Tuesday, 18 April 2017

পাহাড়ের ডায়েরি (১)


শিলিগুড়ি থেকে প্রায় ৭০-৮০ কিলোমিটার যাওয়ার পরেও যখন একটা হালকা ঠাণ্ডা হাওয়ার বেশী কিছু পাচ্ছিলাম না তখন তেড়ে গাল দিচ্ছিলাম অনির্বাণ কে। আমাদের টিম লিডার তো সেইই। ধুয়োটা অবশ্য তুলেছিল পল্লব। "সিকিমে হিলে-ভার্সে বলে একটা জায়গা আছে; যাবি নাকি?" ৬ জন হাত তুললাম। পরে অবশ্য ২ জন ছেঁটে গেল। রইলাম বাকি ৫। আমি (অতনু), পল্লব, অনির্বাণ, বব আর আমার সহধর্ম্মিণী শ্রীরূপা। আমাদের মধ্যে অনির্বাণ ছাড়া ট্রেকিং এ সবাই নবিশ। তো অনির্বাণ আগে থেকেই বলে রেখেছিল, "ওখানে কিন্তু হেব্বি ঠাণ্ডা, ভালো করে গরম জামাকাপড় নিয়ে নিবি।" সেইমত এপ্রিলের গরমে বাক্সয় ঢুকে যাওয়া শীতের জামাকাপড় বের করে ব্যাগ ভর্তি করেছি। এখন শীতের এই চেহারা দেখে কার না মাথা গরম হয়? অনির্বাণের উপদেশের মাহাত্ম অবশ্য পরে টের পেয়েছিলাম হাড়ে হাড়ে। আক্ষরিক অর্থেই!


তিস্তা নদী, গাড়ি থেকে তোলা।

এনজেপি স্টেশনে আমাদের ট্রেন ঠিক সময়েই পৌঁছেছিল। তারপর রিটায়ারিং রুমে একটু হালকা হয়ে যখন সাগরভাইয়ের গাড়িতে উঠলাম তখন সকাল সাড়ে নটা। শিলিগুড়ি শহর পেরিয়ে তিস্তার পাশ দিয়ে পাক খেয়ে খেয়ে পাহাড়ে উঠলাম। ধাপে ধাপে বাড়িঘরগুলো ছোট হয়ে এলো। পুলিস চেকপোস্ট পেরিয়ে পশ্চিমবঙ্গ থেকে সিকিমে ঢুকলাম। তিস্তা ও রঙ্গিতের সঙ্গমস্থলে দাঁড়িয়ে কিছু ছবিটবি তুললাম। সাগরভাই মাঝেমধ্যেই গাড়ি দাঁড় করিয়ে কিছু জিনিসপত্র তুলছিলেন। আবার সেগুলোকে তাদের গন্তব্যস্থলে নামিয়ে দিচ্ছিলেন। রাস্তার ধারে সুন্দরী নেপালি মহিলাদের হাত নাড়া দেখে বোঝা গেল সাগরভাই এখানে বেশ পপুলার। অনেকটা রাস্তা, সবারই ছোটবাইরে যাওয়ার প্রয়োজন। আমরা ছেলেরা যেকোন জায়গায় কাজ সারতে পারি, কিন্তু সঙ্গে একটা মেয়ে আছে। সাগরভাইকে বলতে তিনি আশ্বস্ত করলেন। খানিকবাদে গাড়ি দাঁড়ালো ঝাঁ চকচকে একটা বিশাল মন্দিরের সামনে। কিন্তু আমাদের তো মন্দির দর্শনের কোন বাসনা ছিল না। সাগরভাই বললেন "অন্দরমে টয়লেট ভি হ্যায়!" আহ! নাস্তিক হিসেবে মন্দিরের উপযোগিতা এই প্রথম উপলব্ধি করলাম। জায়গাটার নাম দরমদিন। ফেরার দিন এই সাগরভাই-ই আমাদের এনজেপি নিয়ে যাবেন। আর আমরা নিজে থেকেই তাঁকে বলব, "ঊও মন্দিরমে থোরা রোক দিজিয়ে না, টয়লেট যানা হ্যায়!"


সাগরভাই গাড়ি থামিয়ে একটা দোকান থেকে কিছু কেনাকাটা করছিলেন। সেই ফাঁকে আমরা পা ছাড়িয়ে নিচ্ছিলাম। স্কুলফেরতা এই মেয়েটাকে দেখে পল্লব পটিয়ে ছবি তোলার জন্য রাজি করিয়ে ফেলল।


হিলে তে যখন পৌঁছলাম তখন ৬টা বাজে। সূর্য ডুবে গেছে, তবু কিছু আলোর আভা রয়েছে। যেখানে গাড়ি থামল তার সামনে জঙ্গল, পরে জেনেছি ওটাই ভার্সে যাওয়ার পথ। বাঁদিকে একটু উঁচুতে সার দিয়ে চারটে কুঁড়েঘর। এগুলোই আপাততঃ আমাদের মাথা গোঁজার ঠাঁই। আর ডানদিকে নিচে একটা ফাঁকা জায়গা। সেখানে আর্মির ক্যাম্প বসেছে। আমাদের মধ্যে বব ঘোর দেশপ্রেমিক। ইন্ডিয়ান আর্মি দেখেই ভীষণ উত্তেজিত হয়ে সে ক্যাম্পে দর্শন দিতে যাচ্ছিল। কিন্তু এক কর্তব্যরত জওয়ান নিষেধ করলেন। আর্মি ক্যাম্পে যাওয়া আর ছবি তোলা দুটোই বারণ। পাঁচটা কুঁড়েঘরের মধ্যে দুটো থাকার জায়গা, দুটো রান্নাঘর। শেষে একটা টয়লেট। ঘরে ১৫-২০ জন লোক স্বচ্ছন্দে থাকতে পারে। আপাততঃ একটা ঘর আমাদের পাঁচজনের দখলে। ঘরে বসতে না বসতেই ড্রাগন আঁকা সুদৃশ্য চিনামাটির কাপে ধোঁয়া ওঠা অদ্ভুত স্বাদের লিকার চা আর প্লাস্টিকের বাটিতে ম্যাগি চলে এলো। এখানে জলখাবার হিসেবে ম্যাগি বেশ চলে। আসলে যদিও ম্যাগি নয়, ওয়াই ওয়াই।


ট্রেকার্স হাট, হিলে


এই প্রথম ট্রেকিং এ যাচ্ছি, সবার বাড়িতেই চিন্তা আছে। কিন্তু পৌঁছানোর খবর দেবো কি করে? নেটওয়ার্ক কখন হাপিস হয়ে গেছে। এই "ট্রেকার্স হাট" আর আর্মি ক্যাম্প ছাড়া এলাকায় জনমানবের চিহ্ন নেই। রাস্তাটা ধরে একটু উঠে এক নেপালি মহিলাকে দেখে হিন্দিতে জিজ্ঞাসা করলাম, এখানে কোন ল্যান্ডলাইন আছে কি না। তিনি কি বুঝলেন কে জানে, বাঁদিকে হাত দেখিয়ে বললেন, "ওই ল্যাম্পপোস্টের কাছে চলে যান।" কিন্তু ল্যাম্পপোস্ট পেরিয়ে কয়েক হাত এগিয়েও কিছু চোখে পড়ল না। একটু ওপরে সামান্য আলো আর একজন মানুষকে দেখে একই প্রশ্ন করতে তিনি পালটা জিজ্ঞাসা করলেন, "ভোডোফোন?" আমরা হ্যাঁবাচক মাথা নাড়তে তিনি আবার ঐ ল্যাম্পপোস্টটাই দেখিয়ে দিলেন। সেই ল্যাম্পপোস্টের তলায় দাঁড়াতেই কি আশ্চর্য! দিব্যি টাওয়ার পাওয়া যাচ্ছে! চটপট যে যার বাড়িতে জানিয়ে দিলাম ঠিকঠাক পৌঁছেছি। আর এ কদিন ফোনে যোগাযোগ করা সম্ভব নাও হতে পারে। 


পাহাড়ে জলখাবারের কমন আইটেম হল ম্যাগি।


যত রাত বাড়তে লাগল ঠাণ্ডা কাকে বলে বুঝতে পারলাম। পরের দিন ১০০০০ ফুট উঁচ্চতায় ভার্সেতে কি হতে চলেছে তারও একটা আঁচ পেলাম। ফুলশার্টের ওপর ফুল সোয়েটার, জ্যাকেট, মাথায় মাফলার, টুপি পরেও কাঁপুনি থামানো যাচ্ছিল না। তার ওপর টয়লেট যেতে হবে দুটো ঘর পেরিয়ে। ঘরে টিমটিম করে একটা বাল্ব জ্বললেও বাইরে কোন আলো নেই। যে টর্চটা এনেছিলাম সেটা বিগড়ে গেছে। বড়বাইরে পেলে অতএব মোবাইলই ভরসা! হাতে গড়া রুটি, সেদ্ধ না হওয়া ফুলকপি আর ছালশুদ্ধু মুরগির মাংসের ঝোল দিয়ে নৈশাহার সেরে সোয়েটারের ওপর কম্বল চাপা দিয়ে শুয়ে পড়লাম। পরদিন সকালেই ট্রেকিং শুরু হবে। পল্লব ভূতের গল্প শুরু করল। শুনতে শুনতে ঘুমে তলিয়ে গেলাম। 


হিলেতে সূর্যোদয়

অন্যান্য পর্বের লিঙ্কঃ

Sunday, 12 February 2017

বসন্ত এসে গেছে

কলকাতা বইমেলা হয়ে থাকে মাঘ মাসের মাঝামাঝি। শীত তখন স্লগ ওভারে খেলে। তাই কম্বল মুড়ি দিয়ে নতুন বইয়ের পাতা ওল্টানোর সুযোগ থাকে। এবার কম্বলটা একদিনের জন্যে বেরিয়ে আবার ঢুকে গেছে তার বাক্সয়। কিন্তু শীতের চটপট ড্রেসিংরুমে ফিরে যাওয়ায় ভাগ্য খুলে গেছে আরেকজনের, গ্রীস্মকালের তাড়াতাড়ি ক্রিজে নামার তাগিদে যে ব্যাট করার সুযোগই পায়না। মা-র বাগানের টবগুলোয় দেখছি ফুল ফুটছে, আমগাছে বউল এসে গেছে। একটা পরিচিত পাখির ডাক শুনতে পাচ্ছি থেকে থেকেই। তাই বইমেলা থেকে কেনা একব্যাগ বই থেকে এটাকেই হাতে নিলাম। আর মলাটটা খুলতেই চলে গেলাম এক স্বপ্নের দেশে।

এ তো বই নয়, একখানা আস্ত টাইম মেশিন। টাইম মেশিনের চড়ে কখনো চলে যাচ্ছি দশম শতকের জাপানে, যেখানে রাজপ্রাসাদের অন্দরমহলে বসে উপন্যাস লিখছেন সাম্রাজ্ঞীর এক সহচরী মুরাসাকি শিকিবু, যে উপন্যাস "টেল অফ গেনজি"কে অনেক পরে "পৃথিবীর প্রথম আধুনিক উপন্যাস"এর তকমা দেবেন পণ্ডিতরা। কখনো আবার যাচ্ছি উনিশ শতকের কোরিয়ায়। পাহাড়, অরণ্যের মাঝে প্রাচীনকালের চীনদেশীয় কবি লিন বু-র ছোট্ট কুটিরের ছবি এঁকেছেন কোরিয়ান শিল্পী। তলায় লেখা "আমি লিন বু-র বাড়ি যাচ্ছি"। এই ছবি এঁকেই তিনি চলে যেতে পারবেন লিন বু-র কাছে। সেখান থেকে চলে আসছি বিংশ শতাব্দীরর অভিশপ্ত হিরোশিমায়। হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে একটার পর একটা কাগজের সারস বানিয়ে চলেছে এগারো বছরের ফুটফুটে মেয়ে সাদাকো। পরমাণু বোমার আঘাত থেকে বেঁচে গেলেও তেজস্ক্রিয়তার প্রভাবে ম্যালিগন্যান্ট লিউকেমিয়ায় আক্রান্ত হয়েছিল। তার কোন বন্ধু বলেছিল হাজারটা সারস বানাতে পারলে সে বেঁচে যাবে। ভারাক্রান্ত মন নিয়ে একুশ শতকের সিওলে এসে দেখলাম আকাশে রংবেরঙের ঘুড়ি উড়ছে। ঘুড়ির সুতোয় কিন্তু মাঞ্জা নেই। পাশের ঘুড়িগুলোকে কাটতে না শিখলে নিজে ওড়া যাবে না, সেটা বোধহয় এঁরা মানেন না। আবার তারপর ফিরে গেলাম কোন স্মরণাতীত কালে, কোরিয়ার এক শহরে। সেদেশের রাজা সমুদ্রের ধারে বসে প্রতীক্ষা করছেন ভারতবর্ষ থেকে পালতোলা জাহাজে সাগরপাড়ি দেওয়া এক সুন্দরী রাজকন্যার জন্য।

কোরিয়া আর জাপান এই দুই দেশের কয়েক শতাব্দীর সাহিত্য, শিল্প, ভাষা, দর্শন, খাদ্য, প্রকৃতি সবকিছুরই টুকরো টুকরো দৃশ্য এলোমেলোভাবে ফুটে উঠল টাইম মেশিনের পর্দায়। সে দৃশ্য যেমন লেখা হয়েছে শিজো কবিতা, ইতিহাস, উপকথা আর ট্রাভেলগের মিশেলে তৈরী আশ্চর্য গদ্যে তেমনি আঁকা হয়েছে অজস্র সাদাকালো আর রঙিণ ছবিতে। জাপান আর কোরিয়া - এই দুই দেশ যেমন জড়িয়ে আছে সংস্কৃতির নৈকট্যে, তেমনি ধরে রেখেছে সংঘাতের তিক্ত ইতিহাসকেও। বইয়ের নাম "চেরিফুলে"র নামে। জাপানে জাতীয়তাবাদের প্রতীক এই চেরি ফুল কোরিয়ায় হয়ে যায় জাপানি সাংস্কৃতিক আধিপত্যের প্রতিভূ। আর এই দুই দেশের আত্মাকে বেঁধে রেখেছে আরো একটা দেশ, যে দেশ "স্বপ্ন দিয়ে তৈরী, স্মৃতি দিয়ে ঘেরা", কোন ভূগোল বইয়ের ম্যাপ যে দেশকে বেঁধে রাখতে পারেনি। সেই দেশের এক গৃহত্যাগী রাজকুমারের বার্তা একদিন পৌঁছে গিয়েছিল জাপান, কোরিয়া, চীন আরো কত দেশে। সেইসব দেশের পাহাড়ের চূড়ায়, গুহার তলায়, মন্দিরের অন্দরে হাজার বছর ধরে প্রার্থনার সুর বেজে চলেছে সেই রাজকুমারের বাণীর সঙ্গে তাল মিলিয়ে।

বইটা বন্ধ করে জানলার দিকে তাকাতেই দেখতে পেলাম তাকে সেই পাখিটাকে। বসন্তের দূত। একা একাই গাছের ডালে ঘুরে ঘুরে শিষ দিয়ে গান গেয়ে চলেছে। বসন্ত এসে গেছে।



চেরিবসন্ত
রাকা দাশগুপ্ত
প্রচ্ছদ ও অলঙ্করণঃ চিরঞ্জিত সামন্ত
ধানসিড়ি প্রকাশন

Sunday, 8 January 2017

অন্ধকারের রাজত্ব

কবি বলেছিলেন, "বিপুলা এ পৃথিবীর কতটুকু জানি?" প্রশ্নটা কোন জ্যোতির্বিদকে করা হলে তিনি জবাব দেবেন, "শতকরা পাঁচ ভাগ মাত্র"। তাঁর কাছে অবশ্য পৃথিবী মানে এই শস্য শ্যামলা বসুন্ধরা নয়; গ্রহ, নক্ষত্র, নীহারিকা, ছায়াপথ সম্বলিত এই বিপুল মহাবিশ্বই তাঁর জগৎ। সে যাই হোক, এই গভীর দার্শনিক প্রশ্নের জবাবে এমন নীরস গাণিতিক উত্তর নিশ্চয়ই কবির পছন্দ হবে না! যদিও তাঁর প্রশ্নের মধ্যেই স্পষ্ট নেতিবাচক উত্তর, কিন্তু একেবারে হিসেব কষে বলে দেওয়া পাঁচ ভাগ জানি আর পঁচানব্বই ভাগ জানি না! এটা কি বাড়াবাড়ি হয়ে গেল না? এ প্রশ্নের উত্তর পেতে ঘুরে আসা যাক ষাটের দশকের আমেরিকায়, ওয়াশিংটন ডিসির কার্নেগি ইনস্টিটিউশানে। সেখানে তখন বিভিন্ন ছায়াপথের মধ্যে তারাদের গতিবিধি নিয়ে গবেষণা করছেন এক তরুণী, ভেরা রুবিন।

ছোটবেলায় রুবিনকে জানলা দিয়ে হাঁ করে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে পেশায় ইলেকট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ার পিতা আনন্দ যেমন পেতেন তেমনি মাথায় চিন্তাও ঘুরত, মেয়েদের পক্ষে কি মহাকাশ নিয়ে পড়াশোনা করা সম্ভব! সংশয় সত্ত্বেও তিনি মেয়েকে একটা দূরবীন বানিয়ে দিয়েছিলেন এবং শখের জ্যোতির্বিদদের সম্মেলনে নিয়ে গেছিলেন। তাই রুবিনের পিতার মনোভাবকে দোষ দিলে আমরা ভুল করব যখন দেখব স্কুলের পাঠ শেষ করে রুবিন প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের দরজায় গিয়ে দাঁড়ালে সে দরজা এই কারণে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে যে "প্রিন্সটনে জ্যোতির্বিজ্ঞান পড়ার জন্য মেয়েদের নেওয়া হয় না!" এই নিয়ম প্রিন্সটনে ১৯৭৫ সাল অবধি চালু ছিল! শেষ অবধি রুবিন কর্ণেল ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হলেন এবং সেখান থেকে স্নাতক হয়ে জর্জ গ্যামোর অধীনে গবেষণা শুরু করলেন। পিএইচডি করে তিনি কার্নেগি ইনস্টিটিউশানে গিয়ে জুটি বাঁধলেন আরেক জ্যোতির্বিদ কেন্ট ফোর্ডের সঙ্গে। ফোর্ড তখন মহাকাশের কাণ্ডকারখানা দেখার জন্য অতি সূক্ষ্ম স্পেক্ট্রোমিটার (যা দিয়ে আলোর বর্ণালী বিশ্লেষণ করা হয়) তৈরীর কাজে ব্যস্ত।

গ্যালাক্সি বা ছায়াপথ ছায়াপথ তৈরী হয় অজস্র গ্রহ, নক্ষত্র, নক্ষত্রের মৃতদেহ, মহাজাগতিক ধূলো ইত্যাদি নিয়ে। এক একটা ছায়াপথে কয়েকশো কোটি থেকে কয়েক লক্ষ কোটি নক্ষত্র থাকে! ছায়াপথ গুলো সাধারণত চাকতি বা সর্পিল আকৃতির হয়। মধ্যাকর্ষণ টানের কারণে বেশীরভাগ তারা কেন্দ্রের দিকে থাকে, বাইরের দিকে নক্ষত্রের সংখ্যা অনেক কম। সৌরজগতে যেমন সূর্যকে কেন্দ্র করে গ্রহগুলো প্রদক্ষিণ করে, ছায়াপথের কেন্দ্রের চারদিকে ঠিক তেমনি ভাবে নক্ষত্র গুলো সপরিবারে পরিক্রমণ করে। সৌরজগতের ক্ষেত্রে আমরা দেখি গ্রহগুলো সূর্য থেকে যত দূরে রয়েছে, তারা তত আস্তে ঘুরছে। যেমন সূর্যের সবচেয়ে কাছের গ্রহ হল বুধ। একবার সূর্যকে পাক খেতে বুধের সময় লাগে পৃথিবীর হিসেবে মাত্র ৮৮ দিন। অন্যদিকে সবচেয়ে দূরের গ্রহ প্লুটো, যাকে এখন বামন গ্রহ তকমা দেওয়া হয়েছে, সূর্য কে পাক খেতে ৯০ হাজার দিন লাগিয়ে দেয়। আর পৃথিবী বুধের তুলনায় দূরে কিন্তু প্লুটোর তুলনায় সূর্যের কাছে। তাই পৃথিবীর ১ বছর হয় ৩৬৫ দিনে। পরিক্রমণ বেগের দিকে তাকালে দেখবো যে বুধ, পৃথিবী ও প্লুটোর বেগ যথাক্রমে সেকেন্ডে ৪৭.৪, ২৯.৮ ও ৪.৭ কিলোমিটার। যেহেতু সৌরজগতে গ্রহসমূহের গতি এবং ছায়াপথে নক্ষত্রসমূহের গতি পরিচালিত হচ্ছে একই নিয়ম, অর্থাৎ ভারী কেন্দ্রীয় অঞ্চলের মহাকর্ষীয় টানের কারণে, তাই ছায়াপথেও যত কেন্দ্র থেকে বাইরের দিকে যাওয়া যাবে তত নক্ষত্রগুলোর বেগ কমতে থাকা উচিৎ। 

কিন্তু রুবিন ও ফোর্ড একটা অদ্ভুত ঘটনা দেখলেন। যতই ছায়াপথের কেন্দ্র ছেড়ে সীমানার দিকে যাওয়া হোক, নক্ষত্রগুলোর পরিক্রমণ বেগ প্রায় একই থেকে যাচ্ছে। ষাটটি পেঁচাল ছায়াপথকে তাঁরা পর্যবেক্ষণ করেন এবং প্রতিটার ক্ষেত্রেই একই ফলাফল মেলে অর্থাৎ কেন্দ্র থেকে দূরত্বের সঙ্গে নক্ষত্রদের পরিক্রমণ বেগের কোন পরিবর্তন নেই। এটা ঘটতে পারে যদি ছায়াপথের ভর কেন্দ্রীয় অঞ্চলে সন্নিবিষ্ট না হয়ে গোটা ছায়াপথ জুড়ে বিস্তৃত থাকে। কিন্তু এই ভর আমাদের চেনাজানা কোন পদার্থের হতে পারে না, তা যদি হত তাহলে তো তাদের দেখাই যেত! এই অজানা ভরের নাম দেওয়া হল ডার্ক ম্যাটার। নক্ষত্রদের পরিক্রমণ বেগের হিসেব করে রুবিন ও ফোর্ড দেখলেন একটা গ্যালাক্সির মোট ভরের প্রায় নব্বই শতাংশই হল এই ডার্ক ম্যাটার। মাত্র দশ শতাংশ ভর আমাদের পরিচিত প্রোটন, নিউট্রন ইত্যাদি দিয়ে তৈরী। 

ডার্ক ম্যাটারের কথা যে রুবিন রা-ই প্রথম বলেছিলেন তা নয়। তিরিশের দশকে ডাচ বিজ্ঞানী জন ওর্ট, যাঁকে ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি "বিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ জ্যোতির্বিদ" বলে আখ্যায়িত করেছে, আকাশগঙ্গা ছায়াপথে ডার্ক ম্যাটারের অস্তিত্ব শনাক্ত করেন। আকাশগঙ্গা ছায়াপথ নিয়ে গবেষণায় পথিকৃত ছিলেন ওর্ট। তাঁর অন্যতম অবদান আকাশগঙ্গা ছায়াপথে সৌরমণ্ডলের অবস্থান চিহ্নিত করা। এদিক দিয়ে তাঁকে আধুনিক কোপারনিকাস বলা যেতে পারে। কোপারনিকাস যেমন দেখিয়েছিলেন আমাদের পৃথিবী আদৌ সৌরজগতের কেন্দ্রে নেই, ওর্ট তেমনি প্রচলিত মত খারিজ করে দেখালেন গ্রহমণ্ডলী সমেত সূর্যের অবস্থান আকাশগঙ্গা ছায়াপথের কেন্দ্রে নয়, কেন্দ্র থেকে তিরিশ হাজার আলোকবর্ষ দূরে একটি অপাংক্তেয় জায়গায়! ওর্ট যখন নেদারল্যান্ডের লেইডেন ইউনিভার্সিটিতে আকাশগঙ্গা নিয়ে গবেষণা করছেন তখন আটলান্টিকের ওপারে ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজিতে দাপট দেখাচ্ছিলেন এক বদরাগী ও তক্কবাজ সুইস জ্যোতির্বিদ ফ্রিৎজ জুইকি। সহকর্মীরা তাঁকে বলত স্ফেরিকাল বাস্টার্ড! স্ফিয়ার অর্থাৎ একটা নিটোল গোলককে যেদিক থেকেই দেখি না কেন একইরকম দেখাবে, তেমনি জুইকি কে যেভাবেই দেখা হোক না কেন তিনি না কি একজন বাস্টার্ড! তো এই জুইকি কাজ করছিলেন কোমা ক্লাস্টার নিয়ে। অজস্র তারা নিয়ে যেমন গ্যালাক্সি তেমনি অজস্র গ্যাল্যাক্সি নিয়ে ক্লাস্টার। ক্লাস্টারের মধ্যে গ্যালাক্সি গুলো একই রকম ভাবে পাক খাচ্ছে। জুইকি দেখলেন ক্লাস্টারের বাইরের দিকের গ্যালাক্সিগুলো এত জোরে ছুটছে যেন এক্ষুণি ছিটকে বেরিয়ে যাবে। কিন্তু কোন অদৃশ্য টান তাদের ক্লাস্টারের মধ্যে ধরে রেখেছে। আমরা যদি একটা পাথরকে একটা সুতোর একপ্রান্তে বেঁধে অন্য প্রান্তটা হাতে নিয়ে বনবন করে ঘোরাই তাহলে বাইরের দিকে একটা টান অনুভব করব। সুতোটা পোক্ত না হলে ছিঁড়ে গিয়ে পাথরটা ছিটকে বেরিয়ে যাবে। সেরকমই ব্যাপার। জুইকি এটাও দেখালেন, যে অদৃশ্য ভর এই টান যোগাচ্ছে, তার অনুপাত ক্লাস্টারের মোট ভরের ৯০ শতাংশ! মাত্র ১০ শতাংশ হল দৃশ্যমান ভর। 

ডার্ক ম্যাটারের অস্তিত্ত্বের পক্ষে আরেকটা বড় প্রমাণ পাওয়া গেছে মহাকর্ষীয় লেন্স থেকে। আমরা স্কুলের বইতেই পড়েছি আলো সরলরেখায় চলে। কিন্তু চলার মাধ্যম পরিবর্তন হলে আলোকরশ্মি দিক পরিবর্তন করে। এই ঘটনাকে বলা হয় প্রতিসরণ এবং এটাকে কাজে লাগিয়েই লেন্স তৈরী হয়। আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতার তত্ত্ব থেকে জানা গেছিল আলোকরশ্মি কোন ভারী বস্তুর পাশ দিয়ে যাওয়ার সময়ও বেঁকে যায়। ধরা যাক কোন আলোক উৎস (যেমন একটা নক্ষত্র বা গ্যালাক্সি) আর আমাদের চোখের মাঝে তেমন কোন একটা ভারী মহাজাগতিক বস্তু এসে পড়ল। তখন আমরা সরাসরি নক্ষত্র বা গ্যালাক্সিটা কে না দেখে তাদের এক বা একাধিক বিকৃত প্রতিবিম্ব দেখব। এটাই হল মহাকর্ষীয় লেন্স। এখন ঐ মহাজাগতিক বস্তুটি যদি ডার্ক ম্যাটার দিয়ে তৈরী হয় তবে তাকে দেখা যাবে না বটে কিন্তু ভরের জন্য সে যে লেন্স তৈরী করবে তার ফলে অন্য উজ্জ্বল নক্ষত্র বা গ্যালাক্সির প্রতিবিম্ব দেখা যাবে। এইরকম অনেক ডার্ক ম্যাটার দিয়ে তৈরী মহাকর্ষীয় লেন্সের সন্ধান পাওয়া গেছে।

ডার্ক ম্যাটারের অস্তিত্ত্ব যখন সন্দেহাতীত তখন পরের প্রশ্ন হল এর চরিত্র আসলে কি? এই প্রশ্নের উত্তর এখনো পাওয়া না গেলেও এটা নিশ্চিত এরা অন্যান্য সাধারণ পদার্থের সঙ্গে মেলামেশা করে খুব কম। যে মানুষ সবার সঙ্গে মেলামেশা করে তার নাড়ি নক্ষত্র জানা সহজ। কিন্তু যে চুপচাপ একলা থাকে তাকে বোঝা ভারী কঠিন। বস্তুজগতের বেলাতেও একই নিয়ম খাটে। বস্তুজগতে মেলামেশার উপায় হল চার ধরণের বল - মহাকর্ষ (যার জন্য পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘোরে, আপেল মাটিতে পড়ে), তড়িৎচুম্বকীয় (যার কারণে ইলেকট্রন নিউক্লিয়াসের বাঁধনে আটকা পড়ে পরমাণু তৈরী করে, আমরা চোখে দেখি, রেডিও টিভি থেকে শুরু করে ফোন, এসএমএস, ইন্টারনেট এ বার্তা পাঠানো যায়), দৃঢ় (যা পরমাণুর নিউক্লিয়াসে প্রোটন ও নিউট্রনকে আটকে রাখে, পরমাণু শক্তি থেকে বিদ্যুৎ বা বোমা বানানো যায়) এবং মৃদু (যা তেজস্ক্রিয়তার জন্য দায়ী)। এর মধ্যে ডার্ক ম্যাটারের অস্তিত্ব জানা গেছে সাধারণ পদার্থের সাথে মহাকর্ষীয় আকর্ষণের কারণে। নক্ষত্র গুলোতে যে অবিরাম নিউক্লিয় সংযোজন বিক্রিয়া নক্ষত্রের জ্বালানী জোগায়, তা ডার্ক ম্যাটারে ঘটে না। ঘটলে তারা অদৃশ্য থাকত না। এখন নক্ষত্রের জ্বালানী ফুরিয়ে গেলে তারা নিজের মহাকর্ষের টানে চুপসে গিয়ে শ্বেত বামন, নিউট্রন স্টার বা ব্ল্যাক হোলে পরিণত হয়। এই জাতীয় নক্ষত্রের মৃতদেহগুলো সম্ভাব্য ডার্ক ম্যাটার হতে পারে। সেক্ষেত্রে ডার্ক ম্যাটারের উপাদান আমাদের চেনা জানা নিউট্রন, প্রোটনই হতে পারে। কিন্তু বিভিন্ন মহাজাগতিক পর্যবেক্ষণ বলছে এই মহাবিশ্বে ডার্ক ম্যাটারের মোট পরিমাণের মধ্যে এই জাতীয় তারার মৃতদেহ টাইপের প্রোটন-নিউট্রন দিয়ে তৈরী বড় মহাজাগতিক বস্তু খুবই সামান্য। আরেকটা বিকল্প হল ডার্ক ম্যাটার আসলে সম্পূর্ণ অজানা কোন মৌলিক কণা, যারা মহাকর্ষীয় বলে সাড়া দেয় কিন্তু দৃঢ় বা তড়িৎচুম্বকীয় বলে সাড়া দেয় না। মৃদু বলে সাড়া দিতেও পারে। এধরণের কণার নাম দেওয়া হয়েছে উইকলি ইনটারাক্টিং ম্যাসিভ পার্টিকল বা উইম্প। এছাড়া আরেকটা সম্ভাবনার কথাও বলছেন কেউ কেউ। নিউটনের মহাকর্ষের যে নিয়ম সৌরজগতে খাটে, সেই নিয়ম ছায়াপথেও খাটবে তার নিশ্চয়তা কি? এমনিতেই জানা আছে মহাকর্ষীয় বল তীব্র হলে, যেমনটা নিউট্রন স্টার বা ব্ল্যাক হোলের কাছাকাছি হয়, নিউটনের নিয়ম কাজে লাগে না। সেখানে আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদের রাজত্ব। কাজেই হয়ত ছায়াপথের মধ্যে অন্য কোন নিয়ম বা কোন পঞ্চম বল কাজ করছে। আমরা নিউটনের নিয়ম দিয়ে বোঝার চেষ্টা করি বলেই অপ্রত্যাশিত ফল পাই আর ডার্ক ম্যাটারের কল্পনা করি। 

ডার্ক ম্যাটারের চরিত্র স্পষ্টভাবে জানা না গেলেও আধুনিক পর্যবেক্ষণ বলছে মহাবিশ্বের মোট ভরের মাত্র ছ ভাগের একভাগ হল আমাদের চেনাজানা পদার্থের ভর, বাকি পাঁচভাগই ডার্ক ম্যাটার। তাহলেও একদম শুরুতেই যে বলেছিলাম "মহাবিশ্বের মাত্র পাঁচ শতাংশ জানি" - সে হিসেবটা তো মিলছেনা? সেটার জন্য আবার ফিরে যেতে হবে একশ বছর আগে। আইনস্টাইন বাজারে ছেড়েছেন সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ নামে এক বৈপ্লবিক তত্ত্ব, যা মহাকর্ষ সম্পর্কে প্রচলিত নিউটনীয় ধারণার খোলনলচে পালটে দিয়েছে। এই তত্ত্বের সাহায্যে মহাবিশ্বের কার্যকলাপ বোঝার চেষ্টা করতে গিয়ে রুশ গণিতজ্ঞ ফ্রিডম্যান একটা অদ্ভুত ফল পেলেন। মহাবিশ্ব নাকি স্থির নেই, তা ক্রমাগত স্ফীত বা সংকুচিত হচ্ছে। এসব ব্যাপার আইনস্টাইনের মোটেও পছন্দ হল না। নিউটনের তত্ত্বের সীমাবদ্ধতা প্রমাণ করলেও অনাদি অনন্ত কাল ধরে বিরাজমান মহাবিশ্বের ধারণা তখনো তাঁর মাথায়। তিনি নিজের সমীকরণে একটা "মহাকর্ষীয় ধ্রুবক" নামে একটা পদ যোগ করে দিলেন যাতে সমীকরণের সমাধান করে স্থির মহাবিশ্বের ছবি পাওয়া যায়। কিন্ত শাক দিয়ে কি আর মাছ ঢাকা যায়? ১৯২৯ সালে আমেরিকান জ্যোতির্বিদ এডউইন হাবল টেলিস্কোপে চোখ রেখে দেখলেন মহাকাশের সমস্ত গ্যালাক্সি পরস্পরের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে এবং যেকোন দুটো গ্যালাক্সির দূরে সরার বেগ তাদের মধ্যেকার দূরত্বের সমানুপাতিক! এর একটাই অর্থঃ মহাবিশ্ব স্ফীত হচ্ছে। ফ্রিডম্যান সঠিক ছিলেন। ব্যাপারটা বোঝার জন্য একটা বেলুনের গায়ে কয়েকটা ফুটকি দিন। এবার বেলুনটাকে ফুলিয়ে দেখুন, ফুটকি গুলো একে অপরের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। আইনস্টাইন পরে স্বীকার করেছিলেন, তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল ছিল মহাকর্ষীয় ধ্রুবকের আমদানি!

এরপর প্রায় সত্তর বছর ধরে ফ্রিডম্যানের প্রসারমাণ মহাবিশ্বের মডেলের ওপর নানারকম গয়নাগাঁটি পরিয়েই দিব্যি চলছিল আধুনিক বিশ্বতত্ত্ব। যে মডেল অনুযায়ী ১৪শো কোটি বছর আগে আগে এক মহাবিস্ফোরণ বা বিগ ব্যাং -এর মধ্য দিয়ে জন্ম নিয়েছিল আমাদের মহাবিশ্ব আর সেই বিস্ফোরণের ধাক্কাতেই আজো প্রসারিত হয়ে চলেছে মহাবিশ্ব। কিন্তু মহাবিশ্বে ছেয়ে থাকা ভর ও শক্তির (আইনস্টাইনের তত্ত্ব অনুসারে ভর শক্তিরই একটা বিশেষ রূপ) মধ্যাকর্ষণের জন্য এই স্ফীতির হার কমতে বাধ্য। কারণ মহাকর্ষ বল চরিত্রানুসারে আকর্ষণমূলক। যে কারণে একটা ঢিল আকাশে ছুঁড়ে দিলে তার ওপরে ওঠার বেগ ক্রমশ কমতে থাকে আর একটা উচ্চতায় পৌঁছে আবার নীচের দিকে পড়তে শুরু করে, সেই একই কারণে মহাবিশ্বের স্ফীতির হার ক্রমশ কমতে থাকা উচিৎ। কিন্তু নব্বইয়ের দশকের শেষদিকে ব্রায়ান স্মিথ ও অ্যাডাম রিস যৌথভাবে এবং সোল পারমুটার পৃথকভাবে সুপারনোভা, অর্থাৎ মৃত্যুর আগে তারাদের শেষবারের মত জ্বলে ওঠার দৃশ্য, পর্যবেক্ষণ করে জানালেন - মহাবিশ্ব শুধু প্রসারিত হচ্ছে না, প্রসারণের হারও বাড়ছে! এই আবিষ্কারে জন্য ২০১১ সালে পারমুটার, স্মিথ ও রিস নোবেল পুরস্কারে সম্মানিত হন।

এই ক্রমবর্ধমান হারের প্রসারণের জন্য প্রয়োজন এমন পদার্থ বা শক্তি যার মধ্যাকর্ষণ বিকর্ষণমূলক। এই শক্তির নাম দেওয়া হল ডার্ক এনার্জি! ডার্ক, কারণ অন্য কোনভাবে এই শক্তির অস্তিত্ত্ব ধরা পড়ে না। ডার্ক এনার্জির চরিত্র ডার্ক ম্যাটারের মতই বা তার চেয়েও রহস্যজনক! ঋণাত্মক চাপবিশিষ্ট কোন ভুতুরে ফ্লুইড, স্পেসটাইমের নিজস্ব শক্তি বা আইনস্টাইনের সেই ফেলে দেওয়া মহাকর্ষীয় ধ্রুবক -- ডার্ক এনার্জিকে নানা ভাবে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা চলছে। আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদের বাইরে গিয়ে "ঋণাত্মক মহাকর্ষ" পাওয়া যায় কি না সেটাও রয়েছে তাত্ত্বিক পদার্থবিদদের চিন্তার মধ্যে। 
মহাবিশ্বের প্রসারণের হার থেকে জানা গেছে মহাবিশ্বে ভর ও শক্তির মোট পরিমাণের ৬৮ শতাংশই হল ডার্ক এনার্জি আর ২৭ শতাংশ ডার্ক ম্যাটার। তাহলে পড়ে রইল ৫ শতাংশ! আমাদের চেনাজানা পদার্থের অনুপাত এইটুকুই। এককথায় বলা যায় আজকের মহাবিশ্বে অন্ধকারের রাজত্ব চলছে। এই অন্ধকারে আলো ফেলাই এই সময়ে মৌলিক বিজ্ঞানের সামনে অন্যতম চ্যালেঞ্জ।

"জলসিরি" শারদ সংখ্যা ২০১৬ তে প্রকাশিত

Friday, 23 December 2016

ফেলুদার সাথে

সম্ভবতঃ ৯৩ সাল। মা বলল রাজস্থান বেড়াতে যাবে। আমি বায়না ধরলাম আমাকেও নিতে হবে। তখন থ্রি বা ফোর এ পড়ি। অতএব সে বায়না না মেনে উপায় কি! উঠে পড়লাম ট্রেনে। সঙ্গে একটা পাতলা বই - "জয়বাবা ফেলুনাথ"। বইটা ট্রেনেই প্রায় শেষ করে ফেলেছিলাম। সেটা আসলে দাদার বই, ভাইফোঁটায় পাওয়া। সেই প্রথম ফেলুদার সঙ্গে মোলাকাত। তারপর দাদার ফেলুদাগুলো সব নিজের হেফাজতে নিয়ে নিলাম। আর প্রত্যেক বছর বইমেলা থেকে আর কিছু কিনি বা না কিনি ফেলুদা একটা কিনবই। আনেকগুলো অবশ্য কিনতে হয়নি। জন্মদিন, ভাইফোঁটা আরো নানা উপলক্ষ্যে ঠিক হাতে এসে গেছে। নাহ! ঢাউস ফেলুদা সমগ্র আমার নেই। ঐ হার্ডকভার পাতলা বইগুলোই আমার পছন্দ। আজও মাঝে মাঝে যখন এক এক টা বই র‍্যাক থেকে নিয়ে খুলি, হলুদ হয়ে যাওয়া পাতা, ন্যাপথলিনের গন্ধ আর উপহারের পৃষ্ঠায় লেখার সঙ্গে পাক দিয়ে ওঠে সেই উপুর হয়ে শুয়ে ফেলুদা পড়ার দুপুরগুলো, যখন চাকরির দায়িত্ব নেই, সংসারের সমস্যা নেই্‌ এমনকি পড়াশোনার চাপটাও উধাও হয়ে যায় ফেলুদার আঙুলের তুড়িতে।

  


হবে নাই বা কেন! ফেলুদা-ই তো আমার শৈশবের হিরো, কৈশোরের বন্ধু, যৌবনের আইডল। হ্যাঁ কোন রাষ্ট্রনেতা বা অভিনেতা নয়, মনের মণিকোঠায় নায়ক বা আদর্শ যদি কেউ থেকে থাকে সে ছিল ঐ ফেলুদা। আর কে আছে যে স্রেফ মগজাস্ত্রের জোরে দুঁদে বদমাসদের ঘায়েল করতে পারে! ফেলুদার প্রতিভা নিয়ে সন্দেহ নেই, কিন্তু ওর ভিলেনরাও কি কম প্রতিভাবান! লখনৌএর ইতিহাস গুলে খাওয়া বনবিহারী সরকার, ঘড়ি বিশেষজ্ঞ মহাদেব চৌধুরী, অভিনয় আর ছদ্মবেশ ধারণে তুখোড় বিশ্বনাথ মজুমদার, হিপনোটিজমে ওস্তাদ সুনীল তরফদার, ভ্রমণ কাহিনীর সংগ্রাহক অবিনাশ পাকড়াশি - এমন বিচিত্র সব প্রতিভার প্রতিপক্ষ পেতে যেকোন নায়ককে হেদিয়ে যেতে হবে। এই "ভিলেন"দের অনেকের কাছেই কিন্তু অপরাধের মুখ্য মোটিভেশন হল শখ, অর্থলালসা নয়। বনবিহারীবাবু আওড়ঙ্গজেবের আংটি উদ্ধারের জন্য স্পাই লাগিয়েছিলেন কি সেটা বেচে পয়সা কামাবেন বলে? মহাদেব চৌধুরী যে অষ্টাদশ শতকের পেরিগ্যাল রীপিটারের খোঁজে টমাস গডউইনের কবর খোঁড়াখুঁড়ি করেছিলেন তা কি ঘড়িটা পাচার করার জন্য? শম্ভূচরণ বোসের তিব্বত ভ্রমণের পাণ্ডুলিপি হস্তগত করার জন্য কালকা মেলের কামরায় মিস্টার পাকড়াশির বাক্স বদলের নাটকের পেছনে কি শুধুই ঐ বইটা ছাপিয়ে বড়লোক হওয়ার তাড়না ছিল? বরং শয়তানি বুদ্ধিতে এদের থেকে অনেকটা এগিয়ে থাকা মগনলাল মেঘরাজ এই জায়গাতেই পিছিয়ে আছে। ঘোষালবাড়ির গণেশ চুরি করা বা কাঠমাণ্ডুতে জাল ওষুধের ব্যবসা কোন জায়গাতেই তাকে এক অশিক্ষিত বড়লোক ছাড়া অন্য কিছু ভাবা যায়না। লালমোহনবাবুর মত নিরীহ মানুষকে হেনস্তা করার মধ্যে দিয়েও তার মোটা দাগের শয়তানি চরিত্রটাই বেরিয়ে আসে।



এহেন বিচিত্র প্রতিভার অধিকারী ভিলেনদের সঙ্গে মোকাবিলা করতে গেলে ফেলুদাকেও স্রেফ পিস্তল চালানো আর আঙুলের ছাপ বা সিগারেটের টুকরো বিশ্লেষণে কাজ জানলে তো চলবে না! গুরু শার্লক হোমসের মত সে বলতে পারে না, "A fool takes in all the lumber of every sort that he come across, so that the knowledge which might be useful to him gets crowded out, or at best is jumbled up with a lot of other things ... You say that we go round the sun. If we went round the moon it would not make a pennyworth of difference to me or to my work." বরং নানা ধরণের বিষয় নিয়ে তাকে পড়াশোনা করতে হয়। সে ক্রিমিনোলজি হোক কি ম্যাজিক, ক্রিকেট হোক কি রামায়ণ-মহাভারত, কোপার্নিকাসের সৌর তত্ত্ব হোক কি ইউরোপের রেঁনেশাস যুগের শিল্পকলা। এমনকি টেলিপ্যাথি, প্ল্যানচেটের মত বিষয়, যেগুলোর সত্যতা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে, সে সংক্রান্ত বইও সে পড়ে সমান আগ্রহে। তার নিজের কথায়, "আমি যেটা বিশ্বাস করি সেটা হল এই যে, প্রমাণ ছাড়া কোন জিনিস বিশ্বাস বা অবিশ্বাস করা বোকামো। মনটা খোলা না রাখলে যে মানুষকে বোকা বনতে হয় তার প্রমাণ ইতিহাসে অজস্র আছে। এককালে লোকে পৃথিবীটা ফ্ল্যাট বলে মনে করত জানিস? আর ভাবত যে একটা জায়গায় গিয়ে পৃথিবীটা ফুরিয়ে গেছে, যার পর আর যাওয়া যায় না। কিন্তু ভূপর্যটক ম্যাগেলান যখন এক জায়গা থেকে রওনা হয়ে ভূপ্রদক্ষিণ করে আবার সেই জায়গাতেই ফিরে এলেন, তখন ফ্ল্যাটওয়ালারা সব মাথা চুলকোতে লাগলেন ..."

শুধু বই পড়ে জ্ঞান আহরণ নয়, ফেলুদা চষে বেড়িয়েছে গোটা ভারতবর্ষ। রহস্য সমাধানের তাগিদে ছুটে গেছে কাঠমাণ্ডু, হংকং, লণ্ডন। কিন্তু দিনের শেষে সে একজন মধ্যবিত্ত বাঙালী। গোয়েন্দা হিসেবে পসার জমিয়েও কাকার বাড়িতেই থেকে যায়। রজনী সেন রোডের ফ্ল্যাট ছেড়ে নিজের ফ্ল্যাটে যাওয়ার কথা চিন্তা করলেও কাকার এক ধমকেই ঠাণ্ডা হয়ে যায়। গাড়ি কেনা বা সেক্রেটারি রাখার প্রয়োজন বোধ করে না। বড়দের দেখলেই সিগারেট পেছনে লুকিয়ে ফেলে। বাঙালীয়ানা ফেলুদার মজ্জায়। লালমোহনবাবু "ভূশণ্ডির মাঠ" এর নদু মল্লিকের চরিত্রে অভিনয় করেছেন শুনে অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে। রাজশেখর নিয়োগীর খাওয়া দেখেই ধরে ফেলতে পারে সে বাংলার বাইরে মানুষ! ছাপোষা বইয়ের দোকানি সুধীর ধর থেকে ধনী ব্যবসায়ী দীননাথ লাহিড়ী - সবার সঙ্গেই একইরকমভাবে কথা বলে যামিনী রায়ের আঁকা ছবির সামনে রঙিণ মাছের অ্যাকুয়ারিয়ামের পাশে সোফায় বসে। সে নিজে সংসার করেনি বটে কিন্তু তোপসে আর লালমোহনবাবুর সঙ্গে আসমবয়সী বন্ধুত্বের টান কোন পরিবারের চেয়ে কম নয়। তোপসের মত ভাই আর লালমোহনবাবুর মত বন্ধু যে এজগতে সহজে মেলে না সেটা ফেলুদা ছাড়া কে-ই বা জানে!

তবে বাঙালী মধ্যবিত্তের সব বৈশিষ্ট্যই তার আছে তা নয়। সকালে সে ল্যাদ না খেয়ে যোগব্যায়াম করে, ভাট দিয়ে সময় নষ্ট করে না, পাংচুয়ালিটির পান থেকে চুন খসলে বিরক্ত হয়। মনে প্রাণে বাঙালী বলেই বাঙলার ঐতিহ্যকে যখন বাঙালীরাই ধ্বংস করতে থাকে তখন তার আক্ষেপের শেষ থাকে না। তোপসে কে বলেছিল, "দিল্লী আগ্রার তুলনায় কলকাতা খোকা শহর হলেও এটাকে উড়িয়ে দেওয়া মোটেই ঠিক নয়। এখানে তাজমহল নেই, কুতুব মিনার নেই, যোধপুর-জয়শলমীরের মত কেল্লা নেই, বিশ্বনাথের গলি নেই - এসবই ঠিক। কিন্তু ভেবে দেখ তোপসে - একটা সাহেব মশা মাছি সাপ ব্যাঙ বন-বাদাড়ে ভরা মাঠের এক প্রান্তে গঙ্গার ধারে বসে ভাবল এখানে সে কুঠির পত্তন করবে, আর দেখতে দেখতে বনবাদাড় সাফ হয়ে গিয়ে সেখানে দালান উঠল, রাস্তা হল, রাস্তার ধারে লাইন করে গ্যাসের বাতি বসল, সেই রাস্তায় ঘোড়া ছুটল, পালকি ছুটল, আর একশো বছর যেতে না যেতে গড়ে উঠল এমন একটা শহর যার নাম হয়ে গেল সিটি অফ প্যালেসেজ। এখন সে শহরের কি ছিরি হয়েছে সেটা কথা নয়; আমি বলছি ইতিহাসের কথা। শহরের রাস্তার নাম পালটে এরা সেই ইতিহাসকে মুছে ফেলতে চাইছে ..."

শুধুমাত্র পাণ্ডিত্য আর মগজাস্ত্র নয়, নায়কের শিরদাঁড়াটাও গড়পরতা মানুষের চেয়ে শক্ত হবে, তার নৈতিক মূল্যবোধ স্ফটিকের মত স্বচ্ছ হবে এ প্রত্যাশাও অনুচিৎ নয়। ফেলুদাকে দেখেছি মগনলালের দেওয়া টাকার বাণ্ডিল ছুঁড়ে ফেলে জবাব দিতে "বিনা পরিশ্রমে আমি পারিশ্রমিক নিই না মিস্টার মেঘরাজ!" দেখেছি অর্থপ্রাপ্তির সম্ভাবনা নেই জেনেও একটা বাচ্ছা ছেলের জীবন বাঁচাতে নিজের খরচায় রাজস্থান ছুটতে। দেখেছি "খুনির হাত থেকে উপহার নেওয়ার বাসনা নেই" বলে অপরাধবিজ্ঞানের ওপর লোভনীয় বই ফেরৎ দিয়ে আসতে। "কৈলাসে কেলেঙ্কারি"তে সিধুজ্যাঠা তদন্তের খরচ দেওয়ার প্রস্তাব দিলে ফেলুদা ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে বলেছিলঃ "প্রস্তাবটা আপনার কাছ থেকে এসেছে ঠিকই, কিন্তু আমি যদি নিজে এ ব্যাপারে উৎসাহ বোধ না করতাম তাহলে এগোতাম না। ... দেশের মন্দিরের গা থেকে মূর্তি ভেঙে নিয়ে যারা বিদেশীদের বিক্রি করে, তাদের অপরাধের কোন ক্ষমা নেই।" "গোরস্থানে সাবধান"এ ফেলুদার মক্কেল কে ছিল? অষ্টাদশ শতকে কবরের তলায় চলে যাওয়া টমাস গডউইন? কিসের আশায় পেরিগ্যাল রীপিটারকে বাঁচানোর জন্য ফেলুদা বনের মোষ থুরি গোরস্থানে মশা তাড়াতে গেছিল?

অবশ্য ক্রমশঃ বোঝা গেছে ফেলুদা কোন সুপারম্যান নয়, আমাদের মতই দোষগুণে মেশানো রক্তমাংসের মানুষ। যত ফেলুদার বয়স বাড়তে থাকে তার মগজাস্ত্রের ধার কমতে শুরু করে। ছিঁচকে অপরাধীদের বিরুদ্ধে মামুলি তদন্ত করে সাফল্য পায় বটে কিন্তু বনবিহারী সরকার বা মহাদেব চৌধুরীর মত প্রতিভাবান প্রতিদ্বন্দীদের আর দেখা মেলে না।

"জয়বাবা ফেলুনাথ" বা "যত কাণ্ড কাঠমাণ্ডুতে" যে মগনলালকে ফাঁদে ফেলে নাস্তানাবুদ করেছিল ফেলুদা সেই মগনলালের ডেরা থেকে গোলাপি মুক্তো উদ্ধার করতে গিয়ে তাকে রাইভ্যাল গ্যাঙের আন্টিস্যোশালদের সাহায্য নিতে হয়। যে ফেলুদা "গোঁসাইপুর সরগরম"এ আত্মারামের আত্মা নামানোর জোচ্চুরি ফাঁস করে দিয়েছিল, সেই ফেলুদা "ভূস্বর্গ ভয়ংকর"এ ডাঃ মজুমদারের প্ল্যানচেটের বুজরুকি নিয়ে কিছুই বলে না। এমন কি নিজের ওপর দুবার হামলা কে চালিয়েছিল তাকেও ধরতে পারে না। তাই "নয়ন রহস্য"তে দেখি ফেলুদার গল্পের পাঠকরা দলে দলে চিঠি লিখে অভিযোগ করছে, "ফেলু মিত্তিরের মামলা আর তেমন জমাটি হচ্ছে না, জটায়ু আর তেমন হাসাতে পারছেন না, তপেশের বিবরণ বিবর্ণ হয়ে আসছে..."। আর এই চিঠির ধাক্কাতেই ফেলুদা ঠিক সাধারণ লোকের মতই লালমোহনবাবুর ভাষায় হতোদ্যম, বিষণ্ণ, বিমর্ষ, নিস্তেজ, নিস্প্রভ এমনকি মেদামারা হয়ে পড়ে। সবচেয়ে বেদনাদায়ক যেটা সেটা হল অফিসের বড়বাবুর মতই ফেলুদা এর দায়টা নিজের ঘাড় থেকে সরিয়ে ফেলতে চেয়ে বলে, তোপসে প্রকাশকদের চাপে বিভ্রান্ত হয়ে পড়াতেই না কি এই কাণ্ড!

ফেলুদার আর যে জিনিসটা খারাপ লাগে তা হল মেয়েদের সে একেবারে কাছে ঘেঁষতে দেয় না। তার বেশিরভাগ মক্কেল হয় বিপত্নীক, নয় অকৃতদার। স্রষ্টা যুক্তি দেবেন, ফেলুদার গল্পগুলো ছোটদের জন্য লেখা। এখানে প্রেম বা যৌনতাকে ঠাঁই দেওয়া যায় না। কিন্তু প্রেম বা যৌনতা ছাড়া কি নারীচরিত্র থাকতে পারে না? ফেলুদা মনকে খোলা রাখতে বলেছিল, কিন্তু তার স্রষ্টা কি মেয়েদের সম্পর্কে সমাজের টিপিকাল মানসিকতার ফাঁদেই পড়লেন না?

অবশ্য এইসবে ফেলুদার নায়কত্বে কালি পড়েনি। অনুসরণ তো মানুষকেই করা যায়, শয়তান বা ভগবান কে তো নয়! ফেলুদার সঙ্গে প্রথম মোলাকাৎ হয়েছিল "সোনার কেল্লা"র দেশে বেড়াতে গিয়ে। আর ফেলুদার সঙ্গে বেড়ানোর সম্পর্ক আলাদা করে বলার কিছু নেই। তোপসে শুনলে বলত টেলিপ্যাথি! যদিও তোপসেকে ও একবার বলেছিল, "দেখিস ফেলুদার গল্প যেন ট্যুরিস্ট গাইডবুক না হয়ে যায়!" তবু বেড়াতে যাওয়ার আগে সেখানকার পটভূ্মিতে ফেলুদার কোন গল্প থাকলে চোখ বুলিয়ে নিতে ভুলি না। ফেলুদা কে দেখেছি কোথাও যাওয়ার আগে সিধুজ্যাঠার কাছ থেকে সেই জায়গা সম্পর্কিত বইপত্র এনে পড়াশোনা করে নেয়। আমার কোন সিধুজ্যাঠা নেই, তবে গুগলজ্যাঠা আছে। তাই তার সাহায্যেই বেড়ানোর জায়গাটার ইতিহাস ভূগোল সম্পর্কে ঘাঁটাঘাঁটি করে নিই। "বোম্বাইয়ের বোম্বেটে" তে তোপসে বলেছিল, "পায়ে হেঁটে ঘুরে না দেখলে নতুন শহর দেখা হয়না এটা আমরা তিনজনেই বিশ্বাস করি।" সেই মুম্বাইতে হেঁটে বেড়াতে গিয়ে কি বিপত্তিতে পড়েছিলাম তা আগে একবার বলেছি। ফিরে আসি সেই রাজস্থান ভ্রমণের কথায়। আমরা যখন ফিরছি সেদিন কলকাতা থেকে পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ দেখা গিয়েছিল। আমরা অবশ্য দেখেছিলাম ট্রেনের জানলা দিয়ে। সোনার কেল্লাতেই ফেলুদা বলছিল না, "সৌরজগতের গ্রহগুলোই আবার সূর্যকে প্রদক্ষিণ করছে এলিপটিক কার্ভে!" এভাবে প্রদক্ষিণ করতে করতে যখন সূর্য আর পৃথিবীর ঠিক মাঝখানে চাঁদ একই সরলরেখায় চলে আসে তখনই তো সূর্যগ্রহণ হয়। ... " এখানেও জিওমেট্রি ... সমস্ত জীবনটাই জিওমেট্রি!"


ছবি সৌজন্যেঃ "ফেলুদা ইলাস্ট্রেশন অ্যালবাম", সন্দেশ, অগ্রহায়ণ ১৪০২ - অগ্রহায়ণ ১৪০৩

চারদিকে গোল উঠেছে শুনছি, ফেলুদার নাকি ৫০ বছর পূর্ণ হল। কথাটায় একটু ভুল আছে। ফেলুদার প্রথম অ্যাডভেঞ্চার "ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি" ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছিল সন্দেশে, ১৯৭২ সালের অগ্রহায়ণ, পৌষ ও মাঘ সংখ্যায়। অর্থাৎ ১৯৬৫ সালের ডিসেম্বর এবং ১৯৬৬ সালের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি সংখ্যায়। সেই হিসেবে এবছর ফেলুদা ৫১ পূর্ণ করে ৫২য় পা দিল। কিন্তু তাতে কী? "যাহা বাহান্ন তাহাই যদি তিপ্পান্ন হয়" তবে "যাহা একান্ন তাহা পঞ্চাশ হবে না কেন?"

প্রথম প্রকাশঃ চর্যাপদ

Tuesday, 6 December 2016

সাহারায় শিহরণ

সাইনা এন সি -- ৫ কোটি (১০/৯/১৩ ও ২৪/১/১৪)
সি এম দিল্লী -- ১ কোটি (২৩/৯/১৩)
সি এম মধ্যপ্রদেশ -- ১০ কোটি (২৯/৯/১৩ ও ১/১০/১৩)
সি এম ছত্তিশগড় -- ৪ কোটি (১/১০/১৩)
সি এম গুজরাত -- ১৫.১ কোটি (৩০/১০/১৩ - ২৯/১১/১৩)
আমেদাবাদ মোদিজি - ৩৫.১ কোটি (৩০/১০/১৩ - ২২/২/১৪)
আমেদাবাদ মোদি - ৫ কোটি (২৮/১/১৪)

ওপরের নাম আর সংখ্যাগুলো সুব্রত রায়ের সাহারা গ্রুপের দিল্লীর বিভিন্ন অফিস থেকে উদ্ধার করা কাগজপত্রে পাওয়া গেছে। ২০১৪র নভেম্বরে আয়কর দপ্তর আর সিবিআই এর যৌথ তল্লাশী অভিযানে এই কাগজগুলো উদ্ধার করা হয়েছিল। বন্ধনীর তারিখগুলো নির্দেশ করছে কোন সময়ে ঐ অঙ্কের নগদ টাকা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দেওয়া হয়েছিল। শুধু তাই নয়, সাহারা গ্রুপের তরফে যারা যারা এই টাকা গুলো পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব নিয়েছিল তাদের নামও লেখা রয়েছে এই সব কাগজে। সি এম বলতে যদি চিফ মিনিস্টার বোঝায় তবে বলতে হবে দেশের নামজাদা কয়েকজন রাজনীতিককে সাহারা গোষ্ঠী মোটা অঙ্কের ঘুষ দিয়েছিল এমন ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। অথচ এনিয়ে কোনরকম তদন্ত না করে কাগজগুলো আয়কর দপ্তরের হিমঘরে পাঠিয়ে দেয় সিবিআই। সম্প্রতি এই নথিপত্রগুলোর ফটোকপি ফাঁস হয়ে যাওয়ায় এবং আইনজীবি প্রশান্ত ভূষণ বিষয় টা নিয়ে সিবিআই, এনফোর্সমেন্ট ডাইরেক্টরেট, ভিজিল্যান্স কমিশন ইত্যাদি সংস্থার কাছে চিঠি দেওয়ায় এবং "কমন কজ" একটা এনজিও ভিজিল্যান্স কমিশন নিয়োগ সংক্রান্ত অনিয়মের বিরুদ্ধে রিট পিটিশনে এই নথিপত্রগুলো দাখিল করায় ব্যাপারটা সামনে এসেছে। "ইকনমিক অ্যান্ড পলিটিকাল উইকলি"র তরফ থেকে বিজেপির মহারাষ্ট্র শাখার কোষাধ্যক্ষ সাইনা এন সি, দিল্লীর তদনীন্তন মুখ্যমন্ত্রী শীলা দীক্ষিত, মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ সিং চৌহান, ছত্তিশগড়ের মুখ্যমন্ত্রী রামন সিং এবং গুজরাতের তদনীন্তন মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে ই-মেইল করা হলে তাঁরা কোন জবাব দেননি। আয়কর দপ্তরের যে আধিকারিক নথিগুলো উদ্ধার করেছিলেন, সেই অঙ্কিতা পাণ্ডে জানিয়েছেন তিনি এখন ছুটিতে আছেন এবং এবিষয়ে কথা বলার এক্তিয়ার তাঁর নেই।

অরবিন্দ কেজরিওয়াল অভিযোগ করেছেন, গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন নরেন্দ্র মোদি সাহারা গ্রুপের কাছ থেকে ৫৫ কোটি টাকা ঘুষ নিয়েছিলেন। কারণ উপরোক্ত নথি থেকে "সিএম গুজরাত", "আমেদাবাদ মোদিজি" এবং "আমেদাবাদ মোদি"কে প্রদত্ত অর্থের পরিমাণ যোগ করলে পাওয়া যায় ৫৫.২ কোটি। এখন ঐ তিনজন একই ব্যক্তি নাও হতে পারে। আমেদাবাদে মোদি পদবিধারী অসংখ্য ব্যক্তি আছেন। এমন কি "সিএম" চিফ মিনিস্টার না হয়ে "Alkalies and Chemicals"ও হতে পারে! ২০১৩ সালের অক্টোবরে সিবিআই আদিত্য বিড়লা গ্রুপের হিন্ডালকো ইন্ডাস্ট্রীজের দিল্লী, সেকেন্দ্রাবাদ, মুম্বাই ও ভুবনেশ্বর অফিসে অনুরূপ তল্লাশি চালায়। সেখানে আদিত্য বিড়লা গ্রুপের কার্যনির্বাহী চেয়ারম্যান শুভেন্দু অমিতাভের ল্যাপটপ থেকে একটা রহস্যজনক ই-মেইল উদ্ধার করা হয়। ১৬ই নভেম্বর ২০১২-র ঐ ইমেলে লেখা ছিল "Gujarat CM - 25 cr (12 done - rest?)"। অমিতাভকে এ নিয়ে জেরা করা হলে তিনি জানান, Gujarat CM মানে "Gujarat Alkalies and Chemicals" (Gujrat এর G, Chemicals এর C, Alkalies এর M, সুকুমারের জয় হোক!)। 

একটা প্রশ্ন উঠতেই পারে যে এই কাগজপত্রগুলোর বিশ্বাসযোগ্যতা কতটা? আয়কর দপ্তর বা বিজেপি সরকার কেউই কিন্তু এগুলোর অস্তিত্ব অস্বীকার করেনি। প্রধানমন্ত্রী যথারীতি মৌনেন্দ্র অবতার ধারণ করেছেন। দিল্লীর ফরেনসিক ল্যাবোরেটরি উদ্ধার করা নথিগুলোর তলায় আয়কর দপ্তরের অফিসার অঙ্কিতা পাণ্ডের সইকে আসল বলে জানিয়েছে। শোনা যাচ্ছে ব্যাপারটার একটা ব্যাখ্যা সরকার ইতিমধ্যে তৈরী করেছে। সেটা হল, সাহারা গোষ্ঠীর কোন ক্ষুব্ধ কর্মী সুব্রত রায়কে ব্ল্যাকমেল করার জন্য এই জাল নথিগুলো বানিয়েছে। 

জৈন হাওয়ালা কেসে সুপ্রিম কোর্ট নির্দেশ দিয়ে ছিল, কোন সরকারি কর্মকর্তার বেআইনী অর্থপ্রাপ্তির অভিযোগ পাওয়া গেলে তার স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ তদন্ত করতে হবে। তা কি হবে? ব্যাপম খ্যাত শিবরাজ সিং চৌহান, ললিত মোদিকে পালাতে সাহায্য করা সুষমা স্বরাজ স্বপদে বহাল। সরকারি ব্যাঙ্কগুলো বিজয় মালিয়ার ১২০০ কোটি টাকার লোন উদ্ধার করা যাবে না বলে হাত ধুয়ে ফেলেছে। কেজরিওয়াল যাঁকে সঙ্গে নিয়ে ভ্রষ্টাচার বিরোধী জিহাদে নেমেছেন সেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দলের নেতা মন্ত্রীদের লাখ লাখ টাকার বাণ্ডিল নেওয়া র ভিডিও নারদ চ্যানেল দেখালেও কেন্দ্রীয় সরকার ওদের টিকি ছোঁয়নি। সারদা কাণ্ডের তদন্তও কার্যত বন্ধ। এই অবস্থায় শীর্ষ আদালতের নির্দেশিকা মেনে "সাহারা পেপার্স" নিয়ে কোন স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ তদন্ত হবে এ আশা না করাই ভালো। 

Paranjoy Guha Thakurta, Economic and Political WeeklyVol. 51, Issue No. 47, 19 Nov, 2016

Tuesday, 8 November 2016

দেশপ্রেমিক

জন্মেজয় কহিলেন, - হে মহর্ষে, আপনি বলিতেছিলেন কলিযুগে দেশপ্রেমিক নামক একজাতীয় মনুষ্যপ্রজাতির আবির্ভাব ঘটিবে। তাঁহারা কি প্রকার মনুষ্য হইবেন, এই ধরাধামে আবির্ভূত হইয়া তাঁহারা কি প্রকার কার্য করিবেন তাহা জানিবার বড় কোতূহল হইতেছে।

বৈশম্পায়ন কহিলেন, - হে রাজন, সেই বিচিত্রবুদ্ধি, সর্বববিদ্যা বিশারদ দেশপ্রেমিকগণ অতীব আশ্চর্য জীব হইবে। আমি সেই বাকপটু, বহুরূপধারী, হাফপ্যান্ট পরিহিত দেশপ্রেমিকদিগের কাহিনী বর্ণন করিতেছি, আপনি শ্রবণ করুন। যাঁহারা গরুকে মাতা, সাভারকরকে পিতা এবং মমতা ব্যানার্জীকে ভগিনী মানিবেন তাঁহারাই দেশপ্রেমিক। যাঁহারা মুসলমানের নিকট শার্দুল, হিন্দুর নিকট শাখামৃগ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিকট সারমেয়, তাঁহারাই দেশপ্রেমিক। যাঁহারা বকরি ঈদের সময় পশুপ্রেমিক, আজানের সময় পরিবেশ প্রেমিক এবং কালীপুজোর সময় উৎসবপ্রেমিক হইতে সক্ষম, তাঁহারাই প্রকৃত দেশপ্রেমিক হইবেন।

দেশের প্রতি ভালবাসা ইহাঁদের উর্বর মস্তিস্কে সদা জাগরূক থাকিবে। ইঁহারা চীনদেশে নির্মিত চলমান দূরভাষ যন্ত্রের মাধ্যমে চীনদেশীয় পণ্য বয়কটের আহ্বান জানাইবেন। ইঁহারা পাকিস্তানের চরদিগকে আপন সৈন্যঘাঁটি ঘুরাইয়া দেখাইবেন এবং সেই সৈন্যঘাঁটির চিত্র প্রদর্শনের অপরাধে দেশীয় সংবাদমাধ্যমকে নিষিদ্ধ করিবেন। ইঁহাদের দলপতি শত্রুরাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর জন্মদিবসে আলিঙ্গন করিতে যাইবেন এবং সেই রাষ্ট্রের শিল্পীকে চলচিত্রে লইবার জন্য পরিচালকের নিকট তোলা আদায় করিবেন। ইঁহারা কাশ্মীর ভূখণ্ডকে ভারতবর্ষের "অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ" বলিবেন এবং সেই ভূখণ্ডের আধিবাসীদিগের জীবন নরক করিয়া তুলিবেন। ইঁহারা ভারতবর্ষীয় সৈন্যদিগের জয়ধ্বনিতে গগন বিদীর্ণ করিবেন এবং আত্মঘাতী সৈন্যকে মানসিক ভারসাম্যহীন বলিয়া গাল দিবেন।

ইঁহারা ট্রল করিতে, ফটোশপ বানাইতে, গুজব রটাইতে এবং দাঙ্গা বাঁধাইতে যারপরনাই দক্ষতা অর্জন করিবেন। ইঁহারা ছাত্রকে অপহরণ করিবেন, দলিতকে প্রহার করিবেন, বুদ্ধিজীবির গলা কাটিবেন এবং খ্রিস্টান যাজককে জীবন্ত দগ্ধ করিবেন। ইঁহারা নিজরাষ্ট্রের সংখ্যালঘুকে সবক শেখাইবেন এবং প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সংখ্যালঘুর জন্য অশ্রু বর্জন করিবেন। নারীজাতির সন্মানরক্ষার্থে ইঁহারা রাত্রির নিদ্রা ত্যাগ করিবেন। ইঁহারা গোহন্তক যবন কিশোরীদিগকে ধর্ষণ করিবেন, আদিবাসী মহিলাদিগের স্তন মন্থন করিয়া মাওবাদীত্ব পরীক্ষা করিবেন, মহিলা মানবাধিকার কর্মীর যৌনাঙ্গে প্রস্তরখণ্ড গুঁজিয়া দিবেন এবং মুসলমান নারীদিগের পুরুষতন্ত্র বিরোধী লড়াইয়ে সংহতি জানাইয়া ফেসবুকে পোস্ট করিবেন।

মহারাজ, আমি যাঁহাদিগের কথা বলিলাম তাঁহাদিগের এরূপ বিশ্বাস জন্মিবে যে, বিধর্মীদের বিতাড়ন করিয়া, সাংবাদিককুলকে সন্ত্রস্ত করিয়া, বামাচারীদের নির্মূল করিয়া তাঁহারা ভারতবর্ষের বক্ষে হিন্দুরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করিতে সমর্থ হইবেন।

জনমেজয় কহিলেন, দেশপ্রেমিকদের জয় হউক। হে মুনিপ্রবর, আপনি অন্য প্রসঙ্গ আরম্ভ করুন।

Tuesday, 1 November 2016

ল য ব র হ

মনটা খারাপ ছিল বলে মাঠের ধারে বসে ছিলাম৷ বেজায় গরম। গাছতলায় দিব্যি ছায়ার মধ্যে চুপচাপ শুয়ে আছি, তবু ঘেমে অস্থির। ঘাসের উপর গামছাটা ছিল, ঘাম মুছবার জন্য যেই সেটা তুলতে গিয়েছি অমনি গামছাটা বলল, “হাম্বাআআ!” কি আপদ! গামছাটা হাম্বা করে কেন?
চেয়ে দেখি গামছা তো আর গামছা নেই, দিব্যি মোটা-সোটা সাদা ধপধপে একটা গরু গলা ফুলিয়ে প্যাট্‌প্যাট্‌ করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।

আমি বললাম, “কি মুশকিল! ছিল গামছা, হয়ে গেল একটা গরু৷”
অমনি গরুটা বলে উঠল, “মুশকিল আবার কি? ছিল কট্টর সিপিএম, হয়ে গেল তিলক কাটা তৃণমূল। এ তো হামেশাই হচ্ছে।”
আমি খানিক ভেবে বললাম, “তা হলে তোমায় এখন কি বলে ডাকব? তুমি তো সত্যিকারের গরু নও, আসলে তুমি হচ্ছ গামছা।”
গরু বলল, “গরুও বলতে পার, গামছাও বলতে পার, আবার চাড্ডিও বলতে পার।”
আমি বললাম, “চাড্ডি কেন?”
শুনে গরুটা “তাও জানো না?” বলে শিং নেড়ে ‌খ্যাঁক খ্যাঁক করে বিশ্রীরকম হাসতে লাগল। আমি ভারি অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম। মনে হল, ঐ চাড্ডির কথাটা নিশ্চয় আমার বোঝা উচিত ছিল। তাই থতমত খেয়ে তাড়াতাড়ি বলে ফেললাম, “ও হ্যাঁ-হ্যাঁ, বুঝতে পেরেছি।”
গরুটা খুশি হয়ে বলল, “হ্যাঁ, এ তো বোঝাই যাচ্ছে—চাড্ডির চা, গামছার ম, গরুর চ-এ আকার—হল চামচা। কেমন, হল তো?”

আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না, কিন্তু পাছে গরুটা আবার সেইরকম বিশ্রী করে হেসে ওঠে, তাই সঙ্গে সঙ্গে হুঁ-হুঁ করে গেলাম। তার পর গরুটা খানিকক্ষণ আকাশের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ বলল, "ভালো না লাগে তো আচ্ছে দিন আনলেই পারো৷"

আমি বললাম, “বলা ভারি সহজ, কিন্তু বললেই তো আর আনা যায় না?”
গরু বলল, “কেন? সে আর মুশকিল কি?”
আমি বললাম, “কি করে আনতে হয় তুমি জানো?”
গরু এক গাল হেসে বলল, “তা আর জানি নে? গোমাতা, স্বচ্ছ ভারত, সার্জিকাল স্ট্রাইক, আচ্ছে দিন, ব্যাস্! সোজা মন্তর, আওড়ালেই হল৷”
আমি বললাম, “তা হলে মন্তরটা আমায় বাতলে দিতে পার?”
শুনে গরুটা হঠাৎ কেমন গম্ভীর হয়ে গেল। তার পর মাথা নেড়ে বলল, “উঁহু, সে আমার কর্ম নয়। আমার ফেকুদাদা যদি থাকত, তা হলে সে ঠিক-ঠিক বলতে পারত।”
আমি বললাম, “ফেকুদাদা কে? তিনি থাকেন কোথায়?”
গরু বলল, “ফেকুদাদা আবার কোথায় থাকবে? টিভির পর্দায় থাকে।” আমি বললাম, “কোথায় গেলে তার সঙ্গে দেখা হয়?”
গরুটা খুব জোরে মাথা নেড়ে বলল, “সেটি হচ্ছে না, সে হবার জো নেই।”
আমি বললাম, “কিরকম?”

গরুটা বলল, “সে কিরকম জানো? মনে কর, তুমি যখন যাবে বেজিংএ তার সঙ্গে দেখা করতে, তখন তিনি থাকবেন ন্যুইয়র্ক। যদি ন্যুইয়র্ক যাও, তা হলে শুনবে তিনি আছেন প্যারিসে। আবার সেখানে গেলে দেখবে তিনি গেছেন ইসলামাবাদ। কিছুতেই দেখা হবার জো নেই।”

আমি বললাম, “তা হলে তোমরা কি করে দেখা কর?”
গরু বলল, “সে অনেক হাঙ্গাম। আগে হিসেব করে দেখতে হবে, দাদা কোথায় কোথায় নেই , তার পর হিসেব করে দেখতে হবে, দাদা, কোথায় কোথায় থাকতে পারে, তার পর দেখতে হবে, দাদা এখন কোথায় আছে। তার পর দেখতে হবে, সেই হিসেব মতো যখন সেখানে গিয়ে পৌঁছবে, তখন দাদা কোথায় থাকবে। তার পর দেখতে হবে—”

আমি তাড়াতাড়ি বাধা দিয়ে বললাম, “সে কিরকম হিসেব?”
গরু বলল, “সে ভারি শক্ত। দেখবে কিরকম?” এই বলে সে একটা কাঠি দিয়ে ঘাসের উপর লম্বা আঁচড় কেটে বলল, “এই মনে কর ফেকুদাদা।” বলেই খানিকক্ষণ গম্ভীর হয়ে চুপ করে বসে রইল।
তার পর আবার ঠিক তেমনি একটা আঁচড় কেটে বলল, “এই মনে কর তুমি,” বলে আবার ঘাড় বাঁকিয়ে চুপ করে রইল।
তার পর হঠাৎ আবার একটা আঁচড় কেটে বলল, “এই মনে কর রোহিত ভেমুলা।” এমনি করে খানিকক্ষণ কি ভাবে আর একটা করে লম্বা আঁচড় কাটে, আর বলে, “এই মনে কর ২০০ টাকায় অড়হড় ডাল বিক্রী হচ্ছে—” “এই মনে কর আখলাকের খুনির লাশে জড়ানো তেরঙ্গা—” “এই মনে কর জেএনইউ এর ছাত্র নাজিবকে গুম করা হচ্ছে—”

এইরকম শুনতে-শুনতে শেষটায় আমার কেমন রাগ ধরে গেল। আমি বললাম, “দূর ছাই! কি সব আবোল তাবোল বকছে, একটুও ভালো লাগে না।”
গরু বলল, “আচ্ছা, তা হলে আর একটু সহজ করে বলছি। চোখ বোজ, আমি যা বলব, মনে মনে তার হিসেব কর।” আমি চোখ বুজলাম।
চোখ বুজেই আছি, বুজেই আছি, গরুটার আর কোনো সাড়া-শব্দ নেই। হঠাৎ কেমন সন্দেহ হল, চোখে চেয়ে দেখি গরুটা ল্যাজ খাড়া করে বাগানের বেড়া ভেঙে পালাচ্ছে আর ক্ৰমাগত খ্যাঁকখ্যাঁক‌ করে হাসছে।
........
হ্যাপি বার্থডে প্রফেট সুকুমার!
.........