Thursday 25 June 2015

দু দিনের ভাল্কি

শেষমেষ বেরিয়েই পড়লাম। হানিমুন সেরে আসার পর তিন-তিনটে বেরানোর পরিকল্পনা বাতিল হয়েছে নানা কারণে। এবার তাই মরিয়া হয়ে উঠেছিলাম। আর কিছু না হোক একটা সপ্তাহান্তিক ট্যুর তো হতেই পারে! কিন্তু সে গুড়ে বালি। শনি-রোববারে বা ছুটির দিনে সর্বত্রই ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই দশা। শীতের ছুটিতে বাঙালীকে ঘরে আটকে রাখে এমন বাপের ব্যাটা কে আছে? তাই কর্মসংস্কৃতিকে চুলোয় তুলে সোমবার দেখেই টিকিট কেটে ট্রেনে চেপে বসলাম। গন্তব্য প্রথমে বর্ধমান, তারপর গাড়ী বদল করে মানকর। ঘর তো ফোনেই বুক করা ছিল। স্টেশন থেকে কিভাবে যাব জানতে অরণ্য সুন্দরীর ম্যানেজার মশাই গাড়ীর ফোন নং দিয়ে দিলেন। সেইমত মানকর স্টেশনেই কেষ্টবাবু গাড়ী নিয়ে হাজির। সেই গাড়ীতে চেপে রাঙামাটির পথ বেয়ে এগিয়ে চললাম। মিনিট কুড়ি যাওয়ার পর চোখে পড়ল বনদপ্তরের সাইনবোর্ড। দুপাশে শাল পিয়ালের জঙ্গলের মাঝে পিচরাস্তা। আরো মিনিট দশেক পর বাঁদিকে টার্ণ নিয়ে ঢুকে পড়লাম অরণ্য সুন্দরীতে। সামনেই একটা কুচকুচে কালো ভালুকের মূর্তি স্বাগতঃ জানালো ভালকি মাচানে।



আউশগ্রাম ২ নং পঞ্চায়েত সমিতি এই গেস্ট হাউসটা তৈরী করেছিল। এখন লীজে দেওয়া আছে। চাকচিক্যর অভাব থাকলেও আতিথেয়তায় একশোয় একশো। জঙ্গলের মাঝে নিরালায় নির্ঝঞ্ঝাটে দুটো দিন কাটানোর পক্ষে আইডিয়াল। এখানে থাকার জায়গা এটাই। ৩ কিমি দূরে যমুনাদিঘি-আম্রোপালি মৎস প্রকল্পের ভেতরেও থাকা যায়। কিন্তু জঙ্গলের মধ্যে থাকার মজাটা সেখানে মিলবেনা। তবে বর্ষাকালে, মাছের চারা বোনার সময় ওখানে থাকতে পারেন।
আমরা যখন ঢুকছি হোটেলে তখন বেহালা থেকে একটা চল্লিশজনের দল এসেছিল। তাদের হইহুল্লোড়ে জঙ্গল জমজমাট। আমাদের দেখে তো ওদের চোখ কপালে! "এই অজ গাঁয়ে দুজনে কি করবেন মশাই? ও আমাদের পোষায় না। লোক না হলে কথা বলব কার সাথে?"

ঘরে ব্যাগপত্তর রেখেই বেরিয়ে পরলাম। শালবনের মধ্যে দিয়ে হাঁটতে দিব্যি লাগছিল। নামে ভালকি মাচান হলেও ভালুক কেন কোন জন্তু জানোয়ারেরই দেখা মিলবেনা এক সাপ আর পাখি ছাড়া। অবশ্যি কিছু দুপেয়ে জানোয়ারের দেখা পেতে পারেন। তাঁরা তাঁদের লীলাখেলার স্মারক যেমন কাগজের ডিশ, খাবারের প্যাকেট, জল আর মদের বোতল চারদিকে ছড়িয়ে অরণ্যের পরিবেশকে সৌন্দর্য্যমণ্ডিত করে গেছেন। জঙ্গল পেরিয়ে পিচরাস্তায় উঠতেই নজরে পরল রাস্তার ওপারে পোড়া ইঁটের কাঠামো। মাঝখানের সলিড বডি থেকে চারটে পিলার উঠে গেছে। তলার টানেল দিয়ে এদিক থেকে ওদিকে কোমর ভাঁজ করে চলে যাওয়া যায়। মেঝেতে একটা সুরঙ্গের মুখ। এটার অন্য মুখ নাকি আছে বর্ধমানের রাজবাড়িতে। গোয়েন্দা গণ্ডালু থাকলে ওরা নিশ্চয়ই ঢাকনা সরিয়ে সুরঙ্গের ভেতর নেমে পরত গুজবের সত্যতা যাচাই করতে। এই পোড়ামাটির কাঠামোটা আসলে একটা ওয়াচ টাওয়ারের ধ্বংসাবশেষ। এখানে বসে বর্ধমানের রাজারা ভালুক শিকার করত। আর তাই থেকেই জায়গাটার নাম ভালকি মাচান (Bhalki Machan) । এখন সে রাজাও নেই, সে ভাল্লুকও নেই। তাদের বদলে পেলাম এক যুগলকে ওয়াচ টাওয়ারের সামনে সাইকেল দাঁড় করিয়ে যারা প্রেমালাপে মগ্ন। ওদেরকেই অনুরোধ করলাম আমাদের দুজনের একটা ছবি তুলে দিতে।


"ভালকি" নামটার উৎস সম্বন্ধে অন্যরকম গল্পও চালু আছে। এরকম একটা গল্প হল এক ভল্লুকী জঙ্গলে একটা মানুষের বাচ্ছাকে কুড়িয়ে পায় ও তাকে মাতৃস্নেহে পালন করে। সেই ছেলেটি পরে রাজা হয়। তাদের বংশই হয়ত ভল্লু রাজবংশ হিসেবে পরিচিত হয় এবং বর্ধমান রাজা নয়, এই ওয়াচ টাওয়ারটা ছিল সেই ভল্লু রাজাদের। আরেকটি বিশ্বাসযোগ্য কাহিনী বলছে একদা এই এলাকায় ঋষি ভল্লুপাদ ঘাঁটি গেড়েছিলেন। তারপর তাঁর আশ্রমকে কেন্দ্র করে ভালকি গ্রাম গড়ে ওঠে। 

খিদেয় চুঁইচুই পেট নিয়ে যখন ঘরে ফিরলাম বেহালার দল ততক্ষণে চলে গেছে। জঙ্গল আবার ফিরে যাচ্ছে তার শান্ত গাম্ভীর্য্যের ট্রেডমার্কে। দুপুরের খাওয়াটা বেশ ভালোই হল, ভাত, ডাল, আলুভাজা, মাছ, ... বেশ ঘরোয়া রান্না। রাত্তিরে হয়েছিল মুরগীর মাংস। গেস্ট হাউসের সামনেই একটা পুকুরকে ঘিরে সুন্দর ফুল আর নানা গাছের বাগান। বিকেলের দিকে ওখানে বসেই সময় কেটে গেল। কখন যে সুয্যিমামা ডুব দিয়েছে আর ঘুটঘুটে অন্ধকার নেমে এসেছে খেয়ালই করিনি। মোবাইলের আলোতে ঘরে এলাম। এখানে বিদ্যুৎ নেই। হোটেল চলে জেনারেটরে।


পরদিন ঘুম ভাঙল শিশিরের শব্দে। তাড়াতাড়ি সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেলাম ছাদে। প্রচণ্ড ঠাণ্ডা। ফুল সোয়েটারের ওপর জ্যাকেট চাপিয়ে ঠকঠক করে কাঁপছি। চারধার কুয়াশায় ঢেকে গেছে। টুপটাপ করে শিশির পরছে। মাঝে মাঝে পাখি ডাকছে। একটাই পাখি। সেও বোধহয় আমাদের মত শহর থেকে হয়ত বা পথ ভুলেই এসে পড়েছে। তাই বাসায় ঘুমিয়ে না থেকে শীতে কাঁপতে কাঁপতে আনন্দে শিষ দিচ্ছে। আস্তে আস্তে কুয়াশা কাটল, আলো ফুটল, গেস্ট হাউসের লনে লোকের আনাগোনা দেখা গেল। আমরা নামলাম, চানটান করে নিতে হবে, গরম জল চাইলেই মিলবে। লুচি তরকারি দিয়ে ব্রেকফাস্ট সারব। তারপর গাড়ী আসবে, একটু এদিক ওদিক ঘুরে ফেরার ট্রেন ধরব। 



প্রয়োজনীয় তথ্যঃ কলকাতা থেকে ভালকির দুরত্ব ১৬০ কিমি। কলকাতা থেকে গাড়ীতে বা ট্রেণে যাওয়া যাবে। নিকটবর্তী স্টেশন বর্ধমান-আসানসোল লাইনের মানকর। থাকার জায়গা বলতে অরণ্য সুন্দরী (ফোনঃ ৯৪৩৪৫৩৭৫৪৫)। দেখে নিতে পারেন ভালকি গ্রামে কিছু পুরনো মন্দিরের ধংসাবশেষ, যমুনাদিঘী মৎস প্রকল্প, ইছাই ঘোষের দেউল (৬০ কিমি)। চাইলে অরণ্য সুন্দরীর সামনের পুকুরটায় বোটিং করতে পারেন বা আদিবাসীদের নাচ দেখতে পারেন। লজের কর্মীদের বললে তারাই সব ব্যবস্থা করে দেবে।

ছবিঃ শ্রীরূপা ও অতনু