Monday, 14 August 2017

মুক্তা কুমার, ছোট্ট পত্রিকা এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী

দিদা বেঁচে থাকলে আজ তাঁর বয়স হত একশো বছর। বাবার মা কে ঠাকুমা বলারই চল আছে। কেন জানি না আমি আর দাদা দুজনেই তাঁকে দিদা বলেই ডাকতাম। দাদু যখন মারা যান তখন আমার বয়স মেরেকেটে নয়। তাছাড়া শেষ কয়েকটা বছর তিনি ভীষণ অসুস্থ আর শয্যাশায়ী ছিলেন। কাজেই দাদুর স্মৃতি আমার কাছে খুব একটা নেই। কিন্তু ছোটবেলার অনেকটাই কেটেছে দিদার স্নেহচ্ছায়ায়। বাবা মা দুজনেই স্কুলে চাকরি করতেন। ফাইভ অবধি সকালের স্কুল করে এসে তো দিদার কাছেই থাকতাম। তখন মোড়ে মোড়ে মিষ্টির দোকান গজিয়ে ওঠেনি। দুপুর বেলায় রাস্তা থেকে হাঁক শোনা যেতঃ খাবাআআআর। আর শুনেই একদৌড়ে দরজার বাইরে। বৃদ্ধ ফেরিওয়ালা মাথার ঝাঁকা সামনের রোয়াকে নামাতেন আর তার মধ্যে থেকে বেরতো মেঠাই, সন্দেশ, গজা, নিমকি ... আরো কত কি। দিদা আঁচলের গিঁট খুলে পয়সা বের করার আগেই তার বেশ কয়েকটা চালান হয়ে যেত আমার মুখে। তখনো অবশ্য জানতাম না দিদা কতটা বড় মাপের মানুষ। তবে বাড়িতে লোকজনের আনাগোনা লেগেই থাকত। দূর দূরান্ত থেকে আত্মীয়স্বজনরা যেমন আসতেন তেমনি আসতেন এলাকার নানা মানুষ, দল ও মহিলা সমিতির কর্মীরা। আজও লোকে আমায় চেনে "দয়াল মাস্টার" আর "মুক্তাকাকিমার নাতি হিসেবেই"। 

দিদার জন্ম ১৯১৭ সালের ভাদ্রমাসে, বর্ধমানের একটা সম্পন্ন পরিবারে। তখন তাঁর নাম ছিল হরিমতী। দাদাদের থেকেই স্বদেশী হাওয়ায় প্রভাবিত হয়েছিলেন। মাত্র ১১ বছর বয়সে দয়াল কুমারের সঙ্গে বিয়ে হয়। "মুক্তা" নামটা দাদুই দিয়েছিলেন। তারপর, দিদার নিজেরই কথায়, দেশপ্রেমের আবেগকে শ্রেণিচেতনার আবেগে সেঁকে নেওয়া, দাদুর প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে নেমে, দ্রোহমূলক গান কবিতা লিখে রাজরোষে পড়ে প্রথমে ব্রিটিশ তারপর স্বাধীন ভারতের কারাগারে অন্তরীণ হওয়া। দিদার যুদ্ধ, দাঙ্গা, মহামারীর সময় মহিলা আত্মরক্ষা সমিতির মাধ্যমে ত্রাণ ও সেবাকার্য সংগঠিত করা। সুইজারল্যান্ডের লুসান শহরে বিশ্ব মাতৃ সন্মেলনে পশ্চিমবঙ্গের প্রতিনিধিত্ব করা। আর এসবের সঙ্গেই প্রবল অনটনের মধ্যে দশ ছেলেমেয়েকে মানুষ করে তোলা।

তখন সম্ভবতঃ ফাইভে পড়ি। এক লোডশেডিং এর রাতে আমি আর দাদা হঠাৎ ঠিক করলাম একটা হাতে লেখা পত্রিকা বের করব। বাবা-কাকা-পিসি রা তাদের ছোটবেলায় বাড়ির সবার লেখা দিয়ে ঐরকম একটা হাতে লেখা পত্রিকা করেছিল। সেটা দেখেই হয়ত এমন ভাবনা। যেমন ভাবনা তেমন কাজ। পর পর পাঁচ মাস ধরে বেরলো সেই "ছোট্ট পত্রিকা"। প্রথম সংখ্যার কয়েকটা ফাঁকা পাতা রাখা হয়েছিল যাতে বড়রা মতামত জানাতে পারে। সেই পাতায় দিদা লিখেছিলেনঃ 
"এতদিন আমার মনের মাঝে যে বীজ বপন করা ছিল, তোমাদের উদ্যোগে ছোট্ট পত্রিকা প্রকাশনার মধ্যে অঙ্কুরিত হতে দেখে আশান্বিত হলাম। উত্তরোত্তর শাখাপ্রশাখা পল্লবিত হয়ে উঠুক। -- দিদা, ডিসেম্বর ১৯৯৬।"
পত্রিকার শেষ তথা শারদ সংখ্যায় স্বাধীনতার ৫০ বছর উপলক্ষে তিনি একটা ছোট্ট প্রবন্ধও লিখলেন। আরো বছর পাঁচেক পরে বন্ধুরা মিলে যখন "অভিযান" পত্রিকা বের করলাম তখনও তিনি খুব খুশি হয়েছিলেন। আমাকে বলেছিলেন, "তোকে সায়েন্স নিতে হবে না, তুই আর্টস নিয়ে পড়বি।" তাঁর কথা অবশ্য রাখতে পারিনি। দিদার মৃত্যুর কয়েকমাস পরেই আমি মাধ্যমিক দিলাম। তারপর "অভিযান" পত্রিকার দ্বিতীয় সংখ্যায় স্বাধীনতার ৫০ বছরের সেই লেখাটা আবার ছাপা হল। একটা সুন্দর হেডপিস এঁকে দিয়েছিল সমদা (স্মিতধী গাঙ্গুলী)। স্বাধীনতার ৭০ বছর পূর্তির প্রাক্কালে সমদার হেডপিস সহ পুরো লেখাটাই দিয়ে দিলাম। 



শারীরিক অসুস্থতার কারণে বেশ কিছুদিন কলকাতার কসবায় ছোট ছেলের চিকিৎসাধীনে ও তত্ত্বাবধানে ছিলাম। সেই সময়ের মধ্যেই অনুষ্ঠিত হয়ে গেল স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী। তখন শুয়ে শুয়ে সম্পূর্ণ বিশ্রামের মধ্যে অন্য কিছুই করতে পারতাম না। সময়মত ঝর্ণা রেডিওটা খুলে দিয়ে যেত, শুনতাম। গত একবছর ধরেই প্রচারমাধ্যমে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর নানা অনুষ্ঠানের কর্মসূচী শুনে আসছি। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উৎসবে কোন স্তরে কোন সাড়াই যেন পেলাম না - একমাত্র প্রচারমাধ্যমে কিছু কিছু শুনলাম। সমস্ত এলাকাটাই যেন নিস্তব্ধ। এই নিরিবিলি বিশ্রামের মাঝে পঞ্চাশ বছর আগের সেই প্রথম স্বাধীনতা দিবসের স্মৃতি মনকে আলোড়িত করে তুলতে লাগল। 

সেই দিনের প্রাক্কালে পাড়ায় এবং বাড়িতে সাড়া পড়ে গিয়েছিল। অজয় বলে একটি ছেলে বাড়ি থেকে চলে এসে আমাদের পরিবারের সঙ্গে প্রায় একাত্ম হয়ে গিয়েছিল। দয়াল কুমারের নির্দেশনায় ছোট বড় অশোক চক্রের ব্লক অজয় নিজেই তৈরী করেছিল। তারপর কয়েকদিন ধরে পতাকা সেলাই করতে লেগেছিল। ছোট-বড়, ছেলে-বুড়ো সবাই মিলে বাড়িতেও একটা উৎসব করার মতলব ভাঁজা হচ্ছে। সকলের ভাবনা এটাই যে, দীর্ঘদিনের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে সাম্রাজ্যবাদী শোষকদের হাত থেকে স্বাধীনতা উদ্ধার হবে ১৫ই আগষ্ট। সমস্ত ভারতবাসী খেতে পাবে, পড়তে পাবে, কাজ পাবে এই আশায় সর্বস্তরের ও সব বয়সেরই মানুষ যেন অজানা আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে উঠেছিল। সারা রাত্তির ধরে পতাকা তৈরী হয়েছে, বাড়ির সবাই যোগান দিয়েছে। ভোরবেলাতেই ছনি পরিমল এদের নেতৃত্বে জাতীয় সঙ্গীতের প্রভাতফেরি সারা অঞ্চলটাকে স্বাধীনতা দিবসের আনন্দে উদ্ভাসিত করে তুলল। ভোর হতেই ছোট ছোট পতাকা হাতে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা বেরিয়ে পড়ল এবং বড়রা পতাকা নিয়ে গেল বাড়িতে লাগাবে বলে। আমারও উৎসবের আনন্দে রান্নায় মন লাগছিল না। বারবার সদরে বেরিয়ে এসে কিশোর বাহিনী ও অন্যান্যদের উচ্ছাস ও আনন্দ দেখছিলাম। 

সেদিনের স্বাধীনতার আনন্দ ও আশা আর পঞ্চাশ বছর পর এই দিনটিতে মানুষের উচ্ছাস ও আবেগের আকাশ পাতাল তফাত। যে আশা নিয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামে যুক্ত হয়েছিলাম তার বেশীরভাগই আজ অসম্পূর্ণ, অপূর্ণ। আজ সমস্ত দিকে নির্লিপ্ততা ও শূন্যতার মাঝে মনের মধ্যেও শূন্যতা ও বিষাদ অনুভব করছি। আশা এই যে সমাজ ব্যবস্থার সততই পরিবর্তন হয়। আজ আমি বর্তমান ও আগামী প্রজন্মের কাছে এই প্রত্যয় রাখছি তারা সকলের জন্য খাদ্য, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষার সংগ্রাম করে যাবে এবং অদূর ভবিষ্যতে সকলের জন্য একটা সুখী সমাজ কাঠামো গড়ে তুলবে। 

সুবর্ণজয়ন্তীর শুভলগ্নে আমার জীবনসন্ধ্যার প্রাক্কালে এই আশা রাখছি। 
দশ সন্তানের সঙ্গে দিদা

Wednesday, 9 August 2017

ভোটের গেরোয়

সমনটা যখন হাতে পেলাম একটু টেনশান যে হচ্ছিল তা অস্বীকার করব না, তবে নতুন একটা অভিজ্ঞতা হবে ভেবে উত্তেজনাও অনুভব করছিলাম। একবছর হল কলেজের চাকরিতে যোগ দিয়েছি। এর মধ্যেই সহকর্মীদের কাছে  ভোটের নানা গল্প আর সেইসঙ্গে প্রয়োজনীয় পরামর্শ মাথায় নোট করা হয়ে গেছে। ভোটের আগের দিন (যাকে পি-১ ডে বলা হয়) ব্যাগপত্তর গুছিয়ে ট্রেনে করে পাণ্ডুয়া স্টেশনে নামলাম। আরো অনেক ভোটকর্মীর দেখা পেলাম স্টেশনে। তাঁদের সঙ্গেই নির্বাচন কমিশনের বাসে উঠলাম। তারপর সোজা ডিসি অর্থাৎ ডিস্ট্রিবিউশান সেন্টার। বেশ বড় জায়গা। কিন্তু সূর্যের তেজ ক্রমেই বাড়ছে। প্লাস্টিকের গ্লাসে করে গ্লুকোজ মেশানো জল বিতরন করা হচ্ছিল। তাই এক গ্লাস পান করে কাউন্টারে গিয়ে দাঁড়ালাম। ইতিমধ্যে অন্য পোলিং অফিসাররাও এসে গেছেন। সবাই মিলে জিনিসপত্র সব মিলিয়ে নিলাম। ইভিএম টা ঠিক আছে কিনা পরীক্ষা করে নিলাম। এতদিন সিইউ/বিইউ বলতে বুঝতাম ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটি আর বর্ধমান ইউনিভার্সিটি। এবার জানলাম ঐ চারটি অক্ষর দিয়ে কন্ট্রোল ইউনিট আর ব্যালট ইউনিটকেও বোঝানো যেতে পারে! আরেকটা কাজ বাকি ছিল, তা হল একজন লাঠিধারী পুলিসকে ট্যাগ করা। সেজন্য পুলিসের ক্যাম্পে গিয়ে তো চক্ষু চড়কগাছ! অন্তত ১০০ প্রিসাইডিং অফিসার লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন। আর লাইন এগোচ্ছে কচ্ছপের গতিতে! এভাবে চললে তো বুথে পৌঁছতে রাত্তির হয়ে যাবে। সবার মনেই সেই আশঙ্কা। গরমের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চড়ছে মেজাজ! দু অক্ষর, চার অক্ষর বেরোতে শুরু করল। শেষে রিটার্নিং অফিসার এসে সবাইকে আশ্বস্ত করলেন, আপনারা বুথে চলে যান, পুলিস পাঠিয়ে দেওয়া হবে। অতএব আমাদের জন্য নির্ধারিত বাসে উঠলাম। আমাদের ডিউটি পড়েছে একটা আদিবাসী এলাকায়। আরো দুটো সংলগ্ন বুথের ভোটকর্মীদের নিয়ে বাস ছাড়ল। "জয় ভোটবাবার জয়" বলে রওয়ানা দিলাম।

পৌঁছলাম দিনের আলো থাকতেই। শাল গাছে ঘেরা পরিস্কার পরিচ্ছন্ন প্রাইমারি স্কুলটা দেখে চোখ জুড়িয়ে গেল। একটু ফ্রেশ হয়ে খাওয়াদাওয়া করেই মেঝেতে চাদর পেতে কাজে লেগে পড়লাম। শুধু ভোট নেওয়া নয়, প্রচুর ফর্ম ও কাগজপত্র পূরণ করার থাকে। আর প্রিসাইডিং অফিসার হিসেবে আমার সই সর্বত্র বাধ্যতামূলক। সবাই মিলে সে সব কাজ যতটা সম্ভব এগিয়ে রাখা গেল। এর মধ্যে দুজন গ্রামবাসী এসে হাজির, আমাদের সব কোন অসুবিধা হচ্ছে কিনা খোঁজ নিতে। পরিচয় জানতে বললেন তিনি আবদুল রহিম নবির পোলিং এজেন্ট। এখানে বলে রাখি পাণ্ডুয়া বিধানসভা কেন্দ্রে মূল প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন তৃণমূল কংগ্রেসের আবদুল রহিম নবি এবং সিপিএমের শেখ আমজাদ হোসেন। বিজেপির অশোক ভট্টাচার্য এবং আরো তিনটে ছোট দলের প্রার্থীরাও ছিলেন। এছাড়া ছিলেন একজন নির্দল, তাঁরও নাম শেখ আমজাদ হোসেন! তো এজেন্ট মশাইকে জানিয়ে দিলাম পরদিন যেন সকাল সকাল চলে আসেন। "কোন চিন্তা নেই স্যার, ছটার মধ্যে চলে আসব।" বলে বিদায় নিলেন এজেন্ট সাহেব।

রাতের খাওয়াটাও ভালো হয়েছিল। স্কুলের মিড ডে মিলের দায়িত্বপ্রাপ্ত স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মহিলারা মোটা চালের ভাত, আলুপোস্ত আর ডিমের ঝোল খাওয়ালেন। খাওয়াদাওয়া সেরে শোয়ার তোড়জোড় করছি এমন সময় আরেক বিপত্তি। বুথের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ান একটা কাগজ এনে হাজির, সই করে দিতে হবে। কাগজটা পড়ে তো পিলে চমকে উঠল। এ যে ফায়ারিং অর্ডার! বোঝ ঠ্যালা, কোথাকার এক ছাপোষা সহকারি অধ্যাপক, ইনসাসধারী ফেট্টিবাঁধা জওয়ান কি না তার কাছে গুলি চালানোর আনুমতি চাইছেন! ওঁদের যুক্তি গুণ্ডারা হামলা করলে তখন আর অনুমতি দেওয়ার সময় থাকবেনা, এমনকি অনুমতি দেওয়ার জন্য আমি জীবিত নাও থাকতে পারি, তাই আগেভাগেই এই ব্যবস্থা। শেষে সেক্টর অফিসারকে ফোন করলাম এবং তাঁর পরামর্শ মেনে ফায়ারিং অর্ডারে সই করলাম না। জওয়ান মশাই ক্ষুব্ধ হলেন এবং যাওয়ার আগে সতর্ক করে গেলেন, ভালোমন্দ কিছু হয়ে গেলে ওনারা দায়িত্ব নেবেন না! কি আর করা। দরজায় একটাই ছিটকিনি। সেটা এঁটে দিয়ে শুয়ে পড়লাম। 

পরের দিন আলো ফোটার আগেই ঘুম ভেঙে গেল। টিউবওয়েলে চান করে রেডি হয়ে নিলাম। ৬টা বাজতে না বাজতেই পোলিং এজেন্টরা উপস্থিত। প্রথমেই গতকালের মক্কেল। তাঁর হাতের কাগজটা নিয়ে দেখি সেটা নির্দল প্রার্থী শেখ আমজাদ হোসেনের এজেন্টের নিয়োগপত্র। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, 
"গতকাল যে বললেন আপনি রহিম নবির এজেন্ট? রাত পোহাতেই আমজাদ হোসেনের এজেন্ট হয়ে গেলেন?"
"হ্যাঁ স্যার, বদলে গেছে।" 
কি আর করা নিয়োগপত্র যখন এনেছেন ওনাকে আমজাদ হোসেনের এজেন্ট হিসেবে কাজ করতে দিতে বাধ্য আমি। পরে, রিলিভিং এজেন্টের হাতে দায়িত্ব দিয়ে বুথ ছাড়ার সময় তিনি আমার কাছে এসে রহস্যটা ফাঁস করে গেলেন। "আমরা স্যার টিএমসি করি, নির্দলের হয়ে কাজ করছি। দলটা ভারী করে নেওয়া, আর কি! ট্যাকটিক্স স্যার, বুঝলেন না?!" 

সব এজেন্টকে এনট্রি পাস ইস্যু করে মক পোল শুরু করতে যাব, এমন সময় আরেকজন হাজির। তিনি বিজেপি প্রার্থী অশোক ভট্টাচার্যের এজেন্ট। তাঁর নিয়োগপত্রটায় দেখি শুধু প্রার্থীর নির্বাচনী এজেন্টের সই ছাড়া বাকিটা ফাঁকা! কোথায় কি লিখতে হবে দেখিয়ে তাঁকে কাগজটা ফেরৎ দিলাম। তবু দেখি তিনি মাথা চুলকোচ্ছেন। বুঝলাম লেখা-পড়ার সঙ্গে তাঁর বিশেষ সম্পর্ক নেই। কিন্তু আমার হাত পা বাঁধা, প্রিসাইডিং অফিসার হয়ে একজন এজেন্টের ফর্ম ফিলআপ করে দিতে পারিনা। শেষে মুশকিল আসান হলেন সিপিএমের বয়স্ক এজেন্ট।
 "কি রে ভাই পারছিস না? আয় আমি লিখে দিচ্ছি।" 
"হ্যাঁ দাদা দেখো দিকি" হাতে চাঁদ পেয়ে ফর্মটা এগিয়ে দিলেন বিজেপির এজেন্ট। 
মক পোল শেষ করে ৭টায় ভোট চালু করতে গিয়ে দেখি বাইরে বিশাল লাইন। মহিলারাই সংখ্যায় বেশী। তারপর নির্বিঘ্নে, শান্তিপূর্ণভাবে ভোট হল। ১১টার মধ্যেই ৫০% ভোট পড়ে গেল। ভোট দেওয়ার জন্যে মানুষের এত উৎসাহ এখানে না এলে জানতেই পারতাম না। জানতে পারতাম না কোনরকম জল না মিশিয়েই ৮৪% ভোট হতে পারে। প্রায় অথর্ব বৃদ্ধ, বৃদ্ধা, চোখে দেখতে পান না এমন মানুষেরা ভোট দিতে চলে এসেছেন ছেলে, বৌমা বা নাতির হাত ধরে! ভাবছিলাম কারা বেশী সচেতন? এই অশিক্ষিত আদিবাসী মানুষগুলো না কি আমার শহুড়ে বন্ধুরা, যারা বলে "ধুসস ভোট দিয়ে কি হবে, এক দিন ছুটিতে মস্তি করি!" বেলা বাড়তে ভোটারদের লাইন ক্রমশ হালকা হল। আমরা একে একে খেয়ে এলাম। তেষ্টায় গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। সিপিএমের এজেন্ট জল আনতে গেলেন, তৃণমূলের এজেন্ট বললেন "চলো চাচা আমিও যাই।" বিজেপির এজেন্ট নিজের বোতলটা ধরিয়ে দিলেন, "এটা একটু ভরে আনিস তো।" আমি চেয়ারে বসে দরজার ফাঁক দিয়ে দেখলাম সেই দৃশ্য। তৃণমূলের এজেন্ট টিউবকলের হাতল টিপছেন আর সিপিএমের এজেন্ট জল ভরছেন। তাঁদের ব্যবধান, হ্যাঁ কয়েক ইঞ্চির বেশী হবে না!

নির্ধারিত সময়েই, সন্ধ্যা ৬টায় ভোট শেষ হল। ঘন্টা দুয়েক বাদে বাস এল। এবার মহামূল্যবান ইভিএম যন্ত্র নিয়ে ডাইনে বাঁয়ে সশস্ত্র জওয়ান পরিবিষ্ট হয়ে পৌঁছলাম আগের যায়গায় যা এখন বদলে গেছে আর সি অর্থাৎ রিসিভিং সেন্টারে। লাইন দিয়ে, গুঁতোগঁতি ও মারামারি করে দরকারি কাগজপত্র সমেত বাক্সবন্দী ইভিএম জমা দিয়ে অব্যাহতি পেলাম। তারপর শেষ ট্রেন ধরলাম ফেরার জন্য। 

প্রথম প্রকাশঃ Deconfined, August 2016

Friday, 30 June 2017

Not in My Name

জুন ২০১৪, পুণে নরেন্দ্র মোদি তখতে বসার এক সপ্তাহের মধ্যে ২৪ বছরের তরুণ সফটওয়ার কর্মী মহসিন শেখ কে পিটিয়ে মারল হিন্দু রাষ্ট্র সেনা৷ "একটা উইকেট পড়ল" বলে উল্লাস শোনা গেল তাদের গলায়৷ মহসিনের অপরাধ, তিনি নাকি শিবাজি ও বাল থ্যাকারে কে নিয়ে "আপত্তিকর" পোস্টে লাইক দিয়েছিন৷ হত্যাকারীদের অধিকাংশই জামিনে মুক্ত৷ কারণ ভারতীয় আদালতের মতে তাঁরা ধর্মীয় প্রেরণায় হত্যাকাণ্ডটি ঘটিয়েছিলেন, ব্যক্তিগত স্বার্থে নয়৷

সেপ্টেম্বর ২০১৫, দাদরি স্থানীয় মন্দির থেকে ঘোষণা হল মহম্মদ আখলাকের ফ্রিজে গরুর মাংস আছে৷ উন্মত্ত জনতা বাড়ি থেকে টেনে বের করে খুন করল পঞ্চাশোর্ধ আখলাককে৷ খুনিদের গ্রেফতার না করার দাবীতে জোরদার আন্দোলন গড়ে তুলল বিজেপি৷ আখলাকের পরিবারের বিরুদ্ধে গোহত্যার মামলা দায়ের করল পুলিস৷ ফ্রিজে রাখা মাংস বিফ না মটন জানতে ফরেনসিক ল্যাবে পাঠানো হল৷ আর বছরখানেক বাদে খুনিদের একজনের মৃত্যু হলে তার গায়ে জাতীয় পতাকা জড়িয়ে শেষকৃত্য সম্পন্ন হল৷

এপ্রিল ২০১৭, আলোয়াড় রাজস্থানের হাট থেকে গবাদিপশু কিনে ফেরার পথে গোরক্ষকদের হাতে পড়লেন হরিয়ানার দরিদ্র কৃষক পেহলু খান এবং যথারীতি গোরু পাচারের ধুয়ো তুলে তাঁকে হত্যা করল গোরক্ষকরা৷ রাজস্থান সরকার গোরক্ষকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে পেহলুর পুত্রের বিরুদ্ধেই গোরু পাচারের কেস দিয়ে দিল৷

জুন ২০১৭, প্রতাপগড় স্বচ্ছ ভারত অভিযানের নামে বস্তির মহিলাদের মলত্যাগ করার ফটো তুলছিল মিউনিসিপ্যালিটির কর্মচারীরা৷ সিপিআই (এমএল) লিবারেশান কর্মী এবং রাজস্থানের নির্মাণকর্মী আন্দোলনের সংগঠক জাফর হোসেন প্রতিবাদ করলে "স্বচ্ছ ভারত অভিযান"এ বাধা দেওয়ার জন্য তাঁকে পিটিয়ে মারল পুরকর্মীরা৷

জুন ২০১৭, দিল্লী মথুরা ট্রেন৷ নাহ, ঈদের বাজার করে ঘরে ফেরার সময় জুনায়েদ খানকে মেরে ট্রেন থেকে ফেলে দেওয়ার জন্য আর ফেসবুক লাইক, গোরক্ষা বা স্বচ্ছ ভারতের মত কোন অজুহাতের প্রয়োজন হয়নি৷ টুপি, পায়জামা, পাঞ্জাবীতে প্রতীয়মান ১৫ বছরের যুবকের ধর্মীয় পরিচয়ই তার বেঁচে থাকার অধিকার হারানোর পক্ষে যথেষ্ট কারণ বলে বিবেচিত হয়েছিল সহযাত্রীদের কাছে৷

কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী, উনা থেকে গিরিডি - দেশজুড়ে আরো অজস্র ঘটনার কথা বলতে গেলে রাত কাবার হয়ে যাবে৷ চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে পরাজয়ে হতাশ দ্বেষভক্তরা উল্লসিত - "ওদের" একটার পর একটা উইকেট পড়ছে যে! হিন্দুধর্মের নামে এইসমস্ত হত্যাকাণ্ড সংগঠিত হলেও এসবের জন্য হিন্দুধর্মকে দায়ী করা ঠিক নয়৷ কোটি কোটি সাধারণ হিন্দু আরেসেস-বিজেপি চক্র কে সমর্থন করেন বলেও মনে হয় না৷ কিন্তু বেশী দেরী হওয়ার আগে সাধারণ ধার্মিক হিন্দুরা সোচ্চার হোন গো সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে৷ নাহলে চৈতন্য-রামকৃষ্ণদের সরিয়ে গোসন্ত্রাসীরাই হিন্দুধর্মের মুখ হয়ে উঠবেন৷

সংযোজনঃ আগষ্ট ২০১৬, উদুপি৷ গরু কিনে ফেরার পথে ২৯ বছরের ব্যবসায়ী প্রবীণ পুজারি নিহত হলেন "হিন্দু জাগরণ ভেদিকে" সংগঠনের কর্মীদের হাতে৷ ওরা বোধহয় জানত না প্রবীণ কর্ণাটকের কেনজুর গ্রামের বিজেপি সভাপতি ছিলেন৷ গোসন্ত্রাসবাদী দের হাত থেকে হিন্দুরাও রেহাই পাবে না৷ বিজেপি করলেও না৷


ওপরের লেখাটা ফেসবুকে পোস্ট করেছি ২৯শে জুন। তারপরও তালিকাটা বেড়েই চলেছে।

জুন ২০১৭, রামগড় বাজার থেকে মাংস কিনে গ্রামের বাড়িতে ফিরছিলেন ৫০ বছরের আসগড় আলি ওরফে আলিমুদ্দিন। পথের মধ্যে গাড়ি দাঁড় করিয়ে আলিমুদ্দিনকে টেনে নামিয়ে তাঁকে পিটিয়ে মেরে ফেলে, গাড়িটাও জ্বালিয়ে দেয়। ছুতো সেই একই - আলিমুদ্দিন না কি গাড়িতে করে গরুর মাংস নিয়ে যাচ্ছিলেন! অন্যান্য ঘটনার মত এক্ষেত্রেও ঝাড়খণ্ডের বিজেপি সরকারের পুলিস অপরাধীদের গ্রেফতার না করে গাড়িতে রাখা মাংসটা ফরেনসিক ল্যাবে পাঠিয়ে দিয়েছে।

Thursday, 29 June 2017

ডি লা গ্র্যান্ডি মেফিস্টোফিলিশ ইয়াক ইয়াক

তখনো ফোন বলতে তার লাগানো ল্যান্ডলাইন ফোনই বোঝাতো, ডায়াল ঘুরিয়ে ফোন করতে হত বলে সববার নাম্বার মুখস্থ থাকত। কম্পিউটার, ইন্টারনেট এসব শব্দ সবে শোনা যাচ্ছে। তখন টিভি বলতে বোঝাত ডিডি-১ আর ডিডি-২; যাদের  কেবল টিভি এসে গেছিল, রুদ্ধশ্বাস খেলার দিনে তাদের বাড়িতে লোকের ভিড় জমে যেত। তখনো বাংলা মাধ্যম ইস্কুলে পড়াটা হীনমন্যতার কারণ হয়ে দাঁড়ায় নি, তখনো বাবা-মা রা টিউশন পড়ানোর জন্য দুবেলা এসকর্ট করে নিয়ে যেতেন না। তখনো মহম্মদ আজহারউদ্দিন ভারতের হয়ে টস করতে নামতেন, সৌরভ গাঙ্গুলী লর্ডসে সেঞ্চুরি করেছে কি করেনি। তখনো আনন্দমেলার পুজোসংখ্যায় নিয়মিত হাজিরা দিতেন কাকাবাবু, কিকিরা, অর্জুন, অরণ্যদেব; কখনো সঙ্গ দিত কলাবতী, ফ্রান্সিস, পাণ্ডব গোয়েন্দা। সেবারই শেষবারের মত মুখ্যমন্ত্রীর পদে শপথ নিলেন জ্যোতিবাবু; আর কিছু মাস পরেই কংগ্রেস ত্যাগ করে নিজের দল খুললেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

সেই বছরই আমি মর্নিং সেকশান পার করে ডে সেকশানে ভর্তি হলাম আর প্রথম দিনই
নীলপাহাড়িতে সবুজদাড়ি সাতকড়ি সাঁতরার সঙ্গে চারমূর্তি।
ঝাউ বাংলো রহস্য। শিল্পীঃ সুবোধ দাশগুপ্ত
পরপর তিনটে ক্লাসে মনিটারের খাতায় নাম উঠতে দেখে এসকেবি স্যার আমাকে আর সৈকতকে দরজার বাইরে নিল ডাউন করে শাসিয়ে দিলেন, "এই দুটো নাম আর একবার দেখলে কিন্তু পিঠের চামড়া তুলে নেবো!" সেবারই আমি আর দাদা মিলে হাতে লেখা "ছোট্ট পত্রিকা" বের করলাম আর সৈকত ওর বোনের সঙ্গে বের করল "দুর্লভ পত্রিকা"  সেই সব পত্রিকাতেই আমি গল্প লিখব "গুপিদা" আর তার সাঙ্গপাঙ্গো ন্যাপলা, টুটুন, বুবাই-কে নিয়ে আর সৈকত লিখবে "শিবুদা" কে নিয়ে। এদিকে গুপিদা হানাবাড়িতে রাত কাটাতে গিয়ে ভূতের ভয়ে দৌড় মারবে আর ওদিকে শিবুদা মাছ ধরার কম্পিটিশনে নাম দিয়ে ছিপ দিয়ে লড়ি থেকে মাছ তুলে ফার্স্ট প্রাইজ জিতে নেবে। আর সেই বছরেই পুজোর উপহার হিসেবে ছোটকাকুর কাছ থেকে আদায় করলাম "টেনিদা সমগ্র।" 


"দাদা" শব্দটা অন্য ভাষায় কতটা প্রচলিত জানি না কিন্তু "দাদাগিরি"র পেটেন্ট বাঙালীরই। বেহালার মহারাজ কিংবা আলিমুদ্দিন স্ট্রীট ছাড়া দাদাগিরি কাকে মানায়? (পলিটিকালি কারেক্ট এবং জেন্ডার নিউট্রাল থাকার জন্য কালিঘাটের "দিদিগিরি" যোগ করা যাতে পারে।) তাই বিশ্ববিখ্যাত দাদা-রা যে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড ছেড়ে বাংলা সাহিত্যের পুণ্যভূমিতেই তাঁদের কীর্তি প্রতিষ্ঠা করবেন তাতে আর আশ্চর্য কি??!! ঘনাদা-টেনিদা-ফেলুদা ত্রয়ীর মধ্যে প্রথম ও তৃতীয় জনের যাবতীয় বিশিষ্টতা স্বীকার করেও বলতে হয় বাংলা সাহিত্যে গল্পবলিয়ে বা গোয়েন্দার অভাব নেই। সেই দিক দিয়ে টেনিদার মত চরিত্র বাংলা সাহিত্যে প্রায় বিরল। "প্রায়" বললাম কারণ বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়ের গণশার দল আর দীপঙ্কর বিশ্বাসের মেজদা অ্যান্ড কোং এর কথা মনে রাখতে হবে। 

না টেনিদা কোন সুপারম্যান নয়। জিনিয়াসও নয়। টেনিদা টেনিদা-ই। সে বছরের পর বছর একই ক্লাসে থেকে যায়। পরীক্ষা-ফরীক্ষাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে বলতে পারে, "কতকগুলো গাধা ছেলে গাদা গাদা বই মুখস্থ করে আর টকাটক পাশ করে যায়। পাশ না করতে পারাই সবচেয়ে শক্ত।" আবার সে-ই সম্রাট তেমুজিন আর হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার কাণ্ড, পকেটমার সম্রাট দশাননের জীবনচরিত কিংবা বার্মা ফ্রন্টে ক্যামোফ্লেজ করে জাপানিদের জব্দ করার গল্প শোনাতে পারে। সেসব গল্প না গুল্প সে তর্ক থাক কিন্তু এমন "গুল্প"ই বা কোন পড়ার বইয়ে মেলে? টেনিদা অন্ধকারে ছাদের পাঁচিলে বেড়ালের জ্বলন্ত চোখ দেখে ভির্মি খায়, নীলপাহাড়িতে কাটামুণ্ডুর নাচ দেখে খাটের তলায় লুকিয়ে পড়ে। সেই টেনিদা-ই গড়ের মাঠে গোরা পিটিয়ে সহবৎ শেখায়, মা নেংটিশ্বরীর তিনমণি মস্তান খগেন মাশ্চটক কে কুপোকাৎ করে ফেলে। হাড়কেপ্পন ভজগৌরাঙ্গবাবু, বিটকেল স্বভাবের ব্রহ্মবিকাশবাবু কিম্বা জাঁদরেল টিকিট চেকার রাইনোসোরাস জব্দ হয় টেনিদার হাতে। আবার প্যালাজ্বরে ভোগা, শিঙিমাছের ঝোল খাওয়া প্যালারাম সেই টেনিদাকেই টুপি পড়িয়ে মুড়ো বলে কাঁকড়ার দাঁড়া গছিয়ে দেয়! টেনিদা কাউকে কোনদিন খাইয়েছে এমন বদনাম কেউ দিতে পারবে না বলে গর্ব ছিল টেনিদার। নিত্য প্যালা, ক্যাবলা আর হাবুলের ঘাড় ভেঙে ঘুগনি আলুকাবলি, সিঙাড়া, মিষ্টি খাওয়াই টেনিদার ট্রেড মার্ক। সেই টেনিদাকেই বুদ্ধু বানিয়ে চারটে কাটলেট, দু প্লেট মাংস, এক প্লেট পোলাও আর এক প্লেট পুডিং খেয়ে সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে ট্যাক্সিতে উধাও হয়ে যায় বেচারাম গড়গড়ি ওরফে হনোলুলুর মাকুদা। 

মুড়ি স্টেশনে কলার খোসায় আছাড় খাচ্ছে গজেশ্বর।
চারমূর্তি। শিল্পীঃ নরেন্দ্র দত্ত।
এই টেনিদাকে কেন প্রাণ দিয়ে ভালবাসে প্যালারাম, ঢাকাই হাবুল আর স্কলারশিপ পাওয়া ক্যাবলা তা যদি কেউ না বোঝেন তাহলে তিনি দাদাগিরির মানেই জানেন না। প্যালা-ক্যাবলা-হাবুল যেমন টেনিদা ছাড়া অনাথ, টেনিদাও তেমনি ভাইদের বাদ দিয়ে অসম্পূর্ণ। টেনিদা মানে আসলে পটলডাঙার চারমূর্তি। ক্যাবলা না থাকলে কে জানত যে কুরুবক একধরণের ফুল আর মেফিস্টোফিলিস মানে শয়তান? আর হাবুল বলেছিল বলেই তো জানলুম, বিড়ালের "মিঞাআও" ডাকের অর্থ হল "আইসো ইন্দুর মিঞা, তোমারে ধইর‍্যা চাবাইয়া খামু!" আর প্যালা? সে না থাকলে টেনিদার গল্প শোনাবে কে? ঝন্টিপাহাড়ির দুর্ধর্ষ জাপানি দস্যু কাগামাছির মুখোশই বা খুলবে কে?

আজকের ছোটরা, ইস্কুল থেকে যাদের বাড়িতে বলে দেওয়া হয়, "বাচ্ছার সঙ্গে একদম বাংলায় কথা বলবেন না", খেলা বলতে যারা ভিডিও গেম বোঝে, ইস্কুলের পর চাটুজ্যেদের রোয়াকে বসে আড্ডা না মেরে যারা ব্যাগ কাঁধে টিউশন পড়তে ছোটে, তাদের কাছে টেনিদার কোন আকর্ষণ থাকতে পারে কি? পরীক্ষার খাতায় সুন্দর করে নারকেল গাছের ছবি এঁকে আসার বিলাসিতা কি তাদের আছে? ওদের কথা শুনলে হাবুল সেন বলত, "ছাড়ান দাও, পোলাপান"। ক্যাবলা ভুরু কুঁচকিয়ে বলত "খামোশ"। অনেকদিন পশ্চিমে কাটিয়েছে বলে ওর মুখ থেকে মাঝে মাঝেই রাষ্ট্রভাষা বেরিয়ে আসে। আর টেনিদা হয়ত এক চড় মেরে ওদের মুণ্ডু কাঠমাণ্ডুতে পাঠিয়ে দিত। আর তারপর প্যালার মাথায় গাঁট্টা মেরে বলত, কুরুবকের মত বকবক করিস না। যা ঐ বুড়োটার কাছ থেকে একটা ভালো দেখে আইসক্রিম নিয়ে আয়!   

(নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের জন্মশতবর্ষকে মনে রেখে।)



Saturday, 27 May 2017

পাহাড়ের ডায়েরি (৫)

 শ্রী-তনু-র শেষকথা


সাড়ে নটা বেজে গেল কিন্তু সাগরভাই বা তার গাড়ির দেখা না পেয়ে সবারই কপালে চিন্তার ভাঁজ। এন জে পি তে ট্রেন বিকেল ৬টায়। এমনি তে ৭ ঘন্টার রাস্তা। কিন্তু অনি বলেছে যতটা পারা যায় সময় হাতে নিয়ে বেরোতে হবে। পাহাড়ি রাস্তা কখন কোথায় ধ্বস টস নেমে বন্ধ হয়ে যায় তার ঠিক থাকে না। আমরা দাঁড়িয়ে ছিলাম ওখরের সানবার্ড লজের সামনে। সিকিম ভ্রমণ সাঙ্গ করে এবার আমাদের ফেরার পালা। গতকাল পূর্বা ডিকি দিদির হাতে গড়া সিকিমি মোমো আর আড্ডা, ইয়ার্কি, নাচ, গান, নেপালি বাঁশির সুরে ক্যাম্প ফায়ারের মাধ্যমে জমে উঠেছিল সিকিম ট্রিপের অন্তিম রজনী। এত আনন্দের মাঝেই মনখারাপের মেঘ ঘনিয়ে আসছিল। কাল সকাল থেকেই আবার যে যার জীবনে ফিরে যাব। মনের মেঘ কাটাতে তাই বেশী করে করে পরের ট্রিপের প্ল্যান এর দিকে মনোনিবেশ করছিলাম। 


সাগরভাইয়ের দেখা পাওয়া গেল তখন ঘড়ির কাঁটা দশটা ছুঁই ছুঁই। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে পেমা সিরিং এর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে মালপত্তর নিয়ে গাড়িতে উঠে পড়লাম। ঠাণ্ডা হাওয়া তখনও হাড় কাঁপাচ্ছিল। মনে মনে ভাবলাম আর কিছুক্ষণ, তারপরেই এই এক দমক ঠাণ্ডা হাওয়ার জন্য মনটা হু হু করে উঠবে। এঁকা বেঁকা রাস্তা দিয়ে গড়ি ছুটছিল। একদিকে পাহাড়, অন্যদিকে ধাপ কাটা উপত্যকা। কোথাও নদী আবার কোথাও বা গভীর খাদ। মনে হচ্ছিল কোন video যেন rewind করছি। ঠিক যেমন যেমন হচ্ছিল আসার দিন, আজও ঠিক একই রকম সবকিছু। সেই রাস্তা, সেই প্রকৃতি, সেই সাগরভাইয়ের বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন জিনিস পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব, সুন্দরী মেয়েদের লিফট দেওয়া, গাড়ীর অডিও জ্যাকে আমাদের মোবাইল গুঁজে চিরপরিচিত গান। তফাৎ শুধু একটাই - যাওয়ার দিন মনে ছিল অসম্ভব একটা আনন্দ, curiosity, excitement আর এখন মনে পরিতৃপ্তির স্বাদ আর অল্প অল্প মনখারাপ।

২টোর সময় যখন শিলিগুড়ির কাঞ্চনজঙ্ঘা স্টেডিয়ামের সামনে নামলাম তখন মনে হল যেন স্বর্গ থেকে নরকে নেমে এসেছি। গাড়ির জ্যাম আর প্রচণ্ড গরমে মনে হচ্ছিল শিলিগুড়ি নয়, কলকাতার এম জি রোডে দাঁড়িয়ে আছি! বব চটপট সবার জন্যে আখের রস এনে দিল। ছায়ায় দাঁড়িয়ে সেটা শেষ করার আগেই দেখি দলনেতা অনির্বান সামনের দিকে হাঁটা লাগিয়েছে। অনির্বানকে নেতার পদে পেতে হলে এটা মেনে নিতেই হবে। ও কোথায় যাচ্ছে, কেন যাচ্ছে কোন প্রশ্ন করা চলবে না। শুধু বাধ্য সৈনিকের মত অনুসরণ করতে হবে। তবে অনুসরণ করে পস্তেছি বলা যাবে না। এবার যেমন অনির্বানের পিছু পিছু গিয়ে দাঁড়ালাম "হোটেল নন্দিতা"র সামনে। হোটেল দেখেই খিদেটা চাগাড় দিয়ে উঠল। মধ্যাহ্নভোজ শেষ করে উঠে অনির্বান বলল, "পান খাবি তো? চকোলেট পান?" একে পান, তার ওপর চকোলেট! এ লোভ কি সামলানো যায়! আবার সকলে লিডারকে অনুসরণ করলাম।

এতদিন লালরঙের ভিজে কাপড় দিয়ে পানপাতা চাপা দেওয়া গুমটি থেকে ৬ টাকার পান কিনে খেয়েছি। শিলিগুড়ির পান প্যালেসে এসে চমকে চ! কাঁচে ঘেরা শীততাপনিয়ন্ত্রিত দোকান। একদিকে নানা ধরণের তামাক আর পানীয় রয়েছে। চাইলে হুঁকোও খাওয়া যেতে পারে। অন্যদিকে বিভিন্ন রকম পান আর আইসক্রিমের সম্ভার। চটপট চকোলেট পান চলে এল সাদা প্লেটে করে। সাধারণ পানের দ্বিগুণ। ওপরে চকোলেটের কোটিং তার ওপর একটা লাল চেরী বসানো। বেশ কসরত করে কামড় দিলাম। চকোলেট, মিঠা পাতা পান আর হরেক রকম ড্রাই ফ্রুটসের অংশবিশেষ স্বাদকোরক ছুঁতেই অদ্ভুত একটা স্বর্গীয় শান্তি অনুভব করলাম। একে পান বললে ভুল হবে, একটা গোটা মিলের সমান! অনি যদি আগে বলত লাঞ্চ টা স্কিপ করে পানভোজন করেই কাটিয়ে দিতাম। এই চকোলেট পান দলনেতার তরফ থেকে আমাদের ট্রিট। পান খাইয়ে ট্রিট দেওয়া শুনে যাঁরা ভুরু কোঁচকাচ্ছেন তাঁদের জানিয়ে রাখা যাক আমরা যে চকোলেট পানগুলো খেলাম তার এক একটার দাম ১৩৫ টাকা। দেয়ালে টাঙানো রেট চার্ট দেখে আরো জানা গেল ঐ দোকানের সবচেয়ে দামী পানের দাম ৭০০ টাকা! 
 

উত্তরবঙ্গ এক্সপ্রেস এনজেপি ঢুকলো আধঘন্টা দেরিতে। আমাদের সবারই সিট একসঙ্গে পড়েছিল। খালি পল্লবের একটু দূরে। এক্সচেঞ্জ করার লোক খুঁজে খুঁজে যখন হাল ছেড়ে দিলাম তখনই জানলার ধার থেকে একটা দাড়িওলা ছেলে গোঁফের তলা দিয়ে হাসতে হাসতে বলল, ''চিন্তা করবেন না, আমি ঐ সিটটায় চলে যাব।" হাতে একটা বই নিয়ে বসে সে আমাদের কার্যকলাপ দেখছিল। কিন্তু তাকে আর ছাড়া গেল না। কারণ কয়েক মিনিটের মধ্যেই সেই সুজন বণিক আমাদের গ্রুপে একদম খাপে খাপ হয়ে মিশে গেল। ডিটেকটিভ গল্প থেকে ফুটবল, বেড়ানো থেকে খাওয়াদাওয়া আড্ডা আর হাসিঠাট্টায় তুফান তুলে অন্য সহযাত্রীদের যথেষ্ট বিরক্তি উৎপাদন করে যখন শোয়ার তোড়জোড় করলাম তখন আর খেয়াল করা হল না কে কার সিটে শুচ্ছে! 

আগামীকাল ভোরের আলো ফোটার আগেই যে যার গন্তব্যে নেমে পড়ব। কিছু কিছু সময় থাকে যেখানে আমরা আটকে যাই। এই ৫ দিন ঠিক তেমনি। অসাধারণ অবাক করা প্রকৃতি আর আমরা ৫ জন এমন বন্ধু যারা শুধু বন্ধু নয়, একটা পরিবারের অংশ। আড্ডা, গল্প, হাসি, ইয়ার্কি, অ্যাডভেঞ্চার - প্রকৃতির এক অদ্ভুত কম্বিনেশন। আজও ওখানেই আটকে আছি। রোজই স্বপ্ন দেখি কোন এক অজানা রাস্তায়, অপরিচিত পরিবেশে আমরা পাঁচজন খিল্লি করতে করতে হেঁটে চলেছি।

অপেক্ষা নেক্সট ট্রিপের।



ট্যুর প্ল্যানঃ

ট্রেনযাত্রা বাদ দিয়ে এই ট্রিপটা পাঁচদিনের। প্রথমদিন সকাল সকাল নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে নামুন। শেয়ারে বা রিজার্ভ করে গাড়ি নিয়ে ১৩০ কিলোমিটার দূরে ওখরে বা আরো ১০ কিলোমিটার এগিয়ে হিলে তে চলুন। ৭-৮ ঘন্টা লাগবে। হিলে তে একটি মাত্র ট্রেকার্স হাট। থাকার ব্যবস্থা আরামদায়ক নয়। ওখরে তে অনেক ভালো লজ/ হোমস্টে পাবেন। কিন্তু ওখরে তে থাকলে পরদিন সকালে গাড়ি করে হিলে যেতে হবে। দ্বিতীয়দিন ২-৩ ঘন্টা ট্রেক করে ভার্সে যান। ভার্সেতে গুরস কুঞ্জ বা ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের লজে থাকুন। তৃতীয়দিন সকালে ট্রেক করে হিলেতে নামুন। সেখান থেকে ২ ঘন্টা গাড়িতে ভোরেং যান। ভোরেং থেকে আবার ঘন্টা দুয়েকের ট্রেক করে গোর্খে পৌছন। ইডেন লজে রাত্রিবাস করুন। চতুর্থদিন আবার ট্রেক করে ভোরেং আসুন। ভোরেং থেকে গাড়িতে ওখরে। বিকেলের দিকে ওখরে মনাস্ট্রি দেখে নিতে পারেন। পঞ্চমদিন সকালে গাড়ি করে নিউ জলপাইগুড়ি আসুন। 

বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ

রডোডেনড্রনের বাহার দেখতে হলে মার্চ মাসের শেষদিক থেকে মে মাসের প্রথমদিকে মধ্যে যেতে হবে। ভোরেং থেকে থেকে গোর্খে ট্রেকটা একটু কঠিন হলেও হিলে-ভার্সে ট্রেকটা খুব বাচ্ছা বা বৃদ্ধ ছাড়া যেকোন সুস্থ মানুষ করতে পারবে।

দরকারি ফোন নম্বরঃ

1. Dipankar Dey (Majestic Himalayan Treks & Tours): 9749061941, 9733828481
2. Raj Nambang (Hilley Tour & Travel): 9733271137, 9593980310
3. Gopal Thapa (Pusai) (Barsey Home Stay): 9733412807, 9547219305
4. P. T. Sherpa (Sunbird Lodge Okhrey): 9647811674




Sunday, 14 May 2017

ন্যাদোশ

ঝড়বৃষ্টি হয়ে ওয়েদারটা বেশ ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। তেতলায় চিলেকোঠার ঘরে চিৎ হয়ে শুয়ে ফেসবুকে কি স্ট্যাটাস দেওয়া যায় ভাবছিলাম। হঠাৎ জানলা দিয়ে খচমচ করে কি যেন ঘরে এসে পড়ল। পাশের আমগাছ টা কদিন ধরেই হনুমানদের দখলে। তারাই কেউ ঢুকে পড়ল না কি ভেবে ধড়মড় করে উঠে বসে দেখি, হনুমান তো নয়, ইয়াব্বড় শিংওলা একটা গরু লগবগ করতে করতে ঠ্যাং ছড়িয়ে মেঝেতে বসে পড়ল। গল্পের গরু গাছে ওঠে বলে জানি, কিন্তু তিনতলায় ওঠা গরুর কথা তো আগে শুনিনি। আরেকটু হলেই ভির্মি খেতাম, কিন্তু গরুটা এমন মানুষের গলায় কথা বলে উঠল, যে ভির্মি খাওয়া ভুলে হাঁ করে তাকিয়ে রইলাম।

"মুখ বন্ধ কর, গলায় মশা ঢুকে যাবে। অত অবাক হওয়ার কি আছে শুনি? গরু দেখোনি না কি?"
"নাআআ কিন্তু ..." কথা বলব কি, গলা আটকে যাওয়ার জোগাড়।
"আরে বাবা দিদির খোঁজে এসেছিলাম। তা দিদি তো শুনলাম দ্যুলোকে পাড়ি দিয়েছেন। কোথায় যাব ভাবছিলাম, তারপর জানলা দিয়ে তোমায় দেখে বোকাসোকা ভালোমানুষ মনে হল তাই ঢুকে পড়লাম।"
"দিদি ???"
"দিদি মানে তোমরা যাঁকে মহাশ্বেতা দেবী বল। পাশে সন্দেশ পত্রিকাটা ওল্টানো রয়েছে দেখতে পাচ্ছি, অথচ আমায় চিনতে পারছ না?"
"ন্যা ন্যা ন্যা ..."
"এই তো মাথা খুলেছে, গলাটা খুলছে না কেন। হ্যাঁ আমিই ন্যাদোশ। যাক গে শোন আমি গোলোক থেকে আসছি। গোলোক বোঝ তো? তুমি আবার যা হাঁদাগঙ্গারাম! মানুষ মরলে যেমন দ্যুলোকে যায়, গরু মরলে তেমনি গোলোকে যায়।"
বোতল থেকে দু-ঢোক জল খেয়ে আর ঘাড়ে মাথায় একটু ছিটিয়ে খানিকটা ধাতস্থ হয়ে বললাম, "হ্যাঁ জানি বইকি। সন্দেশে পড়েছি। তুমি মহাশ্বেতা দেবীর পোষা গরু ছিলে। তুমি না কি মাছ মাংস খেয়ে গিনেস বুকে নাম তুলেছিলে?"

"সেসব দিনের কথা আর বোলো না। গো-লোকে এখন মাছ মাংসের সাপ্লাই বন্ধ হয়ে গেছে। কতদিন যে বীফ খাইনি!" উদাস চোখে জানলা দিয়ে তাকিয়ে বলল ন্যাদোশ।
"তুমি বীফ খেয়েছো? এটা তো একরকমের ক্যানিবলিজম! গরু হয়ে গরুর মাংস খাওয়া!"
"আরে রাখো তোমার ইজমের কচকচি। গো-লোকে ক্যানিবলিজম, ন্যাশনালিজম কোন ইজমই নেই। আরে বাবা যে গরুর মাংস খেয়েছি সে তো মরে গিয়ে আমাদের সঙ্গেই যোগ দিয়েছে, না কি?"
মাথা চুলকে বল্লুম, "হুম্ম। ব্যাপারটা বেশ গোলমেলে দেখছি"
"গোলমেলে আবার কিসের? তোমরা মানুষরা বড্ড বেশী ভাবো। ঐজন্যেই তোমাদের মাথা আউলায়ে যায়। এই তোমাদের জন্যেই মর্ত্য থেকে মাংস রপ্তানি বন্ধ হয়ে গেছে। এখন অবশ্য গো-লোকে কাউলেস বীফ আসছে।"

"কাউলেস বীফটা আবার কি?"
ন্যাদোশ দাঁত খিঁচিয়ে উঠল, "ক্যাশলেস ইকনমি বোঝ আর কাউলেস বীফ বোঝ না? কাউলেস বীফে মানুষের মাংস থাকে। যেসব মানুষ খাঁটি দেশপ্রেমিক নয় তাদের মাংস। ভালোই খেতে। সে যাক, যেজন্যে মর্ত্যে এসেছিলাম সেটা বলি। ভূলোকে নাকি আজকাল গরু খাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে? আর গরুরা সব গোমাতা হয়ে যাচ্ছে?"
"হ্যাঁ সে তো ভালোই।"
"ভালো আবার কোথায় পেলে এর মধ্যে? পৃথিবীতে গরু মরছে না বলে তো গোলোকে পপুলেশন কমে যাচ্ছে। যে কটা গরু মরছে তারা গোলোকে না এসে গোমালোকে চলে যাচ্ছে। এরকম চলতে থাকলে তো গোলোক পুরো ফাঁকা হয়ে যাবে!!"
"গোমালোক?"
"গোমাতা দের লোক আর কি!"
"ও আচ্ছা। তা গোলোক ফাঁকা কেন হবে বুঝলাম না। যারা এখনো গোলোকে আছে তারা তো আর দ্বিতীয়বার মরবে না?"

"তোমার দেখছি বিদ্যেবুদ্ধি কিস্যু নেই। বলি বিগ ব্যাং থিয়োরির কথা জানো? ইউনিভার্স যে এক্সপ্যান্ড করছে সে খবর রাখো? দ্যুলোক, গোলোক সবই তো ইউনিভার্সের গায়ে চাদরের মত জড়িয়ে আছে। তাই ইউনিভার্সের সঙ্গে সেগুলোও এক্সপ্যান্ড করছে। এখন নতুন গোরুরা ভূলোক থেকে না গেলে গোলোক ফাঁকা হয়ে যাবে না?"
মাথাটা আরো ঘুলিয়ে গেল। কিন্তু এর যা রকম সকম দেখছি বেশী প্রশ্ন করতে গেলে ঐ শিং দিয়ে গুঁতিয়ে না দেয়! তাই তাড়াতাড়ি মাথা নেড়ে বললাম, "ও আচ্ছা আচ্ছা বুঝেছি।"

"এ আর না বোঝার কি আছে! যাই হোক আগে তো এসব সমস্যার কথা দিদিকে এসে বলতাম। দিদি অনেকবার দুঃখ দুর্দশার কথা কাগজে লিখেছেন। এখন দিদি নেই। তোমাকে পেলাম তাই বলে গেলাম। তোমাদের ঐ ফেসবুক না কি যেন আছে তাতে ছাপিয়ে দিও। আমি মানুষের ভাষায় কথা বলতে পারি বলে গো-লোকের গোরুরা আবার আমাকেই প্রতিনিধি করে পৃথিবীতে পাঠায়।"
"মহাশ্বেতা দেবী তো দ্যুলোকে আছেন। তোমরা ওখানে গিয়ে ওনার সঙ্গে দেখা করতে পারো না?"
"আগে পারতাম। এখন আর পারি না। আমাদের আধার কার্ডের ব্যবস্থা হচ্ছে। ওটা হয়ে গেলেই যেতে পারব। তাছাড়া উনি তো নাস্তিক! দ্যুলোকে আছেন কি না তাও জানি না। তাই বলছি এসব কথা তোমাকেই লিখতে হবে।"
"নিশ্চয়ই। লিখবো তো বটেই। তোমার থুরি আপনার আদেশ কি অমান্য করতে পারি? গোমাতা বলে কথা!"
যেই না বলেছি, গরুটা বিষম রেগে শিং নেড়ে তেড়ে এলো, "গোমাতা বলে গাল দিচ্ছিস কেন রে? আমি গোমাতা নই, ন্যাদোশ" বলেই পেটে মারল এক গুঁতো।

চোখ মেলে দেখি গিন্নি পেটে খোঁচা দিচ্ছে আর চেঁচাচ্ছে, "ওঠো ওঠো। ভরসন্ধেবেলায় চারটে মোটা মোটা বই আর মোবাইল নিয়ে নাক ডাকাচ্ছে। কি ঘুমোতেই না পারে লোকটা!"


ছবিটা "সন্দেশ" পত্রিকা থেকে নেওয়া। মহাশ্বেতা দেবীর "গল্পের গরু ন্যাদোশ" গল্পে সত্যজিৎ রায়ের অলঙ্করণ।

Wednesday, 10 May 2017

পাহাড়ের ডায়েরি (৪)


কুমারের কপচানি


বেড়ানো অনেক রকমের হয়। কেউ যান দুর্গম গিরি কান্তার মরু পেরিয়ে অজানা দেশের সন্ধানে। কেউ চান প্যাকেজ ট্যুরে যাবতীয় দর্শনীয় স্থান দেখে নিতে। কারো পছন্দ আবার স্রেফ শহরের কোলাহল, ব্যস্ততা ভুলে দুটো দিন নিভৃতে নির্জনে কাটাতে। আমরা আবার কোন ব্যাপারেই কট্টরপন্থী নই। তাই ভ্রমণের সবরকম স্বাদই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নিতে চাই। হিলে-ভার্সের সাড়ে চার কিলোমিটার ট্রেক, খাবার ও জলের অপ্রতুলতা, বিদ্যুৎ, নেট ও নেটওয়ার্ক হীনতা - এগুলো উপভোগ করিনি বললে ভীষণ ভুল হবে। তেমনি ছোট্ট একখানি নীড়ের জন্য ভেতো বাঙালী মনটা টান দিচ্ছিল তা-ও অস্বীকার করতে পারিনা। 




তাই এঁকাবেঁকা পাহাড়ি রাস্তা বেয়ে আমাদের গাড়ি যখন ছবির মত সানবার্ড হোমস্টের সামনে এসে দাঁড়ালো আর লাল টুকটুকে দুই নেপালি ছোকরা পেমা আর নিমো আমাদের ব্যাগগুলো ছোঁ মেরে নিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে ওপরে উঠে গেল আর লজের মালিক পেমা সিরিং শেরপা আমাদের হাসিমুখে অভ্যর্থনা জানিয়ে ঘরে নিয়ে গেলেন তখন মনে হল আহ এটাই স্বর্গ! ছোট্ট ঘর, বাইরে একটা ব্যালকনি। জানলার ওপারে দেখা যাচ্ছে বিস্তীর্ণ পাহাড়ের সারি। পাহাড়ের গা কোথাও নেড়া, বেশীরভাগ জায়গাতেই সবুজে ঢাকা। আরো ভালো করে তাকালে দেখা যাবে আনেক জায়গাতে ধাপ কেটে চাষ হচ্ছে, তার মধ্যে ছোট্ট একটা কুঁড়েঘর। কোথাও আবার গ্রাম ধরণের, খেলনাবাড়ির মত অনেকগুলো ঘর। আর এর মধ্যে সাপের মত এঁকেবেঁকে রাস্তাটা ছোট হতে হতে দূরে হারিয়ে গেছে। মাঝে মাঝে গাছপালা, পাহাড়ের মধ্যে রাস্তাটা চাপা পড়ে গেছে, আবার কিছুদূরে গিয়ে উদয় হয়েছে।  





বোঝা গেল এই ঘর বাড়ির লোকেরাই ব্যবহার করেন, আমরাই প্রথম অতিথি। পেমাদাজু বিছানাপত্র ঠিক করতে করতে বললেন, "এসব কাজ নতুন করছি, ভুল হয়ে গেলে মাফ করবেন!" সরকারের থেকে লীজ নিয়ে এই লজটা তাঁরা চালু করেছেন মাত্র ২ মাস আগে। ভার্সের গুরস কুঞ্জের সর্বেসর্বা পাসাং শেরপা এনারই দাদা। পাসাং-এর গাইডেন্সেই উনি এই হোমস্টেটা চালাচ্ছেন। সরু চালের ভাত, তরকারি আর ডিমের ঝোল দিয়ে লাঞ্চ করতে করতে কথা হচ্ছিল পেমা সিরিং এর স্ত্রী ফুর্বা ডিকি শেরপার সঙ্গে। ভদ্রমহিলা গ্যাংটক থেকে ২১ কিমি দূরে নামথাং এ কৃষি দফতরে চাকুরিরতা। সপ্তাহান্তে ওখরেতে এসে স্বামীকে সাহায্য করেন। তাঁদের ন মাসের ফুটফুটে গোলগাল মেয়ে ছিমি সোরেং তো শ্রীরূপার কোল ছেড়ে নামতেই চায় না। ফুর্বা ডিকি বলছিলেন, "সংসার আর কাজের অ্যাত টানাপোড়েন, মাঝে মাঝে মনে হয় চাকরি ছেড়ে দিই।" শ্রীরূপা বলল, "সব জায়গাতেই মেয়েদের এই সমস্যা।" চমৎকার লাঞ্চের জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে তাঁকে আবদার করে এলাম, "কাল কিন্তু আপনার হাতে গড়া সিকিমি মোমো খাচ্ছি!" 




ভার্সের তুলনায় ওখরে অনেকটা নিচে হলেও সেদিন প্রচণ্ড ঝড়বৃষ্টির কারণে ঠাণ্ডাটা ভালোই ছিল। এই আবহাওয়ায় বেরনোর প্রশ্ন নেই। তাছাড়া গত দুদিন হিলে, ভার্সে তে ঠিকমত ঘুম হয়নি। তাই একটার ওপর একটা কম্বল চাপা দিয়ে ভাতঘুমটা সেরে নিলাম। ঘুম ভাঙল পেমাজির শ্যালিকার ডাকে। আমাদের জন্য গরম গরম পকোড়া আর চা নিয়ে এসেছেন তিনি। বৃষ্টি তখনো পড়ছে, তবে বেগ কমেছে। দিনের আলো কমে এসেছে। পাহাড়ের গায়ে বাড়িগুলোয় আলো জ্বলে উঠতে দেখা যাচ্ছে। অনির্বান, বব, পল্লব গোর্খে গেছে, এই বৃষ্টিতে ঠিকমত পৌঁছাল কি না চিন্তা হচ্ছিল, কিন্তু তিনজনের ফোনেই বারবার চেষ্টা করেও লাইন পেলাম না। ওখরে নেটওয়ার্ক দুনিয়ার মধ্যে, গোর্খে নয়। বার বার কারেন্ট চলে যাচ্ছিল। একটা ফাঁকা মদের বোতলের মুখে মোমবাতি বসানো ছিল। সেটা জ্বালিয়ে মোবাইলে ডাউনলোড করে রাখা সানডে সাসপেন্স চালিয়ে দিলাম। মোমবাতির আলোয় বর্ষণস্নাত পাহাড়ি গ্রামে সিকিমি চা-এর সঙ্গে জমে উঠল শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঐতিহাসিক গল্প।




পরের দিনটা ছিল রবিবার। এখানে এসে অবশ্য বার তারিখ কিছুরই হিসেব রাখার দরকার ছিল না। টিভি-কাগজ-ইন্টারনেট হীন এক নতুন রাজ্যে যেন বাস করছিলাম। সকালবেলায় আকাশ একদম পরিস্কার। অনির্বান ঠিকই বলেছে, "প্রেমিকার মতন পাহাড়েরও মন বোঝা দায়, খামখেয়ালি কিন্তু বড়ই প্রিয়!" (পাহাড়ের ডায়েরি ৩)। সানবার্ড লজের আতিথেয়তার জবাব নেই। আমরা ঘুম থেকে উঠেছি টের পেয়েই হাসিমুখে ধোঁয়া ওঠা চা নিয়ে এল পেমা। পেমা আর নিমা - পেমা সিরিং এর দুই আসিস্ট্যান্টের মুখে হাসি ছাড়া কিছু দেখিনি। সকালটা ঘরে বসে নষ্ট করার মানে হয়না। তাই চা খেয়েই বেরিয়ে পড়লাম। একটা অদ্ভুত পরিবেশ। চারদিকে নানারকম গাছ, তাদের কতরকম পাতা, ফুল। পাথরের গায়ে ফুটে আছে ফার্ন জাতীয় গাছ, বুনোফুল। সকালের নরম রোদ উঁকি মারছে পাতার ফাঁক দিয়ে। চারদিক নিস্তব্ধ, খালি কিছু পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে। দূরের কোন পাহাড়ি গ্রাম থেকে একটা কুকুরের ডাক পাওয়া যাচ্ছে। মাঝে মাঝে গাড়ির আওয়াজ আসছে অনেক অনেক দূর থেকে। তারপর আওয়াজটা জোর হতে হতে আমাদের পাশ দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে।     




দুপুরের মধ্যেই তিনমূর্তি ফিরে এল গোর্খে থেকে। লাঞ্চ করতে করতে ওদের গোর্খে ট্রেকের গল্প শুনলাম। সেসব গল্প আপনারাও নিশ্চয়ই শুনে ফেলেছেন পাহাড়ের ডায়েরি (৩) এ? সন্ধ্যায় চা আর মোমো খেয়ে লজের সামনের লনে কাঠে আগুন জ্বালিয়ে ক্যাম্প ফায়ার হল। গল্প আড্ডার পর শুরু হল গানের লড়াই। খানিকবাদে আমাদের সঙ্গে যোগ দিলেন পেমা সিরিং। কথায় কথায় জানা গেল তিনি বাঁশি বাজাতে পারেন। নিজে নিজেই বই-টই পড়ে শিখছেন দু বছর ধরে। আমাদের উপরোধে জনপ্রিয় নেপালি গান "রেশম ফিরি রে"র সুর তুললেন বাঁশিতে। তারপর মোবাইলে আরেকটা নেপালি গানের সঙ্গে শুরু হল নাচ। প্রেম সিরিং এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে নেচে গেল পল্লব। ক্রমশ আগুন নিভে এল। আমরা উঠে পড়লাম। ব্যাগপত্র গুছিয়ে নিতে হবে। সকালেই রওনা দেবো এনজেপির উদ্দেশ্যে। সিকিম ভ্রমণ এবারের মত সাঙ্গ হল।

রাত্রে খাওয়ার জন্য ডাইনিং এ এসে দেখি পাসাং বসে আছেন। মাথায় ডেভি'স ল্যাম্পের মত আলো সমেত বেল্ট, সামনের টেবিলে মদের গ্লাস। তখন দশটা বাজে। বললেন এখান থেকে উঠেই ভার্সে যাবেন। কেমন আছেন জিজ্ঞেস করতে বললেন, "এভরিথিং ইজ ফাইন, হোয়েন অন দা টেবল দেয়ার ইজ আ গ্লাস অফ ওয়াইন!"





অনির বচন



"মেঘপিওনের ব্যাগের ভিতর মনখারাপের দিস্তা 
মন খারাপ হলে কুয়াশা হয়, ব্যাকুল হলে তিস্তা
মন খারাপের খবর আসে বনপাহাড়ের দেশে 
চৌকোন সব বাক্সে যেথায় যেমন থাক্ সে, 
মনখারাপের খবর পড়ে দারুণ ভালোবেসে..."
সত্যি হয়ত আমাদের সাথেসাথে পাহাড়েরও মনখারাপ, নাহলে বেলাশেষে এত কুয়াশা সারা ওখরে জুড়ে! তিনজনে গোরখে থেকে ফিরেছি দুপুরবেলায়। ঠিক ছিল একটু রেস্ট নিয়েই ওখরেটা বিকেলের মধ্যেই দেখে নেব। পল্লব বলেছিল ওখরেতে মনেস্ট্রীটা অ্যাট লীস্ট দেখতেই হবে। সেইমত ঠিক হল চারটে নাগাদ পাঁচজনেই বেরোবো। অতনু শ্রীরূপা আগেরদিনই এসে গেছে তাই ওরা ওখরের ব্যাপারে আমাদের চেয়ে একটু বেশি ইনফর্মড। ওরাই বলল মনেস্ট্রী যাওয়ার দুটো ওয়ে আছে একটা তিনশ সিঁড়ি চড়াই আরেকটা শর্টকাট। আর স্বাভাবিকভাবেই আমরা শর্টকাটটাই বেছে নিলাম।

দুপুরের ওয়েদার ছিল একদম পরিষ্কার কিন্তু বেলা বাড়তেই দেখলাম খারাপ হতে শুরু করেছে। সানবার্ড হোমস্টে থেকে ভিউ চমৎকার । জানালা দিয়েই দেখা যায় সিঙ্গালীলা রেঞ্জের প্যানারোমিক ভিউ। বাঁদিক ঘেঁষে সিঙ্গালীলার হায়েস্ট পয়েন্ট সান্দাকফু তারপর ফালুট, শ্রীখোলা, গোরখে আর একদিকে রিম্বিক আর ঠিক তার পিছনেই "অতিধীর, গুরুগম্ভীর" হিমালয়। হোমস্টের ডরমিটরির কাঁচের বিশাল জানালা দিয়েই দেখতে পেলাম কুয়াশার মতন মেঘ ভেসে আসছে আমাদের দিকে।




শর্টকাটটা হোমস্টে থেকে বেড়িয়ে বাঁদিকে । সেই দিকে কিছুক্ষণ হাঁটার পরও আমরা কোনো রাস্তা পেলামনা তারপর আরেকটু এগোতেই চোখে পড়ল ডান দিকের পাহাড়ের গায়ে কিছু ফুটস্টেপস্। সিঁড়ি বা রাস্তা বলে কিছু নেই বরং সেই ফুটস্টেপস্ গুলোই খাঁড়া উঠে গেছে উপরেরদিকে। কোথায় গেছে নীচ থেকে ঠাওর করা যাচ্ছেনা। শর্টকাটের এমন বহর দেখে অতনু শ্রীরূপা রনে ভঙ্গ দিল বলল ওরা নীচেই ঘুরে কাটবে বিকেলটা সম্ভব হলে তিনশ সিঁড়িযুক্ত পথটা ধরবে। শেষঅবধি আমরা তিন বাঙলা মায়ের দামাল ছেলে আবার পাহাড় চড়া শুরু করলাম। ডেস্টিনেশন ওখরে মনেস্ট্রী।

ওঠার পথ বলতে কিছুই নেই।সেই দিয়েই কোনোরকমে তিনজনে উপরে উঠলাম। দুপুরের ওইরকম জম্পেশ্ খাওয়ার পর এই চড়াই ভাঙার জন্য রীতিমত কসরত করতে হল তিনজনকেই। উপরে উঠে পাকদন্ডী বেয়ে একটু গিয়ে যখন পাকা রাস্তা পেলাম তখন আমাদের চারপাশে এক কুয়াশাচ্ছন্ন বিকেল। এইসব দিকে লোকজন অনেকটা কম, তাই মনেস্ট্রীটা কোনদিকে জানার জন্য লোক পাচ্ছিলামনা তার উপর এমন মেঘ যে দশহাত ডিসটেন্সও পুরো ব্লাইন্ড। পলু ভরসা । ও ওর ইনবিল্ট জিপিএস নেভিগেট্ করে ডান দিক ধরে হাঁটতে শুরু করল ,আমরাও ওর পিছু নিলাম। মেঘের ভিতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে খালি মনে হচ্ছিল যেন সময় থেমে গেছে। এখানে সময় থেমে থাকে পাহাড়ের গায়ে, নাম না জানা পাখিদের গলায়, পাইনের শ্যাওলা-ধরা কান্ডে, যে লোকগুলো মাথায় কিলোকিলো সামান চাপিয়ে টুকটুক করে এগিয়ে আসে তাঁদের পায়েপায়ে। সময় থেমে থাকে।




পলুর আন্দাজ একদম ঠিকঠাক। কিছুটা গিয়েই আবছা চোখে পড়ল একটা ঘর আর দুটো স্তুপ। অনেকগুলো লম্বাটে পতাকা উড়ছে। আসার সময়ই জেনে ছিলাম এই পতাকাগুলোতে লেখা থাকে সম্ভবত টিবেটিয়ান ভাষায়। মনেস্ট্রীর নাম "দি উরগেন থং মনলিং মনেস্ট্রী"। ১৯৫২ তে দরজী লামা এটি তৈরি করেন এবং ১৯৬৬ তে দুক্পা লামা দায়িত্বে এসে এখানে একটি ছেলেদের মনেস্টিক স্কুল স্থাপন করেন যেটি আজও চলছে। বর্তমানে ৪৫ জন বৌদ্ধ ভিক্ষু আছেন এই মনেস্ট্রীতে। "মঙ্ক " থেকেই এসেছে "মনেস্ট্রী" আর "মঙ্ক "এসেছে "মনো" থেকে। অ্যালোন। বৌদ্ধইসম্ এর তত্ত্বীয়ভাব বোধিলাভ। কে জানে হয়ত একাকীত্বই বোধলাভের একটা পথ!

বাইরের ঘিরে থাকা প্রেয়ার হুইল ঘুরিয়ে তিনজনে ঢুকে গেলাম মনেস্ট্রীর ভেতরে । ভিতরে দুজন লামা ছিলেন । একজন একটা বই পড়ছিলেন ঠিক যেমনটি আমরা পাঁচালি পড়ি তেমনটি , আরেকজন একটি ছবি পরীক্ষণ করছিলেন। মনেস্ট্রীর ভেতরে অদ্ভুত এক অ্যাম্বিয়েন্স। ববের একদম শান্তভাব আর পলু চারদিকে ঘুরে ঘুরে মোবাইলে ছবি তুলতে লাগল। ভিতরের দেওয়াল আর ছাদ কাঠের আর তার উপর অদ্ভুত কারুকার্য করা। "ওয়ার্ক অব্ আর্ট"। মনেস্ট্রীর উপাস্য দেবতাটিও অদ্ভুতদর্শন। পলু জিগ্গাসা করাতে জানা গেল নাম গুরু রিন্পোচে। তাঁর এক পাশে বুদ্ধের ইন্কারনেশন্। এছাড়াও আরো অনেক কিছু যেমন দুটো শাঁখ যাকে বলে "কারদুং", দুটো বড় (দুংচেন) আর দুটো ছোট(কাংলিং) ট্রাম্পেট জাতীয় বাজনা, কয়েকটা বই, কাঠের বাঁশি জাতীয় একটা বাজনা (গিয়ালিং) আর কিছু লাল শালুজাতীয় কাপড়।




কিছুক্ষণ থেকে আমরা বেড়িয়ে এলাম। বব একদম নেতিয়ে গেছল। বেড়িয়ে এসে বললাম "ওম মনি পদ্ মে হুম", পলু জবাব দিল "হুমম্"। মনে হল ববেরই যেন এই ক'মিনিটে বোধিলাভ হয়ে গেছে। বেড়িয়ে দেখলাম তখনো আলো আছে। পলু ওখানেই একটি কালো তুলতুলে কুকুরছানাকে চট্ করে দিব্যি আদর করে নিল। তারপর আমরা ফেরার পথ ধরলাম, সামনে সেই তিনশ সিঁড়ির উতরাই।

মেঘ তখন একটু পাতলা হয়ে এসেছে আমরা পাইনবনে ঘেরা আঁকাবাঁকা সিঁড়িপথ দিয়ে এসে নামলাম পাকা রাস্তায়। মাইলস্টোনে লেখা টেন মাইল। বুঝলাম আমরা সানবার্ড থেকে এক মাইল দূরে আছি কারন ওটা ইলেভেন মাইলে। পাহাড়ের রাস্তা ধরে গোধূলিকালীন আলোতে ফেরার অনুভূতি আলাদা। পাকদন্ডী পথ। আমরা এগিয়ে চলেছি হোমস্টের দিকে। দুপাশে গাছেদের সারি পাহাড় থেকে নেমে এসেছে রাস্তার ধারে। দুটো বাঁক নিতেই চোখে পড়ল আমাদের আস্তানাটা। দূর থেকে দেখা যাচ্ছে। মনে হল এই তো এসে গেছি কিন্তু আসছে কোথায়? পাহাড় হল মেয়েদের মন ,মনে হয় নাগালের মধ্যেই তো আছে কিন্তু যত কাছে যাওয়া যায় ততই দূরে সরে যায়। বড়ই কঠিন বাস্তব।
তিনজনে এগিয়ে চললাম। বব রাস্তায় শুয়ে পোজ্ দিয়ে খানকতক ছবি তুলে নিল। হঠাৎ ববের মাথার কাছদিয়ে চৌকো ঘুড়ির মত কি একটা উড়ে এ গাছ থেকে ওগাছে চলে গেল। "জায়েন্ট ফ্লাইং স্কুইরল্" গ্লাইড করে চলে গেল আমাদের সামনে দিয়ে। ঠিক যেন একটা বাদামী রঙের খোলা বই উড়ে গিয়ে পড়ল। তিনজনে দেখলাম একটা গাছের ডালে গিয়ে আটকে রইল চুপচাপ। এ ও এক দেখা।




পাক্কা আড়াই ঘন্টা লাগল। চারটে তে বেড়িয়ে ফিরলাম সাড়ে ছটায়। পেমাজিকে বলে একটা ক্যাম্পফায়ার অ্যারেঞ্জ করা হল। শ্রীরূপা আগে ফিরেই মোমোর ব্যাবস্থা করে রেখেছিল ,এসব ব্যাপারে ও ঠিক "মায়ের মতন ভালো"। সান্ধ্যভোজ সেরে আমরা চললাম ক্যাম্পফায়ার করতে। পলু শ্রীরূপা আর বব গাইবে আমি আর অতনু বেসুরো (বরং অসুর বলা ভালো) তাই আমরা শ্রোতা। অদ্য শেষ রজনী , তাই শেষটুকু চেটেপুটে নেওয়া আর কি! কাল ভোরেই তো ফেরা।
মনে পড়ে যাচ্ছে "তিতলির" সেই গান যেটা দিয়ে শুরু করেছিলাম ,


"...মেঘের ব্যাগের ভেতর ম্যাপ রয়েছে,
মেঘপিওনের পাড়ি,
পাকদন্ডী পথ বেয়ে তার
বাগানঘেরা বাড়ি
বাগান শেষে সদর দুয়ার
বারান্দাতে আরামচেয়ার
কালচে পাতা বিছানাতে ছোট্ট রোদের ফালি
সেথায় এসে মেঘপিওনের সমস্ত ব্যাগ খালি..."

কিন্তু আমাদের ব্যাগ খালি নেই বরং ভরে উঠেছে দারুন এক ঘোরার আনন্দে,অনন্য অভিজ্ঞতায়....!!

পেমা সিরিং এর বাঁশিতে "রেশম ফিরি রে" শুনুন এই ভিডিওতেঃ 


ওখরের সানবার্ড লজের ডিটেলস

Sunbird Lodge
Okhrey, West Sikkim - 737121
P. T. Sherpa. (Phone - 9647811674)
pema.ribdi@gmail.com


অন্যান্য পর্বের লিঙ্কঃ

পাহাড়ের ডায়েরি (১)
পাহাড়ের ডায়েরি (২)
পাহাড়ের ডায়েরি (৩)