Monday 14 August 2017

মুক্তা কুমার, ছোট্ট পত্রিকা এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী

দিদা বেঁচে থাকলে আজ তাঁর বয়স হত একশো বছর। বাবার মা কে ঠাকুমা বলারই চল আছে। কেন জানি না আমি আর দাদা দুজনেই তাঁকে দিদা বলেই ডাকতাম। দাদু যখন মারা যান তখন আমার বয়স মেরেকেটে নয়। তাছাড়া শেষ কয়েকটা বছর তিনি ভীষণ অসুস্থ আর শয্যাশায়ী ছিলেন। কাজেই দাদুর স্মৃতি আমার কাছে খুব একটা নেই। কিন্তু ছোটবেলার অনেকটাই কেটেছে দিদার স্নেহচ্ছায়ায়। বাবা মা দুজনেই স্কুলে চাকরি করতেন। ফাইভ অবধি সকালের স্কুল করে এসে তো দিদার কাছেই থাকতাম। তখন মোড়ে মোড়ে মিষ্টির দোকান গজিয়ে ওঠেনি। দুপুর বেলায় রাস্তা থেকে হাঁক শোনা যেতঃ খাবাআআআর। আর শুনেই একদৌড়ে দরজার বাইরে। বৃদ্ধ ফেরিওয়ালা মাথার ঝাঁকা সামনের রোয়াকে নামাতেন আর তার মধ্যে থেকে বেরতো মেঠাই, সন্দেশ, গজা, নিমকি ... আরো কত কি। দিদা আঁচলের গিঁট খুলে পয়সা বের করার আগেই তার বেশ কয়েকটা চালান হয়ে যেত আমার মুখে। তখনো অবশ্য জানতাম না দিদা কতটা বড় মাপের মানুষ। তবে বাড়িতে লোকজনের আনাগোনা লেগেই থাকত। দূর দূরান্ত থেকে আত্মীয়স্বজনরা যেমন আসতেন তেমনি আসতেন এলাকার নানা মানুষ, দল ও মহিলা সমিতির কর্মীরা। আজও লোকে আমায় চেনে "দয়াল মাস্টার" আর "মুক্তাকাকিমার নাতি হিসেবেই"। 

দিদার জন্ম ১৯১৭ সালের ভাদ্রমাসে, বর্ধমানের একটা সম্পন্ন পরিবারে। তখন তাঁর নাম ছিল হরিমতী। দাদাদের থেকেই স্বদেশী হাওয়ায় প্রভাবিত হয়েছিলেন। মাত্র ১১ বছর বয়সে দয়াল কুমারের সঙ্গে বিয়ে হয়। "মুক্তা" নামটা দাদুই দিয়েছিলেন। তারপর, দিদার নিজেরই কথায়, দেশপ্রেমের আবেগকে শ্রেণিচেতনার আবেগে সেঁকে নেওয়া, দাদুর প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে নেমে, দ্রোহমূলক গান কবিতা লিখে রাজরোষে পড়ে প্রথমে ব্রিটিশ তারপর স্বাধীন ভারতের কারাগারে অন্তরীণ হওয়া। দিদার যুদ্ধ, দাঙ্গা, মহামারীর সময় মহিলা আত্মরক্ষা সমিতির মাধ্যমে ত্রাণ ও সেবাকার্য সংগঠিত করা। সুইজারল্যান্ডের লুসান শহরে বিশ্ব মাতৃ সন্মেলনে পশ্চিমবঙ্গের প্রতিনিধিত্ব করা। আর এসবের সঙ্গেই প্রবল অনটনের মধ্যে দশ ছেলেমেয়েকে মানুষ করে তোলা।

তখন সম্ভবতঃ ফাইভে পড়ি। এক লোডশেডিং এর রাতে আমি আর দাদা হঠাৎ ঠিক করলাম একটা হাতে লেখা পত্রিকা বের করব। বাবা-কাকা-পিসি রা তাদের ছোটবেলায় বাড়ির সবার লেখা দিয়ে ঐরকম একটা হাতে লেখা পত্রিকা করেছিল। সেটা দেখেই হয়ত এমন ভাবনা। যেমন ভাবনা তেমন কাজ। পর পর পাঁচ মাস ধরে বেরলো সেই "ছোট্ট পত্রিকা"। প্রথম সংখ্যার কয়েকটা ফাঁকা পাতা রাখা হয়েছিল যাতে বড়রা মতামত জানাতে পারে। সেই পাতায় দিদা লিখেছিলেনঃ 
"এতদিন আমার মনের মাঝে যে বীজ বপন করা ছিল, তোমাদের উদ্যোগে ছোট্ট পত্রিকা প্রকাশনার মধ্যে অঙ্কুরিত হতে দেখে আশান্বিত হলাম। উত্তরোত্তর শাখাপ্রশাখা পল্লবিত হয়ে উঠুক। -- দিদা, ডিসেম্বর ১৯৯৬।"
পত্রিকার শেষ তথা শারদ সংখ্যায় স্বাধীনতার ৫০ বছর উপলক্ষে তিনি একটা ছোট্ট প্রবন্ধও লিখলেন। আরো বছর পাঁচেক পরে বন্ধুরা মিলে যখন "অভিযান" পত্রিকা বের করলাম তখনও তিনি খুব খুশি হয়েছিলেন। আমাকে বলেছিলেন, "তোকে সায়েন্স নিতে হবে না, তুই আর্টস নিয়ে পড়বি।" তাঁর কথা অবশ্য রাখতে পারিনি। দিদার মৃত্যুর কয়েকমাস পরেই আমি মাধ্যমিক দিলাম। তারপর "অভিযান" পত্রিকার দ্বিতীয় সংখ্যায় স্বাধীনতার ৫০ বছরের সেই লেখাটা আবার ছাপা হল। একটা সুন্দর হেডপিস এঁকে দিয়েছিল সমদা (স্মিতধী গাঙ্গুলী)। স্বাধীনতার ৭০ বছর পূর্তির প্রাক্কালে সমদার হেডপিস সহ পুরো লেখাটাই দিয়ে দিলাম। 



শারীরিক অসুস্থতার কারণে বেশ কিছুদিন কলকাতার কসবায় ছোট ছেলের চিকিৎসাধীনে ও তত্ত্বাবধানে ছিলাম। সেই সময়ের মধ্যেই অনুষ্ঠিত হয়ে গেল স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী। তখন শুয়ে শুয়ে সম্পূর্ণ বিশ্রামের মধ্যে অন্য কিছুই করতে পারতাম না। সময়মত ঝর্ণা রেডিওটা খুলে দিয়ে যেত, শুনতাম। গত একবছর ধরেই প্রচারমাধ্যমে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর নানা অনুষ্ঠানের কর্মসূচী শুনে আসছি। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উৎসবে কোন স্তরে কোন সাড়াই যেন পেলাম না - একমাত্র প্রচারমাধ্যমে কিছু কিছু শুনলাম। সমস্ত এলাকাটাই যেন নিস্তব্ধ। এই নিরিবিলি বিশ্রামের মাঝে পঞ্চাশ বছর আগের সেই প্রথম স্বাধীনতা দিবসের স্মৃতি মনকে আলোড়িত করে তুলতে লাগল। 

সেই দিনের প্রাক্কালে পাড়ায় এবং বাড়িতে সাড়া পড়ে গিয়েছিল। অজয় বলে একটি ছেলে বাড়ি থেকে চলে এসে আমাদের পরিবারের সঙ্গে প্রায় একাত্ম হয়ে গিয়েছিল। দয়াল কুমারের নির্দেশনায় ছোট বড় অশোক চক্রের ব্লক অজয় নিজেই তৈরী করেছিল। তারপর কয়েকদিন ধরে পতাকা সেলাই করতে লেগেছিল। ছোট-বড়, ছেলে-বুড়ো সবাই মিলে বাড়িতেও একটা উৎসব করার মতলব ভাঁজা হচ্ছে। সকলের ভাবনা এটাই যে, দীর্ঘদিনের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে সাম্রাজ্যবাদী শোষকদের হাত থেকে স্বাধীনতা উদ্ধার হবে ১৫ই আগষ্ট। সমস্ত ভারতবাসী খেতে পাবে, পড়তে পাবে, কাজ পাবে এই আশায় সর্বস্তরের ও সব বয়সেরই মানুষ যেন অজানা আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে উঠেছিল। সারা রাত্তির ধরে পতাকা তৈরী হয়েছে, বাড়ির সবাই যোগান দিয়েছে। ভোরবেলাতেই ছনি পরিমল এদের নেতৃত্বে জাতীয় সঙ্গীতের প্রভাতফেরি সারা অঞ্চলটাকে স্বাধীনতা দিবসের আনন্দে উদ্ভাসিত করে তুলল। ভোর হতেই ছোট ছোট পতাকা হাতে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা বেরিয়ে পড়ল এবং বড়রা পতাকা নিয়ে গেল বাড়িতে লাগাবে বলে। আমারও উৎসবের আনন্দে রান্নায় মন লাগছিল না। বারবার সদরে বেরিয়ে এসে কিশোর বাহিনী ও অন্যান্যদের উচ্ছাস ও আনন্দ দেখছিলাম। 

সেদিনের স্বাধীনতার আনন্দ ও আশা আর পঞ্চাশ বছর পর এই দিনটিতে মানুষের উচ্ছাস ও আবেগের আকাশ পাতাল তফাত। যে আশা নিয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামে যুক্ত হয়েছিলাম তার বেশীরভাগই আজ অসম্পূর্ণ, অপূর্ণ। আজ সমস্ত দিকে নির্লিপ্ততা ও শূন্যতার মাঝে মনের মধ্যেও শূন্যতা ও বিষাদ অনুভব করছি। আশা এই যে সমাজ ব্যবস্থার সততই পরিবর্তন হয়। আজ আমি বর্তমান ও আগামী প্রজন্মের কাছে এই প্রত্যয় রাখছি তারা সকলের জন্য খাদ্য, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষার সংগ্রাম করে যাবে এবং অদূর ভবিষ্যতে সকলের জন্য একটা সুখী সমাজ কাঠামো গড়ে তুলবে। 

সুবর্ণজয়ন্তীর শুভলগ্নে আমার জীবনসন্ধ্যার প্রাক্কালে এই আশা রাখছি। 
দশ সন্তানের সঙ্গে দিদা

Wednesday 9 August 2017

ভোটের গেরোয়

সমনটা যখন হাতে পেলাম একটু টেনশান যে হচ্ছিল তা অস্বীকার করব না, তবে নতুন একটা অভিজ্ঞতা হবে ভেবে উত্তেজনাও অনুভব করছিলাম। একবছর হল কলেজের চাকরিতে যোগ দিয়েছি। এর মধ্যেই সহকর্মীদের কাছে  ভোটের নানা গল্প আর সেইসঙ্গে প্রয়োজনীয় পরামর্শ মাথায় নোট করা হয়ে গেছে। ভোটের আগের দিন (যাকে পি-১ ডে বলা হয়) ব্যাগপত্তর গুছিয়ে ট্রেনে করে পাণ্ডুয়া স্টেশনে নামলাম। আরো অনেক ভোটকর্মীর দেখা পেলাম স্টেশনে। তাঁদের সঙ্গেই নির্বাচন কমিশনের বাসে উঠলাম। তারপর সোজা ডিসি অর্থাৎ ডিস্ট্রিবিউশান সেন্টার। বেশ বড় জায়গা। কিন্তু সূর্যের তেজ ক্রমেই বাড়ছে। প্লাস্টিকের গ্লাসে করে গ্লুকোজ মেশানো জল বিতরন করা হচ্ছিল। তাই এক গ্লাস পান করে কাউন্টারে গিয়ে দাঁড়ালাম। ইতিমধ্যে অন্য পোলিং অফিসাররাও এসে গেছেন। সবাই মিলে জিনিসপত্র সব মিলিয়ে নিলাম। ইভিএম টা ঠিক আছে কিনা পরীক্ষা করে নিলাম। এতদিন সিইউ/বিইউ বলতে বুঝতাম ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটি আর বর্ধমান ইউনিভার্সিটি। এবার জানলাম ঐ চারটি অক্ষর দিয়ে কন্ট্রোল ইউনিট আর ব্যালট ইউনিটকেও বোঝানো যেতে পারে! আরেকটা কাজ বাকি ছিল, তা হল একজন লাঠিধারী পুলিসকে ট্যাগ করা। সেজন্য পুলিসের ক্যাম্পে গিয়ে তো চক্ষু চড়কগাছ! অন্তত ১০০ প্রিসাইডিং অফিসার লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন। আর লাইন এগোচ্ছে কচ্ছপের গতিতে! এভাবে চললে তো বুথে পৌঁছতে রাত্তির হয়ে যাবে। সবার মনেই সেই আশঙ্কা। গরমের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চড়ছে মেজাজ! দু অক্ষর, চার অক্ষর বেরোতে শুরু করল। শেষে রিটার্নিং অফিসার এসে সবাইকে আশ্বস্ত করলেন, আপনারা বুথে চলে যান, পুলিস পাঠিয়ে দেওয়া হবে। অতএব আমাদের জন্য নির্ধারিত বাসে উঠলাম। আমাদের ডিউটি পড়েছে একটা আদিবাসী এলাকায়। আরো দুটো সংলগ্ন বুথের ভোটকর্মীদের নিয়ে বাস ছাড়ল। "জয় ভোটবাবার জয়" বলে রওয়ানা দিলাম।

পৌঁছলাম দিনের আলো থাকতেই। শাল গাছে ঘেরা পরিস্কার পরিচ্ছন্ন প্রাইমারি স্কুলটা দেখে চোখ জুড়িয়ে গেল। একটু ফ্রেশ হয়ে খাওয়াদাওয়া করেই মেঝেতে চাদর পেতে কাজে লেগে পড়লাম। শুধু ভোট নেওয়া নয়, প্রচুর ফর্ম ও কাগজপত্র পূরণ করার থাকে। আর প্রিসাইডিং অফিসার হিসেবে আমার সই সর্বত্র বাধ্যতামূলক। সবাই মিলে সে সব কাজ যতটা সম্ভব এগিয়ে রাখা গেল। এর মধ্যে দুজন গ্রামবাসী এসে হাজির, আমাদের সব কোন অসুবিধা হচ্ছে কিনা খোঁজ নিতে। পরিচয় জানতে বললেন তিনি আবদুল রহিম নবির পোলিং এজেন্ট। এখানে বলে রাখি পাণ্ডুয়া বিধানসভা কেন্দ্রে মূল প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন তৃণমূল কংগ্রেসের আবদুল রহিম নবি এবং সিপিএমের শেখ আমজাদ হোসেন। বিজেপির অশোক ভট্টাচার্য এবং আরো তিনটে ছোট দলের প্রার্থীরাও ছিলেন। এছাড়া ছিলেন একজন নির্দল, তাঁরও নাম শেখ আমজাদ হোসেন! তো এজেন্ট মশাইকে জানিয়ে দিলাম পরদিন যেন সকাল সকাল চলে আসেন। "কোন চিন্তা নেই স্যার, ছটার মধ্যে চলে আসব।" বলে বিদায় নিলেন এজেন্ট সাহেব।

রাতের খাওয়াটাও ভালো হয়েছিল। স্কুলের মিড ডে মিলের দায়িত্বপ্রাপ্ত স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মহিলারা মোটা চালের ভাত, আলুপোস্ত আর ডিমের ঝোল খাওয়ালেন। খাওয়াদাওয়া সেরে শোয়ার তোড়জোড় করছি এমন সময় আরেক বিপত্তি। বুথের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ান একটা কাগজ এনে হাজির, সই করে দিতে হবে। কাগজটা পড়ে তো পিলে চমকে উঠল। এ যে ফায়ারিং অর্ডার! বোঝ ঠ্যালা, কোথাকার এক ছাপোষা সহকারি অধ্যাপক, ইনসাসধারী ফেট্টিবাঁধা জওয়ান কি না তার কাছে গুলি চালানোর আনুমতি চাইছেন! ওঁদের যুক্তি গুণ্ডারা হামলা করলে তখন আর অনুমতি দেওয়ার সময় থাকবেনা, এমনকি অনুমতি দেওয়ার জন্য আমি জীবিত নাও থাকতে পারি, তাই আগেভাগেই এই ব্যবস্থা। শেষে সেক্টর অফিসারকে ফোন করলাম এবং তাঁর পরামর্শ মেনে ফায়ারিং অর্ডারে সই করলাম না। জওয়ান মশাই ক্ষুব্ধ হলেন এবং যাওয়ার আগে সতর্ক করে গেলেন, ভালোমন্দ কিছু হয়ে গেলে ওনারা দায়িত্ব নেবেন না! কি আর করা। দরজায় একটাই ছিটকিনি। সেটা এঁটে দিয়ে শুয়ে পড়লাম। 

পরের দিন আলো ফোটার আগেই ঘুম ভেঙে গেল। টিউবওয়েলে চান করে রেডি হয়ে নিলাম। ৬টা বাজতে না বাজতেই পোলিং এজেন্টরা উপস্থিত। প্রথমেই গতকালের মক্কেল। তাঁর হাতের কাগজটা নিয়ে দেখি সেটা নির্দল প্রার্থী শেখ আমজাদ হোসেনের এজেন্টের নিয়োগপত্র। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, 
"গতকাল যে বললেন আপনি রহিম নবির এজেন্ট? রাত পোহাতেই আমজাদ হোসেনের এজেন্ট হয়ে গেলেন?"
"হ্যাঁ স্যার, বদলে গেছে।" 
কি আর করা নিয়োগপত্র যখন এনেছেন ওনাকে আমজাদ হোসেনের এজেন্ট হিসেবে কাজ করতে দিতে বাধ্য আমি। পরে, রিলিভিং এজেন্টের হাতে দায়িত্ব দিয়ে বুথ ছাড়ার সময় তিনি আমার কাছে এসে রহস্যটা ফাঁস করে গেলেন। "আমরা স্যার টিএমসি করি, নির্দলের হয়ে কাজ করছি। দলটা ভারী করে নেওয়া, আর কি! ট্যাকটিক্স স্যার, বুঝলেন না?!" 

সব এজেন্টকে এনট্রি পাস ইস্যু করে মক পোল শুরু করতে যাব, এমন সময় আরেকজন হাজির। তিনি বিজেপি প্রার্থী অশোক ভট্টাচার্যের এজেন্ট। তাঁর নিয়োগপত্রটায় দেখি শুধু প্রার্থীর নির্বাচনী এজেন্টের সই ছাড়া বাকিটা ফাঁকা! কোথায় কি লিখতে হবে দেখিয়ে তাঁকে কাগজটা ফেরৎ দিলাম। তবু দেখি তিনি মাথা চুলকোচ্ছেন। বুঝলাম লেখা-পড়ার সঙ্গে তাঁর বিশেষ সম্পর্ক নেই। কিন্তু আমার হাত পা বাঁধা, প্রিসাইডিং অফিসার হয়ে একজন এজেন্টের ফর্ম ফিলআপ করে দিতে পারিনা। শেষে মুশকিল আসান হলেন সিপিএমের বয়স্ক এজেন্ট।
 "কি রে ভাই পারছিস না? আয় আমি লিখে দিচ্ছি।" 
"হ্যাঁ দাদা দেখো দিকি" হাতে চাঁদ পেয়ে ফর্মটা এগিয়ে দিলেন বিজেপির এজেন্ট। 
মক পোল শেষ করে ৭টায় ভোট চালু করতে গিয়ে দেখি বাইরে বিশাল লাইন। মহিলারাই সংখ্যায় বেশী। তারপর নির্বিঘ্নে, শান্তিপূর্ণভাবে ভোট হল। ১১টার মধ্যেই ৫০% ভোট পড়ে গেল। ভোট দেওয়ার জন্যে মানুষের এত উৎসাহ এখানে না এলে জানতেই পারতাম না। জানতে পারতাম না কোনরকম জল না মিশিয়েই ৮৪% ভোট হতে পারে। প্রায় অথর্ব বৃদ্ধ, বৃদ্ধা, চোখে দেখতে পান না এমন মানুষেরা ভোট দিতে চলে এসেছেন ছেলে, বৌমা বা নাতির হাত ধরে! ভাবছিলাম কারা বেশী সচেতন? এই অশিক্ষিত আদিবাসী মানুষগুলো না কি আমার শহুড়ে বন্ধুরা, যারা বলে "ধুসস ভোট দিয়ে কি হবে, এক দিন ছুটিতে মস্তি করি!" বেলা বাড়তে ভোটারদের লাইন ক্রমশ হালকা হল। আমরা একে একে খেয়ে এলাম। তেষ্টায় গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। সিপিএমের এজেন্ট জল আনতে গেলেন, তৃণমূলের এজেন্ট বললেন "চলো চাচা আমিও যাই।" বিজেপির এজেন্ট নিজের বোতলটা ধরিয়ে দিলেন, "এটা একটু ভরে আনিস তো।" আমি চেয়ারে বসে দরজার ফাঁক দিয়ে দেখলাম সেই দৃশ্য। তৃণমূলের এজেন্ট টিউবকলের হাতল টিপছেন আর সিপিএমের এজেন্ট জল ভরছেন। তাঁদের ব্যবধান, হ্যাঁ কয়েক ইঞ্চির বেশী হবে না!

নির্ধারিত সময়েই, সন্ধ্যা ৬টায় ভোট শেষ হল। ঘন্টা দুয়েক বাদে বাস এল। এবার মহামূল্যবান ইভিএম যন্ত্র নিয়ে ডাইনে বাঁয়ে সশস্ত্র জওয়ান পরিবিষ্ট হয়ে পৌঁছলাম আগের যায়গায় যা এখন বদলে গেছে আর সি অর্থাৎ রিসিভিং সেন্টারে। লাইন দিয়ে, গুঁতোগঁতি ও মারামারি করে দরকারি কাগজপত্র সমেত বাক্সবন্দী ইভিএম জমা দিয়ে অব্যাহতি পেলাম। তারপর শেষ ট্রেন ধরলাম ফেরার জন্য। 

প্রথম প্রকাশঃ Deconfined, August 2016