Saturday, 27 May 2017

পাহাড়ের ডায়েরি (৫)

 শ্রী-তনু-র শেষকথা


সাড়ে নটা বেজে গেল কিন্তু সাগরভাই বা তার গাড়ির দেখা না পেয়ে সবারই কপালে চিন্তার ভাঁজ। এন জে পি তে ট্রেন বিকেল ৬টায়। এমনি তে ৭ ঘন্টার রাস্তা। কিন্তু অনি বলেছে যতটা পারা যায় সময় হাতে নিয়ে বেরোতে হবে। পাহাড়ি রাস্তা কখন কোথায় ধ্বস টস নেমে বন্ধ হয়ে যায় তার ঠিক থাকে না। আমরা দাঁড়িয়ে ছিলাম ওখরের সানবার্ড লজের সামনে। সিকিম ভ্রমণ সাঙ্গ করে এবার আমাদের ফেরার পালা। গতকাল পূর্বা ডিকি দিদির হাতে গড়া সিকিমি মোমো আর আড্ডা, ইয়ার্কি, নাচ, গান, নেপালি বাঁশির সুরে ক্যাম্প ফায়ারের মাধ্যমে জমে উঠেছিল সিকিম ট্রিপের অন্তিম রজনী। এত আনন্দের মাঝেই মনখারাপের মেঘ ঘনিয়ে আসছিল। কাল সকাল থেকেই আবার যে যার জীবনে ফিরে যাব। মনের মেঘ কাটাতে তাই বেশী করে করে পরের ট্রিপের প্ল্যান এর দিকে মনোনিবেশ করছিলাম। 


সাগরভাইয়ের দেখা পাওয়া গেল তখন ঘড়ির কাঁটা দশটা ছুঁই ছুঁই। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে পেমা সিরিং এর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে মালপত্তর নিয়ে গাড়িতে উঠে পড়লাম। ঠাণ্ডা হাওয়া তখনও হাড় কাঁপাচ্ছিল। মনে মনে ভাবলাম আর কিছুক্ষণ, তারপরেই এই এক দমক ঠাণ্ডা হাওয়ার জন্য মনটা হু হু করে উঠবে। এঁকা বেঁকা রাস্তা দিয়ে গড়ি ছুটছিল। একদিকে পাহাড়, অন্যদিকে ধাপ কাটা উপত্যকা। কোথাও নদী আবার কোথাও বা গভীর খাদ। মনে হচ্ছিল কোন video যেন rewind করছি। ঠিক যেমন যেমন হচ্ছিল আসার দিন, আজও ঠিক একই রকম সবকিছু। সেই রাস্তা, সেই প্রকৃতি, সেই সাগরভাইয়ের বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন জিনিস পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব, সুন্দরী মেয়েদের লিফট দেওয়া, গাড়ীর অডিও জ্যাকে আমাদের মোবাইল গুঁজে চিরপরিচিত গান। তফাৎ শুধু একটাই - যাওয়ার দিন মনে ছিল অসম্ভব একটা আনন্দ, curiosity, excitement আর এখন মনে পরিতৃপ্তির স্বাদ আর অল্প অল্প মনখারাপ।

২টোর সময় যখন শিলিগুড়ির কাঞ্চনজঙ্ঘা স্টেডিয়ামের সামনে নামলাম তখন মনে হল যেন স্বর্গ থেকে নরকে নেমে এসেছি। গাড়ির জ্যাম আর প্রচণ্ড গরমে মনে হচ্ছিল শিলিগুড়ি নয়, কলকাতার এম জি রোডে দাঁড়িয়ে আছি! বব চটপট সবার জন্যে আখের রস এনে দিল। ছায়ায় দাঁড়িয়ে সেটা শেষ করার আগেই দেখি দলনেতা অনির্বান সামনের দিকে হাঁটা লাগিয়েছে। অনির্বানকে নেতার পদে পেতে হলে এটা মেনে নিতেই হবে। ও কোথায় যাচ্ছে, কেন যাচ্ছে কোন প্রশ্ন করা চলবে না। শুধু বাধ্য সৈনিকের মত অনুসরণ করতে হবে। তবে অনুসরণ করে পস্তেছি বলা যাবে না। এবার যেমন অনির্বানের পিছু পিছু গিয়ে দাঁড়ালাম "হোটেল নন্দিতা"র সামনে। হোটেল দেখেই খিদেটা চাগাড় দিয়ে উঠল। মধ্যাহ্নভোজ শেষ করে উঠে অনির্বান বলল, "পান খাবি তো? চকোলেট পান?" একে পান, তার ওপর চকোলেট! এ লোভ কি সামলানো যায়! আবার সকলে লিডারকে অনুসরণ করলাম।

এতদিন লালরঙের ভিজে কাপড় দিয়ে পানপাতা চাপা দেওয়া গুমটি থেকে ৬ টাকার পান কিনে খেয়েছি। শিলিগুড়ির পান প্যালেসে এসে চমকে চ! কাঁচে ঘেরা শীততাপনিয়ন্ত্রিত দোকান। একদিকে নানা ধরণের তামাক আর পানীয় রয়েছে। চাইলে হুঁকোও খাওয়া যেতে পারে। অন্যদিকে বিভিন্ন রকম পান আর আইসক্রিমের সম্ভার। চটপট চকোলেট পান চলে এল সাদা প্লেটে করে। সাধারণ পানের দ্বিগুণ। ওপরে চকোলেটের কোটিং তার ওপর একটা লাল চেরী বসানো। বেশ কসরত করে কামড় দিলাম। চকোলেট, মিঠা পাতা পান আর হরেক রকম ড্রাই ফ্রুটসের অংশবিশেষ স্বাদকোরক ছুঁতেই অদ্ভুত একটা স্বর্গীয় শান্তি অনুভব করলাম। একে পান বললে ভুল হবে, একটা গোটা মিলের সমান! অনি যদি আগে বলত লাঞ্চ টা স্কিপ করে পানভোজন করেই কাটিয়ে দিতাম। এই চকোলেট পান দলনেতার তরফ থেকে আমাদের ট্রিট। পান খাইয়ে ট্রিট দেওয়া শুনে যাঁরা ভুরু কোঁচকাচ্ছেন তাঁদের জানিয়ে রাখা যাক আমরা যে চকোলেট পানগুলো খেলাম তার এক একটার দাম ১৩৫ টাকা। দেয়ালে টাঙানো রেট চার্ট দেখে আরো জানা গেল ঐ দোকানের সবচেয়ে দামী পানের দাম ৭০০ টাকা! 
 

উত্তরবঙ্গ এক্সপ্রেস এনজেপি ঢুকলো আধঘন্টা দেরিতে। আমাদের সবারই সিট একসঙ্গে পড়েছিল। খালি পল্লবের একটু দূরে। এক্সচেঞ্জ করার লোক খুঁজে খুঁজে যখন হাল ছেড়ে দিলাম তখনই জানলার ধার থেকে একটা দাড়িওলা ছেলে গোঁফের তলা দিয়ে হাসতে হাসতে বলল, ''চিন্তা করবেন না, আমি ঐ সিটটায় চলে যাব।" হাতে একটা বই নিয়ে বসে সে আমাদের কার্যকলাপ দেখছিল। কিন্তু তাকে আর ছাড়া গেল না। কারণ কয়েক মিনিটের মধ্যেই সেই সুজন বণিক আমাদের গ্রুপে একদম খাপে খাপ হয়ে মিশে গেল। ডিটেকটিভ গল্প থেকে ফুটবল, বেড়ানো থেকে খাওয়াদাওয়া আড্ডা আর হাসিঠাট্টায় তুফান তুলে অন্য সহযাত্রীদের যথেষ্ট বিরক্তি উৎপাদন করে যখন শোয়ার তোড়জোড় করলাম তখন আর খেয়াল করা হল না কে কার সিটে শুচ্ছে! 

আগামীকাল ভোরের আলো ফোটার আগেই যে যার গন্তব্যে নেমে পড়ব। কিছু কিছু সময় থাকে যেখানে আমরা আটকে যাই। এই ৫ দিন ঠিক তেমনি। অসাধারণ অবাক করা প্রকৃতি আর আমরা ৫ জন এমন বন্ধু যারা শুধু বন্ধু নয়, একটা পরিবারের অংশ। আড্ডা, গল্প, হাসি, ইয়ার্কি, অ্যাডভেঞ্চার - প্রকৃতির এক অদ্ভুত কম্বিনেশন। আজও ওখানেই আটকে আছি। রোজই স্বপ্ন দেখি কোন এক অজানা রাস্তায়, অপরিচিত পরিবেশে আমরা পাঁচজন খিল্লি করতে করতে হেঁটে চলেছি।

অপেক্ষা নেক্সট ট্রিপের।



ট্যুর প্ল্যানঃ

ট্রেনযাত্রা বাদ দিয়ে এই ট্রিপটা পাঁচদিনের। প্রথমদিন সকাল সকাল নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে নামুন। শেয়ারে বা রিজার্ভ করে গাড়ি নিয়ে ১৩০ কিলোমিটার দূরে ওখরে বা আরো ১০ কিলোমিটার এগিয়ে হিলে তে চলুন। ৭-৮ ঘন্টা লাগবে। হিলে তে একটি মাত্র ট্রেকার্স হাট। থাকার ব্যবস্থা আরামদায়ক নয়। ওখরে তে অনেক ভালো লজ/ হোমস্টে পাবেন। কিন্তু ওখরে তে থাকলে পরদিন সকালে গাড়ি করে হিলে যেতে হবে। দ্বিতীয়দিন ২-৩ ঘন্টা ট্রেক করে ভার্সে যান। ভার্সেতে গুরস কুঞ্জ বা ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের লজে থাকুন। তৃতীয়দিন সকালে ট্রেক করে হিলেতে নামুন। সেখান থেকে ২ ঘন্টা গাড়িতে ভোরেং যান। ভোরেং থেকে আবার ঘন্টা দুয়েকের ট্রেক করে গোর্খে পৌছন। ইডেন লজে রাত্রিবাস করুন। চতুর্থদিন আবার ট্রেক করে ভোরেং আসুন। ভোরেং থেকে গাড়িতে ওখরে। বিকেলের দিকে ওখরে মনাস্ট্রি দেখে নিতে পারেন। পঞ্চমদিন সকালে গাড়ি করে নিউ জলপাইগুড়ি আসুন। 

বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ

রডোডেনড্রনের বাহার দেখতে হলে মার্চ মাসের শেষদিক থেকে মে মাসের প্রথমদিকে মধ্যে যেতে হবে। ভোরেং থেকে থেকে গোর্খে ট্রেকটা একটু কঠিন হলেও হিলে-ভার্সে ট্রেকটা খুব বাচ্ছা বা বৃদ্ধ ছাড়া যেকোন সুস্থ মানুষ করতে পারবে।

দরকারি ফোন নম্বরঃ

1. Dipankar Dey (Majestic Himalayan Treks & Tours): 9749061941, 9733828481
2. Raj Nambang (Hilley Tour & Travel): 9733271137, 9593980310
3. Gopal Thapa (Pusai) (Barsey Home Stay): 9733412807, 9547219305
4. P. T. Sherpa (Sunbird Lodge Okhrey): 9647811674




Sunday, 14 May 2017

ন্যাদোশ

ঝড়বৃষ্টি হয়ে ওয়েদারটা বেশ ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। তেতলায় চিলেকোঠার ঘরে চিৎ হয়ে শুয়ে ফেসবুকে কি স্ট্যাটাস দেওয়া যায় ভাবছিলাম। হঠাৎ জানলা দিয়ে খচমচ করে কি যেন ঘরে এসে পড়ল। পাশের আমগাছ টা কদিন ধরেই হনুমানদের দখলে। তারাই কেউ ঢুকে পড়ল না কি ভেবে ধড়মড় করে উঠে বসে দেখি, হনুমান তো নয়, ইয়াব্বড় শিংওলা একটা গরু লগবগ করতে করতে ঠ্যাং ছড়িয়ে মেঝেতে বসে পড়ল। গল্পের গরু গাছে ওঠে বলে জানি, কিন্তু তিনতলায় ওঠা গরুর কথা তো আগে শুনিনি। আরেকটু হলেই ভির্মি খেতাম, কিন্তু গরুটা এমন মানুষের গলায় কথা বলে উঠল, যে ভির্মি খাওয়া ভুলে হাঁ করে তাকিয়ে রইলাম।

"মুখ বন্ধ কর, গলায় মশা ঢুকে যাবে। অত অবাক হওয়ার কি আছে শুনি? গরু দেখোনি না কি?"
"নাআআ কিন্তু ..." কথা বলব কি, গলা আটকে যাওয়ার জোগাড়।
"আরে বাবা দিদির খোঁজে এসেছিলাম। তা দিদি তো শুনলাম দ্যুলোকে পাড়ি দিয়েছেন। কোথায় যাব ভাবছিলাম, তারপর জানলা দিয়ে তোমায় দেখে বোকাসোকা ভালোমানুষ মনে হল তাই ঢুকে পড়লাম।"
"দিদি ???"
"দিদি মানে তোমরা যাঁকে মহাশ্বেতা দেবী বল। পাশে সন্দেশ পত্রিকাটা ওল্টানো রয়েছে দেখতে পাচ্ছি, অথচ আমায় চিনতে পারছ না?"
"ন্যা ন্যা ন্যা ..."
"এই তো মাথা খুলেছে, গলাটা খুলছে না কেন। হ্যাঁ আমিই ন্যাদোশ। যাক গে শোন আমি গোলোক থেকে আসছি। গোলোক বোঝ তো? তুমি আবার যা হাঁদাগঙ্গারাম! মানুষ মরলে যেমন দ্যুলোকে যায়, গরু মরলে তেমনি গোলোকে যায়।"
বোতল থেকে দু-ঢোক জল খেয়ে আর ঘাড়ে মাথায় একটু ছিটিয়ে খানিকটা ধাতস্থ হয়ে বললাম, "হ্যাঁ জানি বইকি। সন্দেশে পড়েছি। তুমি মহাশ্বেতা দেবীর পোষা গরু ছিলে। তুমি না কি মাছ মাংস খেয়ে গিনেস বুকে নাম তুলেছিলে?"

"সেসব দিনের কথা আর বোলো না। গো-লোকে এখন মাছ মাংসের সাপ্লাই বন্ধ হয়ে গেছে। কতদিন যে বীফ খাইনি!" উদাস চোখে জানলা দিয়ে তাকিয়ে বলল ন্যাদোশ।
"তুমি বীফ খেয়েছো? এটা তো একরকমের ক্যানিবলিজম! গরু হয়ে গরুর মাংস খাওয়া!"
"আরে রাখো তোমার ইজমের কচকচি। গো-লোকে ক্যানিবলিজম, ন্যাশনালিজম কোন ইজমই নেই। আরে বাবা যে গরুর মাংস খেয়েছি সে তো মরে গিয়ে আমাদের সঙ্গেই যোগ দিয়েছে, না কি?"
মাথা চুলকে বল্লুম, "হুম্ম। ব্যাপারটা বেশ গোলমেলে দেখছি"
"গোলমেলে আবার কিসের? তোমরা মানুষরা বড্ড বেশী ভাবো। ঐজন্যেই তোমাদের মাথা আউলায়ে যায়। এই তোমাদের জন্যেই মর্ত্য থেকে মাংস রপ্তানি বন্ধ হয়ে গেছে। এখন অবশ্য গো-লোকে কাউলেস বীফ আসছে।"

"কাউলেস বীফটা আবার কি?"
ন্যাদোশ দাঁত খিঁচিয়ে উঠল, "ক্যাশলেস ইকনমি বোঝ আর কাউলেস বীফ বোঝ না? কাউলেস বীফে মানুষের মাংস থাকে। যেসব মানুষ খাঁটি দেশপ্রেমিক নয় তাদের মাংস। ভালোই খেতে। সে যাক, যেজন্যে মর্ত্যে এসেছিলাম সেটা বলি। ভূলোকে নাকি আজকাল গরু খাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে? আর গরুরা সব গোমাতা হয়ে যাচ্ছে?"
"হ্যাঁ সে তো ভালোই।"
"ভালো আবার কোথায় পেলে এর মধ্যে? পৃথিবীতে গরু মরছে না বলে তো গোলোকে পপুলেশন কমে যাচ্ছে। যে কটা গরু মরছে তারা গোলোকে না এসে গোমালোকে চলে যাচ্ছে। এরকম চলতে থাকলে তো গোলোক পুরো ফাঁকা হয়ে যাবে!!"
"গোমালোক?"
"গোমাতা দের লোক আর কি!"
"ও আচ্ছা। তা গোলোক ফাঁকা কেন হবে বুঝলাম না। যারা এখনো গোলোকে আছে তারা তো আর দ্বিতীয়বার মরবে না?"

"তোমার দেখছি বিদ্যেবুদ্ধি কিস্যু নেই। বলি বিগ ব্যাং থিয়োরির কথা জানো? ইউনিভার্স যে এক্সপ্যান্ড করছে সে খবর রাখো? দ্যুলোক, গোলোক সবই তো ইউনিভার্সের গায়ে চাদরের মত জড়িয়ে আছে। তাই ইউনিভার্সের সঙ্গে সেগুলোও এক্সপ্যান্ড করছে। এখন নতুন গোরুরা ভূলোক থেকে না গেলে গোলোক ফাঁকা হয়ে যাবে না?"
মাথাটা আরো ঘুলিয়ে গেল। কিন্তু এর যা রকম সকম দেখছি বেশী প্রশ্ন করতে গেলে ঐ শিং দিয়ে গুঁতিয়ে না দেয়! তাই তাড়াতাড়ি মাথা নেড়ে বললাম, "ও আচ্ছা আচ্ছা বুঝেছি।"

"এ আর না বোঝার কি আছে! যাই হোক আগে তো এসব সমস্যার কথা দিদিকে এসে বলতাম। দিদি অনেকবার দুঃখ দুর্দশার কথা কাগজে লিখেছেন। এখন দিদি নেই। তোমাকে পেলাম তাই বলে গেলাম। তোমাদের ঐ ফেসবুক না কি যেন আছে তাতে ছাপিয়ে দিও। আমি মানুষের ভাষায় কথা বলতে পারি বলে গো-লোকের গোরুরা আবার আমাকেই প্রতিনিধি করে পৃথিবীতে পাঠায়।"
"মহাশ্বেতা দেবী তো দ্যুলোকে আছেন। তোমরা ওখানে গিয়ে ওনার সঙ্গে দেখা করতে পারো না?"
"আগে পারতাম। এখন আর পারি না। আমাদের আধার কার্ডের ব্যবস্থা হচ্ছে। ওটা হয়ে গেলেই যেতে পারব। তাছাড়া উনি তো নাস্তিক! দ্যুলোকে আছেন কি না তাও জানি না। তাই বলছি এসব কথা তোমাকেই লিখতে হবে।"
"নিশ্চয়ই। লিখবো তো বটেই। তোমার থুরি আপনার আদেশ কি অমান্য করতে পারি? গোমাতা বলে কথা!"
যেই না বলেছি, গরুটা বিষম রেগে শিং নেড়ে তেড়ে এলো, "গোমাতা বলে গাল দিচ্ছিস কেন রে? আমি গোমাতা নই, ন্যাদোশ" বলেই পেটে মারল এক গুঁতো।

চোখ মেলে দেখি গিন্নি পেটে খোঁচা দিচ্ছে আর চেঁচাচ্ছে, "ওঠো ওঠো। ভরসন্ধেবেলায় চারটে মোটা মোটা বই আর মোবাইল নিয়ে নাক ডাকাচ্ছে। কি ঘুমোতেই না পারে লোকটা!"


ছবিটা "সন্দেশ" পত্রিকা থেকে নেওয়া। মহাশ্বেতা দেবীর "গল্পের গরু ন্যাদোশ" গল্পে সত্যজিৎ রায়ের অলঙ্করণ।

Wednesday, 10 May 2017

পাহাড়ের ডায়েরি (৪)


কুমারের কপচানি


বেড়ানো অনেক রকমের হয়। কেউ যান দুর্গম গিরি কান্তার মরু পেরিয়ে অজানা দেশের সন্ধানে। কেউ চান প্যাকেজ ট্যুরে যাবতীয় দর্শনীয় স্থান দেখে নিতে। কারো পছন্দ আবার স্রেফ শহরের কোলাহল, ব্যস্ততা ভুলে দুটো দিন নিভৃতে নির্জনে কাটাতে। আমরা আবার কোন ব্যাপারেই কট্টরপন্থী নই। তাই ভ্রমণের সবরকম স্বাদই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নিতে চাই। হিলে-ভার্সের সাড়ে চার কিলোমিটার ট্রেক, খাবার ও জলের অপ্রতুলতা, বিদ্যুৎ, নেট ও নেটওয়ার্ক হীনতা - এগুলো উপভোগ করিনি বললে ভীষণ ভুল হবে। তেমনি ছোট্ট একখানি নীড়ের জন্য ভেতো বাঙালী মনটা টান দিচ্ছিল তা-ও অস্বীকার করতে পারিনা। 




তাই এঁকাবেঁকা পাহাড়ি রাস্তা বেয়ে আমাদের গাড়ি যখন ছবির মত সানবার্ড হোমস্টের সামনে এসে দাঁড়ালো আর লাল টুকটুকে দুই নেপালি ছোকরা পেমা আর নিমো আমাদের ব্যাগগুলো ছোঁ মেরে নিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে ওপরে উঠে গেল আর লজের মালিক পেমা সিরিং শেরপা আমাদের হাসিমুখে অভ্যর্থনা জানিয়ে ঘরে নিয়ে গেলেন তখন মনে হল আহ এটাই স্বর্গ! ছোট্ট ঘর, বাইরে একটা ব্যালকনি। জানলার ওপারে দেখা যাচ্ছে বিস্তীর্ণ পাহাড়ের সারি। পাহাড়ের গা কোথাও নেড়া, বেশীরভাগ জায়গাতেই সবুজে ঢাকা। আরো ভালো করে তাকালে দেখা যাবে আনেক জায়গাতে ধাপ কেটে চাষ হচ্ছে, তার মধ্যে ছোট্ট একটা কুঁড়েঘর। কোথাও আবার গ্রাম ধরণের, খেলনাবাড়ির মত অনেকগুলো ঘর। আর এর মধ্যে সাপের মত এঁকেবেঁকে রাস্তাটা ছোট হতে হতে দূরে হারিয়ে গেছে। মাঝে মাঝে গাছপালা, পাহাড়ের মধ্যে রাস্তাটা চাপা পড়ে গেছে, আবার কিছুদূরে গিয়ে উদয় হয়েছে।  





বোঝা গেল এই ঘর বাড়ির লোকেরাই ব্যবহার করেন, আমরাই প্রথম অতিথি। পেমাদাজু বিছানাপত্র ঠিক করতে করতে বললেন, "এসব কাজ নতুন করছি, ভুল হয়ে গেলে মাফ করবেন!" সরকারের থেকে লীজ নিয়ে এই লজটা তাঁরা চালু করেছেন মাত্র ২ মাস আগে। ভার্সের গুরস কুঞ্জের সর্বেসর্বা পাসাং শেরপা এনারই দাদা। পাসাং-এর গাইডেন্সেই উনি এই হোমস্টেটা চালাচ্ছেন। সরু চালের ভাত, তরকারি আর ডিমের ঝোল দিয়ে লাঞ্চ করতে করতে কথা হচ্ছিল পেমা সিরিং এর স্ত্রী ফুর্বা ডিকি শেরপার সঙ্গে। ভদ্রমহিলা গ্যাংটক থেকে ২১ কিমি দূরে নামথাং এ কৃষি দফতরে চাকুরিরতা। সপ্তাহান্তে ওখরেতে এসে স্বামীকে সাহায্য করেন। তাঁদের ন মাসের ফুটফুটে গোলগাল মেয়ে ছিমি সোরেং তো শ্রীরূপার কোল ছেড়ে নামতেই চায় না। ফুর্বা ডিকি বলছিলেন, "সংসার আর কাজের অ্যাত টানাপোড়েন, মাঝে মাঝে মনে হয় চাকরি ছেড়ে দিই।" শ্রীরূপা বলল, "সব জায়গাতেই মেয়েদের এই সমস্যা।" চমৎকার লাঞ্চের জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে তাঁকে আবদার করে এলাম, "কাল কিন্তু আপনার হাতে গড়া সিকিমি মোমো খাচ্ছি!" 




ভার্সের তুলনায় ওখরে অনেকটা নিচে হলেও সেদিন প্রচণ্ড ঝড়বৃষ্টির কারণে ঠাণ্ডাটা ভালোই ছিল। এই আবহাওয়ায় বেরনোর প্রশ্ন নেই। তাছাড়া গত দুদিন হিলে, ভার্সে তে ঠিকমত ঘুম হয়নি। তাই একটার ওপর একটা কম্বল চাপা দিয়ে ভাতঘুমটা সেরে নিলাম। ঘুম ভাঙল পেমাজির শ্যালিকার ডাকে। আমাদের জন্য গরম গরম পকোড়া আর চা নিয়ে এসেছেন তিনি। বৃষ্টি তখনো পড়ছে, তবে বেগ কমেছে। দিনের আলো কমে এসেছে। পাহাড়ের গায়ে বাড়িগুলোয় আলো জ্বলে উঠতে দেখা যাচ্ছে। অনির্বান, বব, পল্লব গোর্খে গেছে, এই বৃষ্টিতে ঠিকমত পৌঁছাল কি না চিন্তা হচ্ছিল, কিন্তু তিনজনের ফোনেই বারবার চেষ্টা করেও লাইন পেলাম না। ওখরে নেটওয়ার্ক দুনিয়ার মধ্যে, গোর্খে নয়। বার বার কারেন্ট চলে যাচ্ছিল। একটা ফাঁকা মদের বোতলের মুখে মোমবাতি বসানো ছিল। সেটা জ্বালিয়ে মোবাইলে ডাউনলোড করে রাখা সানডে সাসপেন্স চালিয়ে দিলাম। মোমবাতির আলোয় বর্ষণস্নাত পাহাড়ি গ্রামে সিকিমি চা-এর সঙ্গে জমে উঠল শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঐতিহাসিক গল্প।




পরের দিনটা ছিল রবিবার। এখানে এসে অবশ্য বার তারিখ কিছুরই হিসেব রাখার দরকার ছিল না। টিভি-কাগজ-ইন্টারনেট হীন এক নতুন রাজ্যে যেন বাস করছিলাম। সকালবেলায় আকাশ একদম পরিস্কার। অনির্বান ঠিকই বলেছে, "প্রেমিকার মতন পাহাড়েরও মন বোঝা দায়, খামখেয়ালি কিন্তু বড়ই প্রিয়!" (পাহাড়ের ডায়েরি ৩)। সানবার্ড লজের আতিথেয়তার জবাব নেই। আমরা ঘুম থেকে উঠেছি টের পেয়েই হাসিমুখে ধোঁয়া ওঠা চা নিয়ে এল পেমা। পেমা আর নিমা - পেমা সিরিং এর দুই আসিস্ট্যান্টের মুখে হাসি ছাড়া কিছু দেখিনি। সকালটা ঘরে বসে নষ্ট করার মানে হয়না। তাই চা খেয়েই বেরিয়ে পড়লাম। একটা অদ্ভুত পরিবেশ। চারদিকে নানারকম গাছ, তাদের কতরকম পাতা, ফুল। পাথরের গায়ে ফুটে আছে ফার্ন জাতীয় গাছ, বুনোফুল। সকালের নরম রোদ উঁকি মারছে পাতার ফাঁক দিয়ে। চারদিক নিস্তব্ধ, খালি কিছু পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে। দূরের কোন পাহাড়ি গ্রাম থেকে একটা কুকুরের ডাক পাওয়া যাচ্ছে। মাঝে মাঝে গাড়ির আওয়াজ আসছে অনেক অনেক দূর থেকে। তারপর আওয়াজটা জোর হতে হতে আমাদের পাশ দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে।     




দুপুরের মধ্যেই তিনমূর্তি ফিরে এল গোর্খে থেকে। লাঞ্চ করতে করতে ওদের গোর্খে ট্রেকের গল্প শুনলাম। সেসব গল্প আপনারাও নিশ্চয়ই শুনে ফেলেছেন পাহাড়ের ডায়েরি (৩) এ? সন্ধ্যায় চা আর মোমো খেয়ে লজের সামনের লনে কাঠে আগুন জ্বালিয়ে ক্যাম্প ফায়ার হল। গল্প আড্ডার পর শুরু হল গানের লড়াই। খানিকবাদে আমাদের সঙ্গে যোগ দিলেন পেমা সিরিং। কথায় কথায় জানা গেল তিনি বাঁশি বাজাতে পারেন। নিজে নিজেই বই-টই পড়ে শিখছেন দু বছর ধরে। আমাদের উপরোধে জনপ্রিয় নেপালি গান "রেশম ফিরি রে"র সুর তুললেন বাঁশিতে। তারপর মোবাইলে আরেকটা নেপালি গানের সঙ্গে শুরু হল নাচ। প্রেম সিরিং এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে নেচে গেল পল্লব। ক্রমশ আগুন নিভে এল। আমরা উঠে পড়লাম। ব্যাগপত্র গুছিয়ে নিতে হবে। সকালেই রওনা দেবো এনজেপির উদ্দেশ্যে। সিকিম ভ্রমণ এবারের মত সাঙ্গ হল।

রাত্রে খাওয়ার জন্য ডাইনিং এ এসে দেখি পাসাং বসে আছেন। মাথায় ডেভি'স ল্যাম্পের মত আলো সমেত বেল্ট, সামনের টেবিলে মদের গ্লাস। তখন দশটা বাজে। বললেন এখান থেকে উঠেই ভার্সে যাবেন। কেমন আছেন জিজ্ঞেস করতে বললেন, "এভরিথিং ইজ ফাইন, হোয়েন অন দা টেবল দেয়ার ইজ আ গ্লাস অফ ওয়াইন!"





অনির বচন



"মেঘপিওনের ব্যাগের ভিতর মনখারাপের দিস্তা 
মন খারাপ হলে কুয়াশা হয়, ব্যাকুল হলে তিস্তা
মন খারাপের খবর আসে বনপাহাড়ের দেশে 
চৌকোন সব বাক্সে যেথায় যেমন থাক্ সে, 
মনখারাপের খবর পড়ে দারুণ ভালোবেসে..."
সত্যি হয়ত আমাদের সাথেসাথে পাহাড়েরও মনখারাপ, নাহলে বেলাশেষে এত কুয়াশা সারা ওখরে জুড়ে! তিনজনে গোরখে থেকে ফিরেছি দুপুরবেলায়। ঠিক ছিল একটু রেস্ট নিয়েই ওখরেটা বিকেলের মধ্যেই দেখে নেব। পল্লব বলেছিল ওখরেতে মনেস্ট্রীটা অ্যাট লীস্ট দেখতেই হবে। সেইমত ঠিক হল চারটে নাগাদ পাঁচজনেই বেরোবো। অতনু শ্রীরূপা আগেরদিনই এসে গেছে তাই ওরা ওখরের ব্যাপারে আমাদের চেয়ে একটু বেশি ইনফর্মড। ওরাই বলল মনেস্ট্রী যাওয়ার দুটো ওয়ে আছে একটা তিনশ সিঁড়ি চড়াই আরেকটা শর্টকাট। আর স্বাভাবিকভাবেই আমরা শর্টকাটটাই বেছে নিলাম।

দুপুরের ওয়েদার ছিল একদম পরিষ্কার কিন্তু বেলা বাড়তেই দেখলাম খারাপ হতে শুরু করেছে। সানবার্ড হোমস্টে থেকে ভিউ চমৎকার । জানালা দিয়েই দেখা যায় সিঙ্গালীলা রেঞ্জের প্যানারোমিক ভিউ। বাঁদিক ঘেঁষে সিঙ্গালীলার হায়েস্ট পয়েন্ট সান্দাকফু তারপর ফালুট, শ্রীখোলা, গোরখে আর একদিকে রিম্বিক আর ঠিক তার পিছনেই "অতিধীর, গুরুগম্ভীর" হিমালয়। হোমস্টের ডরমিটরির কাঁচের বিশাল জানালা দিয়েই দেখতে পেলাম কুয়াশার মতন মেঘ ভেসে আসছে আমাদের দিকে।




শর্টকাটটা হোমস্টে থেকে বেড়িয়ে বাঁদিকে । সেই দিকে কিছুক্ষণ হাঁটার পরও আমরা কোনো রাস্তা পেলামনা তারপর আরেকটু এগোতেই চোখে পড়ল ডান দিকের পাহাড়ের গায়ে কিছু ফুটস্টেপস্। সিঁড়ি বা রাস্তা বলে কিছু নেই বরং সেই ফুটস্টেপস্ গুলোই খাঁড়া উঠে গেছে উপরেরদিকে। কোথায় গেছে নীচ থেকে ঠাওর করা যাচ্ছেনা। শর্টকাটের এমন বহর দেখে অতনু শ্রীরূপা রনে ভঙ্গ দিল বলল ওরা নীচেই ঘুরে কাটবে বিকেলটা সম্ভব হলে তিনশ সিঁড়িযুক্ত পথটা ধরবে। শেষঅবধি আমরা তিন বাঙলা মায়ের দামাল ছেলে আবার পাহাড় চড়া শুরু করলাম। ডেস্টিনেশন ওখরে মনেস্ট্রী।

ওঠার পথ বলতে কিছুই নেই।সেই দিয়েই কোনোরকমে তিনজনে উপরে উঠলাম। দুপুরের ওইরকম জম্পেশ্ খাওয়ার পর এই চড়াই ভাঙার জন্য রীতিমত কসরত করতে হল তিনজনকেই। উপরে উঠে পাকদন্ডী বেয়ে একটু গিয়ে যখন পাকা রাস্তা পেলাম তখন আমাদের চারপাশে এক কুয়াশাচ্ছন্ন বিকেল। এইসব দিকে লোকজন অনেকটা কম, তাই মনেস্ট্রীটা কোনদিকে জানার জন্য লোক পাচ্ছিলামনা তার উপর এমন মেঘ যে দশহাত ডিসটেন্সও পুরো ব্লাইন্ড। পলু ভরসা । ও ওর ইনবিল্ট জিপিএস নেভিগেট্ করে ডান দিক ধরে হাঁটতে শুরু করল ,আমরাও ওর পিছু নিলাম। মেঘের ভিতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে খালি মনে হচ্ছিল যেন সময় থেমে গেছে। এখানে সময় থেমে থাকে পাহাড়ের গায়ে, নাম না জানা পাখিদের গলায়, পাইনের শ্যাওলা-ধরা কান্ডে, যে লোকগুলো মাথায় কিলোকিলো সামান চাপিয়ে টুকটুক করে এগিয়ে আসে তাঁদের পায়েপায়ে। সময় থেমে থাকে।




পলুর আন্দাজ একদম ঠিকঠাক। কিছুটা গিয়েই আবছা চোখে পড়ল একটা ঘর আর দুটো স্তুপ। অনেকগুলো লম্বাটে পতাকা উড়ছে। আসার সময়ই জেনে ছিলাম এই পতাকাগুলোতে লেখা থাকে সম্ভবত টিবেটিয়ান ভাষায়। মনেস্ট্রীর নাম "দি উরগেন থং মনলিং মনেস্ট্রী"। ১৯৫২ তে দরজী লামা এটি তৈরি করেন এবং ১৯৬৬ তে দুক্পা লামা দায়িত্বে এসে এখানে একটি ছেলেদের মনেস্টিক স্কুল স্থাপন করেন যেটি আজও চলছে। বর্তমানে ৪৫ জন বৌদ্ধ ভিক্ষু আছেন এই মনেস্ট্রীতে। "মঙ্ক " থেকেই এসেছে "মনেস্ট্রী" আর "মঙ্ক "এসেছে "মনো" থেকে। অ্যালোন। বৌদ্ধইসম্ এর তত্ত্বীয়ভাব বোধিলাভ। কে জানে হয়ত একাকীত্বই বোধলাভের একটা পথ!

বাইরের ঘিরে থাকা প্রেয়ার হুইল ঘুরিয়ে তিনজনে ঢুকে গেলাম মনেস্ট্রীর ভেতরে । ভিতরে দুজন লামা ছিলেন । একজন একটা বই পড়ছিলেন ঠিক যেমনটি আমরা পাঁচালি পড়ি তেমনটি , আরেকজন একটি ছবি পরীক্ষণ করছিলেন। মনেস্ট্রীর ভেতরে অদ্ভুত এক অ্যাম্বিয়েন্স। ববের একদম শান্তভাব আর পলু চারদিকে ঘুরে ঘুরে মোবাইলে ছবি তুলতে লাগল। ভিতরের দেওয়াল আর ছাদ কাঠের আর তার উপর অদ্ভুত কারুকার্য করা। "ওয়ার্ক অব্ আর্ট"। মনেস্ট্রীর উপাস্য দেবতাটিও অদ্ভুতদর্শন। পলু জিগ্গাসা করাতে জানা গেল নাম গুরু রিন্পোচে। তাঁর এক পাশে বুদ্ধের ইন্কারনেশন্। এছাড়াও আরো অনেক কিছু যেমন দুটো শাঁখ যাকে বলে "কারদুং", দুটো বড় (দুংচেন) আর দুটো ছোট(কাংলিং) ট্রাম্পেট জাতীয় বাজনা, কয়েকটা বই, কাঠের বাঁশি জাতীয় একটা বাজনা (গিয়ালিং) আর কিছু লাল শালুজাতীয় কাপড়।




কিছুক্ষণ থেকে আমরা বেড়িয়ে এলাম। বব একদম নেতিয়ে গেছল। বেড়িয়ে এসে বললাম "ওম মনি পদ্ মে হুম", পলু জবাব দিল "হুমম্"। মনে হল ববেরই যেন এই ক'মিনিটে বোধিলাভ হয়ে গেছে। বেড়িয়ে দেখলাম তখনো আলো আছে। পলু ওখানেই একটি কালো তুলতুলে কুকুরছানাকে চট্ করে দিব্যি আদর করে নিল। তারপর আমরা ফেরার পথ ধরলাম, সামনে সেই তিনশ সিঁড়ির উতরাই।

মেঘ তখন একটু পাতলা হয়ে এসেছে আমরা পাইনবনে ঘেরা আঁকাবাঁকা সিঁড়িপথ দিয়ে এসে নামলাম পাকা রাস্তায়। মাইলস্টোনে লেখা টেন মাইল। বুঝলাম আমরা সানবার্ড থেকে এক মাইল দূরে আছি কারন ওটা ইলেভেন মাইলে। পাহাড়ের রাস্তা ধরে গোধূলিকালীন আলোতে ফেরার অনুভূতি আলাদা। পাকদন্ডী পথ। আমরা এগিয়ে চলেছি হোমস্টের দিকে। দুপাশে গাছেদের সারি পাহাড় থেকে নেমে এসেছে রাস্তার ধারে। দুটো বাঁক নিতেই চোখে পড়ল আমাদের আস্তানাটা। দূর থেকে দেখা যাচ্ছে। মনে হল এই তো এসে গেছি কিন্তু আসছে কোথায়? পাহাড় হল মেয়েদের মন ,মনে হয় নাগালের মধ্যেই তো আছে কিন্তু যত কাছে যাওয়া যায় ততই দূরে সরে যায়। বড়ই কঠিন বাস্তব।
তিনজনে এগিয়ে চললাম। বব রাস্তায় শুয়ে পোজ্ দিয়ে খানকতক ছবি তুলে নিল। হঠাৎ ববের মাথার কাছদিয়ে চৌকো ঘুড়ির মত কি একটা উড়ে এ গাছ থেকে ওগাছে চলে গেল। "জায়েন্ট ফ্লাইং স্কুইরল্" গ্লাইড করে চলে গেল আমাদের সামনে দিয়ে। ঠিক যেন একটা বাদামী রঙের খোলা বই উড়ে গিয়ে পড়ল। তিনজনে দেখলাম একটা গাছের ডালে গিয়ে আটকে রইল চুপচাপ। এ ও এক দেখা।




পাক্কা আড়াই ঘন্টা লাগল। চারটে তে বেড়িয়ে ফিরলাম সাড়ে ছটায়। পেমাজিকে বলে একটা ক্যাম্পফায়ার অ্যারেঞ্জ করা হল। শ্রীরূপা আগে ফিরেই মোমোর ব্যাবস্থা করে রেখেছিল ,এসব ব্যাপারে ও ঠিক "মায়ের মতন ভালো"। সান্ধ্যভোজ সেরে আমরা চললাম ক্যাম্পফায়ার করতে। পলু শ্রীরূপা আর বব গাইবে আমি আর অতনু বেসুরো (বরং অসুর বলা ভালো) তাই আমরা শ্রোতা। অদ্য শেষ রজনী , তাই শেষটুকু চেটেপুটে নেওয়া আর কি! কাল ভোরেই তো ফেরা।
মনে পড়ে যাচ্ছে "তিতলির" সেই গান যেটা দিয়ে শুরু করেছিলাম ,


"...মেঘের ব্যাগের ভেতর ম্যাপ রয়েছে,
মেঘপিওনের পাড়ি,
পাকদন্ডী পথ বেয়ে তার
বাগানঘেরা বাড়ি
বাগান শেষে সদর দুয়ার
বারান্দাতে আরামচেয়ার
কালচে পাতা বিছানাতে ছোট্ট রোদের ফালি
সেথায় এসে মেঘপিওনের সমস্ত ব্যাগ খালি..."

কিন্তু আমাদের ব্যাগ খালি নেই বরং ভরে উঠেছে দারুন এক ঘোরার আনন্দে,অনন্য অভিজ্ঞতায়....!!

পেমা সিরিং এর বাঁশিতে "রেশম ফিরি রে" শুনুন এই ভিডিওতেঃ 


ওখরের সানবার্ড লজের ডিটেলস

Sunbird Lodge
Okhrey, West Sikkim - 737121
P. T. Sherpa. (Phone - 9647811674)
pema.ribdi@gmail.com


অন্যান্য পর্বের লিঙ্কঃ

পাহাড়ের ডায়েরি (১)
পাহাড়ের ডায়েরি (২)
পাহাড়ের ডায়েরি (৩)





Wednesday, 26 April 2017

পাহাড়ের ডায়েরি (৩)

আমাদের সিকিম ট্যুরের প্রথম দুটো পর্ব আমি লিখেছি। তৃতীয় তথা গোর্খে পর্ব এবার বব, অনির্বান আর পল্লব -এর কলমে।


 বব বকানি 

ভার্সে থেকে হিলেতে নামাটা ছিল অনেকটা 'রেস এগেইনস্ট বৃষ্টি'।

আগেই থেকেই ঠিক ছিল যে সকাল সকাল উঠে আমরা ভার্সে থেকে হিলে নেমে দুই ভাগে ভাগ হয়ে যাবো। আমি, পল্লবদা আর অনির্বাণদা বেরিয়ে পড়বো ভোরেঙ এর রাস্তায়; আর অতনুদা আর শ্রীরূপা বৌদি যাবে ওখরেতে। সেই মতো সকালে উঠে পড়লাম, কিন্তু মেঘবৃষ্টির ভিতর দিয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘা কে দেখে সময় যে কোথা দিয়ে কেটে গেলো সে বোঝাই গেলো না। একটু একটু করে রাতের জমা মেঘ যেই না কেটে যেতে লাগলো, আমাদের চোখের সামনে ফুটে উঠতে লাগলো কাঞ্চনজঙ্ঘার অপরূপ সৌন্দর্য! সে দৃশ্য বর্ণনা করার মতো ভাষার দখল বা সাহস কোনোটাই আমার নেই। সূর্যের আলো পড়ার সাথে সাথে, রাতে হওয়া বৃষ্টিতে স্নান করা রডোডেনড্রন গাছগুলো তাদের লাল, গোলাপি, সাদা ও হরেক রকম রংবেরঙের ফুলের ডালি নিয়ে সেজে উঠলো |

কিন্তু কপাল মন্দ, যেই না সবে আমরা সেই অপরূপ দৃশ্য ক্যামেরাবন্দি করতে শুরু করেছি, অমনি নামলো বৃষ্টি। পাহাড়ে কখন যে ঝলমলে নীল আকাশ থাকবে আর কখন যে আকাশ কালো করে বৃষ্টি নামবে, সে খবর ভগবান ও রাখেন না। দূরের পাহাড়ে অল্প অল্প মেঘ আগেই জমতে দেখেছিলাম। হঠাৎ সেই মেঘ আমাদের কাছে এসে পৌঁছলো আর শুরু হলো বৃষ্টি!! আর সে কোনো হেলেফেলা করার মতো বৃষ্টি না, ছোট ছোট আকার এর শিল পড়তে শুরু করলো ! পড়িমরি করে আমরা সবাই ভার্সের কটেজের ভিতর ঢুকে এলাম। প্রবল হাওয়ার সাথে শিলাবৃষ্টি হওয়ার ফলে তাপমাত্রা আরো নিচে নামলো। বাকি সকলের মতো আমিও এই পরিবেশ উপভোগ করলেও ভিতরে ভিতরে আমি একটু অধৈর্য  হয়ে পড়ছিলাম বৃষ্টি থামার প্রতীক্ষায়।

যাহোক, সেই বৃষ্টির ভিতরেও লুচি ও আলুরদম সহযোগে পেটভরে জলখাবার খেয়ে নিলাম! ততক্ষনে বৃষ্টি অনেকটাই ধরে এসেছিলো তাই আর দেরি না করে নিজের নিজের ব্যাগ পিঠে নিয়ে এবারের মতো সুন্দরী ভার্সেকে বিদায় জানিয়ে বেরিয়ে পড়লাম হিলের উদ্দেশ্যে।  আগেই বলেছি, ভার্সে থেকে হিলেতে নামাটা ছিল অনেকটা 'রেস এগেইনস্ট বৃষ্টি', তাই ফের বৃষ্টি শুরু হবার আগেই পা চালিয়ে নামতে লাগলাম। পাহাড়ে চড়াই ওঠার থেকে নিচে নামাটা বরাবরই সোজা, শুধু রাস্তা বৃষ্টিতে ভিজে ছিল বলে সাবধানতা অবলম্বন করে যতটা সম্ভব তাড়াতাড়ি নামতে লাগলাম। এরই মাঝে হঠাৎ করে পথের মধ্যে মেঘ এসে এক আশ্চর্য মায়াবী পরিবেশের সৃষ্টি করলো। কিছু সামনে (খুউব বেশি হলে ১৫/২০ ফুট দূর) অতনুদা, শ্রীরূপা বৌদি এবং পল্লবদা কে আবছা আবছা দেখতে পাচ্ছিলাম। সে এক অসাধারণ পরিবেশের সৃষ্টি হলো। সামনে, পিছনে, ডান-বাঁ সব দিকেই উঁচু উঁচু পাইন, ওক গাছে ঘেরা জঙ্গল। তার ভিতর দিয়ে হেটে চলেছি আমরা কয়েকজন, মাঝে মাঝে গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে সূর্যের আলো এসে রাস্তার ওপর পরে এক মায়াবী আলোআঁধারী পরিবেশ তৈরী করেছিল। হঠাৎ করে যেন কোনো জাদুবলে সময় চার পাঁচশো বছর পিছিয়ে গিয়েছিলো। মন্ত্রমুগ্ধের মতো সেই রাস্তা দিয়ে হেঁটে কখন যে আবার হিলে পৌঁছে গেলাম সে খেয়াল ছিল না। একটানা প্রায় চার পাঁচ কিলোমিটার হাঁটার কোনো কষ্ট বোধ করিনি।

সবথেকে আগে আমি এসে ভার্সের রডোডেনড্রন স্যাংচুয়ারির গেটের বাইরের বেঞ্চে বসলাম। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই অনির্বাণদা, পল্লবদা আর শ্রীরূপা বৌদিকে নিয়ে অতনুদা এসে পড়লো। একটানা হাটাহাটি করে সকালের জলখাবারের লুচি আলুরদম কখন হজম হয়ে গেছে। বেশ খিদে খিদে লাগছিলো। আমাদের দলনেতা অনির্বাণদা ম্যাগির অর্ডার দিলো। এমন সময় হালকা বৃষ্টি শুরু হলো। ঠান্ডায় গরম গরম ম্যাগি খেতে লাগছিলো বেশ উপাদেয়, কিন্তু মোটে একবাটি ম্যাগিতে আমার সদা জাগ্রত খিদের বিশেষ কোনো উপশম হলো না। যাহোক কিছু একটা পেটে গেছে , তাই এবার ভোরেঙ যাবার তোড়জোড় শুরু করতে লাগলাম।




অনির বচন 


ভালো জিনিস, ভালো দিন, ভালো সময়গুলো যেন বড্ড তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে আসে। বিগত দু মাস ধরে যে দিনগুলোর জন্যে আমরা অপেক্ষায় ছিলাম তা প্রায় শেষের মুখে। দু 'দুটো দিন কাটিয়ে দিলাম একসাথে। আজ তৃতীয় দিন। পাঁচজনের বার্সে ঘোরা শেষ, গুরাস কুঞ্জের রডোডেনড্রন দেখা হয়ে গেছে, পাহাড়ের বৃষ্টি আর কনকনে ঠান্ডার সাথে পরিচয়টাও হয়ে গেছে। 

এখন ফেরার পালা ।

বার্সে থেকে হিলেতে ফিরে আমরা রিল্যাক্সড্ যে প্রথম ট্রেকিংরুট সবাই অ্যাকম্প্লিসড্ করেছি। আমি বাদে বাকিদের প্রথম ট্রেকিং তাই পূর্বঅভিজ্ঞতা থাকলেও আমিও টেনশনে ছিলাম। আপাতত আর কোনো চিন্তা নেই। সকালে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখে যখন বার্সে থেকে বেড়োলাম বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। গতরাত্রে যখন আমরা টেন্টে ছিলাম তখনও খুব বৃষ্টি হয়েছিল সঙ্গে তুমুল বজ্রপাত । বব তো রীতিমত এক্সাইটেড ছিল আর পলু তাঁর সেন্স অব হিউমর নিয়েই রাত কাটিয়ে দিল। যদিও পাহাড়ের উপর টেন্টে শুয়ে দূর্যোগপূর্ণ রাত কাটানো যে কি যারা কাটিয়েছেন তাঁরাই জানেন। প্রেমিকার মতন পাহাড়েরও মন বোঝা দায়, খামখেয়ালি কিন্তু বড়ই প্রিয়।

হিলেতে পৌঁছলাম এগারোটা নাগাদ । দিনটা পয়লা বৈশাখ । প্রচুর ট্যুরিস্ট, সবাই বার্সে যাবেন। ইতিমধ্যে দেখলাম বব কয়েকজন ভদ্রমহিলাকে বার্সে যাওয়ার জন্য খুব এনকারেজ্ করছে । শেষে ববের কথায় তাঁরা স্যাংচুয়ারীতে গেলেন যদিও ফিরে তারা ববকে আর খুঁজেছিল কিনা জানিনা। হিলে তেও ওয়েদার ক্লাউডি, চারদিক মেঘে ঢাকা। এবার আমরা দু'দলে ভাগ হয়ে গেলাম।দু 'দলের গন্থব্য আলাদা। অতনু শ্রীরূপা যাবে ওখরে, "সানবার্ড হোমস্টেতে" ওঁদের বুকিং আর আমরা মানে আমি, পল্লব আর বব যাব "ইডেন হোমস্টে", গোরখে ; আমাদের আরো একটু অ্যাডভেঞ্চার চাই ।সিকিমের একটা পাইনবনে ঘেরা গ্রাম "গোরখে" প্রথমে আমদের ট্যুর প্ল্যানে ছিলনা, Dipankar Majestic দীপঙ্করদাই বলল যেতে, এখন ভাবি না গেলে খুব মিস্ হত, থ্যাঙ্কস টু দীপঙ্করদা । সান্দাকফু ফালুট হয়ে শ্রীখোলা দিয়ে ফেরবার পথেই এই গোরখে। ট্রেকার্সরা এখান দিয়েই চলে যায় রিম্বিক অথবা রিব্দি।

শ্রীরূপা আবার বায়না ধরল সেও গোরখে যাবে তারপর অনেক বুঝিয়ে আমাদের পেয়ারের কাপল্ কে ওখরে পাঠিয়ে আমরা তিনজন চললাম ভরেঙ এর পথে। সঙ্গে রইল গাইড নিম দোরজি যার কিনা "দো সাদী"। এইরকম ওয়েদারে বব একটা হেইল্ স্টর্ম আশা করছিল আর পল্লব পড়েছিল গাইড নিম দোরজি আর রাজের পিছনে। পল্লব বরাবর একই রকম, সঙ্গে থাকলে দিব্যি সময় কেটে যায় হাসতে হাসতে।

গাড়িতে হিলে থেকে ভরেঙ যেতে লাগল চল্লিশ মিনিট মতন ,প্রায় ষোলো কিলোমিটার ডাউনহিল। গাড়ি থামলো ভরেঙএ যেখানে পাকা রাস্তা একদম শেষ আর পাহাড়ঘেরা বনের পথ শুরু। যাওয়ার রাস্তা প্রায় নেই বললেই চলে পুরোটাই ভাঙা মাটির আর পাথরের পথ । বব দারুণ খুশি, বলে উঠল, "গড্ লী প্লেস্!" সেই সঙ্গে পলু গান ধরল, "আমার এই ভাঙা পথের রাঙা ধূলায়" । শুরু হল আমাদের ট্রেক টু গোরখে । ।




পলুর পাঁচালি 


অনির্বান কুইজ মাস্টার হতে পারতো, কোনো রিয়ালিটি শো এর সঞ্চালক, কৌন বনেগা করোড়পতি টাইপ! আপনি যখন যাবেন কিনা নিশ্চিত নন, ও বলবে, খুব সহজ ব্যাপার, কোনো চাপ নেই, আরাম সে হয়ে যাবে। আপনি সেটা শুনে যেই একটা হ্যাঁ বাচক সিদ্ধান্ত নেবেন, ও শুরু করবে, "পথটা কিন্তু অন্য পথের থেকে আলাদা, ইনফ্যাক্ট সব জায়গায় পথ বলে কিছু নেই, যথেষ্ট বিপজ্জনক, আর দম ও লাগবে খুব, অনেকটা চড়া খাড়াই! আর নামার সময় তো আরো মুশকিল!" ঠিক এই খেলাটাই ও শুরু করে দিলো, গাড়িতে বসে। অতনু আর শ্রীরূপাকে সদ্য ছেড়ে এসেছি হিলে তে, ওরা ওখান থেকে যাবে ওখরে। আমরা আপাতত ভরেঙ, সেখান থেকে গোরখে ট্রেক শুরু হবে। বৃষ্টি পড়ছে এখনো, সাথে বরফকুচি। আমার পাশে বসে রাজ তামাং দিব্যি গাড়ি চালাচ্ছে এর মধ্যেই, মাঝেমধ্যে কাঁচটা মুছে নিচ্ছে আর টুকটাক ঠাট্টা করছে। বব নিবিষ্ট মনে বাইরের জগৎ দেখছে, আমিও দেখছি আর অনির কথা শুনে বাঁ হাঁটুতে হাত বোলাচ্ছি, জখমী কোমর আর বাঁ পা নিয়ে এসেছি, তার ওপর অনির রিভার্স ভোকাল টনিক!

দিব্যি গাড়ি চলছিল, হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল। বুঝলুম সময় আগত! সুবোধ বালকের মত নেমে পড়লুম তিন ভাই। কিছু বোঝার আগেই আমাদের গাইড নিম দরজি রাস্তার বাঁ পাশ দিয়ে নেমে গেল, আর যেখানে গেল, সেটাকে রাস্তা বলে আপনাদের বিভ্রান্ত করতে চাইনে। ক্ষেতের আলের চেয়ে আরেকটু সরু, অনেকটা উঁচুনিচু, কোথাও পাথুরে, কোথাও সেটুকুরও অস্তিত্ব নেই, এবং বৃষ্টির দরুণ পিছল! ডানপাশে পাহাড় উঠেছে খাঁড়া, বাঁ পাশে খাদ নেমে গেছে, মাঝখানে সামান্য পথের আভা ফুটে উঠেছে, আর তাতে তিন মূর্তি টলমল করে এগিয়ে চলেছি। আমাদের গাইডের গতি এই বৃষ্টিতেও লিওনেল মেসির মত স্বচ্ছন্দ, আর পেছনে আমরা তিনজন মোহনবাগানের রিজার্ভ বেঞ্চের প্লেয়ার! কিন্তু এর মধ্যেই কখন আপনার ভালো লাগতে শুরু করবে, নাম না জানা ফুল, কখনো দেখা দেওয়া, কখনো আড়াল থেকে ডাকা পাখি, মাঝেমধ্যে পা ভেজানো পাহাড়ি ঝোড়া আর গাছের ফাঁকে ফাঁকে দূরে উঁকি দেওয়া পাহাড়ের সারি। এসব দুচোখ দিয়ে গিলতে গিলতে ঢিমেতালে চলতে থাকলাম তিনজন। ঘন্টা দুয়েক চলার পর জলের শব্দ পাওয়া শুরু হল। জানা গেল ওটা রামাং নদী, এ নদী গোরখের মাঝ দিয়ে বয়ে গেছে। যতই এগোই, জলের শব্দ বাড়ে, আর আমাদের বুকের ভেতরটাও ছলাৎ ছলাৎ করতে থাকে। এ কোন আবিষ্কার নয়, নেহাৎই পথপ্রদর্শকের সাহায্যে কয়েক ঘন্টা হেঁটে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় পৌঁছনো। তবু এই জলের আওয়াজ অনুসরণ করে যাওয়ার মধ্যে একটা থ্রিল আছে, যারা গেছেন, তারা জানেন। কিংবা হয়তো প্রথমবার বলে আমাদের মধ্যে উত্তেজনা বেশি, তবু বেশ লাগছিলো, কতকাল আগে আমাদের পূর্বসূরিরা তো এমন করেই কত নতুন জনপদ খুঁজে বের করেছেন, আরো কত কষ্ট, কত সহিষ্ণুতা, কত সাহসিকতার মধ্য দিয়ে। তখন পথ অজানা ছিল, হিংস্র জন্তুর ভয় ছিল অনেক বেশী, পথ আরো দূর্গম ছিলো, তবু তারা থামেননি। ভাবলে শ্রদ্ধায় মাথা আপনা থেকেই নুয়ে আসে।

আরো কিছুটা যাওয়ার পর, একটা বাঁক ঘুরে খানিকটা চড়াই, আর সেই চড়াই বেয়ে উঠে আমাদের তিনজনেরই কথা বন্ধ হয়ে গেল। সামনে গোরখে! তখনো কিছু দূর, এক কিলোমিটার হবে, বা একটু বেশি। পেছনে নীল আকাশের চাঁদোয়া, পাইনের সারি, সামনে রামাং নদী, পাহাড়ের কোলে অপরূপ গোরখে। ববের ভাষায় এইচ ডি ওয়ালপেপার! আমার ভাষা নেই সে ছবি বর্ণনা করার, তবে রবি ঠাকুরের একটা গান মনে এসেছিলো, " এ দিন আজি কোন ঘরে গো খুলে দিল দ্বার, আজি প্রাতে সূর্য ওঠা সফল হল কার।" আমরা তিনজনেই জানি, সফল হয়েছিলো! 

কাঠের ব্রিজ পেরিয়ে আমরা তিনজন সিঙ্গালিলা ন্যাশনাল পার্কে ঢুকে পড়লুম। আমাদের গন্তব্য ইডেন লজ, একটা হোমস্টে। মালিক এক হাসিখুশি গোলগাল নেপালি দিদি, নাম, পেম ডিকি। ছোট্ট কাঠের কটেজ, ঠিক যেমনটি এই পাইন পাড়ায় মানায়! জানলার ওপারে পাহাড় আর নিচে তাকালে নদী, চমৎকার আশ্রয়। অত পরিশ্রমের পর খিদেটা নেহাত মন্দ পায়নি, একটু ফ্রেশ হয়ে নিয়ে খেতে গেলুম। ফাইন চালের ভাত, শাকভাজা, ডাল আর ডিমের ঝোল, এমন সুন্দর রান্না খুব কম জায়গাতেই খেয়েছি। আমি আর অনি চুনোপুঁটি হলেও বব খাবার টেবিলে বাংলাদেশের মান রাখলো, যে ছেলেটি খাবার সার্ভ করছিলো তার চোখে স্পষ্ট দেখলুম ভয় মেশানো সম্ভ্রম! একটু পরেই পাহাড়ি সন্ধ্যে নেমে এল। পাহাড়ের অন্ধকার জ্যালজ্যালে মশারির মত নয়, আঁধারের ঠাস বুনোট। পাহাড় আর জঙ্গলে না গেলে আকাশে যে এত তারা আছে বোঝাই যায় না! একটা বড় দল এসেছিলো, তারা ক্যাম্প ফায়ার করছিলো। একজনের হাতে গিটার, বেহিসাবী সুর পাক দিচ্ছিলো হিমেল হাওয়ায়। আমরা একটা চাতালে বসে ছিলাম। নিচে জলের শব্দ, সামনে প্রাচীন অন্ধকার। যে শহুরে শব্দমালায় আমরা অভ্যস্ত, এখানে তা মিশ খায়না। আমরা তিনজনই চুপ করে ছিলাম, বোধহয় সময়ও। কিন্তু সুরের একটা ধাক্কা আছে যেটা সহজে হৃদয়ে পৌঁছে যায়, অর্থমান শব্দের মত তাকে ভায়া মস্তিষ্ক আসতে হয়না! আশেপাশের গানের দোলা আমাদেরও দোলালো! আমাদের এই সঙ্গীতচর্চা শুরুর কিছুক্ষণের মধ্যেই সেই নেপালি ভাইটি এসে খাওয়ার ডাক দিলো, ওরা বোধহয় ভেবেছিলো আমরা খিদের জ্বালায় চেঁচামেচি করছি! সুরের দেবতা আমাদের ওপর উপুড়হস্ত কিনা! রাতের খাবারে চিকেন, বব প্রত্যাশাভঙ্গ করেনি, আমাদের ও, ওদের ও! খাবার পর আরো কিছুক্ষণ বাইরে দাঁড়িয়েছিলাম, কয়েকটা ট্রেকিং গ্রুপ এসেছে, তাদের সাথে টুকটাক গল্প হচ্ছিল। একজন এসেছেন সান্দাকফু, ফালুট হয়ে, যাবেন রিবদি। তিনি জানালেন রাতের খাওয়ার পর ছাং (স্থানীয় পানীয়, সম্ভবত যবের তৈরী) খাওয়া উচিত, সকালে পেট পরিষ্কার হয়ে যাবে। আমি আর অনি ঠিক ভরসা পেলুম না, কিন্তু বব যথার্থ ট্রেকার, "অচেনা কে ভয় কি আমার ওরে"! পেটভর্তি খাবার,রাতের বিছানাও যথেষ্ট আরামদায়ক ছিলো, ভার্সে থেকে হিলে, আবার ভরেঙ থেকে গোরখে একইদিনে হাঁটার ক্লান্তিও ছিলো, তবু ঘুমোতে দেরী হল। তিনবন্ধু এক জায়গায় হলে নরকগুলজার তো হবেই! আরেকটা কারণ হল জানলার বাইরে চাঁদের আলোয় ভাসতে থাকা পাহাড় আর পাইন বন। তাকে উপেক্ষা করে বিছানায় পপাত চ, মমার চ, হবেন এমন বেরসিক ক্ষণজন্মা! শেষটায় যখন ঘুমিয়ে পড়লাম, তখনো জানিনা কাল সকালে আমাদের জন্য নিম দরজি কি চমক তুলে রাখছেন...............




 অনির বচন  


আজ চতুর্থ দিন। ইডেন লজের জানালার কাঁচের শার্সি দিয়ে চকচকে রোদ্দুর এসে পড়েছে আমাদের বিছানায়। কোনো কোনো সকালের আলো মন ভালো করে দেয়, যেন মনে হয় কোথাও তো কোনো কিছুই হয়নি, কোথাও তো কিছুই হারায়নি, কোথাও তো কেউ চলে যায়নি ছেড়ে, কোথাও কোন সংকীর্ণতা নেই, মলিনতা নেই বরং দিব্যি একটা নতুন দিন অনন্ত আনন্দপথের দিকে আরো এক পা এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার অপেক্ষায়!

আমি একটু আগেই উঠেছি বাকি দুজন তখনো ঘুমোচ্ছে। আজ তেমন কোন কাজ নেই। প্ল্যান বলতে সকালে গ্রামটা একটু ঘুরে দেখা। পশ্চিমের দিকে যে রাস্তাটা শ্রীখোলার দিকে গেছে সেদিকটায় একটা পাইনবন আছে। ববের খুব ইচ্ছা ওঁর ব্রেক আপ সেলিব্রেশনটা সেখানেই হোক, সেলিব্রেশন বলতে চুপচাপ বসে থাকা আর কি! তারপর ব্যাক টু ভরেঙ, দেন ওখরে। অতনু শ্রীরূপা ওখানেই আছে সানবার্ডে। গতকালের পর থেকে ওদের সাথে যোগাযোগ নেই । গোরখেতে আমাদের কারোর মোবাইলের নেটওয়ার্ক নেই আর ববের ফোনের চার্জও শেষ। গতরাত্রে আমরা ফোনপিছু পঞ্চাশ টাকা খসিয়েছি চার্জ দিতে। পাহাড়ের বেশিরভাগ জায়গায় এটাই দস্তুর । তবে গোরখের পরিস্থিতি বার্সে বা হিলের তুলনায় ভালো। এখানেও সন্ধ্যা ছটা থেকে রাত দশটা অবধি আলো থাকে। জেনারেটরের আলো। এই ফেসিলিটি অবশ্য হোমস্টে গুলোতেই আছে, বাকি গ্রাম অন্ধকার।

রাতের দিকে আর বৃষ্টি হয়নি বরং চাঁদ উঠেছিল। আমাদের ঘরের ঠিক পিছন দিক থেকেই, যেখানে পাহাড় উঠে গেছে আকাশে। এইরকম ভাসিয়ে নেওয়া জোছ্না আমরা বহুকাল দেখিনি । আমি এইরকম চাঁদের আলো দেখেছিলাম জয়ন্তী রিভারবেডে। সেবারেও সাথে ছিল দীপঙ্করদা। দূরে বনের থেকে ভেসে এসেছিল ময়ূরের ডাক... সে এক অন্য অনুভূতি ! আমরা অনেক রাত অবধি জেগেছিলাম। কথা হল... কথা হল তাঁদের নিয়ে যাঁরা হয়ত কোনোদিনই আমাদের জীবনে দিনের আলোর মতন স্পষ্ট হবেনা অথচ এই চাঁদের আলোর মতই আবছায়া বিষন্নতায় ভরিয়ে রাখবে সারাজীবন। এ জোছ্না বিষন্নতার জোছ্না, এ জোছ্না "গৃহত্যাগী জোছ্না"।

বব আর পলু উঠল সাড়ে সাতটায়। চা জুড়িয়ে জল হয়ে গিয়েছিল। গতকাল আমাদের গোরখে পৌঁছে দিয়ে নিম দোরজি ভরেঙএ ফিরে গেছে; জানিনা কোন বিবির কাছে। পলু বলে দিয়েছে সকাল আটটার মধ্যে যেন সে গোরখে চলে আসে। তাই ঘুম থেকে উঠেই আমরা রেডি। পেমদিকি দিদিও ব্রেকফাস্ট দিয়ে দিয়েছে সব্জি পুরি আর ডিম ভাজা। দেখলাম অন্যান্য টিমগুলোও ব্রেকফাস্ট সেরে নিচ্ছে। তাঁরা যাবে রিব্দি আর আমরা ফিরব ভরেঙ একই পথে। পাইনবনের ভিতর দিয়ে শ্রীখোলার দিকে কিছুটা ঘুরে এলাম দুজনে, ববকে পাইনের বনে কিছুক্ষণ একলা রেখে। পাইনের বিশেষত্ব হল এর উচ্চতা অদ্ভুত এক প্রাগৈতিহাসিক পরিবেশ তৈরী করে ।

নিম দোরজির আসার কথা ছিল আটটায়। পলু পইপই করে বলে দিয়েছিল "দের মত করনা" অথচ দশটা অবধি নিমের দেখা নেই। আমরা বুঝলাম আমাদের ডুবিয়েছে নিম দোরজি, সে আর আসবেনা। পলু কিছুক্ষন নিম দোরজির নামগান করল , অতঃপর ঠিক হল তিনজনেই ফিরব। পলু ভরসা দিল যে সে রাস্তা চিনে গিয়েছে। যদিও চিন্তার বিষয় ছিল কারন গতকাল যখন আমরা আসছিলাম তখন দেখেছিলাম লোকাল ফরেস্টগার্ডরা একদল ট্রেকার্সকে উদ্ধার করে নিয়ে এসেছে তাঁরা নাকি হারিয়ে গিয়ে একরাত ফরেস্টেই কাটিয়েছে। যাই হোক, আমরা তিনজনেই বেরিয়ে পড়লাম। চেকপোস্টে তিনশ টাকা এন্ট্রীফিস্ দিতে হল। এটা আসলে গতকালই দেওয়ার কথা ছিল। সেখান থেকে একজনকে পাওয়া গেল যে কিনা ভরেঙএ যাবে নিজের কাজে। দুশোটাকায় রাজি হল সে আমাদের সাথে যেতে। আমরা আমাদের হোস্ট আর সুন্দরী গোরখেকে বিদায় জানিয়ে হাঁটা শুরু করলাম।

যুধিষ্ঠিরকে মহাপ্রস্থানের পথ দেখিয়ে নিয়ে গিয়েছিল সরমা। একটি কুকুর। ট্রেকার্সদের এই সারমেরসঙ্গের এক্সপেরিয়েন্স থাকেই। আমারও ছিল। প্রত্যেকবারই কোনো না কোনো কুকুর আমাদের চলার পথের সঙ্গী হয়েছে , এবারেও সে নিয়মের ব্যতিক্রম হলনা। হয়তো মহাভারতের নিয়মবাদ। ফেরাটা চড়াই-উৎরাই-ওয়ালা তবে বেশিটাই ওঠা। টার্গেট বারোটার মধ্যে ভরেঙ পৌঁছানো। গাড়ি থাকবে। বেরোবার আগে পেমদিকির রান্নাঘরের জানলার একদম এক কোনা থেকে অতনুকে কল্ করে দিয়েছি যে যদি আমরা তিনটের মধ্যে ওখরে না পৌঁছাই যেন খোঁজ করে কারন তখনো অবধি আমরা ফেরবার গাইড পাইনি। আমরা আস্তে আস্তে ফিরতে লাগলাম আর রামাং এর জলের আওয়াজ কমতে লাগল। কিছুদূর গিয়ে আমরা দেখে নিচ্ছিলাম নীচের পাহাড়ী ভ্যালিগুলোকে। পাহাড়ের এই বিশালতার সামনে নিজেদের তুচ্ছ মনে হয়। পাহাড়ের সামনে এলে মাথা নীচু হয়ে যায় আর সমুদ্রের সামনে দাড়ালে উদারতা আসে।

ঠিক বারোটাতেই আমরা ভরেঙএ পৌঁছলাম । বব মশালা ম্যাগি আর আমরা চা খেলাম। তারপর একটা অল্টো ছিল তাতে তিনজনে চড়ে বসলাম। গন্থব্য ওখরে। পাহাড়ের পাকদন্ডী বেয়ে গাড়ি নামতে থাকল। মিনিট খানেকের মধ্যে একটা পাহাড়ী বাঁক নিতেই চোখে পড়ল সাজানো সবুজ রঙের সানবার্ড হোমস্টে।আজকের দিনটাই হাতে। পলু বলে উঠল," সবটা দেখে নিতে হবে আজই, বিশেষ করে ওখরে মনেস্ট্রীটা যেটা দেখতে কিনা আবার তিনশ সিঁড়ি চড়তে হবে"। গাড়ি এগিয়ে এসে থামল হোমস্টের সামনে। দেখলাম হোমস্টের মালিক পেমা সিরিং আর অতনু দাঁড়িয়ে হাত নাড়ছে আর শ্রীরূপার কোলে আপেলের মত লাল ফুটফুটে একটা মেয়ে, আমাদের দেখে হেসে উঠল ।  


আগের পর্বগুলোর লিঙ্কঃ

পাহাড়ের ডায়েরি (২)


ছবির মত গ্রাম গোরখে। অনির্বানের তুলি তে।


Friday, 21 April 2017

পাহাড়ের ডায়েরি (২)

চোখে আলো এসে পড়তেই ঘুম ভেঙে গেল। বাইরে বেরিয়ে এলাম। দূরে পাহাড়ের মাঝ দিয়ে উঠে আসছে সূযযিমামা। আকাশে হালকা মেঘ রয়েছে। ঠাণ্ডা ভালোই, কিন্তু পাতলা রোদ আবহাওয়াটাকে আরামদায়ক করে দিয়েছে। আর্মি ক্যাম্পের জওয়ানরা প্রাতঃকালীন শরীরচর্চায় ব্যস্ত। দুজন দেখলাম জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এলেন কাঁধে কাঠকুটো নিয়ে। এখানে রান্নাবান্না চলে কাঠের উনুনেই। পাশেই একটা একটু বড় তাঁবু থেকে মাঝে মাঝেই মেয়েলি গলায় হিন্দি গানের কলি ভেসে আসছিল। ওখানেই বোধহয় রান্নার কাজ চলছে। ট্রেকার্স হাটের হোস্টরা তাঁদের কাজকর্ম শুরু করে দিয়েছেন। একে একে দলের অন্যরাও উঠে পড়েছে। ম্যাগি আর চা দিয়ে ব্রেকফাস্ট সেরে রেডি হয়ে নিলাম। আমাদের গাইড নিম দরজিও এসে গেছেন। সবার জন্য বাঁশের লাঠিও তৈরী হয়ে গেল। এবার শুরু হবে ট্রেকিং।
লাল রডোডেনড্রন।
সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে হিলের উচ্চতা ৯০০০ ফুট আর ভার্সের ১০০০০ ফুট। অর্থাৎ হিলে থেকে ভার্সে এক হাজার ফুট উঁচুতে।
প্রকৃতির ক্যানভাস।
 আর জঙ্গলের মধ্য দিয়ে পায়ে চলা পথে দুরত্ব সাড়ে চার কিলোমিটার। ক্যালকুলেটার খুলে বসলে সহজেই বের করে ফেলতে পারবেন এই পথের গড় নতি কত। তবে করে লাভ নেই। কারণ Welcome to Barsey Rhododendron Sanctuary লেখা গেট দিয়ে ঢুকলে ঐসব অঙ্ক মাথা থেকে বেরিয়ে যাবে। একদিকে উঠে গেছে পাহাড়, অন্যদিকে নেমে গেছে খাদ। দুধারে পাইন, বাঁশের আর কত নাম না জানা গাছের বন। পাহাড়ের গা বেয়ে ছোটো ছোট ঝোরা নেমে এসেছে। পাতা খসে যাওয়া বাদামি পাইন গাছ, হলদে সবুজে মেশানো বাঁশঝাড়, পাথরের গায়ে  গজিয়ে ওঠা ফার্ণ জাতীয় উদ্ভিদের সবুজ পাতা, নানা রঙের বুনো ফুল আর পাতার ফাঁক দিয়ে গলে আসা সূর্যের রশ্মি - সব মিলিয়ে একটা অপরূপ ক্যানভাস প্রকৃতি সাজিয়ে রেখেছে পদযাত্রীদের জন্য। যত ওপরে ওঠা যাচ্ছে ততই সেই ক্যানভাসে ফুটে উঠছে থরে থরে সাজানো রডোডেনড্রন। তাদের রঙ কখনো  টকটকে লাল, কখনো গোলাপি, কখনো ফ্যাকাশে লাল আবার কখনো বা ধপধপে সাদা। কোথাও কোথাও জঙ্গল একটু পাতলা, একধারে খাদের বদলে বিস্তীর্ণ ঘাসের উপত্যকা। তার মধ্যে রডোডেনড্রনের গুচ্ছ, পেছনে পাহড়ের সারি। পথের ধারে ধারে বন দফতরের সাইনবোর্ড জানাচ্ছে এই অরণ্য হিমালয়ান রেড পাণ্ডাদের আবাসস্থল। বাঁশপাতা ভোজী এই লাজুক বেড়ালটা পৃথিবীর বিপন্ন প্রাণীদের তালিকায় অন্যতম। এছাড়া আছে জায়েন্ট স্কুইরেল বা উড়ুক্কু কাঠবেড়ালি।  


গোলাপি রডোডেনড্রন।
আমাদের মধ্যে অনির্বাণ ট্রেকিং এ অভিজ্ঞ, আর ববের ফিটনেস, এনথু দুটোই অপরিসীম। ওরা এগিয়ে যাচ্ছিল লাফিয়ে লাফিয়ে। আমি আর শ্রীরূপা যাচ্ছিলাম থামতে থামতে, ছবি তুলতে তুলতে। পল্লবও আমাদের সঙ্গেই যাচ্ছিল।
যত উঁচুতে উঠছি তত ফুলের সংখ্যা বাড়ছে।
আর নিম দরজি তো একটা পা গলানো চটি আর হাতকাটা জ্যাকেট পরে, কাঁধে দুটো কম্বল নিয়ে হাঁটছিলেন। রাস্তার বাঁকে বাঁকে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন।রাস্তায় প্রচুর লোক ট্রেক করছিল আমাদের আগে-পরে, বুঝলাম ভার্সে হিলের মত জনমানবশূণ্য হবে না। দমদম থেকে এক বাঙালী ভদ্রলোক স্ত্রী ও শ্যালক কে নিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি আগে অনেক ট্রেক করেছেন। আমাদের বললেন, ''আপনাদের তো পাক্কা ট্রেকার মনে হচ্ছে!" আমরা তো শুনে হাঁ! এটা আমাদের প্রথম ট্রেক শুনে অবাক হলেন। "আসলে যারা নতুন ট্রেক করে তারা তড়বড় করে এগিয়ে যায়। আর পাকা ট্রেকাররা সময় নিয়ে চারপাশ টা দেখতে দেখতে যায়!" চড়াই উৎরাই থাকলেও এমনিতে রাস্তাটা কঠিন কিছু নয়। দশ বছরের বাচ্ছা থেকে ষাট বছরের বৃদ্ধ সকলেই যেতে পারবেন - যদি শরীর সুস্থ থাকে, শ্বাসকষ্টর সমস্যা না থাকে। স্থানীয় মানুষের কাছে তো এগুলো কোন ব্যাপারই নয়। নিম দরজি বললেন এই রাস্তাটা হাঁটতে ওনার একঘন্টা লাগবে। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে একটা শর্টকাট রুট দেখালেন, যেটা দিয়ে চটপট সোমবেরিয়া যাওয়া যায়। সোমবেরিয়া এ অঞ্চলের নিকটবর্তী গঞ্জ টাইপের জায়গা। আমরা যেতে পারব কি না জিজ্ঞেস করতে হেসে মাথা নাড়লেন। তবে এখানে চিতাবাঘ আছে। তাই রাতের দিকে একা কেউ চলাফেরা করে না। 


সাদা রডোড্রেনড্রন।
আমরা যখন পাহাড়ের মাথায় পৌছলাম তখন বারোটা বেজে গেছে। রাতে আমাদের মাথা গোঁজার জায়গা হল "গুরস কুঞ্জ"এ। তবে ঘরে নয় তাঁবুতে থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। "গুরস" রডোডেনড্রনের নেপালি প্রতিশব্দ। নেপালি সংস্কৃতিতে রডোডেনড্রনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। নেপালের জাতীয় ফুল যেমন রডোডেনড্রন, ভারতের সিকিম রাজ্যের প্রাদেশিক বৃক্ষও তেমনি রডোডেনড্রন। আগেই বলেছি রডোদেনড্রন নানা রঙের হয়। এর হাজারের কাছাকাছি প্রজাতি আছে। এশিয়া, ইউরোপ, উত্তর আমেরিকার নানা জায়গায় পাওয়া গেলেও প্রজাতির বৈচিত্র্য সবচেয়ে বেশী হিমালয় পর্বতমালা অঞ্চলে। বিভিন্ন প্রজাতির আলাদা আলাদা নেপালি নাম আছে কি না জানিনা। তবে সাদা সাদা রডোডেনড্রনের নেপালি নাম শুনলাম "চিমল"। ফুলের শোভা মন ভরে দেখতে গেলে পাহাড়ের ওপর উঠতেই হবে। রডোডেনড্রন ছাড়াও নাম না জানা নানা রঙের ফুলের মাঝে এই লজটির "গুরস কুঞ্জ" নাম তাই এক্কেবারে সার্থক। 

নাম না জানা ফুল।
সে দিনটা গুডফ্রাইডের ছুটি ছিল। তাছাড়া আকাশ একদম পরিস্কার। প্রচুর লোক ঘুরতে এসেছেন। বাঙালী যেমন আছে তেমনি সিকিমের স্থানীয় মানুষও আছে। এনাদের বেশীরভাগই দিনের বেলাটা কাটিয়ে নেমে যাবেন, বাকিরা এখানেই রাত্রিবাস করবেন। একজন দক্ষিণ ভারতীয় হাতে বিশাল লম্বা একটা ক্যামেরা নিয়ে ঘুরছিলেন। পল্লব বলল উনি পক্ষীবিদ। এত লোকের কলরবে পাখি পাওয়া যাবে না বুঝে তিনি জঙ্গলের দিকে চলে গেলেন। মোটা চালের ভাত, বরবটির তরকারি আর ডিমের ঝোল দিয়ে লাঞ্চ সেরে সামনের খোলা জায়গায় ঘাসের ওপর এলিয়ে পরলাম। ঠাণ্ডার মধ্যে রোদ পোহানোর মজা আর কিছুতে নেই। একদল স্থানীয় ছেলেমেয়ে নেপালি গান বাজিয়ে নাচছে, এক বৃদ্ধও যোগ দিয়েছেন তাদের সঙ্গে। বাঙালী ট্যুরিস্টরা কেউ ক্যামেরা নিয়ে ঘুরছে, কেউ দল পাকিয়ে গুলতানি মারছে। এক সদ্যবিবাহিত দম্পতি নিজেরাই তাঁবু খাটানো শুরু করে দিয়েছে। অনির্বাণ পরে আছে গুরস কুঞ্জের ম্যানেজার পাসাং শেরপার পেছনে। আমাদের তাঁবুগুলোও এইবেলা খাটিয়ে নিতে হবে।
কোথাও কোথাও জঙ্গল একটু পাতলা, একধারে খাদের বদলে বিস্তীর্ণ ঘাসের উপত্যকা। তার মধ্যে রডোডেনড্রনের গুচ্ছ, পেছনে পাহড়ের সারি।
পাসাংএর বাড়ি নেপাল সীমান্তের কাছে বস্তিতে। তিনি কলকাতায় এসে হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্টের কোর্স করে গেছেন। বললেন, "হাওড়া স্টেশনে নেমে তো 'যাত্রীগণ কৃপেয়া ধ্যান দে' আর 'for your kind attenstion please' শুনে তো কান ঝালাপালা হওয়ার জোগাড়! আর কত লোক, বাপরে!!" গুরস কুঞ্জে তাঁর অতিথিও অবশ্য কম নয়। তাদের একেক জনের একেক রকম চাহিদা সামলাতে গিয়ে নাজেহাল হচ্ছিলেন। শেষে বলেই বসলেন, "আপনাদের সমতলের লোকেদের সবাইকে তো একই রকম দেখতে, তাই গুলিয়ে ফেলছি!" আমরা যে উত্তরপূর্ব ভারতের মানুষদের চীনেদের মত দেখতে বলি এটা কি তারই পালটা ভাষ্য? জিজ্ঞাসা করা হল না। বিকেলের আগেই তাঁবু রেডি হয়ে গেল। আমদের দুজনের জন্য একটা ছোট্ট তাঁবু খাটানো হল গুরস কুঞ্জের চত্বরে। ওদের তিনজনের তাঁবুটা একটু বড়। পাসাংজি সেটা খাটিয়ে দিয়ে এলেন চত্বরের বাইরে বন দফতরের এলাকায়।

সূর্য ডুবতেই ঠাণ্ডাটা জাঁকিয়ে বসল। সঙ্গে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি। হাতে গ্লাভস, পায়ে মোজা, তবু হাত পা যেন অসাড় হয়ে যাচ্ছে। শ্রীরূপা দুটো সোয়েটারের ওপর অনির্বাণের একটা কম্বল চাপিয়ে বসল। সবচেয়ে ছড়িয়েছে পল্লব।
এই ফুলটার নাম স্নেক লিলি। পাসাং দেখালেন,
একটা রডোডেনড্রন গাছের তলায় ফুটে ছিল।
একেবারে ফণা তোলা সাপের মত দেখতে।
একটা ফিনফিনে পাঞ্জাবী পরে সে পাহাড়ে পয়লা বৈশাখ উদযাপন করতে এসেছে। ব্যাগে নিয়েছে একটা সোয়েটার আর একটা মাফলার। শেষে অনির্বাণের একটা জ্যাকেট আর আমার একটা হনুমান টুপি পড়ে সামাল দিল। যারা ছিলাম সবাই গুরস কুঞ্জের বড় ডাইনিং হলে এসে আশ্রয় নিলাম। এখানে ইলেকট্রিসিটির কোন গল্প নেই। কেবল সূর্যাস্তের পর থেকে রাতের খাওয়াদাওয়া হওয়া পর্যন্ত ঘন্টা তিনেকের জন্য জেনারেটর চালানো হয়। এদিকে মোবাইলের চার্জ শেষ হয়ে এসেছে। টর্চও বিগড়ে গেছে। রাত্রে কি হবে ভেবে হাড় হিম হয়ে যাচ্ছিল। এমন সময় এক বাঙালী ভদ্রমহিলা খবর দিলেন জেনারেটর থেকেই মোবাইল চার্জের ব্যবস্থা হবে। শুনে অনির্বাণ বলল "যাই ব্যাগ থেকে চার্জারগুলো নিয়ে আসি।" গেলো বটে, কিন্তু ফিরে এলো চার্জার ছাড়াই, "বব, টেন্টের মধ্যে তো ব্যাগ ট্যাগ কিচ্ছু নেই!" আসার আগের দিন অনির্বাণকে ছোট্ট করে একটু বোকা বানানো হয়েছিল। প্রথমে ভেবেছিলাম সেটারই শোধ তুলছে হয়ত। তারপর বুঝলাম না, ব্যাপারটা সিরিয়াস। গুরস কুঞ্জে হুলুস্থুল পড়ে গেল। সবাই টর্চফর্চ যা আছে হাতে নিয়ে ছুটল। এরকম ঘটনা নাকি এখানে কোনদিন ঘটেনি! তাঁবুর ভেতর আলো ফেলে দেখা গেল পরিপাটি করে বিছানা পাতা কিন্তু ব্যাগপত্র হাওয়া। হঠাৎ পল্লব বলল, "আচ্ছা আমরা তো বিছানা পেতে যাইনি?" কি কাণ্ড! চোর শুধু ব্যাগ চুরি করে বিছানা পেতে দিয়ে গেছে - এমন ঘটনা ভার্সে কেন, ভূভারতে কোনদিন ঘটেছে বলে মনে হয়না। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে আছি এমন সময় "ইয়ে আপকা সামান হ্যায় না? মিসটেক হো গিয়া" বলে সাদা জ্যাকেট পরা একজন এসে ব্যাগগুলো তাঁবুর মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে বেরিয়ে গেলেন। জানা গেল তিনি পুসাই, কোন ট্যুরিস্ট পার্টি তাদের মালপত্র তাঁবু থেকে নিয়ে আসতে বলেছিল। উনি অন্ধকারে তাঁবু চিনতে না পেরে আমাদের ব্যাগগুলোই উঠিয়ে নিয়েছিলেন! আমাদের সবাইকে নিজের কার্ডও দিয়ে দিলেন তিনি।
পাসাং শেরপার সঙ্গে।
এদিকে গুরস কুঞ্জে আরেক ক্যাচাল শুরু হল। সেদিনটায় হঠাৎ করে অনেক লোক চলে আসায় লজের কর্মীরা বিপদে পড়ে গেলেন। অতজনকে খাওয়ানোর রসদ তাঁদের ছিল না। আর এটা কোন শহর নয় যে টাকা ফেললেই দোকান থেকে খাবারদাবার কিনে আনা যাবে! কোনরকমে তিনটে মুরগী জোগাড় করা গেল। ভাত, ডাল আর ছোট ছোট দুটো টুকরো সমেত মাংসের ঝোল দিয়ে ডিনার সারলেন ৬৫ জন ট্যুরিষ্ট। কিন্তু এখানেও শেষ হয়নি। তাঁবুতে ঢুকে পড়ার পর একটা হল্লা শুনলাম। আরো দশ বারো জনের একটা দল ঐ রাত্তিরে এসে হাজির। তাঁদের আগে থেকেই বুকিং ছিল। খাবারের জোগাড় নেই কেন এই নিয়ে প্রবল তর্কাতর্কি। মালদা থেকে একটা বড় গ্রুপের সঙ্গে এসেছিলেন ফাল্গুনিদা। শেষে তিনিই ব্যাপারটা সামলালেন। মাংস না থাকলেও ডিম ছিলো। আবার উনুন জ্বেলে ডিমের ঝোল রান্না হল। তাই দিয়ে ভাত খেলেন নিশিকুটুম্বরা। 
আড্ডা @ গুরস কুঞ্জ।
আমি ভার্সে বলছি বটে কিন্তু সঠিক উচ্চারণটা হবে বার্সে (Barsey)। বর্ষা থেকেই এই নাম। তাই বার্সেতে এলে বর্ষা না পেলে কিছু একটা বাকি থেকে যেত! রাতে প্রবল ঝড়বৃষ্টি হল, বজ্রবিদ্যুৎ সহ। সকালের আবহাওয়া আগেরদিনের চেয়ে এক্কেবারে আলাদা। ভীষণ কুয়াশা, বারে বারে বৃষ্টি নামছে -এই অবস্থায় নিচে নামা সম্ভব নয়। সবাই রেনকোট, ছাতাটাতা নিয়ে রেডি, কারো মাথায় প্লাস্টিকের প্যাকেট। ওয়েদার একটু ভালো হলেই বেরোতে হবে। এদিকে রাত্রের মত সকালেও ৭০ জনের ব্রেকফাস্ট তৈরী করতে নাজেহাল করছিলেন লজের কর্মীরা। দেখলাম আমাদের নিম দরজিও লুচি বেলতে চলে গেছেন। একপ্লেট জলখাবার রেডি হতেই কাড়াকাড়ি পরে যাচ্ছে। মুশকিল আসান হলেন ফের ফাল্গুনিদা। কিচেনের দরজা বন্ধ করে জানলার একটা কাঁচ ভাঙা ছিল, সেটাকে কাউন্টার বানিয়ে তার বাইরে দাঁড়ালেন এবং নিজের দলের সদস্যদের জলখাবার একে একে পাস করে দিলেন। তারপর সে জায়গাটা ছেড়ে দিলেন আমাদের টিমলিডার অনির্বাণকে।
ফেরার পথে।
জলখাবার শেষ করে  হাত ধুচ্ছি, এমন সময় অনেকগুলো কন্ঠে উল্লাস শুনে দৌড়ে বাইরে এলাম। কুয়াশা অনেকটা কেটে গেছে, আকাশ থেকে মেঘ সরে সরে যাচ্ছে। আর তার পেছন দিয়ে ধীরে ধীরে আত্মপ্রকাশ করছে মাউন্ট কাঞ্চনজঙ্ঘা। সে দৃশ্য বর্ণনা করার বৃথা চেষ্টা করছি না। আর তা লেন্সবন্দী করার মত ক্যামেরাও আমাদের কারো কাছে ছিল না। তাই চোখ দিয়ে মনের ক্যামেরাতেই গেঁথে রাখলাম।  ভার্সে ট্রেক সার্থক।
নতুন ক্যানভাস।
এবার ফেরার পালা। ভার্সেকে বিদায় জানিয়ে হাঁটা শুরু করলাম। আবহাওয়া অনেকটা ভালো হয়েছে, কিন্তু মাঝে মাঝে বৃষ্টি আসছে। কিছুটা শিলাবৃষ্টিও পেলাম। ওঠার দিন ছিল ঝকঝকে রোদ্দুর। আজ ভেজা রাস্তা, গাছের পাতা থেকে টুপটাপ জল পড়ছে, ঝোরাগুলোর তেজও বেড়ে গেছে।কখনো কখনো হাঁটতে হচ্ছে কুয়াশার মধ্য দিয়ে।
পাঁচ হাত দূরের মানুষকেও দেখা যাচ্ছে না। এর মধ্যে বব আর পল্লব পাকড়াও করেছে একটা পাহাড়ি কুকুরকে। এখানে অনেকরকম লোমশ কুকুর দেখলাম, যাদের কলকাতাতেও দেখতে পাওয়া যায়, বকলস পরা অবস্থায়, বড়লোকদের ড্রয়িংরুমে। এখানে  তারা স্বাধীন। অবশ্য পল্লবের কাছে যেভাবে চোখ বুজে আদর খাচ্ছিল তাতে ওকে বাড়ি নিয়ে গেলেও বোধহয় আপত্তি করত না। বব ব্যাগ থেকে একটা ক্রীমরোল বের করে অফার করতেই একটা আশ্চর্য ঘটনা প্রত্যক্ষ করলাম। কুকুরটা রোলটাকে মুখে ধরে উল্টোদিকে মুখ ঘুরিয়ে জঙ্গলের মধ্যে ছুট লাগালো। তারপর একটা জায়গায় থাবা দিয়ে গর্ত খুঁড়ে রোলটাকে রেখে আবার মাটি চাপা দিয়ে দিল। পাহাড়ের মানুষ যেমন কঠিন জীবনসংগ্রামে অভ্যস্ত তেমনি কুকুররাও জানে দুবেলা খাওয়ানোর মত পশুপ্রেমিক এখানে নেই। নিজের রসদ নিজেকেই সঞ্চয় করে রাখতে হয়। 
পাহাড়ি বন্ধু।
নামার সময় হিলে পৌঁছতে সময় লাগল অনেকটা কম, প্রায় দুঘন্টা। এইবার দলটা দুভাগে ভাগ হয়ে গেল। আমি আর শ্রীরূপা যাব ওখরে তে। অনির্বাণ, বব আর পল্লব যাবে ভোরেং এ। সেখান থেকে আরেকটা ট্রেক করে যাবে গোর্খে। পরের দিন ওখরে তে এসে আমাদের সঙ্গে মিট করবে।




অন্যান্য পর্বের লিঙ্কঃ

পাহাড়ের ডায়েরি (১)
পাহাড়ের ডায়েরি (৩)