Tuesday 26 May 2020

তিন বিপর্যয় ও কিছু ভাবনা

করোনা অতিমারী, ঘূর্ণিঝড়, পঙ্গপাল হানা -- দুহাজার কুড়ি সালের প্রথমার্ধে একটার পর একটা বিপর্যয়ের মধ্যে কোন দৈব দুর্বিপাক না থাকলেও কয়েকটা সাধারণ বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয়৷

প্রথমত এই সবকটা বিপর্যয়ের সঙ্গেই জড়িয়ে আছে প্রকৃতির ওপর মানুষের দখলদারি৷ সার্স, মার্স, ইবোলার মত নোভেল করোনা ভাইরাসের মানবশরীরে অনুপ্রবেশ বন্যজন্তুদের জীবনে মানুষের অকারণ হস্তক্ষেপের ফল৷ সমুদ্রে ঘন ঘন অতি গভীর নিম্নচাপের সৃষ্টি ও তার ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হওয়ার ঘটনা সরাসরি জড়িত বিশ্ব উষ্ণায়ণের সঙ্গে৷ মরুভূমির পঙ্গপালদের "নিঃসঙ্গ দশা" থেকে "দলবদ্ধ দশা"য় উত্তরণ, বিপুল হারে বংশবৃদ্ধি, এক মহাদেশ থেকে অন্য মহাদেশে ছড়িয়ে পড়া এইসবের সঙ্গেও জলবায়ু পরিবর্তনের সম্পর্ক আছে বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত৷

দ্বিতীয়তঃ একটা ভাইরাস কিভাবে পশু থেকে মানুষের দেহে প্রবেশ করে নিজেকে মিউটেট করে, দেহের কোন অঙ্গকে কিভাবে আক্রমণ করে, দেহে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা কিভাবে কাজ করে, সংক্রমণের লক্ষণ ও তা এড়ানোর উপায় কি; সমুদ্রের নিম্নচাপ কিভাবে ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হয়, তা কখন কোন পথে স্থলভাগে প্রবেশ করে, তার গতি ও ক্ষমতাই বা কত হতে পারে; পঙ্গপাল কিভাবে, কোন পরিবেশে একক দশা থেকে ঝাঁকে রূপান্তরিত হয়, তারা কিভাবে এক মহাদেশ থেকে অন্য মহাদেশে পাড়ি দেয় এই সব কিছু বলতে পারে একমাত্র বিজ্ঞান৷ বিজ্ঞানের সেই তথ্যকে কাজে লাগিয়ে প্রশাসন উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে পারে যাতে ক্ষয়ক্ষতি ন্যূনতম হয়৷ যে জিনিসটাকে মানুষ সবচেয়ে বেশী গুরুত্ব দেয় সেই ধর্ম বা ঈশ্বরের এর মধ্যে কোন ভূমিকা নেই৷

তৃতীয়তঃ নোভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হয় চীনের উহান শহরে৷ সেখান থেকে তা ছড়িয়ে পড়েছে গোটা পৃথিবীতে৷ ঘূর্ণিঝড় আমফানের উৎপত্তি বঙ্গোপসাগরে, তার নামকরণ করেছে তাইল্যান্ড, সে আছড়ে পড়েছে পশ্চিমবঙ্গ, ওড়িশা ও বাংলাদেশে৷ পঙ্গপালের ঝাঁক আরব মরুভূমিতে দল পাকিয়ে পূর্ব আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য ঘুরে ইরান, পাকিস্তান হয়ে ঢুকেছে ভারতে৷ কিছু মানুষ এখনও "দেশ" বলতে কাঁটাতারে ঘেরা একটা ভূখণ্ডের বেশী কিছু বোঝেন না, আর সেই ভূখণ্ডের কয়েক ইঞ্চি নিয়ে প্রতিবেশীর সঙ্গে লাঠালাঠি করাকেই দেশপ্রেমের পরকাষ্ঠা বলে গণ্য করেন, সেই ভূখণ্ডের বৈধ অধিবাসীদের তালিকা বানানোর জন্য কোটি কোটি টাকা খরচ করে মানুষের জীবন অতিষ্ঠ করে তোলাকে অত্যন্ত জরুরী কাজ মনে করেন৷ প্রকৃতি আমাদের কান ধরে বুঝিয়ে দিল ঐসব কাঁটাতারের সীমানা আসলে কতটা ঠুনকো৷

চতুর্থতঃ জাতীয়তা ছাড়াও এই ধর্ম, ভাষা ইত্যাদি যেসব নিয়ে মানুষ লড়ালড়ি করতে ভালোবাসে, করোনাভাইরাস, আমপান, পঙ্গপালের দল কেউই সেসব ভাগাভাগি কে পাত্তা দিচ্ছে না৷ তার মানে কি সব মানুষ সমানভাবে বিপর্যস্ত হচ্ছেন? না তাও নয়৷ লকডাউনে কর্মহীন দিনমজুর, ভিনরাজ্যে আটকে পড়ে হাজার মাইল হেঁটে পারি দেওয়া পরিযায়ী শ্রমিক, ঘরবন্দী অবস্থায় অবসাদগ্রস্থ চাকুরীজীবি, মুনাফা কমে যাওয়ার আশঙ্কায় থাকা শিল্পপতি - সবার সঙ্কট একরকম নয়৷ ঘূর্ণিঝড়ে বিদ্যুৎ, জল, নেটওয়ার্ক না পাওয়া শহরবাসী আর বাড়ি ধ্বসে যাওয়া সুন্দরবনবাসীর সমস্যাগুলোও আলাদা আলাদা৷ পঙ্গপালের হানায় শস্যহানির আতঙ্কে ভোগা কৃষক আর খাদ্যশস্যের মূল্যবৃদ্ধির শঙ্কায় থাকা মধ্যবিত্তর অবস্থার মধ্যেও ফারাক আছে৷ এককথায় বলতে গেলে যে মানুষ অর্থনৈতিকভাবে যত দুর্বল, তাঁর বিপর্যয়ের মাত্রাও তত বেশী৷

এখন প্রতিটা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্য আছে, সেগুলোর মোকাবিলার কৌশলও একেবারেই স্বতন্ত্র৷ তবে সাধারণভাবে বলা যায় যেকোন বিপর্যয়ের মোকাবিলার দুটো দিক আছেঃ একটা দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনাঃ বিপর্যয় আবার আসার সম্ভাবনা কমানো৷ আরেকটা তাৎক্ষণিকঃ বিপর্যয় যখন এসে পড়বে, ক্ষয়ক্ষতি যেন ন্যূনতম হয়৷ দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার অঙ্গ হল প্রকৃতির নিয়মকে বোঝা, তার ক্ষতি যথাসম্ভব কম করা, যে ক্ষতি ইতিমধ্যে হয়ে গেছে তার খানিকটা অন্তত পূরণ করা৷ আর তাৎক্ষণিক কৌশলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হল যে মানুষ অর্থনৈতিকভাবে যত দুর্বল, তাকে তত বেশী সুরক্ষা দেওয়া৷ আর এর দুয়ের জন্যই প্রয়োজন সমাজে মুক্তচিন্তা, বিজ্ঞানচর্চার পরিবেশ উন্নত করা, জনমুখী প্রশাসন ও দক্ষ জনস্বাস্থ্য পরিকাঠামো গড়ে তোলা এবং সঙ্কীর্ণ জাত্যাভিমান ত্যাগ করে আন্তর্জাতিক সমন্বয়কে জোরদার করা৷


চিত্রসূত্রঃ এই সময়, ২৬শে মে, ২০২০

পল্লব দত্তর সংযোজনঃ ইদানিং যে বনাঞ্চল ধ্বংস শুরু হয়েছে, সে আমাজন থেকে উত্তরাখন্ড, অস্ট্রেলিয়া থেকে অযোধ্যা। অনেকাংশেই সন্দেহজনকভাবে ঘটা অগ্নিকাণ্ডে পুড়ে যাচ্ছে বিশাল বনভূমি! গাছ কাটা নয় এখন আরো মারাত্মক উপায়ে বনাঞ্চল ধ্বংস করার উপায় বার করে ফেলেছে মাফিয়ারা! এবং কোথাও কোথাও রাষ্ট্রীয় মদতে! আমাজন বনাঞ্চলের ক্ষেত্রেই যেমন প্রেসিডেন্ট Bolsonaro এর বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে! গত কয়েক বছরে অগ্নিকাণ্ডে বনাঞ্চল ধ্বংস হওয়ার ঘটনা উল্লেখযোগ্য ভাবে বেড়েছে।আবার ভারতে নর্মদা ভ্যালিতে তৈরী প্যাটেল স্ট্যাচু ওই অঞ্চলের স্বাভাবিক ইকোসিস্টেম থেকে স্থানীয় বাসিন্দাদের জীবন সবক্ষেত্রেই ভীষণ নেগেটিভ প্রভাব ফেলেছে। বিগত দশকে এমন উদাহরণ ভুরি ভুরি পাওয়া যাবে যেখানে মাফিয়ারা নয়, রাষ্ট্র নিজেই বনাঞ্চল ধ্বংস করায় সক্রিয় ভূমিকা নিচ্ছে!

No comments:

Post a Comment