Tuesday, 26 May 2020

তিন বিপর্যয় ও কিছু ভাবনা

করোনা অতিমারী, ঘূর্ণিঝড়, পঙ্গপাল হানা -- দুহাজার কুড়ি সালের প্রথমার্ধে একটার পর একটা বিপর্যয়ের মধ্যে কোন দৈব দুর্বিপাক না থাকলেও কয়েকটা সাধারণ বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয়৷

প্রথমত এই সবকটা বিপর্যয়ের সঙ্গেই জড়িয়ে আছে প্রকৃতির ওপর মানুষের দখলদারি৷ সার্স, মার্স, ইবোলার মত নোভেল করোনা ভাইরাসের মানবশরীরে অনুপ্রবেশ বন্যজন্তুদের জীবনে মানুষের অকারণ হস্তক্ষেপের ফল৷ সমুদ্রে ঘন ঘন অতি গভীর নিম্নচাপের সৃষ্টি ও তার ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হওয়ার ঘটনা সরাসরি জড়িত বিশ্ব উষ্ণায়ণের সঙ্গে৷ মরুভূমির পঙ্গপালদের "নিঃসঙ্গ দশা" থেকে "দলবদ্ধ দশা"য় উত্তরণ, বিপুল হারে বংশবৃদ্ধি, এক মহাদেশ থেকে অন্য মহাদেশে ছড়িয়ে পড়া এইসবের সঙ্গেও জলবায়ু পরিবর্তনের সম্পর্ক আছে বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত৷

দ্বিতীয়তঃ একটা ভাইরাস কিভাবে পশু থেকে মানুষের দেহে প্রবেশ করে নিজেকে মিউটেট করে, দেহের কোন অঙ্গকে কিভাবে আক্রমণ করে, দেহে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা কিভাবে কাজ করে, সংক্রমণের লক্ষণ ও তা এড়ানোর উপায় কি; সমুদ্রের নিম্নচাপ কিভাবে ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হয়, তা কখন কোন পথে স্থলভাগে প্রবেশ করে, তার গতি ও ক্ষমতাই বা কত হতে পারে; পঙ্গপাল কিভাবে, কোন পরিবেশে একক দশা থেকে ঝাঁকে রূপান্তরিত হয়, তারা কিভাবে এক মহাদেশ থেকে অন্য মহাদেশে পাড়ি দেয় এই সব কিছু বলতে পারে একমাত্র বিজ্ঞান৷ বিজ্ঞানের সেই তথ্যকে কাজে লাগিয়ে প্রশাসন উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে পারে যাতে ক্ষয়ক্ষতি ন্যূনতম হয়৷ যে জিনিসটাকে মানুষ সবচেয়ে বেশী গুরুত্ব দেয় সেই ধর্ম বা ঈশ্বরের এর মধ্যে কোন ভূমিকা নেই৷

তৃতীয়তঃ নোভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হয় চীনের উহান শহরে৷ সেখান থেকে তা ছড়িয়ে পড়েছে গোটা পৃথিবীতে৷ ঘূর্ণিঝড় আমফানের উৎপত্তি বঙ্গোপসাগরে, তার নামকরণ করেছে তাইল্যান্ড, সে আছড়ে পড়েছে পশ্চিমবঙ্গ, ওড়িশা ও বাংলাদেশে৷ পঙ্গপালের ঝাঁক আরব মরুভূমিতে দল পাকিয়ে পূর্ব আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য ঘুরে ইরান, পাকিস্তান হয়ে ঢুকেছে ভারতে৷ কিছু মানুষ এখনও "দেশ" বলতে কাঁটাতারে ঘেরা একটা ভূখণ্ডের বেশী কিছু বোঝেন না, আর সেই ভূখণ্ডের কয়েক ইঞ্চি নিয়ে প্রতিবেশীর সঙ্গে লাঠালাঠি করাকেই দেশপ্রেমের পরকাষ্ঠা বলে গণ্য করেন, সেই ভূখণ্ডের বৈধ অধিবাসীদের তালিকা বানানোর জন্য কোটি কোটি টাকা খরচ করে মানুষের জীবন অতিষ্ঠ করে তোলাকে অত্যন্ত জরুরী কাজ মনে করেন৷ প্রকৃতি আমাদের কান ধরে বুঝিয়ে দিল ঐসব কাঁটাতারের সীমানা আসলে কতটা ঠুনকো৷

চতুর্থতঃ জাতীয়তা ছাড়াও এই ধর্ম, ভাষা ইত্যাদি যেসব নিয়ে মানুষ লড়ালড়ি করতে ভালোবাসে, করোনাভাইরাস, আমপান, পঙ্গপালের দল কেউই সেসব ভাগাভাগি কে পাত্তা দিচ্ছে না৷ তার মানে কি সব মানুষ সমানভাবে বিপর্যস্ত হচ্ছেন? না তাও নয়৷ লকডাউনে কর্মহীন দিনমজুর, ভিনরাজ্যে আটকে পড়ে হাজার মাইল হেঁটে পারি দেওয়া পরিযায়ী শ্রমিক, ঘরবন্দী অবস্থায় অবসাদগ্রস্থ চাকুরীজীবি, মুনাফা কমে যাওয়ার আশঙ্কায় থাকা শিল্পপতি - সবার সঙ্কট একরকম নয়৷ ঘূর্ণিঝড়ে বিদ্যুৎ, জল, নেটওয়ার্ক না পাওয়া শহরবাসী আর বাড়ি ধ্বসে যাওয়া সুন্দরবনবাসীর সমস্যাগুলোও আলাদা আলাদা৷ পঙ্গপালের হানায় শস্যহানির আতঙ্কে ভোগা কৃষক আর খাদ্যশস্যের মূল্যবৃদ্ধির শঙ্কায় থাকা মধ্যবিত্তর অবস্থার মধ্যেও ফারাক আছে৷ এককথায় বলতে গেলে যে মানুষ অর্থনৈতিকভাবে যত দুর্বল, তাঁর বিপর্যয়ের মাত্রাও তত বেশী৷

এখন প্রতিটা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্য আছে, সেগুলোর মোকাবিলার কৌশলও একেবারেই স্বতন্ত্র৷ তবে সাধারণভাবে বলা যায় যেকোন বিপর্যয়ের মোকাবিলার দুটো দিক আছেঃ একটা দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনাঃ বিপর্যয় আবার আসার সম্ভাবনা কমানো৷ আরেকটা তাৎক্ষণিকঃ বিপর্যয় যখন এসে পড়বে, ক্ষয়ক্ষতি যেন ন্যূনতম হয়৷ দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার অঙ্গ হল প্রকৃতির নিয়মকে বোঝা, তার ক্ষতি যথাসম্ভব কম করা, যে ক্ষতি ইতিমধ্যে হয়ে গেছে তার খানিকটা অন্তত পূরণ করা৷ আর তাৎক্ষণিক কৌশলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হল যে মানুষ অর্থনৈতিকভাবে যত দুর্বল, তাকে তত বেশী সুরক্ষা দেওয়া৷ আর এর দুয়ের জন্যই প্রয়োজন সমাজে মুক্তচিন্তা, বিজ্ঞানচর্চার পরিবেশ উন্নত করা, জনমুখী প্রশাসন ও দক্ষ জনস্বাস্থ্য পরিকাঠামো গড়ে তোলা এবং সঙ্কীর্ণ জাত্যাভিমান ত্যাগ করে আন্তর্জাতিক সমন্বয়কে জোরদার করা৷


চিত্রসূত্রঃ এই সময়, ২৬শে মে, ২০২০

পল্লব দত্তর সংযোজনঃ ইদানিং যে বনাঞ্চল ধ্বংস শুরু হয়েছে, সে আমাজন থেকে উত্তরাখন্ড, অস্ট্রেলিয়া থেকে অযোধ্যা। অনেকাংশেই সন্দেহজনকভাবে ঘটা অগ্নিকাণ্ডে পুড়ে যাচ্ছে বিশাল বনভূমি! গাছ কাটা নয় এখন আরো মারাত্মক উপায়ে বনাঞ্চল ধ্বংস করার উপায় বার করে ফেলেছে মাফিয়ারা! এবং কোথাও কোথাও রাষ্ট্রীয় মদতে! আমাজন বনাঞ্চলের ক্ষেত্রেই যেমন প্রেসিডেন্ট Bolsonaro এর বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে! গত কয়েক বছরে অগ্নিকাণ্ডে বনাঞ্চল ধ্বংস হওয়ার ঘটনা উল্লেখযোগ্য ভাবে বেড়েছে।আবার ভারতে নর্মদা ভ্যালিতে তৈরী প্যাটেল স্ট্যাচু ওই অঞ্চলের স্বাভাবিক ইকোসিস্টেম থেকে স্থানীয় বাসিন্দাদের জীবন সবক্ষেত্রেই ভীষণ নেগেটিভ প্রভাব ফেলেছে। বিগত দশকে এমন উদাহরণ ভুরি ভুরি পাওয়া যাবে যেখানে মাফিয়ারা নয়, রাষ্ট্র নিজেই বনাঞ্চল ধ্বংস করায় সক্রিয় ভূমিকা নিচ্ছে!

Friday, 8 May 2020

লকডাউনে পড়া বইঃ গান্ধী গবেষণা

ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীনতার পথে রওনা দেওয়া প্রায় সমস্ত জাতিই তার পিতৃত্ব অর্পণ করে থাকে তার স্বাধীনতা সংগ্রামের কেন্দ্রীয় ভূমিকায় থাকা কোন এক ব্যক্তির ওপর৷ জাতির জনক কোন ব্যক্তি হতে পারেন কি না তা নিয়ে বিতর্ক আছে, থাকবে৷ কিন্তু ভারতবর্ষ বোধহয় একমাত্র দেশ, যার "জাতির জনক" কে স্বাধীন দেশে কুৎসিততম ভাষায় আক্রমণ করা এমনকি তাঁর হত্যাকারীকে মহিমান্বিত করা অপরাধ বলে গণ্য হয় না৷ পান্নালাল দাশগুপ্তর "গান্ধী গবেষণা" বইটা পড়তে পড়তে মনে হল এটার জন্য গান্ধীজি নিজেই দায়ী৷ নিজেকে তো তিনি কোন অবিসংবাদী নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চাননি৷ তিনি নিজেই ঠিক, বাকি সবাই ভুল - এমন ধারণা তিনি কখনও পোষণ করেননি৷ বরং সারাটা জীবন ব্যাপৃত থেকেছেন সত্যানুসন্ধানের কাজে৷ তিনি যে সত্যকে খুঁজে পাচ্ছেন, তা যে খণ্ডিত সত্য, আপেক্ষিক সত্য এব্যাপারেও তিনি সচেতন৷ তাঁর মৃত্যুর পর যেন "গান্ধীবাদ" নামক কোন সঙ্কীর্ণ মতবাদ তৈরী করার চেষ্টা করা না হয় সে বিষয়েও তিনি অনুগামীদের সতর্ক করে দিয়েছেন৷ কাজেই বলা যায় গান্ধীজি এমন দেশ দেখতে চাননি, যেখানে তাঁকে গালিগালাজ করলে শাস্তি পেতে হবে৷ আর তাঁর যে হত্যাকারী সে তো অনেক আগেই তাঁকে হত্যার ব্যর্থ চেষ্টা করেছিল আর গান্ধী তাকেও তখন ক্ষমা করে দিয়েছিলেন৷

পান্নালাল দাশগুপ্ত যৌবনে সশস্ত্র বিপ্লবের পথে স্বাধীনতা অর্জনে প্রয়াসী ছিলেন৷ স্বাধীনতার পরেও তাঁকে কারাবরণ করতে হয়৷ আলোচ্য গন্থটির পাণ্ডুলিপি তিনি লিখেছিলেন ১৯৫৪-৫৫ সালে জেলে বসে৷ তিরিশ বছর পর সেটি বই আকারে প্রকাশিত হয়৷ ইতিমধ্যে দেশ ও বিশ্বের পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়েছে, লেখকের ভাবনাচিন্তাও বদলেছে৷ কিন্তু তিনি মূল পাণ্ডুলিপিকে অপরিবর্তিত রেখেই নতুন চিন্তাভাবনাকে ফুটনোটের মাধ্যমে ব্যক্ত করেছেন৷ "গান্ধী গবেষণা" নামটির দুটি তাৎপর্য আছেঃ গান্ধীজির নিজের সত্যানুসন্ধানের গবেষণা এবং গান্ধীজিকে নিয়ে অন্যদের গবেষণা৷ একজন কমিউনিস্ট বিপ্লবী হিসেবে তিনি মার্কসবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে গান্ধীজির মূল্যায়ন করেছেন৷ তাঁর উদ্দেশ্য বামপন্থীদের কাছে গান্ধীজি কে নতুনভাবে দেখানো এবং তথাকথিত গান্ধীবাদীদের কাছে ঐতিহাসিক গান্ধীকে তুলে ধরা৷ পরিশিষ্ট সহ বইটির মোট ১৫ টি অধ্যায়ঃ (১) গান্ধী ও সত্য, (২) গান্ধীজির ভগবান ও ধর্ম, (৩) অহিংসা, (৪) সত্যাগ্রহ, (৫) সত্যাগ্রহ বনাম দুরাগ্রহ, (৬) গঠনমূলক কাজ, (৭) রবীন্দ্রনাথ ও গান্ধী, (৮) গান্ধীজি ও সুভাষচন্দ্র, (৯) হরিজন-আদিবাসী-মজুর ইত্যাদি, (১০) ট্রাস্টিশিপ বা অছিপ্রথা, (১১) নারীজাতির উন্নয়ন, (১২) গান্ধীজি ও ব্যক্তি, (১৩) গান্ধী ও ইতিহাস, (১৪) গান্ধীবাদ। আগ্রহী পাঠক বইটা থেকে যথেষ্ট ভাবনার খোরাক পাবেন বলে আমার বিশ্বাস৷ কয়েকটা দিক সংক্ষেপে উল্লেখ করছি, যেগুলো আমার কাছে তাৎপর্যপূর্ণ মনে হয়েছে৷


প্রথমতঃ গান্ধীজির সঙ্গে "অহিংসা" কে অনেক সময়েই অবিচ্ছেদ্য ভাবে জুড়ে দেওয়া হয়৷ কিন্তু বাস্তবে তাঁর কাছে "সত্যে"র স্থান ছিল অনেক ওপরে৷ তিনি একাধিকবার বলেছেন, সত্যের সন্ধান করতে গিয়েই তিনি অহিংসা কে পেয়েছেন এবং প্রয়োজনে সত্যের খাতিরে অহিংসা কে ত্যাগ করতেও প্রস্তুত৷ লেখক দেখিয়েছেন বেশ কয়েকটা ক্ষেত্রে তিনি বলপ্রয়োগের ব্যাপারে সম্মতি দিয়েছেন৷ অহিংসা কোন ভীরুর ধর্ম ণয় এবং অহিংসা হিংসা কে এড়িয়ে চলে না বা হিংসা কে অস্বীকার করে না৷ বরং হিংসার মুখোমুখি দাঁড়ানোটাই অহিংস সত্যাগ্রহর বৈশিষ্ট্য৷

দ্বিতীয়তঃ ডগমা বা গোঁড়ামিকে গান্ধীজি সারাজীবন পরিহার করে চলতে চেয়েছেন৷ যে মতবাদই হোক, তাকে বিনা প্রশ্নে মেনে নেওয়া চলবে না৷ সেকারণে তাঁর মত ও বিশ্বাসের পরিবর্তন হয়েছে৷ আগে তিনি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের মহত্বের ওপর আস্থাশীল ছিলেন, উপনিবেশগুলোর ওপর শোষণ নেহাতই বিচ্যূতি বলে মনে করতেন এবং ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের মধ্যে থেকেই ভারত নিজের মর্যাদা পুনরুদ্ধার করতে পারবে বলে বিশ্বাস করতেন৷ সেই বিশ্বাস ক্রমে মুছে যায়৷ চৌরিচৌরার ঘটনা নিয়ে তিনি অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহার করেন, কিন্তু ৪২ এ হিংসার সম্ভাবনা কে মাথায় রেখেই ভারত ছাড়ো আন্দোলনের ডাক দেন৷ পরম ধার্মিক, নিষ্ঠাবান হিন্দু হিসেবে তাঁর বিশ্বাস ছিলঃ God is Truth. পরে তিনি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে Truth is God. হিন্দু সমাজের বর্ণপ্রথা নিয়ে তাঁর যে মোহ ছিল তা থেকেও তিনি ভবিষ্যতে সরে আসেন৷

তৃতীয়তঃ মার্কসবাদীরা গান্ধীজি কে বুর্জোয়া নেতা হিসেবে ব্যাখ্যা করতেন, কেউ কেউ আরো কয়েক ধাপ এগিয়ে তাঁকে "সাম্রাজ্যবাদের এজেন্ট" অভিধা দিতেন৷ লেখক গান্ধীজির শ্রেণীচরিত্র বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন, গান্ধীজি আদৌ ধনিক শ্রেণীর প্রতিনিধি ছিলেন না, বরং গরীব, খেটে খাওয়া মানুষ বিশেষ করে কৃষকশ্রেণীর সঙ্গেই তাঁকে সবচেয়ে বেশী আইডেন্টিফাই করা যায়৷ আর তিনি যে শুধু সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তাই নয়, তিনি পুঁজিবাদেরও বিরোধী ছিলেন এবং তাঁর নেতৃত্বে স্বাধীনতা সংগ্রামের চরিত্র চীন বিপ্লবের মতই নয়া গণতান্ত্রিক চরিত্রের৷ পঞ্চাশের দশকে জেলের অভ্যন্তরে বসে লেখকের ধারণা হয়েছিল ভারত নেহরুর নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক পথে এগিয়ে চলবে৷ পরে তাঁর ভুল সংশোধন করেছেন৷

চতুর্থতঃ বইয়ের ১৫ টি অধ্যায়ের মধ্যে সর্ববৃহৎ অধ্যায়টি হল "গঠনমূলক কাজ"৷ 
যুদ্ধের জন্য বা সশত্র বিপ্লবের জন্য যেমন ট্রেনিং এর দরকার, তেমনি অহিংস সত্যাগ্রহের জন্যও প্রস্তুতির প্রয়োজন৷ সেটাই হল গঠনমূলক কাজ৷ কুটিরশিল্প, চরকা, বয়স্ক শিক্ষা, গোরক্ষা, হিন্দু মুসলমান ঐক্য, হরিজন সেবা ইত্যাদি নানাবিধ গঠনমূলক কাজ এবং অর্থনীতি, নৈতিকতা, শ্রমের মাধ্যমে শিক্ষা ইত্যাদি বিষয়ে গান্ধীজির পরিকল্পনা নিয়ে এই অধ্যায়ে লেখক আলোচনা করেছেন৷ এই প্রসঙ্গে একটা কথা মনে হয়৷ রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ ও ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি প্রায় একই সময়ে গঠিত হয়৷ কমিউনিস্ট পার্টি রাজনৈতিক লড়াইয়ের পাশাপাশি নানাবিধ গণসংগঠনের মাধ্যমে গঠনমূলক কাজ করার চেষ্টা করেছে ঠিকই কিন্তু গণসংগঠনগুলোর ওপর পার্টির নিয়ন্ত্রণ প্রশ্নাতীত৷ পার্টিই নিয়ন্ত্রণ করেছে শ্রমিক ও কৃষক সংগঠনকে, উল্টোটা হয়নি৷ অন্যদিকে আরএসএস নিজেরা সক্রিয় রাজনীতিতে না জড়িয়ে গঠনমূলক (নেতিবাচক অর্থে) কাজে মনোনিবেশ করেছে৷ তার রাজনৈতিক শাখাগুলো কিন্তু নিয়ন্ত্রিত হয়েছে সঙ্ঘের দ্বারা৷ আজ একশো বছর পর ভারতের রাজনৈতিক পরিস্থিতি দেখে আমরা বুঝতে পারি গান্ধীজির গঠনমূলক কাজের তাৎপর্য৷






গান্ধী গবেষণা,
পান্নালাল দাশগুপ্ত,
নবপত্র প্রকাশন৷ দাম ২৫০ টাকা৷

Monday, 29 October 2018

বক্সা পাহাড়ের প্রজাপতি

আমি প্রজাপতি প্রেমিক নই। ফটোগ্রাফিতেও কঅক্ষর গোমাংস। তবু তন্ময় যখন কমলার ওপর কালো নকশাকাটা প্রজাপতিটাকে দেখালো তার পেছন পেছন ক্যামেরা নিয়ে ছুটতে গিয়ে খানিক নেশা ধরে গেল। গোটা ডুয়ার্স ট্রিপ টা আর কিছু না হোক প্রজাপতির জন্যেই মনে থেকে যেত। পাহাড় জঙ্গল ভেঙে হাঁটতে হাঁটতে দেখা পেলাম অজস্র রংবেরং এর প্রজাপতি। কোনটা রেলিং-এর সঙ্গে রঙ ম্যাচ করে ক্যামোফ্লেজ করেছে, কোনটা আবার শুকনো পাতার মিমিক্রি করেছে।দুর্ভাগ্যের বিষয় তাদের এনার্জি অফুরন্ত, দুদণ্ড বসে ছবি তোলার অবকাশ দেওয়ার ইচ্ছে মোটে নেই। তবু যে কটা কে তুলতে পেরেছি দিয়ে দিলাম। এই বক্সা ব্যাঘ্র প্রকল্প (Buxa Tiger Reserve) এলাকায় নাকি চারশোর ওপর প্রজাপতির প্রজাতি আছে। এই ওয়েবসাইট থেকে ভারতবর্ষের সমস্ত প্রজাপতির তথ্য মিলবে। এখান থেকেই যতগুলো কে চিহ্নিত করতে পেরেছি তাদের নাম দিয়ে দিলাম। 

Indian Red Admiral

Bengal Yellowjack Sailer



Chocolate Pansy

Oriental Common Mime

Double-branded Crow

Coromandel Glassy Tiger



Medus Brown

Broad-banded Sailer



সমস্ত ছবি অক্টোবরের ২১-২৪ তারিখে Buxa Tiger Reserve  এলাকায় Canon EOS 1500D Digital SLR Camera তে EF S18-55 লেন্স ব্যবহার করে তুলেছি।


Thursday, 26 July 2018

মদনমোহনের কীর্তিকলাপ


বিষ্ণুপুর ঘুরতে গেছি দুদিনের জন্যে। যেকোন ট্যুরিস্ট স্পটেই যা হয় মন্দিরগুলোর সামনে গাইডবুক, ছবির অ্যালবাম, আরো নানারকম চটি বই বিক্রি হচ্ছিল। মদনমোহন মন্দিরের সামনে বয়সের ভারে ন্যূব্জ এক বৃদ্ধ ফেরিওয়ালাকে দেখে শ্রীরূপা দয়াপরবশ হয়ে ১০ টাকা দিয়ে একটা হলুদ রঙের চটি বই কিনে ফেলল। বৃদ্ধ ওকে বললেন, "মা, রোজ সকালে এই বইটা পাঠ করবে, মঙ্গল হবে।" মঙ্গল কে না চায়! তাই ঘরে এসেই বইটা খুলে বসে গেলাম। মলাটের ওপর লেখা, "বিষ্ণুপুরের মদন মোহনের আদি মাহাত্ম্য"। পাঁচালির ঢঙে মদনমোহনের কেরামতির বিবরণ দেওয়া আছে। পদকর্তার নাম, রচনাকাল কিছুই নেই। যে মুদ্রকের নাম দেওয়া রয়েছে তাঁরাও কিছু বলতে পারলেন না। পরে শুনলাম এধরণের অজস্র ছড়া গান বিষ্ণুপুরে প্রচলিত। সেসব কথা পরে হবে, আগে গপ্পোটা বলা যাক।


মদন মোহন মন্দির, বিষ্ণুপুর

গল্প শুরু হচ্ছে বিষ্ণুপুর গ্রামের "দেবদ্বিজে ভক্তিমতী সতী শিরোমণি" এক ক্ষত্রিয়কন্যার কথা দিয়ে। সে যখন দশমাসের গর্ভবতী তখন যুদ্ধে তার স্বামীর মৃত্যু হয়। ঘরে আর ভালো লাগছিল না। তাই পাশের বাড়ির এক মহিলা পুরীতে জগন্নাথ দর্শনে যাচ্ছে শুনে তার সঙ্গে ভিড়ে পড়ল। পথে এক জঙ্গলের মধ্যে তার প্রসব বেদনা উপস্থিত হল এবং সেখানেই এক পুত্রসন্তানের জন্ম দিল। সদ্যোজাত শিশুকে জঙ্গলে ফেলে রেখেই সেই ক্ষত্রিয় কন্যা চম্পট দিল। অন্তর্যামী নারায়ণ সব দেখে "মদনমোহন" রূপে মর্ত্যে নেমে এসে মৌমাছি সেজে গাছের ডালে রাতারাতি মৌচাক বানিয়ে ফেললেন। সেই মৌচাক থেকে ফোঁটা ফোঁটা মধু শিশুটির মুখে পড়ল। পরদিন সকালে এক বাগদির মেয়ে কাঠ কুড়োতে এসে সেই শিশুকে দেখতে পেয়ে তাকে কোলে করে এক ব্রাহ্মণের বাড়ি নিয়ে গেল।

ব্রাহ্মণের বাড়িতে সেই শিশু সযত্নে বড় হতে থাকে। সাত মাস বয়সে মাঘী পূর্ণিমার দিনে তার অন্নপ্রাশন হয়। গণকের পরামর্শে তার নাম রাখা হয় গোপাল সিংহ। আরেকটু বড় হলে সে ব্রাহ্মণের গরুগুলোকে মাঠে চড়াতে নিয়ে যেতে শুরু করে। এভাবে ভালোই চলছিল। কিন্তু একদিন গরু চড়াতে গিয়ে আর ফেরে না। তার বয়স তখন দশ বছর।  অরণ্যে হিংস্র জন্তু জানোয়ারের বাস। উদ্বিগ্ন ব্রাহ্মণ খুঁজতে গিয়ে দেখলেন গাছের তলায় সেই বালক নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে। তার মুখে সূর্যের আলো এসে পড়ছে। আর তাকে ছায়া দিতে ছাতা হয়ে ফণা তুলে দাঁড়িয়ে আছে দুটো সাপ।


বৃক্ষতলে শুয়ে শিশু নিদ্রা যায় সুখে,
সূর্যের কিরণ লাগে বালকের মুখে।।
নাগ ও নাগিনী দুটি সর্প তার কাছে।
ছায়া হেতু ছত্রাকারে ফণা ধরি আছে।।


ব্রাহ্মণকে দেখে সাপদুটো পালাল। বালককে কোলে নিয়ে বাড়ি ফিরে ব্রাহ্মণীকে বলল, "এ ছেলে যে সে নয়। একে আর তুমি পাতের এঁটোকাঁটা খেতে দিওনা।" পালিতপুত্রের মাহাত্ম্য সম্পর্কে ব্রাহ্মণ নিশ্চিত হলেন আরেকটা ঘটনায়। ঝিলে মাছ ধরতে গিয়ে সেই বালকের জালে উঠল গোটাকয়েক আস্ত সোনার ইঁট। মাছের আশায় সে আরেকবার জাল ফেলল। এবারো মাছ নয়, উঠল তুলসী চন্দন। তৃতীয়বার জাল জাল ফেলে পেল শঙ্খ, প্রদীপ, ঘন্টা ইত্যাদি পুজোর জিনিসপত্র। আর চতুর্থবার জালে উঠল স্বয়ং মদনমোহনের বিগ্রহ। মদনমোহনের আদেশে বালক তাঁকে ব্রাহ্মণের গৃহে স্থাপন করল। ব্রাহ্মণ বালকের কপালে রাজলক্ষণ দেখতে পেলেন। তাকে দিয়ে শপথ করিয়ে নিলেন সে যদি কোনদিন রাজা হয় তবে যেন তাঁকে পুজারি ব্রাহ্মণের পদে নিযুক্ত করে। 

বড় পাথর দরজা। দলমাদল কামান আগে এখানেই থাকত এবং মিথ অনুযায়ী এখানেই মদনমোহন বর্গীদের ওপর কামান দেগেছিলেন।

ক্রমে মদনমোহনের আশীর্বাদে বিষ্ণুপুরের সিংহাসনে বসল গোপাল সিংহ। সে আগের জন্মে ছিল মল্লবীর ভীম। এইভাবে বিষ্ণুপুরে মল্ল রাজবংশ স্থাপিত হল। একদিন বিষ্ণুপুর রাজ্য আক্রমণ করল বাহান্ন হাজার বর্গীর দল। রাজার করুণ অবস্থা দেখে মদনমোহন বুঝলেন তাঁকেই মাঠে নামতে হবে।



একদা আসিল বর্গী বাহান্ন হাজার।
লুটিতে রাজার গড় করি মার মার।।
নৃপ কহে গোলন্দাজ শুনহ বচন।
সহায় আমার শুধু মদনমোহন।।
অন্তর্যামী নারায়ণ জানিয়া অন্তরে।
তাড়াইতে বর্গী তিনি গেলেন সত্বরে।।
লালবাঁধে দল-মাদল দুটি কামান ছিল।
তার মধ্যে আশী মণ বারুদ ভরিল।।
দুইটি কামান প্রভু লইল দুই বগলে।
দুই হাতে দু কামানে দিল পলতে জ্বেলে।।
এক তোপে বহু বর্গী হইল নিধন।
কামানের শব্দে মূর্ছা গেল বহুজন।। 
দলমাদল কামান।

কামান দেগে বর্গী তাড়িয়ে রণক্লান্ত দেবতা ঘরে ফেরার পথে এক গোয়ালার কাছে দই চাইলেন। মদনমোহনকে চিনতে না পেরে গোয়ালা বল, "ওহে সিপাই, দই যে খাবে, তার পয়সা আছে তো তোমার কাছে?" মদনমোহন বললেন, "দেখো ভায়া আমি রাজার ছেলে। পয়সার জন্যে চিন্তা কোরো না।" এই বলে সাড়ে ষোলমণ দই সাবাড় করে মদনমোহন উধাও হয়ে গেলেন। এদিকে রাজা তখন রাস্তায় রাস্তায় মদনমোহনকে খুঁজে বেড়াচ্ছেন। গোয়ালা তাঁকে পেয়ে রাজপুত্রের দই খেয়ে যাওয়ার কথা নিবেদন করল। "রাজা বলে গোয়ালা তোর সার্থক জীবন, ছেলে নয় বই খেয়েছেন মদনমোহন।" গোয়ালা দেখল তার দইয়ের হাঁড়ি সোনা হয়ে গেছে। 



গোয়ালা বলে ভুলাও কি হে মদনমোহন।
মরণকালে দিও প্রভু অভয়চরণ।।

এই গোয়ালা পূর্বজন্মে ছিল কেশব ভারতী (শ্রীচৈতন্যের গুরু)। বিষ্ণপুরে তার নাম ছিল গোপাম মূরতি। পরের জন্মে সে উদয় হল কলকাতার বাগবাজারে, গোকুল মিত্র নামে এক ব্যবসায়ীরূপে। ওদিকে বিষ্ণুপুরে রাজবংশে প্রবল অর্থসংকট উপস্থিত হল। 


বিষ্ণুপুরের গ্রামখানি ছিল চাকুন্দার বন।
সন্ধ্যা দিতে তৈল পুড়ত সাড়ে সাত মণ।।

মদনমোহনের আদেশে রাজা গোকুল মিত্রের থেকে তিন লক্ষ টাকা ধার করলেন। বন্ধক রইল মদনমোহনের সেই বিগ্রহ। বিষ্ণুপুরের বদলে এবার বাগবাজারে পূজিত হতে শুরু করলেন মদনমোহন। গোকুল মিত্রর চাকরের নাম ছিল মদন। একদিন ঘুম ভেঙে বাবু মদনকে ডাকছেন। তার মনের কথা টের পেয়ে স্বয়ং মদনমোহন মদনের বেশে তামাক সেজে নিয়ে এল। তামাকে টান দিয়ে তো বাবু অবাক!


তামাক খেয়ে গোকুল মিত্র চারিদিকে চায়।
বিষ্ণুপুরের তামাক মদনা পেলি রে কোথায়।।

"মদন" ততক্ষণে মন্দিরে গা ঢাকা দিয়েছে।পরের দিন পুজো করতে গিয়ে বামুন ঠাকুর দেখলেন বিগ্রহের হাতে তামাক আর টীকার দাগ, কাপড় দিয়ে মুছলেও উঠছে না। ব্যাপার দেখে মিত্তিরমশাই কেসটা বুঝতে পারলেন এবং আদেশ জারি করলেন, তার বংশে যে তামাক সেবন করবে, সে স্ত্রীহত্যা ও ব্রহ্মহত্যার পাপে লিপ্ত হবে।
মদন মোহন ও লক্ষীপ্রিয়ার মূর্তি।
এদিকে মদনমোহন পড়েছেন লক্ষীপ্রিয়ার প্রেমে। লক্ষীপ্রিয়া হল গোকুল মিত্রের কন্যা। এক রাতে মদনমোহন হানা দিলেন লক্ষীপ্রিয়ার শয্যাকক্ষে। তার অঙ্গ স্পর্শ করতেই পতীব্রতা কন্যা জেগে উঠে বলে, "কে হে তুমি আমার সতীত্ব নষ্ট করছ??" ঠাকুর বললেন, "আমি কে পরে জানবে, আপাতত আমার চূড়া বাঁশীটা রাখো।" এই বলে নিজের চূড়া বাঁশি রেখে মদনমোহন নিজের ঘরে চলে এলেন। পরদিন চূড়াবাঁশি চুরি গেছে দেখে গোকুল মিত্র পুজারি ব্রাহ্মণদের ওপর হম্বি তম্বি শুরু করল। এমন সময় মদনমোহন দৈববাণী করে জানালেন, চূড়া বাঁশি তার কন্যার কাছেই আছে। এই লক্ষীপ্রিয়া আসলে একজন শাপভ্রষ্ট অপ্সরা। চূড়াবাঁশী ফেরৎ দিয়ে সে শাপমুক্ত হল এবং মদনমোহনের বাঁদিকে জায়গা পেল। 




বাগবাজারে বসে ঠাকুর খাচ্ছ চিনির পানা।
বিষ্ণুপুরে যেতে তোমায় কে করেছে মানা।।

ঠাকুর তো গোকুল মিত্তিরের ঘরে দিব্যি রয়েছেন, ওদিকে বিষ্ণুপুরে হাহাকার পড়ে গেছে। মন্দিরের পাথর খসে যাচ্ছে। রাজা থেকে প্রজা সবাই কাঁদছে। এমনকি দোলযাত্রা, রাস উৎসবও বন্ধ হয়ে গেছে।


হাতীশালে হাতী কাঁদে ঘোড়া না খায় পানি।
বিনিয়ে বিনিয়ে কাঁদে গোপাল সিংহের রাণী।।

রাণী নিজের গলা থেকে গজমোতি হার খুলে দিয়ে বললেন, "হার বেচে শোধ রাজা গোকুলের ধার।" কিন্তু রাজা টাকা নিয়ে গোকুল মিত্রের কাছে গেলে সে একটা জাল দলিল দেখিয়ে বলল, বিগ্রহ বিক্রী হয়ে গেছে। রাজা আর কি করেন! কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরে যাচ্ছিলেন এমন সময় স্বয়ং মদনমোহন তাঁকে দেখা দিয়ে বললেন, "ওহে রাজা, ফিরে যাচ্ছ কেন? তুমি আলিপুরের কাছারিতে গিয়ে আপিল করো। তোমার হয়ে আমি পাগড়ি পরে সওয়াল করব।" শুনে রাজা চটপট আলিপুরে গিয়ে দরখাস্ত দিলেন।


উকীলের বেশে প্রভু মদনমোহন।
কাছারিতে গিয়ে তিনি দেন দরশন।।
দেখি জজ ম্যাজিস্ট্রেট মানিল বিস্ময়।
কোথায় নিবাস তব কিবা নাম হয়।।
মদন উকীল নাম বাড়ী বিষ্ণুপুরে।
বেতন দিয়া মহারাজ রেখেছেন পুরে।।

মদন উকিলের কেরামতিতে রাজা মামলা জিতে গেলেন। কিন্তু গোকুল মিত্র অত সহজে হার মানার পাত্র নন। তিনি কুমোরটুলি থেকে একটা নকল মূর্তি গড়িয়ে রাজার হাতে তুলে দিলেন। রাজা মহা খুশি হয়ে যখন ফিরছেন তখন আবার দেখা দিলেন মদনমোহন। তাঁর কাছে ব্যাপার শুনে তো রাজা হাঁ! কোন বিগ্রহ আসল আর কোনটা নকল তা চেনার উপায়ও বাতলে দিলেন সেই মদনমোহন।


বামাঙ্গ যখন মোর ভিজিবে ঘামেতে।
হেরিবে মক্ষিকা শ্বেত নাকেতে বসিতে।।
আসল ঠাকুর সেই লবে কোলে তুলে।
রাখিও মনের কথা নাহি যেও ভুলে।।

রাজা মহাখাপ্পা হয়ে বাগবাজার ফিরে চললেন। ডাকাডাকিতে গোকুল বাইরে বেরিয়ে এলেন। রাজা বললেন, "তুমি তো মহা ছোটলোক হে! আমাকে একটা নকল ঠাকুর গছিয়ে দিলে?!!" গোকুল তখন আরেকটা ঠাকুর এনে বসিয়ে দেয়। দুটো হুবহু একরকম। কিন্তু দেখা গেল একটার বাম অঙ্গগুলো ঘামছে আর নাকে একটা সাদা মাছি এসে বসেছে। ব্যাস রাজা ওমনি সেটাকে কোলে তুলে নিলেন। এবার গোকুলের কাঁদার পালা। ঠাকুর তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, বৎসরান্তে অন্নকূট উৎসবের সময় বারো দণ্ড সময় তিনি গোকুলের কাছে থাকবেন। রাজা মদনমোহনকে সঙ্গে করে বিষ্ণুপুর নিয়ে গেলেন। রাণী সোনার থালায় করে ঠাকুরকে ক্ষীর, সর, মাখন খাওয়ালেন। রাস, দোল উৎসব আবার চালু হল। "বিষ্ণুপুর পুনঃ হয় হর্ষে হর্ষময়"।
  
পাঁচালি শেষ হল সকলকে মদনমোহনের আদি কথা পাঠ করার পরামর্শ দিয়ে। 


ভক্তিতে ডাকিলে নর মদনমোহনে।
অন্তকালে পায় স্থান প্রভুর চরণে।।
যে গৃহেতে হইবে এ আদি কথা।
রোগ শোক দুঃখ দৈন্য নাহি যায় তথা।।

বইয়ের কোথাও পদকর্তার নাম, রচনাকাল কিচ্ছু দেওয়া নেই। প্রকাশকও কিছু বলতে পারলেন না। সুকুমার সেন "বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস" গ্রন্থে লিখেছেন, "অষ্টাদশ-উনবিংশ শতাব্দীতে স্থানীয় দেবদেবী, ব্যক্তি বা ঘটনা বিশেষ ও দৈবদুর্বিপাক লইয়া বিস্তর ছড়া গান রচিত হইয়াছিল। পূর্বেও এইরূপ ছড়া রচিত হইত, কিন্তু সেগুলি আমাদের হস্তগত হইবার পূর্বেই লুপ্ত হইয়া গিয়াছে। ... একাধিক কবি রচিত মদনমোহন বন্দনা পাওয়া গিয়াছে। ইহার বর্ণনীয় বিষয় হইতেছে মদনমোহন কর্তৃক দলমাদল কামান দাগিয়া বিষ্ণুপুর হইতে বর্গী বিতাড়ন এবং চৈতন্য সিংহ কর্তৃক কলিকাতায় গোকুল মিত্রের নিকট মদনমোহন বিগ্রহ বন্ধক রাখা"। 

মদন গোপাল মন্দিরের দেওয়ালে চিত্রকলা। কামান দেগে বর্গী তাড়াচ্ছেন মদন মোহন।

ইন্টারনেটে ঘাঁটাঘাঁটি করতে করতে এই ধরণের আরেকটা ছড়া গান পেলামঃ "সাধু গোকুল মিত্রের জীবনী"। গল্প প্রায় এক, কোথাও কোথাও বিবরণ বিস্তৃততর, কোথাও সংক্ষিপ্ত, কোথাও আবার হুবহু এক পদ রয়েছে। যেমন "মদনমোহন মাহাত্ম্য"এ গোকুল মিত্রের কন্যা লক্ষীপ্রিয়ার শাপমুক্তির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু "গোকুল মিত্রের জীবনী"তে শাপের ব্যাপারটা বিশদে বলা হয়েছে। লক্ষীপ্রিয়া আসলে স্বর্গের অপ্সরা চন্দ্রাবলী। বৃন্দাবনের রাস উৎসব দেখে রাধার নামে কটুক্তি করেছিল বলে তাকে নীচঘরে জন্ম নিতে হয়েছিল।  আবার কোন কোন ঘটনা একেবারে অন্যরকম। যেমন মদনমোহন বিগ্রহ নিয়ে মামলার কথা দুই পাঁচালিতেই আছে। মদনমোহনের রাজার পক্ষে ওকালতির কথাও আছে। কিন্তু মামলার ফল দুই জায়গায় দুরকম। "মদনমোহন মাহাত্ম্য"এ বলা হচ্ছে, "রাজার ঠাকুর বলি ডিগ্রি হয়ে গেল/ গোকুল আকুল হয়ে কাঁদিতে লাগিল।" আর "গোকুল মিত্রের জীবনী" বলছে, "বিচার মতে রাজার ঠাকুর গোকুল ডঙ্কা মেরে নিল।" এখানে নকল ঠাকুর গড়ার ব্যাপারটাও নেই স্বাভাবিকভাবেই। কোথাও আবার একই পদ সামান্য অদলবদল করে ভিন্ন জায়গায় বসানো হয়েছে, যার ফলে অর্থ গেছে এক্কেবারে উলটে। "গোকুল মিত্রের জীবনী"তে বাগবাজারে মদনমোহনকে বন্ধক রেখে বিষ্ণুপুরে ফিরে যাওয়ার আগে রাজা বলছেন,
বাগবাজারে বসে ঠাকুর খাও চিনির পানা।আজ অবধি বিষ্ণুপুরে যেতে তোমায় করে গেলাম মানা।।
"মদনমোহন মাহাত্ম্য" তে প্রায় একই ধরণের পদ রয়েছে খানিকটা পরে, যখন বিষ্ণুপুরবাসী মদনমোহনের শোকে বিলাপ করছেনঃ
বাগবাজারে বসে ঠাকুর খাচ্ছ চিনির পানা।
বিষ্ণুপুরে যেতে তোমায় কে করেছে মানা।।

বুঝতে অসুবিধে হয় না "মদনমোহন মাহাত্ম্য" লিখেছেন হয়ত রাজার সভাকবি বা রাজভক্ত পদকর্তা। আর "গোকুল মিত্রের জীবনী"র রচয়িতা মিত্র পরিবারের বেতনভুক গীতিকার। তাই একই ঘটনা উভয়ে ব্যাখ্যা করেছেন ভিন্নভাবে, কখনো আবার ঘটনাটাকেই বদলে দিয়েছেন। আজকের সংবাদমাধ্যমের যে বিভিন্ন অংশ বিভিন্ন রাজনৈতিক গোষ্ঠীর স্বার্থরক্ষার তাগিদে "খবর তৈরী" করে, গোকুল মিত্র ও রাজার অন্নুভূক পদকর্তারা কি তাদেরই পূর্বসূরি? মনে পড়ছে নন্দীগ্রাম নিয়ে রাজ্য রাজনীতি যখন উত্তাল, শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক মহল আড়াআড়িভাবে বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল। তদনীন্তন রাজ্যপাল বলেছিলেন, "ট্রুথ ইজ ডিভাইডেড ইন নন্দীগ্রাম।"
এই ধরণের পদ ও পাঁচালিতে রাজভক্তি ও অলৌকিকতা প্রকট হলেও এসবের মধ্যে যে ইতিহাসের অনেক কিছুই লুকিয়ে থাকে তা বলাই বাহুল্য। বিষ্ণুপুরে আমাদের গাইড বলছিলেন বিষ্ণুপুরের রাজারা ক্ষত্রিয় ছিলেন, রাজস্থান থেকে এসেছিলেন। বাঁকুড়া ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ারে বিষ্ণুপুরের রাজপরিবারের সংরক্ষিত নথি অবলম্বনে যে "ইতিহাস" লেখা হয়েছে তাতে বলা হয়েছে ৬৯৫ খ্রীষ্টাব্দে উত্তর ভারতের এক রাজপুত্র সস্ত্রীক পুরীতে তীর্থ করতে যাওয়ার সময় বিষ্ণুপুরের কাছাকাছি লাউগ্রামে তাঁর স্ত্রী পুত্রসন্তান প্রসব করেন এবং সেই রাজপুত্র মা ও ছেলে কে স্থানীয় এক ব্রাহ্মণ ও এক কায়স্থর তত্ত্বাবধানে রেখে যান। এই পুত্রই কালক্রমে আদিমল্ল নাম নিয়ে মল্লরাজবংশের প্রতিষ্ঠা করেন। উইলিয়াম হান্টারের "অ্যানালস অফ রুরাল বেঙ্গল" বইয়ে আবার বৃন্দাবনের কাছের জয়নগর রাজ্যের রাজার দেশভ্রমণে বেরিয়ে বিষ্ণুপুরের নিকটস্থ অরণ্যে রাণীর পুত্রসন্তান প্রসব, সদ্যোজাতকে জঙ্গলে ফেলে রেখে প্রস্থান, স্থানীয় এক কাঠকুড়ুনি বাগদির শিশুকে আবিষ্কার এবং কালক্রমে নানা অলৌকিক ঘটনার মধ্য দিয়ে তার রাজপদে অভিষেকের কাহিনী আছে। আদিমল্লের জন্মকাহিনীর এই দুই বৃত্তান্তের সঙ্গে আলোচ্য "মদনমোহন মাহাত্ম্য" বা "গোকুল মিত্রের জীবনী"তে গোপাল সিংহের বাল্যলীলার বেশকিছু মিল ও অমিল আছে। সবকটা আখ্যানের একটা কমন বক্তব্য হল বিষ্ণুপুরের রাজারা স্থানীয় বা উত্তর ভারতীয় কোন ক্ষত্রিয় বংশজাত। বিনয় ঘোষ তাঁর "পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি" গ্রন্থে লিখেছেন, "মল্লরাজারা যখন সভাপণ্ডিতকে দিয়ে বংশবৃত্তান্ত রচনা করিয়েছেন তখন ভিতর থেকে জেলে আদিবাসীদের সঙ্গে আদিমল্লের সম্পর্কের সমস্ত কাহিনী ছেঁটে ফেলে ব্রাহ্মণ-কায়স্থদের কথা যোগ করেছেন এবং তাঁরা যে উত্তর ভারতের রাজপুত বংশজাত তাও ভালোভাবে বুঝিয়ে দিয়েছেন। বাংলার এইসমস্ত 'রাজবংশচরিত' ও 'কুলপঞ্জিকা'র একটা উপসর্গ মনোবিজ্ঞানীদের সহজেই নজরে পড়বে - সেটার নামকরণ করা যায় 'ক্ষত্রিয় কমপ্লেক্স' এবং 'রাজপুত কমপ্লেক্স'। হিন্দুসমাজের বর্ণবৈষম্যের এটা একটা স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া"। বাঁকুড়া ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ারেও বলা হয়েছে, "The fact that the Rajas of Bishnupur called themselves Mallas (an aboriginal title) for many centuries before they assumed the Kshattriya title of Singh, the fact that down to the present day they are known as Bagdi Rajas all over the Bengal, as well as numerous local facts and circumstances - all go to prove that the Rajas of Bishnupur are Khatriyas, because of their long independence and their past histories, but not by decent."

মল্লরাজারা ক্ষত্রিয় না বাগদি সে তর্ক মুলতুবি রেখেও একটা ব্যাপার বলা যায় যে বিষ্ণুপুরের রাজারা অন্তত সপ্তদশ শতকের আগে পর্যন্ত যথেষ্ট বীরত্বের পরিচয় দিয়ে নিজেদের স্বাতন্ত্র বজায় রেখেছিলেন। "মদনমোহন মাহাত্ম্য"এর রচয়িতা গোপাল সিংহের ভক্ত। তাই সপ্তম শতকে মল্লরাজ বংশের প্রতিষ্ঠা থেকে শুরু করে অষ্টাদশ শতকে বর্গী আক্রমণ ও গোকুল মিত্রের কাছে বিগ্রহ বন্ধক রাখা এই পুরো কীর্তিটাই তিনি চাপিয়ে দিয়েছেন গোপাল সিংহের ওপর। বাস্তবে গোপাল সিংহের রাজত্বকাল ছিল ১৭৩০ থেকে ১৭৪৫ খ্রিষ্টাব্দ এবং তাঁর সময়েই বিষ্ণুপুর রাজবংশের পতনের সূচনা। মল্লরাজারা আগে শাক্ত ছিলেন, সপ্তদশ শতকে রাজা বীরহাম্বিরকে বৈষ্ণবধর্মে দীক্ষিত করেন শ্রীনিবাস আচার্য। তারপরই বিষ্ণুপুরের বিখ্যাত টেরাকোটার মন্দির গুলো নির্মাণের কাজ শুরু হয়। কিন্তু গোপাল সিংহের সময় বৈষ্ণব আচার উৎকট আকার নিয়েছিল। রাজার আদেশে বাধ্যতামূলক হয় মালা জপ করা ও সূর্যাস্তের আগে হরিনাম ভজন করা। অন্যদিকে বর্ধমানের রাজা একের পর এক এলাকা ছিনিয়ে নিতে থাকে। ভাস্কর রাওয়ের বর্গীবাহিনী দুর্গের প্রতিরোধ ভেদ করতে না পারলেও ফসল ধবংস করে অর্থনীতিকে তছনচ করে দিয়ে যায়। 

অন্যদিকে ভারতবর্ষের ভাগ্যাকাশে ততদিনে উদিত হয়েছে নানাবিধ ঔপনিবেশিক শক্তি। বৃটিশদের বণিকের মানদণ্ড রাজদণ্ডে রূপান্তরিত হওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। যে মুর্শিদাবাদের নবাবদের থেকে "সিংহ" উপাধি পেয়েছিলেন বীরহাম্বিরের পৌত্র রঘুনাথ সিংহ, সেই নবাবরা কয়েকবছর পরেই পলাশীর যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বৃটিশের বেতনভুগে পরিণত হবেন। দেশীয় সামন্তশ্রেণী বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের কাছে সঙ্গে এঁটে উঠতে না পেরে ক্রমে তাদের অধীনস্ত জমিদারে পরিণত হল। আর অন্যদিকে সাম্রাজ্যবাদের ছত্রছায়ায় উত্থান ঘটল এক শ্রেণীর নব্য জমিদার ও ব্যবসায়ীগোষ্ঠীর। বিষ্ণুপুরের পরাক্রমশালী রাজা অর্থের প্রয়োজনে কুলদেবতাকে বন্ধক রাখতে যাচ্ছেন কলকাতার ব্যবসায়ীর কাছে - এ হয়ত সামন্ততন্ত্রের হাত থেকে বণিকতন্ত্রের হাতে ক্ষমতার হাতবদলেরই এক উদাহরণ। তবে মনে রাখতে হবে এই দুই শ্রেণীরই টিকি তখন বাঁধা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের কাছে। তাই কুলদেবতার অধিকার নিয়ে লড়াইয়ের নিস্পত্তি হয় ব্রিটিশ আদালতে। সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ হল স্বয়ং মদনমোহনের উকিল রূপে আদালতে সওয়াল। ভাগ্যের কি পরিহাস! যে ভগবান বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের নিয়ন্তা, মানুষের জাগতিক পাপ-পুণ্যের বিচারক, সেই ভগবান কে কি না পাগড়ি পরে দাঁড়াতে হল ম্লেচ্ছ জজ ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে! 

এতে ভগবানের মহিমা কতটা ক্ষুণ্ণ হল জানি না তবে বাঙালীর কাছে ভগবান এই রূপেই ধরা দিয়েছে বার বার। অন্তর্যামী নারায়ণ তাই কামান দেগে বর্গী তাড়ান, গোয়ালার থেকে দই হাতিয়ে ক্ষুধা মেটান, কামতাড়নায় বণিক কন্যার শয্যায় হানা দেন, কাছারি আদালতে ওকালতি ই বা করবেন না কেন? 

বিষ্ণুপুরে যাঁরা ঘুরতে যাবেন তাঁরা একটা করে "মদনমোহন মাহাত্ম্য" না নিয়ে ফিরবেন না। মন দিয়ে মদন মোহনের মাহত্ম্য পড়লে আধুনিক বর্গীদের হামলা ঠেকাতে সুবিধে হবে।


তথ্যসূত্রঃ


   () বিষ্ণুপুরের মদনমোহনের আদি মাহাত্ম্য, প্রকাশকঃ বীণাপাণি পুস্তক মন্দির
() সাধু গোকুল মিত্রের জীবনী, প্রকাশকঃ অজানা
() মন্দির নগরী বিষ্ণুপুর A Guide Book, প্রকাশকঃ বিশ্বজিৎ ব্যানার্জি
() পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি (প্রথম খণ্ড), বিনয় ঘোষ, প্রকাশকঃ প্রকাশ ভবন
() Bankura District Gezetier, Chapter II
() বিষ্ণুপুর ট্যুরিষ্ট গাইড শ্রী মিঠু ভুঁই-এর সঙ্গে কথোপকথন

ছবিঃ অতনু ও শ্রীরূপা
প্রথম প্রকাশঃ চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম

Wednesday, 27 June 2018

বিষাদ গাথা

বিষাদ সিন্ধু বইটার কথা শুনেছি অনেকদিন আগেই, কিন্তু পড়ার সুযোগ হয়ে ওঠেনি। এবছরের বইমেলায় বাংলাদেশের স্টল থেকে কিনেছিলাম। বইয়ের র‍্যাকে পড়েই ছিল, অনেক বইই যেমন হয়। তারপর কি মনে হতে একদিন হাতে তুলে নিলাম। উনবিংশ শতকের এই আখ্যান যে এতটা টানটান উত্তেজনায় পাঠককে আটকে রাখতে পারে তা ভাবতেই পারিনি। অথচ এই আখ্যানের প্রেক্ষাপট সুদূর আরবদেশের কারবালা প্রান্তর। লেখকের কলমের গুণ সে বিষাদগাথাকে প্রোথিত করেছে বাংলার মাটিতে। অনেকটা যেমন রামায়ণ-মহাভারতকে বাঙালীর ঘরের কাব্য করে তুলেছেন কাশিরাম-কৃত্তিবাস থেকে শুরু করে উপেন্দ্রকিশোর-পরশুরাম রা। 

ঘটনার মূলে আছে হযরত মহম্মদের দুই দৌহিত্র ইমাম হোসেন ও ইমাম হাসানের সঙ্গে মহম্মদের শিষ্য ও দামেস্ক নগরের অধিপতি মোবিয়ার পুত্র এজিদ-এর ক্ষমতার দ্বন্দ্ব। এই দ্বন্দ্ব ভয়ঙ্কর শত্রুতায় পর্যবসিত হয় যখন এজিদের কামনার ধন জয়নাব ইমাম হাসানের পাণিগ্রহণ করে ফেলে। এজিদ প্রথমে হাসানকে বিষপ্রয়োগে হত্যা করে, তারপর কৌশলে হোসেনকে সপরিবারে মদিনা থেকে বের করে কারবালার প্রান্তরে নিয়ে আসে। সেখানেই এক মর্মান্তিক যুদ্ধে শহীদ হন তিন পুত্র সহ হোসেন এবং হাসানের পুত্র কাসেম। হোসেনের কনিষ্ঠ পুত্র জয়নাল আবেদিন এবং জয়নাব সহ ইমাম পরিবারের নারী রা। মহম্মদীয় বংশের সমস্ত উত্তরাধিকারীদের হাতের মুঠোয় পাওয়া গেছে ভেবে যখন এজিদ উল্লসিত, তখনই ঘটনা অন্য দিকে মোড় নেয়। ময়দানে অবতীর্ণ হন হযরত আলির আরেক পুত্র আম্বাজ অধিপতি মহাবীর মহম্মদ হনিফা। মহম্মদের অনুগামী অন্যান্য নৃপতিদের একত্রিত করে নানা নাটকীয় ও রোমাঞ্চকর ঘটনার মধ্য দিয়ে জয়নাল আবেদীন সহ ইমাম বংশের নারীদের উদ্ধার করেন। 

বইটি তিনটি পর্বে বিভক্ত। মহরম পর্ব, উদ্ধার পর্ব ও এজিদ বধ পর্ব। এর মধ্যে মহরম পর্বে খানিকটা ইতিহাসকে অনুসরণ করা হয়েছে। বাকি দুই পর্ব প্রায় পুরোপুরি কল্পনাশ্রয়ী। রামায়ণ-মহাভারতের সঙ্গে তুলনা না এসে পারে না। ঐ দুই মহাকাব্যকে যেমন বলা হয় ধর্ম ও অধর্মের লড়াইয়ের কাহিনী, বিষাদ সিন্ধুও তাই। রাম, পাণ্ডবদের মত ধর্মের ধ্বজাধারী হাসান ও হোসেন ও তাঁদের অনুগামীরা। রাবণ, কৌরব পক্ষের মত অধর্মের প্রতিমূর্তি এজিদ পক্ষ। মজার ব্যাপার হল লড়াইটা ধর্ম-অধর্মের হলেও তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে একটা নারী চরিত্র। সীতা হোক বা দ্রৌপদী কিংবা জয়নাব। মিল আরো আছে। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধপ্রান্তরে প্রায়সই স্বর্গ থেকে নেমে আসতেন দেবতারা। কারবালার যুদ্ধের পর লেখকের ভাষায়, "স্বর্গীয় দূতগণ স্বর্গসংস্রবী দেবগণ, সকলেই আসিয়া উপস্থিত হইলেন।" হযরত আদম থেকে শুরু করে ইব্রাহিম, ইসমাইল, ইউসুফ, মোজেস, যিশু, মহম্মদ "প্রভৃতি মহা মহা মহাত্মাগণের আত্মা অদৃশ্য শরীরে কারবালায় হসেনের দৈহিক শেষক্রিয়ার জন্য উপস্থিত হইলেন।" আরব্য ও পারস্য দেশের কাব্য অবলম্বনে মীর মোসাররফ হোসেন লিখেছেন ইসলামিক ইতিহাসের এক বিষাদঘন কাহিনী। অথচ তাঁর ভাষায় আরবি-ফারসির প্রভাব স্বাভবিকের চেয়ে এতটুকু বেশী নয়। "ঈশ্বর" কে "ঈশ্বর" বলেই উল্লেখ করা হয়েছে, আরবি প্রতিশব্দ "আল্লা" দিয়ে নয়। হযরত মহম্মদ সহ পয়গম্বর দের সম্বোধন করেছেন মহর্ষি বলে, ইমামা পরিবারের মহিলারা বন্দিত হয়েছেন "সতী সাধ্বী দেবিগণ" হিসেবে। এজন্য তাঁকে মূল্য একেবারে চোকাতে হয়নি তা নয়। "উদ্ধার পর্ব"এর শুরুর দিকে তিনি লিখেছেন, "বিষাদ সিন্ধুর প্রথম ভাগেই স্বজাতীয় মূর্খদল হাড়ে চটিয়া রহিয়াছেন। অপরাধ আর কিছুই নহে, পয়গম্বর এবং ইমামদিগের নামের পূর্বে বাংলা ভাষায় ব্যবহার্য শব্দে সম্বোধন করা হইয়াছে; মহাপাপের কার্যই করিয়াছি।" ভাগ্যিস করেছিলেন এই মহাপাপ! তাই তো "ইসলামিক সাহিত্য"এর গণ্ডী পেরিয়ে "বিষাদ সিন্ধু" হয়ে উঠেছে এক সার্বজনীন বিষাদ গাথা।


বিষাদ সিন্ধু, মীর মোসাররফ হোসেন,
অক্ষর প্রকাশনী, ঢাকা।

Saturday, 25 November 2017

কিষাণ মুক্তি আন্দোলন নিয়ে কিছু কথা

এই নভেম্বর মাসের ২০ ও ২১ তারিখ সমস্ত সংবাদমাধ্যম যখন পদ্মাবতীময় তখনই নয়াদিল্লীর রামলীলা ময়দানে সমবেত হয়েছিলেন দেশের নানা প্রান্ত থেকে আসা তিন লক্ষের বেশী কৃষক। পার্লামেন্ট স্ট্রীটে মহামিছিলেও সামিল হন তাঁরা। তাঁরা এসেছিলেন "কিষাণ মুক্তি সংসদ" এ যোগ দিতে, ১৮৪টি কৃষক ও ক্ষেতমজুর সংগঠনের যৌথ মঞ্চ "অল ইন্ডিয়া কিষান সংঘর্ষ কো-অর্ডিনেশান কমিটি"র ডাকে। দেশের সংসদ তাঁদের কথা শুনছে না, তাই নিজেরাই সংসদ বসালেন কৃষকরা। পার্লামেন্টের ৫৪৫ জন সদস্য সংখ্যার সঙ্গে মিলিয়ে ৫৪৫ জন আত্মঘাতী কৃষক পরিবারের সদস্য উপস্থিত ছিলেন সাংসদ হিসেবে। প্রতিটি ধারা ধরে দুদিন আলোচনার পর পাস হল দুটি বিলঃ (১) কৃষক যেন তাঁর পরিশ্রমের উপযুক্ত পারিশ্রমিক পান তা নিশ্চিত করতে হবে। সমস্ত ফসল, দুধ এবং কিছু বনজ দ্রব্যের মোট উৎপাদন খরচের ৫০% বেশী ন্যূনতম সহায়ক মূল্য ধার্য করতে হবে এবং উৎপাদক যাতে এই মূল্যে তাঁর পণ্য বিক্রয় করতে পারেন তার ব্যবস্থা করতে হবে। (২) কৃষককে ঋণের জাল থেকে মুক্ত করার জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে। শুধু ভোটের আগে ঋণ মকুব করা নয়, রাষ্ট্রকে ধারাবাহিকভাবে তার নাগরিকদের অন্নদাতা কৃষকদের পাশে থাকতে হবে।

কৃষক আত্মহত্যা, ঋণের জাল ও স্বামীনাথন কমিশন

এই দুটো দাবী আকাশ থেকে পড়া কিছু নয়, ১০ বছর আগে কৃষিক্ষেত্রের সংকট ও কৃষক আত্মহত্যার কারণ অনুসন্ধানের জন্য গঠিত স্বামীনাথন কমিটির সুপারিশের অঙ্গ এই দুই প্রস্তাব। ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে বিজেপি কৃষকদের দেড়গুণ রিটার্ন দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কৃষকদের অবস্থা শাঁখের করাতের মত। ফসল উৎপাদন কম হলেও সমস্যা, বিক্রি করে খরচ উঠবে না, আবার বেশী উৎপাদন হলেও দাম পড়ে গিয়ে লোকসান হয়ে যাবে। আমরা বাজার করতে গিয়ে টের পাই আজ আলু ৮ টাকা কেজি তো মাসখানেক বাদেই ২০ টাকা কেজি হয়ে গেল! দাম পড়ে গেলে কৃষকদের সর্বনাশ তো বটেই, দাম বাড়লেও যে তাঁরা খুব লাভবান হন তা নয়। ফসল ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই ঋণশোধ করার তাগিদে এবং ফসল সংরক্ষণে অপারগতার কারণে তাঁরা ফসল বিক্রি করে দিতে বাধ্য হন। আর দাম বাড়ে বিক্রি করে দেওয়ার পরেই। কৃষকদের দুর্দশার কারণ খুঁজতে গিয়ে স্বামীনাথন কমিটি দেখেছিল ভূমিবন্টনে বীভৎস বৈষম্য, প্রাচীন প্রযুক্তি, সেচ হীনতা, প্রাতিষ্ঠানিক ঋণের অপ্রতুলতা ও দীর্ঘসূত্রিতা ইত্যাদি। ঐ কমিটির সুপারিশগুলোর মধ্যে ছিল অসম্পূর্ণ ভূমিসংস্কার সম্পূর্ণ করা, জলসংরক্ষণ ও উন্নত প্রযুক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে আরো বেশী সংখ্যক জমিকে সেচের আওতায় আনা, সরকারি বিনিয়োগ বাড়ানো, কম ঝুঁকিপূর্ণ ও কমদামী প্রযুক্তির ব্যবহার উৎসাহিত করা, পর্যাপ্ত ঋণ ও বীমার ব্যবস্থা করা, সার্বজনীন গণবন্টন ব্যবস্থা, সামাজিক নিরাপত্তার জন্য নানাবিধ প্রকল্প যথা স্বাস্থ্যবীমা, বার্ধক্যভাতা ইত্যাদি। ২০০৬ সালে জমা পড়া এইসব সুপারিশ কংগ্রেস সরকারের হিমঘরেই পড়ে ছিল। আর বিজেপি? ৫০% লাভের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এসে তারা একদিকে সারের দাম বাড়িয়ে চলল অন্যদিকে এমন নিচু হারে সহায়ক মূল্য ধার্য করল যা উৎপাদন খরচের চেয়ে সামান্য বেশী, শস্যবিশেষে কম। দেখা গেছে হরিয়ানার এক চাষী তাঁর আড়াই হেক্টর জমিতে বাজরা চাষ করে যদি সরকার নির্ধারিত সহায়ক মূল্যে তাঁর উৎপাদিত এক কুইন্টাল বাজরা বিক্রি করেন তবে এক মরশুমে তাঁর লাভ দাঁড়ায় ২৯৪০ টাকা! সরকারের আশা এই টাকা দিয়ে তিনি ঋণের সুদ মিটিয়ে সংসার প্রতিপালন করবেন। বাস্তব অবশ্য আরো কঠিন, কারণ তিনি তাঁর ফসল বিক্রি করতে বাধ্য হন সহায়ক মূল্যের অনেক কম দামে, যার ফলে তাঁর লোকসান দাঁড়ায় ২৮০০ টাকা। এর ফল - সংসার চালানোর জন্যেই এবার তাঁকে ঋণ করতে হয় স্থানীয় মহাজনদের কাছে। ছোট চাষীরা অবশ্য এমনিতেই সরকারি ঋণের তুলনায় মহাজন দের ঋণের ওপরেই বেশী নির্ভরশীল। সরকারি ঋণের ওপর নির্ভর করতে পারেন মূলতঃ ধনী চাষীরা। ন্যাশনাল স্যাম্পল সার্ভে অর্গানাইজেশনের সমীক্ষা থেকে দেখা গেছে গ্রামীণ ঋণের ৪৪ শতাংশই অপ্রাতিষ্ঠানিক। আর এই অপ্রাতিষ্ঠানিক ঋণের সুদের হার ৩৬% থেকে শুরু করে ১০০% ও হয়ে যায়। পাঞ্জাব ও বিদর্ভের দুটি গ্রামে অজয় দাণ্ডেকর ও শ্রীদীপ ভট্টাচার্যের একটি ফিল্ড ওয়ার্কে দেখা গেছে এমনিতেই ব্যাঙ্ক যা ঋণ দেয় তা ক্রমবর্ধমান চাষের খরচের তুলনায় অপ্রতুল, তার ওপর কৃষকরা ব্যাঙ্কের ঋণ শোধ করার জন্য মহাজনের থেকে বা পরিবারের সদস্যদের থেকে ধার করেন। তাঁদের ধার আবার শোধ করেন ব্যাঙ্ক থেকে প্রাপ্ত পরের কিস্তির ঋণ থেকে। ফলতঃ চাষের খরচ চালানোর জন্য আবার ধার! ফলে শেষপর্যন্ত যা বিকল্প থাকে তা হল চাষের জন্য কিনে রাখা কীটনাশক গলায় ঢেলে দেওয়া। আত্মহননে অবশ্য ঋণের চক্র থেকে বেরিয়ে আসা যায় না। ঋণশোধের দায় এবার এসে পড়ে বাড়ির সদস্যদের ওপর।

সরকারের তথ্য অনুযায়ীই প্রতি বছর গড়ে ১২ হাজার কৃষক আত্মহননের পথ বেছে নেন। অর্থাৎ প্রতি ৩০ মিনিটে একজন করে কৃষক আত্মহত্যা করেন। এই কৃষক আত্মহত্যার ৮৭.৫% ঘটেছে সাতটি রাজ্যেঃ মহারাষ্ট্র, কর্নাটক, তেলেঙ্গানা, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড়, অন্ধ্রপ্রদেশ ও তামিলনাড়ু। পিছিয়ে নেই সবুজ বিপ্লবের রাজ্য পাঞ্জাবও। ১৯৯৫ থেকে ২০১৫ - দশ বছরে ৪৬৮৭ জন কৃষকের আত্মহত্যা নথিভুক্ত হয়েছে এই রাজ্যে। মোদির মডেল রাজ্য গুজরাতে ২০১৩ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে ১৪৮৩ জন কৃষক আত্মহত্যা করেছেন। পশ্চিমবঙ্গের শস্যভাণ্ডার বলে খ্যাত বর্ধমান জেলাতেও এখন কৃষক আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। শুধু ভাতার থানা এলাকায় ৬ মাসে ১০ জন কৃষক আত্মহত্যা করেছেন ঋণের জ্বালায় বা জলের অভাবে ফসল নষ্ট হতে দেখে। এই ঘটনা গুলো এখন এতই "স্বাভাবিক" হয়ে গেছে আমাদের কাছে যে খবরের কাগজের ভেতর দিকের পাতার দু-চার লাইনের বেশী বরাদ্দ হয় না। প্রশাসনিক তরফেও চেষ্টা থাকে ঘটনা অস্বীকারের। ২০১৫ সালের একটি লেখায় পি সাইনাথ দেখিয়েছিলেন ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর তথ্য জোগাড় ও বিশ্লেষণের পদ্ধতির পরিবর্তনের ফলে ২০১৪ সালে কৃষক আত্মহত্যার সংখ্যা দাঁড়ায় ২০১৩ সালের অর্ধেকেরও কম। কিন্তু ঐ বছরেই ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায় "অন্যান্য" কারণে আত্মহত্যার সংখ্যা। ২০০১ সালের অন্ধ্রপ্রদেশ জেলার ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর তথ্য থেকে দেখা গেছিল আগের তিন বছরে ঐ জেলায় কয়েকশ মানুষ পেটে প্রচণ্ড যন্ত্রণার কারণে অসুস্থ হয়ে মারা যান। পরে জানা যায় ওনাদের পেটের যন্ত্রণার কারণ হল আত্মহত্যার জন্য কীটনাশক খাওয়া!

লড়াইয়ের সংক্ষিপ্ত বৃত্তান্ত

কিন্তু ভারতীয় কৃষকদের রক্তে নীল বিদ্রোহ, সন্ন্যাসী বিদ্রোহ, ওয়াহাবি বিদ্রোহের রক্ত বইছে। তেভাগা, তেলেঙ্গানা, নকশালবাড়ির ইতিহাস যাঁরা রচনা করেছেন, তাঁদের উত্তরপুরুষরা নিজেদের জীবন শেষ করে দিয়ে অদৃষ্টের কাছে আত্মসমর্পণ করবেন এ হতেই পারে না। লড়াইয়ের জেদ সলতে পাকাচ্ছিল তাঁদের মধ্যে। ২০১৬ সালে বৃষ্টিপাত গত দুবছরের তুলনায় বেড়েছে এবং ২০১৬-১৭র কেন্দ্রীয় বাজেটে আগের তুলনায় কৃষিক্ষেত্রে বরাদ্দও কিছু বেড়েছে। কিন্তু কৃষকদের দুর্দশা লাঘবের জন্য এগুলো নগণ্য। তার ওপর খাঁড়ার ঘায়ের মত নেমে এসেছে গত বছরের নোট বাতিল। বেশীরভাগ লেনদেন নগদ টাকায় হওয়ার কারণে নোটবাতিলের কারণে বড়সড় ক্ষতির মুখে পড়েন কৃষক রা। এই বছরের মে-জুন মাস থেকেই মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, রাজস্থান প্রভৃতি রাজ্যে কৃষক বিক্ষোভ জ্বলে উঠতে থাকে। মহারাষ্ট্রে কিষাণসভার নেতৃত্বে একটা কিছু অঞ্চলে আন্দোলন শুরু হওয়ার পর সরকারি তরফে কিছু সংগঠনকে ডেকে আলোচনার নামে আন্দোলন ভাঙ্গার চেষ্টা হয়। মধ্যরাতে আলোচনা থেকে বেরিয়ে এসে কিষাণ সভার নেতৃত্ব জানিয়ে দেন ঋণ মকুব ও ন্যায্য দামের দাবীতে আন্দোলন চলবে। আরো ৩২টি সংগঠন সাড়া দেয় তাদের ডাকে। স্বাভিমানী শ্বেতকারি সংগঠনের নেতা রাজু শেট্টি এনডিএ সরকারের ওপর থেকে সমর্থন তুলে নেন। ১লা জুন থেকে সবকটি সংগঠনের যৌথ কমিটির ডাকে কৃষকরা শহরে দুধ সহ কৃষিজাত পণ্য পাঠানো বন্ধ করে "ধর্মঘট" শুরু করেন। দুধ, সবজির দাম হু হু করে বাড়তে থাকে। জেড ক্যাটাগরির নিরাপত্তা দিয়ে মুম্বাইয়ে দুধ পাঠানো হয়। ষাট হাজার কৃষক মহারাষ্ট্রের কৃষিমন্ত্রীকে ঘেরাও করেন। টানা ১০ দিন ধর্মঘট চলার পর মুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র ফড়নবিশ কৃষক সংগঠনগুলোর সঙ্গে আলোচনায় বসে ৩৪ হাজার কোটি টাকা ঋণ মকুবের ঘোষণা করেন। এর মধ্যেই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে মধ্যপ্রদেশে। সেরাজ্যের শিবরাজ সিং সরকার মন্দাসৌর জেলায় গুলি চালিয়ে আট কৃষককে হত্যা করলে আন্দোলন হিংসাত্মক চেহারা নেয়। রাজস্থানে অন্যান্য অংশের মানুষ যোগ দেওয়ায় কিষাণ সভার নেতৃত্বে কৃষক আন্দোলন গণ আন্দোলনের রূপ পরিগ্রহ করে। সেপ্টেম্বর মাসে রাজ্যের প্রত্যেক জেলার প্রশাসনিক অফিসের সামনে মহাপড়াও শুরু হয়। সেপ্টেম্বরের ৭ তারিখে সর্বাত্মক সাধারণ ধর্মঘট পালিত হয়। অবশেষে বসুন্ধরা রাজের সরকার আন্দোলনকারীদের বেশীরভাগ দাবী মানতে বাধ্য হয়। 

দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ঘটে চলা কৃষক আন্দোলনগুলোকে একসুতোয় বাঁধতে জুন মাসের শেষদিকে গঠিত হয় অল ইন্ডিয়া কিষাণ সংঘর্ষ কোঅর্ডিনেশন কমিটি। বামপন্থীদের পাশাপাশি এই কমিটিতে সামিল হয় রাজু শেট্টির স্বাভিমানি শ্বেতকারি সংগঠন, মেধা পাটকরের এন এ পি এম, যোগেন্দ্র যাদবের স্বরাজ্য অভিযান, দক্ষিণ ভারতের ন্যাশনাল সাউথ ইন্ডিয়ান রিভার লিঙ্কিং ফার্মারস অ্যাসোসিয়েশান সহ ১৮৪ টি সংগঠন। কমিটির উদ্যোগে ১০ হাজার কিলোমিটার পথ হাঁটে কিষাণ মুক্তি যাত্রা। তারপর রাজধানীতে এই সমাবেশ। সমাবেশে বিদর্ভের আত্মঘাতী কৃষকদের সন্তানদের সঙ্গেই ছিলেন পুলিসের হাতে খুন হওয়া মন্দাসৌরের কৃষকদের স্ত্রী রা। যন্তর মন্তরে নগ্নগাত্রে ধর্ণা চালানো তামিলনাড়ুর কৃষকদের সাথে মিলিত হলেন ভাঙড়ের জমি হাঙরদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধী কৃষকরা। অবস্থান মঞ্চে সম্বর্ধনা দেওয়া হয় মহারাষ্ট্র ও রাজস্থানের কৃষক আন্দোলনের দুই নেতা রাজু শেট্টি ও অমরা রাম কে। নিজেদের মধ্যে আদর্শগত, শ্রেণীগত ও অঞ্চলগত নানা পার্থক্যকে দূরে সরিয়ে রেখে এভাবে এতগুলো কৃষক ও ক্ষেতমজুর সংগঠনের এক মঞ্চে আসা যেমন নজিরবিহীন, তেমনি অভিনব নিজেরাই প্রতীকি সংসদ বসিয়ে বিল পাস করানো। এই দুটি বিলের কপি পার্লামেন্টের সমস্ত সাংসদের কাছে পাঠানো হবে, পাঠানো হবে কেন্দ্রীয় কৃষিমন্ত্রকেও। ২৬শে নভেম্বর থেকে ২৬শে জানুয়ারি, ভারতীয় সাধারণতন্ত্রের সংবিধান পাস হওয়া ও লাগু হওয়া কে মনে রেখে, এই দুটি বিল নিয়ে প্রচার চালাবে সংঘর্ষ কমিটি।

সরকার ও কর্পোরেট মেসিহা

আমরা স্কুলে পড়তাম, ভারতবর্ষ একটি কৃষিপ্রধান দেশ। এখানকার ৭০% মানুষ কৃষির ওপর নির্ভরশীল। অবস্থাটা খুব একটা বদলায় নি। অথচ কৃষির সংকট নিয়ে আমাদের, শহরের মানুষদের মধ্যে একটা অদ্ভুত ঔদাসীন্য কাজ করে। গুলিচালনা বা হিংসাত্মক ঘটনা না ঘটলে সংবাদমাধ্যমেও জায়গা পান না কৃষক রা। সরকারি প্রতিক্রিয়াও তথৈবচ। খরায় বিপর্যস্ত তামিলনাড়ুর কৃষকরা সরকারি ক্ষতিপূরণের দাবী নিয়ে কয়েকমাস ধরে পড়ে রইলেন দিল্লীর রাস্তায়, আত্মঘাতি হওয়া পরিজনদের মাথার খুলি নিয়ে। স্যোসাল মিডিয়ার কিছু ছবি ছাড়া না তাঁরা পেলেন জাতীয় মিডিয়ার অ্যাটেনশান, না পেলেন কোন সরকারের কোন মন্ত্রীর দেখা। উল্টে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের কাছে বিক্ষোভ দেখানোর জন্য পুলিস তাঁদের কয়েকজনকে গ্রেফতার করে নিয়ে গেল। মধ্যপ্রদেশের হত্যাকাণ্ডের পর অনশনে বসলেন মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ সিং চৌহান, আর কেন্দ্রীয় কৃষিমন্ত্রী রাধারমণ সিং কৃষকদের পরামর্শ দিলেন যোগাসন করতে। শাসকদলের ঘনিষ্ঠ এক হিন্দু ধর্মগুরু ঘোষণা করলেন কৃষকরা আত্মহত্যা করছে আধ্যাত্ম্যিকতার অভাবে। ভারতবর্ষের কৃষকরা শেষ হয়ে গেলেও বোধহয় শাসকগোষ্ঠীর কিছু এসে যায় না। কিংবা ভুল বললাম, বর্তমান শাসকগোষ্ঠী হয়ত চায় কৃষি অর্থনীতি ধ্বংস হয়ে যাক। তাহলেই বহুজাতিক কর্পোরেট সংস্থাগুলোর হাতের মুঠোয় বন্দী হবেন কৃষকরা। এই নভেম্বর মাসের গোড়াতেই "ওয়ার্ল্ড ফুড ইন্ডিয়া" নামক মেগা ইভেন্টের উদ্বোধন করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ভারতবর্ষে চুক্তি চাষের বিরাট সম্ভাবনা আছে। কর্পোরেটদের এই সুযোগ নষ্ট না করতে আহবান জানান তিনি। 

বহুজাতিক কর্পোরেটদের হাত পড়লে কৃষির কি সর্বনাশ হতে পারে তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে মনসান্টোর উপাখ্যান। স্থানীয় বীজ বৈচিত্র্য কে তছনছ করে জেনেটিকালি মডিফায়েড বিটি তুলো চালু করে কৃষকদের গলা কেটে "রয়ালটি"র টাকা আদায় করছে তারা। বিটি তুলো চালু করা হয়েছিল পোকামাকড়ের উতপাৎ কমানোর কথা বলে। বাস্তবে বিটি তুলোর প্রযুক্তি এমনই যে কিছু নির্দিষ্ট পোকামাকড়ের জন্য তা বানানো যায় এবং এর ফলে অন্য পোকামাকড়ের আক্রমণ বেড়ে যায়। শুধু তাই নয় ঐ নির্দিষ্ট পোকাগুলোও খুব তাড়াতাড়ি নিজেদের জিনে প্রয়োজনীয় মিউটেশন ঘটিয়ে ফের আক্রমণ শুরু করে। তখন আবার আমদানি হয় পরের প্রজন্মের বিটি তুলোর। বিটি তুলো ১ ও ২ এর ব্যর্থতার পর এখন বিটি তুলো ৩ বাজারে আনতে চলেছে মনসান্টো। আর এর মধ্যে কি হয়েছে? ৯৮ এ মনসান্টো এদেশে ব্যবসা শুরু করার পর তুলোর দাম বেড়েছে ৮০ শতাংশ আর লোকসানের বোঝা সামলাতে না পেরে দলে দলে আত্মহত্যা করেছেন কৃষকরা। শুধু তাই নয় দেশীয় বীজ প্রস্তুতকারী সংস্থাগুলোর অভিযোগ মনসান্টো যে রয়ালটি ও প্রযুক্তি ফি-র টাকা নেয় সেটাই বেআইনী। ভারতীয় পেটেন্ট আইন অনুযায়ী প্রাণী উদ্ভিদ বা তাদের কোন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নিয়ে জিনগত গবেষণা পেটেন্টের আওতায় পড়ে না। বিষয়টা এখন জাতীয় প্রতিযোগিতা কমিশনের বিচারাধীন।

এই লেখার কোন উপসংহার টানার মানে হয় না। কৃষকরা কোন পথে তাঁদের আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন, তাঁদের মধ্যে ঐক্য অটুট থাকবে কি না, সরকার এর মোকাবিলায় কি পদক্ষেপ নেবে, ধর্মীয় মেরুকরণ বা যুদ্ধোন্মাদনা তৈরী করে আন্দোলনকে ভাঙতে পারবে কি না, বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর কি ভূমিকা হবে, স্বামীনাথন কমিশনের সুপারিশ মানতে সংসদকে বাধ্য করা যায় কি না, সংবাদমাধ্যম ও নাগরিক সমাজ তাদের ঔদাসীন্য ঝেড়ে ফেলতে পারে কি না এ সব প্রশ্নের উত্তরই এখনো ভবিষ্যতের গর্ভে।

  

তথ্যসূত্রঃ

১। কৃষক আত্মহত্যা, চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম (১লা জুলাই ২০১৭)
২। Interview with Yogendra Yadav, Indian express, 23rd November, 2017
৩। "Sikar: No Longer Just a Farmers’ Movement, But a People’s Movement for Farmers", News Click, 12th September, 2017
৪। "How Long Can India’s Farmers Subsidise the Nation?", The Wire, 2oth November, 2017
৫। স্বামীনাথন কমিশনের রিপোর্ট, PRSLegislative Researchএর ওয়েবসাইট
৬। Interview with Ajit Nawale on farmers movement in Maharashtra, News Click, 6th October, 2017
৭। গণশক্তির রিপোর্ট, ২১/১১/১৭ ও ২২/১১/১৭
৮। ইন্টারনেট ও বিভিন্ন পত্রপত্রিকা থেকে প্রাপ্ত তথ্য।


Monday, 16 October 2017

ঈশ্বরের লুডো আর ব্ল্যাকহোলের চুল

"ঝাউবাংলোর রহস্য"র সাতকড়ি সাঁতরা কে মনে আছে? প্যালারাম সেই সবুজ দাড়িওয়ালা বিজ্ঞানীকে তাঁর গবেষণার বিষয়বস্তু জানতে চাইলে তিনি বলেছিলেন "থিয়োরি অফ রিলেটিভিটির সঙ্গে অ্যাকোয়া টাইকোটিস যোগ করলে কি হয় বলতে পারো?" অ্যাকোয়া টাইকোটিস অর্থাৎ জোয়ানের আরকের সঙ্গে থিয়োরি অফ রিলেটিভিটির কি সম্পর্ক থাকতে পারে সে প্রশ্ন সঙ্গতভাবেই উদয় হয়েছিল ক্যাবলার মনে। এই প্রবন্ধের শিরোনাম দেখে পাঠকের মনেও একই রকম প্রশ্ন জাগতে পারে। ব্ল্যাকহোল এমনিতেই গোলমেলে জিনিস। তার ওপর সে টাকমাথা না চুল আছে এসব প্রশ্ন করলে তো ব্যাপারটা রীতিমত পুঁদুচেরি মানে ভীষণ গুরুতর হয়ে দাঁড়ায়! আর চুল যদি থেকেই থাকে তার সঙ্গে ঈশ্বর লুডো খেলেন কি না তার কি লেনদেন? গপ্পোটা তাই গোড়া থেকেই ফাঁদি।

বিংশ শতকের গোড়ার দিকেই যে তিনটে আবিষ্কার পদার্থবিজ্ঞানের সাবেকি ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিল সেই বিশেষ ও সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ এবং কোয়ান্টাম বলবিদ্যার মধ্যে কমন নামটা হল অ্যালবার্ট আইনস্টাইন। বিশেষ আপেক্ষিকতাবাদের (Special Theory of Relativity) সূত্রায়ণে প্রধাণ ভূমিকা ছিল আইনস্টাইনের। সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ (General Relativity) তো তাঁরই হাতে গড়া বলা যেতে পারে। তবে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের (Quantum Mechanics) সঙ্গে আইনস্টাইনের সম্পর্কটা ছিল অম্লমধুর। কোয়ান্টাম তত্ত্বের চারাগাছ যাঁরা রোপণ করেছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম আইনস্টাইন। তাঁর নোবেল প্রাপ্তিও কোয়ান্টাম তত্ত্বের জন্য। অথচ সে চারাগাছ যখন মহীরূহ হয়ে দাঁড়ালো তখন আইনস্টাইনই হয়ে উঠলেন তার সবচেয়ে বড় সমালোচক। ঈশ্বরের লুডো খেলার ব্যাপারটা জানতে হলে আইনস্টাইনের সঙ্গে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের এই দ্বন্দ্বটা বুঝতে হবে। 

"কোয়ান্টা" শব্দের অর্থ হল গুচ্ছ। কোয়ান্টাম মেকানিক্সের এহেন নামকরণের কারণ হল পদার্থবিজ্ঞানের এই বিপ্লবটি সাধিত হয়েছিল আলোর আঁটি পাকানোর দ্বারা। ধরা যাক আপনি জল দিয়ে ওষুধের ট্যাবলেট খাচ্ছেন। আপনি একটা, দুটো বা তিনটে ট্যাবলেট খেতে পারেন, কিন্তু দেড়খানা বা পৌনে তিনখানা খেতে পারবেন না যদি না ট্যাবলেটটা ভাঙা না হয়। কিন্তু জলের ক্ষেত্রে তেমন বাধ্যবাধকতা নেই। আপনি স্বচ্ছন্দে আড়াই গ্লাস বা পৌনে তিন গ্লাস জল খেতে পারেন। আলোকে মনে করা হত জলের মত। অর্থাৎ একটা পদার্থ যেকোন পরিমাণ আলো শোষণ বা বিকিরণ করতে পারেন। এই ধারণায় ঘা দিলেন ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক, অষ্টাদশ ও উনবিংশ শতকের সন্ধিক্ষণে।
ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক
তিনি দেখালেন কোন পদার্থ কে উত্তপ্ত করলে সে যে আলো বিকিরণ করে সেই বিকিরণ যেকোন পরিমাণে হয় না, হয় গুচ্ছ বা কোয়ান্টার আকারে। এই কোয়ান্টাগুলোর পরে নাম দেওয়া হবে ফোটন (photon)। এক একটা ফোটনের শক্তি সেই আলোর কম্পাঙ্কের সমানুপাতিক। এই সমানুপাতিক ধ্রুবককে "প্ল্যাঙ্ক ধ্রুবক" বলা হয়ে থাকে। অর্থাৎ একটা ফোটনকণার শক্তির মান প্ল্যাঙ্ক ধ্রুবক ও সংশ্লিষ্ট আলোর কম্পাঙ্কের গুণফলের সমান। দ্বিতীয় ঘা টা মেরেছিলেন আইনস্টাইন। কোন ধাতব পদার্থের ওপর আলো পড়লে সেই আলো থেকে শক্তি পেয়ে উত্তেজিত হয়ে ধাতবপৃষ্ঠের ওপর বিচরণশীল মুক্ত ইলেকট্রনগুলো বেরিয়ে আসতে থাকে। এই ঘটনাকে বলে আলোকতড়িৎ ক্রিয়া (photoelecric effect )। আইনস্টাইন দেখালেন আপতিত আলোক ইলেকট্রনগুলোকে শক্তি সরবরাহ করে গুচ্ছ বা কোয়ান্টার আকারে। অর্থাৎ আলোর শোষণ বা বিকিরণ দুইই হয় কোয়ান্টার আকারে। আরো কয়েক বছর পর এই দুই তত্ত্বের সাহায্যে নীলস বোর পরমাণুর কোয়ান্টাম মডেল বাজারে আনবেন। 


কিন্তু এসব করতে গিয়ে আলোর চরিত্র নিয়ে একটা গুরুতর প্রশ্ন উঠে গেল। সেই ষোড়শ শতকে আইজ্যাক নিউটন আলোকে কণিকা হিসেবে কল্পনা করে প্রতিফলন ও প্রতিসরণের সূত্রগুলো ব্যাখ্যা করেছিলেন। কিন্তু পরে দেখা গেল ব্যাতিচার (interference), অপবর্তনের (diffraction) মত বেশ কিছু ধর্ম কণিকাতত্ত্বের সাহায্যে ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে না। উনবিংশ শতকের মাঝামাঝি স্কটিশ গণিতজ্ঞ ও পদার্থবিদ জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল দেখালেন তড়িৎ ক্ষেত্র ও চৌম্বক ক্ষেত্রের পরস্পরের লম্বদিকে কম্পনের ফলে একধরণের তরঙ্গ সৃষ্টি হয় যাকে বলে তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ (electromagnetic wave)। আলোও একধরণের তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ। শুধু আলো নয়, এক্স রশ্মি, অতিবেগুনী রশ্মি, রেডিও তরঙ্গ সবই আসলে তড়ীৎচুম্বকীয় তরঙ্গ, পার্থক্য শুধু তরঙ্গদৈর্ঘ্যে। 

তো আলোর কোয়ান্টাম উত্থানের ফলে নিউটনের সেই কণিকা তত্ত্বই যেন ফিরে এলো। কিন্তু পরিস্থিতি ইতিমধ্যে অনেক জটিল হয়ে গেছে। আলোকে কণা ভাবলে ব্যাতিচার, অপবর্তনকে ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে না। আবার আলোকে তরঙ্গ ভাবলে কৃষ্ণবস্তু বিকিরণ, আলোকতড়িৎ ক্রিয়া বোঝা যাচ্ছে না। বিজ্ঞানীরা বুঝতে পারছিলেন যতই আজগুবি লাগুক, এই সমস্যার সমাধান একটাই, তা হল আলোর দ্বৈত চরিত্রকে মেনে নেওয়া। অর্থাৎ আলো (এবং অন্যান্য তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ) কোন কোন পরীক্ষায় দেখা দেয় তরঙ্গরূপে আবার কোন কোন পরীক্ষায় আবির্ভূত হয় কণা রূপে। কোন পরীক্ষায় কোন রূপ দেখা যাবে তা নির্ভর করছে পরীক্ষার যন্ত্রপাতির আকারের ওপর। যন্ত্রের আকার যদি পরীক্ষাধীন আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্যের চেয়ে অনেক বড় হয় তবে আলোর কণারূপ দেখা যাবে। আর যন্ত্রপাতির আকার তরঙ্গদৈর্ঘ্যের কাছাকাছি হলে দেখা যাবে তরঙ্গরূপ। 


আলোর দ্বৈতসত্ত্বা (wave particle duality) স্বীকার করে নেওয়ার সঙ্গে বলা যেতে পারে প্যান্ডোরার বাক্স খুলে গেল। প্রশ্ন উঠল আলোর যদি দুই রূপ থাকতে পারে তাহলে তখনো অবধি মৌলিক কণা বলে পরিচিত ইলেকট্রন, প্রোটনরা কি দোষ করল? তাদের কেন দ্বৈত সত্ত্বা থাকবেনা? এই প্রশ্নের উত্তর দিলেন ফ্রান্সের লুই ডি ব্রগলী। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ থেকে ফিরে তিনি ঘোষণা করলেন, হ্যাঁ মৌলিক কণাদেরও তরঙ্গরূপ আছে। এদের তরঙ্গদৈর্ঘ্য ভরবেগের (ভর ও গতিবেগের গুণফল) সঙ্গে ব্যাস্তানুপাতিক। চারবছর বাদে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বেল ল্যাবোরেটরিতে ইলেকট্রন তরঙ্গের অস্তিত্ব প্রমাণ করলেন জোসেফ ডেভিসন ও লেস্টর জার্মার। শুধু ইলেকট্রন নয়, সমস্ত কণা এবং দৃঢ় বস্তুরই (এমনকি আমাদেরও) দ্বৈত সত্ত্বা আছে। কিন্তু ইলেকট্রনের মত হালকা কণাগুলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য অনেক বেশী বলে ওদের তরঙ্গরূপকে পর্যবেক্ষণ করা তুলনায় সহজ।  

ইতিমধ্যে ময়দানে নেমে পড়েছেন আরউইন স্রোডিংগার, উলফগ্যাং পাউলি, ম্যাক্স বর্ন, ওয়ার্নার হাইজেনবার্গ এবং আরো অনেকে। কোয়ান্টাম তত্ত্ব যত গাণিতিক সূত্রায়ণের মাধ্যমে দৃঢ় অবয়ব ধারণ করতে লাগল ততই এটা স্পষ্ট হয়ে উঠল এই বিশ্ব সম্পর্কে আমাদের সাবেকি চিন্তাভাবনায় বড় রকমের পরিবর্তন প্রয়োজন। জানা গেল যে ইলেকট্রন তরঙ্গের কথা বলা হচ্ছিল তা আসলে সম্ভাবনা তরঙ্গ। বোঝা গেল পরমাণুর ভিতরে রাদারফোর্ড বা বোর যেমন বলেছিলেন, ইলেক্ট্রনগুলো মোটেই সেরকম কোন কক্ষপথে নিউক্লিয়াসকে প্রদক্ষিণ করেনা। ইলেকট্রনের তরঙ্গ পরমাণুর মধ্যে একধরণের মেঘের মত ছেয়ে থাকে। কোন স্থানে ইলেকট্রনের তরঙ্গরাশির বর্গ করলে সেই স্থানে ইলেকট্রনের থাকার সম্ভাবনা পাওয়া যায়। আরো জানা গেল কোন কণার অবস্থান এবং ভরবেগ একইসঙ্গে নিখুঁতভাবে মাপা যায়না। যদি অবস্থানকে নিখুঁতভাবে মাপার চেষ্টা করা হয় তাহলে ভরবেগ পুরোপুরি অনির্ণেয় হয়ে যাবে।  আবার ভরবেগ নিখুঁতভাবে মাপলে অবস্থান পুরোপুরি অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। আরেকটা মাঝামাঝি উপায় হল অবস্থান আর ভরবেগ কোনটাই নিখুঁত ভাবে মাপা হলনা, কিন্তু কোনটাই আবার পুরোপুরি অনিশ্চিত হয়ে পড়ল না। দুটো রাশিতেই কিছু কিছু অনিশ্চয়তা থাকল। ব্যাপারটা বোঝার জন্য ধরা যাক একটা পদার্থের পরমাণুর মধ্যে একটা ইলেকট্রনের অবস্থান নির্ণয় করার চেষ্টা করা হচ্ছে। তাহলে একটা আলোকরশ্মিকে ঐ ইলেকট্রনের ওপর ফেলতে হবে। কিন্তু আলোকরশ্মি অর্থাৎ ফোটন কণার স্রোতের সঙ্গে যেই ইলেকট্রনের সংঘর্ষ হবে অমনি ইলেকট্রনের ভরবেগ বদলে যাবে। অর্থাৎ অবস্থান মাপতে গিয়ে অনিশ্চিত হয়ে পড়ল ইলেকট্রনের ভরবেগ। গাণিতিক ভাষায় হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তা নীতি (Uncertainty principle) বলছে অবস্থান ও ভরবেগের অনিশ্চয়তার গুণফল কোনভাবেই প্ল্যাঙ্কের ধ্রুবকের চেয়ে কম হবেনা। 




এককথায় বলা যায় কোয়ান্টাম মেকানিক্স নিউটনের সময় থেকে চলে আসা "নির্দেশ্যবাদে"র (Determinism) গোড়ায় জোরালো আঘাত করল। "নির্দেশ্যবাদ" অনুযায়ী কোন একটা নির্দিষ্ট মূহুর্তে আমরা যদি কোন বস্তু বা বস্তুসমষ্টির অবস্থান ও ভরবেগ সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য জেনে থাকি এবং ঐ বস্তু বা বস্তসমষ্টির ওপর ক্রিয়াশীল সবরকম বাহ্যিক বল সম্পর্কিত ডিটেলস জানতে পারি তাহলে ভবিষ্যতের যেকোন মূহুর্তে ঐ বস্তু বা বস্তুসমষ্টির অবস্থান ও ভরবেগ নির্ণ্য করতে পারব। আরেকটু এগিয়ে বলতে পারি - আজ, এই মুহূর্তে মহাবিশ্ব সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য যদি আমাদের নাগালে থাকে, তবে আমরা যেকোন সময়ে মহাবিশ্ব সম্পর্কে নিখুঁত ভবিষ্যৎবাণী করতে পারব। আমরা ভবিষ্যৎবাণী করতে পারছিনা তথ্যসংগ্রহে অপারগতার জন্য, কিন্তু সবকিছুই আসলে পূর্বনির্ধারিত। এই দর্শনের সঙ্গে ঈশ্বরবিশ্বাসী বা ভাগ্যবিশ্বাসীদের "সবই ঈশ্বরের ইচ্ছা" বা "ভাগ্যে যা আছে তাই হবে" টাইপের ধারণার তুলনা করতে পারি। কোয়ান্টাম মেকানিক্সের এই অনিশ্চয়তার যদি ঠিক হয় তবে তার মানে দাঁড়ায় ঈশ্বর তাঁর জাবদা খাতায় সব ঘটনা লিখে রাখেননি। বরং তিনি লুডো খেলেন এবং লুডোর দান অনুযায়ী দুনিয়া চালান। এই ব্যাপারটাই আইনস্টাইনের পছন্দ হয়নি। প্রথাগত অর্থে ঈশ্বরে বিশ্বাসী না হলেও তিনি নির্দেশ্যবাদে আস্থাশীল ছিলেন। কোয়ান্টাম মেকানিক্সের জন্মের পিছনে তাঁর হাত ছিল, কিন্তু সন্তানের বিপথে যাওয়া তিনি মেনে নিতে পারেননি! তিরিশের দশকের শেষভাগে এনিয়ে নীলস বোরের সঙ্গে আইনস্টাইনের এক মহাবিতর্ক হয়। আইনস্টাইন নানারকম যুক্তি ও কাল্পনিক পরীক্ষার অবতারণা করে অনিশ্চয়তা নীতির অসারতা প্রমাণ করতে চেয়ে ব্যর্থ হন। বিজ্ঞানীমহল বোর, হাইজেনবার্গের মতই মেনে নেন। আইনস্টাইন এব্যাপারে উচ্চবাচ্য না করলেও জীবনের শেষদিন পর্যন্ত এই বিশ্বাসে অটল ছিলেন যে "ঈশ্বর লুডো খেলেন না"। এই বিখ্যাত উক্তির জের টেনে আইনস্টাইনের মৃত্যুর ১৫ বছর পর স্টিফেন হকিং বলবেন, "ঈশ্বর যে শুধু লুডো খেলেন তাই নয়, তিনি কখনো কখনো লুডোর ছক্কাটাকে এমন জায়গায় ছুঁড়ে ফেলেন যে সেটাকে আর খুঁজে পাওয়া যায় না।" এই "এমন জায়গা"টা হল একটা কৃষ্ণগহ্বর বা ব্ল্যাকহোল (black hole)। তাই হকিং কেন এই মন্তব্য করেছিলেন তা জানতে হলে ব্ল্যাকহোল কি সেটা বুঝতে হবে।

আমরা জানি হিমালয় পর্বত থেকে বাতাসের একটা নাইট্রোজেন অণু সবাই পৃথিবীর আশেপাশে আটকে রয়েছে পৃথিবীর মধ্যাকর্ষণ বলের জন্য। কিন্তু কোন বস্তু যদি সেকেন্ডে ১১.২ কিলোমিটারের চেয়ে বেশী বেগে ওপরের দিকে গতিশীল হয় তবে সে পৃথিবীর মধ্যাকর্ষণের প্রভাব কাটিয়ে বেরিয়ে যেতে পারবে। এই ১১.২ কিমি/সেকেন্ড হল পৃথিবী পৃষ্ঠের ওপর মুক্তিবেগ। চন্দ্রপৃষ্ঠের ওপর মুক্তিবেগ অনেক কম ৪.২ কিলোমিটার/সেকেন্ড। এই কারণে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে নাইট্রোজেন, অক্সিজেনের মত গ্যাস পাওয়া যায়, কিন্তু চাঁদের অত্যন্ত পাতলা বায়ুমণ্ডলে এদের পাওয়া যায় না। সূর্যের ওপর সূর্যের মধ্যাকর্ষণজনিত মুক্তিবেগ আরো বেশী, সেকেন্ডে ৬১৭.৫ কিমি। তা এমন কোন নক্ষত্র বা মহাজাগতিক বস্তু কি থাকতে পারে যার আকর্ষণ কাটিয়ে কোন বস্তুই বেরোতে পারবে না? পারে, যদি সেই নক্ষত্রটির ওপর মুক্তিবেগ সেকেন্ডে ৩ লক্ষ কিলোমিটারের বেশী হয়। কারণ এটাই শূণ্য মাধ্যমে আলোর গতিবেগ এবং বিশেষ আপেক্ষিকতাবাদ অনুযায়ী আলোর চেয়ে বেশী বেগে কোন বস্তু গতিশীল হতে পারে না। কিন্তু এত বিশাল মুক্তিবেগ থাকতে গেলে নক্ষটির ভর খুব বেশী আর আয়তন খুব কম হতে হবে অর্থাৎ নক্ষত্রের উপাদান আসীম ঘনত্বের হতে হবে। এইরকম আলোকেও বেরোতে দেয়না এমন তারকার অস্তিত্ত্ব উনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকেই কল্পনা করেছিলেন ব্রিটিশ বিজ্ঞানী জন মিচেল বা ফরাসী বিজ্ঞানী ল্যাপ্লাস। কিন্তু তাঁদের কল্পনা দৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে পারেননি, কারণ আলোর চরিত্র নিয়ে ধোঁয়াশা। আলো যদি তরঙ্গ হয় তার ওপর মহাকর্ষের প্রভাব কি হবে তা নিউটনের তত্ত্ব থেকে জানা ছিল না। আবার আলোকে বস্তুকণার মত ধরলেও মুশকিল। একটা ঢিলকে ওপরের দিকে ছুঁড়লে তার দ্রুতি মন্থরতর হবে। কিন্তু আলোর দ্রুতি ধ্রুবক, কোনরকম বলের প্রভাবেই আলোর দ্রুতি বদলায় না। কাজেই মহাকর্ষ কিভাবে আলোর ওপর কাজ করবে তা স্পষ্ট ছিল না।

পরিস্থিতির আমূল পরিবর্তন ঘটল যখন ১৯১৬ সালে মহাকর্ষণের এক নতুন ব্যাখ্যা আমদানি করলেন আইনস্টাইন। তাঁর সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদের তত্ত্ব অনুযায়ী মধ্যাকর্ষণ দুটো বস্তুর মধ্যে আকর্ষণ বল নায়, জ্যামিতির খেলা। জ্যামিতি মানে স্পেসটাইমের জ্যামিতি। এক দশক আগেই বিশেষ আপেক্ষিকতার তত্ত্বে তিনি দেখিয়েছেন যে দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, উচ্চতা নিয়ে আমাদের তিনমাত্রার স্পেস আর একমাত্রার সময় বা টাইমকে আলাদা করে না দেখে চারমাত্রার স্পেসটাইম (spacetime continuum) হিসেবে দেখাই ভালো। তো আশেপাশে যখন কোন ভারী বস্তু নেই তখন স্পেসটাইম সমতল থাকে। কিন্তু কোন ভারী বস্তু রাখলেই স্পেসটাইম আর সমতল থাকেনা, বক্রতল হয়ে যায়। যত ভারী বস্তু রাখা হবে, এই বক্রতলের বক্রতা তত বেশী হবে। এবার দ্বিতীয় আরেকটি বস্তুর কথা ভাবা যাক। দ্বিতীয় বস্তুটি সমতল স্পেসটাইমে থাকলে অর্থাৎ নিউটনের ভাষায় তার ওপর কোন বল প্রযুক্ত না হলে সে সমবেগে সরলরেখায় ছুটবে। যখনই ভারী বস্তুটাকে রাখা হবে সে দ্বিতীয় বস্তুর ওপর মধ্যাকর্ষণ বল প্রয়োগ করে তাকে একটা নির্দিষ্ট পথে চালাবে, যেমন সূর্য পৃথিবীকে উপবৃত্তাকার পথে চালাচ্ছে। আইনস্টাইনের মতে অবশ্য দ্বিতীয় বস্তুটা সেই পথেই চলবে যাতে তাকে সবচেয়ে কম দুরত্ব পেরোতে হয়। যেটা আমরাও করি, কোন জায়গায় যাওয়ার আগে জেনে নিই শর্টেস্ট রুটটা কি (যদি না হাঁটা বা বেড়ানোটাই উদ্দেশ্য হয়)। সমতল স্পেসটাইমে সরলরেখায় ছোটার কারণ ওভাবে চললেই ন্যূনতম দুরত্ব অতিক্রম করতে হয়। সমতল ব্ল্যাকবোর্ডে দুটো বিন্দু এঁকে তাদের অসংখ্য রেখা দিয়ে যোগ করতে পারি, কিন্তু সবচেয়ে কমদৈর্ঘের রেখাটা হবে সরলরেখা। এবার যদি একটা ফুটবলের ওপর দুটো বিন্দু দিই, তাহলে কিন্তু তাদের মধ্যের ক্ষুদ্রতম দৈর্ঘ্যের পথ সরলরেখা হবেনা। স্পেসটাইমের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। ভারী বস্তুটা স্পেসটাইমটাকে এমনভাবে বেঁকিয়ে চুড়িয়ে রাখবে যাতে দ্বিতীয় বস্তুটা সরলরেখার বদলে ন্যূনতম দুরত্বের পথে ছোটে, আমরা যেমন রাস্তায় খানাখন্দ থাকলে একটু ঘুরপথে যাই।  

মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রের এহেন জ্যামিতিক ব্যাখ্যায় আলোর প্রভাবিত হওয়ার পথে কোন বাধা রইলনা। বক্রতলে আলোর দ্রুতি একই থাকে বটে কিন্তু গতিপথ বেঁকে যায়। এ যে শুধু তত্ত্ব নয়, তিন বছরের মধ্যে তা হাতে নাতে দেখালেন আর্থার এডিংটনের নেতৃত্বে একদল ব্রিটিশ বিজ্ঞানী। বৃষরাশির কিছু নক্ষত্র থেকে পৃথিবীর দিকে ধেয়ে আসা আলোকরশ্মি সূর্যের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় কতটা বেঁকে যায় তা পর্যবেক্ষণ করে তাঁরা জানালেন আইনস্টাইনের গণনা এক্কেবারে সঠিক। 
সিঙ্গুলারিটিকে ঘিরে একটা বৃত্তাকার তল পাওয়া যাবে যে তলের ওপর মুক্তিবেগ আলোর বেগের সমান। ফলে বাইরে থেকে যেকোন বস্তু এই তল দিয়ে ভেতরে ঢুকতে পারে, কিন্তু ভেতর থেকে কোনকিছুই বাইরে বেরোতে পারবেনা। নক্ষত্রের এই অন্তিম অবস্থাই হল ব্ল্যাকহোল বা কৃষ্ণগহ্বর।

১৯২৮ সালে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে এই এডিংটনের কাছে গবেষণা করার উদ্দেশ্যে মাদ্রাজ থেকে জাহাজে চাপেন এক তামিল ব্রাহ্মণসন্তান, সুব্রহ্মনিয়ম চন্দ্রশেখর। জাহাজে দীর্ঘপথ পারি দেওয়ার সময় তিনি তিনি চিন্তা করছিলেন একটা নক্ষত্রের অন্তিম দশা নিয়ে। আমাদের সূর্য সমেত সমস্ত "জীবিত" নক্ষত্রে অবিরাম নিউক্লিয়ার সংযোজন (fusion) চুল্লী চালু থাকে। নক্ষত্রের আলো ও তাপের উৎস এই চুল্লী। আবার এই চুল্লীর তাপে যে বহির্মুখি চাপের সৃষ্টি হয় সেই চাপই নক্ষত্রটিকে ভরের জন্য চুপসে যাওয়া থেকে রক্ষা করে। কিন্তু চুল্লীর জ্বালানী যখন শেষ হয়ে যায় তখন? চন্দ্রশেখর অঙ্ক কষে দেখলেন পাউলির অপবর্জন নীতি (exclusion principle) (দুটি ইলেকট্রন একই অবস্থায় থাকতে পারে না) মহাকর্ষীয় সংকোচনকে ঠেকিয়ে রাখতে পারে, যদি তারাটির কেন্দ্রীয় অঞ্চলের ভর সূর্যের ভরে দেড়গুণের বেশী না হয়। এই ভরকে বলা হয় চন্দ্রশেখর সীমা। এক্ষেত্রে তারাটির অন্তিম দশা হবে শ্বেত বামন (white dwarf)। তারাটির কেন্দ্রীয় অঞ্চলের ভর যদি সূর্যের ভরের ১.৪ গুণ থেকে ৩ গুণের মধ্যে হয় তাহলে আরো সংকুচিত হয়ে নিউট্রন স্টারে (neutron star) পরিণত হবে। এক একটা নিউট্রন স্টারের ঘনত্ব এমন যে কয়েক কিলোমিটার ব্যাসার্ধের গোলকের মধ্যে গোটা কতক সূর্য ঢুকে যাবে।
সুব্রহ্মণিয়ম চন্দ্রশেখর
ভর আরো বেশী হলে নক্ষত্রটি চুপসে যেতে থাকবে এবং তার সমস্ত ভর অবশেষে একটা বিন্দুতে গিয়ে জমা হবে। এই বিন্দু হল একধরণের স্পেসটাইম সিঙ্গুলারিটি (singularity), কারণ এই বিন্দুতে ঘনত্ব এবং স্পেসটাইমের বক্রতা অসীম। সিঙ্গুলারিটিকে ঘিরে একটা বৃত্তাকার তল পাওয়া যাবে যে তলের ওপর মুক্তিবেগ আলোর বেগের সমান। ফলে বাইরে থেকে যেকোন বস্তু এই তল দিয়ে ভেতরে ঢুকতে পারে, কিন্তু ভেতর থেকে কোনকিছুই বাইরে বেরোতে পারবেনা। নক্ষত্রের এই অন্তিম অবস্থাই হল ব্ল্যাকহোল বা কৃষ্ণগহ্বর। "ব্ল্যাক", কারণ কালোরঙের বস্তু যেমন সমস্ত তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলোকে শোষণ করে, ব্ল্যাকহোল তেমনি যাবতীয় বস্তুকে টেনে নেয় নিজের ভেতর। ঐ বৃত্তাকার তলকে বলা হয় ঘটনা দিগন্ত (horizon)।


 "ব্ল্যাকহোল" নামটার উৎপত্তি অবশ্য অনেক পরে। ১৯৬৯ সালে জন হুইলার প্রথম এই শব্দটা ব্যবহার করেন। এর মধ্যেই ব্ল্যাকহোলের চরিত্র বেশ খানিকটা জানা গেছে। যেহেতু ঘটনা দিগন্তের মধ্য থেকে আলো বেরিয়ে আসতে পারে না, তাই ব্ল্যাকহোলের ভেতরে কি আছে না আছে তা জানা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। শুধুমাত্র বাইরের স্পেসটাইমের বক্রতা থেকে আমরা ব্ল্যাকহোলের ভর, আধান ও কৌণিক ভরবেগ নির্ণয় করতে পারি। ব্যাপারটা তাৎপর্য মারাত্মক। যে নক্ষত্রটা চুপসে গিয়ে ব্ল্যাকহোলে পরিণত হল তার উপাদান বা গঠনের কোন ছাপই আর ব্ল্যাকহোলের মধ্যে পাওয়া যাবে না। যে পদার্থগুলো ব্ল্যাকহোলের ভিতর গিয়ে পড়ছে তাদের মধ্যে সঞ্চিত তথ্যও চিরতরে হারিয়ে যাবে ব্ল্যাকহোলের মধ্যে। এই ব্যাপারটাকে হুইলার বলেছিলেন চারটি শব্দেঃ "ব্ল্যাকহোলের কোন চুল নেই" (blackholes have no hair)। চুল এখানে জটিলতার প্রতীক। ধরা যাক তিন যমজ ভাই, হুবহু একরকম দেখতে, শুধুমাত্র তাদের হেয়ার স্টাইল আলাদা। এবার যদি তিনজনকেই ধরে ন্যাড়া করে দেওয়া হয় তাহলে আর তাদের আলাদা করে চেনা যাবে না। সেরকমই একই ভর, আধান ও কৌণিক ভরবেগ বিশিষ্ট একাধিক ব্ল্যাকহোলকে পৃথক করার উপায় নেই। এতেও খুব সমস্যা ছিল তা নয়। গোল বাঁধল যখন স্টিফেন হকিং কোয়ান্টাম তত্ত্বকে বক্র স্পেসটাইমে প্রয়োগ করতে গেলেন। 
স্টিফেন হকিং 

হকিং ততদিনে বিরল মোটর নিউরোন ডিসিজে আক্রান্ত। হাঁটা চলা, কথা বলা কিছুই করতে পারছেন না। তবু শারীরিক প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই করার সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বতত্ত্ব ও সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদে একের পর যুগান্তকারী গবেষণা করে চলেছেন। ব্ল্যাকহোলের তাপগতিবিদ্যার চর্চা করতে গিয়ে তিনি একটা চমকপ্রদ ফল পেলেন। ব্ল্যাকহোল নাকি যতটা কালো ভাবা হচ্ছিল, ততটা কালো নয়! একটা বস্তুকে উত্তপ্ত করলে সে যেমন আলো ও তাপ বিকিরণ করে, ঠিক সেরকমই ব্ল্যাকহোল থেকেও শক্তির বিকিরণ ঘটে। এই ঘটনা কে বলা হয় হকিং বিকিরণ। আগেই বলেছি কোয়ান্টাম তত্ত্ব ধ্রুপদী নির্দেশ্যবাদের গোড়া ধরে টান দিয়েছিল। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এক ধরণের কোয়ান্টাম নির্দেশ্যবাদের জন্ম দিয়েছিল। এই নীতি অনুযায়ী আজকের তথ্য থেকে ভবিষ্যতে কোন কণার অবস্থান বা ভরবেগ নিখুঁত ভাবে বলা যাবেনা ঠিকই, কিন্তু ঐ কণার কোনো অবস্থান বা ভরবেগ থাকার সম্ভাবনা কতটা তা নিখুঁতভাবে বলা যাবে। এই সম্ভাবনা সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য জমা থাকে কণাটির তরঙ্গরাশি বা ওয়েভ ফাংশানে। এখন এই কণাটি যদি কোন ব্ল্যাকহোলে ঢুকে পড়ে তাহলে "নো হেয়ার থিয়োরেম" অনুযায়ী তার ওয়েভ ফাংশানে সঞ্চিত সমস্ত তথ্য মুছে যাবে! তাহলে হকিং বিকিরণের মাধ্যমে সেই কণাটা যদি আবার বাইরে বেরিয়ে আসে তাহলে তার তরঙ্গরাশিতে আর কোন পুরনো "স্মৃতি" থাকবে না। ফলতঃ আগের তথ্যের ভিত্তিতে কোনরকম ভবিষ্যতবাণীও করা যাবে না আর। এভাবেই হকিং বিকিরণ আর নো হেয়ার থিয়োরেম মিলে "কোয়ান্টাম নির্দেশ্যবাদে"র বারোটা বাজিয়ে দিলো। ব্যাপার যেটা দাঁড়ালো, ঈশ্বর শুধু লুডো খেলেন তাই নয়, কাছাকাছি ব্ল্যাকহোল থাকলে তিনি লুডোর ছক্কাটাকে হারিয়ে ফেলতে পারেন!   


তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানে এটা একটা ধাঁধার মত। এই ধাঁধা "ব্ল্যাকহোল ইনফরমেশান প্যারাডক্স" নামে পরিচিত। চারদশক ধরে বিজ্ঞানীরা এই ধাঁধার সমাধান করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। ৯০ এর দশক থেকে তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের নবীন শাখা স্ট্রিং থিয়োরির (string theory) গবেষণা "নো হেয়ার থিয়োরেম"এর ওপর সন্দেহ বাড়িয়ে দিলো। ব্ল্যাকহোল যে তথ্য গিলে ফেলে, বিকিরণের মাধ্যমে সেই তথ্য ফিরিয়ে দেয় এই ধারণা পোক্ত হতে থাকল বিজ্ঞানীমহলে। কিন্তু কিভাবে তা হতে পারে সেটা এখনো স্পষ্ট হয়নি। এই বছরের গোড়ায় একটা সমাধানের ইঙ্গিত দিয়েছেন হকিং স্বয়ং। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর সহকর্মী ম্যালকম পেরি ও হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অ্যান্ড্রু স্ট্রমিংগারের সঙ্গে যৌথভাবে লেখা একটি প্রবন্ধে তিনি জানিয়েছেন- ভর, আধান ও কৌণিক ভরবেগ ছাড়াও ব্ল্যাকহোলের অসংখ্য সংরক্ষিত "সুপার ট্রান্সলেশান চার্জ" থাকতে পারে। চার্জ অর্থে তড়িতাধান নয়, বিভিন্ন ধরণের সংরক্ষিত রাশিকে "চার্জ" বলা হয়। এই চার্জগুলো "নরম চুলে"র মত কাজ করে, অর্থাৎ কোন বস্তু ব্ল্যাকহোলের মধ্যে পড়লে তার তরঙ্গরাশিতে সঞ্চিত তথ্য ধরা থাকতে পারে এই নরম চুলে। ঠিক যেমন গোঁফদাড়িতে লেগে থাকা দুধ বা মাংসর টুকরো থেকে আন্দাজ করা যেতে পারে আমি কি খেয়েছি! 
এই তথ্য ধরে রাখার প্রক্রিয়া যে পুরোপুরি বোঝা গেছে তা নয়। "নরম চুল"কি ব্ল্যাকহোলের মধ্যে পড়া সমস্ত তথ্যই ধরে রাখতে পারে সেটাও স্পষ্ট নয়। এ নিয়ে কাজ এখনো চলছে। ব্ল্যাকহোলের চুল পাওয়া গেলে ঈশ্বরকে লুডো খেলা থেকে নিবৃত্ত করা যাবে না বটে, কিন্তু তাঁর লুডোর ছক্কাটা যাতে হারিয়ে না যায় সেই ব্যবস্থা করা যেতে পারে।

তথ্যসূত্রঃ
১। L Ponomarev, "The Quantum Dice", Mir Publishers Moscow (1988)
২। স্টিফেন ডব্লু  হকিং, "কালের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস", অনুবাদঃ শত্রুজিৎ দাশগুপ্ত, বাউলমন প্রকাশন (১৯৯৩)
৩। Gary T. Horowitz, "Black holes have soft quantum hair", APS Physics 9, 62 (2016)

* "আমি অনন্যা" পত্রিকার অক্টোবর-ডিসেম্বর ২০১৬ সংখ্যায় প্রকাশিত