Saturday 20 June 2020

সূর্যগ্রহণ নিয়ে কিছু কথা।

আজ আকাশে করোনা দেখা যেতে পারে৷ না, করোনা ভাইরাস নয়৷ সূর্যের মুকুট অর্থাৎ বায়ুমণ্ডলের সবচেয়ে বাইরের অংশ হল করোনা৷ সাধারণ সময়ে আমরা সূর্যের যে অংশটা দেখি তা হল ফটোস্ফিয়ার৷ তার বাইরে ক্রোমোস্ফিয়ার এবং করোনা ফটোস্ফিয়ারের থেকে অনেক বেশী উত্তপ্ত হলেও পদার্থের ঘনত্ব খুব কম হওয়ার কারণে ঐ অঞ্চলগুলোর উজ্জ্বলতাও কম৷ তাই করোনাকে দেখা সম্ভব যদি ফটোস্ফিয়ারকে পুরোপুরি আড়াল করে দেওয়া যায়৷ পুরোপুরি না হলেও কাল ফটোস্ফিয়ারকে প্রায় ৩৯ সেকেন্ডের জন্য অনেকখানি ঢেকে দেবে চাঁদ৷ এত ভ্যানতাড়া করে যেটা বললাম সেটা হল আজ সূর্যগ্রহণ৷ বলয়গ্রাস সূর্যগ্রহণ৷ তিনটে মহাজাগতিক ঘটনা যুগপৎ ঘটলে বলয়গ্রাস সূর্যগ্রহণ ঘটতে পারে৷ (১) সূর্য ও চাঁদ উভয়েই পৃথিবীর একই দিকে থাকবে (যা প্রতি অমাবস্যাতেই ঘটে), (২) সূর্য, পৃথিবী ও চাঁদ একই তলে থাকবে, (৩) পৃথিবী থেকে চাঁদের দূরত্ব সর্বাধিক হবে৷ এর মধ্যে প্রথম দুটো শর্ত পূরণ হলেই সূর্যগ্রহণ ঘটে৷ কিন্তু বলয়গ্রাস অর্থাৎ আগুণের আংটি দেখার জন্য চাই তৃতীয় শর্তটাও৷ তৃতীয় শর্ত পূরণ না হলে চাঁদ গোটা সূর্যটাকেই ঢেকে ফেলবে, যাকে আমরা বলি পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ৷ পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণের সময়েই অবশ্য করোনা কে ভালোভাবে দেখা যায়৷ আজ আমরা পশ্চিমবঙ্গ থেকে সেই আগুণের আংটি দেখতে পাবো না৷ সূর্যের কেন্দ্রর সঙ্গে চাঁদের কেন্দ্রকে যদি একটা সরলরেখা দিয়ে যুক্ত করা হয়, সেই সরলরেখা পৃথিবীর ওপর যে রাস্তা দিয়ে যাবে, সেই রাস্তা থেকে বলয়গ্রাস সূর্যগ্রহণ দেখা যাবে৷ ভারতের মধ্যে বলয়গ্রাসের রাস্তাটা পাকিস্তান থেকে ঢুকে রাজস্থান, হরিয়ানা, উত্তরাখণ্ডের ওপর দিয়ে তিব্বতের দিকে চলে যাবে৷ তবে আমাদের একেবারে হতাশ হওয়ার কিছু নেই৷ বলয়গ্রাস না হলেও আংশিক সূর্যগ্রহণ আমরা দেখতে পাবো সকালে পৌনে এগারোটা থেকে দুপুর সওয়া দুটো পর্যন্ত৷ সাড়ে বারোটা নাগাদ চাঁদ সূর্যের প্রায় ৬৫% ঢেকে যাবে৷

এতক্ষণ যা বকবক করলাম তা মোটামুটি সবাই ছোটবেলায় ভূগোল বইয়ে পড়েছেন৷ তবু ঐ জানা কথাগুলো বলার উদ্দেশ্য হল এটা আরেকবার বুঝে নেওয়া যে সূর্যগ্রহণ একেবারেই একটা মহাজাগতিক জ্যামিতির খেলা৷ হিন্দু পুরাণে ও জ্যোতিষশাস্ত্র অনুযায়ী সূর্যগ্রহণের সময় রাহু নামক একটা দৈত্য সূর্যকে গিলে ফেলে৷ শাস্ত্রের নির্দেশঃ গ্রহণ চলাকালীন কিছু খাওয়া যাবে না, রান্না করা খাবার ফেলে দিতে হবে, গ্রহণ শেষ হয়ে গেলে বাসনপত্র ভালো করে মাজতে হবে, বাইরে বেরনোর জামাকাপড় কেচে ফেলতে হবে৷ গর্ভবতী মহিলারা গ্রহণের সময় বাইরে বেরোলে গর্ভের শিশু বিকলাঙ্গ হয়ে যাবে ইত্যাদি৷ ইসরো যখন চাঁদে মহাকাশযান পাঠাচ্ছে আর সেই খবর ভারতবাসী গর্বের সঙ্গে শেয়ার করছে, সেই সময়ে দাঁড়িয়ে লোকে এইসবে বিশ্বাস করবে - এটা মানতে মন চায় না৷ তবু বাস্তব বড় বিচিত্র৷ বহু উচ্চশিক্ষিত মানুষও জন্মলগ্নে সূর্য কোন রাশির সামনে ছিল তার ওপর নিজের ভাগ্য নির্ভর করে, আঙুলে কিছু পাথর ধারণ করে সেই ভাগ্যকে বদলে ফেলা যায় বলে বিশ্বাস করেন! তারওপর এখন এইসমস্ত কুসংস্কারকে হাজির করা হচ্ছে বিজ্ঞানের মোড়কে! সূর্যগ্রহণের সময় নাকি সূর্যের আলো কমে যাওয়ার কারণে জীবাণুদের দাপট বেড়ে যায়৷ তাই যদি হত তাহলে তো মনুষ্যপ্রজাতি কবেই বিলুপ্ত হয়ে যেত! প্রতিদিন তো বারোঘন্টা করে সূর্যের আলো থাকে না, মেঘ করলে দিনের বেলায়ও সূর্যের আলো কমে যায়! জনৈক "বিজ্ঞানী" শুনলাম বলেছেন যে সূর্যগ্রহণের সঙ্গে সঙ্গেই করোনা ভাইরাস পৃথিবী থেকে বিদায় নেবে৷ এইসব মহাজাগতিক ঘটনার সঙ্গে যে মানুষের বা জীবজগতের বিন্দুমাত্র সম্পর্ক নেই তা জোরের সঙ্গে বলা দরকার৷ তাই নির্ভয়ে যেকোন জায়গায় যান, পছন্দের খাবার খেতে খেতে সূর্যগ্রহণ দেখুন৷

তার মানে অবশ্য এটা নয় যে সূর্যগ্রহণের সময় কোনরকম সতর্কতার প্রয়োজন নেই৷ ভুলেও খালিচোখে বা রোদচশমা দিয়ে সূর্যগ্রহণ দেখতে যাবেন না৷ সূর্যের আলো সরাসরি চোখে পড়লে রেটিনার স্থায়ী ক্ষতি হতে পারে৷ সূর্যগ্রহণ দেখুন সোলার ফিল্টারের সাহায্যে বা পিনহোল ক্যামেরা বানিয়ে৷ আর সূর্যগ্রহণ দেখার উৎসাহে স্যোসাল ডিস্ট্যান্সিং ভাঙবেন না৷ সূর্যের করোনা পৃথিবীর করোনা কে নিকেশ করতে পারবে না৷


আজকের দিনটা আরেকটা কারণেও বিশিষ্ট৷ আজ কর্কট সংক্রান্তি৷ সূর্য উত্তরায়ণ শেষ করে দক্ষিণপন্থী হবে৷ সূর্যের আলো পৃথিবীর ওপর সবচেয়ে তেরছা ভাবে পড়বে৷ যার ফলে উত্তর গোলার্ধে আজ সবচেয়ে বড় দিন আর সবচেয়ে ছোট রাত্রি৷ একটা দিন নাহয় ধর্ম, বর্ডার, ডিপ্রেশন এইসব তুচ্ছ জিনিস ভুলে মহাকাশের কাণ্ডকারখানা অনুভব করার চেষ্টা করি৷

ছবিতে রইল পিনহোল ক্যামেরায় তোলা গ্রহণ চলাকালীন সূর্যের ছবি। ফেসবুক লিঙ্ক

No comments:

Post a Comment