Thursday 28 September 2017

কাকাবাবু, সাবা কাব্বানি আর সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ

কেমন আছেন কাকাবাবু? সন্তু, জোজো, দেবলীনা, ওরা সবাই ভালো আছে? এবারই প্রথম পুজোয় আপনার সঙ্গে দেখা হচ্ছে না।
নতুন কোন অভিযানে যাচ্ছেন না কি? গেলেও আমরা তো আর জানতে পারব না। তাই পুরনো কথাগুলো ভাবছিলাম।  আচ্ছা আপনার সাবা কাব্বানির কথা মনে আছে? আপনি আর সন্তু যখন ক্রাক দ্য শ্যাটেলিয়র দুর্গে বন্দি ছিলেন, তখন কাব্বানি আপনাদের পাহারা দিত। আপনি বলেছিলেন জেলখানার পাহারাদারের এমন ব্যবহার কোন গল্পের বইয়েও দেখা যায়না। তার ছেলে যখন মারা যায় সে ছিল সন্তুরই বয়সী। প্রচণ্ড শীতে সন্তুকে কাঁপতে দেখে সে ছেলের একটা কোট এনে জোর করে পরিয়ে দিয়েছিল। তার একটা কথা হঠাৎ মনে পড়ে গেল, "সিরিয়া দেশটা বেশ শান্তিপূর্ণ, যুদ্ধটুদ্ধ হয়না। তবে মানুষই তো মানুষের শত্রু।" কিম্বা বাঙালি ব্যবাসায়ী প্রোজ্জ্বল রায়? সেও তো বলেছিল "এ দেশের মানুষগুলো সত্যি ভালো। পাশের দেষগুলোতে কত যুদ্ধবিগ্রহ আর মারামারি চলছে। এ দেশটা কিন্তু শান্তিপুর্ণ। আপনাদের ভালো লাগবে।" বেশিদিন নয়, আমি এই বছর তিনেক আগের কথা বলছি। আপনারা যেবার ধনকুবের আবু-আল-ফিদা সালাদিনের আমন্ত্রণে সিরিয়া তারতুফ শহরে গিয়েছিলেন।[১] এখন নিশ্চয়ই ওই কথাগুলো এক একটা নির্মম রসিকতা বলে মনে হয় আপনার? আপনারা ফিরে আসার এক বছরও কাটেনি, ওই দেশে যে অশান্তি শুরু হল তা এখনো থামার তো কোন লক্ষণই নেই বরং তার ভয়াবহতা রোজই বেড়ে চলেছে। ইতিমধ্যেই লক্ষাধিক মানুষ মারা গেছেন, কুড়ি লাখ মানুষ, সীমানা পেরিয়ে আশেপাশের দেশগুলোর উদ্বাস্তু শিবিরে আশ্রয় নিয়েছেন। সব মিলিয়ে প্রায় ষাট লাখ মানুষ অর্থাৎ সিরিয়ার জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ ঘরছাড়া।[২] 

এগুলো অবশ্য নেহাতই স্ট্যাটিস্টিক্স। একটা লেভেলের পর তো আর সংখ্যার কোন অর্থ হয় না। কাকাবাবু আপনি নিশ্চয়ই গত ২১শে আগষ্ট খবরের কাগজে দেখেছেন, সেই সারি দিয়ে শুয়ে থাকা বাচ্ছাগুলোর ছবি? ঘুমের মধ্যেই তাদের ঘরে হানা দেয় বর্ণহীন, গন্ধহীন সারিন গ্যাস। ছটফট করতে করতে দমবন্ধ হয়ে তারা মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়ে।[৩] ঐ ছবিগুলো দেখতে দেখতে আপনার কি রবের কথা মনে পড়ছিল? সেই ফুটফুটে বাচ্ছাটা, যে আপনাকে আর সন্তুকে কমলালেবু দিয়েছিল? আপনি শিখিয়ে দেওয়ার পর সুন্দর উচ্চারণে ন-ম-স-কা-র বলে হাত নেড়েছিল? তার মায়ের নাম ছিল জেনোবিয়া। আপনি যখন বললেন জেনোবিয়া নামে সিরিয়ার এক রাণী ছিলেন, যিনি রোমান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন, তখন ভদ্রমহিলা বেশ অবাক হয়ে বলেছিলেন, "আপনি আমাদের দেশের ইতিহাস জানেন দেখছি! আপনি কি অধ্যাপক?" আসুন ছোট্ট করে একবার এই দেশটার ইতিহাসে চোখ বুলিয়ে নিই।

পৃথিবীর প্রাচীনতম সভ্যতা যেখানে গড়ে উঠেছিল সেই উর্বর হাঁসুলির (Fertile Crescent) অন্তর্ভূক্ত ছিল আজকের সিরিয়া।
পশ্চিমে মিশর থেকে শুরু করে, ভূমধ্যসাগরকে ঘিরে, সিরিয়া, প্যালেস্তাইন, লেবানন হয়ে ইরান, তুরস্কের খানিকটা অংশ আর পূর্বদিকে ইরাক, ম্যাপের দিকে তাকালে দেখা যাবে এই অঞ্চলটার চেহারা অনেকটা হাঁসুলি বা কাস্তের মত। টাইগ্রিস-ইউফ্রেটিস আর নীলনদের জলে উর্বর মাটি এই হাঁসুলিতে সভ্যতা পত্তনের অনুকূল পরিবেশের সৃষ্টি করেছিল। যিশুখ্রিস্টের জন্মের প্রায় দশহাজার বছর আগের মনুষের বসতির প্রমাণ পাওয়া গেছে এখানে। চাকার ব্যবহার, নব্য প্রস্তরযুগে চাষবাস ও পশুপালন এমনকি বর্ণমালার উদ্ভবও হয়েছিল সিরিয়ায়। নীলনদের দান মিশর আর টাইগ্রিস-ইউফ্রেটিসের মাঝে মেসোপটেমিয়া (ইরাক), দুই বিখ্যাত প্রাচীন সভ্যতার সেতু ছিল সিরিয়া। হাজার হাজার বছর ধরে দুই সভ্যতার ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প সংস্কৃতির আদান প্রদান সমৃদ্ধ করেছে সিরিয়াকে। দলে দলে এসেছে মেসোপটেমিয়া থেকে সুমেরীয়, আসারীয়, আক্কাদরা, মিশর থেকে মিশরীয়রা, এশিয়া মাইনর থেকে হিটাইটরা। ঠিক আমাদের দেশের মতই "দুর্বার স্রোতে এল কোথা হতে, সমুদ্রে হল হারা"।[৪,৫] 

ভারতবর্ষের মতই সিরিয়াকেও বারবার বহিরাগতদের হাতে আক্রান্ত হতে হয়েছে। পর্যায়ক্রমে পারস্য সাম্রাজ্য, আলেক্সান্ডারের গ্রীক সাম্রাজ্য, রোমান সাম্রাজ্য, ইসলামিক আরব সাম্রাজ্য ও অটমান তুর্কি সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে সিরিয়া। আরব মুসলমানদের অধিকারের সময় থেকেই আরবি সিরিয়ার প্রধান ভাষা হয়ে ওঠে। পশ্চিমে স্পেন থেকে পূর্বে ভারতবর্ষের সীমান্তে হিন্দুকুশ পর্বতমালা, বিশাল ইসলামিক সাম্রাজ্যের রাজধানী হিসেবে দামাস্কাস নগরীর রমরমা বেড়ে যায়। খ্রিস্টধর্মের সঙ্গেও সিরিয়ার সম্পর্ক অত্যন্ত পুরনো। সেন্ট পল নাকি দামাস্কাসের পথে যিশুখ্রিস্টের দেখা পেয়ে ইহুদি মতবাদ ত্যাগ করে খৃষ্টধর্ম গ্রহণ করেন এবং দামাস্কাস থেকেই তাঁর নতুন ধর্মপ্রচারের কাজ শুরু করেন। নানা জাতিধর্মের সমাহার ঘটলেও আরব সুন্নীরাই ক্রমশ সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে উঠল। তবে তারা শিয়া, ইহুদী, মেরোনাইট ও আর্মেনীয় খ্রিস্টানদের সঙ্গে মোটামুটি শান্তিতেই সহাবস্থান করত।[৬] 

সালাদিন আপনাকে সম্ভবত ভেড়ার চামড়ার ওপর লেখা কয়েকটা নথি দিয়েছিলেন। আরামাইক ভাষায় লেখা ঐ নথিগুলোতে স্বয়ং যিশুখ্রিস্টের হাতের লেখা ছিল বলে সালাদিন অনুমান। প্রায় তিনহাজার বছরের পুরনো এই আরামাইক ভাষাতেই নাকি যিশু কথা বলতেন। দীর্ঘ বিবর্তনের ফলে এই ভাষা নানা উপভাষায় ভেঙ্গে গেছে। এখনও খ্রিস্টান ও ইহুদী ধর্মাবলম্বী পশ্চিম এশিয়ার অনেক বিচ্ছিন্ন জনজাতি এইসমস্ত উপভাষায় কথা বললেও আরামাইক ভাষাকে বিপন্ন বলেই ধরা হয়। ঐ নথির পাঠোদ্ধার করার আশায় আপনারা মম আলুলা গ্রামে গেলেন। দামাস্কাস থেকে ষাট কিলোমিটার দূরে পাহাড়ের খাঁজে গড়ে ওঠা এই গ্রামটির বৈশিষ্ট হল এখানকার হাজার দুয়েক অধিবাসী সকলেই পশ্চিমী আরামাইক ভাষায় কথা বলেন।[৭] এত জায়গা থাকতে এরা পাহাড়ের মধ্যে থাকে কেন এ ব্যাপারে সন্তু কৌতূহল  প্রকাশ করতে আপনি বললেন, "একসময় খ্রিস্টানরা ইহুদি আর রোমানদের ভয়ে পালিয়ে-পালিয়ে বেড়াত, লুকিয়ে থাকত। সেই রকমই একটা গোষ্ঠী এই পাহাড়ের গুহাগুলোয় আশ্রয় নিয়েছিল। এরা তাদেরই বংশধর। এখনও সেই সময়ের ভাষা বলে। তবে এখন নিশ্চয়ই এদের অনেকে চাকরিবাকরি করে। অন্য ভাষাও শিখেছে, তবু নিজেদের পুরনো ধারাটা বজায় রেখেছে"। ভাগ্যিস রেখেছিল, তাই চলতি সংঘর্ষের আঁচ থেকে এরা অনেকদিন অবধি নিজেদের বাঁচিয়ে রাখতে পেরেছিল। কিন্তু হাজার হাজার বছর ধরে সিরিয়ার ধর্মীয় সহিষ্ণুতার প্রতীক মম্ আলুলা আজ অস্তিত্বের সঙ্কটে। কদিন আগেই আল কায়দার উগ্রপন্থীরা ৮ জন নিরাপত্তারক্ষীকে খুন করে গ্রামটি দখল করে। পাল্টা অভিযান চালাচ্ছে সরকারি বাহিনীও।[৮]  আরামাইক ভাষা আর কদিন টিকে থাকবে বলা যাচ্ছেনা, কাকাবাবু। ভাগ্যিস সালাদিন ঐ দলিলটা আপনাকে দিয়ে দিয়েছিলেন, নাহলে এই অশান্তির মধ্যে ওটার কথা আর কে মাথায় রাখত!

শুধু মম্ আলুলা নয়, আড়াই বছরের গৃহযুদ্ধের শিকার হয়েছে প্রাচীন সভ্যতার বহু ঐতিহ্য। আল কাশিম ওরফে ইব্রাহিম আপনাদের যে ক্রাক দ্য শ্যাটেলিয়র দুর্গে আটকে রেখেছিল, সেটা তৈরী করেছিল কুর্দরা, একাদশ শতাব্দীতে। পরে তা ক্রুসেডারদের হাতে যায়। ইতিহাসের বহু ঘটনার সাক্ষী এই কেল্লার একটা টাওয়ার ভেঙে পড়েছে সেনাবাহিনীর বিমান হানায়। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সৈদনেয়ার কনভেন্ট অফ আওয়ার লেডি চার্চ, আলেপ্পোর বিরাট মসজিদ, বিখ্যাত আল মানার বাজার, প্রাচীন আসিরীয় মন্দির ও আরো অনেক ঐতিহাসিক নিদর্শন। হজরত মহম্মদের বিশ্বস্ত সঙ্গী হিজির আল কিন্দীর সমাধিও রেহাই পায়নি ইসলামের ধ্বজাধারী বিদ্রোহীদের হাত থেকে।[৯]

যাকে সিরিয়া বলছি সেই অঞ্চলের মধ্যে আজকের প্যালেস্তাইন, জর্ডন, লেবানন, এবং ইরাক ও তুরস্কের খানিকটা অংশও পড়ছে। আধুনিক সিরিয়ার পত্তন বলা যেতে পারে ফরাসী ম্যানডেটের মাধ্যমে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর বৃটিশ ও ফরাসীরা আরবভূমিকে নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেয়। ইরাক, প্যালেস্তাইন, জর্ডন বৃটিশরা দখলে নেয় আর ফরাসীদের ভাগে পড়ে সিরিয়া, লেবানন।[৬] দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৪৬ সালে সিরিয়া স্বাধীন হয়। ঠাণ্ডা যুদ্ধের সময় ও তা শেষ হওয়ার পরেও পশ্চিম এশিয়া ও উত্তর আফ্রিকা, যাকে মধ্যপ্রাচ্য বলা হয়, বিশ্বরাজনীতির নানা তৎপরতার সাক্ষী।  মিশরের আরব জাতীয়তাবাদী নায়ক আবদুল গামাল নাসেরের ডাকে সাড়া দিয়ে সিরিয়া মিশরের সঙ্গে জোট বেঁধে সংযুক্ত আরব প্রজাতন্ত্র গড়ে তোলে, কিন্তু বছর তিনেকের মধ্যেই আবার দুই দেশ  পৃথক হয়ে যায়। এদিকে তেলসমৃদ্ধ এবং রণনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ মধ্যপ্রাচ্যের ওপর ছড়ি ঘোরানোর জন্য সাম্রাজ্যবাদীরা চলে যাওয়ার আগে প্যালেস্তাইনের মাটিতে ইজরায়েল নামে ইহুদীদের জন্য একটা রাষ্ট্র খাড়া করে গেল। প্রসঙ্গতঃ ইহুদীরা ঐ অঞ্চলে দীর্ঘদিন ধরেই ছিল, আরবদের সঙ্গেই। তার ওপর হিটলারের উত্থানের পর ইউরোপ থেকে বিতাড়িত হয়ে ইহুদীরা দলে দলে চলে এলেন প্যালেস্তাইনে। তাঁদের জন্য স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের হয়ত প্রয়োজন ছিল, কিন্তু প্যালেস্তাইনের মধ্যে ইজরায়েলের প্রতিষ্ঠায় মধ্যপ্রাচ্যে যে সঙ্ঘাতের সূত্রপাত হল তা মেটার কোন সম্ভাবনা আজও দেখা যাচ্ছেনা। পশ্চিমীদের সমর্থনপুষ্ট ও উচ্চ সামরিক ক্ষমতার অধিকারী ইজরায়েল ছুতোনাতায় আরব দেশগুলোর ওপর হামলা চালিয়ে নিজের জমি বাড়িয়ে নিয়েছে। নিজভূমে পরবাসী হয়ে থাকছেন প্যালেস্তিনীয়রা। 

১৯৪৭ সালে সিরিয়ায় মাইকেল আফলাকের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয় আরব স্যোসালিস্ট বাথ পার্টি। আরব জাতীয়তাবাদ ও সমাজবাদী আদর্শ নিয়ে এবং অনেকটা লেনিনীয় গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার কাঠামো নিয়ে বাথ পার্টি দ্রুত ইরাক, লেবানন, জর্ডন, সুদান ইত্যাদি দেশে সংগঠন বিস্তৃত করে। ১৯৬৩তে বাথ পার্টি সিরিয়ায় ক্ষমতা দখল করল। সোভিয়েত ইউনিয়নের সাহায্যে প্রেসিডেন্ট জাহিদ সমাজতান্ত্রিক ধাঁচে দেশ গড়তে উদ্যোগী হলেন। কিন্তু ইজরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধে গোলান হাইট খোয়ানোর পর বাথ পার্টির আভ্যন্তরীন দ্বন্দ্ব চরমে উঠল। অবশেষে আবার একটা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে হাফেজ আল আসাদ পার্টি ও রাষ্ট্রের ক্ষমতা দখল করলেন। ১৯৭২ সালে গণভোটে আসাদ সাত বছরের জন্য রাষ্ট্রপতি হন। পরের বছর সংসদীয় নির্বাচনের মাধ্যমে সিরিয়া নতুন সংবিধান গ্রহণ করে। সিরিয়াকে মুসলিম জনবহুল ধর্মনিরপেক্ষ সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষনা করা হয়। কয়েকটা কমিউনিস্ট, বামপন্থী এবং জাতীয়তাবাদী দল ও সংগঠন কে নিয়ে বাথ পার্টির নেতৃত্বে গড়ে ওঠে জাতীয় দেশপ্রেমিক মোর্চা। এই মোর্চাই সরকার পরিচালনার দায়িত্ব নেয়।[১০] 

সিরিয়ার পাশাপাশি ইরাকেও বাথ পার্টি ক্ষমতা দখল করে, কিন্তু ভাগাভাগির চিরাচরিত নিয়ম মেনে বাথ আন্দোলন সিরিয়া ও ইরাকপন্থী অংশে ভেঙ্গে যায়। দুই গোষ্ঠির তিক্ততা এমন চরমে ওঠে যে ইরাক ইরান যুদ্ধ ও উপসাগরীয় যুদ্ধে সিরিয়া ইরাকের বিপক্ষে যোগ দেয়। ২০০৩ এ ইরাকে মার্কিন আক্রমণ ও ফাঁসির নামে সাদ্দাম হোসেনকে হত্যার বিরোধিতা অবশ্য সিরিয়া করেছিল।
প্রেসিডেন্ট আসাদ ছিলেন আলাওইট সম্প্রদায়ভুক্ত, যা আসলে শিয়া ইসলামেরই একটা শাখা, অথচ দেশের অধিকাংশ মানুষ সুন্নী মুসলমান। তাই একটা দ্বন্দ্ব ছিলই, কিন্তু ইসলামিক সাম্রাজ্য ও অটোমান তুর্কি সাম্রাজ্যের ঐতিহ্য মেনে সিরিয়ার শাসকগোষ্ঠী সুন্নী আরব, আলাওইট, খ্রিস্টান, কুর্দ সকলকে নিয়েই সহিষ্ণুতার বাতাবরণ বজায় রেখেছিলেন। আটের দশকের প্রথমদিকে মৌলবাদী শাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে মুসলিম ব্রাদারহুড হোমস, হামা ও আলেপ্পো শহরে হিংসাত্মক আন্দোলন শুরু করে। সেনাবাহিনীর পাল্টা আক্রমণে দশ থেকে পঁচিশ হাজার মানুষ নিহত হন। এর পর রাজনৈতিক স্বাধীনতা ও মানবাধিকার অনেকটাই নিয়ন্ত্রিত হয়। বাথ পার্টির ক্ষমতা দখলের সময় থেকেই সিরিয়ায় জরুরী অবস্থা বলবৎ ছিল।[১১]

হাফেজ আল আসাদ তাঁর উত্তরসূরী হিসেবে বড়ছেলে বাসেলকে ঠিক করে রেখেছিলেন। কিন্তু তিনি পথদুর্ঘটনায় নিহত হলে ছোট ছেলে বাসারের ভাগ্য খুলে গেল। বাবার ডাকে স্নাতকোত্তর পাঠ অসমাপ্ত রেখেই তিনি তরিঘড়ি দেশে ফিরলেন। আপনি কি এর সঙ্গে অন্য কোন ঘটনার মিল খুঁজে পাচ্ছেন? ঠিক ধরেছেন, সঞ্জয় গান্ধীর মৃত্যু না হলে তো রাজীবের ভাগ্যে শিকে ছিঁড়ত না! কে বলতে পারে, তাহলে হয়ত আজ বরুণ গান্ধীকেই নরেন্দ্র মোদীর উল্টোদিকে দেখা যেত! 

২০০০ সালে বাসার আল আসাদ হাফেজের মৃত্যুর পর মৃত্যুর পর প্রেসিডেন্ট হলেন বাসার আল আসাদ।
পেশায় সামরিক চক্ষু চিকিৎসক, বিলেতফেরত তরুণ প্রেসিডেন্টকে ঘিরে সিরিয়াবাসীর মধ্যে নতুন উদ্দীপনার সৃষ্টি হল।  ২০০৭ এর গণভোটে ৯৭% ভোট পেয়ে আসাদ বিপুলভাবে জয়ী হলেন। কিন্তু তাঁদের প্রত্যাশা পূর্ণ হল না। ওপর ওপর কিছু সংস্কার হলেও জরুরী অবস্থার প্রত্যাহার, গণতান্ত্রিক অধিকারের প্রসার বা বহুদলীয় নির্বাচনের কোন প্রক্রিয়াই শুরু হল না। তার সঙ্গে দুর্নীতি ও আসাদ পরিবারের স্বজনপোষণ তো ছিলই। সোভিয়েতের পতনের পর সিরিয়ার অর্থনীতিতে ধাক্কা আসে। সমাজবাদী পথ ছেড়ে মুক্ত অর্থনীতি বেছে নেওয়ার অবধারিত ফল হিসেবে আয়বৈষম্য বাড়তে লাগল। বহুদিন ধরে বজায় রাখা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিও টাল খেল। বিশেষ করে আরব ও কুর্দ সুন্নীরা নিজেদের বঞ্চিত ও শোষিত মনে করতে লাগলেন।[১২]

আপনারা সিরিয়া থেকে ফেরার কিছুদিনের মধ্যেই তিউনিশিয়া ও মিশরে স্বৈরতন্ত্র বিরোধী বিক্ষোভ শুরু হল এবং দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়ল গোটা আরব দুনিয়ায়, যাকে সাধারণভাবে আরব বসন্ত বলা হয়ে থাকে। ২০১১ সালের ১৫ই মার্চ সিরিয়ার দারা শহরে রাজনৈতিক বন্দীমুক্তি, দুর্নীতি প্রতিরোধ, জলসংকট নিরসন ও রাজনৈতিক সংস্কারের দাবীতে বিশাল বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হল। ক্রমশ এই আন্দোলন দেশের অন্যত্র প্রসার পেল এবং আর সব দাবীকে পিছনে ফেলে গণতন্ত্র ও রাজনৈতিক সংস্কারের দাবীটাই মুখ্য হয়ে উঠল। গঠিত হল ন্যাশনাল কোঅর্ডিনেশন কমিটি ফর ডেমোক্রাটিক চেঞ্জ। প্রথমদিকে দমন পীড়নের রাস্তা ধরলেও অচিরেই পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝল সরকার। ২৬শে মার্চ ২০০ জন বন্দী মুক্তি পেল। ২১শে এপ্রিল জরুরী অবস্থা উঠে গেল, শান্তিপুর্ণ রাজনৈতিক কার্যক্রমের অধিকার স্বীকৃত হল। এক বছরের মধ্যে বহুদলীয় নির্বাচনের সংস্থান রেখে নতুন সংবিধান রচিত হল। তুমুল অশান্তির মধ্যেই ভোট হল এবং সংসদের ৬০% শতাংশ আসনে জিতল বাথ পার্টি। অবশ্য বিদ্রোহীরা এই ভোট বয়কট করেছিল।[১৩]

কিন্তু এরমধ্যে ছবিটা বদলে গেছে। একইসঙ্গে মৌলবাদী সন্ত্রাস ও জায়নবাদী আগ্রাসনের প্রতিরোধ করে এবং ধর্মনিরপেক্ষতা ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতার পতাকা তুলে ধরে সিরিয়া নিজেকে আঞ্চলিক ও বহুজাতিক কায়েমী স্বার্থগুলোর শত্রু করে তুলেছিল। আলেপ্পোয় ফ্রি সিরিয়ান আর্মির ঘঁটি তারা এ সুযোগ ছাড়তে চাইবে কেন? তারা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ইন্ধন যোগাতে শুরু করল অশান্তিতে। সিরিয়ার সেনাবাহিনী থেকে একদল অফিসার ও সেনা বেরিয়ে গিয়ে তৈরী করল ফ্রি সিরিয়ান আর্মি। দেশের বিভিন্ন এলাকায় নাশকতা, সরকারি দপ্তর, স্কুল, হাসপাতাল, জনপদের ওপর হামলা চালিয়ে দেশের বেশ কিছু এলাকা দখল করল তারা। দেশের প্রধান বাণিজ্যিক কেন্দ্র আলেপ্পো সরকারি বাহিনীর কাছ থেকে ছিনিয়ে নিল। পাল্টা আক্রমণে গেল সিরিয়ার নিরাপত্তাবাহিনী। সরকারের হয়ে যুদ্ধে নেমে পড়ল অনেক আঞ্চলিক মিলিশিয়াও। ইজয়ায়েলি দখলদারির বিরুদ্ধে সংগ্রামরত লেবাননের হেজবোল্লা এবং প্যালেস্তাইনের পপুলার ফ্রন্টও সিরিয়া সরকারের পাশে দাঁড়াল। দুপক্ষের গোলাগুলিতে দুর্বিষহ হয়ে পড়ল সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা। একা রামে রক্ষা নেই, সুগ্রীব দোসর। ২০১২-র গোড়ার দিকে প্রতিষ্ঠিত হল আল নুসরা ফ্রন্ট। আল কায়দার এই শাখা গোষ্ঠীটি আপাতত আসাদের বিরুদ্ধে লড়লেও তাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য সিরিয়ায় শরিয়তি কানুন ও কট্টর সুন্নী ওয়াহাবী শাসন কায়েম করা। সরকারি বাহিনী ও বাথ পার্টির সমর্থকদের পাশাপাশি তাদের লক্ষ্য হয়ে উঠল দেশের খ্রিস্টান ও আলাওইট অধিবাসীরা। গণতন্ত্রের দাবীতে যাঁরা আন্দোলন শুরু করেছিলেন তাঁরা হারিয়ে গেলেন, অনেকে খুন হলেন উগ্রপন্থীদের হাতে।

কাকাবাবু, আপনার সঙ্গে তো হানি আলকাদির আলাপ হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথের ভক্ত এই বিপ্লবীটি আপনাকে বলেছিল, "যারা ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখতে জানেনা তারা কী করে বিপ্লবী হবে?"[১৪] আপনি যদি সিরিয়ার "বিদ্রোহীদের" হানি আলকাদির সঙ্গে গুলিয়ে ফেলে থাকেন তবে আপনাকে মহম্মদ তাতার কথা বলি শুনুন। গৃহযুদ্ধের ধাক্কায় ১৪ বছরের এই ছেলেটার আর পড়াশোনা এগোয়নি। সে আলেপ্পো শহরে একটা চায়ের দোকান চালাত। এক সকালে একজন খদ্দের তাকে ফ্রিতে এককাপ চা খাওয়াতে বললে সে বলে "স্বয়ং নবী এলেও বিনা পয়সায় চা দেবনা।" কিছুক্ষণের মধ্যেই একদল সশস্ত্র লোক এসে তাকে তুলে নিয়ে যায় এবং "নবীকে অবমাননা"র অপরাধে অভিযুক্ত করে গুলি করে মারে। এরা সকলেই ছিল ইসলামের স্বঘোষিত রক্ষক নুসরা ফ্রন্টের ক্যাডার এবং আলেপ্পো তখন বিদ্রোহীদেরই দখলে ছিল।[১৫] আপনি যদি মনে করেন এরকম কিছু উগ্রপন্থী থাকলেও বিদ্রোহীদের মধ্যে ধর্মনিরপেক্ষ অংশও আছে, তাহলে এই ভিডিওটা দেখুন,  http://www.youtube.com/watch?v=qxb8OFbwMQQ । এখানে দেখা যাচ্ছে ফ্রি সিরিয়ান আর্মির যোদ্ধা আবু সকর একজন সিরিয়ান সেনার পেট তার হৃৎপিণ্ড বের করে কামড় দিচ্ছে। পরে বিবিসির সঙ্গে সাক্ষাৎকারে সে বলে, শত্রুদের সন্ত্রস্ত করতেই তার এই কাজ এবং আমেরিকা শিগগির অস্ত্রশস্ত্র না পাঠালে সে এরকম কাণ্ড আরো করবে। সে এটাও উল্লেখ করতে ভোলেনা যে ঐ সেনা ছিল আলাওইট এবং তাদের মতে আলাওইটরা ঠিকঠাক মুসলমান নয়।[১৬] আল নুসরা এবং ফ্রি সিরিয়ান আর্মি উভয়েই বর্বরতা, গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত। যুদ্ধবন্দী সেনা, সাংবাদিক, ধর্মযাজক, ইমাম, বুদ্ধিজীবি ও অজস্র সাধারণ মানুষকে ঠাণ্ডা মাথায় নৃশংসভাবে হত্যা করেছে। একথা বলার অর্থ অবশ্য সিরিয়ার সেনাবাহিনীকে সার্টিফিকেট দেওয়া নয়। তারাও বিদ্রোহীদের দমন করতে গিয়ে সাধারণ মানুষকে মেরেছে।[২]

কাকাবাবু, আপনি জানেন আফগানিস্তান ও মধ্যপ্রাচ্যে সোভিয়েত প্রভাবকে খর্ব করার জন্য আল কায়দা ও তালিবানকে তৈরী করেছিল আমেরিকাই।[১৭] সোভিয়েতের পতন হলে দুপক্ষের স্বার্থের সঙ্ঘাত তীব্র হয়। তারপর এল ১১ই সেপ্টেম্বরের হামলা এবং সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ। কিন্তু ২০১১-র লিবিয়া ও সিরিয়া দেখিয়ে দিল তারা এখনও কমরেড ইন আর্মস। লিবিয়াতেও একই কৌশল, প্রথমে জেহাদিদের হাতে অস্ত্র দিয়ে লেলিয়ে দাও, তারপর সরকার প্রত্যাঘাত করলে "গণতন্ত্র বিপন্ন" ছুতো দেখিয়ে সরাসরি আগ্রাসন চালাও। রাশিয়া-চীন নিস্ক্রিয় থাকায় লিবিয়ায় তাদের কৌশল সফল হল। ভোটের মুখে গদ্দাফির সঙ্গে তাঁর গোপন আঁতাত ফাঁস হয়ে যাওয়ার ভয়ে ফরাসি প্রেসিডেন্ট সারকোজি গুপ্তচর পাঠিয়ে খুন করলেন গদ্দাফিকে।[১৮] তবে পাপ যে তার বাপকেও ছাড়েনা তা আবার প্রমাণ হল যখন "মুক্ত" লিবিয়ায় আল কায়দার জঙ্গিদের হাতে নিজের দপ্তরেই খুন হলেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত।[১৯]

বিদেশী যোদ্ধাদের সিরিয়ায় ক্রমবর্ধমান তৎপরতা সিরিয়াকে সন্ত্রাসবাদীদের মুক্তাঞ্চল করে তুলতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। ইরাক, জর্ডন, মিশর এমনকি তাজিকিস্তান, চেচানিয়া থেকেও ওয়াহাবি জঙ্গিরা সিরিয়ার বিদ্রোহে অংশ নিয়েছে।[২০] পাকিস্তান থেকে তালিবানদের একটা দলও সিরিয়ায় গেছে আসাদ হঠানোর লক্ষ্যে।[২১] আমেরিকা আল নুসরাকে সন্ত্রাসবাদী তালিকাভুক্ত করলেও তাদের বিরুদ্ধে কার্যত কোন ব্যবস্থা তো নেয়ইনি, বরং জর্ডন ও তুরস্কের মাটিতে ঘাঁটি গেড়ে সিআইএ অফিসাররা নুসরা সমেত সব ধরনের বিদ্রোহীদেরই প্রশিক্ষণ ও পরামর্শ দিচ্ছে।[২২] সিরিয়া সরকারের অভিযোগ অনুযায়ী অস্ত্রও সরবরাহ করছে। দামাস্কাসে প্রাক্তন মার্কিন রাষ্ট্রদূত রবার্ট ফোর্ড বিদ্রোহীদের সংঘটিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।
কাকাবাবু, আপনি নিশ্চয়ই সিরিয়াকে নিয়ে আমেরিকার মাথাব্যাথায় অবাক হচ্ছেন, কারণ সিরিয়া অর্থনৈতিক ও সামরিকভাবে দুর্বল একটা দেশ, তাদের তেলসম্পদও খুব বেশী নয়। আসলে যত ছোটই হোক, লেবাননের গৃহযুদ্ধ থামিয়ে, প্যালেস্তাইনের মুক্তিসংগ্রামে সবরকমভাবে পাশে দাঁড়িয়ে সিরিয়া আরব দুনিয়ায় সমীহ আদায় করে নিয়েছে এবং আমেরিকা-ইজরায়েলের সাম্রাজ্যবাদী দখলদারির সামনে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে। তাছাড়া ইসলামি বিপ্লবের সময় থেকেই ইরান আমেরিকার ঘোরতর শত্রু, বুশ কথিত শয়তানের অক্ষের অন্তর্ভূক্ত। ইজরায়েলের সামরিক শক্তির সঙ্গে টক্কর দেওয়ার ক্ষমতা মধ্যপ্রাচ্যে একমাত্র ইরানেরই আছে। তাই ইরানকে সমঝে দেওয়াও একটা উদ্দেশ্য।[২৩] 

এবছরের মে মাস থেকে থেকেই ছবিটা ঘুরতে শুরু করে। এফএসএ জঙ্গিরা লেবাননে শিয়া বসতির ওপর হামলা চালালে হেজবোল্লা তাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নামতে বাধ্য হয়। হেজবোল্লা ও সরকারি সেনা যৌথ আক্রমণ চালিয়ে আল কোয়াসার শহরটি পুনরুদ্ধার করে।[২৪] শহরটি রণনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ সরকারের কাছে কোয়াসার যেমন দামাস্কাস ও হোমস শহরের সংযোগ রক্ষা করছে তেমনি বিদ্রোহীদের কাছে এটা ছিল লেবানন হয়ে অস্ত্রপাচারের পথ। এর পর আরো কয়েকটা জায়গায় সাফল্য পায় সরকারি সেনা, এফএসএ ও নুসরা পিছু হঠতে থাকে। তার সঙ্গে বিদ্রোহীদের আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ মাথাচাড়া দিতে শুরু করে। ফ্রি সিরিয়ান আর্মির কমান্ডার আবু বসির আল লকদানি খুন হলেন আল কায়দা জঙ্গিদের হাতে।[২৫] কুর্দিশ বিদ্রোহীরা প্রথমদিকে সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই করলেও পরে তারা ঘোষণা করে গৃহযুদ্ধের ফলাফল যাই হোক না কেন কুর্দরা সিরিয়ার ভেতরেই স্বশাসিত প্রদেশ গঠন করবে।[২৬] এটা মেনে নিতে না পেরে নুসরা ও ইসলামিক স্টেট অফ ইরাক অ্যান্ড লেভেন্ট কুর্দিশদের ওপর হামলা চালায়।[২৭]

২১শে আগষ্ট দামাস্কাসের উপকন্ঠে ঘুটা শহরে রাসায়নিক অস্ত্রের আক্রমণে হাজারের বেশী মানুষের মৃত্যু হয়, যাদের মধ্যে বেশীরভাগই শিশু।[২৮] এটা ঘটেছে এমন একটা সময় যখন রাষ্ট্রসঙ্ঘের পর্যবেক্ষকরা আগের একটা রাসায়নিক হামলার তদন্তে সিরিয়ায় ছিলেন। রাষ্ট্রসঙ্ঘের মহাসচিবের আহ্বানে সাড়া দিয়ে সিরিয়া সরকার পর্যবেক্ষকদের ঘুটায় গিয়ে নমুনা সংগ্রহের অনুমতি দেয়। কাকাবাবু, আপনি শুনেছেন যে এই হামলায় ব্যবহার করা হয়েছিল নার্ভ এজেন্ট সারিন গ্যাস। এটাও নিশ্চয়ই জানেন যে বিদ্রোহীরা এবং আমেরিকা, বৃটেন, ফ্রান্সের মত তাদের পৃষ্ঠপোষকরা সিরিয়া সরকারকেই দায়ী করেছে এবং সিরিয়াকে শাস্তি দেবার জন্য সামরিক অভিযান চালানোর পরিকল্পনা করছে। কিন্তু আপনি কি এটা শুনেছেন যে গত মে মাসে তুরস্কের আদনান শহরে পুলিস আল নুসরা ফ্রন্টের ১২ জন সদস্যকে ২ কেজি সারিন গ্যাস সহ গ্রেপ্তার করে?[২৯] পরে অবশ্য তুর্কি সরকার এঘটনার কথা অস্বীকয়ার করেছিল। আরো একটা মারাত্মক তথ্য উঠে এসেছে মিন্টপ্রেস সংবাদসংস্থার অনুসন্ধানে। ঘুটায় গ্যাসে আক্রান্ত মানুষ, ডাক্তার, বিদ্রোহী ও তাদের পরিবার এবং সাধারণ নাগরিকদের সাক্ষ্য থেকে জানা গেছে সৌদি আরবের গোয়েন্দা প্রধান বান্দার বিন সুলতান ঐ অস্ত্রগুলো বিদ্রোহীদের কাছে পাঠিয়েছিলেন। তবে চোঙাকৃতি গ্যাসবোতলের মত দেখতে ওগুলো কি ধরনের অস্ত্র বা কিভাবে ওগুলো ব্যবহার করতে হয় তা বিদ্রোহীরা জানত না বলে দাবী করেছেন সেদিনের ঘটনায় নিহত এক বিদ্রোহীর বাবা। একটা টানেলে সেগুলোকে লুকিয়ে রাখতে গিয়ে তারা বিস্ফোরন ঘটিয়ে ফেলে বলে সহযোদ্ধারা জানিয়েছেন।[৩০] 

বছরখানেক আগেই মার্কিন রাষ্ট্রপতি ওবামা রাসায়নিক অস্ত্রের ব্যবহারকে লালদাগ ঘোষণা করে বলেছিলেন ঐ লালদাগ অতিক্রম করলেই তাঁর সরকার সরাসরি সিরিয়ায় সামরিক হস্তক্ষেপ করবে। কাকাবাবু, আপনি নিশ্চয়ই মানবেন যে সিরিয়ার সরকার যখন বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে সাফল্য অর্জন করছে, তখন খামোকা রাসায়নিক অস্ত্র প্রয়োগ মার্কিন আক্রমণকে নেমন্তন্ন করা তাদের পক্ষে চরম আহাম্মকি? আর আমেরিকার ওপর সৌদি আরবের নির্ভরতার কথা মাথায় রাখলে এটা বিশ্বাস করা কঠিন যে আমেরিকাকে না জানিয়েই সৌদি সুলতান সিরিয়ায় রাসায়নিক অস্ত্র পাঠিয়েছেন। এই সূত্রগুলো কিন্তু সিরিয়াকে ঘিরে একটা মারাত্মক চক্রান্তের দিকে ইঙ্গিত করছে। 

আন্তর্জাতিক রাজনীতি এখন সিরিয়াকে ঘিরেই আবর্তিত হচ্ছে। প্রথম থেকেই সিরিয়ার বিদ্রোহীদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সাহায্য ও মদত দিয়ে চলেছে সৌদি আরব, কাতার, তুরস্ক, ইজরায়েলের মত আঞ্চলিক শক্তি এবং আমেরিকা, ব্রিটেন, ফ্রান্সের মত সাম্রাজ্যবাদীরা। এই সমস্ত দেশগুলো সিরিয়ার সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে বিদ্রোহীদের জোট সিরিয়ান ন্যাশনাল কোয়ালিশানকে সিরিয়ার জনগণের একমাত্র বৈধ প্রতিনিধি বলে স্বীকৃতি দিয়েছে। আরব লীগের আমীর, শেখ, সুলতানরা গণভোটে নির্বাচিত আসাদকে স্বৈরাচারী আখ্যা দিয়ে সিরিয়াকে বহিস্কার করেছে। অন্যদিকে সিরিয়ার পাশে আছে ইরান। সোভিয়েত সঙ্গে সিরিয়ার যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল তা বজায় আছে রাশিয়ার সঙ্গেও। তারা প্রথম থেকেই দুপক্ষের আলোচনার মাধ্যমে রাজনৈতিক সমাধানের ওপর জোর দিয়েছে। রাষ্ট্রসঙ্ঘ নিযুক্ত মধ্যস্থতাকারী কোফি আন্নান এবং পরে লাখদার ব্রাহিমি অবশ্য সে কাজে ব্যর্থ হয়েছেন। 

লালদাগ অতিত্রান্ত হওয়ার পর ওবামা এবার নতুন উদ্যমে সিরিয়ায় হামলার ছক কষেছেন। আগে দুবার রাশিয়া চীনের ভেটোয় রাষ্ট্রসংঘকে শিখণ্ডী করার চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ায় এবার তাঁর কথায় "পক্ষাঘাতগ্রস্ত" রাষ্ট্রসঙ্ঘকে পাশ কাটিয়েই যা করার করতে চান তিনি। তবে সম্ভবতঃ রাসায়নিক অস্ত্রের ভয়েই সেনা না নামিয়ে আকাশপথে ষাট দিনের "সীমাবদ্ধ" আক্রমণের প্রস্তাব পেশ হয়েছে মার্কিন সেনেটে। কিন্তু এনিয়ে ওবামা কূটনৈতিকভাবে অনেকটাই ব্যাকফুটে। সিরিয়ার সংকটে দেশকে জড়ানোর প্রস্তাব খারিজ করেছে বৃটিশ পার্লামেন্ট। জার্মানী কোনরকম সামরিক অভিযানে যোগ দেবেনা বলে জানিয়ে দিয়েছে। গ্রীস তাদের সামুদ্রিক ঘাঁটিগুলো ব্যবহার করতে দিতে অস্বীকার করেছে। ভারত স্পষ্টভাবে রাষ্ট্রসঙ্ঘের অনুমোদন ছাড়া কোনরকম সামরিক তৎপরতার বিরোধিতা করেছে। এমনকি আরব লীগ ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়নও রাষ্ট্রসঙ্ঘের নেতৃত্ব ছাড়া অভিযানে আপত্তি জানিয়েছে। একমাত্র ফ্রান্স যুদ্ধ করতে এক পায়ে খাড়া। যে ফ্রান্সের রক্ষণশীল প্রেসিডেন্ট জ্যাক শিরাক ইরাক যুদ্ধের কড়া বিরোধিতা করেছিল, সেই ফ্রান্সের স্যোসালিস্ট প্রেসিডেন্ট হোলান্দে এখন আসাদকে সরাতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন। রাজনীতি বড় বিষম বস্তু কাকাবাবু! হয়ত সিরিয়া একসময় ফ্রান্সের উপনিবেশ ছিল বলে ঐ দেশের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করা তাদের কর্তব্য বলে ফ্রান্স মনে করে। ওদিকে ভূমধ্যসাগরের মার্কিন নৌবহর সিরিয়ামুখী হতেই চাপ বাড়াতে রাশিয়াও দুটো রণতরী পাঠিয়েছে। ইরান জানিয়ে দিয়েছে হামলা হলে তারা শেষ অবধি সিরিয়ার পাশে থাকবে।

শেষপর্যন্ত কি হবে, আসাদ কি আত্মসমর্পণ করবেন না কি সাদ্দাম-গদ্দাফির মত যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণ দেবেন, সিরিয়া কতটা প্রতিরোধ করতে পারবে সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের, রাশিয়া-ইরানের ভূমিকা কি হবে তা ভবিষ্যতই বলবে; কিন্তু সিরিয়ার মানুষের জন্য যে এখনও অসীম দুর্গতি অপেক্ষা করছে তাতে সন্দেহ নেই। তবে তাঁরা দুবছরে এই পরিস্থিতির সঙ্গে নিজেদের অভ্যস্ত করে নিয়েছেন। মার্কিন হুঙ্কারের বিরুদ্ধে এককাট্টা দামাস্কাসবাসী জানিয়ে দিয়েছেন তাঁরা কোন বিদেশী শক্তির কাছে মাথা নোয়াবেননা, প্রেসিডেন্ট আসাদের পাশেই থাকবেন।[৩১] এমনকি সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনরত সমাজকর্মীও বলছেন, "এ দেশের মানুষ বিদেশের সেনাকে দেশের মাটিতে দেখতে চায়না। স্বাধীনতা নিজেরাই রক্ষা করবে দেশের মানুষ।"[৩]

আমি ভাবছিলাম সাবা কাব্বানির কথা। আপনি যখন সন্তুকে জিজ্ঞেস করলেন, "এই দেশের কোন মানুষটাকে আমাদের সারাজীবন মনে থাকবে বল তো?" সে একটুও চিন্তা না করে বলল, "সাবা কাব্বানি"। কাব্বানি একজন কুর্দ, ইরাকে বাড়ি, সেখানকার আর্মিতে কাজ করত। সাদ্দাম হোসেনের পতনের পর একদিকে আমেরিকার দখলদারি, অন্যদিকে জাতিদাঙ্গায় ইরাক ছাড়খার হয়ে গেল। সব দেশেই যা হয়, যেকোন সমস্যার আঁচে সব থেকে বেশি পোড়ে কাব্বানির মত সংখ্যালঘুরা। একদিন রাত্রে কারা যেন তার বাড়িতে হামলা চালিয়ে আগুন লাগিয়ে দিল। ছেলের মাথায় বোমা পড়ল, বাকিরা ইরাক ছেড়ে পালিয়ে এল সিরিয়ায়। তার আরো এক মেয়েও হারিয়ে গিয়েছিল ইরাক যুদ্ধের সময়। সে বলেছিল, "জানি না, আল্লা আমাদের কপালে আরো কত কঠিন পরীক্ষার কথা লিখে রেখেছেন"। সাবা কাব্বানি এখন কোথায়? সে কি মাটি কামড়ে পড়ে আছে সিরিয়ায়, না ফিরে গেছে তার নিজের দেশ ইরাকে? নাকি আবার পাড়ি জমিয়েছে অন্য কোথাও, পরের পরীক্ষার মুখোমুখি হওয়ার জন্য?




তথ্যসূত্র:
[১] সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, আরবদেশে সন্তু কাকাবাবু, আনন্দ পাবলিশার্স
[২] Facebook page of Syrian Observatoryfor Human Rights
[৩] নিসান আহমাদো, নিঃশ্বাসে বিষ বিশ্বাসে দ্রোহ, এবেলা, ৩০ আগষ্ট, ২০১৩
[৪] দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় ও রমাকৃষ্ণ মৈত্র, পৃথিবীর ইতিহাস, অনুষ্টুপ
[৫] Fertile Crescent, Wikipedia
[৬] History of Syria, Wikipedia
[৭] Robert Fisc, Maaloula, the past has relevance to Syria's tragic present, The Independent, September 3, 2012
[৮] Syria Islamist rebels take control of historic Christian town of Maaloula, CNN, September 8, 2013
[৯] List of heritage sites damaged during Syrian civil war, Wikipedia,  Al-Qaeda Takfiris Destroying World’s Heritage, Syrianews, May 2, 2013
[১০] Ba'ath Party, Wikipedia
[১১] Syria Profile: A chronology of key events, BBC
[১২] Bashar al-Assad, Wikipedia
[১৩] Timeline of the Syrian civil war, Wikipedia
[১৪] সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, মিশর রহস্য, আনন্দ পাবলিশার্স
[১৫] Al-Qa'ida Islamists kill Syrian boy, 15, for "insulting the prophet", The Australian, June 11, 2013 
[১৬] Paul Wood, Face-to-face with Abu Sakkar, Syria's 'heart-eating cannibal' BBC, July 5, 2013
[১৭] Norm Dixon, How the CIA created Osama bin Laden, Green Left Weekly, September 19, 2001,
Noam Chomsky interviewed by David Barsamian, The United States is a Leading Terrorist State, Monthly Review, vol. 53, no. 6, November, 2001
[১৮] French spy shot dead Gaddafi on Nicolas Sarkozy's order, The Indian Express, October 1, 2012
[১৯] Al-Qaeda indicates responsibility for killing US envoy in Libya, urges more attacks, The Times of Israel, September 15, 2012
[২০] As foreign fighters flood Syria, fears of a new terrorist haven, The Times of India, August 8, 2013
[২১] Pakistan Taliban says its fighters in Syria, Al Jazeera, July 16, 2013
[২২] Al-Nusra leader meets CIA officials, Alalam, August 30, 2013
[২৩] দেবাশিস চক্রবর্ত্তী, কার যুদ্ধ সিরিয়ায়, গণশক্তি, ৩১শে আগষ্ট, ২০১৩,
নাজেস আফরোজ, রাসায়নিক অস্ত্রে হঠাৎ এত আপত্তি!, আনন্দবাজার পত্রিকা, ৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৩
[২৪] Battle of al-Qusayr (2013), Wikipedia
[২৫] Key Free Syria Army rebel 'killed by Islamist group', BBC, July 12, 2013
[২৬] War in Syria inspires Kurdish unity, Al Jazeera, July 27 2013 
[২৭] Kurds, Islamists clash in north Syria, at least 12 jihadists killed, The Daily Star Lebanon, August 03, 2013 
[২৮] 2013 Ghouta attacks, Wikipedia
[২৯] Turkey finds sarin gas in homes of suspected Syrian Islamists, Strategic Culture Foundation, May 31, 2013
[৩০] Dale Gavlak and Yahya Ababneh, Syrians In Ghouta Claim Saudi-Supplied Rebels Behind Chemical Attack, August 29, 2013 
[৩১] নিয়তির হাতে ভবিতব্যকে সঁপেছে দামাস্কাস, বর্তমান, ৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৩

Tuesday 19 September 2017

সাতনায় সাবধান

সেবার মধ্যপ্রদেশ যাচ্ছিলাম চারজনে মিলে। শিপ্রা এক্সপ্রেস যখন সাতনা স্টেশনে থামল তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেলে ঢলতে আরম্ভ করেছে। সাতনা নিয়ে খুব একটা প্ল্যান ছিল না। পরের দিন খাজুরাহো যাওয়ার কথা। চিত্রকূট পাহাড়ের কথা শুনেছিলাম, কিন্তু হাফবেলায় চিত্রকূট অভিযান সম্ভব ছিল না। ট্রেনে এক মাড়োয়ারি ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। খাসা লোক। জেনেরেটরের ব্যবসা। সেই কাজেই সাতনা যাচ্ছেন। শ্রীরূপার সঙ্গে খাঁটি হিন্দিতে গপ্পো জমিয়ে দিলেন। মেয়ে জামাই কুয়েত না ইউএই কোথায় যেন থাকে। ছেলে আছে। ছেলের বৌ একটা ইংরেজি স্কুলে পড়ায়। পুত্রবধুর চাকরি করাটাকে তিনি বেশ সহজভাবেই মেনে নিয়েছেন। নিজের স্ত্রীকে বলেছেন "ও যদি সংসারের কাজ গুছিয়ে চাকরি করতে পারে তোমার অসুবিধে কি? তুমি ধর্মকর্ম নিয়ে থাকো।" আমাদের মিষ্টি অফার করলেন, "মারোয়াড়ি মিষ্টি টেস্ট করে দেখুন?" উনি একটু বাথরুমে যেতেই তন্ময় বলল "মিষ্টিটা ফেলে দে। রেলের নোটিশ দেখিসনি, অপরিচিত ব্যক্তির হাত থেকে খাবার খাবেন না?" আমি তো জাতপেটুক, তাই ওসব সতর্কবাণীতে কান দিলাম না। আর সৌম্য আপার বাঙ্কে চাদর চাপা দিয়ে নাক ডাকাচ্ছিল। মিষ্টি খেয়ে আবার উঠে নাক ডাকাতে লাগল। তো সেই মাড়োয়ারি ভদ্রলোক বলেছিলেন, "সাতনায় যখন নামছেন, মাইহারের সারদা মন্দির অবশ্যই দেখবেন। ভীষণ জাগ্রত।" ভক্তিভাব কারোরই প্রবল না হলেও শেষমেশ মাইহার যাওয়াই মনস্থ করলাম। একটা হোটেলে অতিকষ্টে "পিওর ভেজ থালি" খেয়ে এসে ট্যাক্সিস্ট্যান্ডে খোঁজ করে গণেশ প্রজাপতি নামে এক ছোকরা কে তন্ময়ের পছন্দ হল। সে ট্যাক্সি চালানোর পাশাপাশি একটা কলেজে বিটেক করছে। ঠিক হল মাইহার তো ঘুরিয়ে আনবেই, পরের দিন আমাদের খাজুরাহোতেও ছেড়ে আসবে। 



মাইহার সাতনা স্টেশন থেকে প্রায় ৪৫ কিমি দূরে। পৌঁছতে সন্ধ্যে হয়ে গেল। গাড়ী দাঁড়ালো পাহাড়ের নিচে। তারপর রোপওয়ে করে প্রায় ৫০০ মি উঁচু পাহাড়ের ওপর চড়া। দড়ির লাইন বেয়ে একটা বাক্সে চারজন উঠলাম। নিচের দিকে ক্রমশঃ ছোট হয়ে আসা শহর ও জঙ্গল দেখে বুক কেঁপে উঠল। বিশেষতঃ যখন বাক্সটা লোহার রেলিং দিয়ে দিক বদলাচ্ছিল, মনে হচ্ছিল এই বুঝি দড়ির বাঁধন ত্যাগ করে দেশলাই বাক্সটা খাদের পথে যাত্রা করে! যত ওপর দিকে উঠছি, নীচের শহর ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর হচ্ছে আর অন্ধকার গাঢ় হওয়ার সাথে সাথে তলায় বিন্দু বিন্দু আলোর ফুলকি জ্বলে উঠছে। রোপওয়ে আমাদের নিয়ে গেল পাহাড়ের একদম মাথায়, মন্দিরের সামনে। মন্দিরের মধ্যে একটা সরু রাস্তা দিয়ে লাইন দিতে হল সারদা ওরফে দুর্গা মা কে দেখার জন্য। দেখি সে লাইন আর নড়ছেই না। আমাদের কারোরই ভক্তিভাব নেই, পাহাড়ে চড়তেই এসেছিলাম, মাতাজিকে দর্শন দেবার বিশেষ আগ্রহ ছিল না। শ্রীরূপা বলল চলো ফিরে যাই। কিন্তু ফেরার রাস্তা বন্ধ, আমাদের পেছনে তখন প্রচুর লোক লাইন দিয়েছেন। একজন পুরোহিতকে সামনে পেয়ে বললাম আমার স্ত্রীর শরীরটা ভালো লাগছে না, ফিরে যাব। তিনি বললেন, মাতাজি কে দর্শন না করে ফেরা যাবে না। আরেকজন পুরোহিতকে ডেকে আমাদের দেখিয়ে কিছু বললেন, সম্ভবত আমরা যাতে পালাতে না পারি সেইদিকে নজর রাখতে বললেন। আরেকটু এগোতেই দেখলাম আরেকটা রাস্তা দিয়ে লোক পিলপিল করে লোক ঢুকছে। কপালে গেরুয়া ফেট্টি বাঁধা। হাতে লাঠি, মুখে উন্মত্ত স্লোগান, "মাতাজি কি জ্যেএএএ"। এরা সবাই হেঁটে পাহাড়ে উঠছে।  চোখে ভেসে উঠল টিভিতে দেখা কুম্ভমেলা বা মক্কায় তীর্থযাত্রীদের পদপিষ্ট হয়ে মৃত্যুর ছবি। মনে পড়ল মধ্যপ্রদেশ দীর্ঘদিনের বিজেপি শাসিত রাজ্য। প্রাণ নিয়ে বাঁচতে পারলে হয়! তন্ময় খেয়াল করল রোপওয়ের দিকে লাইন একটু হালকা হয়েছে। চারজন চটপট ঘুরে উল্টোদিকে দৌড় দিলাম। এক পুরুত বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলেও তাকে এড়িয়ে আমরা কোনরকমে গিয়ে রোপওয়েতে বসলাম। যে বিপদ থেকে পালিয়েছি, সেটার কথা ভেবেই বোধহয় ফেরার সময় রোপওয়ে নিয়ে কোন আর ভয় রইলনা। 

সেদিনটা ছিল দুর্গাপুজোর দশমী। ফেরার পথে কয়েকটা দুর্গাঠাকুর দেখলাম, ভাসানের জন্য বেরিয়েছে। লক্ষ্য করলাম এই দুর্গাঠাকুরের দুটো মাত্র হাত, সঙ্গে তাঁর ছেলেমেয়েরাও নেই। ডান হাতে ত্রিশূল থাকলেও বাঁহাত শঙ্কাহরণ করে না। "ললাটনেত্র আগুণবরণ" বটে কিন্তু "দুই নয়নে স্নেহের হাসি" নেই। বুঝলাম এই সারদা মাতাজি আমাদের গিরিকন্যা উমা নন। কার্তিক-গণেশ-লক্ষী-সরস্বতীর স্নেহময়ী মা-দুর্গা নন। ব্যোম ভোলানাথের দশভূজা পার্বতীও নন। বরের ওপর রাগ করে বাপের বাড়ি চলে আসার মানুষোচিত চপলতা তাঁর মানায় না। ছেলেমেয়েদের নিয়ে বিউটি পার্লারে যাওয়ার স্বাধীনতা তাঁর নেই। তিনি শুধু মহিষাসুরকে বধ করেন।

ফেরার সময় গণেশজি জানালেন মাতাজিকে দর্শন না করে পিঠ দেখিয়ে চলে আসলে মৃত্যু অনিবার্য। দুবছর হতে চলল, আমরা সবাই অক্ষতদেহে বেঁচে আছি। তবু গণেশজি যখন বলেছেন, মৃত্যু নিশ্চয়ই অবধারিত! তাই আর দেরি না করে সেদিনের অভিজ্ঞতার কথা লিখে ফেললাম।