Tuesday 2 June 2020

একটি হাতির মৃত্যু


হাতিটা যখন গ্রামে ঢুকল, এদিক ওদিক ঘুরে মাঠের মধ্যে পড়ে থাকা আনারসটা মুখে পুরল, আমি গাছের তলায় বসেছিলাম৷ কাউকে কিছু বলিনি৷ খাবার যখন পেয়ে গেছে চলে যাবে৷ ওরা আবার জানতে পারলে ... কিন্তু তার আগেই বিকট শব্দ৷ তাকিয়ে দেখলাম হাতিটার মুখ রক্তাক্ত হয়ে উঠেছে৷ সে ছটফট করতে করতে সারা গ্রামে ছুটে বেড়াতে লাগল৷ ততক্ষণে সবাই বাড়ির বাইরে বেরিয়ে এসেছে৷ কিন্তু হাতিটা কাউকে কিছু বলল না৷ কারো বাড়িতে হামলা চালালো না৷ কিছুক্ষণ ছোটাছুটি করার পর পুকুরে নেমে গিয়ে মাঝপুকুরে দাঁড়িয়ে পড়ল৷ পুকুরে অবশ্য জল প্রায় নেই৷ কতদিন বৃষ্টি হয়নি৷
কোতোয়াল কে দেখতে পেয়ে দৌড়ে গেলামঃ
"হাতিটার কি হল? আনারসের মধ্যে কি ছিল?"
কোতোয়াল অট্টহাসি হেসে বলল, "ঠুসে বারুদ ভরা ছিল৷ ব্যাটা ঠিক টোপ গিলেছে৷"
"সে কি? দয়া করে কিছু করুন৷ ওকে বাঁচান৷"
ততক্ষণে গোস্বামী চলে এসেছে, "কেন রে ব্যাটা? হাতিদের ওপর তোর অত দরদ কেন? গেল বার যখন হাতিটা আমার কলাগাছগুলো উপড়ে নিল তখন তুই কোথায় ছিলিস?"
পাশ থেকে সরকারমশাই ফুট কাটলেন, "হাতিদের তোল্লাই দিয়ে দিয়েই এই অবস্থা হয়েছে৷ সে আগে যা হওয়ার হয়ে গেছে৷ রাজামশাই আসার পর এখন আর হাতিরা মানুষকে ভয় দেখাতে পারবে না৷"

প্রচণ্ড রাগে গা জ্বলতে লাগল আমার৷ এটা তাহলে রাজামশাইয়ের হাতি মারার নতুন কৌশল৷ দিন পনেরো আগে একটা হাতিকে বিষ খাইয়ে মেরেছিলেন৷ তার আগে একটাকে ফাঁদে আটকে গ্রামের সবাই মিলে খুঁচিয়ে মেরেছিল৷ এবার বোঝা গেল পরশু কেন রাজামশাই বণিকটার কাছ থেকে বারুদ কিনছিলেন৷ বললাম, "তাই বলে এত নৃশংসভাবে মারতে হবে?"
কোতোয়াল এক ধমক দিয়ে বলল, "চোপরাও রাজদ্রোহী! আর একটা কথা বললে তোকেও ঐরকম একটা আনারস খাইয়ে দেবো৷"
গোস্বামী বলল, "সেই হাতিটা যখন পণ্ডিতের বাড়ি ভেঙে দিয়েছিল তখন তুই কোথায় ছিলিস?"
আমার বলা হল না, পণ্ডিত এখনও মন্দিরের বেদীতে শুয়ে থাকে কেন? রাজামশাই কি ওর জন্য ছোটখাটো একটা ঘর বানিয়ে দিতে পারতেন না? পণ্ডিতের সেই ভাঙা ঘরটাকেও উনি সারাতে দেন নি৷ প্রত্যেকবার একটা করে মারা হয় আর রাজামশাই ঐ ভাঙা ঘরটা দেখিয়ে বলেন, হাতিরা কত বিপদ্জনক৷

তাকিয়ে দেখলাম হাতিটা পুকুরের মধ্যেই শুয়ে পড়েছে৷ তার নড়াচড়াও প্রায় থেমে গেছে৷ সারা গ্রামের লোক মহা উৎসাহে দেখছে হাতিটার মরণযন্ত্রণা৷ পরশু যখন বারুদের দাম বাবদ প্রত্যেক গ্রামবাসীর কাছ থেকে চাঁদা আদায় করা হল সবার মধ্যে চাপা ক্ষোভ দেখা গিয়েছিল৷ এবছর অনাবৃষ্টিতে ফসল হয়নি বললেই চলে৷ তবু রাজার পেয়াদারা প্রত্যেকের ঘর থেকে খাজনা আদায় করে নিয়ে গেছে৷ যারা দিতে পারেনি তাদের আটক করেছে৷ তার ওপর চাঁদা তুলে বারুদ কেনায় লোকে তো খেপবেই৷ এখন তাদের ক্ষোভ মিটে গেছে৷ হাতি মারার উত্তেজনায় সবার চোখ জ্বলজ্বল করছে৷

হঠাৎ জোয়ান ছেলে নাথুরাম কপালে একটা ফেট্টি বেঁধে পুকুরের জলে লাফ দিল৷ হাতে একটা বিশাল বল্লম৷ গ্রামের লোক হোওওও করে চেঁচিয়ে উঠল৷ ঠিক হাতিটার তলপেটের কাছে গিয়ে পরপর কয়েকবার বল্লম চালালো৷ তারপর হাতিটার দেহের ওপর উঠে দাঁড়িয়ে বল্লমটা মাথার ওপর তুলে চিৎকার করল, "জয়! রাজামশাইয়ের জয়!" বল্লমের ডগায় তখন একরত্তি একটা খেলনা হাতি৷ গ্রামের সব লোক উল্লাসে গলা মেলালঃ "জয়! রাজামশাইয়ের জয়!"

No comments:

Post a Comment