Tuesday 18 April 2017

পাহাড়ের ডায়েরি (১)


শিলিগুড়ি থেকে প্রায় ৭০-৮০ কিলোমিটার যাওয়ার পরেও যখন একটা হালকা ঠাণ্ডা হাওয়ার বেশী কিছু পাচ্ছিলাম না তখন তেড়ে গাল দিচ্ছিলাম অনির্বাণ কে। আমাদের টিম লিডার তো সেইই। ধুয়োটা অবশ্য তুলেছিল পল্লব। "সিকিমে হিলে-ভার্সে বলে একটা জায়গা আছে; যাবি নাকি?" ৬ জন হাত তুললাম। পরে অবশ্য ২ জন ছেঁটে গেল। রইলাম বাকি ৫। আমি (অতনু), পল্লব, অনির্বাণ, বব আর আমার সহধর্ম্মিণী শ্রীরূপা। আমাদের মধ্যে অনির্বাণ ছাড়া ট্রেকিং এ সবাই নবিশ। তো অনির্বাণ আগে থেকেই বলে রেখেছিল, "ওখানে কিন্তু হেব্বি ঠাণ্ডা, ভালো করে গরম জামাকাপড় নিয়ে নিবি।" সেইমত এপ্রিলের গরমে বাক্সয় ঢুকে যাওয়া শীতের জামাকাপড় বের করে ব্যাগ ভর্তি করেছি। এখন শীতের এই চেহারা দেখে কার না মাথা গরম হয়? অনির্বাণের উপদেশের মাহাত্ম অবশ্য পরে টের পেয়েছিলাম হাড়ে হাড়ে। আক্ষরিক অর্থেই!


তিস্তা নদী, গাড়ি থেকে তোলা।

এনজেপি স্টেশনে আমাদের ট্রেন ঠিক সময়েই পৌঁছেছিল। তারপর রিটায়ারিং রুমে একটু হালকা হয়ে যখন সাগরভাইয়ের গাড়িতে উঠলাম তখন সকাল সাড়ে নটা। শিলিগুড়ি শহর পেরিয়ে তিস্তার পাশ দিয়ে পাক খেয়ে খেয়ে পাহাড়ে উঠলাম। ধাপে ধাপে বাড়িঘরগুলো ছোট হয়ে এলো। পুলিস চেকপোস্ট পেরিয়ে পশ্চিমবঙ্গ থেকে সিকিমে ঢুকলাম। তিস্তা ও রঙ্গিতের সঙ্গমস্থলে দাঁড়িয়ে কিছু ছবিটবি তুললাম। সাগরভাই মাঝেমধ্যেই গাড়ি দাঁড় করিয়ে কিছু জিনিসপত্র তুলছিলেন। আবার সেগুলোকে তাদের গন্তব্যস্থলে নামিয়ে দিচ্ছিলেন। রাস্তার ধারে সুন্দরী নেপালি মহিলাদের হাত নাড়া দেখে বোঝা গেল সাগরভাই এখানে বেশ পপুলার। অনেকটা রাস্তা, সবারই ছোটবাইরে যাওয়ার প্রয়োজন। আমরা ছেলেরা যেকোন জায়গায় কাজ সারতে পারি, কিন্তু সঙ্গে একটা মেয়ে আছে। সাগরভাইকে বলতে তিনি আশ্বস্ত করলেন। খানিকবাদে গাড়ি দাঁড়ালো ঝাঁ চকচকে একটা বিশাল মন্দিরের সামনে। কিন্তু আমাদের তো মন্দির দর্শনের কোন বাসনা ছিল না। সাগরভাই বললেন "অন্দরমে টয়লেট ভি হ্যায়!" আহ! নাস্তিক হিসেবে মন্দিরের উপযোগিতা এই প্রথম উপলব্ধি করলাম। জায়গাটার নাম দরমদিন। ফেরার দিন এই সাগরভাই-ই আমাদের এনজেপি নিয়ে যাবেন। আর আমরা নিজে থেকেই তাঁকে বলব, "ঊও মন্দিরমে থোরা রোক দিজিয়ে না, টয়লেট যানা হ্যায়!"


সাগরভাই গাড়ি থামিয়ে একটা দোকান থেকে কিছু কেনাকাটা করছিলেন। সেই ফাঁকে আমরা পা ছাড়িয়ে নিচ্ছিলাম। স্কুলফেরতা এই মেয়েটাকে দেখে পল্লব পটিয়ে ছবি তোলার জন্য রাজি করিয়ে ফেলল।


হিলে তে যখন পৌঁছলাম তখন ৬টা বাজে। সূর্য ডুবে গেছে, তবু কিছু আলোর আভা রয়েছে। যেখানে গাড়ি থামল তার সামনে জঙ্গল, পরে জেনেছি ওটাই ভার্সে যাওয়ার পথ। বাঁদিকে একটু উঁচুতে সার দিয়ে চারটে কুঁড়েঘর। এগুলোই আপাততঃ আমাদের মাথা গোঁজার ঠাঁই। আর ডানদিকে নিচে একটা ফাঁকা জায়গা। সেখানে আর্মির ক্যাম্প বসেছে। আমাদের মধ্যে বব ঘোর দেশপ্রেমিক। ইন্ডিয়ান আর্মি দেখেই ভীষণ উত্তেজিত হয়ে সে ক্যাম্পে দর্শন দিতে যাচ্ছিল। কিন্তু এক কর্তব্যরত জওয়ান নিষেধ করলেন। আর্মি ক্যাম্পে যাওয়া আর ছবি তোলা দুটোই বারণ। পাঁচটা কুঁড়েঘরের মধ্যে দুটো থাকার জায়গা, দুটো রান্নাঘর। শেষে একটা টয়লেট। ঘরে ১৫-২০ জন লোক স্বচ্ছন্দে থাকতে পারে। আপাততঃ একটা ঘর আমাদের পাঁচজনের দখলে। ঘরে বসতে না বসতেই ড্রাগন আঁকা সুদৃশ্য চিনামাটির কাপে ধোঁয়া ওঠা অদ্ভুত স্বাদের লিকার চা আর প্লাস্টিকের বাটিতে ম্যাগি চলে এলো। এখানে জলখাবার হিসেবে ম্যাগি বেশ চলে। আসলে যদিও ম্যাগি নয়, ওয়াই ওয়াই।


ট্রেকার্স হাট, হিলে


এই প্রথম ট্রেকিং এ যাচ্ছি, সবার বাড়িতেই চিন্তা আছে। কিন্তু পৌঁছানোর খবর দেবো কি করে? নেটওয়ার্ক কখন হাপিস হয়ে গেছে। এই "ট্রেকার্স হাট" আর আর্মি ক্যাম্প ছাড়া এলাকায় জনমানবের চিহ্ন নেই। রাস্তাটা ধরে একটু উঠে এক নেপালি মহিলাকে দেখে হিন্দিতে জিজ্ঞাসা করলাম, এখানে কোন ল্যান্ডলাইন আছে কি না। তিনি কি বুঝলেন কে জানে, বাঁদিকে হাত দেখিয়ে বললেন, "ওই ল্যাম্পপোস্টের কাছে চলে যান।" কিন্তু ল্যাম্পপোস্ট পেরিয়ে কয়েক হাত এগিয়েও কিছু চোখে পড়ল না। একটু ওপরে সামান্য আলো আর একজন মানুষকে দেখে একই প্রশ্ন করতে তিনি পালটা জিজ্ঞাসা করলেন, "ভোডোফোন?" আমরা হ্যাঁবাচক মাথা নাড়তে তিনি আবার ঐ ল্যাম্পপোস্টটাই দেখিয়ে দিলেন। সেই ল্যাম্পপোস্টের তলায় দাঁড়াতেই কি আশ্চর্য! দিব্যি টাওয়ার পাওয়া যাচ্ছে! চটপট যে যার বাড়িতে জানিয়ে দিলাম ঠিকঠাক পৌঁছেছি। আর এ কদিন ফোনে যোগাযোগ করা সম্ভব নাও হতে পারে। 


পাহাড়ে জলখাবারের কমন আইটেম হল ম্যাগি।


যত রাত বাড়তে লাগল ঠাণ্ডা কাকে বলে বুঝতে পারলাম। পরের দিন ১০০০০ ফুট উঁচ্চতায় ভার্সেতে কি হতে চলেছে তারও একটা আঁচ পেলাম। ফুলশার্টের ওপর ফুল সোয়েটার, জ্যাকেট, মাথায় মাফলার, টুপি পরেও কাঁপুনি থামানো যাচ্ছিল না। তার ওপর টয়লেট যেতে হবে দুটো ঘর পেরিয়ে। ঘরে টিমটিম করে একটা বাল্ব জ্বললেও বাইরে কোন আলো নেই। যে টর্চটা এনেছিলাম সেটা বিগড়ে গেছে। বড়বাইরে পেলে অতএব মোবাইলই ভরসা! হাতে গড়া রুটি, সেদ্ধ না হওয়া ফুলকপি আর ছালশুদ্ধু মুরগির মাংসের ঝোল দিয়ে নৈশাহার সেরে সোয়েটারের ওপর কম্বল চাপা দিয়ে শুয়ে পড়লাম। পরদিন সকালেই ট্রেকিং শুরু হবে। পল্লব ভূতের গল্প শুরু করল। শুনতে শুনতে ঘুমে তলিয়ে গেলাম। 


হিলেতে সূর্যোদয়

অন্যান্য পর্বের লিঙ্কঃ

No comments:

Post a Comment