Wednesday 26 April 2017

পাহাড়ের ডায়েরি (৩)

আমাদের সিকিম ট্যুরের প্রথম দুটো পর্ব আমি লিখেছি। তৃতীয় তথা গোর্খে পর্ব এবার বব, অনির্বান আর পল্লব -এর কলমে।


 বব বকানি 

ভার্সে থেকে হিলেতে নামাটা ছিল অনেকটা 'রেস এগেইনস্ট বৃষ্টি'।

আগেই থেকেই ঠিক ছিল যে সকাল সকাল উঠে আমরা ভার্সে থেকে হিলে নেমে দুই ভাগে ভাগ হয়ে যাবো। আমি, পল্লবদা আর অনির্বাণদা বেরিয়ে পড়বো ভোরেঙ এর রাস্তায়; আর অতনুদা আর শ্রীরূপা বৌদি যাবে ওখরেতে। সেই মতো সকালে উঠে পড়লাম, কিন্তু মেঘবৃষ্টির ভিতর দিয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘা কে দেখে সময় যে কোথা দিয়ে কেটে গেলো সে বোঝাই গেলো না। একটু একটু করে রাতের জমা মেঘ যেই না কেটে যেতে লাগলো, আমাদের চোখের সামনে ফুটে উঠতে লাগলো কাঞ্চনজঙ্ঘার অপরূপ সৌন্দর্য! সে দৃশ্য বর্ণনা করার মতো ভাষার দখল বা সাহস কোনোটাই আমার নেই। সূর্যের আলো পড়ার সাথে সাথে, রাতে হওয়া বৃষ্টিতে স্নান করা রডোডেনড্রন গাছগুলো তাদের লাল, গোলাপি, সাদা ও হরেক রকম রংবেরঙের ফুলের ডালি নিয়ে সেজে উঠলো |

কিন্তু কপাল মন্দ, যেই না সবে আমরা সেই অপরূপ দৃশ্য ক্যামেরাবন্দি করতে শুরু করেছি, অমনি নামলো বৃষ্টি। পাহাড়ে কখন যে ঝলমলে নীল আকাশ থাকবে আর কখন যে আকাশ কালো করে বৃষ্টি নামবে, সে খবর ভগবান ও রাখেন না। দূরের পাহাড়ে অল্প অল্প মেঘ আগেই জমতে দেখেছিলাম। হঠাৎ সেই মেঘ আমাদের কাছে এসে পৌঁছলো আর শুরু হলো বৃষ্টি!! আর সে কোনো হেলেফেলা করার মতো বৃষ্টি না, ছোট ছোট আকার এর শিল পড়তে শুরু করলো ! পড়িমরি করে আমরা সবাই ভার্সের কটেজের ভিতর ঢুকে এলাম। প্রবল হাওয়ার সাথে শিলাবৃষ্টি হওয়ার ফলে তাপমাত্রা আরো নিচে নামলো। বাকি সকলের মতো আমিও এই পরিবেশ উপভোগ করলেও ভিতরে ভিতরে আমি একটু অধৈর্য  হয়ে পড়ছিলাম বৃষ্টি থামার প্রতীক্ষায়।

যাহোক, সেই বৃষ্টির ভিতরেও লুচি ও আলুরদম সহযোগে পেটভরে জলখাবার খেয়ে নিলাম! ততক্ষনে বৃষ্টি অনেকটাই ধরে এসেছিলো তাই আর দেরি না করে নিজের নিজের ব্যাগ পিঠে নিয়ে এবারের মতো সুন্দরী ভার্সেকে বিদায় জানিয়ে বেরিয়ে পড়লাম হিলের উদ্দেশ্যে।  আগেই বলেছি, ভার্সে থেকে হিলেতে নামাটা ছিল অনেকটা 'রেস এগেইনস্ট বৃষ্টি', তাই ফের বৃষ্টি শুরু হবার আগেই পা চালিয়ে নামতে লাগলাম। পাহাড়ে চড়াই ওঠার থেকে নিচে নামাটা বরাবরই সোজা, শুধু রাস্তা বৃষ্টিতে ভিজে ছিল বলে সাবধানতা অবলম্বন করে যতটা সম্ভব তাড়াতাড়ি নামতে লাগলাম। এরই মাঝে হঠাৎ করে পথের মধ্যে মেঘ এসে এক আশ্চর্য মায়াবী পরিবেশের সৃষ্টি করলো। কিছু সামনে (খুউব বেশি হলে ১৫/২০ ফুট দূর) অতনুদা, শ্রীরূপা বৌদি এবং পল্লবদা কে আবছা আবছা দেখতে পাচ্ছিলাম। সে এক অসাধারণ পরিবেশের সৃষ্টি হলো। সামনে, পিছনে, ডান-বাঁ সব দিকেই উঁচু উঁচু পাইন, ওক গাছে ঘেরা জঙ্গল। তার ভিতর দিয়ে হেটে চলেছি আমরা কয়েকজন, মাঝে মাঝে গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে সূর্যের আলো এসে রাস্তার ওপর পরে এক মায়াবী আলোআঁধারী পরিবেশ তৈরী করেছিল। হঠাৎ করে যেন কোনো জাদুবলে সময় চার পাঁচশো বছর পিছিয়ে গিয়েছিলো। মন্ত্রমুগ্ধের মতো সেই রাস্তা দিয়ে হেঁটে কখন যে আবার হিলে পৌঁছে গেলাম সে খেয়াল ছিল না। একটানা প্রায় চার পাঁচ কিলোমিটার হাঁটার কোনো কষ্ট বোধ করিনি।

সবথেকে আগে আমি এসে ভার্সের রডোডেনড্রন স্যাংচুয়ারির গেটের বাইরের বেঞ্চে বসলাম। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই অনির্বাণদা, পল্লবদা আর শ্রীরূপা বৌদিকে নিয়ে অতনুদা এসে পড়লো। একটানা হাটাহাটি করে সকালের জলখাবারের লুচি আলুরদম কখন হজম হয়ে গেছে। বেশ খিদে খিদে লাগছিলো। আমাদের দলনেতা অনির্বাণদা ম্যাগির অর্ডার দিলো। এমন সময় হালকা বৃষ্টি শুরু হলো। ঠান্ডায় গরম গরম ম্যাগি খেতে লাগছিলো বেশ উপাদেয়, কিন্তু মোটে একবাটি ম্যাগিতে আমার সদা জাগ্রত খিদের বিশেষ কোনো উপশম হলো না। যাহোক কিছু একটা পেটে গেছে , তাই এবার ভোরেঙ যাবার তোড়জোড় শুরু করতে লাগলাম।




অনির বচন 


ভালো জিনিস, ভালো দিন, ভালো সময়গুলো যেন বড্ড তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে আসে। বিগত দু মাস ধরে যে দিনগুলোর জন্যে আমরা অপেক্ষায় ছিলাম তা প্রায় শেষের মুখে। দু 'দুটো দিন কাটিয়ে দিলাম একসাথে। আজ তৃতীয় দিন। পাঁচজনের বার্সে ঘোরা শেষ, গুরাস কুঞ্জের রডোডেনড্রন দেখা হয়ে গেছে, পাহাড়ের বৃষ্টি আর কনকনে ঠান্ডার সাথে পরিচয়টাও হয়ে গেছে। 

এখন ফেরার পালা ।

বার্সে থেকে হিলেতে ফিরে আমরা রিল্যাক্সড্ যে প্রথম ট্রেকিংরুট সবাই অ্যাকম্প্লিসড্ করেছি। আমি বাদে বাকিদের প্রথম ট্রেকিং তাই পূর্বঅভিজ্ঞতা থাকলেও আমিও টেনশনে ছিলাম। আপাতত আর কোনো চিন্তা নেই। সকালে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখে যখন বার্সে থেকে বেড়োলাম বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। গতরাত্রে যখন আমরা টেন্টে ছিলাম তখনও খুব বৃষ্টি হয়েছিল সঙ্গে তুমুল বজ্রপাত । বব তো রীতিমত এক্সাইটেড ছিল আর পলু তাঁর সেন্স অব হিউমর নিয়েই রাত কাটিয়ে দিল। যদিও পাহাড়ের উপর টেন্টে শুয়ে দূর্যোগপূর্ণ রাত কাটানো যে কি যারা কাটিয়েছেন তাঁরাই জানেন। প্রেমিকার মতন পাহাড়েরও মন বোঝা দায়, খামখেয়ালি কিন্তু বড়ই প্রিয়।

হিলেতে পৌঁছলাম এগারোটা নাগাদ । দিনটা পয়লা বৈশাখ । প্রচুর ট্যুরিস্ট, সবাই বার্সে যাবেন। ইতিমধ্যে দেখলাম বব কয়েকজন ভদ্রমহিলাকে বার্সে যাওয়ার জন্য খুব এনকারেজ্ করছে । শেষে ববের কথায় তাঁরা স্যাংচুয়ারীতে গেলেন যদিও ফিরে তারা ববকে আর খুঁজেছিল কিনা জানিনা। হিলে তেও ওয়েদার ক্লাউডি, চারদিক মেঘে ঢাকা। এবার আমরা দু'দলে ভাগ হয়ে গেলাম।দু 'দলের গন্থব্য আলাদা। অতনু শ্রীরূপা যাবে ওখরে, "সানবার্ড হোমস্টেতে" ওঁদের বুকিং আর আমরা মানে আমি, পল্লব আর বব যাব "ইডেন হোমস্টে", গোরখে ; আমাদের আরো একটু অ্যাডভেঞ্চার চাই ।সিকিমের একটা পাইনবনে ঘেরা গ্রাম "গোরখে" প্রথমে আমদের ট্যুর প্ল্যানে ছিলনা, Dipankar Majestic দীপঙ্করদাই বলল যেতে, এখন ভাবি না গেলে খুব মিস্ হত, থ্যাঙ্কস টু দীপঙ্করদা । সান্দাকফু ফালুট হয়ে শ্রীখোলা দিয়ে ফেরবার পথেই এই গোরখে। ট্রেকার্সরা এখান দিয়েই চলে যায় রিম্বিক অথবা রিব্দি।

শ্রীরূপা আবার বায়না ধরল সেও গোরখে যাবে তারপর অনেক বুঝিয়ে আমাদের পেয়ারের কাপল্ কে ওখরে পাঠিয়ে আমরা তিনজন চললাম ভরেঙ এর পথে। সঙ্গে রইল গাইড নিম দোরজি যার কিনা "দো সাদী"। এইরকম ওয়েদারে বব একটা হেইল্ স্টর্ম আশা করছিল আর পল্লব পড়েছিল গাইড নিম দোরজি আর রাজের পিছনে। পল্লব বরাবর একই রকম, সঙ্গে থাকলে দিব্যি সময় কেটে যায় হাসতে হাসতে।

গাড়িতে হিলে থেকে ভরেঙ যেতে লাগল চল্লিশ মিনিট মতন ,প্রায় ষোলো কিলোমিটার ডাউনহিল। গাড়ি থামলো ভরেঙএ যেখানে পাকা রাস্তা একদম শেষ আর পাহাড়ঘেরা বনের পথ শুরু। যাওয়ার রাস্তা প্রায় নেই বললেই চলে পুরোটাই ভাঙা মাটির আর পাথরের পথ । বব দারুণ খুশি, বলে উঠল, "গড্ লী প্লেস্!" সেই সঙ্গে পলু গান ধরল, "আমার এই ভাঙা পথের রাঙা ধূলায়" । শুরু হল আমাদের ট্রেক টু গোরখে । ।




পলুর পাঁচালি 


অনির্বান কুইজ মাস্টার হতে পারতো, কোনো রিয়ালিটি শো এর সঞ্চালক, কৌন বনেগা করোড়পতি টাইপ! আপনি যখন যাবেন কিনা নিশ্চিত নন, ও বলবে, খুব সহজ ব্যাপার, কোনো চাপ নেই, আরাম সে হয়ে যাবে। আপনি সেটা শুনে যেই একটা হ্যাঁ বাচক সিদ্ধান্ত নেবেন, ও শুরু করবে, "পথটা কিন্তু অন্য পথের থেকে আলাদা, ইনফ্যাক্ট সব জায়গায় পথ বলে কিছু নেই, যথেষ্ট বিপজ্জনক, আর দম ও লাগবে খুব, অনেকটা চড়া খাড়াই! আর নামার সময় তো আরো মুশকিল!" ঠিক এই খেলাটাই ও শুরু করে দিলো, গাড়িতে বসে। অতনু আর শ্রীরূপাকে সদ্য ছেড়ে এসেছি হিলে তে, ওরা ওখান থেকে যাবে ওখরে। আমরা আপাতত ভরেঙ, সেখান থেকে গোরখে ট্রেক শুরু হবে। বৃষ্টি পড়ছে এখনো, সাথে বরফকুচি। আমার পাশে বসে রাজ তামাং দিব্যি গাড়ি চালাচ্ছে এর মধ্যেই, মাঝেমধ্যে কাঁচটা মুছে নিচ্ছে আর টুকটাক ঠাট্টা করছে। বব নিবিষ্ট মনে বাইরের জগৎ দেখছে, আমিও দেখছি আর অনির কথা শুনে বাঁ হাঁটুতে হাত বোলাচ্ছি, জখমী কোমর আর বাঁ পা নিয়ে এসেছি, তার ওপর অনির রিভার্স ভোকাল টনিক!

দিব্যি গাড়ি চলছিল, হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল। বুঝলুম সময় আগত! সুবোধ বালকের মত নেমে পড়লুম তিন ভাই। কিছু বোঝার আগেই আমাদের গাইড নিম দরজি রাস্তার বাঁ পাশ দিয়ে নেমে গেল, আর যেখানে গেল, সেটাকে রাস্তা বলে আপনাদের বিভ্রান্ত করতে চাইনে। ক্ষেতের আলের চেয়ে আরেকটু সরু, অনেকটা উঁচুনিচু, কোথাও পাথুরে, কোথাও সেটুকুরও অস্তিত্ব নেই, এবং বৃষ্টির দরুণ পিছল! ডানপাশে পাহাড় উঠেছে খাঁড়া, বাঁ পাশে খাদ নেমে গেছে, মাঝখানে সামান্য পথের আভা ফুটে উঠেছে, আর তাতে তিন মূর্তি টলমল করে এগিয়ে চলেছি। আমাদের গাইডের গতি এই বৃষ্টিতেও লিওনেল মেসির মত স্বচ্ছন্দ, আর পেছনে আমরা তিনজন মোহনবাগানের রিজার্ভ বেঞ্চের প্লেয়ার! কিন্তু এর মধ্যেই কখন আপনার ভালো লাগতে শুরু করবে, নাম না জানা ফুল, কখনো দেখা দেওয়া, কখনো আড়াল থেকে ডাকা পাখি, মাঝেমধ্যে পা ভেজানো পাহাড়ি ঝোড়া আর গাছের ফাঁকে ফাঁকে দূরে উঁকি দেওয়া পাহাড়ের সারি। এসব দুচোখ দিয়ে গিলতে গিলতে ঢিমেতালে চলতে থাকলাম তিনজন। ঘন্টা দুয়েক চলার পর জলের শব্দ পাওয়া শুরু হল। জানা গেল ওটা রামাং নদী, এ নদী গোরখের মাঝ দিয়ে বয়ে গেছে। যতই এগোই, জলের শব্দ বাড়ে, আর আমাদের বুকের ভেতরটাও ছলাৎ ছলাৎ করতে থাকে। এ কোন আবিষ্কার নয়, নেহাৎই পথপ্রদর্শকের সাহায্যে কয়েক ঘন্টা হেঁটে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় পৌঁছনো। তবু এই জলের আওয়াজ অনুসরণ করে যাওয়ার মধ্যে একটা থ্রিল আছে, যারা গেছেন, তারা জানেন। কিংবা হয়তো প্রথমবার বলে আমাদের মধ্যে উত্তেজনা বেশি, তবু বেশ লাগছিলো, কতকাল আগে আমাদের পূর্বসূরিরা তো এমন করেই কত নতুন জনপদ খুঁজে বের করেছেন, আরো কত কষ্ট, কত সহিষ্ণুতা, কত সাহসিকতার মধ্য দিয়ে। তখন পথ অজানা ছিল, হিংস্র জন্তুর ভয় ছিল অনেক বেশী, পথ আরো দূর্গম ছিলো, তবু তারা থামেননি। ভাবলে শ্রদ্ধায় মাথা আপনা থেকেই নুয়ে আসে।

আরো কিছুটা যাওয়ার পর, একটা বাঁক ঘুরে খানিকটা চড়াই, আর সেই চড়াই বেয়ে উঠে আমাদের তিনজনেরই কথা বন্ধ হয়ে গেল। সামনে গোরখে! তখনো কিছু দূর, এক কিলোমিটার হবে, বা একটু বেশি। পেছনে নীল আকাশের চাঁদোয়া, পাইনের সারি, সামনে রামাং নদী, পাহাড়ের কোলে অপরূপ গোরখে। ববের ভাষায় এইচ ডি ওয়ালপেপার! আমার ভাষা নেই সে ছবি বর্ণনা করার, তবে রবি ঠাকুরের একটা গান মনে এসেছিলো, " এ দিন আজি কোন ঘরে গো খুলে দিল দ্বার, আজি প্রাতে সূর্য ওঠা সফল হল কার।" আমরা তিনজনেই জানি, সফল হয়েছিলো! 

কাঠের ব্রিজ পেরিয়ে আমরা তিনজন সিঙ্গালিলা ন্যাশনাল পার্কে ঢুকে পড়লুম। আমাদের গন্তব্য ইডেন লজ, একটা হোমস্টে। মালিক এক হাসিখুশি গোলগাল নেপালি দিদি, নাম, পেম ডিকি। ছোট্ট কাঠের কটেজ, ঠিক যেমনটি এই পাইন পাড়ায় মানায়! জানলার ওপারে পাহাড় আর নিচে তাকালে নদী, চমৎকার আশ্রয়। অত পরিশ্রমের পর খিদেটা নেহাত মন্দ পায়নি, একটু ফ্রেশ হয়ে নিয়ে খেতে গেলুম। ফাইন চালের ভাত, শাকভাজা, ডাল আর ডিমের ঝোল, এমন সুন্দর রান্না খুব কম জায়গাতেই খেয়েছি। আমি আর অনি চুনোপুঁটি হলেও বব খাবার টেবিলে বাংলাদেশের মান রাখলো, যে ছেলেটি খাবার সার্ভ করছিলো তার চোখে স্পষ্ট দেখলুম ভয় মেশানো সম্ভ্রম! একটু পরেই পাহাড়ি সন্ধ্যে নেমে এল। পাহাড়ের অন্ধকার জ্যালজ্যালে মশারির মত নয়, আঁধারের ঠাস বুনোট। পাহাড় আর জঙ্গলে না গেলে আকাশে যে এত তারা আছে বোঝাই যায় না! একটা বড় দল এসেছিলো, তারা ক্যাম্প ফায়ার করছিলো। একজনের হাতে গিটার, বেহিসাবী সুর পাক দিচ্ছিলো হিমেল হাওয়ায়। আমরা একটা চাতালে বসে ছিলাম। নিচে জলের শব্দ, সামনে প্রাচীন অন্ধকার। যে শহুরে শব্দমালায় আমরা অভ্যস্ত, এখানে তা মিশ খায়না। আমরা তিনজনই চুপ করে ছিলাম, বোধহয় সময়ও। কিন্তু সুরের একটা ধাক্কা আছে যেটা সহজে হৃদয়ে পৌঁছে যায়, অর্থমান শব্দের মত তাকে ভায়া মস্তিষ্ক আসতে হয়না! আশেপাশের গানের দোলা আমাদেরও দোলালো! আমাদের এই সঙ্গীতচর্চা শুরুর কিছুক্ষণের মধ্যেই সেই নেপালি ভাইটি এসে খাওয়ার ডাক দিলো, ওরা বোধহয় ভেবেছিলো আমরা খিদের জ্বালায় চেঁচামেচি করছি! সুরের দেবতা আমাদের ওপর উপুড়হস্ত কিনা! রাতের খাবারে চিকেন, বব প্রত্যাশাভঙ্গ করেনি, আমাদের ও, ওদের ও! খাবার পর আরো কিছুক্ষণ বাইরে দাঁড়িয়েছিলাম, কয়েকটা ট্রেকিং গ্রুপ এসেছে, তাদের সাথে টুকটাক গল্প হচ্ছিল। একজন এসেছেন সান্দাকফু, ফালুট হয়ে, যাবেন রিবদি। তিনি জানালেন রাতের খাওয়ার পর ছাং (স্থানীয় পানীয়, সম্ভবত যবের তৈরী) খাওয়া উচিত, সকালে পেট পরিষ্কার হয়ে যাবে। আমি আর অনি ঠিক ভরসা পেলুম না, কিন্তু বব যথার্থ ট্রেকার, "অচেনা কে ভয় কি আমার ওরে"! পেটভর্তি খাবার,রাতের বিছানাও যথেষ্ট আরামদায়ক ছিলো, ভার্সে থেকে হিলে, আবার ভরেঙ থেকে গোরখে একইদিনে হাঁটার ক্লান্তিও ছিলো, তবু ঘুমোতে দেরী হল। তিনবন্ধু এক জায়গায় হলে নরকগুলজার তো হবেই! আরেকটা কারণ হল জানলার বাইরে চাঁদের আলোয় ভাসতে থাকা পাহাড় আর পাইন বন। তাকে উপেক্ষা করে বিছানায় পপাত চ, মমার চ, হবেন এমন বেরসিক ক্ষণজন্মা! শেষটায় যখন ঘুমিয়ে পড়লাম, তখনো জানিনা কাল সকালে আমাদের জন্য নিম দরজি কি চমক তুলে রাখছেন...............




 অনির বচন  


আজ চতুর্থ দিন। ইডেন লজের জানালার কাঁচের শার্সি দিয়ে চকচকে রোদ্দুর এসে পড়েছে আমাদের বিছানায়। কোনো কোনো সকালের আলো মন ভালো করে দেয়, যেন মনে হয় কোথাও তো কোনো কিছুই হয়নি, কোথাও তো কিছুই হারায়নি, কোথাও তো কেউ চলে যায়নি ছেড়ে, কোথাও কোন সংকীর্ণতা নেই, মলিনতা নেই বরং দিব্যি একটা নতুন দিন অনন্ত আনন্দপথের দিকে আরো এক পা এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার অপেক্ষায়!

আমি একটু আগেই উঠেছি বাকি দুজন তখনো ঘুমোচ্ছে। আজ তেমন কোন কাজ নেই। প্ল্যান বলতে সকালে গ্রামটা একটু ঘুরে দেখা। পশ্চিমের দিকে যে রাস্তাটা শ্রীখোলার দিকে গেছে সেদিকটায় একটা পাইনবন আছে। ববের খুব ইচ্ছা ওঁর ব্রেক আপ সেলিব্রেশনটা সেখানেই হোক, সেলিব্রেশন বলতে চুপচাপ বসে থাকা আর কি! তারপর ব্যাক টু ভরেঙ, দেন ওখরে। অতনু শ্রীরূপা ওখানেই আছে সানবার্ডে। গতকালের পর থেকে ওদের সাথে যোগাযোগ নেই । গোরখেতে আমাদের কারোর মোবাইলের নেটওয়ার্ক নেই আর ববের ফোনের চার্জও শেষ। গতরাত্রে আমরা ফোনপিছু পঞ্চাশ টাকা খসিয়েছি চার্জ দিতে। পাহাড়ের বেশিরভাগ জায়গায় এটাই দস্তুর । তবে গোরখের পরিস্থিতি বার্সে বা হিলের তুলনায় ভালো। এখানেও সন্ধ্যা ছটা থেকে রাত দশটা অবধি আলো থাকে। জেনারেটরের আলো। এই ফেসিলিটি অবশ্য হোমস্টে গুলোতেই আছে, বাকি গ্রাম অন্ধকার।

রাতের দিকে আর বৃষ্টি হয়নি বরং চাঁদ উঠেছিল। আমাদের ঘরের ঠিক পিছন দিক থেকেই, যেখানে পাহাড় উঠে গেছে আকাশে। এইরকম ভাসিয়ে নেওয়া জোছ্না আমরা বহুকাল দেখিনি । আমি এইরকম চাঁদের আলো দেখেছিলাম জয়ন্তী রিভারবেডে। সেবারেও সাথে ছিল দীপঙ্করদা। দূরে বনের থেকে ভেসে এসেছিল ময়ূরের ডাক... সে এক অন্য অনুভূতি ! আমরা অনেক রাত অবধি জেগেছিলাম। কথা হল... কথা হল তাঁদের নিয়ে যাঁরা হয়ত কোনোদিনই আমাদের জীবনে দিনের আলোর মতন স্পষ্ট হবেনা অথচ এই চাঁদের আলোর মতই আবছায়া বিষন্নতায় ভরিয়ে রাখবে সারাজীবন। এ জোছ্না বিষন্নতার জোছ্না, এ জোছ্না "গৃহত্যাগী জোছ্না"।

বব আর পলু উঠল সাড়ে সাতটায়। চা জুড়িয়ে জল হয়ে গিয়েছিল। গতকাল আমাদের গোরখে পৌঁছে দিয়ে নিম দোরজি ভরেঙএ ফিরে গেছে; জানিনা কোন বিবির কাছে। পলু বলে দিয়েছে সকাল আটটার মধ্যে যেন সে গোরখে চলে আসে। তাই ঘুম থেকে উঠেই আমরা রেডি। পেমদিকি দিদিও ব্রেকফাস্ট দিয়ে দিয়েছে সব্জি পুরি আর ডিম ভাজা। দেখলাম অন্যান্য টিমগুলোও ব্রেকফাস্ট সেরে নিচ্ছে। তাঁরা যাবে রিব্দি আর আমরা ফিরব ভরেঙ একই পথে। পাইনবনের ভিতর দিয়ে শ্রীখোলার দিকে কিছুটা ঘুরে এলাম দুজনে, ববকে পাইনের বনে কিছুক্ষণ একলা রেখে। পাইনের বিশেষত্ব হল এর উচ্চতা অদ্ভুত এক প্রাগৈতিহাসিক পরিবেশ তৈরী করে ।

নিম দোরজির আসার কথা ছিল আটটায়। পলু পইপই করে বলে দিয়েছিল "দের মত করনা" অথচ দশটা অবধি নিমের দেখা নেই। আমরা বুঝলাম আমাদের ডুবিয়েছে নিম দোরজি, সে আর আসবেনা। পলু কিছুক্ষন নিম দোরজির নামগান করল , অতঃপর ঠিক হল তিনজনেই ফিরব। পলু ভরসা দিল যে সে রাস্তা চিনে গিয়েছে। যদিও চিন্তার বিষয় ছিল কারন গতকাল যখন আমরা আসছিলাম তখন দেখেছিলাম লোকাল ফরেস্টগার্ডরা একদল ট্রেকার্সকে উদ্ধার করে নিয়ে এসেছে তাঁরা নাকি হারিয়ে গিয়ে একরাত ফরেস্টেই কাটিয়েছে। যাই হোক, আমরা তিনজনেই বেরিয়ে পড়লাম। চেকপোস্টে তিনশ টাকা এন্ট্রীফিস্ দিতে হল। এটা আসলে গতকালই দেওয়ার কথা ছিল। সেখান থেকে একজনকে পাওয়া গেল যে কিনা ভরেঙএ যাবে নিজের কাজে। দুশোটাকায় রাজি হল সে আমাদের সাথে যেতে। আমরা আমাদের হোস্ট আর সুন্দরী গোরখেকে বিদায় জানিয়ে হাঁটা শুরু করলাম।

যুধিষ্ঠিরকে মহাপ্রস্থানের পথ দেখিয়ে নিয়ে গিয়েছিল সরমা। একটি কুকুর। ট্রেকার্সদের এই সারমেরসঙ্গের এক্সপেরিয়েন্স থাকেই। আমারও ছিল। প্রত্যেকবারই কোনো না কোনো কুকুর আমাদের চলার পথের সঙ্গী হয়েছে , এবারেও সে নিয়মের ব্যতিক্রম হলনা। হয়তো মহাভারতের নিয়মবাদ। ফেরাটা চড়াই-উৎরাই-ওয়ালা তবে বেশিটাই ওঠা। টার্গেট বারোটার মধ্যে ভরেঙ পৌঁছানো। গাড়ি থাকবে। বেরোবার আগে পেমদিকির রান্নাঘরের জানলার একদম এক কোনা থেকে অতনুকে কল্ করে দিয়েছি যে যদি আমরা তিনটের মধ্যে ওখরে না পৌঁছাই যেন খোঁজ করে কারন তখনো অবধি আমরা ফেরবার গাইড পাইনি। আমরা আস্তে আস্তে ফিরতে লাগলাম আর রামাং এর জলের আওয়াজ কমতে লাগল। কিছুদূর গিয়ে আমরা দেখে নিচ্ছিলাম নীচের পাহাড়ী ভ্যালিগুলোকে। পাহাড়ের এই বিশালতার সামনে নিজেদের তুচ্ছ মনে হয়। পাহাড়ের সামনে এলে মাথা নীচু হয়ে যায় আর সমুদ্রের সামনে দাড়ালে উদারতা আসে।

ঠিক বারোটাতেই আমরা ভরেঙএ পৌঁছলাম । বব মশালা ম্যাগি আর আমরা চা খেলাম। তারপর একটা অল্টো ছিল তাতে তিনজনে চড়ে বসলাম। গন্থব্য ওখরে। পাহাড়ের পাকদন্ডী বেয়ে গাড়ি নামতে থাকল। মিনিট খানেকের মধ্যে একটা পাহাড়ী বাঁক নিতেই চোখে পড়ল সাজানো সবুজ রঙের সানবার্ড হোমস্টে।আজকের দিনটাই হাতে। পলু বলে উঠল," সবটা দেখে নিতে হবে আজই, বিশেষ করে ওখরে মনেস্ট্রীটা যেটা দেখতে কিনা আবার তিনশ সিঁড়ি চড়তে হবে"। গাড়ি এগিয়ে এসে থামল হোমস্টের সামনে। দেখলাম হোমস্টের মালিক পেমা সিরিং আর অতনু দাঁড়িয়ে হাত নাড়ছে আর শ্রীরূপার কোলে আপেলের মত লাল ফুটফুটে একটা মেয়ে, আমাদের দেখে হেসে উঠল ।  


আগের পর্বগুলোর লিঙ্কঃ

পাহাড়ের ডায়েরি (২)


ছবির মত গ্রাম গোরখে। অনির্বানের তুলি তে।


Friday 21 April 2017

পাহাড়ের ডায়েরি (২)

চোখে আলো এসে পড়তেই ঘুম ভেঙে গেল। বাইরে বেরিয়ে এলাম। দূরে পাহাড়ের মাঝ দিয়ে উঠে আসছে সূযযিমামা। আকাশে হালকা মেঘ রয়েছে। ঠাণ্ডা ভালোই, কিন্তু পাতলা রোদ আবহাওয়াটাকে আরামদায়ক করে দিয়েছে। আর্মি ক্যাম্পের জওয়ানরা প্রাতঃকালীন শরীরচর্চায় ব্যস্ত। দুজন দেখলাম জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এলেন কাঁধে কাঠকুটো নিয়ে। এখানে রান্নাবান্না চলে কাঠের উনুনেই। পাশেই একটা একটু বড় তাঁবু থেকে মাঝে মাঝেই মেয়েলি গলায় হিন্দি গানের কলি ভেসে আসছিল। ওখানেই বোধহয় রান্নার কাজ চলছে। ট্রেকার্স হাটের হোস্টরা তাঁদের কাজকর্ম শুরু করে দিয়েছেন। একে একে দলের অন্যরাও উঠে পড়েছে। ম্যাগি আর চা দিয়ে ব্রেকফাস্ট সেরে রেডি হয়ে নিলাম। আমাদের গাইড নিম দরজিও এসে গেছেন। সবার জন্য বাঁশের লাঠিও তৈরী হয়ে গেল। এবার শুরু হবে ট্রেকিং।
লাল রডোডেনড্রন।
সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে হিলের উচ্চতা ৯০০০ ফুট আর ভার্সের ১০০০০ ফুট। অর্থাৎ হিলে থেকে ভার্সে এক হাজার ফুট উঁচুতে।
প্রকৃতির ক্যানভাস।
 আর জঙ্গলের মধ্য দিয়ে পায়ে চলা পথে দুরত্ব সাড়ে চার কিলোমিটার। ক্যালকুলেটার খুলে বসলে সহজেই বের করে ফেলতে পারবেন এই পথের গড় নতি কত। তবে করে লাভ নেই। কারণ Welcome to Barsey Rhododendron Sanctuary লেখা গেট দিয়ে ঢুকলে ঐসব অঙ্ক মাথা থেকে বেরিয়ে যাবে। একদিকে উঠে গেছে পাহাড়, অন্যদিকে নেমে গেছে খাদ। দুধারে পাইন, বাঁশের আর কত নাম না জানা গাছের বন। পাহাড়ের গা বেয়ে ছোটো ছোট ঝোরা নেমে এসেছে। পাতা খসে যাওয়া বাদামি পাইন গাছ, হলদে সবুজে মেশানো বাঁশঝাড়, পাথরের গায়ে  গজিয়ে ওঠা ফার্ণ জাতীয় উদ্ভিদের সবুজ পাতা, নানা রঙের বুনো ফুল আর পাতার ফাঁক দিয়ে গলে আসা সূর্যের রশ্মি - সব মিলিয়ে একটা অপরূপ ক্যানভাস প্রকৃতি সাজিয়ে রেখেছে পদযাত্রীদের জন্য। যত ওপরে ওঠা যাচ্ছে ততই সেই ক্যানভাসে ফুটে উঠছে থরে থরে সাজানো রডোডেনড্রন। তাদের রঙ কখনো  টকটকে লাল, কখনো গোলাপি, কখনো ফ্যাকাশে লাল আবার কখনো বা ধপধপে সাদা। কোথাও কোথাও জঙ্গল একটু পাতলা, একধারে খাদের বদলে বিস্তীর্ণ ঘাসের উপত্যকা। তার মধ্যে রডোডেনড্রনের গুচ্ছ, পেছনে পাহড়ের সারি। পথের ধারে ধারে বন দফতরের সাইনবোর্ড জানাচ্ছে এই অরণ্য হিমালয়ান রেড পাণ্ডাদের আবাসস্থল। বাঁশপাতা ভোজী এই লাজুক বেড়ালটা পৃথিবীর বিপন্ন প্রাণীদের তালিকায় অন্যতম। এছাড়া আছে জায়েন্ট স্কুইরেল বা উড়ুক্কু কাঠবেড়ালি।  


গোলাপি রডোডেনড্রন।
আমাদের মধ্যে অনির্বাণ ট্রেকিং এ অভিজ্ঞ, আর ববের ফিটনেস, এনথু দুটোই অপরিসীম। ওরা এগিয়ে যাচ্ছিল লাফিয়ে লাফিয়ে। আমি আর শ্রীরূপা যাচ্ছিলাম থামতে থামতে, ছবি তুলতে তুলতে। পল্লবও আমাদের সঙ্গেই যাচ্ছিল।
যত উঁচুতে উঠছি তত ফুলের সংখ্যা বাড়ছে।
আর নিম দরজি তো একটা পা গলানো চটি আর হাতকাটা জ্যাকেট পরে, কাঁধে দুটো কম্বল নিয়ে হাঁটছিলেন। রাস্তার বাঁকে বাঁকে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন।রাস্তায় প্রচুর লোক ট্রেক করছিল আমাদের আগে-পরে, বুঝলাম ভার্সে হিলের মত জনমানবশূণ্য হবে না। দমদম থেকে এক বাঙালী ভদ্রলোক স্ত্রী ও শ্যালক কে নিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি আগে অনেক ট্রেক করেছেন। আমাদের বললেন, ''আপনাদের তো পাক্কা ট্রেকার মনে হচ্ছে!" আমরা তো শুনে হাঁ! এটা আমাদের প্রথম ট্রেক শুনে অবাক হলেন। "আসলে যারা নতুন ট্রেক করে তারা তড়বড় করে এগিয়ে যায়। আর পাকা ট্রেকাররা সময় নিয়ে চারপাশ টা দেখতে দেখতে যায়!" চড়াই উৎরাই থাকলেও এমনিতে রাস্তাটা কঠিন কিছু নয়। দশ বছরের বাচ্ছা থেকে ষাট বছরের বৃদ্ধ সকলেই যেতে পারবেন - যদি শরীর সুস্থ থাকে, শ্বাসকষ্টর সমস্যা না থাকে। স্থানীয় মানুষের কাছে তো এগুলো কোন ব্যাপারই নয়। নিম দরজি বললেন এই রাস্তাটা হাঁটতে ওনার একঘন্টা লাগবে। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে একটা শর্টকাট রুট দেখালেন, যেটা দিয়ে চটপট সোমবেরিয়া যাওয়া যায়। সোমবেরিয়া এ অঞ্চলের নিকটবর্তী গঞ্জ টাইপের জায়গা। আমরা যেতে পারব কি না জিজ্ঞেস করতে হেসে মাথা নাড়লেন। তবে এখানে চিতাবাঘ আছে। তাই রাতের দিকে একা কেউ চলাফেরা করে না। 


সাদা রডোড্রেনড্রন।
আমরা যখন পাহাড়ের মাথায় পৌছলাম তখন বারোটা বেজে গেছে। রাতে আমাদের মাথা গোঁজার জায়গা হল "গুরস কুঞ্জ"এ। তবে ঘরে নয় তাঁবুতে থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। "গুরস" রডোডেনড্রনের নেপালি প্রতিশব্দ। নেপালি সংস্কৃতিতে রডোডেনড্রনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। নেপালের জাতীয় ফুল যেমন রডোডেনড্রন, ভারতের সিকিম রাজ্যের প্রাদেশিক বৃক্ষও তেমনি রডোডেনড্রন। আগেই বলেছি রডোদেনড্রন নানা রঙের হয়। এর হাজারের কাছাকাছি প্রজাতি আছে। এশিয়া, ইউরোপ, উত্তর আমেরিকার নানা জায়গায় পাওয়া গেলেও প্রজাতির বৈচিত্র্য সবচেয়ে বেশী হিমালয় পর্বতমালা অঞ্চলে। বিভিন্ন প্রজাতির আলাদা আলাদা নেপালি নাম আছে কি না জানিনা। তবে সাদা সাদা রডোডেনড্রনের নেপালি নাম শুনলাম "চিমল"। ফুলের শোভা মন ভরে দেখতে গেলে পাহাড়ের ওপর উঠতেই হবে। রডোডেনড্রন ছাড়াও নাম না জানা নানা রঙের ফুলের মাঝে এই লজটির "গুরস কুঞ্জ" নাম তাই এক্কেবারে সার্থক। 

নাম না জানা ফুল।
সে দিনটা গুডফ্রাইডের ছুটি ছিল। তাছাড়া আকাশ একদম পরিস্কার। প্রচুর লোক ঘুরতে এসেছেন। বাঙালী যেমন আছে তেমনি সিকিমের স্থানীয় মানুষও আছে। এনাদের বেশীরভাগই দিনের বেলাটা কাটিয়ে নেমে যাবেন, বাকিরা এখানেই রাত্রিবাস করবেন। একজন দক্ষিণ ভারতীয় হাতে বিশাল লম্বা একটা ক্যামেরা নিয়ে ঘুরছিলেন। পল্লব বলল উনি পক্ষীবিদ। এত লোকের কলরবে পাখি পাওয়া যাবে না বুঝে তিনি জঙ্গলের দিকে চলে গেলেন। মোটা চালের ভাত, বরবটির তরকারি আর ডিমের ঝোল দিয়ে লাঞ্চ সেরে সামনের খোলা জায়গায় ঘাসের ওপর এলিয়ে পরলাম। ঠাণ্ডার মধ্যে রোদ পোহানোর মজা আর কিছুতে নেই। একদল স্থানীয় ছেলেমেয়ে নেপালি গান বাজিয়ে নাচছে, এক বৃদ্ধও যোগ দিয়েছেন তাদের সঙ্গে। বাঙালী ট্যুরিস্টরা কেউ ক্যামেরা নিয়ে ঘুরছে, কেউ দল পাকিয়ে গুলতানি মারছে। এক সদ্যবিবাহিত দম্পতি নিজেরাই তাঁবু খাটানো শুরু করে দিয়েছে। অনির্বাণ পরে আছে গুরস কুঞ্জের ম্যানেজার পাসাং শেরপার পেছনে। আমাদের তাঁবুগুলোও এইবেলা খাটিয়ে নিতে হবে।
কোথাও কোথাও জঙ্গল একটু পাতলা, একধারে খাদের বদলে বিস্তীর্ণ ঘাসের উপত্যকা। তার মধ্যে রডোডেনড্রনের গুচ্ছ, পেছনে পাহড়ের সারি।
পাসাংএর বাড়ি নেপাল সীমান্তের কাছে বস্তিতে। তিনি কলকাতায় এসে হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্টের কোর্স করে গেছেন। বললেন, "হাওড়া স্টেশনে নেমে তো 'যাত্রীগণ কৃপেয়া ধ্যান দে' আর 'for your kind attenstion please' শুনে তো কান ঝালাপালা হওয়ার জোগাড়! আর কত লোক, বাপরে!!" গুরস কুঞ্জে তাঁর অতিথিও অবশ্য কম নয়। তাদের একেক জনের একেক রকম চাহিদা সামলাতে গিয়ে নাজেহাল হচ্ছিলেন। শেষে বলেই বসলেন, "আপনাদের সমতলের লোকেদের সবাইকে তো একই রকম দেখতে, তাই গুলিয়ে ফেলছি!" আমরা যে উত্তরপূর্ব ভারতের মানুষদের চীনেদের মত দেখতে বলি এটা কি তারই পালটা ভাষ্য? জিজ্ঞাসা করা হল না। বিকেলের আগেই তাঁবু রেডি হয়ে গেল। আমদের দুজনের জন্য একটা ছোট্ট তাঁবু খাটানো হল গুরস কুঞ্জের চত্বরে। ওদের তিনজনের তাঁবুটা একটু বড়। পাসাংজি সেটা খাটিয়ে দিয়ে এলেন চত্বরের বাইরে বন দফতরের এলাকায়।

সূর্য ডুবতেই ঠাণ্ডাটা জাঁকিয়ে বসল। সঙ্গে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি। হাতে গ্লাভস, পায়ে মোজা, তবু হাত পা যেন অসাড় হয়ে যাচ্ছে। শ্রীরূপা দুটো সোয়েটারের ওপর অনির্বাণের একটা কম্বল চাপিয়ে বসল। সবচেয়ে ছড়িয়েছে পল্লব।
এই ফুলটার নাম স্নেক লিলি। পাসাং দেখালেন,
একটা রডোডেনড্রন গাছের তলায় ফুটে ছিল।
একেবারে ফণা তোলা সাপের মত দেখতে।
একটা ফিনফিনে পাঞ্জাবী পরে সে পাহাড়ে পয়লা বৈশাখ উদযাপন করতে এসেছে। ব্যাগে নিয়েছে একটা সোয়েটার আর একটা মাফলার। শেষে অনির্বাণের একটা জ্যাকেট আর আমার একটা হনুমান টুপি পড়ে সামাল দিল। যারা ছিলাম সবাই গুরস কুঞ্জের বড় ডাইনিং হলে এসে আশ্রয় নিলাম। এখানে ইলেকট্রিসিটির কোন গল্প নেই। কেবল সূর্যাস্তের পর থেকে রাতের খাওয়াদাওয়া হওয়া পর্যন্ত ঘন্টা তিনেকের জন্য জেনারেটর চালানো হয়। এদিকে মোবাইলের চার্জ শেষ হয়ে এসেছে। টর্চও বিগড়ে গেছে। রাত্রে কি হবে ভেবে হাড় হিম হয়ে যাচ্ছিল। এমন সময় এক বাঙালী ভদ্রমহিলা খবর দিলেন জেনারেটর থেকেই মোবাইল চার্জের ব্যবস্থা হবে। শুনে অনির্বাণ বলল "যাই ব্যাগ থেকে চার্জারগুলো নিয়ে আসি।" গেলো বটে, কিন্তু ফিরে এলো চার্জার ছাড়াই, "বব, টেন্টের মধ্যে তো ব্যাগ ট্যাগ কিচ্ছু নেই!" আসার আগের দিন অনির্বাণকে ছোট্ট করে একটু বোকা বানানো হয়েছিল। প্রথমে ভেবেছিলাম সেটারই শোধ তুলছে হয়ত। তারপর বুঝলাম না, ব্যাপারটা সিরিয়াস। গুরস কুঞ্জে হুলুস্থুল পড়ে গেল। সবাই টর্চফর্চ যা আছে হাতে নিয়ে ছুটল। এরকম ঘটনা নাকি এখানে কোনদিন ঘটেনি! তাঁবুর ভেতর আলো ফেলে দেখা গেল পরিপাটি করে বিছানা পাতা কিন্তু ব্যাগপত্র হাওয়া। হঠাৎ পল্লব বলল, "আচ্ছা আমরা তো বিছানা পেতে যাইনি?" কি কাণ্ড! চোর শুধু ব্যাগ চুরি করে বিছানা পেতে দিয়ে গেছে - এমন ঘটনা ভার্সে কেন, ভূভারতে কোনদিন ঘটেছে বলে মনে হয়না। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে আছি এমন সময় "ইয়ে আপকা সামান হ্যায় না? মিসটেক হো গিয়া" বলে সাদা জ্যাকেট পরা একজন এসে ব্যাগগুলো তাঁবুর মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে বেরিয়ে গেলেন। জানা গেল তিনি পুসাই, কোন ট্যুরিস্ট পার্টি তাদের মালপত্র তাঁবু থেকে নিয়ে আসতে বলেছিল। উনি অন্ধকারে তাঁবু চিনতে না পেরে আমাদের ব্যাগগুলোই উঠিয়ে নিয়েছিলেন! আমাদের সবাইকে নিজের কার্ডও দিয়ে দিলেন তিনি।
পাসাং শেরপার সঙ্গে।
এদিকে গুরস কুঞ্জে আরেক ক্যাচাল শুরু হল। সেদিনটায় হঠাৎ করে অনেক লোক চলে আসায় লজের কর্মীরা বিপদে পড়ে গেলেন। অতজনকে খাওয়ানোর রসদ তাঁদের ছিল না। আর এটা কোন শহর নয় যে টাকা ফেললেই দোকান থেকে খাবারদাবার কিনে আনা যাবে! কোনরকমে তিনটে মুরগী জোগাড় করা গেল। ভাত, ডাল আর ছোট ছোট দুটো টুকরো সমেত মাংসের ঝোল দিয়ে ডিনার সারলেন ৬৫ জন ট্যুরিষ্ট। কিন্তু এখানেও শেষ হয়নি। তাঁবুতে ঢুকে পড়ার পর একটা হল্লা শুনলাম। আরো দশ বারো জনের একটা দল ঐ রাত্তিরে এসে হাজির। তাঁদের আগে থেকেই বুকিং ছিল। খাবারের জোগাড় নেই কেন এই নিয়ে প্রবল তর্কাতর্কি। মালদা থেকে একটা বড় গ্রুপের সঙ্গে এসেছিলেন ফাল্গুনিদা। শেষে তিনিই ব্যাপারটা সামলালেন। মাংস না থাকলেও ডিম ছিলো। আবার উনুন জ্বেলে ডিমের ঝোল রান্না হল। তাই দিয়ে ভাত খেলেন নিশিকুটুম্বরা। 
আড্ডা @ গুরস কুঞ্জ।
আমি ভার্সে বলছি বটে কিন্তু সঠিক উচ্চারণটা হবে বার্সে (Barsey)। বর্ষা থেকেই এই নাম। তাই বার্সেতে এলে বর্ষা না পেলে কিছু একটা বাকি থেকে যেত! রাতে প্রবল ঝড়বৃষ্টি হল, বজ্রবিদ্যুৎ সহ। সকালের আবহাওয়া আগেরদিনের চেয়ে এক্কেবারে আলাদা। ভীষণ কুয়াশা, বারে বারে বৃষ্টি নামছে -এই অবস্থায় নিচে নামা সম্ভব নয়। সবাই রেনকোট, ছাতাটাতা নিয়ে রেডি, কারো মাথায় প্লাস্টিকের প্যাকেট। ওয়েদার একটু ভালো হলেই বেরোতে হবে। এদিকে রাত্রের মত সকালেও ৭০ জনের ব্রেকফাস্ট তৈরী করতে নাজেহাল করছিলেন লজের কর্মীরা। দেখলাম আমাদের নিম দরজিও লুচি বেলতে চলে গেছেন। একপ্লেট জলখাবার রেডি হতেই কাড়াকাড়ি পরে যাচ্ছে। মুশকিল আসান হলেন ফের ফাল্গুনিদা। কিচেনের দরজা বন্ধ করে জানলার একটা কাঁচ ভাঙা ছিল, সেটাকে কাউন্টার বানিয়ে তার বাইরে দাঁড়ালেন এবং নিজের দলের সদস্যদের জলখাবার একে একে পাস করে দিলেন। তারপর সে জায়গাটা ছেড়ে দিলেন আমাদের টিমলিডার অনির্বাণকে।
ফেরার পথে।
জলখাবার শেষ করে  হাত ধুচ্ছি, এমন সময় অনেকগুলো কন্ঠে উল্লাস শুনে দৌড়ে বাইরে এলাম। কুয়াশা অনেকটা কেটে গেছে, আকাশ থেকে মেঘ সরে সরে যাচ্ছে। আর তার পেছন দিয়ে ধীরে ধীরে আত্মপ্রকাশ করছে মাউন্ট কাঞ্চনজঙ্ঘা। সে দৃশ্য বর্ণনা করার বৃথা চেষ্টা করছি না। আর তা লেন্সবন্দী করার মত ক্যামেরাও আমাদের কারো কাছে ছিল না। তাই চোখ দিয়ে মনের ক্যামেরাতেই গেঁথে রাখলাম।  ভার্সে ট্রেক সার্থক।
নতুন ক্যানভাস।
এবার ফেরার পালা। ভার্সেকে বিদায় জানিয়ে হাঁটা শুরু করলাম। আবহাওয়া অনেকটা ভালো হয়েছে, কিন্তু মাঝে মাঝে বৃষ্টি আসছে। কিছুটা শিলাবৃষ্টিও পেলাম। ওঠার দিন ছিল ঝকঝকে রোদ্দুর। আজ ভেজা রাস্তা, গাছের পাতা থেকে টুপটাপ জল পড়ছে, ঝোরাগুলোর তেজও বেড়ে গেছে।কখনো কখনো হাঁটতে হচ্ছে কুয়াশার মধ্য দিয়ে।
পাঁচ হাত দূরের মানুষকেও দেখা যাচ্ছে না। এর মধ্যে বব আর পল্লব পাকড়াও করেছে একটা পাহাড়ি কুকুরকে। এখানে অনেকরকম লোমশ কুকুর দেখলাম, যাদের কলকাতাতেও দেখতে পাওয়া যায়, বকলস পরা অবস্থায়, বড়লোকদের ড্রয়িংরুমে। এখানে  তারা স্বাধীন। অবশ্য পল্লবের কাছে যেভাবে চোখ বুজে আদর খাচ্ছিল তাতে ওকে বাড়ি নিয়ে গেলেও বোধহয় আপত্তি করত না। বব ব্যাগ থেকে একটা ক্রীমরোল বের করে অফার করতেই একটা আশ্চর্য ঘটনা প্রত্যক্ষ করলাম। কুকুরটা রোলটাকে মুখে ধরে উল্টোদিকে মুখ ঘুরিয়ে জঙ্গলের মধ্যে ছুট লাগালো। তারপর একটা জায়গায় থাবা দিয়ে গর্ত খুঁড়ে রোলটাকে রেখে আবার মাটি চাপা দিয়ে দিল। পাহাড়ের মানুষ যেমন কঠিন জীবনসংগ্রামে অভ্যস্ত তেমনি কুকুররাও জানে দুবেলা খাওয়ানোর মত পশুপ্রেমিক এখানে নেই। নিজের রসদ নিজেকেই সঞ্চয় করে রাখতে হয়। 
পাহাড়ি বন্ধু।
নামার সময় হিলে পৌঁছতে সময় লাগল অনেকটা কম, প্রায় দুঘন্টা। এইবার দলটা দুভাগে ভাগ হয়ে গেল। আমি আর শ্রীরূপা যাব ওখরে তে। অনির্বাণ, বব আর পল্লব যাবে ভোরেং এ। সেখান থেকে আরেকটা ট্রেক করে যাবে গোর্খে। পরের দিন ওখরে তে এসে আমাদের সঙ্গে মিট করবে।




অন্যান্য পর্বের লিঙ্কঃ

পাহাড়ের ডায়েরি (১)
পাহাড়ের ডায়েরি (৩)

Tuesday 18 April 2017

পাহাড়ের ডায়েরি (১)


শিলিগুড়ি থেকে প্রায় ৭০-৮০ কিলোমিটার যাওয়ার পরেও যখন একটা হালকা ঠাণ্ডা হাওয়ার বেশী কিছু পাচ্ছিলাম না তখন তেড়ে গাল দিচ্ছিলাম অনির্বাণ কে। আমাদের টিম লিডার তো সেইই। ধুয়োটা অবশ্য তুলেছিল পল্লব। "সিকিমে হিলে-ভার্সে বলে একটা জায়গা আছে; যাবি নাকি?" ৬ জন হাত তুললাম। পরে অবশ্য ২ জন ছেঁটে গেল। রইলাম বাকি ৫। আমি (অতনু), পল্লব, অনির্বাণ, বব আর আমার সহধর্ম্মিণী শ্রীরূপা। আমাদের মধ্যে অনির্বাণ ছাড়া ট্রেকিং এ সবাই নবিশ। তো অনির্বাণ আগে থেকেই বলে রেখেছিল, "ওখানে কিন্তু হেব্বি ঠাণ্ডা, ভালো করে গরম জামাকাপড় নিয়ে নিবি।" সেইমত এপ্রিলের গরমে বাক্সয় ঢুকে যাওয়া শীতের জামাকাপড় বের করে ব্যাগ ভর্তি করেছি। এখন শীতের এই চেহারা দেখে কার না মাথা গরম হয়? অনির্বাণের উপদেশের মাহাত্ম অবশ্য পরে টের পেয়েছিলাম হাড়ে হাড়ে। আক্ষরিক অর্থেই!


তিস্তা নদী, গাড়ি থেকে তোলা।

এনজেপি স্টেশনে আমাদের ট্রেন ঠিক সময়েই পৌঁছেছিল। তারপর রিটায়ারিং রুমে একটু হালকা হয়ে যখন সাগরভাইয়ের গাড়িতে উঠলাম তখন সকাল সাড়ে নটা। শিলিগুড়ি শহর পেরিয়ে তিস্তার পাশ দিয়ে পাক খেয়ে খেয়ে পাহাড়ে উঠলাম। ধাপে ধাপে বাড়িঘরগুলো ছোট হয়ে এলো। পুলিস চেকপোস্ট পেরিয়ে পশ্চিমবঙ্গ থেকে সিকিমে ঢুকলাম। তিস্তা ও রঙ্গিতের সঙ্গমস্থলে দাঁড়িয়ে কিছু ছবিটবি তুললাম। সাগরভাই মাঝেমধ্যেই গাড়ি দাঁড় করিয়ে কিছু জিনিসপত্র তুলছিলেন। আবার সেগুলোকে তাদের গন্তব্যস্থলে নামিয়ে দিচ্ছিলেন। রাস্তার ধারে সুন্দরী নেপালি মহিলাদের হাত নাড়া দেখে বোঝা গেল সাগরভাই এখানে বেশ পপুলার। অনেকটা রাস্তা, সবারই ছোটবাইরে যাওয়ার প্রয়োজন। আমরা ছেলেরা যেকোন জায়গায় কাজ সারতে পারি, কিন্তু সঙ্গে একটা মেয়ে আছে। সাগরভাইকে বলতে তিনি আশ্বস্ত করলেন। খানিকবাদে গাড়ি দাঁড়ালো ঝাঁ চকচকে একটা বিশাল মন্দিরের সামনে। কিন্তু আমাদের তো মন্দির দর্শনের কোন বাসনা ছিল না। সাগরভাই বললেন "অন্দরমে টয়লেট ভি হ্যায়!" আহ! নাস্তিক হিসেবে মন্দিরের উপযোগিতা এই প্রথম উপলব্ধি করলাম। জায়গাটার নাম দরমদিন। ফেরার দিন এই সাগরভাই-ই আমাদের এনজেপি নিয়ে যাবেন। আর আমরা নিজে থেকেই তাঁকে বলব, "ঊও মন্দিরমে থোরা রোক দিজিয়ে না, টয়লেট যানা হ্যায়!"


সাগরভাই গাড়ি থামিয়ে একটা দোকান থেকে কিছু কেনাকাটা করছিলেন। সেই ফাঁকে আমরা পা ছাড়িয়ে নিচ্ছিলাম। স্কুলফেরতা এই মেয়েটাকে দেখে পল্লব পটিয়ে ছবি তোলার জন্য রাজি করিয়ে ফেলল।


হিলে তে যখন পৌঁছলাম তখন ৬টা বাজে। সূর্য ডুবে গেছে, তবু কিছু আলোর আভা রয়েছে। যেখানে গাড়ি থামল তার সামনে জঙ্গল, পরে জেনেছি ওটাই ভার্সে যাওয়ার পথ। বাঁদিকে একটু উঁচুতে সার দিয়ে চারটে কুঁড়েঘর। এগুলোই আপাততঃ আমাদের মাথা গোঁজার ঠাঁই। আর ডানদিকে নিচে একটা ফাঁকা জায়গা। সেখানে আর্মির ক্যাম্প বসেছে। আমাদের মধ্যে বব ঘোর দেশপ্রেমিক। ইন্ডিয়ান আর্মি দেখেই ভীষণ উত্তেজিত হয়ে সে ক্যাম্পে দর্শন দিতে যাচ্ছিল। কিন্তু এক কর্তব্যরত জওয়ান নিষেধ করলেন। আর্মি ক্যাম্পে যাওয়া আর ছবি তোলা দুটোই বারণ। পাঁচটা কুঁড়েঘরের মধ্যে দুটো থাকার জায়গা, দুটো রান্নাঘর। শেষে একটা টয়লেট। ঘরে ১৫-২০ জন লোক স্বচ্ছন্দে থাকতে পারে। আপাততঃ একটা ঘর আমাদের পাঁচজনের দখলে। ঘরে বসতে না বসতেই ড্রাগন আঁকা সুদৃশ্য চিনামাটির কাপে ধোঁয়া ওঠা অদ্ভুত স্বাদের লিকার চা আর প্লাস্টিকের বাটিতে ম্যাগি চলে এলো। এখানে জলখাবার হিসেবে ম্যাগি বেশ চলে। আসলে যদিও ম্যাগি নয়, ওয়াই ওয়াই।


ট্রেকার্স হাট, হিলে


এই প্রথম ট্রেকিং এ যাচ্ছি, সবার বাড়িতেই চিন্তা আছে। কিন্তু পৌঁছানোর খবর দেবো কি করে? নেটওয়ার্ক কখন হাপিস হয়ে গেছে। এই "ট্রেকার্স হাট" আর আর্মি ক্যাম্প ছাড়া এলাকায় জনমানবের চিহ্ন নেই। রাস্তাটা ধরে একটু উঠে এক নেপালি মহিলাকে দেখে হিন্দিতে জিজ্ঞাসা করলাম, এখানে কোন ল্যান্ডলাইন আছে কি না। তিনি কি বুঝলেন কে জানে, বাঁদিকে হাত দেখিয়ে বললেন, "ওই ল্যাম্পপোস্টের কাছে চলে যান।" কিন্তু ল্যাম্পপোস্ট পেরিয়ে কয়েক হাত এগিয়েও কিছু চোখে পড়ল না। একটু ওপরে সামান্য আলো আর একজন মানুষকে দেখে একই প্রশ্ন করতে তিনি পালটা জিজ্ঞাসা করলেন, "ভোডোফোন?" আমরা হ্যাঁবাচক মাথা নাড়তে তিনি আবার ঐ ল্যাম্পপোস্টটাই দেখিয়ে দিলেন। সেই ল্যাম্পপোস্টের তলায় দাঁড়াতেই কি আশ্চর্য! দিব্যি টাওয়ার পাওয়া যাচ্ছে! চটপট যে যার বাড়িতে জানিয়ে দিলাম ঠিকঠাক পৌঁছেছি। আর এ কদিন ফোনে যোগাযোগ করা সম্ভব নাও হতে পারে। 


পাহাড়ে জলখাবারের কমন আইটেম হল ম্যাগি।


যত রাত বাড়তে লাগল ঠাণ্ডা কাকে বলে বুঝতে পারলাম। পরের দিন ১০০০০ ফুট উঁচ্চতায় ভার্সেতে কি হতে চলেছে তারও একটা আঁচ পেলাম। ফুলশার্টের ওপর ফুল সোয়েটার, জ্যাকেট, মাথায় মাফলার, টুপি পরেও কাঁপুনি থামানো যাচ্ছিল না। তার ওপর টয়লেট যেতে হবে দুটো ঘর পেরিয়ে। ঘরে টিমটিম করে একটা বাল্ব জ্বললেও বাইরে কোন আলো নেই। যে টর্চটা এনেছিলাম সেটা বিগড়ে গেছে। বড়বাইরে পেলে অতএব মোবাইলই ভরসা! হাতে গড়া রুটি, সেদ্ধ না হওয়া ফুলকপি আর ছালশুদ্ধু মুরগির মাংসের ঝোল দিয়ে নৈশাহার সেরে সোয়েটারের ওপর কম্বল চাপা দিয়ে শুয়ে পড়লাম। পরদিন সকালেই ট্রেকিং শুরু হবে। পল্লব ভূতের গল্প শুরু করল। শুনতে শুনতে ঘুমে তলিয়ে গেলাম। 


হিলেতে সূর্যোদয়

অন্যান্য পর্বের লিঙ্কঃ