Friday 8 May 2020

লকডাউনে পড়া বইঃ গান্ধী গবেষণা

ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীনতার পথে রওনা দেওয়া প্রায় সমস্ত জাতিই তার পিতৃত্ব অর্পণ করে থাকে তার স্বাধীনতা সংগ্রামের কেন্দ্রীয় ভূমিকায় থাকা কোন এক ব্যক্তির ওপর৷ জাতির জনক কোন ব্যক্তি হতে পারেন কি না তা নিয়ে বিতর্ক আছে, থাকবে৷ কিন্তু ভারতবর্ষ বোধহয় একমাত্র দেশ, যার "জাতির জনক" কে স্বাধীন দেশে কুৎসিততম ভাষায় আক্রমণ করা এমনকি তাঁর হত্যাকারীকে মহিমান্বিত করা অপরাধ বলে গণ্য হয় না৷ পান্নালাল দাশগুপ্তর "গান্ধী গবেষণা" বইটা পড়তে পড়তে মনে হল এটার জন্য গান্ধীজি নিজেই দায়ী৷ নিজেকে তো তিনি কোন অবিসংবাদী নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চাননি৷ তিনি নিজেই ঠিক, বাকি সবাই ভুল - এমন ধারণা তিনি কখনও পোষণ করেননি৷ বরং সারাটা জীবন ব্যাপৃত থেকেছেন সত্যানুসন্ধানের কাজে৷ তিনি যে সত্যকে খুঁজে পাচ্ছেন, তা যে খণ্ডিত সত্য, আপেক্ষিক সত্য এব্যাপারেও তিনি সচেতন৷ তাঁর মৃত্যুর পর যেন "গান্ধীবাদ" নামক কোন সঙ্কীর্ণ মতবাদ তৈরী করার চেষ্টা করা না হয় সে বিষয়েও তিনি অনুগামীদের সতর্ক করে দিয়েছেন৷ কাজেই বলা যায় গান্ধীজি এমন দেশ দেখতে চাননি, যেখানে তাঁকে গালিগালাজ করলে শাস্তি পেতে হবে৷ আর তাঁর যে হত্যাকারী সে তো অনেক আগেই তাঁকে হত্যার ব্যর্থ চেষ্টা করেছিল আর গান্ধী তাকেও তখন ক্ষমা করে দিয়েছিলেন৷

পান্নালাল দাশগুপ্ত যৌবনে সশস্ত্র বিপ্লবের পথে স্বাধীনতা অর্জনে প্রয়াসী ছিলেন৷ স্বাধীনতার পরেও তাঁকে কারাবরণ করতে হয়৷ আলোচ্য গন্থটির পাণ্ডুলিপি তিনি লিখেছিলেন ১৯৫৪-৫৫ সালে জেলে বসে৷ তিরিশ বছর পর সেটি বই আকারে প্রকাশিত হয়৷ ইতিমধ্যে দেশ ও বিশ্বের পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়েছে, লেখকের ভাবনাচিন্তাও বদলেছে৷ কিন্তু তিনি মূল পাণ্ডুলিপিকে অপরিবর্তিত রেখেই নতুন চিন্তাভাবনাকে ফুটনোটের মাধ্যমে ব্যক্ত করেছেন৷ "গান্ধী গবেষণা" নামটির দুটি তাৎপর্য আছেঃ গান্ধীজির নিজের সত্যানুসন্ধানের গবেষণা এবং গান্ধীজিকে নিয়ে অন্যদের গবেষণা৷ একজন কমিউনিস্ট বিপ্লবী হিসেবে তিনি মার্কসবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে গান্ধীজির মূল্যায়ন করেছেন৷ তাঁর উদ্দেশ্য বামপন্থীদের কাছে গান্ধীজি কে নতুনভাবে দেখানো এবং তথাকথিত গান্ধীবাদীদের কাছে ঐতিহাসিক গান্ধীকে তুলে ধরা৷ পরিশিষ্ট সহ বইটির মোট ১৫ টি অধ্যায়ঃ (১) গান্ধী ও সত্য, (২) গান্ধীজির ভগবান ও ধর্ম, (৩) অহিংসা, (৪) সত্যাগ্রহ, (৫) সত্যাগ্রহ বনাম দুরাগ্রহ, (৬) গঠনমূলক কাজ, (৭) রবীন্দ্রনাথ ও গান্ধী, (৮) গান্ধীজি ও সুভাষচন্দ্র, (৯) হরিজন-আদিবাসী-মজুর ইত্যাদি, (১০) ট্রাস্টিশিপ বা অছিপ্রথা, (১১) নারীজাতির উন্নয়ন, (১২) গান্ধীজি ও ব্যক্তি, (১৩) গান্ধী ও ইতিহাস, (১৪) গান্ধীবাদ। আগ্রহী পাঠক বইটা থেকে যথেষ্ট ভাবনার খোরাক পাবেন বলে আমার বিশ্বাস৷ কয়েকটা দিক সংক্ষেপে উল্লেখ করছি, যেগুলো আমার কাছে তাৎপর্যপূর্ণ মনে হয়েছে৷


প্রথমতঃ গান্ধীজির সঙ্গে "অহিংসা" কে অনেক সময়েই অবিচ্ছেদ্য ভাবে জুড়ে দেওয়া হয়৷ কিন্তু বাস্তবে তাঁর কাছে "সত্যে"র স্থান ছিল অনেক ওপরে৷ তিনি একাধিকবার বলেছেন, সত্যের সন্ধান করতে গিয়েই তিনি অহিংসা কে পেয়েছেন এবং প্রয়োজনে সত্যের খাতিরে অহিংসা কে ত্যাগ করতেও প্রস্তুত৷ লেখক দেখিয়েছেন বেশ কয়েকটা ক্ষেত্রে তিনি বলপ্রয়োগের ব্যাপারে সম্মতি দিয়েছেন৷ অহিংসা কোন ভীরুর ধর্ম ণয় এবং অহিংসা হিংসা কে এড়িয়ে চলে না বা হিংসা কে অস্বীকার করে না৷ বরং হিংসার মুখোমুখি দাঁড়ানোটাই অহিংস সত্যাগ্রহর বৈশিষ্ট্য৷

দ্বিতীয়তঃ ডগমা বা গোঁড়ামিকে গান্ধীজি সারাজীবন পরিহার করে চলতে চেয়েছেন৷ যে মতবাদই হোক, তাকে বিনা প্রশ্নে মেনে নেওয়া চলবে না৷ সেকারণে তাঁর মত ও বিশ্বাসের পরিবর্তন হয়েছে৷ আগে তিনি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের মহত্বের ওপর আস্থাশীল ছিলেন, উপনিবেশগুলোর ওপর শোষণ নেহাতই বিচ্যূতি বলে মনে করতেন এবং ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের মধ্যে থেকেই ভারত নিজের মর্যাদা পুনরুদ্ধার করতে পারবে বলে বিশ্বাস করতেন৷ সেই বিশ্বাস ক্রমে মুছে যায়৷ চৌরিচৌরার ঘটনা নিয়ে তিনি অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহার করেন, কিন্তু ৪২ এ হিংসার সম্ভাবনা কে মাথায় রেখেই ভারত ছাড়ো আন্দোলনের ডাক দেন৷ পরম ধার্মিক, নিষ্ঠাবান হিন্দু হিসেবে তাঁর বিশ্বাস ছিলঃ God is Truth. পরে তিনি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে Truth is God. হিন্দু সমাজের বর্ণপ্রথা নিয়ে তাঁর যে মোহ ছিল তা থেকেও তিনি ভবিষ্যতে সরে আসেন৷

তৃতীয়তঃ মার্কসবাদীরা গান্ধীজি কে বুর্জোয়া নেতা হিসেবে ব্যাখ্যা করতেন, কেউ কেউ আরো কয়েক ধাপ এগিয়ে তাঁকে "সাম্রাজ্যবাদের এজেন্ট" অভিধা দিতেন৷ লেখক গান্ধীজির শ্রেণীচরিত্র বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন, গান্ধীজি আদৌ ধনিক শ্রেণীর প্রতিনিধি ছিলেন না, বরং গরীব, খেটে খাওয়া মানুষ বিশেষ করে কৃষকশ্রেণীর সঙ্গেই তাঁকে সবচেয়ে বেশী আইডেন্টিফাই করা যায়৷ আর তিনি যে শুধু সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তাই নয়, তিনি পুঁজিবাদেরও বিরোধী ছিলেন এবং তাঁর নেতৃত্বে স্বাধীনতা সংগ্রামের চরিত্র চীন বিপ্লবের মতই নয়া গণতান্ত্রিক চরিত্রের৷ পঞ্চাশের দশকে জেলের অভ্যন্তরে বসে লেখকের ধারণা হয়েছিল ভারত নেহরুর নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক পথে এগিয়ে চলবে৷ পরে তাঁর ভুল সংশোধন করেছেন৷

চতুর্থতঃ বইয়ের ১৫ টি অধ্যায়ের মধ্যে সর্ববৃহৎ অধ্যায়টি হল "গঠনমূলক কাজ"৷ 
যুদ্ধের জন্য বা সশত্র বিপ্লবের জন্য যেমন ট্রেনিং এর দরকার, তেমনি অহিংস সত্যাগ্রহের জন্যও প্রস্তুতির প্রয়োজন৷ সেটাই হল গঠনমূলক কাজ৷ কুটিরশিল্প, চরকা, বয়স্ক শিক্ষা, গোরক্ষা, হিন্দু মুসলমান ঐক্য, হরিজন সেবা ইত্যাদি নানাবিধ গঠনমূলক কাজ এবং অর্থনীতি, নৈতিকতা, শ্রমের মাধ্যমে শিক্ষা ইত্যাদি বিষয়ে গান্ধীজির পরিকল্পনা নিয়ে এই অধ্যায়ে লেখক আলোচনা করেছেন৷ এই প্রসঙ্গে একটা কথা মনে হয়৷ রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ ও ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি প্রায় একই সময়ে গঠিত হয়৷ কমিউনিস্ট পার্টি রাজনৈতিক লড়াইয়ের পাশাপাশি নানাবিধ গণসংগঠনের মাধ্যমে গঠনমূলক কাজ করার চেষ্টা করেছে ঠিকই কিন্তু গণসংগঠনগুলোর ওপর পার্টির নিয়ন্ত্রণ প্রশ্নাতীত৷ পার্টিই নিয়ন্ত্রণ করেছে শ্রমিক ও কৃষক সংগঠনকে, উল্টোটা হয়নি৷ অন্যদিকে আরএসএস নিজেরা সক্রিয় রাজনীতিতে না জড়িয়ে গঠনমূলক (নেতিবাচক অর্থে) কাজে মনোনিবেশ করেছে৷ তার রাজনৈতিক শাখাগুলো কিন্তু নিয়ন্ত্রিত হয়েছে সঙ্ঘের দ্বারা৷ আজ একশো বছর পর ভারতের রাজনৈতিক পরিস্থিতি দেখে আমরা বুঝতে পারি গান্ধীজির গঠনমূলক কাজের তাৎপর্য৷






গান্ধী গবেষণা,
পান্নালাল দাশগুপ্ত,
নবপত্র প্রকাশন৷ দাম ২৫০ টাকা৷

4 comments:

  1. বইটি খুবই সুন্দর ... আপনার লেখাটি বইটির উপর যথাযথ আলোকপাত করেছে

    ReplyDelete