Thursday, 4 June 2020

রাম শ্যাম যদু মধু

রোববার সকালেতে রামবাবু ভাবে, 
সারাদিন শুয়ে বসে কষে ল্যাদ খাবে;
গিন্নীর চিৎকার,
উঠে পড়ো এইবার,
চটপট চা-টা খেয়ে বাজারেতে যাবে৷৷



বদরাগী শ্যামবাবু পড়ল কি রোগে, 
শ্মশানেতে মেতে থাকে তান্ত্রিক যোগে;
হরলাল ডাক্তার,
নেই হাঁকডাক তার,
জোলাপ খাওয়ালো কষে, রোগ গেল ভোগে৷৷




যাদবপুরের যদুবাবু লোকটি বড়ই ঠাণ্ডা,
মুখটি বুজে চুপটি থাকো, এটাই তাহার ফান্ডা;
কিন্তু যদি খাবার পাতে,
মটন চিকেন রুই না থাকে,
ভীষণ রেগে মাথায় তোমার বসিয়ে দেবেন ডান্ডা৷৷



মধুবাবু মোক্তার, বহু নামযশ তার, 
এজলাশে আর যত উকিলরা খায় ঝাড়;
সংসার বাওয়ালে,
গিন্নীর সওয়ালে,
মধুবাবু মারে চুপ, মুখে নাই সাড়৷৷

ছবিঃ অনির্বাণ সেনগুপ্ত

Tuesday, 2 June 2020

একটি হাতির মৃত্যু


হাতিটা যখন গ্রামে ঢুকল, এদিক ওদিক ঘুরে মাঠের মধ্যে পড়ে থাকা আনারসটা মুখে পুরল, আমি গাছের তলায় বসেছিলাম৷ কাউকে কিছু বলিনি৷ খাবার যখন পেয়ে গেছে চলে যাবে৷ ওরা আবার জানতে পারলে ... কিন্তু তার আগেই বিকট শব্দ৷ তাকিয়ে দেখলাম হাতিটার মুখ রক্তাক্ত হয়ে উঠেছে৷ সে ছটফট করতে করতে সারা গ্রামে ছুটে বেড়াতে লাগল৷ ততক্ষণে সবাই বাড়ির বাইরে বেরিয়ে এসেছে৷ কিন্তু হাতিটা কাউকে কিছু বলল না৷ কারো বাড়িতে হামলা চালালো না৷ কিছুক্ষণ ছোটাছুটি করার পর পুকুরে নেমে গিয়ে মাঝপুকুরে দাঁড়িয়ে পড়ল৷ পুকুরে অবশ্য জল প্রায় নেই৷ কতদিন বৃষ্টি হয়নি৷
কোতোয়াল কে দেখতে পেয়ে দৌড়ে গেলামঃ
"হাতিটার কি হল? আনারসের মধ্যে কি ছিল?"
কোতোয়াল অট্টহাসি হেসে বলল, "ঠুসে বারুদ ভরা ছিল৷ ব্যাটা ঠিক টোপ গিলেছে৷"
"সে কি? দয়া করে কিছু করুন৷ ওকে বাঁচান৷"
ততক্ষণে গোস্বামী চলে এসেছে, "কেন রে ব্যাটা? হাতিদের ওপর তোর অত দরদ কেন? গেল বার যখন হাতিটা আমার কলাগাছগুলো উপড়ে নিল তখন তুই কোথায় ছিলিস?"
পাশ থেকে সরকারমশাই ফুট কাটলেন, "হাতিদের তোল্লাই দিয়ে দিয়েই এই অবস্থা হয়েছে৷ সে আগে যা হওয়ার হয়ে গেছে৷ রাজামশাই আসার পর এখন আর হাতিরা মানুষকে ভয় দেখাতে পারবে না৷"

প্রচণ্ড রাগে গা জ্বলতে লাগল আমার৷ এটা তাহলে রাজামশাইয়ের হাতি মারার নতুন কৌশল৷ দিন পনেরো আগে একটা হাতিকে বিষ খাইয়ে মেরেছিলেন৷ তার আগে একটাকে ফাঁদে আটকে গ্রামের সবাই মিলে খুঁচিয়ে মেরেছিল৷ এবার বোঝা গেল পরশু কেন রাজামশাই বণিকটার কাছ থেকে বারুদ কিনছিলেন৷ বললাম, "তাই বলে এত নৃশংসভাবে মারতে হবে?"
কোতোয়াল এক ধমক দিয়ে বলল, "চোপরাও রাজদ্রোহী! আর একটা কথা বললে তোকেও ঐরকম একটা আনারস খাইয়ে দেবো৷"
গোস্বামী বলল, "সেই হাতিটা যখন পণ্ডিতের বাড়ি ভেঙে দিয়েছিল তখন তুই কোথায় ছিলিস?"
আমার বলা হল না, পণ্ডিত এখনও মন্দিরের বেদীতে শুয়ে থাকে কেন? রাজামশাই কি ওর জন্য ছোটখাটো একটা ঘর বানিয়ে দিতে পারতেন না? পণ্ডিতের সেই ভাঙা ঘরটাকেও উনি সারাতে দেন নি৷ প্রত্যেকবার একটা করে মারা হয় আর রাজামশাই ঐ ভাঙা ঘরটা দেখিয়ে বলেন, হাতিরা কত বিপদ্জনক৷

তাকিয়ে দেখলাম হাতিটা পুকুরের মধ্যেই শুয়ে পড়েছে৷ তার নড়াচড়াও প্রায় থেমে গেছে৷ সারা গ্রামের লোক মহা উৎসাহে দেখছে হাতিটার মরণযন্ত্রণা৷ পরশু যখন বারুদের দাম বাবদ প্রত্যেক গ্রামবাসীর কাছ থেকে চাঁদা আদায় করা হল সবার মধ্যে চাপা ক্ষোভ দেখা গিয়েছিল৷ এবছর অনাবৃষ্টিতে ফসল হয়নি বললেই চলে৷ তবু রাজার পেয়াদারা প্রত্যেকের ঘর থেকে খাজনা আদায় করে নিয়ে গেছে৷ যারা দিতে পারেনি তাদের আটক করেছে৷ তার ওপর চাঁদা তুলে বারুদ কেনায় লোকে তো খেপবেই৷ এখন তাদের ক্ষোভ মিটে গেছে৷ হাতি মারার উত্তেজনায় সবার চোখ জ্বলজ্বল করছে৷

হঠাৎ জোয়ান ছেলে নাথুরাম কপালে একটা ফেট্টি বেঁধে পুকুরের জলে লাফ দিল৷ হাতে একটা বিশাল বল্লম৷ গ্রামের লোক হোওওও করে চেঁচিয়ে উঠল৷ ঠিক হাতিটার তলপেটের কাছে গিয়ে পরপর কয়েকবার বল্লম চালালো৷ তারপর হাতিটার দেহের ওপর উঠে দাঁড়িয়ে বল্লমটা মাথার ওপর তুলে চিৎকার করল, "জয়! রাজামশাইয়ের জয়!" বল্লমের ডগায় তখন একরত্তি একটা খেলনা হাতি৷ গ্রামের সব লোক উল্লাসে গলা মেলালঃ "জয়! রাজামশাইয়ের জয়!"

Monday, 1 June 2020

বয়কট চায়না

কদিন ধরে হঠাৎ স্যোসাল মিডিয়ায় চীনদেশের পণ্য বয়কট করার আবেদন জানিয়ে পোস্ট দেখতে পাচ্ছি৷ এরকম আবেদনের ঢেউ মাঝেমধ্যে ওঠে আবার মিলিয়েও যায়৷ চীনদেশের পণ্যের বাজার ক্ষতিগ্রস্থ হওয়া বা আমাদের দেশের উৎপাদন শিল্পের উন্নতির কোন লক্ষণ অবশ্য দেখা যায় না৷ তবে এবারে সমস্ত চীনা পণ্য বয়কটের বদলে স্মার্টফোনের চীনা অ্যাপ আনইনস্টল করার আবেদনই আসছে বেশী৷ সমস্ত চীনা পণ্য বয়কট করার আহ্বান যে বাস্তবসম্মত নয় তা অনেকে বুঝেছেন৷ সে যাই হোক এবারের ঢেউটাও মিলিয়ে যাওয়ার আগে চীনের শিল্পজাত পণ্য ছাড়া আরো কি কি বয়কট করা যেতে পারে তা একটু ভেবে দেখা যেতে পারে৷

এইমুহূর্তে হংকং এ সরকারবিরোধী আন্দোলনের খবর গোটা পৃথিবী জানে৷ ১৯৯৭ সালে হংকং ব্রিটিশ সরকারের থেকে চীনে হাতবদল হওয়ার সময় একটা চুক্তি হয়েছিল যে হংকং একটা বিশেষ স্বায়ত্তশাসন বজায় রাখতে পারবে৷ হংকং এর প্রশাসন, আইনসভা, বিচারব্যবস্থা সবই চীনের মূল ভূখণ্ডের থেকে আলাদা হবে৷ সম্প্রতি চীনের কেন্দ্রীয় সরকার মূল ভূখণ্ডের জাতীয় নিরাপত্তা আইনকে হংকং এ প্রয়োগ করার জন্য সংবিধান সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে৷ এতে স্বায়ত্তশাসন ক্ষুণ্ণ হওয়ার আশঙ্কা করে হংকং এর মানুষ পথে নেমেছে আর পুলিস নামিয়ে তাদের আন্দোলনকে দমন করার চেষ্টা হচ্ছে৷ আমাদের দেশেও ১৯৪৭ সালে জম্মু- কাশ্মীর নামের দেশীয় রাজ্যটি ভারতে অন্তর্ভূক্ত হয়েছিল তার বিশেষ স্বায়ত্তশাসন বজায় রাখার চুক্তি মেনে৷ তারপর ক্রমান্বয়ে ঐ রাজ্যের মানুষের নাগরিক অধিকার গুলো হরণ করা হয়েছে, অবশেষে গত বছর রাজ্যের বিধানসভার মতামত না নিয়েই ৩৭০ ধারায় জম্মু কাশ্মীরের স্বায়ত্তশাসন খারিজ করা হয়েছে৷ রাজ্যের মানুষ প্রতিবাদে নামলে সেনাবাহিনীর বুটের তলায় তাদের দমন করা হয়েছে৷ ভদ্রলোকের চুক্তি ভঙ্গ করা, রাজ্যের স্বায়ত্বশাসন কেড়ে নেওয়া, নাগরিকের প্রতিবাদের ওপর দমনপীড়ণ চালানোর চীনা মডেলটিকে আমরা বয়কট করতে পারি৷

আমরা জানি চীনে নিরপেক্ষ সংবাদমাধ্যমের অস্তিত্ব নেই৷ যে কটা সংবাদমাধ্যম আছে সেগুলো সরকার নিয়ন্ত্রিত৷ আমাদের দেশে অবশ্য বেসরকারী সংবাদমাধ্যমের একটা বড় ভূমিকা রয়েছে৷ এমনকি দূরদর্শন বা আকাশবানীর মত সরকারী সংস্থাগুলোও সরকারী মতের পাশাপাশি বিরোধী মতও প্রচার করত৷ কিন্তু এখন সরকারী সংবাদমাধ্যমগুলো তো বটেই, প্রায় সমস্ত বেসরকারী সংবাদমাধ্যমও অন্ধভাবে সরকারকে সমর্থন করতে বাধ্য৷ যে কজন সাহসী সাংবাদিক সত্যানুসন্ধানে ব্রতী, তাঁদের নানাবিধ হুমকি, গ্রেফতার, এমনকি প্রাণসংশয়েরও মুখোমুখি হতে হচ্ছে৷ গ্লোবাল প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্সে ভারত ২০১৩ সালের ১০৫তম অবস্থান থেকে ২০২০ তে ১৪২ তম অবস্থানে নেমে গেছে৷ সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব করার এই চীনা অভ্যাসটাকে আমরা বয়কট করতে পারি৷

চীনে শ্রমিকদের অধিকার অনেকটা কেড়ে নেওয়া হয়েছে বলে শোনা যায়৷ মালিকপক্ষ যখন খুশি ছাঁটাই করতে পারে, শ্রমিকরা ইউনিয়ন করতে পারেনা, ধর্মঘটের অধিকার নেই - এমন সব দাবী পশ্চিমের সংবাদপত্রগুলো করে থাকে৷ আমাদের দেশে অনেক লড়াইয়ের মাধ্যমে শ্রমিকরা তাঁদের অধিকার অর্জন করেছেন৷ কিন্তু কর্পোরেটদের চাপে ক্রমশ তাদের সেই অধিকার কেড়ে নেওয়া হচ্ছে৷ স্থায়ী কর্মীর তুলনায় ঠিকা কর্মীর অনুপাত বাড়ানো হচ্ছে, ন্যূনতম মজুরির আইন নেই, "হায়ার এন্ড ফায়ার" নীতি জোরদার হচ্ছে৷ এখন তো অনেক রাজ্যে কাজের সময় ৮ ঘন্টা থেকে বাড়িয়ে ১২ ঘন্টা হয়ে গেছে৷ ধর্মঘট ও আন্দোলন করতে গেলেও সরকার ও মালিকপক্ষের প্রতিহিংসার সম্মুখীন হতে হচ্ছে৷ শ্রমিকস্বার্থ বিরোধী এই কথিত চীনা মডেলটাকেও আমরা বয়কট করতে পারি৷

ছোটবেলায় শিখেছিলাম অপরের খারাপটাকে বর্জন আর ভালোটাকে গ্রহণ করা উচিৎ৷ সাম্প্রতিক করোনা অতিমারী চীনেই উৎপত্তি হলেও তারা অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে এই অসুখকে দমন করতে পেরেছে৷ উন্নত জনস্বাস্থ্য পরিকাঠামো এবং দক্ষ প্রশাসনিক ব্যবস্থার পাশাপাশি সরকার, দল ও সাধারণ মানুষের হাতে হাত মিলিয়ে কাজের মধ্য দিয়েই এই অসাধ্য সাধন সম্ভব হয়েছে৷ আরেকটা বিষয় হল চীনের দারিদ্র্য দূরীকরণ প্রকল্প৷ চীনের কমিউনিস্ট পার্টি ২০২০ সালের মধ্যে দেশকে দারিদ্র্যমুক্ত করার লক্ষ্য স্থির করেছে৷ বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের তথ্য অনুযায়ী গত চল্লিশ বছরে ৮০ কোটি মানুষকে দারিদ্র্যমুক্ত করা হয়েছে৷ গতবছরের হিসেব অনুযায়ী দেশে এখনও ৫০ লক্ষ দরিদ্র মানুষ আছেন৷ করোনা সঙ্কট সত্ত্বেও তাঁদের দারিদ্র্যসীমার ওপরে তুলতে তারা বদ্ধপরিকর৷

এখন যদি ভারত যদি চীনের ভালো অভিজ্ঞতাগুলো থেকে শিক্ষা নেয় এবং খারাপ জিনিসগুলো বয়কট করে তাহলে চীনা অ্যাপ আনইনস্টল করার থেকেও ভালো কাজ হবে৷ পাশাপাশি যদি বেসরকারীকরণের রাস্তা ছেড়ে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে উৎপাদন শিল্পের উন্নতি ঘটায় তাহলে হয়ত একদিন চীনের ওপর অতি নির্ভরশীলতা থেকে বেরিয়ে আসা যাবে৷


Tuesday, 26 May 2020

তিন বিপর্যয় ও কিছু ভাবনা

করোনা অতিমারী, ঘূর্ণিঝড়, পঙ্গপাল হানা -- দুহাজার কুড়ি সালের প্রথমার্ধে একটার পর একটা বিপর্যয়ের মধ্যে কোন দৈব দুর্বিপাক না থাকলেও কয়েকটা সাধারণ বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয়৷

প্রথমত এই সবকটা বিপর্যয়ের সঙ্গেই জড়িয়ে আছে প্রকৃতির ওপর মানুষের দখলদারি৷ সার্স, মার্স, ইবোলার মত নোভেল করোনা ভাইরাসের মানবশরীরে অনুপ্রবেশ বন্যজন্তুদের জীবনে মানুষের অকারণ হস্তক্ষেপের ফল৷ সমুদ্রে ঘন ঘন অতি গভীর নিম্নচাপের সৃষ্টি ও তার ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হওয়ার ঘটনা সরাসরি জড়িত বিশ্ব উষ্ণায়ণের সঙ্গে৷ মরুভূমির পঙ্গপালদের "নিঃসঙ্গ দশা" থেকে "দলবদ্ধ দশা"য় উত্তরণ, বিপুল হারে বংশবৃদ্ধি, এক মহাদেশ থেকে অন্য মহাদেশে ছড়িয়ে পড়া এইসবের সঙ্গেও জলবায়ু পরিবর্তনের সম্পর্ক আছে বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত৷

দ্বিতীয়তঃ একটা ভাইরাস কিভাবে পশু থেকে মানুষের দেহে প্রবেশ করে নিজেকে মিউটেট করে, দেহের কোন অঙ্গকে কিভাবে আক্রমণ করে, দেহে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা কিভাবে কাজ করে, সংক্রমণের লক্ষণ ও তা এড়ানোর উপায় কি; সমুদ্রের নিম্নচাপ কিভাবে ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হয়, তা কখন কোন পথে স্থলভাগে প্রবেশ করে, তার গতি ও ক্ষমতাই বা কত হতে পারে; পঙ্গপাল কিভাবে, কোন পরিবেশে একক দশা থেকে ঝাঁকে রূপান্তরিত হয়, তারা কিভাবে এক মহাদেশ থেকে অন্য মহাদেশে পাড়ি দেয় এই সব কিছু বলতে পারে একমাত্র বিজ্ঞান৷ বিজ্ঞানের সেই তথ্যকে কাজে লাগিয়ে প্রশাসন উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে পারে যাতে ক্ষয়ক্ষতি ন্যূনতম হয়৷ যে জিনিসটাকে মানুষ সবচেয়ে বেশী গুরুত্ব দেয় সেই ধর্ম বা ঈশ্বরের এর মধ্যে কোন ভূমিকা নেই৷

তৃতীয়তঃ নোভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হয় চীনের উহান শহরে৷ সেখান থেকে তা ছড়িয়ে পড়েছে গোটা পৃথিবীতে৷ ঘূর্ণিঝড় আমফানের উৎপত্তি বঙ্গোপসাগরে, তার নামকরণ করেছে তাইল্যান্ড, সে আছড়ে পড়েছে পশ্চিমবঙ্গ, ওড়িশা ও বাংলাদেশে৷ পঙ্গপালের ঝাঁক আরব মরুভূমিতে দল পাকিয়ে পূর্ব আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য ঘুরে ইরান, পাকিস্তান হয়ে ঢুকেছে ভারতে৷ কিছু মানুষ এখনও "দেশ" বলতে কাঁটাতারে ঘেরা একটা ভূখণ্ডের বেশী কিছু বোঝেন না, আর সেই ভূখণ্ডের কয়েক ইঞ্চি নিয়ে প্রতিবেশীর সঙ্গে লাঠালাঠি করাকেই দেশপ্রেমের পরকাষ্ঠা বলে গণ্য করেন, সেই ভূখণ্ডের বৈধ অধিবাসীদের তালিকা বানানোর জন্য কোটি কোটি টাকা খরচ করে মানুষের জীবন অতিষ্ঠ করে তোলাকে অত্যন্ত জরুরী কাজ মনে করেন৷ প্রকৃতি আমাদের কান ধরে বুঝিয়ে দিল ঐসব কাঁটাতারের সীমানা আসলে কতটা ঠুনকো৷

চতুর্থতঃ জাতীয়তা ছাড়াও এই ধর্ম, ভাষা ইত্যাদি যেসব নিয়ে মানুষ লড়ালড়ি করতে ভালোবাসে, করোনাভাইরাস, আমপান, পঙ্গপালের দল কেউই সেসব ভাগাভাগি কে পাত্তা দিচ্ছে না৷ তার মানে কি সব মানুষ সমানভাবে বিপর্যস্ত হচ্ছেন? না তাও নয়৷ লকডাউনে কর্মহীন দিনমজুর, ভিনরাজ্যে আটকে পড়ে হাজার মাইল হেঁটে পারি দেওয়া পরিযায়ী শ্রমিক, ঘরবন্দী অবস্থায় অবসাদগ্রস্থ চাকুরীজীবি, মুনাফা কমে যাওয়ার আশঙ্কায় থাকা শিল্পপতি - সবার সঙ্কট একরকম নয়৷ ঘূর্ণিঝড়ে বিদ্যুৎ, জল, নেটওয়ার্ক না পাওয়া শহরবাসী আর বাড়ি ধ্বসে যাওয়া সুন্দরবনবাসীর সমস্যাগুলোও আলাদা আলাদা৷ পঙ্গপালের হানায় শস্যহানির আতঙ্কে ভোগা কৃষক আর খাদ্যশস্যের মূল্যবৃদ্ধির শঙ্কায় থাকা মধ্যবিত্তর অবস্থার মধ্যেও ফারাক আছে৷ এককথায় বলতে গেলে যে মানুষ অর্থনৈতিকভাবে যত দুর্বল, তাঁর বিপর্যয়ের মাত্রাও তত বেশী৷

এখন প্রতিটা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্য আছে, সেগুলোর মোকাবিলার কৌশলও একেবারেই স্বতন্ত্র৷ তবে সাধারণভাবে বলা যায় যেকোন বিপর্যয়ের মোকাবিলার দুটো দিক আছেঃ একটা দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনাঃ বিপর্যয় আবার আসার সম্ভাবনা কমানো৷ আরেকটা তাৎক্ষণিকঃ বিপর্যয় যখন এসে পড়বে, ক্ষয়ক্ষতি যেন ন্যূনতম হয়৷ দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার অঙ্গ হল প্রকৃতির নিয়মকে বোঝা, তার ক্ষতি যথাসম্ভব কম করা, যে ক্ষতি ইতিমধ্যে হয়ে গেছে তার খানিকটা অন্তত পূরণ করা৷ আর তাৎক্ষণিক কৌশলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হল যে মানুষ অর্থনৈতিকভাবে যত দুর্বল, তাকে তত বেশী সুরক্ষা দেওয়া৷ আর এর দুয়ের জন্যই প্রয়োজন সমাজে মুক্তচিন্তা, বিজ্ঞানচর্চার পরিবেশ উন্নত করা, জনমুখী প্রশাসন ও দক্ষ জনস্বাস্থ্য পরিকাঠামো গড়ে তোলা এবং সঙ্কীর্ণ জাত্যাভিমান ত্যাগ করে আন্তর্জাতিক সমন্বয়কে জোরদার করা৷


চিত্রসূত্রঃ এই সময়, ২৬শে মে, ২০২০

পল্লব দত্তর সংযোজনঃ ইদানিং যে বনাঞ্চল ধ্বংস শুরু হয়েছে, সে আমাজন থেকে উত্তরাখন্ড, অস্ট্রেলিয়া থেকে অযোধ্যা। অনেকাংশেই সন্দেহজনকভাবে ঘটা অগ্নিকাণ্ডে পুড়ে যাচ্ছে বিশাল বনভূমি! গাছ কাটা নয় এখন আরো মারাত্মক উপায়ে বনাঞ্চল ধ্বংস করার উপায় বার করে ফেলেছে মাফিয়ারা! এবং কোথাও কোথাও রাষ্ট্রীয় মদতে! আমাজন বনাঞ্চলের ক্ষেত্রেই যেমন প্রেসিডেন্ট Bolsonaro এর বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে! গত কয়েক বছরে অগ্নিকাণ্ডে বনাঞ্চল ধ্বংস হওয়ার ঘটনা উল্লেখযোগ্য ভাবে বেড়েছে।আবার ভারতে নর্মদা ভ্যালিতে তৈরী প্যাটেল স্ট্যাচু ওই অঞ্চলের স্বাভাবিক ইকোসিস্টেম থেকে স্থানীয় বাসিন্দাদের জীবন সবক্ষেত্রেই ভীষণ নেগেটিভ প্রভাব ফেলেছে। বিগত দশকে এমন উদাহরণ ভুরি ভুরি পাওয়া যাবে যেখানে মাফিয়ারা নয়, রাষ্ট্র নিজেই বনাঞ্চল ধ্বংস করায় সক্রিয় ভূমিকা নিচ্ছে!

Friday, 8 May 2020

লকডাউনে পড়া বইঃ গান্ধী গবেষণা

ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীনতার পথে রওনা দেওয়া প্রায় সমস্ত জাতিই তার পিতৃত্ব অর্পণ করে থাকে তার স্বাধীনতা সংগ্রামের কেন্দ্রীয় ভূমিকায় থাকা কোন এক ব্যক্তির ওপর৷ জাতির জনক কোন ব্যক্তি হতে পারেন কি না তা নিয়ে বিতর্ক আছে, থাকবে৷ কিন্তু ভারতবর্ষ বোধহয় একমাত্র দেশ, যার "জাতির জনক" কে স্বাধীন দেশে কুৎসিততম ভাষায় আক্রমণ করা এমনকি তাঁর হত্যাকারীকে মহিমান্বিত করা অপরাধ বলে গণ্য হয় না৷ পান্নালাল দাশগুপ্তর "গান্ধী গবেষণা" বইটা পড়তে পড়তে মনে হল এটার জন্য গান্ধীজি নিজেই দায়ী৷ নিজেকে তো তিনি কোন অবিসংবাদী নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চাননি৷ তিনি নিজেই ঠিক, বাকি সবাই ভুল - এমন ধারণা তিনি কখনও পোষণ করেননি৷ বরং সারাটা জীবন ব্যাপৃত থেকেছেন সত্যানুসন্ধানের কাজে৷ তিনি যে সত্যকে খুঁজে পাচ্ছেন, তা যে খণ্ডিত সত্য, আপেক্ষিক সত্য এব্যাপারেও তিনি সচেতন৷ তাঁর মৃত্যুর পর যেন "গান্ধীবাদ" নামক কোন সঙ্কীর্ণ মতবাদ তৈরী করার চেষ্টা করা না হয় সে বিষয়েও তিনি অনুগামীদের সতর্ক করে দিয়েছেন৷ কাজেই বলা যায় গান্ধীজি এমন দেশ দেখতে চাননি, যেখানে তাঁকে গালিগালাজ করলে শাস্তি পেতে হবে৷ আর তাঁর যে হত্যাকারী সে তো অনেক আগেই তাঁকে হত্যার ব্যর্থ চেষ্টা করেছিল আর গান্ধী তাকেও তখন ক্ষমা করে দিয়েছিলেন৷

পান্নালাল দাশগুপ্ত যৌবনে সশস্ত্র বিপ্লবের পথে স্বাধীনতা অর্জনে প্রয়াসী ছিলেন৷ স্বাধীনতার পরেও তাঁকে কারাবরণ করতে হয়৷ আলোচ্য গন্থটির পাণ্ডুলিপি তিনি লিখেছিলেন ১৯৫৪-৫৫ সালে জেলে বসে৷ তিরিশ বছর পর সেটি বই আকারে প্রকাশিত হয়৷ ইতিমধ্যে দেশ ও বিশ্বের পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়েছে, লেখকের ভাবনাচিন্তাও বদলেছে৷ কিন্তু তিনি মূল পাণ্ডুলিপিকে অপরিবর্তিত রেখেই নতুন চিন্তাভাবনাকে ফুটনোটের মাধ্যমে ব্যক্ত করেছেন৷ "গান্ধী গবেষণা" নামটির দুটি তাৎপর্য আছেঃ গান্ধীজির নিজের সত্যানুসন্ধানের গবেষণা এবং গান্ধীজিকে নিয়ে অন্যদের গবেষণা৷ একজন কমিউনিস্ট বিপ্লবী হিসেবে তিনি মার্কসবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে গান্ধীজির মূল্যায়ন করেছেন৷ তাঁর উদ্দেশ্য বামপন্থীদের কাছে গান্ধীজি কে নতুনভাবে দেখানো এবং তথাকথিত গান্ধীবাদীদের কাছে ঐতিহাসিক গান্ধীকে তুলে ধরা৷ পরিশিষ্ট সহ বইটির মোট ১৫ টি অধ্যায়ঃ (১) গান্ধী ও সত্য, (২) গান্ধীজির ভগবান ও ধর্ম, (৩) অহিংসা, (৪) সত্যাগ্রহ, (৫) সত্যাগ্রহ বনাম দুরাগ্রহ, (৬) গঠনমূলক কাজ, (৭) রবীন্দ্রনাথ ও গান্ধী, (৮) গান্ধীজি ও সুভাষচন্দ্র, (৯) হরিজন-আদিবাসী-মজুর ইত্যাদি, (১০) ট্রাস্টিশিপ বা অছিপ্রথা, (১১) নারীজাতির উন্নয়ন, (১২) গান্ধীজি ও ব্যক্তি, (১৩) গান্ধী ও ইতিহাস, (১৪) গান্ধীবাদ। আগ্রহী পাঠক বইটা থেকে যথেষ্ট ভাবনার খোরাক পাবেন বলে আমার বিশ্বাস৷ কয়েকটা দিক সংক্ষেপে উল্লেখ করছি, যেগুলো আমার কাছে তাৎপর্যপূর্ণ মনে হয়েছে৷


প্রথমতঃ গান্ধীজির সঙ্গে "অহিংসা" কে অনেক সময়েই অবিচ্ছেদ্য ভাবে জুড়ে দেওয়া হয়৷ কিন্তু বাস্তবে তাঁর কাছে "সত্যে"র স্থান ছিল অনেক ওপরে৷ তিনি একাধিকবার বলেছেন, সত্যের সন্ধান করতে গিয়েই তিনি অহিংসা কে পেয়েছেন এবং প্রয়োজনে সত্যের খাতিরে অহিংসা কে ত্যাগ করতেও প্রস্তুত৷ লেখক দেখিয়েছেন বেশ কয়েকটা ক্ষেত্রে তিনি বলপ্রয়োগের ব্যাপারে সম্মতি দিয়েছেন৷ অহিংসা কোন ভীরুর ধর্ম ণয় এবং অহিংসা হিংসা কে এড়িয়ে চলে না বা হিংসা কে অস্বীকার করে না৷ বরং হিংসার মুখোমুখি দাঁড়ানোটাই অহিংস সত্যাগ্রহর বৈশিষ্ট্য৷

দ্বিতীয়তঃ ডগমা বা গোঁড়ামিকে গান্ধীজি সারাজীবন পরিহার করে চলতে চেয়েছেন৷ যে মতবাদই হোক, তাকে বিনা প্রশ্নে মেনে নেওয়া চলবে না৷ সেকারণে তাঁর মত ও বিশ্বাসের পরিবর্তন হয়েছে৷ আগে তিনি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের মহত্বের ওপর আস্থাশীল ছিলেন, উপনিবেশগুলোর ওপর শোষণ নেহাতই বিচ্যূতি বলে মনে করতেন এবং ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের মধ্যে থেকেই ভারত নিজের মর্যাদা পুনরুদ্ধার করতে পারবে বলে বিশ্বাস করতেন৷ সেই বিশ্বাস ক্রমে মুছে যায়৷ চৌরিচৌরার ঘটনা নিয়ে তিনি অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহার করেন, কিন্তু ৪২ এ হিংসার সম্ভাবনা কে মাথায় রেখেই ভারত ছাড়ো আন্দোলনের ডাক দেন৷ পরম ধার্মিক, নিষ্ঠাবান হিন্দু হিসেবে তাঁর বিশ্বাস ছিলঃ God is Truth. পরে তিনি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে Truth is God. হিন্দু সমাজের বর্ণপ্রথা নিয়ে তাঁর যে মোহ ছিল তা থেকেও তিনি ভবিষ্যতে সরে আসেন৷

তৃতীয়তঃ মার্কসবাদীরা গান্ধীজি কে বুর্জোয়া নেতা হিসেবে ব্যাখ্যা করতেন, কেউ কেউ আরো কয়েক ধাপ এগিয়ে তাঁকে "সাম্রাজ্যবাদের এজেন্ট" অভিধা দিতেন৷ লেখক গান্ধীজির শ্রেণীচরিত্র বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন, গান্ধীজি আদৌ ধনিক শ্রেণীর প্রতিনিধি ছিলেন না, বরং গরীব, খেটে খাওয়া মানুষ বিশেষ করে কৃষকশ্রেণীর সঙ্গেই তাঁকে সবচেয়ে বেশী আইডেন্টিফাই করা যায়৷ আর তিনি যে শুধু সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তাই নয়, তিনি পুঁজিবাদেরও বিরোধী ছিলেন এবং তাঁর নেতৃত্বে স্বাধীনতা সংগ্রামের চরিত্র চীন বিপ্লবের মতই নয়া গণতান্ত্রিক চরিত্রের৷ পঞ্চাশের দশকে জেলের অভ্যন্তরে বসে লেখকের ধারণা হয়েছিল ভারত নেহরুর নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক পথে এগিয়ে চলবে৷ পরে তাঁর ভুল সংশোধন করেছেন৷

চতুর্থতঃ বইয়ের ১৫ টি অধ্যায়ের মধ্যে সর্ববৃহৎ অধ্যায়টি হল "গঠনমূলক কাজ"৷ 
যুদ্ধের জন্য বা সশত্র বিপ্লবের জন্য যেমন ট্রেনিং এর দরকার, তেমনি অহিংস সত্যাগ্রহের জন্যও প্রস্তুতির প্রয়োজন৷ সেটাই হল গঠনমূলক কাজ৷ কুটিরশিল্প, চরকা, বয়স্ক শিক্ষা, গোরক্ষা, হিন্দু মুসলমান ঐক্য, হরিজন সেবা ইত্যাদি নানাবিধ গঠনমূলক কাজ এবং অর্থনীতি, নৈতিকতা, শ্রমের মাধ্যমে শিক্ষা ইত্যাদি বিষয়ে গান্ধীজির পরিকল্পনা নিয়ে এই অধ্যায়ে লেখক আলোচনা করেছেন৷ এই প্রসঙ্গে একটা কথা মনে হয়৷ রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ ও ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি প্রায় একই সময়ে গঠিত হয়৷ কমিউনিস্ট পার্টি রাজনৈতিক লড়াইয়ের পাশাপাশি নানাবিধ গণসংগঠনের মাধ্যমে গঠনমূলক কাজ করার চেষ্টা করেছে ঠিকই কিন্তু গণসংগঠনগুলোর ওপর পার্টির নিয়ন্ত্রণ প্রশ্নাতীত৷ পার্টিই নিয়ন্ত্রণ করেছে শ্রমিক ও কৃষক সংগঠনকে, উল্টোটা হয়নি৷ অন্যদিকে আরএসএস নিজেরা সক্রিয় রাজনীতিতে না জড়িয়ে গঠনমূলক (নেতিবাচক অর্থে) কাজে মনোনিবেশ করেছে৷ তার রাজনৈতিক শাখাগুলো কিন্তু নিয়ন্ত্রিত হয়েছে সঙ্ঘের দ্বারা৷ আজ একশো বছর পর ভারতের রাজনৈতিক পরিস্থিতি দেখে আমরা বুঝতে পারি গান্ধীজির গঠনমূলক কাজের তাৎপর্য৷






গান্ধী গবেষণা,
পান্নালাল দাশগুপ্ত,
নবপত্র প্রকাশন৷ দাম ২৫০ টাকা৷

Monday, 29 October 2018

বক্সা পাহাড়ের প্রজাপতি

আমি প্রজাপতি প্রেমিক নই। ফটোগ্রাফিতেও কঅক্ষর গোমাংস। তবু তন্ময় যখন কমলার ওপর কালো নকশাকাটা প্রজাপতিটাকে দেখালো তার পেছন পেছন ক্যামেরা নিয়ে ছুটতে গিয়ে খানিক নেশা ধরে গেল। গোটা ডুয়ার্স ট্রিপ টা আর কিছু না হোক প্রজাপতির জন্যেই মনে থেকে যেত। পাহাড় জঙ্গল ভেঙে হাঁটতে হাঁটতে দেখা পেলাম অজস্র রংবেরং এর প্রজাপতি। কোনটা রেলিং-এর সঙ্গে রঙ ম্যাচ করে ক্যামোফ্লেজ করেছে, কোনটা আবার শুকনো পাতার মিমিক্রি করেছে।দুর্ভাগ্যের বিষয় তাদের এনার্জি অফুরন্ত, দুদণ্ড বসে ছবি তোলার অবকাশ দেওয়ার ইচ্ছে মোটে নেই। তবু যে কটা কে তুলতে পেরেছি দিয়ে দিলাম। এই বক্সা ব্যাঘ্র প্রকল্প (Buxa Tiger Reserve) এলাকায় নাকি চারশোর ওপর প্রজাপতির প্রজাতি আছে। এই ওয়েবসাইট থেকে ভারতবর্ষের সমস্ত প্রজাপতির তথ্য মিলবে। এখান থেকেই যতগুলো কে চিহ্নিত করতে পেরেছি তাদের নাম দিয়ে দিলাম। 

Indian Red Admiral

Bengal Yellowjack Sailer



Chocolate Pansy

Oriental Common Mime

Double-branded Crow

Coromandel Glassy Tiger



Medus Brown

Broad-banded Sailer



সমস্ত ছবি অক্টোবরের ২১-২৪ তারিখে Buxa Tiger Reserve  এলাকায় Canon EOS 1500D Digital SLR Camera তে EF S18-55 লেন্স ব্যবহার করে তুলেছি।


Thursday, 26 July 2018

মদনমোহনের কীর্তিকলাপ


বিষ্ণুপুর ঘুরতে গেছি দুদিনের জন্যে। যেকোন ট্যুরিস্ট স্পটেই যা হয় মন্দিরগুলোর সামনে গাইডবুক, ছবির অ্যালবাম, আরো নানারকম চটি বই বিক্রি হচ্ছিল। মদনমোহন মন্দিরের সামনে বয়সের ভারে ন্যূব্জ এক বৃদ্ধ ফেরিওয়ালাকে দেখে শ্রীরূপা দয়াপরবশ হয়ে ১০ টাকা দিয়ে একটা হলুদ রঙের চটি বই কিনে ফেলল। বৃদ্ধ ওকে বললেন, "মা, রোজ সকালে এই বইটা পাঠ করবে, মঙ্গল হবে।" মঙ্গল কে না চায়! তাই ঘরে এসেই বইটা খুলে বসে গেলাম। মলাটের ওপর লেখা, "বিষ্ণুপুরের মদন মোহনের আদি মাহাত্ম্য"। পাঁচালির ঢঙে মদনমোহনের কেরামতির বিবরণ দেওয়া আছে। পদকর্তার নাম, রচনাকাল কিছুই নেই। যে মুদ্রকের নাম দেওয়া রয়েছে তাঁরাও কিছু বলতে পারলেন না। পরে শুনলাম এধরণের অজস্র ছড়া গান বিষ্ণুপুরে প্রচলিত। সেসব কথা পরে হবে, আগে গপ্পোটা বলা যাক।


মদন মোহন মন্দির, বিষ্ণুপুর

গল্প শুরু হচ্ছে বিষ্ণুপুর গ্রামের "দেবদ্বিজে ভক্তিমতী সতী শিরোমণি" এক ক্ষত্রিয়কন্যার কথা দিয়ে। সে যখন দশমাসের গর্ভবতী তখন যুদ্ধে তার স্বামীর মৃত্যু হয়। ঘরে আর ভালো লাগছিল না। তাই পাশের বাড়ির এক মহিলা পুরীতে জগন্নাথ দর্শনে যাচ্ছে শুনে তার সঙ্গে ভিড়ে পড়ল। পথে এক জঙ্গলের মধ্যে তার প্রসব বেদনা উপস্থিত হল এবং সেখানেই এক পুত্রসন্তানের জন্ম দিল। সদ্যোজাত শিশুকে জঙ্গলে ফেলে রেখেই সেই ক্ষত্রিয় কন্যা চম্পট দিল। অন্তর্যামী নারায়ণ সব দেখে "মদনমোহন" রূপে মর্ত্যে নেমে এসে মৌমাছি সেজে গাছের ডালে রাতারাতি মৌচাক বানিয়ে ফেললেন। সেই মৌচাক থেকে ফোঁটা ফোঁটা মধু শিশুটির মুখে পড়ল। পরদিন সকালে এক বাগদির মেয়ে কাঠ কুড়োতে এসে সেই শিশুকে দেখতে পেয়ে তাকে কোলে করে এক ব্রাহ্মণের বাড়ি নিয়ে গেল।

ব্রাহ্মণের বাড়িতে সেই শিশু সযত্নে বড় হতে থাকে। সাত মাস বয়সে মাঘী পূর্ণিমার দিনে তার অন্নপ্রাশন হয়। গণকের পরামর্শে তার নাম রাখা হয় গোপাল সিংহ। আরেকটু বড় হলে সে ব্রাহ্মণের গরুগুলোকে মাঠে চড়াতে নিয়ে যেতে শুরু করে। এভাবে ভালোই চলছিল। কিন্তু একদিন গরু চড়াতে গিয়ে আর ফেরে না। তার বয়স তখন দশ বছর।  অরণ্যে হিংস্র জন্তু জানোয়ারের বাস। উদ্বিগ্ন ব্রাহ্মণ খুঁজতে গিয়ে দেখলেন গাছের তলায় সেই বালক নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে। তার মুখে সূর্যের আলো এসে পড়ছে। আর তাকে ছায়া দিতে ছাতা হয়ে ফণা তুলে দাঁড়িয়ে আছে দুটো সাপ।


বৃক্ষতলে শুয়ে শিশু নিদ্রা যায় সুখে,
সূর্যের কিরণ লাগে বালকের মুখে।।
নাগ ও নাগিনী দুটি সর্প তার কাছে।
ছায়া হেতু ছত্রাকারে ফণা ধরি আছে।।


ব্রাহ্মণকে দেখে সাপদুটো পালাল। বালককে কোলে নিয়ে বাড়ি ফিরে ব্রাহ্মণীকে বলল, "এ ছেলে যে সে নয়। একে আর তুমি পাতের এঁটোকাঁটা খেতে দিওনা।" পালিতপুত্রের মাহাত্ম্য সম্পর্কে ব্রাহ্মণ নিশ্চিত হলেন আরেকটা ঘটনায়। ঝিলে মাছ ধরতে গিয়ে সেই বালকের জালে উঠল গোটাকয়েক আস্ত সোনার ইঁট। মাছের আশায় সে আরেকবার জাল ফেলল। এবারো মাছ নয়, উঠল তুলসী চন্দন। তৃতীয়বার জাল জাল ফেলে পেল শঙ্খ, প্রদীপ, ঘন্টা ইত্যাদি পুজোর জিনিসপত্র। আর চতুর্থবার জালে উঠল স্বয়ং মদনমোহনের বিগ্রহ। মদনমোহনের আদেশে বালক তাঁকে ব্রাহ্মণের গৃহে স্থাপন করল। ব্রাহ্মণ বালকের কপালে রাজলক্ষণ দেখতে পেলেন। তাকে দিয়ে শপথ করিয়ে নিলেন সে যদি কোনদিন রাজা হয় তবে যেন তাঁকে পুজারি ব্রাহ্মণের পদে নিযুক্ত করে। 

বড় পাথর দরজা। দলমাদল কামান আগে এখানেই থাকত এবং মিথ অনুযায়ী এখানেই মদনমোহন বর্গীদের ওপর কামান দেগেছিলেন।

ক্রমে মদনমোহনের আশীর্বাদে বিষ্ণুপুরের সিংহাসনে বসল গোপাল সিংহ। সে আগের জন্মে ছিল মল্লবীর ভীম। এইভাবে বিষ্ণুপুরে মল্ল রাজবংশ স্থাপিত হল। একদিন বিষ্ণুপুর রাজ্য আক্রমণ করল বাহান্ন হাজার বর্গীর দল। রাজার করুণ অবস্থা দেখে মদনমোহন বুঝলেন তাঁকেই মাঠে নামতে হবে।



একদা আসিল বর্গী বাহান্ন হাজার।
লুটিতে রাজার গড় করি মার মার।।
নৃপ কহে গোলন্দাজ শুনহ বচন।
সহায় আমার শুধু মদনমোহন।।
অন্তর্যামী নারায়ণ জানিয়া অন্তরে।
তাড়াইতে বর্গী তিনি গেলেন সত্বরে।।
লালবাঁধে দল-মাদল দুটি কামান ছিল।
তার মধ্যে আশী মণ বারুদ ভরিল।।
দুইটি কামান প্রভু লইল দুই বগলে।
দুই হাতে দু কামানে দিল পলতে জ্বেলে।।
এক তোপে বহু বর্গী হইল নিধন।
কামানের শব্দে মূর্ছা গেল বহুজন।। 
দলমাদল কামান।

কামান দেগে বর্গী তাড়িয়ে রণক্লান্ত দেবতা ঘরে ফেরার পথে এক গোয়ালার কাছে দই চাইলেন। মদনমোহনকে চিনতে না পেরে গোয়ালা বল, "ওহে সিপাই, দই যে খাবে, তার পয়সা আছে তো তোমার কাছে?" মদনমোহন বললেন, "দেখো ভায়া আমি রাজার ছেলে। পয়সার জন্যে চিন্তা কোরো না।" এই বলে সাড়ে ষোলমণ দই সাবাড় করে মদনমোহন উধাও হয়ে গেলেন। এদিকে রাজা তখন রাস্তায় রাস্তায় মদনমোহনকে খুঁজে বেড়াচ্ছেন। গোয়ালা তাঁকে পেয়ে রাজপুত্রের দই খেয়ে যাওয়ার কথা নিবেদন করল। "রাজা বলে গোয়ালা তোর সার্থক জীবন, ছেলে নয় বই খেয়েছেন মদনমোহন।" গোয়ালা দেখল তার দইয়ের হাঁড়ি সোনা হয়ে গেছে। 



গোয়ালা বলে ভুলাও কি হে মদনমোহন।
মরণকালে দিও প্রভু অভয়চরণ।।

এই গোয়ালা পূর্বজন্মে ছিল কেশব ভারতী (শ্রীচৈতন্যের গুরু)। বিষ্ণপুরে তার নাম ছিল গোপাম মূরতি। পরের জন্মে সে উদয় হল কলকাতার বাগবাজারে, গোকুল মিত্র নামে এক ব্যবসায়ীরূপে। ওদিকে বিষ্ণুপুরে রাজবংশে প্রবল অর্থসংকট উপস্থিত হল। 


বিষ্ণুপুরের গ্রামখানি ছিল চাকুন্দার বন।
সন্ধ্যা দিতে তৈল পুড়ত সাড়ে সাত মণ।।

মদনমোহনের আদেশে রাজা গোকুল মিত্রের থেকে তিন লক্ষ টাকা ধার করলেন। বন্ধক রইল মদনমোহনের সেই বিগ্রহ। বিষ্ণুপুরের বদলে এবার বাগবাজারে পূজিত হতে শুরু করলেন মদনমোহন। গোকুল মিত্রর চাকরের নাম ছিল মদন। একদিন ঘুম ভেঙে বাবু মদনকে ডাকছেন। তার মনের কথা টের পেয়ে স্বয়ং মদনমোহন মদনের বেশে তামাক সেজে নিয়ে এল। তামাকে টান দিয়ে তো বাবু অবাক!


তামাক খেয়ে গোকুল মিত্র চারিদিকে চায়।
বিষ্ণুপুরের তামাক মদনা পেলি রে কোথায়।।

"মদন" ততক্ষণে মন্দিরে গা ঢাকা দিয়েছে।পরের দিন পুজো করতে গিয়ে বামুন ঠাকুর দেখলেন বিগ্রহের হাতে তামাক আর টীকার দাগ, কাপড় দিয়ে মুছলেও উঠছে না। ব্যাপার দেখে মিত্তিরমশাই কেসটা বুঝতে পারলেন এবং আদেশ জারি করলেন, তার বংশে যে তামাক সেবন করবে, সে স্ত্রীহত্যা ও ব্রহ্মহত্যার পাপে লিপ্ত হবে।
মদন মোহন ও লক্ষীপ্রিয়ার মূর্তি।
এদিকে মদনমোহন পড়েছেন লক্ষীপ্রিয়ার প্রেমে। লক্ষীপ্রিয়া হল গোকুল মিত্রের কন্যা। এক রাতে মদনমোহন হানা দিলেন লক্ষীপ্রিয়ার শয্যাকক্ষে। তার অঙ্গ স্পর্শ করতেই পতীব্রতা কন্যা জেগে উঠে বলে, "কে হে তুমি আমার সতীত্ব নষ্ট করছ??" ঠাকুর বললেন, "আমি কে পরে জানবে, আপাতত আমার চূড়া বাঁশীটা রাখো।" এই বলে নিজের চূড়া বাঁশি রেখে মদনমোহন নিজের ঘরে চলে এলেন। পরদিন চূড়াবাঁশি চুরি গেছে দেখে গোকুল মিত্র পুজারি ব্রাহ্মণদের ওপর হম্বি তম্বি শুরু করল। এমন সময় মদনমোহন দৈববাণী করে জানালেন, চূড়া বাঁশি তার কন্যার কাছেই আছে। এই লক্ষীপ্রিয়া আসলে একজন শাপভ্রষ্ট অপ্সরা। চূড়াবাঁশী ফেরৎ দিয়ে সে শাপমুক্ত হল এবং মদনমোহনের বাঁদিকে জায়গা পেল। 




বাগবাজারে বসে ঠাকুর খাচ্ছ চিনির পানা।
বিষ্ণুপুরে যেতে তোমায় কে করেছে মানা।।

ঠাকুর তো গোকুল মিত্তিরের ঘরে দিব্যি রয়েছেন, ওদিকে বিষ্ণুপুরে হাহাকার পড়ে গেছে। মন্দিরের পাথর খসে যাচ্ছে। রাজা থেকে প্রজা সবাই কাঁদছে। এমনকি দোলযাত্রা, রাস উৎসবও বন্ধ হয়ে গেছে।


হাতীশালে হাতী কাঁদে ঘোড়া না খায় পানি।
বিনিয়ে বিনিয়ে কাঁদে গোপাল সিংহের রাণী।।

রাণী নিজের গলা থেকে গজমোতি হার খুলে দিয়ে বললেন, "হার বেচে শোধ রাজা গোকুলের ধার।" কিন্তু রাজা টাকা নিয়ে গোকুল মিত্রের কাছে গেলে সে একটা জাল দলিল দেখিয়ে বলল, বিগ্রহ বিক্রী হয়ে গেছে। রাজা আর কি করেন! কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরে যাচ্ছিলেন এমন সময় স্বয়ং মদনমোহন তাঁকে দেখা দিয়ে বললেন, "ওহে রাজা, ফিরে যাচ্ছ কেন? তুমি আলিপুরের কাছারিতে গিয়ে আপিল করো। তোমার হয়ে আমি পাগড়ি পরে সওয়াল করব।" শুনে রাজা চটপট আলিপুরে গিয়ে দরখাস্ত দিলেন।


উকীলের বেশে প্রভু মদনমোহন।
কাছারিতে গিয়ে তিনি দেন দরশন।।
দেখি জজ ম্যাজিস্ট্রেট মানিল বিস্ময়।
কোথায় নিবাস তব কিবা নাম হয়।।
মদন উকীল নাম বাড়ী বিষ্ণুপুরে।
বেতন দিয়া মহারাজ রেখেছেন পুরে।।

মদন উকিলের কেরামতিতে রাজা মামলা জিতে গেলেন। কিন্তু গোকুল মিত্র অত সহজে হার মানার পাত্র নন। তিনি কুমোরটুলি থেকে একটা নকল মূর্তি গড়িয়ে রাজার হাতে তুলে দিলেন। রাজা মহা খুশি হয়ে যখন ফিরছেন তখন আবার দেখা দিলেন মদনমোহন। তাঁর কাছে ব্যাপার শুনে তো রাজা হাঁ! কোন বিগ্রহ আসল আর কোনটা নকল তা চেনার উপায়ও বাতলে দিলেন সেই মদনমোহন।


বামাঙ্গ যখন মোর ভিজিবে ঘামেতে।
হেরিবে মক্ষিকা শ্বেত নাকেতে বসিতে।।
আসল ঠাকুর সেই লবে কোলে তুলে।
রাখিও মনের কথা নাহি যেও ভুলে।।

রাজা মহাখাপ্পা হয়ে বাগবাজার ফিরে চললেন। ডাকাডাকিতে গোকুল বাইরে বেরিয়ে এলেন। রাজা বললেন, "তুমি তো মহা ছোটলোক হে! আমাকে একটা নকল ঠাকুর গছিয়ে দিলে?!!" গোকুল তখন আরেকটা ঠাকুর এনে বসিয়ে দেয়। দুটো হুবহু একরকম। কিন্তু দেখা গেল একটার বাম অঙ্গগুলো ঘামছে আর নাকে একটা সাদা মাছি এসে বসেছে। ব্যাস রাজা ওমনি সেটাকে কোলে তুলে নিলেন। এবার গোকুলের কাঁদার পালা। ঠাকুর তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, বৎসরান্তে অন্নকূট উৎসবের সময় বারো দণ্ড সময় তিনি গোকুলের কাছে থাকবেন। রাজা মদনমোহনকে সঙ্গে করে বিষ্ণুপুর নিয়ে গেলেন। রাণী সোনার থালায় করে ঠাকুরকে ক্ষীর, সর, মাখন খাওয়ালেন। রাস, দোল উৎসব আবার চালু হল। "বিষ্ণুপুর পুনঃ হয় হর্ষে হর্ষময়"।
  
পাঁচালি শেষ হল সকলকে মদনমোহনের আদি কথা পাঠ করার পরামর্শ দিয়ে। 


ভক্তিতে ডাকিলে নর মদনমোহনে।
অন্তকালে পায় স্থান প্রভুর চরণে।।
যে গৃহেতে হইবে এ আদি কথা।
রোগ শোক দুঃখ দৈন্য নাহি যায় তথা।।

বইয়ের কোথাও পদকর্তার নাম, রচনাকাল কিচ্ছু দেওয়া নেই। প্রকাশকও কিছু বলতে পারলেন না। সুকুমার সেন "বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস" গ্রন্থে লিখেছেন, "অষ্টাদশ-উনবিংশ শতাব্দীতে স্থানীয় দেবদেবী, ব্যক্তি বা ঘটনা বিশেষ ও দৈবদুর্বিপাক লইয়া বিস্তর ছড়া গান রচিত হইয়াছিল। পূর্বেও এইরূপ ছড়া রচিত হইত, কিন্তু সেগুলি আমাদের হস্তগত হইবার পূর্বেই লুপ্ত হইয়া গিয়াছে। ... একাধিক কবি রচিত মদনমোহন বন্দনা পাওয়া গিয়াছে। ইহার বর্ণনীয় বিষয় হইতেছে মদনমোহন কর্তৃক দলমাদল কামান দাগিয়া বিষ্ণুপুর হইতে বর্গী বিতাড়ন এবং চৈতন্য সিংহ কর্তৃক কলিকাতায় গোকুল মিত্রের নিকট মদনমোহন বিগ্রহ বন্ধক রাখা"। 

মদন গোপাল মন্দিরের দেওয়ালে চিত্রকলা। কামান দেগে বর্গী তাড়াচ্ছেন মদন মোহন।

ইন্টারনেটে ঘাঁটাঘাঁটি করতে করতে এই ধরণের আরেকটা ছড়া গান পেলামঃ "সাধু গোকুল মিত্রের জীবনী"। গল্প প্রায় এক, কোথাও কোথাও বিবরণ বিস্তৃততর, কোথাও সংক্ষিপ্ত, কোথাও আবার হুবহু এক পদ রয়েছে। যেমন "মদনমোহন মাহাত্ম্য"এ গোকুল মিত্রের কন্যা লক্ষীপ্রিয়ার শাপমুক্তির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু "গোকুল মিত্রের জীবনী"তে শাপের ব্যাপারটা বিশদে বলা হয়েছে। লক্ষীপ্রিয়া আসলে স্বর্গের অপ্সরা চন্দ্রাবলী। বৃন্দাবনের রাস উৎসব দেখে রাধার নামে কটুক্তি করেছিল বলে তাকে নীচঘরে জন্ম নিতে হয়েছিল।  আবার কোন কোন ঘটনা একেবারে অন্যরকম। যেমন মদনমোহন বিগ্রহ নিয়ে মামলার কথা দুই পাঁচালিতেই আছে। মদনমোহনের রাজার পক্ষে ওকালতির কথাও আছে। কিন্তু মামলার ফল দুই জায়গায় দুরকম। "মদনমোহন মাহাত্ম্য"এ বলা হচ্ছে, "রাজার ঠাকুর বলি ডিগ্রি হয়ে গেল/ গোকুল আকুল হয়ে কাঁদিতে লাগিল।" আর "গোকুল মিত্রের জীবনী" বলছে, "বিচার মতে রাজার ঠাকুর গোকুল ডঙ্কা মেরে নিল।" এখানে নকল ঠাকুর গড়ার ব্যাপারটাও নেই স্বাভাবিকভাবেই। কোথাও আবার একই পদ সামান্য অদলবদল করে ভিন্ন জায়গায় বসানো হয়েছে, যার ফলে অর্থ গেছে এক্কেবারে উলটে। "গোকুল মিত্রের জীবনী"তে বাগবাজারে মদনমোহনকে বন্ধক রেখে বিষ্ণুপুরে ফিরে যাওয়ার আগে রাজা বলছেন,
বাগবাজারে বসে ঠাকুর খাও চিনির পানা।আজ অবধি বিষ্ণুপুরে যেতে তোমায় করে গেলাম মানা।।
"মদনমোহন মাহাত্ম্য" তে প্রায় একই ধরণের পদ রয়েছে খানিকটা পরে, যখন বিষ্ণুপুরবাসী মদনমোহনের শোকে বিলাপ করছেনঃ
বাগবাজারে বসে ঠাকুর খাচ্ছ চিনির পানা।
বিষ্ণুপুরে যেতে তোমায় কে করেছে মানা।।

বুঝতে অসুবিধে হয় না "মদনমোহন মাহাত্ম্য" লিখেছেন হয়ত রাজার সভাকবি বা রাজভক্ত পদকর্তা। আর "গোকুল মিত্রের জীবনী"র রচয়িতা মিত্র পরিবারের বেতনভুক গীতিকার। তাই একই ঘটনা উভয়ে ব্যাখ্যা করেছেন ভিন্নভাবে, কখনো আবার ঘটনাটাকেই বদলে দিয়েছেন। আজকের সংবাদমাধ্যমের যে বিভিন্ন অংশ বিভিন্ন রাজনৈতিক গোষ্ঠীর স্বার্থরক্ষার তাগিদে "খবর তৈরী" করে, গোকুল মিত্র ও রাজার অন্নুভূক পদকর্তারা কি তাদেরই পূর্বসূরি? মনে পড়ছে নন্দীগ্রাম নিয়ে রাজ্য রাজনীতি যখন উত্তাল, শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক মহল আড়াআড়িভাবে বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল। তদনীন্তন রাজ্যপাল বলেছিলেন, "ট্রুথ ইজ ডিভাইডেড ইন নন্দীগ্রাম।"
এই ধরণের পদ ও পাঁচালিতে রাজভক্তি ও অলৌকিকতা প্রকট হলেও এসবের মধ্যে যে ইতিহাসের অনেক কিছুই লুকিয়ে থাকে তা বলাই বাহুল্য। বিষ্ণুপুরে আমাদের গাইড বলছিলেন বিষ্ণুপুরের রাজারা ক্ষত্রিয় ছিলেন, রাজস্থান থেকে এসেছিলেন। বাঁকুড়া ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ারে বিষ্ণুপুরের রাজপরিবারের সংরক্ষিত নথি অবলম্বনে যে "ইতিহাস" লেখা হয়েছে তাতে বলা হয়েছে ৬৯৫ খ্রীষ্টাব্দে উত্তর ভারতের এক রাজপুত্র সস্ত্রীক পুরীতে তীর্থ করতে যাওয়ার সময় বিষ্ণুপুরের কাছাকাছি লাউগ্রামে তাঁর স্ত্রী পুত্রসন্তান প্রসব করেন এবং সেই রাজপুত্র মা ও ছেলে কে স্থানীয় এক ব্রাহ্মণ ও এক কায়স্থর তত্ত্বাবধানে রেখে যান। এই পুত্রই কালক্রমে আদিমল্ল নাম নিয়ে মল্লরাজবংশের প্রতিষ্ঠা করেন। উইলিয়াম হান্টারের "অ্যানালস অফ রুরাল বেঙ্গল" বইয়ে আবার বৃন্দাবনের কাছের জয়নগর রাজ্যের রাজার দেশভ্রমণে বেরিয়ে বিষ্ণুপুরের নিকটস্থ অরণ্যে রাণীর পুত্রসন্তান প্রসব, সদ্যোজাতকে জঙ্গলে ফেলে রেখে প্রস্থান, স্থানীয় এক কাঠকুড়ুনি বাগদির শিশুকে আবিষ্কার এবং কালক্রমে নানা অলৌকিক ঘটনার মধ্য দিয়ে তার রাজপদে অভিষেকের কাহিনী আছে। আদিমল্লের জন্মকাহিনীর এই দুই বৃত্তান্তের সঙ্গে আলোচ্য "মদনমোহন মাহাত্ম্য" বা "গোকুল মিত্রের জীবনী"তে গোপাল সিংহের বাল্যলীলার বেশকিছু মিল ও অমিল আছে। সবকটা আখ্যানের একটা কমন বক্তব্য হল বিষ্ণুপুরের রাজারা স্থানীয় বা উত্তর ভারতীয় কোন ক্ষত্রিয় বংশজাত। বিনয় ঘোষ তাঁর "পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি" গ্রন্থে লিখেছেন, "মল্লরাজারা যখন সভাপণ্ডিতকে দিয়ে বংশবৃত্তান্ত রচনা করিয়েছেন তখন ভিতর থেকে জেলে আদিবাসীদের সঙ্গে আদিমল্লের সম্পর্কের সমস্ত কাহিনী ছেঁটে ফেলে ব্রাহ্মণ-কায়স্থদের কথা যোগ করেছেন এবং তাঁরা যে উত্তর ভারতের রাজপুত বংশজাত তাও ভালোভাবে বুঝিয়ে দিয়েছেন। বাংলার এইসমস্ত 'রাজবংশচরিত' ও 'কুলপঞ্জিকা'র একটা উপসর্গ মনোবিজ্ঞানীদের সহজেই নজরে পড়বে - সেটার নামকরণ করা যায় 'ক্ষত্রিয় কমপ্লেক্স' এবং 'রাজপুত কমপ্লেক্স'। হিন্দুসমাজের বর্ণবৈষম্যের এটা একটা স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া"। বাঁকুড়া ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ারেও বলা হয়েছে, "The fact that the Rajas of Bishnupur called themselves Mallas (an aboriginal title) for many centuries before they assumed the Kshattriya title of Singh, the fact that down to the present day they are known as Bagdi Rajas all over the Bengal, as well as numerous local facts and circumstances - all go to prove that the Rajas of Bishnupur are Khatriyas, because of their long independence and their past histories, but not by decent."

মল্লরাজারা ক্ষত্রিয় না বাগদি সে তর্ক মুলতুবি রেখেও একটা ব্যাপার বলা যায় যে বিষ্ণুপুরের রাজারা অন্তত সপ্তদশ শতকের আগে পর্যন্ত যথেষ্ট বীরত্বের পরিচয় দিয়ে নিজেদের স্বাতন্ত্র বজায় রেখেছিলেন। "মদনমোহন মাহাত্ম্য"এর রচয়িতা গোপাল সিংহের ভক্ত। তাই সপ্তম শতকে মল্লরাজ বংশের প্রতিষ্ঠা থেকে শুরু করে অষ্টাদশ শতকে বর্গী আক্রমণ ও গোকুল মিত্রের কাছে বিগ্রহ বন্ধক রাখা এই পুরো কীর্তিটাই তিনি চাপিয়ে দিয়েছেন গোপাল সিংহের ওপর। বাস্তবে গোপাল সিংহের রাজত্বকাল ছিল ১৭৩০ থেকে ১৭৪৫ খ্রিষ্টাব্দ এবং তাঁর সময়েই বিষ্ণুপুর রাজবংশের পতনের সূচনা। মল্লরাজারা আগে শাক্ত ছিলেন, সপ্তদশ শতকে রাজা বীরহাম্বিরকে বৈষ্ণবধর্মে দীক্ষিত করেন শ্রীনিবাস আচার্য। তারপরই বিষ্ণুপুরের বিখ্যাত টেরাকোটার মন্দির গুলো নির্মাণের কাজ শুরু হয়। কিন্তু গোপাল সিংহের সময় বৈষ্ণব আচার উৎকট আকার নিয়েছিল। রাজার আদেশে বাধ্যতামূলক হয় মালা জপ করা ও সূর্যাস্তের আগে হরিনাম ভজন করা। অন্যদিকে বর্ধমানের রাজা একের পর এক এলাকা ছিনিয়ে নিতে থাকে। ভাস্কর রাওয়ের বর্গীবাহিনী দুর্গের প্রতিরোধ ভেদ করতে না পারলেও ফসল ধবংস করে অর্থনীতিকে তছনচ করে দিয়ে যায়। 

অন্যদিকে ভারতবর্ষের ভাগ্যাকাশে ততদিনে উদিত হয়েছে নানাবিধ ঔপনিবেশিক শক্তি। বৃটিশদের বণিকের মানদণ্ড রাজদণ্ডে রূপান্তরিত হওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। যে মুর্শিদাবাদের নবাবদের থেকে "সিংহ" উপাধি পেয়েছিলেন বীরহাম্বিরের পৌত্র রঘুনাথ সিংহ, সেই নবাবরা কয়েকবছর পরেই পলাশীর যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বৃটিশের বেতনভুগে পরিণত হবেন। দেশীয় সামন্তশ্রেণী বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের কাছে সঙ্গে এঁটে উঠতে না পেরে ক্রমে তাদের অধীনস্ত জমিদারে পরিণত হল। আর অন্যদিকে সাম্রাজ্যবাদের ছত্রছায়ায় উত্থান ঘটল এক শ্রেণীর নব্য জমিদার ও ব্যবসায়ীগোষ্ঠীর। বিষ্ণুপুরের পরাক্রমশালী রাজা অর্থের প্রয়োজনে কুলদেবতাকে বন্ধক রাখতে যাচ্ছেন কলকাতার ব্যবসায়ীর কাছে - এ হয়ত সামন্ততন্ত্রের হাত থেকে বণিকতন্ত্রের হাতে ক্ষমতার হাতবদলেরই এক উদাহরণ। তবে মনে রাখতে হবে এই দুই শ্রেণীরই টিকি তখন বাঁধা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের কাছে। তাই কুলদেবতার অধিকার নিয়ে লড়াইয়ের নিস্পত্তি হয় ব্রিটিশ আদালতে। সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ হল স্বয়ং মদনমোহনের উকিল রূপে আদালতে সওয়াল। ভাগ্যের কি পরিহাস! যে ভগবান বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের নিয়ন্তা, মানুষের জাগতিক পাপ-পুণ্যের বিচারক, সেই ভগবান কে কি না পাগড়ি পরে দাঁড়াতে হল ম্লেচ্ছ জজ ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে! 

এতে ভগবানের মহিমা কতটা ক্ষুণ্ণ হল জানি না তবে বাঙালীর কাছে ভগবান এই রূপেই ধরা দিয়েছে বার বার। অন্তর্যামী নারায়ণ তাই কামান দেগে বর্গী তাড়ান, গোয়ালার থেকে দই হাতিয়ে ক্ষুধা মেটান, কামতাড়নায় বণিক কন্যার শয্যায় হানা দেন, কাছারি আদালতে ওকালতি ই বা করবেন না কেন? 

বিষ্ণুপুরে যাঁরা ঘুরতে যাবেন তাঁরা একটা করে "মদনমোহন মাহাত্ম্য" না নিয়ে ফিরবেন না। মন দিয়ে মদন মোহনের মাহত্ম্য পড়লে আধুনিক বর্গীদের হামলা ঠেকাতে সুবিধে হবে।


তথ্যসূত্রঃ


   () বিষ্ণুপুরের মদনমোহনের আদি মাহাত্ম্য, প্রকাশকঃ বীণাপাণি পুস্তক মন্দির
() সাধু গোকুল মিত্রের জীবনী, প্রকাশকঃ অজানা
() মন্দির নগরী বিষ্ণুপুর A Guide Book, প্রকাশকঃ বিশ্বজিৎ ব্যানার্জি
() পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি (প্রথম খণ্ড), বিনয় ঘোষ, প্রকাশকঃ প্রকাশ ভবন
() Bankura District Gezetier, Chapter II
() বিষ্ণুপুর ট্যুরিষ্ট গাইড শ্রী মিঠু ভুঁই-এর সঙ্গে কথোপকথন

ছবিঃ অতনু ও শ্রীরূপা
প্রথম প্রকাশঃ চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম