Sunday 23 June 2013

এই মিছিল


এই প্রথম মিছিলে হাঁটলাম। এই প্রথম সম্মিলিত প্রতিবাদের ঢেউয়ে রেজোন্যান্স হল। এই প্রথম হাজারো মানুষের ভিড়ে খুঁজে ফিরলাম নিজেকে।

এই মিছিল ছিল কামদুনির কলেজে পড়া হতভাগা মেয়েটার জন্য। এই মিছিল ছিল গাইঘাটার ধর্ষিতা শিশুটার জন্য। এই মিছিল ছিল দিল্লীর দামিনীর জন্য। এই মিছিল ছিল শারীরিক ধর্ষণের পরও বারবার সামাজিকভাবে ধর্ষিত হওয়া পার্ক স্ট্রীটের সুজেটের জন্য। এই মিছিল ছিল সিঙ্গুরের তাপসী মালিক, নন্দীগ্রামের রাধারাণী আড়ি, বানতলার অনীতা দেওয়ানের জন্য। এই মিছিল ছিল কাশ্মীর, মণিপুর, ছত্তিশগড়ে "নিরাপত্তা বাহিনী"র হাতে প্রাণ ও ইজ্জত খোয়ানো মা-বোনদের জন্য। এই মিছিল ছিল গুজরাটে মোদীবাহিনীর হাতে ধর্ষিতা মহিলাদের জন্য।

এই মিছিলে ছিল সেই মেয়েটা, যে রোজ পুরূষের লোভী দৃষ্টি ও কামুক হাতের নাগাল দিয়ে যাতায়াত করে। এই মিছিলে ছিল সেই বউটা, প্রতিরাতে যাকে দাম্পত্যের নামে ধর্ষিতা হতে হয়। এই মিছিলে ছিল সেই শিশুটা, সুযোগ পেলেই যার বাবা-কাকা-দাদা রা শরীরে হাত বুলোয়। এই মিছিলে ছিল সেই ছেলেটা, "মেয়েলি" হওয়ার অপরাধে যাকে বন্ধুরা টিটকিরি দেয়, আর সেই মেয়েটা, "পুরূষালি" ভাবের জন্য যার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের অবস্থান নিয়ে খবরের কাগজে গবেষণা চলে। এই মিছিলে ছিল সেই ছেলেটা যে তার ছেলেবন্ধুকে ভালবাসে আর সেই মেয়েটা যে তার মেয়েবন্ধুর সঙ্গে ঘর বাঁধতে চায়। এই মিছিলে ছিল সেই মেয়েটা, যাকে রোজ মুখে রঙ মেখে খদ্দেরের জন্য রাস্তায় দাঁড়াতে হয় পেটের দায়ে।

এই মিছিল মানে গলার শির ফুলিয়ে স্লোগান আর গলায় পোস্টার ঝুলিয়ে চুপচাপ হেঁটে যাওয়া। এই মিছিল মানে লাঠিহাতে বৃদ্ধ আর ব্যাগকাঁধে অফিসফেরতা কেরানী। এই মিছিল মানে নিরাপত্তার দাবী, এই মিছিল মানে সংবেদনশীলতার দাবী। এই মিছিল মানে ইনকিলাব জিন্দাবাদের পাশে সমকাম চুম্বনের ছবি। এই মিছিল মানে বঙ্কিমচন্দ্রের বাণী আর সলিল চৌধুরীর শপথ। এই মিছিলে হাঁটেন কন্ঠে গণসঙ্গীতের সুর, চোখে বিপ্লবের স্বপ্নমাখা রবিঠাকুর।

এই মিছিল কোন রাজনৈতিক দল ডাকেনি। এই মিছিলে কোন রাজনৈতিক দলের পতাকা ছিল না। এই মিছিলে কোন রাজনৈতিক নেতা নেতৃত্ব দেয়নি। এই মিছিলের জন্য কেউ গ্রামে গঞ্জে বাস-ট্রাক পাঠায়নি। তবু এই মিছিল ছিল পুরোদস্তুর রাজনৈতিক। কারণ রাজনীতিটা কোন নেতানেত্রীর ব্যক্তিগত জমিদারি নয়। কারণ রাজনীতিটা কোন দলের খিড়কির উঠোন নয়। কারণ রাজনীতিটা কোন কর্পোরেট মিডিয়ার জ্ঞান বিতরণের পাঠশালা নয়। রাজনীতিটা মানুষের, রাজনীতিটা মানুষের জন্য, রাজনীতিটা হবে মানুষের দ্বারা।


যারা ধর্ষণকে সাজানো ঘটনা বলে, প্রতিবাদীদের চোখ রাঙায়, যারা "ক্ষতিপুরণ" দিয়ে মুখ বন্ধ করতে চায়, যারা ভোটের জন্য মস্তান পোষে, এই মিছিল তাদের গালে একটা থাপ্পর। যারা ধর্ষিতার চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলে, যারা খাটো জামাকে ধর্ষণের কারণ হিসেবে তুলে ধরতে চায়, যারা মেয়েদের রাতবিরেতে না বেরোতে পরামর্শ দেয়, এই মিছিল তাদের গালে একটা থাপ্পর। যারা রাস্তার আন্দোলনকে মেঠো রাজনীতি বলে ব্যঙ্গ করে, যারা রাজনীতিকে মার্কিন মুলুকের মত টিভির টক শো তে পরিণত করতে চায়, এই মিছিল তাদের গালে একটা থাপ্পর। যারা কামদুনি নিয়ে চিৎকার করে, অথচ বানতলার কথা শুনলেই পেছন চুলকোয়, এই মিছিল তাদের গালেও একটা থাপ্পর।

এই মিছিল স্যালুট জানায় টুম্পা কয়ালের অকুতোভয় প্রতিবাদকে। এই মিছিল স্যালুট করে "ক্ষতিপুরণে"র টাকা প্রত্যাখ্যান করা ধর্ষিতার পরিবারগুলিকে। এই মিছিল স্যালুট করে ক্ষমতার দম্ভের বিরুদ্ধে সুজেটের লড়াইকে। এই মিছিল স্যালুট করে নন্দীগ্রাম, লালগড়ের লড়াকু মহিলাদের। এই মিছিল স্যালুট জানায় মণিপুরী মায়েদের নগ্ন প্রতিবাদকে। এই মিছিল মাথা নত করে একযুগ ধরে অনশনরত শর্মিলা চানুর সামনে।

এই মিছিল মানে সম অধিকারের দাবী, এই মিছিল মানে সম মর্যাদার দাবী। এই মিছিল দেখায় প্রতিবাদের পথ। এই মিছিল আনে সুন্দর ভবিষ্যতের স্বপ্ন। 

"প্রতিভা আর যশোদা মার রক্ত বীজ এই মিছিল,
 স্বামীহারা অনাথিনীর চোখের জল এই মিছিল; 
শিশুহারা মাতাপিতার অভিশাপের এই মিছিল, 
এই মিছিল সব হারায় সব পাওয়ার এই মিছিল।"



(ঋণঃ সলিল চৌধুরী)


রাজ্যজুড়ে নারী নির্যাতন, ধর্ষণ এবং প্রশাসন ও শাসকদলের কর্তাদের পক্ষ থেকে অপরাধীদের আড়াল করার চেষ্টার প্রতিবাদে ২০১৩ সালের ২১শে জুন কলকাতায় যেঁ মহামিছিল হয়েছিল সেই প্রসঙ্গেই এই লেখা। প্রথম প্রকাশঃ চর্যাপদ

No comments:

Post a Comment