বছর চারেক আগের কথা। পুজোয় বেড়ানোর প্রোগ্রাম তো প্রতিবারই থাকে। সেইবছরও ছিল। ভাইজাগ-আরাকু ভ্যালির টিকিট কাটা। কিন্তু কলেজে ন্যাক ভিজিটের কারণে পুজোর ছুটি সংক্ষিপ্ত হয়ে গেল। তাই বাধ্য হয়ে টিকিট ক্যানসেল করতে হল। কিন্তু তাই বলে পুজোর বেড়ানোটা একেবারে বাদ যাবে, তা তো হতে দেওয়া যায় না। তাই নাকের বদলে নরুণের মত মুকুটমণিপুর আর বিষ্ণুপুর। অবশ্যি গিয়ে বুঝলাম নরুণটাও ফেলনা নয়। এমন নরুণ পেলে নাক ত্যাগ করতে খুব বেশি কষ্ট হবে না। যাওয়ার সময় আমরা হুল এক্সপ্রেসে গিয়ে নামলাম দুর্গাপুরে। সেখান থেকে বাসে মুকুটমণিপুর। দুদিন কাটিয়ে গাড়ি ভাড়া করে এলাম বিষ্ণুপুর। রাজ্য পর্যটন দপ্তরের ট্যুরিস্ট লজে বুকিং ছিল। বিকেলের দিকে লজ থেকে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে রাসমঞ্চের দিকে যেতেই গাইড মিঠু ভুঁই মশাই পাকড়াও করলেন। সেদিন এবং তার পরের দিন তাঁর সঙ্গে টোটো করে ঘুরে বেড়ালাম বাংলার মধ্যযুগের ইতিহাসের আনাচ কানাচ দিয়ে।
মৃণ্ময়ী মন্দির
আজকের বিষ্ণুপুর, সেদিনের ছিল অতীতের মল্লভূম রাজ্যের রাজধানী। কেউ কেউ বলেন মল্লরাজারা রাজপুতানা থেকে এসেছিলেন। আমাদের গাইডও তাই বললেন। আবার কিছু ঐতিহাসিকের মতে মল্লরাজারা স্থানীয় আদিবাসীদের বংশধর ছিলেন।
মল্লরাজ জগৎমল্ল মৃণ্ময়ী অর্থাৎ দুর্গার মন্দিরটি তৈরী করেন ৯৯৭ সালে। বৈষ্ণব হওয়ার আগে মল্লরাজারা শিব ও শক্তির উপাসক ছিলেন। এখনো রাজপরিবারের সদস্যদের তত্ত্বাবধানে দুর্গাপুজো হয় এখানে।
মল্লেশ্বর মন্দির
মল্লেশ্বর মানে শিব। মল্লরাজা বীরহাম্বির এটার নির্মাণকার্য শুরু করেন। আচার্য শ্রীনিবাস গোস্বামীর কাছে বৈষ্ণবধর্মে দীক্ষিত হওয়ার পর তিনি এই মন্দিরের নির্মাণ কাজ বন্ধ রাখেন। পরে বীরসিংহ সম্পূর্ণ করেন। নির্মাণকাল আনুমানিক ১৬২২।
অভিনেতা অভি ভট্টাচার্যের বাড়ি ও নাটমন্দির। মল্লেশ্বর মন্দিরের পাশেই।
শ্রীনিবাস গোস্বামীর সমাধি
ষোড়শ শতকে বৃন্দাবনের গোস্বামীরা গরুর গাড়িতে করে অনেকগুলো বৈষ্ণব পুঁথি পাঠাচ্ছিলেন। পথে মল্লভূমের গোপালপুর গ্রামে বইগুলো লুঠ হয়। লুন্ঠিত গ্রন্থের মধ্যে কৃষ্ণদাস কবিরাজ রচিত "শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত"র আসল পাণ্ডুলিপিও ছিল বলে শোনা যায়। গাড়িতে ধনরত্ন আছে মনে করে রাজা বীরহাম্বিরই ওগুলো লুঠ করিয়েছিলেন। বইগুলোর সন্ধানে রাজসভায় উপস্থিত হয়ে শ্রীনিবাস আচার্য দেখলেন এক পণ্ডিত পুঁথিগুলো পাঠ করছেন এবং ভুল ব্যাখ্যা দিচ্ছেন। তখন শ্রীনিবাস আচার্য এগিয়ে আসেন এবং সঠিক ব্যাখ্যা করে বীরহাম্বিরকে আকৃষ্ট করেন। তারপর এই শ্রীনিবাস আচার্যর কাছেই বীরহাম্বির বৈষ্ণবধর্মে দীক্ষিত হন।
রাসমঞ্চ
বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত হওয়ার পর বীর হাম্বির এই রাসমঞ্চটি প্রতিষ্ঠা করেন ১৬০০ সালে। তলায় মাকড়া পাথরের বর্গাকার বেদী। ওপরের স্থাপত্য ইঁটের। সৌধের চূড়াটা মিশরের পিরামিডের মত, মাঝে বাংলার চালা আর তলায় ইসলামিক স্থাপত্যের খিলান।
রাসমঞ্চে মোট ১০৮টা খিলান আছে। রাস উৎসবের সময় বিভিন্ন মন্দির থেকে বিগ্রহগুলোকে নিয়ে আসা হত।
রাসমঞ্চের দেওয়ালের ভাস্কর্য। বাঁদিকে চৈতন্য মহাপ্রভু কে দেখা যাচ্ছে।
খিলানের মাথায় প্রস্ফুটিত পদ্মের মত ছবি।
শ্যামরায় পঞ্চরত্ন মন্দির
রত্ন অর্থে চূড়া। বাঁকানো চারচালা বাংলাঘরের ওপর চারকোণে চারটে দেউল। মাঝখানে একটা ছয়চালাবিশিষ্ট দেউলের ওপর একটা গম্বুজ। আমাদের গাইড বললেন চারটে ছোট দেউল যথাক্রমে বাংলার চালাঘর, উড়িষ্যার মন্দির, বৌদ্ধ ও জৈন স্থাপত্যের অনুকরণে নির্মিত। আর মাঝখানের গম্বুজটায় তো ইসলামিক স্থাপত্যের ছাপ স্পষ্ট।মন্দিরের প্রবেশপথের ঠিক ওপরে খোদাই করা আছেঃ
"শ্রীরাধাকৃষ্ণমুদে শশাঙ্ক বেদাঙ্ক যুক্তে নবরত্নম,শ্রীবীরহম্বীর নরেশ সূনুর্দদৌ নৃপঃ শ্রী রঘুনাথ সিংহ।।মল্ল সকে ৯৪৯। শ্রীরাজা বীরসিংহ।"
অর্থাৎ রাধাকৃষ্ণের আনন্দের জন্য নরেশ বীর হাম্বীরের পুত্র রঘুনাথ সিংহ এই মন্দিরটি দান করলেন ৯৪৯ মল্লাব্দে (১৬৪৩ খৃষ্টাব্দে)। ৬৯৪ সালে আদি মল্লের সিংহাসনারোহণের সময় থেকে মল্লাব্দের শুরু।
বিষ্ণুপুরের যে সমস্ত মন্দিরে টেরাকোটার কাজ রয়েছে সেগুলোর মধ্যে অন্যতম শ্যামরায় পঞ্চরত্ন মন্দির।
জোড়বাংলা মন্দির
জোড়বাংলা বা কেষ্ট রায় মন্দিরটি নির্মিত হয়েছিল ১৬৫৫ সালে, মল্লরাজা রঘুনাথ সিংহের সময়ে। দুটো দোচালা বাংলা ঘর জুড়ে তৈরী হয়েছে বলে এর নাম জোড়বাংলা। মাঝখানে একটা চারচালার চূড়া।
ভীস্মের শরশয্যা।
ওপরে পশুপালকদের গরু, ছাগল চড়ানোর দৃশ্য। মাঝে বালি-সুগ্রীবের যুদ্ধ; রামচন্দ্র পেছন থেকে অন্যায় যুদ্ধে বালিকে হত্যা করছে। তলায় একজন মানুষ বাঘ শিকার করছে।
ওপরে ঘরোয়া জীবনযাত্রার ছবি। মাঝখানে মোগল সম্রাট পায়রা ওড়াচ্ছেন। তলায় হাতি, ঘোড়া, উটের পিঠে চেপে যুদ্ধযাত্রায় বেরোচ্ছে মোগল সেনা।
সুজাতা বুদ্ধদেবকে পায়েস খাওয়াচ্ছে।
যুদ্ধ, শিকার, সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ছবি, রামায়ণ-মহাভারতের গল্প - সবই রয়েছে জোড়বাংলা মন্দিরের দেওয়ালে। কিছু নষ্ট হয়ে গেছে। আবার অনেকগুলোই টিকে আছে।
লালজী মন্দির
রাধা ও কৃষ্ণকে আনন্দ দেওয়ার জন্য দ্বিতীয় বীরসিংহ ১৬৫৮ সালে এই একরত্ন মন্দিরটি প্রস্তুত করেন। মূলত রাজপরিবারের মহিলারা এখানে পুজো দিতে আসতেন। মন্দিরের সঙ্গে নাটমঞ্চ ও ভোগ রান্নার ঘর রয়েছে।
লালজী মন্দিরের পাশের এই মাঠটায় চৈত্র সংক্রান্তিতে গাজনের মেলা বসে। এখন অবশ্য ক্রিকেট খেলা চলছে।
বড় পাথর দরজা
বিষ্ণুপুরের প্রাচীন দুর্গের উত্তরদিকের প্রবেশপথ হল মাকড়া পাথরের তৈরী বড় দরজাটা। বীরসিংহ সপ্তদশ শতকের মধ্যভাগে এটা তৈরী করেন। দরজার সামনে একটা পরিখা রয়েছে।
বড় পাথর দরজার তোরণের প্রবেশপথের দুপাশে সৈন্যদের লুকিয়ে থাকার জায়গা রয়েছে। তলায় ছোট ছোট গর্ত দিয়ে শত্রুর দিকে তীর বা গুলি ছোঁড়া হত।
মদনমোহন মন্দির
দুর্জন সিংহর আমলে ১৬৯৪ সালে এই একরত্ন ইঁটের মদনমোহন মন্দির তৈরী হয়েছিল। এখনও রাস ও দোল খেলা হয় এখানে।নিত্যসেবাও হয়ে থাকে। ভোগ রান্নার ঘরে রান্নার কাঠও দেখতে পেলাম।
মদনমোহন মন্দিরের নাটমঞ্চ
অষ্টধাতুর কৃষ্ণ আর কষ্টিপাথরের রাধা। এই মূর্তিটাকে নিয়ে একটা রোমাঞ্চকর গল্প আছে। সেটা নিয়ে এক্কবার জমিয়ে লিখেছিলাম। আগ্রহ থাকলে এখানে পড়তে পারেনঃ মদনমোহনের কীর্তিকলাপ।
বিষ্ণূপুরের মন্দিরগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভালো পোড়ামাটির কাজ রয়েছে মদনমোহন মন্দিরে।
নব নারী কুঞ্জর। ন জন মহিলা মিলে একটা হাতির রূপ তৈরী করেছে। এই ন জন নারী হল রাধা ও তার অষ্টসখী। কৃষ্ণের সঙ্গে ছল করে তাকে পিঠে নিয়ে জঙ্গলে ঘোরার জন্য রাধা সখীদের নিয়ে এই কাণ্ডটা করেছিলেন। দাশরথি রায়ের পাঁচালীতে আছেঃ
তোমরা ত অষ্টসখী, আমি এক জন ।নয় জনে একত্রেতে হইব মিলন ॥নব নারী মিলে হব অপূৰ্ব্ব কুঞ্জর।কুঞ্জর রূপেতে রব কুঞ্জের ভিতর ॥করী -রূপে প্রাণকান্তে পৃষ্ঠেতে করিয়া।
ব্রজের বিপিন মাঝে বেড়াব ভ্ৰমিয়া ॥
চীনা ড্রাগনের অনুকরণে স্থাপত্য।
নৃসিংহ অবতারে হিরণ্যকশিপুকে বধ করছে বিষ্ণু।
বিষ্ণুর বরাহ অবতার। দশ অবতারেরই ছবি পাওয়া যাবে এই মন্দিরের দেয়ালে।
মদনমোহন মন্দিরের সামনে পোড়ামাটির জিনিসের পসরা। বাজারের চেয়ে এখানেই সস্তায় পাওয়া যাবে।
মুরলীমোহন মন্দির
মাকড়া পাথরনির্মিত মুরলীমোহন মন্দিরের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বীরসিংহের রাণী শিরোমণিদেবী। অন্য মন্দিরগুলোর থেকে এই মন্দিরটা একটু দূরে অবস্থিত। এটা খুঁজে পেতে গাইড আর টোটোচালকমশাই বেশ নাজেহাল হলেন।
দলমাদল
৪ মিটার দীর্ঘ, ৩০ সেন্টিমিটার ব্যাস ও ৩০০ মন ওজন বিশিষ্ট এই কামানটা আগে বসানো ছিল বড় পাথর দরজার সামনে। ১৭৪২ সালে ভাস্কর রাওয়ের নেতৃত্বে মারাঠারা হামলা চালালে এই কামান থেকে গোলা বর্ষণ করে বর্গীদের দলকে মর্দন করা হয়। লোকের বিশ্বাস নগরপ্রাকারে দাঁড়িয়ে কামান দেগেছিলেন স্বয়ং মদনমোহন! দল মর্দন থেকে অপভ্রংশ হয়ে দলমাদল নামটা দাঁরিয়েছে।
লালবাঁধ
বাঁধ অর্থে তিনদিকে ঘেরা জলাশয়। একদিক ঢালু করা থাকে। সেখান দিয়ে জল এসে জলাশয়ে জমা হয়। বিষ্ণুপুরে অনেকগুলো বাঁধ আছে তার মধ্যে লালবাঁধ বিশিষ্ট অষ্টাদশ শতকের একটা মর্মান্তিক ঘটনার জন্য। পাঠান সর্দার রহিম খাঁর মহল থেকে লালবাঈকে তুলে নিয়ে আসেন মল্লরাজা দ্বিতীয় রঘুনাথ সিংহ। লালবাঈএর থাকার জন্য যে নতুনমহল তিনি তৈরী করে দিয়েছিলেন তার ধ্বংসাবশেষও গাইডমশাই আমাদের দেখালেন। লালবাঈএর গর্ভে দ্বিতীয় রঘুনাথ সিংহের এক পুত্রসন্তানও জন্মগ্রহণ করে। লালবাঈ ও তার পুত্র রাজত্বের দখল নিয়ে নেবে এই আশঙ্কায় রাজার প্রথমা স্ত্রী চন্দ্রভামা দেবী প্রথমে রাজাকে বিষপ্রয়োগে হত্যা করেন, তারপর লালবাঈ ও তার পুত্রকে একটা নৌকোয় বেঁধে তার ওপর বড় বড় পাথর চাপিয়ে এই জলাশয়ে ডুবিয়ে মারেন। চন্দ্রভামা দেবী নিজে অবশ্য রাজত্ব ভোগ করতে পারেননি। রাজার চিতায় তাঁকে সহমরণে যেতে হয়।
রাধাশ্যাম মন্দির
১৭৫৮ সালে মাকড়া পাথর নির্মিত এই গম্বুজাকৃতি একরত্ন মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন মল্লরাজ চৈতন্য সিংহ। এই মন্দিরে রাধাশ্যাম, জগন্নাথ ও গৌর নিতাই ের মূর্তি আছে। তুলসীমঞ্চ, নাটমঞ্চ, ভোগ রান্নার ঘর, প্রবেশপথে নহবৎখনা ্ররয়েছে।
মন্দিরের প্রবেশদ্বারে ইঁটের নহবৎখানা। একসময় এখানে সানাই ও বাদ্যযন্ত্র বাজানো হত।
ভোগ রান্নার ঘর।
পঙ্খের কাজে ফুটে উঠেছে নানা পৌরাণিক কাহিনী।
গৌর-নিতাইএর এই মূর্তিদুটো আগে মহাপ্রভু মন্দিরে ছিল। সংরক্ষণের অভাবে সেটার ভগ্নপ্রায় দশা। তাই গৌর নিতাই ঠাঁই নিয়েছেন এই মন্দিরে।
গুমঘর
মল্লরাজা বীরসিংহ এই ইঁটের ঘরটি বানিয়েছিলেন। কারো মতে এটা রাজা দের শস্যাগার ছিল আবার কেউ বলেন এর ওপর থেকে ফেলে অপরাধীদের শাস্তি দেওয়া হত। ঐতিহাসিকরা অনেকে মনে করেন এটা জলের ট্যাঙ্ক ছিল, কারণ আশেপাশে অনেক পোড়ামাটির পাইপ পাওয়া গিয়েছিল।
পাথরের রথ
আনুমানিক সপ্তদশ শতকে মাকড়া পাথর নির্মিত মাটিতে গাঁথা এই রথ কি কাজে লাগত বোঝা গেল না। এটার তলার অংশটা রাসমঞ্চের মত আর ওপরটা বিষ্ণুপুরের মন্দিরের মত। চার ধারে তিনটে করে পাথরের চাকা দেখা যাচ্ছে।
ছবিগুলো সবই আমার বা শ্রীরূপার তোলা। খালি শ্যামরায় পঞ্চরত্ন মন্দিরের সামনে দুজনের ছবিটা তুলে দিয়েছেন গাইড মহাশয়। সঙ্গের তথ্যগুলো মূলতঃ গাইড মশাই এর কাছ থেকে শোনা বা বিষ্ণুপুর গাইড বুক এবং মন্দির চত্বরে ভারতীয় পুরাতত্ত্ব বিভাগের সাইনবোর্ড এ পড়া। এছাড়া বিনয় ঘোষের "পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি (প্রথম খণ্ড)" এবং "পশ্চিমবঙ্গ" পত্রিকার বাঁকুড়া জেলা সংখ্যার সাহায্য ও নিয়েছি। সরকারী গাইড মিঠু ভুঁই এর যোগাযোগ নম্বরঃ 9474452992।
No comments:
Post a Comment