ে চলেছে। ইতিমধ্যেই লক্ষাধিক মানুষ মারা গেছেন, কুড়ি লাখ মানুষ, সীমানা পেরিয়ে আশেপাশের দেশগুলোর উদ্বাস্তু শিবিরে আশ্রয় নিয়েছেন। সব মিলিয়ে প্রায় ষাট লাখ মানুষ অর্থাৎ সিরিয়ার জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ ঘরছাড়া।[২] 

এগুলো অবশ্য নেহাতই স্ট্যাটিস্টিক্স। একটা লেভেলের পর তো আর সংখ্যার কোন অর্থ হয় না। কাকাবাবু আপনি নিশ্চয়ই গত ২১শে আগষ্ট খবরের কাগজে দেখেছেন, সেই সারি দিয়ে শুয়ে থাকা বাচ্ছাগুলোর ছবি? ঘুমের মধ্যেই তাদের ঘরে হানা দেয় বর্ণহীন, গন্ধহীন সারিন গ্যাস। ছটফট করতে করতে দমবন্ধ হয়ে তারা মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়ে।[৩] ঐ ছবিগুলো দেখতে দেখতে আপনার কি রবের কথা মনে পড়ছিল? সেই ফুটফুটে বাচ্ছাটা, যে আপনাকে আর সন্তুকে কমলালেবু দিয়েছিল? আপনি শিখিয়ে দেওয়ার পর সুন্দর উচ্চারণে ন-ম-স-কা-র বলে হাত নেড়েছিল? তার মায়ের নাম ছিল জেনোবিয়া। আপনি যখন বললেন জেনোবিয়া নামে সিরিয়ার এক রাণী ছিলেন, যিনি রোমান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন, তখন ভদ্রমহিলা বেশ অবাক হয়ে বলেছিলেন, "আপনি আমাদের দেশের ইতিহাস জানেন দেখছি! আপনি কি অধ্যাপক?" আসুন ছোট্ট করে একবার এই দেশটার ইতিহাসে চোখ বুলিয়ে নিই।

পৃথিবীর প্রাচীনতম সভ্যতা যেখানে গড়ে উঠেছিল সেই উর্বর হাঁসুলির (Fertile Crescent) অন্তর্ভূক্ত ছিল আজকের সিরিয়া।
পশ্চিমে মিশর থেকে শুরু করে, ভূমধ্যসাগরকে ঘিরে, সিরিয়া, প্যালেস্তাইন, লেবানন হয়ে ইরান, তুরস্কের খানিকটা অংশ আর পূর্বদিকে ইরাক, ম্যাপের দিকে তাকালে দেখা যাবে এই অঞ্চলটার চেহারা অনেকটা হাঁসুলি বা কাস্তের মত। টাইগ্রিস-ইউফ্রেটিস আর নীলনদের জলে উর্বর মাটি এই হাঁসুলিতে সভ্যতা পত্তনের অনুকূল পরিবেশের সৃষ্টি করেছিল। যিশুখ্রিস্টের জন্মের প্রায় দশহাজার বছর আগের মনুষের বসতির প্রমাণ পাওয়া গেছে এখানে। চাকার ব্যবহার, নব্য প্রস্তরযুগে চাষবাস ও পশুপালন এমনকি বর্ণমালার উদ্ভবও হয়েছিল সিরিয়ায়। নীলনদের দান মিশর আর টাইগ্রিস-ইউফ্রেটিসের মাঝে মেসোপটেমিয়া (ইরাক), দুই বিখ্যাত প্রাচীন সভ্যতার সেতু ছিল সিরিয়া। হাজার হাজার বছর ধরে দুই সভ্যতার ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প সংস্কৃতির আদান প্রদান সমৃদ্ধ করেছে সিরিয়াকে। দলে দলে এসেছে মেসোপটেমিয়া থেকে সুমেরীয়, আসারীয়, আক্কাদরা, মিশর থেকে মিশরীয়রা, এশিয়া মাইনর থেকে হিটাইটরা। ঠিক আমাদের দেশের মতই "দুর্বার স্রোতে এল কোথা হতে, সমুদ্রে হল হারা"।[৪,৫] 

ভারতবর্ষের মতই সিরিয়াকেও বারবার বহিরাগতদের হাতে আক্রান্ত হতে হয়েছে। পর্যায়ক্রমে পারস্য সাম্রাজ্য, আলেক্সান্ডারের গ্রীক সাম্রাজ্য, রোমান সাম্রাজ্য, ইসলামিক আরব সাম্রাজ্য ও অটমান তুর্কি সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে সিরিয়া। আরব মুসলমানদের অধিকারের সময় থেকেই আরবি সিরিয়ার প্রধান ভাষা হয়ে ওঠে। পশ্চিমে স্পেন থেকে পূর্বে ভারতবর্ষের সীমান্তে হিন্দুকুশ পর্বতমালা, বিশাল ইসলামিক সাম্রাজ্যের রাজধানী হিসেবে দামাস্কাস নগরীর রমরমা বেড়ে যায়। খ্রিস্টধর্মের সঙ্গেও সিরিয়ার সম্পর্ক অত্যন্ত পুরনো। সেন্ট পল নাকি দামাস্কাসের পথে যিশুখ্রিস্টের দেখা পেয়ে ইহুদি মতবাদ ত্যাগ করে খৃষ্টধর্ম গ্রহণ করেন এবং দামাস্কাস থেকেই তাঁর নতুন ধর্মপ্রচারের কাজ শুরু করেন। নানা জাতিধর্মের সমাহার ঘটলেও আরব সুন্নীরাই ক্রমশ সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে উঠল। তবে তারা শিয়া, ইহুদী, মেরোনাইট ও আর্মেনীয় খ্রিস্টানদের সঙ্গে মোটামুটি শান্তিতেই সহাবস্থান করত।[৬] 

সালাদিন আপনাকে সম্ভবত ভেড়ার চামড়ার ওপর লেখা কয়েকটা নথি দিয়েছিলেন। আরামাইক ভাষায় লেখা ঐ নথিগুলোতে স্বয়ং যিশুখ্রিস্টের হাতের লেখা ছিল বলে সালাদিন অনুমান। প্রায় তিনহাজার বছরের পুরনো এই আরামাইক ভাষাতেই নাকি যিশু কথা বলতেন। দীর্ঘ বিবর্তনের ফলে এই ভাষা নানা উপভাষায় ভেঙ্গে গেছে। এখনও খ্রিস্টান ও ইহুদী ধর্মাবলম্বী পশ্চিম এশিয়ার অনেক বিচ্ছিন্ন জনজাতি এইসমস্ত উপভাষায় কথা বললেও আরামাইক ভাষাকে বিপন্ন বলেই ধরা হয়। ঐ নথির পাঠোদ্ধার করার আশায় আপনারা মম আলুলা গ্রামে গেলেন। দামাস্কাস থেকে ষাট কিলোমিটার দূরে পাহাড়ের খাঁজে গড়ে ওঠা এই গ্রামটির বৈশিষ্ট হল এখানকার হাজার দুয়েক অধিবাসী সকলেই পশ্চিমী আরামাইক ভাষায় কথা বলেন।[৭] এত জায়গা থাকতে এরা পাহাড়ের মধ্যে থাকে কেন এ ব্যাপারে সন্তু কৌতূহল  প্রকাশ করতে আপনি বললেন, "একসময় খ্রিস্টানরা ইহুদি আর রোমানদের ভয়ে পালিয়ে-পালিয়ে বেড়াত, লুকিয়ে থাকত। সেই রকমই একটা গোষ্ঠী এই পাহাড়ের গুহাগুলোয় আশ্রয় নিয়েছিল। এরা তাদেরই বংশধর। এখনও সেই সময়ের ভাষা বলে। তবে এখন নিশ্চয়ই এদের অনেকে চাকরিবাকরি করে। অন্য ভাষাও শিখেছে, তবু নিজেদের পুরনো ধারাটা বজায় রেখেছে"। ভাগ্যিস রেখেছিল, তাই চলতি সংঘর্ষের আঁচ থেকে এরা অনেকদিন অবধি নিজেদের বাঁচিয়ে রাখতে পেরেছিল। কিন্তু হাজার হাজার বছর ধরে সিরিয়ার ধর্মীয় সহিষ্ণুতার প্রতীক মম্ আলুলা আজ অস্তিত্বের সঙ্কটে। কদিন আগেই আল কায়দার উগ্রপন্থীরা ৮ জন নিরাপত্তারক্ষীকে খুন করে গ্রামটি দখল করে। পাল্টা অভিযান চালাচ্ছে সরকারি বাহিনীও।[৮]  আরামাইক ভাষা আর কদিন টিকে থাকবে বলা যাচ্ছেনা, কাকাবাবু। ভাগ্যিস সালাদিন ঐ দলিলটা আপনাকে দিয়ে দিয়েছিলেন, নাহলে এই অশান্তির মধ্যে ওটার কথা আর কে মাথায় রাখত!

শুধু মম্ আলুলা নয়, আড়াই বছরের গৃহযুদ্ধের শিকার হয়েছে প্রাচীন সভ্যতার বহু ঐতিহ্য। আল কাশিম ওরফে ইব্রাহিম আপনাদের যে ক্রাক দ্য শ্যাটেলিয়র দুর্গে আটকে রেখেছিল, সেটা তৈরী করেছিল কুর্দরা, একাদশ শতাব্দীতে। পরে তা ক্রুসেডারদের হাতে যায়। ইতিহাসের বহু ঘটনার সাক্ষী এই কেল্লার একটা টাওয়ার ভেঙে পড়েছে সেনাবাহিনীর বিমান হানায়। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সৈদনেয়ার কনভেন্ট অফ আওয়ার লেডি চার্চ, আলেপ্পোর বিরাট মসজিদ, বিখ্যাত আল মানার বাজার, প্রাচীন আসিরীয় মন্দির ও আরো অনেক ঐতিহাসিক নিদর্শন। হজরত মহম্মদের বিশ্বস্ত সঙ্গী হিজির আল কিন্দীর সমাধিও রেহাই পায়নি ইসলামের ধ্বজাধারী বিদ্রোহীদের হাত থেকে।[৯]

যাকে সিরিয়া বলছি সেই অঞ্চলের মধ্যে আজকের প্যালেস্তাইন, জর্ডন, লেবানন, এবং ইরাক ও তুরস্কের খানিকটা অংশও পড়ছে। আধুনিক সিরিয়ার পত্তন বলা যেতে পারে ফরাসী ম্যানডেটের মাধ্যমে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর বৃটিশ ও ফরাসীরা আরবভূমিকে নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেয়। ইরাক, প্যালেস্তাইন, জর্ডন বৃটিশরা দখলে নেয় আর ফরাসীদের ভাগে পড়ে সিরিয়া, লেবানন।[৬] দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৪৬ সালে সিরিয়া স্বাধীন হয়। ঠাণ্ডা যুদ্ধের সময় ও তা শেষ হওয়ার পরেও পশ্চিম এশিয়া ও উত্তর আফ্রিকা, যাকে মধ্যপ্রাচ্য বলা হয়, বিশ্বরাজনীতির নানা তৎপরতার সাক্ষী।  মিশরের আরব জাতীয়তাবাদী নায়ক আবদুল গামাল নাসেরের ডাকে সাড়া দিয়ে সিরিয়া মিশরের সঙ্গে জোট বেঁধে সংযুক্ত আরব প্রজাতন্ত্র গড়ে তোলে, কিন্তু বছর তিনেকের মধ্যেই আবার দুই দেশ  পৃথক হয়ে যায়। এদিকে তেলসমৃদ্ধ এবং রণনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ মধ্যপ্রাচ্যের ওপর ছড়ি ঘোরানোর জন্য সাম্রাজ্যবাদীরা চলে যাওয়ার আগে প্যালেস্তাইনের মাটিতে ইজরায়েল নামে ইহুদীদের জন্য একটা রাষ্ট্র খাড়া করে গেল। প্রসঙ্গতঃ ইহুদীরা ঐ অঞ্চলে দীর্ঘদিন ধরেই ছিল, আরবদের সঙ্গেই। তার ওপর হিটলারের উত্থানের পর ইউরোপ থেকে বিতাড়িত হয়ে ইহুদীরা দলে দলে চলে এলেন প্যালেস্তাইনে। তাঁদের জন্য স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের হয়ত প্রয়োজন ছিল, কিন্তু প্যালেস্তাইনের মধ্যে ইজরায়েলের প্রতিষ্ঠায় মধ্যপ্রাচ্যে যে সঙ্ঘাতের সূত্রপাত হল তা মেটার কোন সম্ভাবনা আজও দেখা যাচ্ছেনা। পশ্চিমীদের সমর্থনপুষ্ট ও উচ্চ সামরিক ক্ষমতার অধিকারী ইজরায়েল ছুতোনাতায় আরব দেশগুলোর ওপর হামলা চালিয়ে নিজের জমি বাড়িয়ে নিয়েছে। নিজভূমে পরবাসী হয়ে থাকছেন প্যালেস্তিনীয়রা। 

১৯৪৭ সালে সিরিয়ায় মাইকেল আফলাকের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয় আরব স্যোসালিস্ট বাথ পার্টি। আরব জাতীয়তাবাদ ও সমাজবাদী আদর্শ নিয়ে এবং অনেকটা লেনিনীয় গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার কাঠামো নিয়ে বাথ পার্টি দ্রুত ইরাক, লেবানন, জর্ডন, সুদান ইত্যাদি দেশে সংগঠন বিস্তৃত করে। ১৯৬৩তে বাথ পার্টি সিরিয়ায় ক্ষমতা দখল করল। সোভিয়েত ইউনিয়নের সাহায্যে প্রেসিডেন্ট জাহিদ সমাজতান্ত্রিক ধাঁচে দেশ গড়তে উদ্যোগী হলেন। কিন্তু ইজরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধে গোলান হাইট খোয়ানোর পর বাথ পার্টির আভ্যন্তরীন দ্বন্দ্ব চরমে উঠল। অবশেষে আবার একটা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে হাফেজ আল আসাদ পার্টি ও রাষ্ট্রের ক্ষমতা দখল করলেন। ১৯৭২ সালে গণভোটে আসাদ সাত বছরের জন্য রাষ্ট্রপতি হন। পরের বছর সংসদীয় নির্বাচনের মাধ্যমে সিরিয়া নতুন সংবিধান গ্রহণ করে। সিরিয়াকে মুসলিম জনবহুল ধর্মনিরপেক্ষ সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষনা করা হয়। কয়েকটা কমিউনিস্ট, বামপন্থী এবং জাতীয়তাবাদী দল ও সংগঠন কে নিয়ে বাথ পার্টির নেতৃত্বে গড়ে ওঠে জাতীয় দেশপ্রেমিক মোর্চা। এই মোর্চাই সরকার পরিচালনার দায়িত্ব নেয়।[১০] 

সিরিয়ার পাশাপাশি ইরাকেও বাথ পার্টি ক্ষমতা দখল করে, কিন্তু ভাগাভাগির চিরাচরিত নিয়ম মেনে বাথ আন্দোলন সিরিয়া ও ইরাকপন্থী অংশে ভেঙ্গে যায়। দুই গোষ্ঠির তিক্ততা এমন চরমে ওঠে যে ইরাক ইরান যুদ্ধ ও উপসাগরীয় যুদ্ধে সিরিয়া ইরাকের বিপক্ষে যোগ দেয়। ২০০৩ এ ইরাকে মার্কিন আক্রমণ ও ফাঁসির নামে সাদ্দাম হোসেনকে হত্যার বিরোধিতা অবশ্য সিরিয়া করেছিল।
প্রেসিডেন্ট আসাদ ছিলেন আলাওইট সম্প্রদায়ভুক্ত, যা আসলে শিয়া ইসলামেরই একটা শাখা, অথচ দেশের অধিকাংশ মানুষ সুন্নী মুসলমান। তাই একটা দ্বন্দ্ব ছিলই, কিন্তু ইসলামিক সাম্রাজ্য ও অটোমান তুর্কি সাম্রাজ্যের ঐতিহ্য মেনে সিরিয়ার শাসকগোষ্ঠী সুন্নী আরব, আলাওইট, খ্রিস্টান, কুর্দ সকলকে নিয়েই সহিষ্ণুতার বাতাবরণ বজায় রেখেছিলেন। আটের দশকের প্রথমদিকে মৌলবাদী শাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে মুসলিম ব্রাদারহুড হোমস, হামা ও আলেপ্পো শহরে হিংসাত্মক আন্দোলন শুরু করে। সেনাবাহিনীর পাল্টা আক্রমণে দশ থেকে পঁচিশ হাজার মানুষ নিহত হন। এর পর রাজনৈতিক স্বাধীনতা ও মানবাধিকার অনেকটাই নিয়ন্ত্রিত হয়। বাথ পার্টির ক্ষমতা দখলের সময় থেকেই সিরিয়ায় জরুরী অবস্থা বলবৎ ছিল।[১১]

হাফেজ আল আসাদ তাঁর উত্তরসূরী হিসেবে বড়ছেলে বাসেলকে ঠিক করে রেখেছিলেন। কিন্তু তিনি পথদুর্ঘটনায় নিহত হলে ছোট ছেলে বাসারের ভাগ্য খুলে গেল। বাবার ডাকে স্নাতকোত্তর পাঠ অসমাপ্ত রেখেই তিনি তরিঘড়ি দেশে ফিরলেন। আপনি কি এর সঙ্গে অন্য কোন ঘটনার মিল খুঁজে পাচ্ছেন? ঠিক ধরেছেন, সঞ্জয় গান্ধীর মৃত্যু না হলে তো রাজীবের ভাগ্যে শিকে ছিঁড়ত না! কে বলতে পারে, তাহলে হয়ত আজ বরুণ গান্ধীকেই নরেন্দ্র মোদীর উল্টোদিকে দেখা যেত! 

২০০০ সালে বাসার আল আসাদ হাফেজের মৃত্যুর পর মৃত্যুর পর প্রেসিডেন্ট হলেন বাসার আল আসাদ।
পেশায় সামরিক চক্ষু চিকিৎসক, বিলেতফেরত তরুণ প্রেসিডেন্টকে ঘিরে সিরিয়াবাসীর মধ্যে নতুন উদ্দীপনার সৃষ্টি হল।  ২০০৭ এর গণভোটে ৯৭% ভোট পেয়ে আসাদ বিপুলভাবে জয়ী হলেন। কিন্তু তাঁদের প্রত্যাশা পূর্ণ হল না। ওপর ওপর কিছু সংস্কার হলেও জরুরী অবস্থার প্রত্যাহার, গণতান্ত্রিক অধিকারের প্রসার বা বহুদলীয় নির্বাচনের কোন প্রক্রিয়াই শুরু হল না। তার সঙ্গে দুর্নীতি ও আসাদ পরিবারের স্বজনপোষণ তো ছিলই। সোভিয়েতের পতনের পর সিরিয়ার অর্থনীতিতে ধাক্কা আসে। সমাজবাদী পথ ছেড়ে মুক্ত অর্থনীতি বেছে নেওয়ার অবধারিত ফল হিসেবে আয়বৈষম্য বাড়তে লাগল। বহুদিন ধরে বজায় রাখা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিও টাল খেল। বিশেষ করে আরব ও কুর্দ সুন্নীরা নিজেদের বঞ্চিত ও শোষিত মনে করতে লাগলেন।[১২]

আপনারা সিরিয়া থেকে ফেরার কিছুদিনের মধ্যেই তিউনিশিয়া ও মিশরে স্বৈরতন্ত্র বিরোধী বিক্ষোভ শুরু হল এবং দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়ল গোটা আরব দুনিয়ায়, যাকে সাধারণভাবে আরব বসন্ত বলা হয়ে থাকে। ২০১১ সালের ১৫ই মার্চ সিরিয়ার দারা শহরে রাজনৈতিক বন্দীমুক্তি, দুর্নীতি প্রতিরোধ, জলসংকট নিরসন ও রাজনৈতিক সংস্কারের দাবীতে বিশাল বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হল। ক্রমশ এই আন্দোলন দেশের অন্যত্র প্রসার পেল এবং আর সব দাবীকে পিছনে ফেলে গণতন্ত্র ও রাজনৈতিক সংস্কারের দাবীটাই মুখ্য হয়ে উঠল। গঠিত হল ন্যাশনাল কোঅর্ডিনেশন কমিটি ফর ডেমোক্রাটিক চেঞ্জ। প্রথমদিকে দমন পীড়নের রাস্তা ধরলেও অচিরেই পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝল সরকার। ২৬শে মার্চ ২০০ জন বন্দী মুক্তি পেল। ২১শে এপ্রিল জরুরী অবস্থা উঠে গেল, শান্তিপুর্ণ রাজনৈতিক কার্যক্রমের অধিকার স্বীকৃত হল। এক বছরের মধ্যে বহুদলীয় নির্বাচনের সংস্থান রেখে নতুন সংবিধান রচিত হল। তুমুল অশান্তির মধ্যেই ভোট হল এবং সংসদের ৬০% শতাংশ আসনে জিতল বাথ পার্টি। অবশ্য বিদ্রোহীরা এই ভোট বয়কট করেছিল।[১৩]

কিন্তু এরমধ্যে ছবিটা বদলে গেছে। একইসঙ্গে মৌলবাদী সন্ত্রাস ও জায়নবাদী আগ্রাসনের প্রতিরোধ করে এবং ধর্মনিরপেক্ষতা ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতার পতাকা তুলে ধরে সিরিয়া নিজেকে আঞ্চলিক ও বহুজাতিক কায়েমী স্বার্থগুলোর শত্রু করে তুলেছিল। আলেপ্পোয় ফ্রি সিরিয়ান আর্মির ঘঁটি তারা এ সুযোগ ছাড়তে চাইবে কেন? তারা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ইন্ধন যোগাতে শুরু করল অশান্তিতে। সিরিয়ার সেনাবাহিনী থেকে একদল অফিসার ও সেনা বেরিয়ে গিয়ে তৈরী করল ফ্রি সিরিয়ান আর্মি। দেশের বিভিন্ন এলাকায় নাশকতা, সরকারি দপ্তর, স্কুল, হাসপাতাল, জনপদের ওপর হামলা চালিয়ে দেশের বেশ কিছু এলাকা দখল করল তারা। দেশের প্রধান বাণিজ্যিক কেন্দ্র আলেপ্পো সরকারি বাহিনীর কাছ থেকে ছিনিয়ে নিল। পাল্টা আক্রমণে গেল সিরিয়ার নিরাপত্তাবাহিনী। সরকারের হয়ে যুদ্ধে নেমে পড়ল অনেক আঞ্চলিক মিলিশিয়াও। ইজয়ায়েলি দখলদারির বিরুদ্ধে সংগ্রামরত লেবাননের হেজবোল্লা এবং প্যালেস্তাইনের পপুলার ফ্রন্টও সিরিয়া সরকারের পাশে দাঁড়াল। দুপক্ষের গোলাগুলিতে দুর্বিষহ হয়ে পড়ল সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা। একা রামে রক্ষা নেই, সুগ্রীব দোসর। ২০১২-র গোড়ার দিকে প্রতিষ্ঠিত হল আল নুসরা ফ্রন্ট। আল কায়দার এই শাখা গোষ্ঠীটি আপাতত আসাদের বিরুদ্ধে লড়লেও তাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য সিরিয়ায় শরিয়তি কানুন ও কট্টর সুন্নী ওয়াহাবী শাসন কায়েম করা। সরকারি বাহিনী ও বাথ পার্টির সমর্থকদের পাশাপাশি তাদের লক্ষ্য হয়ে উঠল দেশের খ্রিস্টান ও আলাওইট অধিবাসীরা। গণতন্ত্রের দাবীতে যাঁরা আন্দোলন শুরু করেছিলেন তাঁরা হারিয়ে গেলেন, অনেকে খুন হলেন উগ্রপন্থীদের হাতে।

কাকাবাবু, আপনার সঙ্গে তো হানি আলকাদির আলাপ হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথের ভক্ত এই বিপ্লবীটি আপনাকে বলেছিল, "যারা ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখতে জানেনা তারা কী করে বিপ্লবী হবে?"[১৪] আপনি যদি সিরিয়ার "বিদ্রোহীদের" হানি আলকাদির সঙ্গে গুলিয়ে ফেলে থাকেন তবে আপনাকে মহম্মদ তাতার কথা বলি শুনুন। গৃহযুদ্ধের ধাক্কায় ১৪ বছরের এই ছেলেটার আর পড়াশোনা এগোয়নি। সে আলেপ্পো শহরে একটা চায়ের দোকান চালাত। এক সকালে একজন খদ্দের তাকে ফ্রিতে এককাপ চা খাওয়াতে বললে সে বলে "স্বয়ং নবী এলেও বিনা পয়সায় চা দেবনা।" কিছুক্ষণের মধ্যেই একদল সশস্ত্র লোক এসে তাকে তুলে নিয়ে যায় এবং "নবীকে অবমাননা"র অপরাধে অভিযুক্ত করে গুলি করে মারে। এরা সকলেই ছিল ইসলামের স্বঘোষিত রক্ষক নুসরা ফ্রন্টের ক্যাডার এবং আলেপ্পো তখন বিদ্রোহীদেরই দখলে ছিল।[১৫] আপনি যদি মনে করেন এরকম কিছু উগ্রপন্থী থাকলেও বিদ্রোহীদের মধ্যে ধর্মনিরপেক্ষ অংশও আছে, তাহলে এই ভিডিওটা দেখুন,  http://www.youtube.com/watch?v=qxb8OFbwMQQ । এখানে দেখা যাচ্ছে ফ্রি সিরিয়ান আর্মির যোদ্ধা আবু সকর একজন সিরিয়ান সেনার পেট তার হৃৎপিণ্ড বের করে কামড় দিচ্ছে। পরে বিবিসির সঙ্গে সাক্ষাৎকারে সে বলে, শত্রুদের সন্ত্রস্ত করতেই তার এই কাজ এবং আমেরিকা শিগগির অস্ত্রশস্ত্র না পাঠালে সে এরকম কাণ্ড আরো করবে। সে এটাও উল্লেখ করতে ভোলেনা যে ঐ সেনা ছিল আলাওইট এবং তাদের মতে আলাওইটরা ঠিকঠাক মুসলমান নয়।[১৬] আল নুসরা এবং ফ্রি সিরিয়ান আর্মি উভয়েই বর্বরতা, গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত। যুদ্ধবন্দী সেনা, সাংবাদিক, ধর্মযাজক, ইমাম, বুদ্ধিজীবি ও অজস্র সাধারণ মানুষকে ঠাণ্ডা মাথায় নৃশংসভাবে হত্যা করেছে। একথা বলার অর্থ অবশ্য সিরিয়ার সেনাবাহিনীকে সার্টিফিকেট দেওয়া নয়। তারাও বিদ্রোহীদের দমন করতে গিয়ে সাধারণ মানুষকে মেরেছে।[২]

কাকাবাবু, আপনি জানেন আফগানিস্তান ও মধ্যপ্রাচ্যে সোভিয়েত প্রভাবকে খর্ব করার জন্য আল কায়দা ও তালিবানকে তৈরী করেছিল আমেরিকাই।[১৭] সোভিয়েতের পতন হলে দুপক্ষের স্বার্থের সঙ্ঘাত তীব্র হয়। তারপর এল ১১ই সেপ্টেম্বরের হামলা এবং সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ। কিন্তু ২০১১-র লিবিয়া ও সিরিয়া দেখিয়ে দিল তারা এখনও কমরেড ইন আর্মস। লিবিয়াতেও একই কৌশল, প্রথমে জেহাদিদের হাতে অস্ত্র দিয়ে লেলিয়ে দাও, তারপর সরকার প্রত্যাঘাত করলে "গণতন্ত্র বিপন্ন" ছুতো দেখিয়ে সরাসরি আগ্রাসন চালাও। রাশিয়া-চীন নিস্ক্রিয় থাকায় লিবিয়ায় তাদের কৌশল সফল হল। ভোটের মুখে গদ্দাফির সঙ্গে তাঁর গোপন আঁতাত ফাঁস হয়ে যাওয়ার ভয়ে ফরাসি প্রেসিডেন্ট সারকোজি গুপ্তচর পাঠিয়ে খুন করলেন গদ্দাফিকে।[১৮] তবে পাপ যে তার বাপকেও ছাড়েনা তা আবার প্রমাণ হল যখন "মুক্ত" লিবিয়ায় আল কায়দার জঙ্গিদের হাতে নিজের দপ্তরেই খুন হলেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত।[১৯]

বিদেশী যোদ্ধাদের সিরিয়ায় ক্রমবর্ধমান তৎপরতা সিরিয়াকে সন্ত্রাসবাদীদের মুক্তাঞ্চল করে তুলতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। ইরাক, জর্ডন, মিশর এমনকি তাজিকিস্তান, চেচানিয়া থেকেও ওয়াহাবি জঙ্গিরা সিরিয়ার বিদ্রোহে অংশ নিয়েছে।[২০] পাকিস্তান থেকে তালিবানদের একটা দলও সিরিয়ায় গেছে আসাদ হঠানোর লক্ষ্যে।[২১] আমেরিকা আল নুসরাকে সন্ত্রাসবাদী তালিকাভুক্ত করলেও তাদের বিরুদ্ধে কার্যত কোন ব্যবস্থা তো নেয়ইনি, বরং জর্ডন ও তুরস্কের মাটিতে ঘাঁটি গেড়ে সিআইএ অফিসাররা নুসরা সমেত সব ধরনের বিদ্রোহীদেরই প্রশিক্ষণ ও পরামর্শ দিচ্ছে।[২২] সিরিয়া সরকারের অভিযোগ অনুযায়ী অস্ত্রও সরবরাহ করছে। দামাস্কাসে প্রাক্তন মার্কিন রাষ্ট্রদূত রবার্ট ফোর্ড বিদ্রোহীদের সংঘটিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।
কাকাবাবু, আপনি নিশ্চয়ই সিরিয়াকে নিয়ে আমেরিকার মাথাব্যাথায় অবাক হচ্ছেন, কারণ সিরিয়া অর্থনৈতিক ও সামরিকভাবে দুর্বল একটা দেশ, তাদের তেলসম্পদও খুব বেশী নয়। আসলে যত ছোটই হোক, লেবাননের গৃহযুদ্ধ থামিয়ে, প্যালেস্তাইনের মুক্তিসংগ্রামে সবরকমভাবে পাশে দাঁড়িয়ে সিরিয়া আরব দুনিয়ায় সমীহ আদায় করে নিয়েছে এবং আমেরিকা-ইজরায়েলের সাম্রাজ্যবাদী দখলদারির সামনে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে। তাছাড়া ইসলামি বিপ্লবের সময় থেকেই ইরান আমেরিকার ঘোরতর শত্রু, বুশ কথিত শয়তানের অক্ষের অন্তর্ভূক্ত। ইজরায়েলের সামরিক শক্তির সঙ্গে টক্কর দেওয়ার ক্ষমতা মধ্যপ্রাচ্যে একমাত্র ইরানেরই আছে। তাই ইরানকে সমঝে দেওয়াও একটা উদ্দেশ্য।[২৩] 

এবছরের মে মাস থেকে থেকেই ছবিটা ঘুরতে শুরু করে। এফএসএ জঙ্গিরা লেবাননে শিয়া বসতির ওপর হামলা চালালে হেজবোল্লা তাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নামতে বাধ্য হয়। হেজবোল্লা ও সরকারি সেনা যৌথ আক্রমণ চালিয়ে আল কোয়াসার শহরটি পুনরুদ্ধার করে।[২৪] শহরটি রণনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ সরকারের কাছে কোয়াসার যেমন দামাস্কাস ও হোমস শহরের সংযোগ রক্ষা করছে তেমনি বিদ্রোহীদের কাছে এটা ছিল লেবানন হয়ে অস্ত্রপাচারের পথ। এর পর আরো কয়েকটা জায়গায় সাফল্য পায় সরকারি সেনা, এফএসএ ও নুসরা পিছু হঠতে থাকে। তার সঙ্গে বিদ্রোহীদের আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ মাথাচাড়া দিতে শুরু করে। ফ্রি সিরিয়ান আর্মির কমান্ডার আবু বসির আল লকদানি খুন হলেন আল কায়দা জঙ্গিদের হাতে।[২৫] কুর্দিশ বিদ্রোহীরা প্রথমদিকে সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই করলেও পরে তারা ঘোষণা করে গৃহযুদ্ধের ফলাফল যাই হোক না কেন কুর্দরা সিরিয়ার ভেতরেই স্বশাসিত প্রদেশ গঠন করবে।[২৬] এটা মেনে নিতে না পেরে নুসরা ও ইসলামিক স্টেট অফ ইরাক অ্যান্ড লেভেন্ট কুর্দিশদের ওপর হামলা চালায়।[২৭]

২১শে আগষ্ট দামাস্কাসের উপকন্ঠে ঘুটা শহরে রাসায়নিক অস্ত্রের আক্রমণে হাজারের বেশী মানুষের মৃত্যু হয়, যাদের মধ্যে বেশীরভাগই শিশু।[২৮] এটা ঘটেছে এমন একটা সময় যখন রাষ্ট্রসঙ্ঘের পর্যবেক্ষকরা আগের একটা রাসায়নিক হামলার তদন্তে সিরিয়ায় ছিলেন। রাষ্ট্রসঙ্ঘের মহাসচিবের আহ্বানে সাড়া দিয়ে সিরিয়া সরকার পর্যবেক্ষকদের ঘুটায় গিয়ে নমুনা সংগ্রহের অনুমতি দেয়। কাকাবাবু, আপনি শুনেছেন যে এই হামলায় ব্যবহার করা হয়েছিল নার্ভ এজেন্ট সারিন গ্যাস। এটাও নিশ্চয়ই জানেন যে বিদ্রোহীরা এবং আমেরিকা, বৃটেন, ফ্রান্সের মত তাদের পৃষ্ঠপোষকরা সিরিয়া সরকারকেই দায়ী করেছে এবং সিরিয়াকে শাস্তি দেবার জন্য সামরিক অভিযান চালানোর পরিকল্পনা করছে। কিন্তু আপনি কি এটা শুনেছেন যে গত মে মাসে তুরস্কের আদনান শহরে পুলিস আল নুসরা ফ্রন্টের ১২ জন সদস্যকে ২ কেজি সারিন গ্যাস সহ গ্রেপ্তার করে?[২৯] পরে অবশ্য তুর্কি সরকার এঘটনার কথা অস্বীকয়ার করেছিল। আরো একটা মারাত্মক তথ্য উঠে এসেছে মিন্টপ্রেস সংবাদসংস্থার অনুসন্ধানে। ঘুটায় গ্যাসে আক্রান্ত মানুষ, ডাক্তার, বিদ্রোহী ও তাদের পরিবার এবং সাধারণ নাগরিকদের সাক্ষ্য থেকে জানা গেছে সৌদি আরবের গোয়েন্দা প্রধান বান্দার বিন সুলতান ঐ অস্ত্রগুলো বিদ্রোহীদের কাছে পাঠিয়েছিলেন। তবে চোঙাকৃতি গ্যাসবোতলের মত দেখতে ওগুলো কি ধরনের অস্ত্র বা কিভাবে ওগুলো ব্যবহার করতে হয় তা বিদ্রোহীরা জানত না বলে দাবী করেছেন সেদিনের ঘটনায় নিহত এক বিদ্রোহীর বাবা। একটা টানেলে সেগুলোকে লুকিয়ে রাখতে গিয়ে তারা বিস্ফোরন ঘটিয়ে ফেলে বলে সহযোদ্ধারা জানিয়েছেন।[৩০] 

বছরখানেক আগেই মার্কিন রাষ্ট্রপতি ওবামা রাসায়নিক অস্ত্রের ব্যবহারকে লালদাগ ঘোষণা করে বলেছিলেন ঐ লালদাগ অতিক্রম করলেই তাঁর সরকার সরাসরি সিরিয়ায় সামরিক হস্তক্ষেপ করবে। কাকাবাবু, আপনি নিশ্চয়ই মানবেন যে সিরিয়ার সরকার যখন বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে সাফল্য অর্জন করছে, তখন খামোকা রাসায়নিক অস্ত্র প্রয়োগ মার্কিন আক্রমণকে নেমন্তন্ন করা তাদের পক্ষে চরম আহাম্মকি? আর আমেরিকার ওপর সৌদি আরবের নির্ভরতার কথা মাথায় রাখলে এটা বিশ্বাস করা কঠিন যে আমেরিকাকে না জানিয়েই সৌদি সুলতান সিরিয়ায় রাসায়নিক অস্ত্র পাঠিয়েছেন। এই সূত্রগুলো কিন্তু সিরিয়াকে ঘিরে একটা মারাত্মক চক্রান্তের দিকে ইঙ্গিত করছে। 

আন্তর্জাতিক রাজনীতি এখন সিরিয়াকে ঘিরেই আবর্তিত হচ্ছে। প্রথম থেকেই সিরিয়ার বিদ্রোহীদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সাহায্য ও মদত দিয়ে চলেছে সৌদি আরব, কাতার, তুরস্ক, ইজরায়েলের মত আঞ্চলিক শক্তি এবং আমেরিকা, ব্রিটেন, ফ্রান্সের মত সাম্রাজ্যবাদীরা। এই সমস্ত দেশগুলো সিরিয়ার সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে বিদ্রোহীদের জোট সিরিয়ান ন্যাশনাল কোয়ালিশানকে সিরিয়ার জনগণের একমাত্র বৈধ প্রতিনিধি বলে স্বীকৃতি দিয়েছে। আরব লীগের আমীর, শেখ, সুলতানরা গণভোটে নির্বাচিত আসাদকে স্বৈরাচারী আখ্যা দিয়ে সিরিয়াকে বহিস্কার করেছে। অন্যদিকে সিরিয়ার পাশে আছে ইরান। সোভিয়েত সঙ্গে সিরিয়ার যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল তা বজায় আছে রাশিয়ার সঙ্গেও। তারা প্রথম থেকেই দুপক্ষের আলোচনার মাধ্যমে রাজনৈতিক সমাধানের ওপর জোর দিয়েছে। রাষ্ট্রসঙ্ঘ নিযুক্ত মধ্যস্থতাকারী কোফি আন্নান এবং পরে লাখদার ব্রাহিমি অবশ্য সে কাজে ব্যর্থ হয়েছেন। 

লালদাগ অতিত্রান্ত হওয়ার পর ওবামা এবার নতুন উদ্যমে সিরিয়ায় হামলার ছক কষেছেন। আগে দুবার রাশিয়া চীনের ভেটোয় রাষ্ট্রসংঘকে শিখণ্ডী করার চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ায় এবার তাঁর কথায় "পক্ষাঘাতগ্রস্ত" রাষ্ট্রসঙ্ঘকে পাশ কাটিয়েই যা করার করতে চান তিনি। তবে সম্ভবতঃ রাসায়নিক অস্ত্রের ভয়েই সেনা না নামিয়ে আকাশপথে ষাট দিনের "সীমাবদ্ধ" আক্রমণের প্রস্তাব পেশ হয়েছে মার্কিন সেনেটে। কিন্তু এনিয়ে ওবামা কূটনৈতিকভাবে অনেকটাই ব্যাকফুটে। সিরিয়ার সংকটে দেশকে জড়ানোর প্রস্তাব খারিজ করেছে বৃটিশ পার্লামেন্ট। জার্মানী কোনরকম সামরিক অভিযানে যোগ দেবেনা বলে জানিয়ে দিয়েছে। গ্রীস তাদের সামুদ্রিক ঘাঁটিগুলো ব্যবহার করতে দিতে অস্বীকার করেছে। ভারত স্পষ্টভাবে রাষ্ট্রসঙ্ঘের অনুমোদন ছাড়া কোনরকম সামরিক তৎপরতার বিরোধিতা করেছে। এমনকি আরব লীগ ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়নও রাষ্ট্রসঙ্ঘের নেতৃত্ব ছাড়া অভিযানে আপত্তি জানিয়েছে। একমাত্র ফ্রান্স যুদ্ধ করতে এক পায়ে খাড়া। যে ফ্রান্সের রক্ষণশীল প্রেসিডেন্ট জ্যাক শিরাক ইরাক যুদ্ধের কড়া বিরোধিতা করেছিল, সেই ফ্রান্সের স্যোসালিস্ট প্রেসিডেন্ট হোলান্দে এখন আসাদকে সরাতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন। রাজনীতি বড় বিষম বস্তু কাকাবাবু! হয়ত সিরিয়া একসময় ফ্রান্সের উপনিবেশ ছিল বলে ঐ দেশের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করা তাদের কর্তব্য বলে ফ্রান্স মনে করে। ওদিকে ভূমধ্যসাগরের মার্কিন নৌবহর সিরিয়ামুখী হতেই চাপ বাড়াতে রাশিয়াও দুটো রণতরী পাঠিয়েছে। ইরান জানিয়ে দিয়েছে হামলা হলে তারা শেষ অবধি সিরিয়ার পাশে থাকবে।

শেষপর্যন্ত কি হবে, আসাদ কি আত্মসমর্পণ করবেন না কি সাদ্দাম-গদ্দাফির মত যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণ দেবেন, সিরিয়া কতটা প্রতিরোধ করতে পারবে সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের, রাশিয়া-ইরানের ভূমিকা কি হবে তা ভবিষ্যতই বলবে; কিন্তু সিরিয়ার মানুষের জন্য যে এখনও অসীম দুর্গতি অপেক্ষা করছে তাতে সন্দেহ নেই। তবে তাঁরা দুবছরে এই পরিস্থিতির সঙ্গে নিজেদের অভ্যস্ত করে নিয়েছেন। মার্কিন হুঙ্কারের বিরুদ্ধে এককাট্টা দামাস্কাসবাসী জানিয়ে দিয়েছেন তাঁরা কোন বিদেশী শক্তির কাছে মাথা নোয়াবেননা, প্রেসিডেন্ট আসাদের পাশেই থাকবেন।[৩১] এমনকি সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনরত সমাজকর্মীও বলছেন, "এ দেশের মানুষ বিদেশের সেনাকে দেশের মাটিতে দেখতে চায়না। স্বাধীনতা নিজেরাই রক্ষা করবে দেশের মানুষ।"[৩]

আমি ভাবছিলাম সাবা কাব্বানির কথা। আপনি যখন সন্তুকে জিজ্ঞেস করলেন, "এই দেশের কোন মানুষটাকে আমাদের সারাজীবন মনে থাকবে বল তো?" সে একটুও চিন্তা না করে বলল, "সাবা কাব্বানি"। কাব্বানি একজন কুর্দ, ইরাকে বাড়ি, সেখানকার আর্মিতে কাজ করত। সাদ্দাম হোসেনের পতনের পর একদিকে আমেরিকার দখলদারি, অন্যদিকে জাতিদাঙ্গায় ইরাক ছাড়খার হয়ে গেল। সব দেশেই যা হয়, যেকোন সমস্যার আঁচে সব থেকে বেশি পোড়ে কাব্বানির মত সংখ্যালঘুরা। একদিন রাত্রে কারা যেন তার বাড়িতে হামলা চালিয়ে আগুন লাগিয়ে দিল। ছেলের মাথায় বোমা পড়ল, বাকিরা ইরাক ছেড়ে পালিয়ে এল সিরিয়ায়। তার আরো এক মেয়েও হারিয়ে গিয়েছিল ইরাক যুদ্ধের সময়। সে বলেছিল, "জানি না, আল্লা আমাদের কপালে আরো কত কঠিন পরীক্ষার কথা লিখে রেখেছেন"। সাবা কাব্বানি এখন কোথায়? সে কি মাটি কামড়ে পড়ে আছে সিরিয়ায়, না ফিরে গেছে তার নিজের দেশ ইরাকে? নাকি আবার পাড়ি জমিয়েছে অন্য কোথাও, পরের পরীক্ষার মুখোমুখি হওয়ার জন্য?




তথ্যসূত্র:
[১] সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, আরবদেশে সন্তু কাকাবাবু, আনন্দ পাবলিশার্স
[২] Facebook page of Syrian Observatoryfor Human Rights
[৩] নিসান আহমাদো, নিঃশ্বাসে বিষ বিশ্বাসে দ্রোহ, এবেলা, ৩০ আগষ্ট, ২০১৩
[৪] দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় ও রমাকৃষ্ণ মৈত্র, পৃথিবীর ইতিহাস, অনুষ্টুপ
[৫] Fertile Crescent, Wikipedia
[৬] History of Syria, Wikipedia
[৭] Robert Fisc, Maaloula, the past has relevance to Syria's tragic present, The Independent, September 3, 2012
[৮] Syria Islamist rebels take control of historic Christian town of Maaloula, CNN, September 8, 2013
[৯] List of heritage sites damaged during Syrian civil war, Wikipedia,  Al-Qaeda Takfiris Destroying World’s Heritage, Syrianews, May 2, 2013
[১০] Ba'ath Party, Wikipedia
[১১] Syria Profile: A chronology of key events, BBC
[১২] Bashar al-Assad, Wikipedia
[১৩] Timeline of the Syrian civil war, Wikipedia
[১৪] সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, মিশর রহস্য, আনন্দ পাবলিশার্স
[১৫] Al-Qa'ida Islamists kill Syrian boy, 15, for "insulting the prophet", The Australian, June 11, 2013 
[১৬] Paul Wood, Face-to-face with Abu Sakkar, Syria's 'heart-eating cannibal' BBC, July 5, 2013
[১৭] Norm Dixon, How the CIA created Osama bin Laden, Green Left Weekly, September 19, 2001,
Noam Chomsky interviewed by David Barsamian, The United States is a Leading Terrorist State, Monthly Review, vol. 53, no. 6, November, 2001
[১৮] French spy shot dead Gaddafi on Nicolas Sarkozy's order, The Indian Express, October 1, 2012
[১৯] Al-Qaeda indicates responsibility for killing US envoy in Libya, urges more attacks, The Times of Israel, September 15, 2012
[২০] As foreign fighters flood Syria, fears of a new terrorist haven, The Times of India, August 8, 2013
[২১] Pakistan Taliban says its fighters in Syria, Al Jazeera, July 16, 2013
[২২] Al-Nusra leader meets CIA officials, Alalam, August 30, 2013
[২৩] দেবাশিস চক্রবর্ত্তী, কার যুদ্ধ সিরিয়ায়, গণশক্তি, ৩১শে আগষ্ট, ২০১৩,
নাজেস আফরোজ, রাসায়নিক অস্ত্রে হঠাৎ এত আপত্তি!, আনন্দবাজার পত্রিকা, ৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৩
[২৪] Battle of al-Qusayr (2013), Wikipedia
[২৫] Key Free Syria Army rebel 'killed by Islamist group', BBC, July 12, 2013
[২৬] War in Syria inspires Kurdish unity, Al Jazeera, July 27 2013 
[২৭] Kurds, Islamists clash in north Syria, at least 12 jihadists killed, The Daily Star Lebanon, August 03, 2013 
[২৮] 2013 Ghouta attacks, Wikipedia
[২৯] Turkey finds sarin gas in homes of suspected Syrian Islamists, Strategic Culture Foundation, May 31, 2013
[৩০] Dale Gavlak and Yahya Ababneh, Syrians In Ghouta Claim Saudi-Supplied Rebels Behind Chemical Attack, August 29, 2013 
[৩১] নিয়তির হাতে ভবিতব্যকে সঁপেছে দামাস্কাস, বর্তমান, ৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৩

Tuesday 19 September 2017

সাতনায় সাবধান

সেবার মধ্যপ্রদেশ যাচ্ছিলাম চারজনে মিলে। শিপ্রা এক্সপ্রেস যখন সাতনা স্টেশনে থামল তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেলে ঢলতে আরম্ভ করেছে। সাতনা নিয়ে খুব একটা প্ল্যান ছিল না। পরের দিন খাজুরাহো যাওয়ার কথা। চিত্রকূট পাহাড়ের কথা শুনেছিলাম, কিন্তু হাফবেলায় চিত্রকূট অভিযান সম্ভব ছিল না। ট্রেনে এক মাড়োয়ারি ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। খাসা লোক। জেনেরেটরের ব্যবসা। সেই কাজেই সাতনা যাচ্ছেন। শ্রীরূপার সঙ্গে খাঁটি হিন্দিতে গপ্পো জমিয়ে দিলেন। মেয়ে জামাই কুয়েত না ইউএই কোথায় যেন থাকে। ছেলে আছে। ছেলের বৌ একটা ইংরেজি স্কুলে পড়ায়। পুত্রবধুর চাকরি করাটাকে তিনি বেশ সহজভাবেই মেনে নিয়েছেন। নিজের স্ত্রীকে বলেছেন "ও যদি সংসারের কাজ গুছিয়ে চাকরি করতে পারে তোমার অসুবিধে কি? তুমি ধর্মকর্ম নিয়ে থাকো।" আমাদের মিষ্টি অফার করলেন, "মারোয়াড়ি মিষ্টি টেস্ট করে দেখুন?" উনি একটু বাথরুমে যেতেই তন্ময় বলল "মিষ্টিটা ফেলে দে। রেলের নোটিশ দেখিসনি, অপরিচিত ব্যক্তির হাত থেকে খাবার খাবেন না?" আমি তো জাতপেটুক, তাই ওসব সতর্কবাণীতে কান দিলাম না। আর সৌম্য আপার বাঙ্কে চাদর চাপা দিয়ে নাক ডাকাচ্ছিল। মিষ্টি খেয়ে আবার উঠে নাক ডাকাতে লাগল। তো সেই মাড়োয়ারি ভদ্রলোক বলেছিলেন, "সাতনায় যখন নামছেন, মাইহারের সারদা মন্দির অবশ্যই দেখবেন। ভীষণ জাগ্রত।" ভক্তিভাব কারোরই প্রবল না হলেও শেষমেশ মাইহার যাওয়াই মনস্থ করলাম। একটা হোটেলে অতিকষ্টে "পিওর ভেজ থালি" খেয়ে এসে ট্যাক্সিস্ট্যান্ডে খোঁজ করে গণেশ প্রজাপতি নামে এক ছোকরা কে তন্ময়ের পছন্দ হল। সে ট্যাক্সি চালানোর পাশাপাশি একটা কলেজে বিটেক করছে। ঠিক হল মাইহার তো ঘুরিয়ে আনবেই, পরের দিন আমাদের খাজুরাহোতেও ছেড়ে আসবে। 



মাইহার সাতনা স্টেশন থেকে প্রায় ৪৫ কিমি দূরে। পৌঁছতে সন্ধ্যে হয়ে গেল। গাড়ী দাঁড়ালো পাহাড়ের নিচে। তারপর রোপওয়ে করে প্রায় ৫০০ মি উঁচু পাহাড়ের ওপর চড়া। দড়ির লাইন বেয়ে একটা বাক্সে চারজন উঠলাম। নিচের দিকে ক্রমশঃ ছোট হয়ে আসা শহর ও জঙ্গল দেখে বুক কেঁপে উঠল। বিশেষতঃ যখন বাক্সটা লোহার রেলিং দিয়ে দিক বদলাচ্ছিল, মনে হচ্ছিল এই বুঝি দড়ির বাঁধন ত্যাগ করে দেশলাই বাক্সটা খাদের পথে যাত্রা করে! যত ওপর দিকে উঠছি, নীচের শহর ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর হচ্ছে আর অন্ধকার গাঢ় হওয়ার সাথে সাথে তলায় বিন্দু বিন্দু আলোর ফুলকি জ্বলে উঠছে। রোপওয়ে আমাদের নিয়ে গেল পাহাড়ের একদম মাথায়, মন্দিরের সামনে। মন্দিরের মধ্যে একটা সরু রাস্তা দিয়ে লাইন দিতে হল সারদা ওরফে দুর্গা মা কে দেখার জন্য। দেখি সে লাইন আর নড়ছেই না। আমাদের কারোরই ভক্তিভাব নেই, পাহাড়ে চড়তেই এসেছিলাম, মাতাজিকে দর্শন দেবার বিশেষ আগ্রহ ছিল না। শ্রীরূপা বলল চলো ফিরে যাই। কিন্তু ফেরার রাস্তা বন্ধ, আমাদের পেছনে তখন প্রচুর লোক লাইন দিয়েছেন। একজন পুরোহিতকে সামনে পেয়ে বললাম আমার স্ত্রীর শরীরটা ভালো লাগছে না, ফিরে যাব। তিনি বললেন, মাতাজি কে দর্শন না করে ফেরা যাবে না। আরেকজন পুরোহিতকে ডেকে আমাদের দেখিয়ে কিছু বললেন, সম্ভবত আমরা যাতে পালাতে না পারি সেইদিকে নজর রাখতে বললেন। আরেকটু এগোতেই দেখলাম আরেকটা রাস্তা দিয়ে লোক পিলপিল করে লোক ঢুকছে। কপালে গেরুয়া ফেট্টি বাঁধা। হাতে লাঠি, মুখে উন্মত্ত স্লোগান, "মাতাজি কি জ্যেএএএ"। এরা সবাই হেঁটে পাহাড়ে উঠছে।  চোখে ভেসে উঠল টিভিতে দেখা কুম্ভমেলা বা মক্কায় তীর্থযাত্রীদের পদপিষ্ট হয়ে মৃত্যুর ছবি। মনে পড়ল মধ্যপ্রদেশ দীর্ঘদিনের বিজেপি শাসিত রাজ্য। প্রাণ নিয়ে বাঁচতে পারলে হয়! তন্ময় খেয়াল করল রোপওয়ের দিকে লাইন একটু হালকা হয়েছে। চারজন চটপট ঘুরে উল্টোদিকে দৌড় দিলাম। এক পুরুত বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলেও তাকে এড়িয়ে আমরা কোনরকমে গিয়ে রোপওয়েতে বসলাম। যে বিপদ থেকে পালিয়েছি, সেটার কথা ভেবেই বোধহয় ফেরার সময় রোপওয়ে নিয়ে কোন আর ভয় রইলনা। 

সেদিনটা ছিল দুর্গাপুজোর দশমী। ফেরার পথে কয়েকটা দুর্গাঠাকুর দেখলাম, ভাসানের জন্য বেরিয়েছে। লক্ষ্য করলাম এই দুর্গাঠাকুরের দুটো মাত্র হাত, সঙ্গে তাঁর ছেলেমেয়েরাও নেই। ডান হাতে ত্রিশূল থাকলেও বাঁহাত শঙ্কাহরণ করে না। "ললাটনেত্র আগুণবরণ" বটে কিন্তু "দুই নয়নে স্নেহের হাসি" নেই। বুঝলাম এই সারদা মাতাজি আমাদের গিরিকন্যা উমা নন। কার্তিক-গণেশ-লক্ষী-সরস্বতীর স্নেহময়ী মা-দুর্গা নন। ব্যোম ভোলানাথের দশভূজা পার্বতীও নন। বরের ওপর রাগ করে বাপের বাড়ি চলে আসার মানুষোচিত চপলতা তাঁর মানায় না। ছেলেমেয়েদের নিয়ে বিউটি পার্লারে যাওয়ার স্বাধীনতা তাঁর নেই। তিনি শুধু মহিষাসুরকে বধ করেন।

ফেরার সময় গণেশজি জানালেন মাতাজিকে দর্শন না করে পিঠ দেখিয়ে চলে আসলে মৃত্যু অনিবার্য। দুবছর হতে চলল, আমরা সবাই অক্ষতদেহে বেঁচে আছি। তবু গণেশজি যখন বলেছেন, মৃত্যু নিশ্চয়ই অবধারিত! তাই আর দেরি না করে সেদিনের অভিজ্ঞতার কথা লিখে ফেললাম। 

Monday 14 August 2017

মুক্তা কুমার, ছোট্ট পত্রিকা এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী

দিদা বেঁচে থাকলে আজ তাঁর বয়স হত একশো বছর। বাবার মা কে ঠাকুমা বলারই চল আছে। কেন জানি না আমি আর দাদা দুজনেই তাঁকে দিদা বলেই ডাকতাম। দাদু যখন মারা যান তখন আমার বয়স মেরেকেটে নয়। তাছাড়া শেষ কয়েকটা বছর তিনি ভীষণ অসুস্থ আর শয্যাশায়ী ছিলেন। কাজেই দাদুর স্মৃতি আমার কাছে খুব একটা নেই। কিন্তু ছোটবেলার অনেকটাই কেটেছে দিদার স্নেহচ্ছায়ায়। বাবা মা দুজনেই স্কুলে চাকরি করতেন। ফাইভ অবধি সকালের স্কুল করে এসে তো দিদার কাছেই থাকতাম। তখন মোড়ে মোড়ে মিষ্টির দোকান গজিয়ে ওঠেনি। দুপুর বেলায় রাস্তা থেকে হাঁক শোনা যেতঃ খাবাআআআর। আর শুনেই একদৌড়ে দরজার বাইরে। বৃদ্ধ ফেরিওয়ালা মাথার ঝাঁকা সামনের রোয়াকে নামাতেন আর তার মধ্যে থেকে বেরতো মেঠাই, সন্দেশ, গজা, নিমকি ... আরো কত কি। দিদা আঁচলের গিঁট খুলে পয়সা বের করার আগেই তার বেশ কয়েকটা চালান হয়ে যেত আমার মুখে। তখনো অবশ্য জানতাম না দিদা কতটা বড় মাপের মানুষ। তবে বাড়িতে লোকজনের আনাগোনা লেগেই থাকত। দূর দূরান্ত থেকে আত্মীয়স্বজনরা যেমন আসতেন তেমনি আসতেন এলাকার নানা মানুষ, দল ও মহিলা সমিতির কর্মীরা। আজও লোকে আমায় চেনে "দয়াল মাস্টার" আর "মুক্তাকাকিমার নাতি হিসেবেই"। 

দিদার জন্ম ১৯১৭ সালের ভাদ্রমাসে, বর্ধমানের একটা সম্পন্ন পরিবারে। তখন তাঁর নাম ছিল হরিমতী। দাদাদের থেকেই স্বদেশী হাওয়ায় প্রভাবিত হয়েছিলেন। মাত্র ১১ বছর বয়সে দয়াল কুমারের সঙ্গে বিয়ে হয়। "মুক্তা" নামটা দাদুই দিয়েছিলেন। তারপর, দিদার নিজেরই কথায়, দেশপ্রেমের আবেগকে শ্রেণিচেতনার আবেগে সেঁকে নেওয়া, দাদুর প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে নেমে, দ্রোহমূলক গান কবিতা লিখে রাজরোষে পড়ে প্রথমে ব্রিটিশ তারপর স্বাধীন ভারতের কারাগারে অন্তরীণ হওয়া। দিদার যুদ্ধ, দাঙ্গা, মহামারীর সময় মহিলা আত্মরক্ষা সমিতির মাধ্যমে ত্রাণ ও সেবাকার্য সংগঠিত করা। সুইজারল্যান্ডের লুসান শহরে বিশ্ব মাতৃ সন্মেলনে পশ্চিমবঙ্গের প্রতিনিধিত্ব করা। আর এসবের সঙ্গেই প্রবল অনটনের মধ্যে দশ ছেলেমেয়েকে মানুষ করে তোলা।

তখন সম্ভবতঃ ফাইভে পড়ি। এক লোডশেডিং এর রাতে আমি আর দাদা হঠাৎ ঠিক করলাম একটা হাতে লেখা পত্রিকা বের করব। বাবা-কাকা-পিসি রা তাদের ছোটবেলায় বাড়ির সবার লেখা দিয়ে ঐরকম একটা হাতে লেখা পত্রিকা করেছিল। সেটা দেখেই হয়ত এমন ভাবনা। যেমন ভাবনা তেমন কাজ। পর পর পাঁচ মাস ধরে বেরলো সেই "ছোট্ট পত্রিকা"। প্রথম সংখ্যার কয়েকটা ফাঁকা পাতা রাখা হয়েছিল যাতে বড়রা মতামত জানাতে পারে। সেই পাতায় দিদা লিখেছিলেনঃ 
"এতদিন আমার মনের মাঝে যে বীজ বপন করা ছিল, তোমাদের উদ্যোগে ছোট্ট পত্রিকা প্রকাশনার মধ্যে অঙ্কুরিত হতে দেখে আশান্বিত হলাম। উত্তরোত্তর শাখাপ্রশাখা পল্লবিত হয়ে উঠুক। -- দিদা, ডিসেম্বর ১৯৯৬।"
পত্রিকার শেষ তথা শারদ সংখ্যায় স্বাধীনতার ৫০ বছর উপলক্ষে তিনি একটা ছোট্ট প্রবন্ধও লিখলেন। আরো বছর পাঁচেক পরে বন্ধুরা মিলে যখন "অভিযান" পত্রিকা বের করলাম তখনও তিনি খুব খুশি হয়েছিলেন। আমাকে বলেছিলেন, "তোকে সায়েন্স নিতে হবে না, তুই আর্টস নিয়ে পড়বি।" তাঁর কথা অবশ্য রাখতে পারিনি। দিদার মৃত্যুর কয়েকমাস পরেই আমি মাধ্যমিক দিলাম। তারপর "অভিযান" পত্রিকার দ্বিতীয় সংখ্যায় স্বাধীনতার ৫০ বছরের সেই লেখাটা আবার ছাপা হল। একটা সুন্দর হেডপিস এঁকে দিয়েছিল সমদা (স্মিতধী গাঙ্গুলী)। স্বাধীনতার ৭০ বছর পূর্তির প্রাক্কালে সমদার হেডপিস সহ পুরো লেখাটাই দিয়ে দিলাম। 



শারীরিক অসুস্থতার কারণে বেশ কিছুদিন কলকাতার কসবায় ছোট ছেলের চিকিৎসাধীনে ও তত্ত্বাবধানে ছিলাম। সেই সময়ের মধ্যেই অনুষ্ঠিত হয়ে গেল স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী। তখন শুয়ে শুয়ে সম্পূর্ণ বিশ্রামের মধ্যে অন্য কিছুই করতে পারতাম না। সময়মত ঝর্ণা রেডিওটা খুলে দিয়ে যেত, শুনতাম। গত একবছর ধরেই প্রচারমাধ্যমে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর নানা অনুষ্ঠানের কর্মসূচী শুনে আসছি। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উৎসবে কোন স্তরে কোন সাড়াই যেন পেলাম না - একমাত্র প্রচারমাধ্যমে কিছু কিছু শুনলাম। সমস্ত এলাকাটাই যেন নিস্তব্ধ। এই নিরিবিলি বিশ্রামের মাঝে পঞ্চাশ বছর আগের সেই প্রথম স্বাধীনতা দিবসের স্মৃতি মনকে আলোড়িত করে তুলতে লাগল। 

সেই দিনের প্রাক্কালে পাড়ায় এবং বাড়িতে সাড়া পড়ে গিয়েছিল। অজয় বলে একটি ছেলে বাড়ি থেকে চলে এসে আমাদের পরিবারের সঙ্গে প্রায় একাত্ম হয়ে গিয়েছিল। দয়াল কুমারের নির্দেশনায় ছোট বড় অশোক চক্রের ব্লক অজয় নিজেই তৈরী করেছিল। তারপর কয়েকদিন ধরে পতাকা সেলাই করতে লেগেছিল। ছোট-বড়, ছেলে-বুড়ো সবাই মিলে বাড়িতেও একটা উৎসব করার মতলব ভাঁজা হচ্ছে। সকলের ভাবনা এটাই যে, দীর্ঘদিনের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে সাম্রাজ্যবাদী শোষকদের হাত থেকে স্বাধীনতা উদ্ধার হবে ১৫ই আগষ্ট। সমস্ত ভারতবাসী খেতে পাবে, পড়তে পাবে, কাজ পাবে এই আশায় সর্বস্তরের ও সব বয়সেরই মানুষ যেন অজানা আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে উঠেছিল। সারা রাত্তির ধরে পতাকা তৈরী হয়েছে, বাড়ির সবাই যোগান দিয়েছে। ভোরবেলাতেই ছনি পরিমল এদের নেতৃত্বে জাতীয় সঙ্গীতের প্রভাতফেরি সারা অঞ্চলটাকে স্বাধীনতা দিবসের আনন্দে উদ্ভাসিত করে তুলল। ভোর হতেই ছোট ছোট পতাকা হাতে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা বেরিয়ে পড়ল এবং বড়রা পতাকা নিয়ে গেল বাড়িতে লাগাবে বলে। আমারও উৎসবের আনন্দে রান্নায় মন লাগছিল না। বারবার সদরে বেরিয়ে এসে কিশোর বাহিনী ও অন্যান্যদের উচ্ছাস ও আনন্দ দেখছিলাম। 

সেদিনের স্বাধীনতার আনন্দ ও আশা আর পঞ্চাশ বছর পর এই দিনটিতে মানুষের উচ্ছাস ও আবেগের আকাশ পাতাল তফাত। যে আশা নিয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামে যুক্ত হয়েছিলাম তার বেশীরভাগই আজ অসম্পূর্ণ, অপূর্ণ। আজ সমস্ত দিকে নির্লিপ্ততা ও শূন্যতার মাঝে মনের মধ্যেও শূন্যতা ও বিষাদ অনুভব করছি। আশা এই যে সমাজ ব্যবস্থার সততই পরিবর্তন হয়। আজ আমি বর্তমান ও আগামী প্রজন্মের কাছে এই প্রত্যয় রাখছি তারা সকলের জন্য খাদ্য, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষার সংগ্রাম করে যাবে এবং অদূর ভবিষ্যতে সকলের জন্য একটা সুখী সমাজ কাঠামো গড়ে তুলবে। 

সুবর্ণজয়ন্তীর শুভলগ্নে আমার জীবনসন্ধ্যার প্রাক্কালে এই আশা রাখছি। 
দশ সন্তানের সঙ্গে দিদা

Wednesday 9 August 2017

ভোটের গেরোয়

সমনটা যখন হাতে পেলাম একটু টেনশান যে হচ্ছিল তা অস্বীকার করব না, তবে নতুন একটা অভিজ্ঞতা হবে ভেবে উত্তেজনাও অনুভব করছিলাম। একবছর হল কলেজের চাকরিতে যোগ দিয়েছি। এর মধ্যেই সহকর্মীদের কাছে  ভোটের নানা গল্প আর সেইসঙ্গে প্রয়োজনীয় পরামর্শ মাথায় নোট করা হয়ে গেছে। ভোটের আগের দিন (যাকে পি-১ ডে বলা হয়) ব্যাগপত্তর গুছিয়ে ট্রেনে করে পাণ্ডুয়া স্টেশনে নামলাম। আরো অনেক ভোটকর্মীর দেখা পেলাম স্টেশনে। তাঁদের সঙ্গেই নির্বাচন কমিশনের বাসে উঠলাম। তারপর সোজা ডিসি অর্থাৎ ডিস্ট্রিবিউশান সেন্টার। বেশ বড় জায়গা। কিন্তু সূর্যের তেজ ক্রমেই বাড়ছে। প্লাস্টিকের গ্লাসে করে গ্লুকোজ মেশানো জল বিতরন করা হচ্ছিল। তাই এক গ্লাস পান করে কাউন্টারে গিয়ে দাঁড়ালাম। ইতিমধ্যে অন্য পোলিং অফিসাররাও এসে গেছেন। সবাই মিলে জিনিসপত্র সব মিলিয়ে নিলাম। ইভিএম টা ঠিক আছে কিনা পরীক্ষা করে নিলাম। এতদিন সিইউ/বিইউ বলতে বুঝতাম ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটি আর বর্ধমান ইউনিভার্সিটি। এবার জানলাম ঐ চারটি অক্ষর দিয়ে কন্ট্রোল ইউনিট আর ব্যালট ইউনিটকেও বোঝানো যেতে পারে! আরেকটা কাজ বাকি ছিল, তা হল একজন লাঠিধারী পুলিসকে ট্যাগ করা। সেজন্য পুলিসের ক্যাম্পে গিয়ে তো চক্ষু চড়কগাছ! অন্তত ১০০ প্রিসাইডিং অফিসার লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন। আর লাইন এগোচ্ছে কচ্ছপের গতিতে! এভাবে চললে তো বুথে পৌঁছতে রাত্তির হয়ে যাবে। সবার মনেই সেই আশঙ্কা। গরমের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চড়ছে মেজাজ! দু অক্ষর, চার অক্ষর বেরোতে শুরু করল। শেষে রিটার্নিং অফিসার এসে সবাইকে আশ্বস্ত করলেন, আপনারা বুথে চলে যান, পুলিস পাঠিয়ে দেওয়া হবে। অতএব আমাদের জন্য নির্ধারিত বাসে উঠলাম। আমাদের ডিউটি পড়েছে একটা আদিবাসী এলাকায়। আরো দুটো সংলগ্ন বুথের ভোটকর্মীদের নিয়ে বাস ছাড়ল। "জয় ভোটবাবার জয়" বলে রওয়ানা দিলাম।

পৌঁছলাম দিনের আলো থাকতেই। শাল গাছে ঘেরা পরিস্কার পরিচ্ছন্ন প্রাইমারি স্কুলটা দেখে চোখ জুড়িয়ে গেল। একটু ফ্রেশ হয়ে খাওয়াদাওয়া করেই মেঝেতে চাদর পেতে কাজে লেগে পড়লাম। শুধু ভোট নেওয়া নয়, প্রচুর ফর্ম ও কাগজপত্র পূরণ করার থাকে। আর প্রিসাইডিং অফিসার হিসেবে আমার সই সর্বত্র বাধ্যতামূলক। সবাই মিলে সে সব কাজ যতটা সম্ভব এগিয়ে রাখা গেল। এর মধ্যে দুজন গ্রামবাসী এসে হাজির, আমাদের সব কোন অসুবিধা হচ্ছে কিনা খোঁজ নিতে। পরিচয় জানতে বললেন তিনি আবদুল রহিম নবির পোলিং এজেন্ট। এখানে বলে রাখি পাণ্ডুয়া বিধানসভা কেন্দ্রে মূল প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন তৃণমূল কংগ্রেসের আবদুল রহিম নবি এবং সিপিএমের শেখ আমজাদ হোসেন। বিজেপির অশোক ভট্টাচার্য এবং আরো তিনটে ছোট দলের প্রার্থীরাও ছিলেন। এছাড়া ছিলেন একজন নির্দল, তাঁরও নাম শেখ আমজাদ হোসেন! তো এজেন্ট মশাইকে জানিয়ে দিলাম পরদিন যেন সকাল সকাল চলে আসেন। "কোন চিন্তা নেই স্যার, ছটার মধ্যে চলে আসব।" বলে বিদায় নিলেন এজেন্ট সাহেব।

রাতের খাওয়াটাও ভালো হয়েছিল। স্কুলের মিড ডে মিলের দায়িত্বপ্রাপ্ত স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মহিলারা মোটা চালের ভাত, আলুপোস্ত আর ডিমের ঝোল খাওয়ালেন। খাওয়াদাওয়া সেরে শোয়ার তোড়জোড় করছি এমন সময় আরেক বিপত্তি। বুথের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ান একটা কাগজ এনে হাজির, সই করে দিতে হবে। কাগজটা পড়ে তো পিলে চমকে উঠল। এ যে ফায়ারিং অর্ডার! বোঝ ঠ্যালা, কোথাকার এক ছাপোষা সহকারি অধ্যাপক, ইনসাসধারী ফেট্টিবাঁধা জওয়ান কি না তার কাছে গুলি চালানোর আনুমতি চাইছেন! ওঁদের যুক্তি গুণ্ডারা হামলা করলে তখন আর অনুমতি দেওয়ার সময় থাকবেনা, এমনকি অনুমতি দেওয়ার জন্য আমি জীবিত নাও থাকতে পারি, তাই আগেভাগেই এই ব্যবস্থা। শেষে সেক্টর অফিসারকে ফোন করলাম এবং তাঁর পরামর্শ মেনে ফায়ারিং অর্ডারে সই করলাম না। জওয়ান মশাই ক্ষুব্ধ হলেন এবং যাওয়ার আগে সতর্ক করে গেলেন, ভালোমন্দ কিছু হয়ে গেলে ওনারা দায়িত্ব নেবেন না! কি আর করা। দরজায় একটাই ছিটকিনি। সেটা এঁটে দিয়ে শুয়ে পড়লাম। 

পরের দিন আলো ফোটার আগেই ঘুম ভেঙে গেল। টিউবওয়েলে চান করে রেডি হয়ে নিলাম। ৬টা বাজতে না বাজতেই পোলিং এজেন্টরা উপস্থিত। প্রথমেই গতকালের মক্কেল। তাঁর হাতের কাগজটা নিয়ে দেখি সেটা নির্দল প্রার্থী শেখ আমজাদ হোসেনের এজেন্টের নিয়োগপত্র। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, 
"গতকাল যে বললেন আপনি রহিম নবির এজেন্ট? রাত পোহাতেই আমজাদ হোসেনের এজেন্ট হয়ে গেলেন?"
"হ্যাঁ স্যার, বদলে গেছে।" 
কি আর করা নিয়োগপত্র যখন এনেছেন ওনাকে আমজাদ হোসেনের এজেন্ট হিসেবে কাজ করতে দিতে বাধ্য আমি। পরে, রিলিভিং এজেন্টের হাতে দায়িত্ব দিয়ে বুথ ছাড়ার সময় তিনি আমার কাছে এসে রহস্যটা ফাঁস করে গেলেন। "আমরা স্যার টিএমসি করি, নির্দলের হয়ে কাজ করছি। দলটা ভারী করে নেওয়া, আর কি! ট্যাকটিক্স স্যার, বুঝলেন না?!" 

সব এজেন্টকে এনট্রি পাস ইস্যু করে মক পোল শুরু করতে যাব, এমন সময় আরেকজন হাজির। তিনি বিজেপি প্রার্থী অশোক ভট্টাচার্যের এজেন্ট। তাঁর নিয়োগপত্রটায় দেখি শুধু প্রার্থীর নির্বাচনী এজেন্টের সই ছাড়া বাকিটা ফাঁকা! কোথায় কি লিখতে হবে দেখিয়ে তাঁকে কাগজটা ফেরৎ দিলাম। তবু দেখি তিনি মাথা চুলকোচ্ছেন। বুঝলাম লেখা-পড়ার সঙ্গে তাঁর বিশেষ সম্পর্ক নেই। কিন্তু আমার হাত পা বাঁধা, প্রিসাইডিং অফিসার হয়ে একজন এজেন্টের ফর্ম ফিলআপ করে দিতে পারিনা। শেষে মুশকিল আসান হলেন সিপিএমের বয়স্ক এজেন্ট।
 "কি রে ভাই পারছিস না? আয় আমি লিখে দিচ্ছি।" 
"হ্যাঁ দাদা দেখো দিকি" হাতে চাঁদ পেয়ে ফর্মটা এগিয়ে দিলেন বিজেপির এজেন্ট। 
মক পোল শেষ করে ৭টায় ভোট চালু করতে গিয়ে দেখি বাইরে বিশাল লাইন। মহিলারাই সংখ্যায় বেশী। তারপর নির্বিঘ্নে, শান্তিপূর্ণভাবে ভোট হল। ১১টার মধ্যেই ৫০% ভোট পড়ে গেল। ভোট দেওয়ার জন্যে মানুষের এত উৎসাহ এখানে না এলে জানতেই পারতাম না। জানতে পারতাম না কোনরকম জল না মিশিয়েই ৮৪% ভোট হতে পারে। প্রায় অথর্ব বৃদ্ধ, বৃদ্ধা, চোখে দেখতে পান না এমন মানুষেরা ভোট দিতে চলে এসেছেন ছেলে, বৌমা বা নাতির হাত ধরে! ভাবছিলাম কারা বেশী সচেতন? এই অশিক্ষিত আদিবাসী মানুষগুলো না কি আমার শহুড়ে বন্ধুরা, যারা বলে "ধুসস ভোট দিয়ে কি হবে, এক দিন ছুটিতে মস্তি করি!" বেলা বাড়তে ভোটারদের লাইন ক্রমশ হালকা হল। আমরা একে একে খেয়ে এলাম। তেষ্টায় গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। সিপিএমের এজেন্ট জল আনতে গেলেন, তৃণমূলের এজেন্ট বললেন "চলো চাচা আমিও যাই।" বিজেপির এজেন্ট নিজের বোতলটা ধরিয়ে দিলেন, "এটা একটু ভরে আনিস তো।" আমি চেয়ারে বসে দরজার ফাঁক দিয়ে দেখলাম সেই দৃশ্য। তৃণমূলের এজেন্ট টিউবকলের হাতল টিপছেন আর সিপিএমের এজেন্ট জল ভরছেন। তাঁদের ব্যবধান, হ্যাঁ কয়েক ইঞ্চির বেশী হবে না!

নির্ধারিত সময়েই, সন্ধ্যা ৬টায় ভোট শেষ হল। ঘন্টা দুয়েক বাদে বাস এল। এবার মহামূল্যবান ইভিএম যন্ত্র নিয়ে ডাইনে বাঁয়ে সশস্ত্র জওয়ান পরিবিষ্ট হয়ে পৌঁছলাম আগের যায়গায় যা এখন বদলে গেছে আর সি অর্থাৎ রিসিভিং সেন্টারে। লাইন দিয়ে, গুঁতোগঁতি ও মারামারি করে দরকারি কাগজপত্র সমেত বাক্সবন্দী ইভিএম জমা দিয়ে অব্যাহতি পেলাম। তারপর শেষ ট্রেন ধরলাম ফেরার জন্য। 

প্রথম প্রকাশঃ Deconfined, August 2016

Friday 30 June 2017

Not in My Name

জুন ২০১৪, পুণে নরেন্দ্র মোদি তখতে বসার এক সপ্তাহের মধ্যে ২৪ বছরের তরুণ সফটওয়ার কর্মী মহসিন শেখ কে পিটিয়ে মারল হিন্দু রাষ্ট্র সেনা৷ "একটা উইকেট পড়ল" বলে উল্লাস শোনা গেল তাদের গলায়৷ মহসিনের অপরাধ, তিনি নাকি শিবাজি ও বাল থ্যাকারে কে নিয়ে "আপত্তিকর" পোস্টে লাইক দিয়েছিন৷ হত্যাকারীদের অধিকাংশই জামিনে মুক্ত৷ কারণ ভারতীয় আদালতের মতে তাঁরা ধর্মীয় প্রেরণায় হত্যাকাণ্ডটি ঘটিয়েছিলেন, ব্যক্তিগত স্বার্থে নয়৷

সেপ্টেম্বর ২০১৫, দাদরি স্থানীয় মন্দির থেকে ঘোষণা হল মহম্মদ আখলাকের ফ্রিজে গরুর মাংস আছে৷ উন্মত্ত জনতা বাড়ি থেকে টেনে বের করে খুন করল পঞ্চাশোর্ধ আখলাককে৷ খুনিদের গ্রেফতার না করার দাবীতে জোরদার আন্দোলন গড়ে তুলল বিজেপি৷ আখলাকের পরিবারের বিরুদ্ধে গোহত্যার মামলা দায়ের করল পুলিস৷ ফ্রিজে রাখা মাংস বিফ না মটন জানতে ফরেনসিক ল্যাবে পাঠানো হল৷ আর বছরখানেক বাদে খুনিদের একজনের মৃত্যু হলে তার গায়ে জাতীয় পতাকা জড়িয়ে শেষকৃত্য সম্পন্ন হল৷

এপ্রিল ২০১৭, আলোয়াড় রাজস্থানের হাট থেকে গবাদিপশু কিনে ফেরার পথে গোরক্ষকদের হাতে পড়লেন হরিয়ানার দরিদ্র কৃষক পেহলু খান এবং যথারীতি গোরু পাচারের ধুয়ো তুলে তাঁকে হত্যা করল গোরক্ষকরা৷ রাজস্থান সরকার গোরক্ষকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে পেহলুর পুত্রের বিরুদ্ধেই গোরু পাচারের কেস দিয়ে দিল৷

জুন ২০১৭, প্রতাপগড় স্বচ্ছ ভারত অভিযানের নামে বস্তির মহিলাদের মলত্যাগ করার ফটো তুলছিল মিউনিসিপ্যালিটির কর্মচারীরা৷ সিপিআই (এমএল) লিবারেশান কর্মী এবং রাজস্থানের নির্মাণকর্মী আন্দোলনের সংগঠক জাফর হোসেন প্রতিবাদ করলে "স্বচ্ছ ভারত অভিযান"এ বাধা দেওয়ার জন্য তাঁকে পিটিয়ে মারল পুরকর্মীরা৷

জুন ২০১৭, দিল্লী মথুরা ট্রেন৷ নাহ, ঈদের বাজার করে ঘরে ফেরার সময় জুনায়েদ খানকে মেরে ট্রেন থেকে ফেলে দেওয়ার জন্য আর ফেসবুক লাইক, গোরক্ষা বা স্বচ্ছ ভারতের মত কোন অজুহাতের প্রয়োজন হয়নি৷ টুপি, পায়জামা, পাঞ্জাবীতে প্রতীয়মান ১৫ বছরের যুবকের ধর্মীয় পরিচয়ই তার বেঁচে থাকার অধিকার হারানোর পক্ষে যথেষ্ট কারণ বলে বিবেচিত হয়েছিল সহযাত্রীদের কাছে৷

কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী, উনা থেকে গিরিডি - দেশজুড়ে আরো অজস্র ঘটনার কথা বলতে গেলে রাত কাবার হয়ে যাবে৷ চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে পরাজয়ে হতাশ দ্বেষভক্তরা উল্লসিত - "ওদের" একটার পর একটা উইকেট পড়ছে যে! হিন্দুধর্মের নামে এইসমস্ত হত্যাকাণ্ড সংগঠিত হলেও এসবের জন্য হিন্দুধর্মকে দায়ী করা ঠিক নয়৷ কোটি কোটি সাধারণ হিন্দু আরেসেস-বিজেপি চক্র কে সমর্থন করেন বলেও মনে হয় না৷ কিন্তু বেশী দেরী হওয়ার আগে সাধারণ ধার্মিক হিন্দুরা সোচ্চার হোন গো সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে৷ নাহলে চৈতন্য-রামকৃষ্ণদের সরিয়ে গোসন্ত্রাসীরাই হিন্দুধর্মের মুখ হয়ে উঠবেন৷

সংযোজনঃ আগষ্ট ২০১৬, উদুপি৷ গরু কিনে ফেরার পথে ২৯ বছরের ব্যবসায়ী প্রবীণ পুজারি নিহত হলেন "হিন্দু জাগরণ ভেদিকে" সংগঠনের কর্মীদের হাতে৷ ওরা বোধহয় জানত না প্রবীণ কর্ণাটকের কেনজুর গ্রামের বিজেপি সভাপতি ছিলেন৷ গোসন্ত্রাসবাদী দের হাত থেকে হিন্দুরাও রেহাই পাবে না৷ বিজেপি করলেও না৷


ওপরের লেখাটা ফেসবুকে পোস্ট করেছি ২৯শে জুন। তারপরও তালিকাটা বেড়েই চলেছে।

জুন ২০১৭, রামগড় বাজার থেকে মাংস কিনে গ্রামের বাড়িতে ফিরছিলেন ৫০ বছরের আসগড় আলি ওরফে আলিমুদ্দিন। পথের মধ্যে গাড়ি দাঁড় করিয়ে আলিমুদ্দিনকে টেনে নামিয়ে তাঁকে পিটিয়ে মেরে ফেলে, গাড়িটাও জ্বালিয়ে দেয়। ছুতো সেই একই - আলিমুদ্দিন না কি গাড়িতে করে গরুর মাংস নিয়ে যাচ্ছিলেন! অন্যান্য ঘটনার মত এক্ষেত্রেও ঝাড়খণ্ডের বিজেপি সরকারের পুলিস অপরাধীদের গ্রেফতার না করে গাড়িতে রাখা মাংসটা ফরেনসিক ল্যাবে পাঠিয়ে দিয়েছে।