Sunday, 21 August 2016

হুতোম

তার নাম হুতোম। আমার খুব বন্ধু, যাকে বলে বেস্ট ফ্রেন্ড।
"সে কি তোমার ইস্কুলে পড়ে?" ... "না"
"তোমার বাড়ির পাশে থাকে বুঝি? বিকেলবেলায় তার সঙ্গে খেলো?" ... "ঊঁহু"
"তাহলে নিশ্চই তোমার আত্মীয় হয়?" ... "একেবারেই না"
আরে বন্ধু হলেই কেমন করে হয়েছে বলতে হবে না কি! সে যে আমার বন্ধু, এটাই তো সবচেয়ে বড় কথা। কোথায় থাকে? এই ধরে নাও পটলতলা। কি বলছ? পটলতলা কোন জায়গার নাম হতে পারে না? কেন? তালতলা হতে পারে, আমতলা হতে পারে আর পটলতলা হতে পারে না? আর না পারে তো বয়েই গেল, ধরে নিতে দোষ কি?
হুতোম সবসময় আমাকে সাহায্য করে। পড়ার সময়, খেলার সময়, ইস্কুল যাবার সময়, টিভি দেখার সময়। আমি ডাকলেই সে চলে আসে। তবে সাবধান, তোমাদের বিশ্বাস করে বলছি কিন্ত, কাউকে বলে দিওনা যেন, বিশেষ করে আমার বাবা মা কে। ওরা জানেই না হুতোমের কথা। জানেনা বললে অবশ্যি একটু ভুল হবে, জানতে চায় না, মানে বিশ্বাসই করে না।
এই তো সেদিন হুতোমের সঙ্গে পাঙ্খাটুলি গিয়েছিলাম, বাবার বন্ধু দেবেশকাকু দেখে ফেলেছে আর বাবাকে এসে রিপোর্ট করেছে।
বাবা চোখ পাকিয়ে বলল, "অতদূরে গিয়েছিলে কেন একা একা?"
"একা কোথায়! হুতোম ছিল তো সঙ্গে।"
"হুতোম আবার কে? কতবার বলেছি, ঐ সব বাজে ছেলেদের সঙ্গে মিশবে না?"
বোঝ কথা!! হুতোম না কি খারাপ ছেলে!! তাহলে ভালো ছেলে কারা? যারা সারাদিন বইমুখে বসে থাকে, সকাল বিকেল সেজেগুজে পড়তে যায়, বাসে বুড়োলোকেদের সিট ছেড়ে দেয়না, রাস্তায় আক্সিডেন্ট হলে পাশ কাটিয়ে চলে যায়, তারা? এসব কথা অবশ্যি বাবাকে বলিনি। বলে কোন লাভ নেই। বয়স হলে বুদ্ধিটা যে কেন কমে যায় কে জানে!

একদিন বাবা-মার সঙ্গে বিয়েবাড়ি গিয়েছিলাম ট্রেনে চেপে। ফেরার সময় কি ভীষণ ঝড়বৃষ্টি। ট্রেন থেকে নেমে তো মাথায় হাত। বাস, অটো, রিকশো, কিচ্ছু নেই। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর বাবা বলল, "বৃষ্টি থামার কোন লক্ষণ নেই, আর কিছু পাওয়া যাবে না। এবার হাঁটা লাগাতে হবে।" ঠিক সেই সময় একটা অটো এসে দাঁড়াল। তখন আর দরদাম করার সময় নেই, হুড়মুড় করে ভেতরে ঢুকে পড়লাম। সে অটো কোথায় যাব কিছু না শুনেই রাস্তায় নেমে পাঁইপাই করে ছুটতে লাগল। মা তো ভয়ে সিটিঁয়ে গেছে। বাবা যত বলে আস্তে চালাতে সে তত জোরে চালাতে থাকে। আধঘন্টার রাস্তা দশ মিনিটে পার করে পয়সা দেওয়ার আগেই আমাদের নামিয়ে দিয়ে হুউউস করে বেরিয়ে গেল। বাবা-মা তো অবাক। আমি অবশ্য অবাক হইনি, কারণ আগেই বুঝতে পেরেছিলাম কে অটো চালাচ্ছে, কিন্তু সে চোখ দিয়ে ইশারা করাতে কিছু বলিনি। তবে হুতোম যে অটো চালাতে পারে তা আগে জানতাম না।
পরে হুতোমকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, "তুমি অটো কিনলে না কি?"
"দ্যুৎ, তোমার যেমন বুদ্ধি! ওটা তো সামিরের অটো। সে ব্যাটা তো আর বেরোবে না, তাই আমিই নিয়ে এলাম। ও কিছু জানতেই পারেনি, কম্বলমুড়ি দিয়ে ঘুম দিচ্ছিল তো।"
"অ্যাঁ! তাহলে নিলে কিকরে? চুরি করেছ না কি?"
"চুরি করতে যাব কেন? আমি তো আবার রেখে এসেছি। তাছাড়া সামির আমার খুব ভালো বন্ধু, তোমার মতই।"


এই হল হুতোম। হুতোম পারেনা এমন কাজ বোধহয় নেই। কিন্তু সে যে কোন ক্লাসে পড়ে সেটা কিছুতেই বলবে না। তবে আমি যখনই ইস্কুলে যাই, তখন দেখি হুতোম জানলা দিয়ে থেকে বা গাছের ডাল থেকে উঁকি মারছে, কখনও বা আমার পাশে এসেও বসে পড়ে। কেবল আমিই ওকে দেখতে পাই, আর কেউ পায়না। তবে কোনদিন আমার হোমটাস্ক করে দেয়নি। যদিও আমি জানি ও অঙ্ক খুব ভালো পারে। কিন্তু সেকথা বললেই দুদিকে ঘাড় নেড়ে বলবে, "ওটি হচ্ছেনা, তোমার অঙ্ক তোমাকেই করতে হবে।"
আমাদের ইংরেজি স্যার সাংঘাতিক লোক। ছাত্রদের পেটাতেই তাঁর আনন্দ। তিনি ইচ্ছে করেই ভয়ংকর সব ট্রান্সলেশন দেন, বিচ্ছিরি সব শব্দের মানে জিজ্ঞেস করেন আর উত্তর অনুযায়ী বিভিন্ন রকম শাস্তি দেন। যারা মার খেল তাদের তবু ভাগ্য ভালো। কাউকে হয়ত বললেন চেয়ার, ব্যাস ক্লাস শেষ না হওয়া পর্যন্ত শূন্যে চেয়ার হয়ে বসে থাকতে হবে। কাউকে যদি বলেন এক পা, অমনি এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে।
একদিন তিনি ভবানীকে ধরেছেন, "বলত ফুলিজিনাস মানে কি?"
ভবানী অনেকটা ভেবেচিন্তে, খানিকটা কানটান চুলকে বলল, "ফুলিজিনাস মানে ফুলিশ মানে বোকা কিন্তু জিনিয়াস"
"বেশ বলেছিস, ঠিক তোর মতই। আয় জিনিয়াসগিরি কাকে বলে দেখিয়ে দিই", স্যার ভবানীর কানের দিকে হাত বাড়াতেই হুতোম স্যারের কানটাকেই পাকড়ে ধরল। স্যারের মুখ ভয়ে সাদা হয়ে গেল। এদিকে হুতোমকে আমি ছাড়া কেউ দেখতে পাচ্ছে না। সবাই তাজ্জব। হুতোম স্যারের কানে কি একটা বলে ছেড়ে দিল। ভবানী সাহস করে জিজ্ঞেস করল, "কি হয়েছে স্যার?"
স্যার কিছু না বলে পেনটাকে পকেটে পুরে রোলকলের খাতাটা টেবিলেই ফেলে ক্লাস থেকে বেরিয়ে গেলেন।
হুতোমকে জিজ্ঞেস করলাম, "স্যারকে কানে কানে কি বললে তখন?",
"কিছু না, বললাম আপনি আসার সময় যে দুধটা না খেয়ে নর্দমায় ফেলে দিয়েছেন, তা কিন্তু আপনার স্ত্রী দেখে ফেলেছেন"

এই যে এতক্ষণ হুতোমকে নিয়ে আবোল তাবোল বকলাম, তোমরা নিশ্চই ভাবছ, হুতোমটা আসলে কে? মানুষ? ভূত? রোবট? না কি অন্য গ্রহের জীব? তোমরা ভাবতে থাকো, আমি যাই, হুতোম ডাকছে।


এটা কবে লিখেছিলাম মনে নেই, পুরনো খাতাপত্তর ঘাঁটাঘাটি করতে গিয়ে বেরিয়ে পড়ল। লেখাটা পাতে দেওয়ার মত হয়নি জানি, কিন্তু ছোটবেলার লেখার প্রতি সবারই তো একটা দুর্বলতা থাকে, তাই চর্যাপদের বন্ধুদের সঙ্গে শেয়ার করছি। আর এটা যে খুব মৌলিক তাও আমি দাবী করছিনা। তবে কি না একজায়গা থেকে টুকলে সেটা হয় চুরি করা, আর অনেক জায়গা থেকে টুকলে গবেষণা। তাই কাঠগড়ায় তুললে আমি বলতেই পারি, ধর্মাবতার, আমি চোর নই, গবেষক হতে পারি বড্ডজোর। 
প্রথম প্রকাশঃ চর্যাপদ

Tuesday, 29 March 2016

সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদের ১০০ বছর ও মহাকর্ষীয় তরঙ্গ

সময়টা ১৯১৯। সবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছে। ধ্বংসের স্মৃতি পেছনে ফেলে ছন্দে ফিরছে ইউরোপ। মে মাস নাগাদ আর্থার এডিংটনের নেতৃত্বে একদল বিজ্ঞানী বাক্সয় করে বিশাল বড় এক দূরবীন নিয়ে পাড়ি দিলেন আফ্রিকার পশ্চিম উপকূলের প্রিন্সিপি দ্বীপে। না ছুটি কাটাতে নয়, তাঁরা গিয়েছিলেন পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ দেখতে। সূর্যগ্রহণ দেখতে বলা ভুল হল তাঁরা গিয়েছিলেন বৃষ রাশির কয়েকটা নক্ষত্রকে দেখতে। একই সময় একই উদ্দেশ্যে ব্রাজিলের সোবরাল শহরে গেলেন ফ্রাঙ্ক ডেভিসনের নেতৃত্বে আর এক দল বিজ্ঞানী। এর আগে জানুয়ারি মাসেও তাঁরা ঐ দুই জায়গা থেকে নক্ষত্রগুলো দেখে এসেছেন, কিন্তু সে ছিল রাত্রিবেলা, আকাশে সূর্য ছিল না। এবার দিনের বেলায় দেখবেন, যখন ঐ তারাগুলো থেকে আলো আসবে সূর্যের পাশ দিয়ে। সূর্য্যগ্রহণের সময় আসতে হল কারণ চাঁদমামা যতক্ষণ না সুয্যিমামাকে আড়াল করছে, ততক্ষণ বৃষ কেন কোন রাশিকেই দেখা যাবেনা। 

অ্যালবার্ট আইনস্টাইন
এত কাণ্ড করার কারণ তিন বছর আগে অ্যালবার্ট আইনস্টাইন জেনারেল রিলেটিভিটি নামে এক বিদঘুটে তত্ত্ব বাজারে ছেড়েছেন। এই তত্ত্ব বলছে মহাকর্ষ না কি নিউটন যেমন বলে গেছিলেন দুটি ভারী বস্তুর আকর্ষণ বলের ব্যাপারই নয়, পুরোটাই জ্যামিতির খেলা। জ্যামিতি মানে স্পেসটাইমের জ্যামিতি। এর আগে ১৯০৭ সালের বিশেষ আপেক্ষিকতার তত্ত্বে তিনিই দেখিয়েছেন যে দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, উচ্চতা নিয়ে আমাদের তিনমাত্রার স্পেস আর সময় বা টাইমকে আলাদা করে না দেখে চারমাত্রার স্পেসটাইম হিসেবে দেখাই ভালো। তো আশেপাশে যখন কোন ভারী বস্তু নেই তখন স্পেসটাইম সমতল থাকে। কোন ভারী বস্তু রাখলেই স্পেসটাইম আর সমতল থাকেনা, বক্রতল হয়ে যায়। এই বক্রতলের বক্রতা নির্ভর করছে ঐ বস্তটির ভরের ওপর। এবার দ্বিতীয় আরেকটি বস্তুর কথা ভাবা যাক। দ্বিতীয় বস্তুটি সমতল স্পেসটাইমে থাকলে অর্থাৎ নিউটনের ভাষায় তার ওপর কোন বল প্রযুক্ত না হলে সে সমবেগে সরলরেখায় ছুটবে। যখনই ভারী বস্তুটাকে রাখা হবে সে দ্বিতীয় বস্তুর ওপর মধ্যাকর্ষণ বল প্রয়োগ করে তাকে একটা নির্দিষ্ট পথে চালাবে, যেমন সূর্য পৃথিবীকে উপবৃত্তাকার পথে চালাচ্ছে। আইনস্টাইনের মতে অবশ্য দ্বিতীয় বস্তুটা সেই পথেই চলবে যাতে তাকে সবচেয়ে কম দুরত্ব পেরোতে হয়। যেটা আমরাও করি, কোন জায়গায় যাওয়ার আগে জেনে নিই শর্টেস্ট রুটটা কি (যদি না হাঁটা বা বেড়ানোটাই উদ্দেশ্য হয়)। সমতল স্পেসটাইমে সরলরেখায় ছোটার কারণ ওভাবে চললেই ন্যূনতম দুরত্ব অতিক্রম করতে হয়। সমতল ব্ল্যাকবোর্ডে দুটো বিন্দু এঁকে তাদের অসংখ্য রেখা দিয়ে যোগ করতে পারি, কিন্তু সবচেয়ে কমদৈর্ঘের রেখাটা হবে সরলরেখা। এবার যদি একটা ফুটবলের ওপর দুটো বিন্দু দিই, তাহলে কিন্তু তাদের মধ্যের ক্ষুদ্রতম দৈর্ঘ্যের পথ সরলরেখা হবেনা। স্পেসটাইমের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। ভারী বস্তুটা স্পেসটাইমটাকে এমনভাবে বেঁকিয়ে চুড়িয়ে রাখবে যাতে দ্বিতীয় বস্তুটা সরলরেখার বদলে ন্যূনতম দুরত্বের পথে ছোটে, আমরা যেমন রাস্তায় খানাখন্দ থাকলে একটু ঘুরপথে যাই।
আইনস্টাইনের এই নতুন তত্ত্ব অনেকের কাছে হয়ে উঠল সুখে থাকতে ভূতে কিলনোর সামিল। নিউটনের মহাকর্ষ সূত্র দিয়ে দিব্যি কষে ফেলা যাচ্ছে চন্দ্র তারার অংক হিসেব। খামোকা এইসব জ্যামিতির ঝামেলা কেন বাপু? রবীন্দ্রনাথ তখন কিশোরদের উপযোগী বিজ্ঞানের পাঠ্যবই লিখছিলেন। ৭০ বছর বয়সে জেনারেল রিলেটিভিটি শিখতে বসে লিখলেন, 
"আমরা এমন একটা জগতে আছি যার আয়তনের স্বভাব অনুসারে প্রত্যেক বস্তুই প্রত্যেকের দিকে ঝুঁকতে বাধ্য। বস্তুমাত্র যে আকাশে থাকে তার একটা বাঁকানো গুণ আছে, মহাকর্ষ তারই প্রকাশ। এটা সর্ব্যব্যাপী, অপরিবর্তনীয়। এমনকি আলোককেও এই বাঁকা বিশ্বের ধারা মানতে হয়, তার নানা প্রমাণ পাওয়া গেছে। বোঝার পক্ষে (নিউটনের) টানের ছবি সহজ ছিল, কিন্তু যে নতুন জ্যামিতির সাহায্যে এই বাঁকা আকাশের ঝোঁক হিসেব করে জানা যায় সে কজন লোকেরই বা আয়ত্তে আছে।"  (বিশ্বপরিচয়)
আইনস্টাইনের তত্ত্ব অনুযায়ী ভারী বস্তুর পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় আলোকরশ্মিরও "বাঁকা বিশ্বের ধারা" মেনে সরলরেখা ছেড়ে বিচ্যুত হওয়ার কথা।
আইনস্টাইনের তত্ত্ব অনুযায়ী ভারী বস্তুর পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় আলোকরশ্মিরও "বাঁকা বিশ্বের ধারা" মেনে সরলরেখা ছেড়ে বিচ্যুত হওয়ার কথা।

ফিরে আসি সেই সূর্য্যগ্রহণের কথায়। আইনস্টাইনের তত্ত্ব অনুযায়ী ভারী বস্তুর পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় আলোকরশ্মিরও "বাঁকা বিশ্বের ধারা" মেনে সরলরেখা ছেড়ে বিচ্যুত হওয়ার কথা। এই বিচ্যুতিটাই মাপতে গেছিলেন এডিংটনরা। রাত্রে সূর্যের অনুপস্থিতিতে বৃষরাশির তারাগুলো থেকে আলো আসছিল সরলরেখায়। দিনের বেলায় সূর্যের পাশ দিয়ে আসার সময় ঐ একই তারা থেকে আসা আলো বেঁকে গেছিল প্রিন্সিপির পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী ১.৬১ সেকেন্ড ও সোবরালের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী ১.৯৮ সেকেন্ড কোণে। আইনস্টাইনের হিসেব অনুসারে এই কৌণিক সরণের মাপ হওয়া উচিৎ ১.৭৮ সেকেন্ড, যা পরীক্ষালব্ধ ফলের কাছাকাছি। 
এটাই ছিল সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্বের সপক্ষে প্রথম পরীক্ষামূলক প্রমাণ। এডিংটন তার করে খবরটা জানালে আইনস্টাইন তারবার্তাটি তাঁর এক ছাত্রের হাতে দিয়ে বলেন "এতে তোমার আগ্রহ থাকতে পারে।" গুরুর তত্ত্ব প্রমাণিত হয়েছে দেখে ছাত্রটি উল্লাসিত হয়ে ওঠে, কিন্তু আইনস্টাইন তার উৎসাহে জল ঢেলে বলেন, "এত লাফাচ্ছো কেন বাপু? এ তো জানা কথা আমার তত্ত্ব ঠিক" ছাত্রটি থমকে গিয়ে বলে, "যদি এমন হত যে পরীক্ষার ফল আপনার হিসেবের সঙ্গে মিলছে না, তখন কি বলতেন?" এর উত্তরে আইনস্টাইন যা বলেন তা ইতিহাস হয়ে গেছে, "তখন ঈশ্বরের জন্য দুঃখিত হতাম, আমার তত্ত্বটা নির্ভুল!" (Then I would have been sorry for the dear Lord - the theory is correct)

নিউটনের মহাকর্ষের সূত্র দিব্যি কাজ করলেও তাতে কিছু গণ্ডগোল ছিল। যেমন নিউটনের মহাকর্ষীয় বল কাজ করে action at a distance নীতি অনুসারে। ধরা যাক সূর্য যদি হঠাৎ হাপিস হয়ে যায় সেই মুহূর্তেই পৃথিবী সমেত সব গ্রহ ছিটকে চলে যাবে। কিন্তু আলোর বেগের (৩ ১০৮ মিটার/সেকেন্ড) চেয়ে দ্রুতগতিতে কোন তথ্য আদান প্রদান হতে পারেনা। সূর্য থেকে পৃথিবীতে আলো আসতে সময় লাগে ৮ মিনিট। তার আগে সূর্যের অন্তর্ধানের খবর আমরা পাবনা। কিন্তু সে খবরটা আসবে কিভাবে? সূর্যের না হয় আলো আছে। ধরা যাক একটা মৃত নক্ষত্র শ্বেত বামন উড়ে এসে জুড়ে বসল সৌরমণ্ডলের কাছাকাছি। শ্বেত বামন আলো বিকিরণ করে না। তাহলে সে কিভাবে খবর পাঠাবে, "আমি এসে গেছি"?

আইনস্টাইন এক নতুন দূতের গল্প শোনালেন, যার নাম মহাকর্ষীয় তরঙ্গ। তরঙ্গ বোঝা গেল, কিন্তু কেমন তরঙ্গ? আগে তরঙ্গ বলতে জানা ছিল, সমুদ্রের ঢেউ, শব্দ তরঙ্গ ইত্যাদি, যেগুলো প্রবাহিত হয় মাধ্যমের কণাগুলির কম্পনের মাধ্যমে। তারপর হাইগেন্স, ম্যাক্সওয়েল এরা দেখালেন আলোও এক ধরণের তরঙ্গ, তড়িৎ চুম্বকীয় তরঙ্গ, যা কোন মাধ্যম ছাড়াই অগ্রসর হতে পারে। শুধু দৃশ্যমান আলো নয়, এক্স রশ্মি, গামা রশ্মি, অতিবেগুনি রশ্মি, অবলোহিত রশ্মি, মাইক্রোওয়েভ সবাই তড়িৎ চুম্বকীয় তরঙ্গ, পার্থক্য শুধু তরঙ্গদৈর্ঘ্য ও কম্পাঙ্কে। তরঙ্গের গতির লম্বভাবে তড়িৎ ও চৌম্বকক্ষেত্রের কম্পনের সঙ্গে এই ধরণের তরঙ্গ প্রবাহিত হয়। কিন্তু শব্দ তরঙ্গই হোক বা তড়িৎ চুম্বকীয় তরঙ্গই হোক, মাধ্যম থাক না থাক, এগোয় স্পেসটাইমের ওপর দিয়েই। কিন্তু মহাকর্ষীয় তরঙ্গের চরিত্র সম্পূর্ণ অন্য, এক্ষেত্রে ঢেউ তৈরী হয় খোদ স্পেসটাইমেই।  ব্যাপারটা বুঝতে একটা থিয়েটারের হলে যাওয়া যাক। থিয়েটারের মঞ্চটা হল স্পেসটাইম আর নটনটিরা হলেন মাধমের কণা বা তড়িৎ বা চৌম্বক ক্ষেত্র। মঞ্চের ওপর নটনটিরা অভিনয় করছে এটা হল শব্দ বা তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ। এবার হঠাৎ ভূমিকম্প হল আর সোফা, খাট, আলমারি সমেত মঞ্চটা নাচতে শুরু করল, তখন যে নাটক শুরু হবে তা হল স্পেসটাইমের ঢেউ।  

এখন কথা হল এই ঢেউ তৈরী হবে কিভাবে? জলে একটা পাথর ছুঁড়লে জলের ঢেউ তৈরী হয়। তড়িৎ চুম্বকীয় তরঙ্গের উৎপত্তি হয় যদি কোন আধানযুক্ত কণার গতিবেগের মান বা দিক সময়ের সঙ্গে বদলাতে থাকে। একইরকম ভাবে মহাকর্ষীয় তরঙ্গের উৎস হল কোন ভারী বস্তুর ত্বরিত গতি। অর্থাৎ আপনি যদি মাটিতে ডিগবাজি খান বা একটা ডাম্বেল নিয়ে বনবন করে ঘোরান তাহলেও মহাকর্ষীয় তরঙ্গের সৃষ্টি হবে যদিও অত ছোট্ট ঢেউকে ধরার মত যন্ত্র দূর ভবিষ্যতেও পাওয়ার সম্ভাবনা নগণ্য। শনাক্ত করার মত ঢেঊ তৈরী হতে পারে কোন মহাজাগতিক ধুন্ধুমার কাণ্ড ঘটলে। এই যে পৃথিবী সূর্যের চারদিকে উপবৃত্তাকার পথে ঘুরছে, তার অর্থ পৃথিবীর গতিবেগের অভিমুখ প্রতিমুহূর্তে বদলাচ্ছে। তাহলে পৃথিবীও মহাকর্ষীয় তরঙ্গ বিকিরণ করছে। সেই বিকিরণের প্রাবল্য কতটা?

এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগে একটা ব্যাপার মনে রখলে সুবিধে হবে যে অন্যান্য যেকোন তরঙ্গের মত মহাকর্ষীয় তরঙ্গও কিছু শক্তি বহন করে নিয়ে যায়। এখন শক্তির নিত্যতা সূত্র অনুযায়ী শক্তির মোট পরিমাণ ধ্রুবক থাকতে হবে। মনে রাখা প্রয়োজন শক্তি বলতে শুধু স্থিতিশক্তি বা গতিশক্তি নয়, বস্তুর ভরকেও হিসেবে রাখতে হবে। কারণ আইনস্টাইনের বিশেষ আপেক্ষিকতাবাদের তত্ত্ব থেকে আমরা জানি ভরকে শক্তিতে এবং শক্তিকে ভরে রূপান্তরিত করা যায়। m পরিমাণ ভরকে যদি E পরিমাণ শক্তিতে রূপান্তরিত করা যায় তবে তাদের সম্পর্ক হবে E=mc2, যেখানে c হল শূণ্য মাধ্যমে আলোর বেগ। তো মহাকর্ষীয় তরঙ্গ যদি খানিকটা শক্তি ছিনিয়ে নিয়ে যায় তবে যে বস্তুটি ঐ তরঙ্গকে বিকিরণ করছে তার শক্তি সেই পরিমাণে কমে যাবে। তাহলে পৃথিবী সূর্যের চারিদিকে পরিভ্রমণ করার সময় মহাকর্ষীয় বিকিরণের মাধ্যমে শক্তিক্ষয় করতে থাকবে। ফলতঃ তার কক্ষের ব্যাসার্ধ ক্রমশ কমবে এবং শেষে হতোদ্যম হয়ে সূর্যের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। অনুরূপ সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিলেন বিজ্ঞানী রাদারফোর্ড, যখন তিনি পরমাণুর ভেতরে ধণাত্মক আধানবিশিষ্ট নিউক্লিয়াসের চারিদিকে ঋণাত্মক আধানবিশিষ্ট ইলেকট্রনের আবর্তনকে সৌরমণ্ডলে সূর্যের চারিদিকে গ্রহগুলির আবর্তনের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। রাদারফোর্ডের মডেল সত্যি হলে ইলেকট্রন তড়িৎচুম্বকীয় বিকিরণের মাধ্যমে শক্তিক্ষয় করে নিউক্লিয়াসের ঘাড়ে পড়বে আর পরমাণুর কোন অস্তিত্বই থাকবে না! পরে অবশ্য জানা যায় পরমাণুর ভেতরটা মোটেই সৌরজগতের মত নয়, ইলেকট্রন আসলে কোয়ান্টাম কণা, যে কোন নির্দিষ্ট ব্যাসার্ধের কক্ষে ঘোরে না, বরং সে এমনভাবে চলাফেরা করে যাতে তার কৌণিক ভরবেগ ও শক্তি ধ্রুবক থাকে। 

তো যেকোন দুটো মহাজাগতিক বস্তু যদি পরস্পরের চারদিকে ঘোরে তবে মহাকর্ষীয় তরঙ্গের মাধ্যমে যে শক্তি বিকিরিত হবে তা গণনা করা সম্ভব যদি বস্তুদুটির ভর ও মধ্যবর্তী দুরত্ব জানা থাকে। বস্তুদুটির ভর যত বেশী হবে ও তাদের মধ্যেকার দুরত্ব যত কম হবে তত বেশী শক্তি বিকিরিত হবে। সূর্যের চারপাশে পৃথিবীর বার্ষিক গতির জন্য এভাবে যে শক্তি বিকিরিত হয় তার হার ২০০ ওয়াট। এইটুকু শক্তি দিয়ে আপনি বড়জোর গোটা পাঁচেক টিউব লাইট জ্বালাতে পারেন বা একটা টিভি বা ল্যাপটপ কষ্টেসৃষ্টে চালাতে পারেন! ওয়াশিং মেশিন বা এসি শক্তিতে কুলোবে না। একটা তুলনার জন্য সূর্যের তড়িৎ চুম্বকীয় বিকিরণের কথা ভাবা যেতে পারে, আমাদের মানব সভ্যতা, জীবজগৎ যার একটা ছোট্ট অংশ ব্যবহার করে টিকে আছে। ১ এর পিছনে ২৬টা শূণ্য বসালে যা হয়,  সূর্যের তড়িৎ চুম্বকীয় বিকিরণের ক্ষমতা তত ওয়াট। অর্থাৎ মহাকর্ষীয় তরঙ্গের মাধ্যমে সৌরমণ্ডল থেকে বিকীর্ণ শক্তি যে নেহাতই নগণ্য তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। এইটুকু শক্তি বিকিরণের ফলে পৃথিবীর কক্ষপথের ব্যাসার্ধ প্রতি বছর ০.০৩ ন্যানোমিটার অর্থাৎ একটা হাইড্রোজেন পরমাণুর আকারের ৩০০ ভাগের একভাগ করে কমছে! এভাবে ১এর পিছনে ২৩টা শূণ্য বসালে যা হয় তত বছর পর পৃথিবী সূর্যের ঘাড়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে! সময়টা কত বড় তা বুঝতে এটুকু তথ্যই যথেষ্ট যে এই মহাবিশ্বের বয়স ১৪ বিলিয়ন অর্থাৎ চোদ্দর পিছনে ৯ টা শূন্য বসালে যা হয় তত বছর।

দুটো নক্ষত্র পরস্পরের চারদিকে পরিক্রমণ করলে মহাকর্ষীয় বিকিরণের মাধ্যমে শক্তিক্ষয় করে অবশেষে পরস্পরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে।


ওপরের সংখ্যাগুলো থেকে এটা বোঝা গেল যে সাধারণ গ্রহ, নক্ষত্রের গতির জন্য যে অতিক্ষুদ্র মহাকর্ষীয় তরঙ্গ তৈরী হয় তার মাপ নেওয়া আদৌ সম্ভব নয়। পরিমাপযোগ্য মহাকর্ষীয় তরঙ্গ উৎপাদনের জন্য আরো অনেক বেশী ভর ও অনেক কম ব্যাসার্ধের কক্ষে পরিভ্রমণ করা মহাজাগতিক বস্তু সমষ্টির প্রয়োজন। এখন একটা গ্রহ একটা নক্ষত্রের যতখুশি কাছে তো যেতে পারেনা। যেমন সৌরজগতের কোন গ্রহই সূর্যের যা ব্যাসার্ধ অর্থাৎ ৭ লক্ষ কিলোমিটার তার কাছাকাছি যেতে পারবে না। তাই এমন বস্তু দরকার যার ভর শুধু বিশাল নয়, আয়তনও খুব ছোট। অর্থাৎ ঘনত্ব খুব বেশী। এই ধরণের মহাজাগতিক বস্তু তৈরী হয় একটা নক্ষত্রের জ্বালানি শেষ হয়ে যাওয়ার পর। এমনিতে ভরের জন্য যেকোন নক্ষত্রই চুপসে যেতে চায়, কিন্তু অনবরত নিউক্লিয় সংযোজন চুল্লী চালু থাকায় একটা বহির্মুখী চাপ কাজ করে, ফলে নক্ষত্র সাম্যাবস্থায় থাকে। এই নিউক্লিয় চুল্লীর জ্বালানি ফুরিয়ে গেলে নক্ষত্র সংকুচিত হতে থাকে। আমাদের সুব্রহ্মণিয়ন চন্দ্রশেখর দেখিয়েছিলেন তারাটির কেন্দ্রীয় অঞ্চলের (যেখানে নিউক্লিয় সংযোজন বিক্রিয়া চলার মত চাপ তাপমাত্রা বিদ্যমান থাকে) ভর যদি সূর্যের ভরের ১.৪ গুণের কম হয় তবে সে সংকুচিত হয়ে শ্বেতবামনে পরিণত হবে। একটা শ্বেতবামনের ঘনত্ব সূর্যের ঘনত্বের দশ লক্ষ গুণ, অর্থাৎ পৃথিবীর সমান আয়তনে সূর্যের সমান ভর ঢুকে যাবে। তারাটির কেন্দ্রীয় অঞ্চলের ভর যদি সূর্যের ভরের ১.৪ গুণ থেকে ৩ গুণের মধ্যে হয় তাহলে আরো সংকুচিত হয়ে নিউট্রন স্টারে পরিণত হবে। এক একটা নিউট্রন স্টারের ঘনত্ব এমন যে কয়েক কিলোমিটার ব্যাসার্ধের গোলকের মধ্যে গোটা কতক সূর্য ঢুকে যাবে। আর তারাটির ভর আরো বেশী হলে তার ভবিতব্য হল কৃষ্ণগহ্বর বা ব্ল্যাকহোল। ব্ল্যাকহোল হল একধরণের স্পেসটাইম সিঙ্গুলারিটি যেখানে সমস্ত ভর কেন্দ্রীভূত থাকে একটা বিন্দুতে। ফলত ঘনত্ব ও স্পেসটাইম জ্যামিতির বক্রতা হয়ে দাঁড়ায় অসীম। ব্ল্যাকহোলের আশেপাশে মহাকর্ষীয় ক্ষেত্র এমনই শক্তিশালী হয় যে কোন বস্তু এমনকি আলোও বেরিয়ে আসতে পারেনা তার আকর্ষণ থেকে। 

সুতরাং নিউট্রন স্টার বা ব্ল্যাকহোল মহাকর্ষীয় তরঙ্গের একটা গুরুত্বপূর্ণ উৎস হতে পারে। এরকম একজোড়া ব্ল্যাকহোল বা নিউট্রন স্টার যদি পরস্পরকে প্রদক্ষিণ করে তবে মহাকর্ষীয় বিকিরণ হবে। ফলত তাদের কক্ষের ব্যাসার্ধ কমবে আর ততই প্রদক্ষিণ বেগের মান বাড়তে থাকবে আর মহাকর্ষীয় বিকিরণের হারও বাড়তে থাকবে। এভাবে যখন তারা পরস্পরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে তখন বিকিরণের হার সবচেয়ে বেশী হবে। কিন্তু মুশকিল টা হল তরঙ্গ যত এগোয় তার তীব্রতা ব্যাস্তানুপাতে কমতে থকে এবং এই ধরণের নিউট্রন স্টার বা ব্ল্যাকহোল পৃথিবী থেকে এত দূরে রয়েছে যে আমাদের কাছে পৌঁছতে পৌঁছতে সে অতি দুর্বল হয়ে যায়। যদি হাজার কিলোমিটার  দৈর্ঘ্যের একটা রড নেওয়া হয়, মহাকর্ষীয় তরঙ্গের প্রভাবে তার দৈর্ঘ্যের হ্রাস বা বৃদ্ধি হবে একটা নিউক্লিয়াসের ব্যাসের চাইতেও কম। বলা বাহুল্য এত সূক্ষ্ম পরিমাপ করার মত যন্ত্র তৈরী করা মোটেই সহজ ব্যাপার ছিল না। অথচ পরীক্ষামূলক প্রমাণ না থাকা সত্ত্বেও বিজ্ঞানীরা ধরেই নিয়েছিলেন মহাকর্ষীয় তরঙ্গ থাকতেই হবে। এর কারণ হল তড়িৎ চুম্বকীয় ক্ষেত্রের সঙ্গে মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রের সাদৃশ্য (analogy)। এই "সাদৃশ্য" জিনিসটা তাত্ত্বিক গবেষণায় একটা গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। যখন একটা নতুন কোন তত্ত্ব বাজারে আসে, তখন দেখা হয় কোন সুপরিচিত পুরনো তত্ত্বের সঙ্গে তার মিল আছে কিনা, থাকলে সেই জানা তত্ত্বের সাহায্যে নতুন অজানা তত্ত্বকে বোঝার চেষ্টা হয়। যেমন রাদারফোর্ড পরমাণুর গঠন ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছিলেন সৌরজগতের সঙ্গে সাদৃশ্য বের করে। এই সাদৃশ্য দিয়ে একটা অজানা বিষয়কে বোঝার সুবিধে হয় বটে কিন্তু মিলের পাশাপাশি দুটো বিষয়ের অমিল গুলোকে মাথায় না রাখলে বড়সড় ভুল হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা। উনিশ শতকের মাঝামাঝি ম্যাক্সওয়েল যখন বললেন আলো একধরণের তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ, তখন স্বাভাবিক ভাবেই তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গের সঙ্গে সাদৃশ্য খোঁজা হয়েছিল সুপরিচিত শব্দ তরঙ্গের সঙ্গে। স্থিতিস্থাপক শব্দ তরঙ্গ মাধ্যম ছাড়া প্রবাহিত হতে পারেনা। অথচ সূর্য থেকে তো দিব্যি পৃথিবীতে আলো আসছে কোন মাধ্যম ছাড়াই। তাই কল্পনা করা হল এক ভুতুরে মাধ্যম ইথার ব্যাপ্ত রয়েছে সৌরজগতে। ইথারের অস্তিত্ত্বের পক্ষে কোন প্রমাণ না মিললেও, মাইকেলসন ও মর্লীর পরীক্ষায় ইথারের দেখা পাওয়া না গেলেও প্রায় অর্ধ শতক ধরে বিজ্ঞানীরা ইথারকে ত্যাগ করতে পারেননি। শেষে আইনস্টাইনের বিশেষ আপেক্ষিকতাবাদ ইথারের জল্পনা শেষ করল এবং নিশ্চিতভাবে জানা গেল কোন মাধ্যম ব্যাতিরেকেই তড়িৎ চুম্বকীয় তরঙ্গ প্রবাহিত হতে পারে।

তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গের ক্ষেত্রে তড়িৎ ও চৌম্বক ক্ষেত্র তরঙ্গ প্রবাহের সঙ্গে লম্বভাবে প্রবাহিত হয়। এজন্য তড়িৎ চুম্বকীয় তরঙ্গ হল তির্যক তরঙ্গ। 


আরো বছর দশেক বাদে আইনস্টাইন যখন সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ হাজির করলেন ততদিনে তড়িৎচুম্বকীয় ক্ষেত্র ও তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গের কাজ কারবার মোটামুটি জানা হয়ে গেছে। কাজেই এই সাদৃশ্য অনুযায়ী মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রের সঙ্গে মহাকর্ষীয় তরঙ্গের অস্তিত্ত্ব কল্পনা করা অত্যন্ত স্বাভাবিক। কিন্তু সমস্যা যেটা হল, ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণের তুলনায় আইনস্টাইনের সমীকরণ বহুগুণ জটিল। কাজেই ম্যাক্সওয়েল সমীকরণকে সমাধান করে যেভাবে সহজেই তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ বের করা গেছিল আইনস্টাইন সমীকরণের বেলায় তা সম্ভব হল না। তবে দুর্বল মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রের জন্য মহাকর্ষীয় তরঙ্গের একটা সরলীকৃত সমাধান আইনস্টাইন বের করে ফেললেন। দেখা গেল মহাকর্ষীয় তরঙ্গও তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গের মতই আলোর বেগে চলে। শব্দ তরঙ্গ ও তড়িৎ চুম্বকীয় একটা অন্যতম পার্থক্য হল শব্দ তরঙ্গের ক্ষেত্রে মাধ্যমের অণুগুলো তরঙ্গ প্রবাহের অভিমুখ বরাবর স্পন্দিত হয় আর তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গের ক্ষেত্রে তড়িৎ ও চৌম্বক ক্ষেত্র তরঙ্গ প্রবাহের সঙ্গে লম্বভাবে স্পন্দিত হয়। এজন্য শব্দকে বলা হয় অনুদৈর্ঘ্য তরঙ্গ আর তড়িৎ চুম্বকীয় তরঙ্গ হল তির্যক তরঙ্গ। এবার প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক মহাকর্ষীয় তরঙ্গের চরিত্র নিয়ে। আইনস্টাইন সমীকরণ সমাধান করে অনুদৈর্ঘ্য ও তির্যক দুধরণের উপাংশ পাওয়া গেল। কিন্তু আইনস্টাইন অনতিবিলম্বেই উপলব্ধি করলেন অনুদৈর্ঘ্য উপাংশগুলোর কোন বাস্তব অস্তিত্ত্ব নেই, কাজেই মহাকর্ষীয় তরঙ্গও কার্যত তির্যক তরঙ্গই। আসলে আপেক্ষিকতা তত্ত্বের মর্মই হল আমরা কি ধরণের স্কেল দিয়ে দৈর্ঘ্য মাপছি, কেমন ঘড়ি দিয়ে সময় মাপছি, স্থির আছি না গাড়ীতে চড়ে যাচ্ছি, তার ওপর বস্তুজগতের নিয়মগুলো নির্ভর করে না। কিন্তু পরীক্ষা করার জন্য বা অঙ্ক করার জন্যেও আমাদের একটা স্কেল, একটা ঘড়ি, একটা গাড়ী বেছে নিতে হয়। আর এই বেছে নিতে গিয়ে এমন কিছু সমাধান বেরোয় যেগুলো বাস্তবে নেই। এডিংটন বলেছিলেন এই এই ভুতুরে তরঙ্গগুলো আলোর বেগে নয়, চিন্তার বেগে চলে। 

এই বিখ্যাত উক্তিটির জন্য অনেক সময় এডিংটনকে মহাকর্ষীয় তরঙ্গের বিরোধী বলা হয়ে থাকে। আসলে এডিংটন তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গের সঙ্গে সাদৃশ্য থেকে মহাকর্ষীয় তরঙ্গের চরিত্র নির্ণয়ের প্রক্রিয়াটিতে সন্দিহান ছিলেন। শুধু এডিংটন নয় সন্দেহ গ্রাস করেছিল স্বয়ং আইনস্টাইনকেও। এবং এই সন্দেহের বশে তিনি একটা মারাত্মক ভুল করে বসেন। সেই সময় তাঁর ব্যক্তিগত জীবনও একটা সঙ্কটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। তাঁর দেশে উগ্রজাতীয়তাবাদী নাজি পার্টির দাপট। একে ইহুদি তায় শান্তিকামি, যুদ্ধবিরোধী, "অ্যান্টি ন্যাশনাল" হওয়ার জন্য এটুকুই যথেষ্ট ছিল! জার্মানীর "আইনস্টাইন বিরোধী লীগ" প্রচার করছিল "আপেক্ষিকতা আর্যরাও জানত। আইনস্টাইন তার ওপর রঙ চড়িয়েছে। এটা অতি বিপজ্জনক ইহুদী চক্রান্ত।" ১৯৩৩ এ হিটলার ক্ষমতা দখল করার পর শুরু হল ইহু্দী বিজ্ঞানীদের বিতাড়ন। আইনস্টাইনের বাড়ি ভাঙচুর, বই পোড়ানো হল, মাথার দাম ঘোষণা হল। দ্বিতীয় স্ত্রী এলসা কিডনীর গুরুতর সমস্যায় আক্রান্ত, তিন বছর পরই যাঁর মৃত্যু হবে। আইনস্টান বাধ্য হলেন জার্মানী ছেড়ে আমেরিকায় আশ্রয় নিতে। যোগ দিলেন প্রিন্সটনের ইনস্টিটিউট অফ অ্যাডভান্সড স্টাডিজে। এখান থেকেই বন্ধু বিজ্ঞানী ম্যাক্স বর্নকে লেখা এক চিঠিত তিনি লিখলেন, "এক নতুন সহযোগীর সঙ্গে কাজ করে আমি একটা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি যে মহাকর্ষীয় তরঙ্গের কোন অস্তিত্ব নেই।" 

বিশ শতকের অসহিষ্ণুতা, "অ্যান্টি ন্যাশনাল" আইনস্টাইনকে দেশ থেকে তাড়িয়ে দিচ্ছেন হিটলার।


এই নতুন সহযোগীটি ছিলেন নাথান রোজেন, যাঁর সঙ্গে যৌথভাবে তিনি ১৯৩৬ এর পয়লা জুন একটি লেখা পাঠান পদার্থবিদ্যার অন্যতম জার্নাল "ফিজিকাল রিভিউ"এ। লেখাটির নাম ছিল "Do gravitational waves exist?" লেখাটির প্রথম সংস্করণ পাওয়া না গেলেও বর্নকে লেখা উপরোক্ত চিঠিটা থেকে বুঝতে অসুবিধে হয় না যে এই প্রশ্নের উত্তর ছিল "No"। এখন বিজ্ঞানের জার্নালে কোন লেখা জমা পড়লে সম্পাদক সেটা প্রকাশ করার আগে কোন বিশেষজ্ঞের কাছে পাঠান, যাঁকে রেফারি বলা হয়। রেফারি লেখাটি ছাপানোর সুপারিশ করতে পারেন বা বাতিল করতে পারেন অথবা লেখকের কাছে ফেরৎ পাঠাতে পারেন প্রয়োজনীয় পরিবর্তন/পরিবর্ধনের পরামর্শ দিয়ে। এই রেফারির পরিচয় সম্পাদক ছাড়া কেউ জানতে পারেন না। আলোচ্য লেখাটি জমা পড়ার পৌনে দুমাসের মাথায় সম্পাদক জন টেট সেটা রেফারির সমালোচনা ও মন্তব্যসমেত আইনস্টাইনকে ফেরৎ পাঠান। আর এতেই বেদম চটে যান আইনস্টাইন। সম্পাদককে পালটা চিঠিতে লেখেন, "আমি আপনাকে লেখাটা প্রকাশ করার জন্যে পাঠিয়েছিলাম, কোন বিশেষজ্ঞকে পড়ানোর জন্য নয়। আপনার এক্সপার্টের ভুলভাল মন্তব্যের জবাব দেওয়ার কোন ইচ্ছে আমার নেই। লেখাটি আমি অন্য জার্নালে পাঠাব।" এ ঘটনার মাসখানেকের মধ্যেই প্রিন্সটনে পা রাখেন এক টগবগে, ঠোঁটকাটা যুবক, হাওয়ার্ড রবার্টসন। ততদিনে রোজেন চলে গেছেন সোভিয়েত ইউনিয়নে। আইনস্টাইনের সহযোগী হিসেবে যোগ দিয়েছেন লিওপোল্ড ইনফেল্ড, যিনি নিজেও একজন ইহুদী, নাজি অধিকৃত পোল্যান্ড থেকে বিতাড়িত হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রয় নিয়েছেন। রবার্টসন ইনফেল্ডকে জানান তিনি মহাকর্ষীয় তরঙ্গ বিষয়ে আইনস্টাইনের সিদ্ধান্ত মানেন না। ইনফেল্ড তাঁর বসের কানে তুললে আইনস্টাইন বলেন কাকতালীয়ভাবে তিনি আগের রাতেই তিনি নিজের গণনার একটা ভুল চিহ্নিত করেছেন। আইনস্টাইন ভুল আঁকড়ে থাকার মানুষ ছিলেন না। ফলতঃ কয়েক মাস বাদে জার্নাল অফ ফ্রাঙ্কলিন ইনস্টিটিউট এ "On gravitational waves" নামে আইনস্টাইন ও রোজেনের যে লেখাটি প্রকাশিত হয় তার প্রতিপাদ্য হয়ে দাঁড়ায় আগেরটার এক্কেবারে উল্টো, অর্থাৎ মহাকর্ষীয় তরঙ্গ আছে। নাটকের অবশ্য এখানেই শেষ হয়নি। রাশিয়ায় বসে খবরের কাগজ পড়ে রোজেন জানতে পারেন তাঁদের লেখাটি সম্পূর্ণ বিপরীত সিদ্ধান্ত নিয়ে অন্য এক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছেন। তিনি ক্ষুব্ধ হন এবং একটা সোভিয়েত জার্নালে একটা লেখা ছাপান যেখানে তাঁদের পুরনো অবস্থান অর্থৎ মহাকর্ষীয় তরঙ্গ নেই এটাই প্রমাণ করার চেষ্টা করেন। তাঁর চেষ্টা অবশ্য সফল হয়নি। যুদ্ধের পর ফেলিক্স পিরানি, হারমান বন্ডি ও ইভর রবিনসনের গবেষণায় রোজেনের মত খারিজ হয়ে গেল। আর একটা তথ্য দিয়ে এই পর্বটা শেষ করি। ফিজিকাল রিভিউ-এর নথি থেকে জানা যায় সেই অজ্ঞাতপরিচয় রেফারি, যাঁর সমালোচনামূলক রিপোর্টে আইনস্টাইন খেপে গিয়েছিলেন তিনি আর কেউ না স্বয়ং রবার্টসন। রেফারি হিসেবে তিনি আইনস্টাইনকে দিয়ে ভুল সংশোধন করাতে পারেননি, কিন্তু সহকর্মী হিসেবে সেই কাজটাই সাফল্যের সঙ্গে উতরে দিয়েছিলেন। 

পদার্থবিজ্ঞানের যেকোন শাখাতেই তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক দুটো দিকই গুরুত্বপূর্ণ। তত্ত্ব যেমন পরীক্ষা ও প্রয়োগের পথ দেখায়, ব্যবহারিক পর্যবেক্ষণ থেকে তেমন তত্ত্বের পরিমার্জন/পরিবর্ধন বা নতুন তত্ত্ব খোঁজার মোটিভেশন পাওয়া যায়। এই মোটিভেশনটারই অভাব ছিল মহাকর্ষীয় তরঙ্গ বা আরো বড় করে বলতে গেলে সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদে। বিংশ শতকের প্রথম চতুর্থার্ধেই যে দুটো আবিষ্কার বিজ্ঞানের জগতে আমূল বিপ্লব ঘটিয়েছিল তার একটা যদি কোয়ান্টাম মেকানিক্স হয় তো আরেকটা আপেক্ষিকতাবাদ। পরীক্ষা ও ব্যবহারিক প্রয়োগের বিস্তৃত ক্ষেত্র নিয়ে কোয়ান্টাম মেকানিক্স স্বাভাবিকভাবেই পদার্থবিজ্ঞানীদের অনেক বেশী আকৃষ্ট করেছিল। সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদের চর্চায় মেতে রইলেন হাতে গোণা কয়েকজন গণিতজ্ঞ ও পদার্থবিদ। তাঁরা আবার ছড়িয়ে ছিলেন আমেরিকা, সোভিয়েত ইউনিয়ন আর ইউরোপের বিভিন্ন দেশে। তার ওপর বেজে গেল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা। কাগজ কলম ছেড়ে বন্দুক হাতে যুদ্ধক্ষেত্রে চলে গেলেন অনেক গবেষক, অনেকে আবার নেমে পড়লেন প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত গবেষণা। যাঁরা রইলেন, তাঁদের কাছে তখন স্কাইপ বা ইমেল ছিল না যে যুদ্ধের বাজারে তিন মহাদেশে বসে পরস্পরের সঙ্গে সহযোগিতা করবেন। ধংসের মধ্যেও অবশ্য বিজ্ঞানের সলতেটা জ্বালিয়ে রেখেছিলেন ল্যান্ডাউএর নেতৃত্বে সোভিয়েত বিজ্ঞানীরা। পরস্পরের চারদিকে ঘূর্ণায়মান নক্ষত্রজুড়ির মহাকর্ষীয় বিকিরণ তিনিই দেখিয়েছিলেন আরেক পদার্থবিদ লিফশিৎজের সাহায্যে। যুদ্ধ থামলে রাষ্ট্রনেতারা আবার সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ ও তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যার অন্যান্য ক্ষেত্রে গবেষণার জন্য অর্থ খরচ করার কথা ভাবলেন। পঞ্চাশের দশক থেকে সত্তরের দশকের শেষ পর্যন্ত সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদের জন্য বরাদ্দ করা অর্থের একটা বড় অংশ এসেছিল আমেরিকান বায়ুসেনার তহবিল থেকে। ফিজিক্সের কোন তত্ত্ব যে কখন অস্ত্র বানানোর কাজে লেগে যায় তা নিয়ে রাজনীতিকরা নিশ্চিত ছিলেন না। হাজার হোক পরমাণুর শক্তিকে কাজে লাগিয়ে যে বোমা বানানো যেতে পারে তার ইঙ্গিত তো বিশেষ আপেক্ষিকতাবাদ থেকেই এসেছিল!

মহাকর্ষীয় তরঙ্গের গবেষনায় নতুন জোয়ার এলো ১৯৫৫ সালে যখন বিশেষ আপেক্ষিকতাবাদের ৫০ বছর ও সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদের ৪০ বছর উপলক্ষে এক সুইজারল্যান্ডের বার্ন শহরে বিশেষ বৈজ্ঞানিক সম্মেলনে মিলিত হলেন বিশ্বের তাবড় আপেক্ষবিদরা। বার্ন শহরটার একটা অন্য তাৎপর্যও আছে। ১৯০৫ এ এই শহরেরই এক পেটেন্ট অফিসের কেরাণী ছিলেন আইনস্টাইন, এখানে বসেই বিশেষ আপেক্ষিকতাবাদের বিখ্যাত পেপারগুলো তিনি লিখেছিলেন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেবছরই অর্থাৎ ১৯৫৫ সালের এপ্রিল মাসে মারা গেলেন আইনস্টাইন। ফলত বার্ন সম্মেলনে তিনি ছিলেন না। তবে তাঁর প্রাক্তন সহযোগী রোজেন ছিলেন। তিনি তখনো মহাকর্ষীয় তরঙ্গের বাস্তবতা নিয়ে সন্দিহান। রোজেন তাঁর ভাষণে বললেন মহাকর্ষীয় তরঙ্গ কোন শক্তি বহন করে না। তাঁর বক্তব্য কার্যত আইনস্টাইনের সঙ্গে সেই ১৯৩৬ এর ছাপা না হওয়া লেখারই প্রতিফলন ছিল। রোজেনের যুক্তি অবশ্য ধোপে টিকল না। দু বছর পর আমেরিকার নর্থ ক্যারোলিনা রাজ্যের চ্যাপেল হিলে সাধারণ আপেক্ষিকতা ও মহাকর্ষ নিয়ে আরেকটা সম্মেলনে এক কাল্পনিক পরীক্ষার সাহায্যে রোজেনের যুক্তি খারিজ করে দিয়েছিলেন রিচার্ড ফাইনম্যান। "কাল্পনিক পরীক্ষা", শুনেই বোঝা যাচ্ছে ল্যাবরেটারিতে সম্পন্ন করা হয় না। মনে মনে পরীক্ষাটির পরিকল্পনা করে, যুক্তি দিয়ে বোঝার চেষ্টা করা হয় তার রেজাল্ট কি হতে পারে।  সেই পরীক্ষার কথায় আসার আগে "সিওরলি ইউ আর জোকিং মিস্টার ফাইনম্যান" বই থেকে দেখে নিই ফাইনম্যান কিভাবে সম্মেলনস্থলে পৌঁছেছিলেন। 

ফাইনম্যানের কাল্পনিক পরীক্ষা। একটা স্পেসটাইমের ঢেউ যদি ঐ রডটার দৈর্ঘ্যের সঙ্গে লম্বভাবে যায় তাহলে রিং দুটো রডের গা বেয়ে ওঠানামা করবে।


বরাবরের লেটলতিফ ফাইনম্যান নর্থ ক্যারোলিনার এয়ারপোর্টে নামলেন সম্মেলন শুরু হওয়ার একদিন পরে। সঙ্গে আর কেউ ছিল না, সবাই আগের দিন চলে গেছেন। বিমানবন্দরে নেমে তিনি ট্যাক্সিস্ট্যান্ডে গিয়ে স্মার্টলি বললেন ইউনিভার্সিটি যাব। ট্যাক্সিস্ট্যান্ডের তত্ত্বাবধায়ক জিজ্ঞাসা করলেন, "আপনি কোথায় যাবেন, চ্যাপেল হিলের ইউনিভার্সিটি অফ নর্থ ক্যারোলিনা না কি র‍্যালের স্টেট ইউনিভার্সিটি অফ নর্থ ক্যারোলিনা?" বলা বাহুল্য এ প্রশ্নের কোন জবাব ছিল না ফাইনম্যানের কাছে। এখানে যে দুটো ইউনিভার্সিটি আছে তাইই তিনি জানতেন না।  তখন মোবাইল ছিল না যে কোন বন্ধুকে ফোন করে জেনে নেবেন! তবে তাঁর নাম ফাইনম্যান। একটা উপায় বের করে ফেললেন। তত্ত্বাবধায়ককে বললেন, "আচ্ছা গতকাল আপনি একদল আধপাআগলা বুড়োকে দেখেছেন, যারা কোনদিকে না তাকিয়ে খালি নিজেদের মধ্যে বকবক করছিল আর জি-মিউ-নিউ, জি-মিউ-নিউ আওড়াচ্ছিল?" এটুকু শুনেই তত্ত্বাবধায়ক একগাল হেসে বললেন, "বুঝে গেছি স্যার আর বলতে হবে না। এই এনাকে ইউনিভার্সিটি অফ নর্থ ক্যারোলিনা নিয়ে যাও।" বলে রাখা যাক বড়হাতের জি-মিউ-নিউ (Gμ𝜈) হল আইনস্টাইন টেনসর আর ছোটহাতের জি-মিউ-নিউ (gμ𝜈) হল মেট্রিক টেনসর। জেনারেল রিলেটিভিটি নিয়ে যাঁরা কাজ করেন তাঁদের ঐ মিউ-নিউ এর চক্করে না পড়ে উপায় থাকে না!

ফাইনম্যান তাঁর কাল্পনিক পরীক্ষায় একটা চোঙাকৃতি রড কল্পনা করেছিলেন। দুটো রিং রডটার সঙ্গে আঁটোসাঁটো ভাবে পরানো আছে। আগেই বলেছি মহাকর্ষীয় তরঙ্গ তির্যক তরঙ্গ। অর্থাৎ তরঙ্গ যে দিক বরাবর এগোয় তার লম্ব দিকে স্পেস ক্রমান্বয়ে সংকুচিত ও প্রসারিত হয়। এখন এরকম একটা ঢেউ যদি ঐ রডটার দৈর্ঘ্যের সঙ্গে লম্বভাবে যায় তাহলে সে চেষ্টা করবে রডটাকে একবার লম্বা ও সরু আর একবার বেঁটে ও মোটা করতে। এখন রডটা যদি শক্তপোক্ত হয় তবে সে নিজের বিকৃতি আটকাতে পারবে, কিন্তু তখন ঐ রিং দুটো রডের গা বেয়ে ওঠানামা করবে। ফলে রড ও রিং এর মধ্যে ঘর্ষণজনিত তাপ উৎপন্ন হবে। এখন শক্তির সংরক্ষণ নীতি অনুযায়ী এমনি এমনি তাপ তৈরী হতে পারে না। সুতরাং মহাকর্ষীয় তরঙ্গের শক্তিই তাপে রূপান্তরিত হয়েছে। ফাইনম্যান প্রস্তাবিত এই কাল্পনিক পরীক্ষাকে হাতিয়ার করে হারমান বন্ডি এবং আলাদাভাবে জন হুইলার ও জোসেফ ওয়েবার প্রমাণ করলেন রোজেন এবারো ভুল করেছেন, মহাকর্ষীয় তরঙ্গ শক্তিহীন নয়। রোজেন অবশ্য হার মানার পাত্র নন, সত্তর অবধি তাঁর মহাকর্ষীয় তরঙ্গ বিরোধী জেহাদ চালিয়ে গেছেন। 

জোসেফ ওয়েবার

চ্যাপেল হিলের সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন ৩৮ বছরের এক তরুণ জোসেফ ওয়েবার। মেধাবী এই ইঞ্জিনিয়ার সংসার টানার দায়ে নৌসেনায় চাকরি নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। জাপানের পার্ল হারবার আক্রমণ তিনি সামনে থেকে দেখেছেন মার্কিন যুদ্ধজাহাজের লেক্সিটনের ডেক অফিসার হিসেবে। জাপানি দের গোলায় লেক্সিটনের সলিল সমাধি ঘটে, কোনক্রমে রক্ষা পান ওয়েবার। যুদ্ধ থামলে মেরিল্যান্ড ইউনিভার্সিটিতে ইঞ্জিনিয়ারিংএর অধ্যাপক হিসেবে যোগ দিলেন। মাইক্রোওয়েভ স্পেক্ট্রোস্কোপিতে পিএইচডি করার পর তিনি জেনারেল রিলেটিভিটিতে আগ্রহী হয়ে পড়েন। তিনি বুঝতে পারছিলেন তাত্ত্বিক আলোচনার পাশাপাশি মহাকর্ষীয় তরঙ্গকে হাতেনাতে ধরা দরকার। যেমন ভাবা তেমনি কাজ। মেরিল্যান্ডে অ্যালুমিনিয়ামের তৈরী ২মিটার লম্বা ও ১ মিটার ব্যাসবিশিষ্ট অনেকগুলো অ্যান্টেনা বানালেন। অ্যান্টেনা থেকে কিছু পজিটিভ সিগন্যাল পেয়ে একটা অ্যান্টেনাকে সরিয়ে নিয়ে গেলেন হাজার কিলোমিটার দূরে শিকাগোতে। দুজায়গাতেই পরীক্ষা নিরীক্ষা চালাতে লাগলেন। অবশেষে ষাটের দশকের শেষদিকে তিনি ঘোষণা করলেন মহাকর্ষীয় তরঙ্গ পাওয়া গেছে এবং এই তরঙ্গ আসছে একটা নির্দিষ্ট দিক থেকে, যেদিকে কি না আমাদের আকাশগঙ্গা ছায়াপথের কেন্দ্র রয়েছে। হুলুস্থুল পড়ে গেল অপেক্ষবিদদের মধ্যে। ওয়েবারের নোবেলপ্রাপ্তির সম্ভাবনা নিয়ে জল্পনা শুরু হল। অনেক গবেষক পৃথকভাবে ওয়েবার দণ্ড তৈরী করে মহাকর্ষীয় তরঙ্গকে ধরার চেষ্টা করলেন। কিন্তু ওয়েবারের মত রেজাল্ট কেউই পেলেন না। দেখা গেল ওয়েবারের কম্পিউটার প্রোগ্রামিংএ কিছু গোলমাল ছিল। তাছাড়া ওয়েবার ছিলেন আদতে একজন ইঞ্জিনিয়ার। পরীক্ষা থেকে পাওয়া তথ্যকে কিভাবে বিশ্লেষণ করতে হয় তা তিনি জানতেন না বলে অনেকে মনে করেন। সত্তরের দশকের শেষদিক নাগাদ মোটামুটি সকলেই নিশ্চিত হয়ে গেলেন যে ওয়েবার কোন গ্র্যাভিটেশানাল ওয়েভ ধরতে পারেননি। একমাত্র ব্যাতিক্রম সম্ভবতঃ ওয়েবার নিজে, যিনি মৃত্যুর আগে পর্যন্ত নিজের দাবীতে অনড় ছিলেন। ব্যর্থ হলেও একথা কিন্তু অস্বীকার করার উপায় নেই ওয়েবারই প্রথম মহাকর্ষীয় তরঙ্গকে পাকড়াও করতে উদ্যোগী হয়েছিলেন তাঁর গবেষণার পথ ধরেই তৈরী হয় "লেসার ইন্টারফেরোমিটার গ্র্যাভিটেশানাল ওয়েভ অবজার্ভেটরি" বা "লাইগো" যা আরো অর্ধশতক পার করে সাফল্যের মুখ দেখবে। এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে লাইগো যখন ঘোষণা করল মহাকর্ষীয় তরঙ্গের প্রত্যক্ষ প্রমাণ তারা পেয়েছে তখন সেখানে উপস্থিত ছিলেন ওয়েবারের স্ত্রী ভার্জিনিয়া ট্রিম্বল। যখন প্রশ্ন করা হয় তাঁর স্বামী সত্যিই গ্র্যাভিটেশানাল ওয়েভ দেখতে পেয়েছিলেন কি না, ট্রিম্বল বলেন, "আমি জানি না"। ওয়েবারের গবেষণায় অনুদান বন্ধ করে দেওয়ার জন্য ন্যাশনাল সায়েন্স ফাউন্ডেশনের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি। লাইগোর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা কিপ থর্ণ দ্বিধাহীনভাবে ঘোষণা করেন, ওয়েবার ই তাঁদের পথপ্রদর্শক। লাইগোর প্রসঙ্গে আসার আগে আরো একটা গুরুত্বপূর্ন পর্যবেক্ষণের কথা বলে নিই।

জোসেফ টেলর ও রাসেল হালস

সত্তরের দশকে ম্যাসাচুসেটস ইউনিভার্সিটির দুজন বিজ্ঞানী রাসেল হালস এবং জোসেফ টেলর ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের পোর্তো রিকোয় ৩০০ মিটার ব্যাসের একটা রেডিও টেলিস্কোপের সাহায্যে একটা পালসারের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করছিলেন। পালসার একধরণের নিউট্রন স্টার, তার ওপর একটা পেল্লায় চুম্বকও বটে। এই প্রচণ্ড শক্তিশালী ঘূর্ণায়মান চুম্বক নির্দিষ্ট সময় অন্তর তড়িৎ চুম্বকীয় পালস ছাড়ে। এই তড়িৎ চুম্বকীয় পালস পৃথিবীর দিকে এলে টেলিস্কোপের সাহায্যে দেখা যায় এবং পালস আসার সময়ের ব্যবধান থেকে বলে দেওয়া যায় ঐ পালসারটির বেগ কত। কারণ তরঙ্গের কম্পাঙ্ক নির্ভর করে তরঙ্গের উৎস ও দর্শকের আপেক্ষিক বেগের ওপর। একে বলে ডপলার এফেক্ট। যেমন স্টেশনে দাঁড়িয়ে চোখ বন্ধ করে স্রেফ ট্রেনের বাঁশি শুনে আমরা বলে দিতে পারি ট্রেনটা আমাদের দিকে আসছে না দূরে সরে যাচ্ছে। এইভাবে পালস মেপে হালস ও টেলর দেখলেন এই পালসারটা ১০ লক্ষ কিলোমিটার দূরত্বে প্রায় সমান ভরের আরেকটা নিউট্রন স্টারের সঙ্গে জুড়ি বেঁধে ঘুরছে এবং তাদের মধ্যের ব্যবধান ক্রমশ কমছে, বছরে সাড়ে ৩ মিটার করে। অঙ্ক কষে দেখা গেল কক্ষপথের এই সংকোচনের হার মহাকর্ষীয় বিকিরণের জন্য যা হওয়া উচিৎ তার সাথে এক্কেবারে মিলে যাচ্ছে। হালস ও টেলর এর এই পর্যবেক্ষণই মহাকর্ষীয় তরঙ্গের প্রথম প্রমাণ, যদিও পরোক্ষ। তাঁরা এজন্য ১৯৯৩ সালে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। একটা তুলনার জন্য বলে রাখা যাক হালস টেলর জোড়ার মহাকর্ষীয় বিকিরণের হার ১ এর পিছনে ২৪ টা শূন্য বসালে যা হয় তত ওয়াট, অর্থাৎ সূর্যের তড়িৎ চুম্বকীয় বিকিরণের ২% এবং দুরত্ব কমিয়ে পরস্পরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে এদের সময় লাগবে ৩০ কোটি বছর।

হালস ও টেলরের পর্যবেক্ষণ মহাকর্ষীয় তরঙ্গের অস্তিত্ত্ব নিশ্চিত করেছিল। এবার বাকি রইল তাকে হাতেনাতে ধরা। কিন্তু গ্রাভিটেশানাল ওয়েভ নামক বেড়ালটার গলায় ঘন্টা কে বাঁধবেন? ওয়েবার সে কাজে সাহস করে এগিয়ে যেতেই আরো অনেকে হাত লাগালেন। তাঁদের একজন হলেন রেইনার ওয়েইস। বার্লিনের এক অভিজাত ইহুদি চিকিৎসক ও এক জার্মান অভিনেত্রীর সন্তান ছিলেন ওয়েইস। কিন্তু শৈশবেই তাঁকে দেশ ছাড়তে হয়। সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মেও কমিউনিস্ট রাজনীতির প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন ওয়েইসের পিতা। একে ইহুদি, কমিউনিস্ট, লাভ জিহাদ করে খাঁটি আর্যবংশীয় মহিলাকে বিয়ে করা, তার ওপর এক নাজি ডাক্তারের ভুল অপারেশানের বিরুদ্ধে রিপোর্ট করলেন। "দেশদ্রোহী" হওয়ার জন্য আর কি চাই! তখনো হিটলার সরাসরি ক্ষমতা দখল করেনি। তাই প্রাণ নিয়ে চেকস্লোভাকিয়ায় পালিয়ে আসতে সক্ষম হন, সেখান থেকে আমেরিকায়। ওয়েইস প্রথমে ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়াশোনা করলেও পরে ফিজিক্সের প্রতি আকৃষ্ট হন। দুটো বিশাল মাপের মহাজাগতিক পর্যবেক্ষণের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন ওয়েইস। একটা যদি মহাকর্ষীয় তরঙ্গ হয় তো আরেকটা হল মহাজাগতিক ক্ষুদ্রতরঙ্গ পশ্চাৎপট বিকিরণ (cosmic microwave background radiation) বা সি এম বি আর, যার ওপর দাঁড়িয়ে আছে আধুনিক বিশ্বতত্ত্ব (cosmology)। ষাটের দশকের শেষভাগে ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজিতে (এম আই টি) স্নাতকোত্তরের ছাত্রদের সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ পড়াচ্ছিলেন ওয়েইস। কিন্তু ওয়েবারের লেখা বই থেকে মহাকর্ষীয় বিকিরণ পড়াতে গিয়ে মুশকিলে পরলেন। ওয়েবারের মহাকর্ষীয় তরঙ্গ ধরার পদ্ধতি নিজেরই মাথায় ঢুকছিল না তো পড়াবেন কি? তাই বিকল্প পদ্ধতি নিয়ে নিজেই ভাবনাচিন্তা করতে লাগলেন। ওয়েইসের কল্পনাটা অনেক সহজ। ধরা যাক হাঁদা আর ভোঁদা মাথায় মাথা ঠেকিয়ে ইংরেজি এল অক্ষরের আকারে মাঠের ওপর শুয়ে আছে। এবারে পৃথিবী ফুঁড়ে যদি একটা মহাকর্ষীয় তরঙ্গ বেরিয়ে যায় তাহলে তরঙ্গের পর্যায়কালের এক অর্ধে হাঁদা লম্বা আর ভোঁদা বেঁটে হয়ে যাবে। অন্য অর্ধে ঠিক উল্টোটা ঘটবে। এখন দৈর্ঘ্যের এই অতিক্ষুদ্র হ্রাসবৃদ্ধি মাপা যাবে কিভাবে? এত সূক্ষ্ম পরিমাপ আলো ছাড়া কারো সাধ্য নয়। ১৯৬২ তেই অবশ্য দুই সোভিয়েত পদার্থবিদ গার্টেনস্টাইন ও পুস্তোভিৎ আলোর ব্যাতিচার (interference) ধর্মকে কাজে লাগিয়ে মহাকর্ষীয় তরঙ্গকে পাকড়াও করার দাওয়াই বাৎলেছিলেন। 

রেইনার ওয়েইস ও কিপ থর্ণ, ন্যাশনাল সায়েন্স ফাউন্ডেশনের সাংবাদিক সম্মেলনে।


অনেক বিজ্ঞানী অবশ্য মনে করতেন না যে আলোর ব্যাতিচারের সাহায্যে মহাকর্ষীয় তরঙ্গকে ধরা যাবে। তাঁদের অন্যতম ছিলেন কিপ থর্ণ। ইন্টারস্টেলার খ্যাত ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজির (ক্যালটেক) এই অধ্যাপকের মত বদলায় ১৯৭৫ এ। ওয়েইস তখন তাঁর প্রস্তাবিত যন্ত্র তৈরীর জন্য দরবার করছেন মার্কিন সরকারের বিভিন্ন সংস্থার কাজে। তাঁর দাবী বিবেচনার জন্য নাসার এক প্যানেলের সামনে বক্তব্য রাখতে ওয়েইসের আমন্ত্রণে ওয়াংশিংটন ডি সি তে হাজির হয়েছিলেন থর্ণ। শহরে থাকার মত হোটেল না পেয়ে তাঁরা দুজন একটা ঘর শেয়ার করেছিলেন। ওয়েইসের কথায়, 
"সত্যি বলতে কি আমি একটু চিন্তায় ছিলাম, লোকটাকে তো আমি চিনতামই না। দেখে অবশ্য ভীষণ মজার মনে হয়েছিল। তারপর তো সারারাত তর্ক-বিতর্কে কেটে গেল। আমরা সে রাতে ভোর চারটের আগে ঘুমোইনি। থর্ণের মাথায় তখন ঘুরছিল, ক্যালটেকে গ্র্যাভিটি নিয়ে কি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা যেতে পারে! শেষমেশ সে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছালো যে ব্যাতিচার মাপন (interferometry) পদ্ধতিতে মহাকর্ষীয় তরঙ্গ ধরার কাজই করতে হবে।"

থর্ণ একা নন, ব্যাতিচার মেপে মহাকর্ষীয় তরঙ্গ সনাক্তকরণ (interferometric gravitational wave detection) ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে উঠল বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে। এম আই টি ও ক্যালটেক ছাড়াও হাইন বিলিংএর নেতৃত্বে জার্মানীর গারচিং-এ এবং রোনাল্ড ড্রেভরের নেতৃত্বে স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোয় তৈরী মডেল ইন্টারফেরোমিটার। অনেক ভাবনাচিন্তা, তর্ক-বিতর্ক, সেমিনারের পর ওয়েইস, থর্ণ ও ড্রেভর আমেরিকার ন্যাশনাল সায়েন্স ফাউন্ডেশনের (এনএসএফ) কাছে লাইগো প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব দিয়ে ২৭২ মিলিয়ন ডলার অনুদান চাইলেন। অনুদানের অঙ্কের দিক দিয়ে এটাই ছিল এনএসএফের বৃহত্তম প্রকল্প। স্বাভাবিকভাবেই বিভিন্ন মহল থেকে বাধা এল। অন্যান্য ক্ষেত্রের গবেষকরা বিশেষতঃ জ্যোতির্বিদরা মনে করেছিলেন তাঁদের ভাগের অনুদানে টান পড়বে। অনেকের মতেই এটা ছিল স্রেফ অপচয়। ওয়েবারের ইতিবৃত্ত তাঁদের অবস্থানকে জোরালো করেছিল। থর্ণ-ওয়েইস-ড্রেভররা লড়াই চালিয়ে গেলেন। থর্ণ তো বাজিই ধরে বসলেন চলতি শতকের শেষেই মহাকর্ষীয় তরঙ্গ ধরা যাবে! অনেক টালবাহানার পর এনএসএফের অনুমোদন মিলল। ১৯৯৪ সালে ওয়াশিংটন প্রদেশের হ্যানফোর্ডে আর একবছর পর লুইজিয়ানা প্রদেশের লিভিংস্টোনে প্রকল্পের ভিত খোঁড়া শুরু হল। ওয়েইসরা অবশ্য সতর্ক করে দিয়েছিলেন, প্রথম অবতারেই লাইগো তার কাজে সফল নাও হতে পারে। প্রথমবারের ভুল ত্রুটি মেরামত করে উন্নততর লাইগো তৈরী হবে।

এইবার একটু লাইগোর ইন্টারফেরোমিটারের বর্ণনা দেওয়া যাক। ছবিতে দেখা যাচ্ছে L আকারের যন্ত্রটির দুটি বাহু রয়েছে যাদের দৈর্ঘ্য l
1 ও l2। M হল রশ্মিবিভাজক। ছোট্ট লেজার উৎস S থেকে আসা আলোকরশ্মিগুলি অর্ধেক প্রতিফলিত হয়ে M1 আয়নার দিকে যাচ্ছে এবং সেখান থেকে প্রতিফলিত হয়ে M হয়ে টেলিস্কোপ T তে পৌঁছচ্ছে। এরকম একটা রশ্মিকে সবুজ রঙে দেখানো হয়েছে। বাকি অর্ধেক রশ্মি M এর মধ্য দিয়ে প্রতিসৃত হয়ে দ্বিতীয় আয়না M2 থেকে প্রতিফলিত হয়ে M থেকে ফের প্রতিফলিত হয়ে টেলিস্কোপে পৌছচ্ছে। এরকম একটা রশ্মিকে লাল রঙে দেখানো হয়েছে। টেলিস্কোপে চোখ রেখে এই দুই রশ্মির ব্যাতিচারের ধরণ থেকে বোঝা যায় রশ্মিদুটোর দশার পার্থক্য। দশা আবার নির্ভর করে আলোকরশ্মির অতিক্রান্ত পথের ওপর। দেখা যাচ্ছে সবুজ আর লাল রঙে চিহ্নিত রশ্মিটাদুটোর অতিক্রান্ত পথের দৈর্ঘ্য যথাক্রমে 2l1 ও 2l2 । এখন একটা মহাকর্ষীয় তরঙ্গ যদি কম্পিউটার স্ক্রিনের সঙ্গে লম্বভাবে বেরিয়ে যায় তবে তরঙ্গের পর্যায়কালের এক অর্ধে  l1 কমে যাবে ও l2 বেড়ে যাবে এবং পরের অর্ধে উল্টোটা হবে। তাহলে টেলিস্কোপে ব্যাতিচারের ধরণ বদল দেখেই তা ধরা পড়বে। এইরকম ইন্টারফেরোমিটার প্রথম বানিয়েছিলেন অ্যালবার্ট আব্রাহাম মাইকেলসন, উনিশ শতকে। বিজ্ঞানের ইতিহাসে মাইকেলসন ইন্টারফেরোমিটার স্মরণীয় হয়ে আছে এডওয়ার্ড মর্লীর সঙ্গে সেই বিখ্যাত পরীক্ষার জন্য যাতে প্রমাণ হয়েছিল ইথার বলে কিছু নেই এবং আলোর বেগ দর্শকের গতির ওপর নির্ভর করে না। মাইকেলসন ছিলেন প্রথম আমেরিকান যিনি বিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। সওয়া শতক পরে হয়ত আরেকটা নোবেল আসতে চলেছে মাইকেলসনের নকশাকে কাজে লাগিয়ে।  

আসল যন্ত্রটা অবশ্য ওপরে যা বলা হল তার চেয়ে অনেক বেশী জটিল। ইন্টারফেরোমিটারের ৪ কিলোমিটার লম্বা বাহুদুটোকে মাটি খুঁড়ে শোয়ানো হল। আগেই বলা হয়েছে পৃথিবীতে যদি মহাকর্ষীয় তরঙ্গ পৌঁছায়ও তার শক্তি হবে অতি ক্ষীণ।  সেই তরঙ্গকে চিহ্নিত করার কাজটাও তাহলে হতে হবে অতিশয় সূক্ষ্ম। হরেক রকম ছোটখাটো প্রাকৃতিক বা মনুষ্যসৃষ্ট ঘটনা পর্যবেক্ষণে ব্যাঘাত সৃষ্টি করতে পারে। সমুদ্রের তুফান থেকে স্বল্পশক্তির ভূমিকম্প, রাস্তায় ভারী ট্রাকের ব্রেক কষা থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহে সামান্য উত্থান পতন, নানাবিধ কাণ্ডকে মহাকর্ষীয় তরঙ্গের সঙ্কেত বলে ভুল করার সম্ভাবনা সাড়ে পোনেরো আনা। কাজেই এই সমস্ত উপদ্রবের প্রভাব থেকে যন্ত্রকে আড়াল করতে হাজারটা ছোটখাট রক্ষাকবচের ব্যবস্থা রাখতে হয়েছিল। তাছাড়া দুটো ইন্টারফেরোমিটার বসানো হয়েছিল, একটা হ্যানফোর্ডে, আরেকটা লিভিংস্টোনে। উড়োজাহাজে উঠলে একটা জায়গা থেকে আরেকটায় যেতে সময় লাগে সাড়ে তিনঘন্টা। মহাকর্ষীয় তরঙ্গ অবশ্য এক সেকেণ্ডের দশ হাজার ভাগেরও কম সময়ে এই পথ পাড়ি দিতে পারে। তাহলে ঐ সময়ের ব্যবধানে দুটি যন্ত্রে যদি একই ধরণের সঙ্কেত পাওয়া যায় তবে তা নিশ্চিতভাবেই মহাকর্ষীয় তরঙ্গ, স্থানীয় উপদ্রব নয়। সুতরাং কর্মযজ্ঞটা যে ছোটখাটো কিছু ছিল না বেশ বোঝা যাচ্ছে। সব দিক সামলে ২০০১ সালে লাইগোর যাত্রা শুরু হল। ৯ বছর ধরে মহাকাশের দিকে চেয়ে থেকে ২০১০ এ ঝাঁপ ফেলল লাইগো, সাময়িকভাবে যদিও। যেমনটা বলা হয়ছিল এই সময়ে বিজ্ঞানীরা তাঁদের পরিকল্পনার ভুলত্রুটি গুলো দেখলেন, এবং তাকে আরো শক্তিশালী ও নিখুঁত করার ছক কষলেন। পাঁচবছর ধরে সে কাজ চলার পর উন্নততর লাইগোর উদ্বোধনের দিন ধার্য হল ২০১৫-র ১৮ই সেপ্টেম্বর। কিন্তু অতিথি কবেই বা তিথিনক্ষত্র মেনে এসেছে! উদ্বোধনের চারদিন আগে যখন প্রস্তুতি সম্পূর্ণ, শেষবারের মত সবকিছু মিলিয়ে নেওয়ার কাজ চলছে, তখনি দুই যন্ত্র থেকেই ধরা পড়ল সেই বহু আকাঙ্খিত সঙ্কেত। প্রথমটায় কেউ বিশ্বাস করেননি যে এটা আসলে মহাকর্ষীয় তরঙ্গ। 

লাইগো, হ্যান্সফোর্ড


বিশ্বাস না করার কারণও ছিল। বছর দেড়েক আগে সি এম বি আর সনাক্তকরণে নিযুক্ত বাইসেপ ২ নামক রেডিও টেলিস্কোপটি ঘোষণা করে মহাবিস্ফোরণজাত আদিম মহাকর্ষীয় তরঙ্গ সনাক্ত করা গেছে। বছরখানেকের মধ্যেই অবশ্য সে দাবী প্রত্যাহার করা হয়। যাকে মহাকর্ষীয় তরঙ্গ বলে ভুল করা হয়েছিল সেই সঙ্কেতের জন্য দায়ী নাকি কসমিক ডাস্ট। সন্দেহের আরেকটা কারণ হল "ব্লাইন্ড ইঞ্জেকশান গ্রুপ"। টিম লাইগোর মধ্যে এই গোষ্ঠীটির কাজ ছিল সোজা বাংলায় কাঠি করা। অর্থাৎ কৃত্তিম সঙ্কেত তৈরী করে গবেষকদের বিভ্রান্ত করা, তাঁরা সঙ্কেতটিকে কৃত্তিম বলে বুঝতে পারছেন কি না তার পরীক্ষা নেওয়া। প্রথম পর্যায়ের লাইগোর কাজ যখন শেষের মুখে তখনও এরকম একটা সঙ্কেত পাওয়া গিয়েছিল। কোন জায়গা থেকে ঐ "মহাকর্ষীয় তরঙ্গ" আসছে তাও চিহ্নিত করা গেছিল। তাঁদের রেজাল্ট জার্নালে প্রকাশের জন্য পাঠানো মুখে জানা গেল ঐ সঙ্কেত আসলে ব্লাইন্ড ইঞ্জেকশন গ্রুপের কীর্তি। এবারে অবশ্য তেনারা প্রথমেই হাত তুলে নিলেন। ইতিমধ্যে কয়েকটা ইউরোপীয় দেশের উদ্যোগে ইতালিতে "ভার্গো ইনটারফেরোমিটার" স্থাপিত হয়েছে। পরস্পরের তথ্য বিশ্লেষণের জন্য হাতে হাতে হাত মিলিয়েছে। পাঁচ মাস ধরে বিশ্লেষণের পর লাইগো ও ভার্গোর যৌথ টিম নিঃসন্দেহ হল ১৪ই সেপ্টেম্বরের সঙ্কেতটা "ডক্টরড" নয়। অবশেষে ২০১৬র ১১ই ফেব্রুয়ারি ন্যাশনাল সায়েন্স ফাউন্ডেশন আয়োজিত এক সাংবাদিক সম্মেলনে ঘোষিত হল মহাকর্ষীয় তরঙ্গ ধরা পড়েছে। এই তরঙ্গের উৎপত্তি অবশ্য আজ নয়। ১৩০ কোটি আলোকবর্ষ দূরে দুটো ব্ল্যাকহোল পরস্পরের চারদিকে পাক খেতে খেতে প্রচণ্ড সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে মিশে গিয়ে একটা ভারী ব্ল্যাকহোল তৈরী করেছিল অতদিন আগে। সংঘর্ষের আগে ব্ল্যাকহোলদুটোর ভর ছিল সূর্যের ভরের ২৯ ও ৩৬ গুণ। আর যে নতুন ব্ল্যাকহোলটা তৈরী হল তার ভর সূর্যের ভরের ৬২ গুণ। বাকি ৩টে সূর্যের সমান ভর বেরিয়ে এলো মহাকর্ষীয় বিকিরণের আকারে। সেই বিকিরণ ১৩০ কোটি বছর মহাশূণ্যে পাড়ি দিয়ে আমাদের গ্রহে পৌঁছালো।

"মহাবিশ্বে, মহাকাশে, মহাকাল মাঝে/ আমি মানব একাকী বিস্ময়ে ভ্রমি বিস্ময়ে..." মানুষ অবশ্য শুধু বিস্ময়ে ভ্রমণ করেনি, সে জানতে চেয়েছে মহাবিশ্বকে, জয় করতে চেয়েছে মহাকাল কে। এতদিন মহাকাশকে দেখার জন্য তার চোখ ছিল, যা দিয়ে সে আলোর সঙ্কেত দেখতে পেত। এবার পেল কান, মহাকর্ষের সঙ্কেত শোনার জন্য। কিপ থর্ণের কথায়, "প্রথমবারের জন্য মহাকর্ষীয় তরঙ্গ সনাক্ত করা কখনোই লাইগোর মূল লক্ষ্য ছিল না। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল মহাবিশ্বকে দেখার জন্য একটা নতুন জানালা খুলে দেওয়া।" যেমন ব্ল্যাকহোল জুড়ির পরিক্রমণ ও সংঘর্ষ, যা এতদিন তাত্ত্বিক গবেষণারই বিষয় ছিল, এবার তা প্রমাণিত হল মহাকর্ষীয় তরঙ্গের নিয়ে আসা বার্তায়। আমাদের দুটো কান মাথার দুপাশে রয়েছে যাতে আমরা শ্রবণক্ষমতার পূর্ণ সদ্ব্যবহার করতে পারি। মহাবিশ্বের বার্তা আরো ভালো করে শোনার জন্যেও আমাদের অ্যান্টেনা গুলোকে দূরে দূরে ছড়িয়ে দেওয়া দরকার। আমেরিকার লাইগো ও ইতালির ভার্গো ছাড়াও একটা ইন্টারফেরোমিটার বসেছে জাপানে। আরেকটা ইন্টারফেরোমিটার লিসা (লেজার ইন্টারফেরোমিটার স্পেস অ্যান্টেনা) কে পাঠানো হয়েছে মহাকাশে। শিকে ছিঁড়েছে ভারতের কপালেও। আমরা যদি পৃথিবীর ম্যাপের দিকে তাকাই তাহলে দেখবো আমেরিকার ঠিক উল্টোদিকে আছে আমাদের দেশ। তাই আমেরিকার দুটো লাইগোর মধ্যে একটাকে ভারতে স্থানান্তরিত করার পরিকল্পনা চলছে। আমাদের দেশের কর্ণধারেরা এতদিন দিবানিদ্রা দিচ্ছিলেন আর গণেশের ঘাড়ে প্লাস্টিক সার্জারি করে হাতির মুণ্ডু লাগানোর দৃশ্য দেখছিলেন স্বপ্নে। লাইগোর ঘোষণার পর স্যোসাল মিডিয়ায় প্রবল হই হট্টগোলে তাঁদের কাঁচা ঘুম ভেঙে গেল। তড়িঘড়ি লাইগো-ইণ্ডিয়া প্রকল্পে সবুজ সঙ্কেত দিয়ে দিলেন। ভারতীয় গবেষকরা মহাকর্ষীয় তরঙ্গের গবেষণায় বহুদিন থেকেই যুক্ত আছেন। ভি বিশ্বেশ্বর, সঞ্জীব ধুরন্ধর, তরুণ সৌরদীপরা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। লাইগো-ইণ্ডিয়া বাস্তবায়িত হলে মহাবিশ্বের সাধনায় ভারতের আসনটা আরো পোক্ত হবে। 

শেষ করব আইনস্টাইনকে দিয়েই। এই বছরেই সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদের একশো বছর হচ্ছে। ধরা যাক কিপ থর্ণ প্ল্যানচেট করে আইনস্টাইনকে ডেকেছেন। (প্ল্যানচেট বিজ্ঞানসম্মত কি না প্রশ্ন তুললে নাস্তিক বলে চাপাতি চালানো হবে) তাঁদের বার্তালাপটা নিচে তুলে দেওয়া হলঃ

কিপ থর্ণঃ হ্যালো মিস্টার আইনস্টাইন! আমরা গ্র্যাভিটেশানাল ওয়েভ খুঁজে পেয়েছি। জেনারেল রিলেটিভিটি যুগ যুগ জিও!
আইনস্টাইনঃ ওহ! কনগ্র্যাটস!
কিপ থর্ণঃ আপনি এত কুল কেন বস? অ্যাত বড় একটা ব্যাপার ...
আইনস্টাইনঃ তোমাদের কাছে বড় হতে পারে ইয়ং ম্যান, আমার কাছে নয়।
কিপ থর্ণঃ আচ্ছা যদি ধরুন একবছর পর বোঝা যায় আমরা ভুল? যে সিগন্যালটা পেয়েছি সেটা একটা ঢপ, গ্র্যাভিটেশানাল ওয়েভ পাওয়া যায়নি? তখন কি বলবেন?
আইনস্টাইনঃ দেন আই উইল বি সরি ফর দ্য ডিয়ার লর্ড। মাই থিয়োরি ইজ কারেক্ট!    



হস্তীদার একটা ফেসবুক পোস্টে নবকলম ও আরো অনেকের সঙ্গে আলোচনার সময়ই বিষয়টা নিয়ে বাংলায় বিস্তারিতভাবে লেখার কথা মাথায় আসে। তারপর আমার মত হদ্দ কুঁড়ে যে জিনিসটা নামাতে মাস পার করে দেবে তাতে আর আশ্চর্য্য কি! এর মধ্যে এ নিয়ে অনেক কাগজে, পত্রিকায়, ইন্টারনেটে অনেক লেখালিখি হয়ে গেছে। তবু লিখে যখন ফেলেইছি আর প্রত্যয় আর সিংদা মাঝে মাঝে খোঁচা দিচ্ছে চর্যাপদে না লেখার জন্যে … তাই লেখাটা দিয়েই দিলাম। লেখার জন্য অনেক বই, পত্রিকা, ওয়েবসাইটের সাহায্য নিয়েছি। কয়েকটা উল্লেখ করলাম। কিছু ভুলের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে নাজমূল হক ও প্রশান্ত কর। ছবিগুলো বেশীরভাগই ইন্টারনেট থেকে সংগ্রহ করেছি। আর কার্টুনটা এঁকে দিয়েছে অনির্বাণ। 

১। উইকিপিডিয়ার বিভিন্ন পেজ, যেমন Gravitational Waves, Sticky bead argument, LIGO.
২। R. M. Wald, General Relativity, Pearson Education.
৩। অমল দাশগুপ্ত, আলোর দিশারী আইনস্টাইন, অয়ন পাবলিশার্স।
৫। Daniel Kennefick, Travelling at the Speed of Thought: Einstein and the Quest for Gravitational Waves, Princeton University Press.
৬। David Lindley, Focus: A Fleeting Detection of Gravitational Waves, Phys. Rev. Focus, 16, 19 (2005)
[https://physics.aps.org/story/v16/st19]
৭। Shirley K. Cohen, Interview of Rainer Weiss, California Institute of Technolodgy Archives (2000).
৯। Emanuele Berti, The First Sounds of Merging Black Holes, Physics (2016)
ছবিগুলো বেশীরভাগই ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত।  কার্টুনঃ অনির্বাণ সেনগুপ্ত। 

প্রশান্ত ভট্টাচার্য যম্পাদিত "নির্বাচিত রসেবশে ২০১৬" সঙ্কলনে প্রকাশিত।

Thursday, 25 June 2015

দু দিনের ভাল্কি

শেষমেষ বেরিয়েই পড়লাম। হানিমুন সেরে আসার পর তিন-তিনটে বেরানোর পরিকল্পনা বাতিল হয়েছে নানা কারণে। এবার তাই মরিয়া হয়ে উঠেছিলাম। আর কিছু না হোক একটা সপ্তাহান্তিক ট্যুর তো হতেই পারে! কিন্তু সে গুড়ে বালি। শনি-রোববারে বা ছুটির দিনে সর্বত্রই ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই দশা। শীতের ছুটিতে বাঙালীকে ঘরে আটকে রাখে এমন বাপের ব্যাটা কে আছে? তাই কর্মসংস্কৃতিকে চুলোয় তুলে সোমবার দেখেই টিকিট কেটে ট্রেনে চেপে বসলাম। গন্তব্য প্রথমে বর্ধমান, তারপর গাড়ী বদল করে মানকর। ঘর তো ফোনেই বুক করা ছিল। স্টেশন থেকে কিভাবে যাব জানতে অরণ্য সুন্দরীর ম্যানেজার মশাই গাড়ীর ফোন নং দিয়ে দিলেন। সেইমত মানকর স্টেশনেই কেষ্টবাবু গাড়ী নিয়ে হাজির। সেই গাড়ীতে চেপে রাঙামাটির পথ বেয়ে এগিয়ে চললাম। মিনিট কুড়ি যাওয়ার পর চোখে পড়ল বনদপ্তরের সাইনবোর্ড। দুপাশে শাল পিয়ালের জঙ্গলের মাঝে পিচরাস্তা। আরো মিনিট দশেক পর বাঁদিকে টার্ণ নিয়ে ঢুকে পড়লাম অরণ্য সুন্দরীতে। সামনেই একটা কুচকুচে কালো ভালুকের মূর্তি স্বাগতঃ জানালো ভালকি মাচানে।



আউশগ্রাম ২ নং পঞ্চায়েত সমিতি এই গেস্ট হাউসটা তৈরী করেছিল। এখন লীজে দেওয়া আছে। চাকচিক্যর অভাব থাকলেও আতিথেয়তায় একশোয় একশো। জঙ্গলের মাঝে নিরালায় নির্ঝঞ্ঝাটে দুটো দিন কাটানোর পক্ষে আইডিয়াল। এখানে থাকার জায়গা এটাই। ৩ কিমি দূরে যমুনাদিঘি-আম্রোপালি মৎস প্রকল্পের ভেতরেও থাকা যায়। কিন্তু জঙ্গলের মধ্যে থাকার মজাটা সেখানে মিলবেনা। তবে বর্ষাকালে, মাছের চারা বোনার সময় ওখানে থাকতে পারেন।
আমরা যখন ঢুকছি হোটেলে তখন বেহালা থেকে একটা চল্লিশজনের দল এসেছিল। তাদের হইহুল্লোড়ে জঙ্গল জমজমাট। আমাদের দেখে তো ওদের চোখ কপালে! "এই অজ গাঁয়ে দুজনে কি করবেন মশাই? ও আমাদের পোষায় না। লোক না হলে কথা বলব কার সাথে?"

ঘরে ব্যাগপত্তর রেখেই বেরিয়ে পরলাম। শালবনের মধ্যে দিয়ে হাঁটতে দিব্যি লাগছিল। নামে ভালকি মাচান হলেও ভালুক কেন কোন জন্তু জানোয়ারেরই দেখা মিলবেনা এক সাপ আর পাখি ছাড়া। অবশ্যি কিছু দুপেয়ে জানোয়ারের দেখা পেতে পারেন। তাঁরা তাঁদের লীলাখেলার স্মারক যেমন কাগজের ডিশ, খাবারের প্যাকেট, জল আর মদের বোতল চারদিকে ছড়িয়ে অরণ্যের পরিবেশকে সৌন্দর্য্যমণ্ডিত করে গেছেন। জঙ্গল পেরিয়ে পিচরাস্তায় উঠতেই নজরে পরল রাস্তার ওপারে পোড়া ইঁটের কাঠামো। মাঝখানের সলিড বডি থেকে চারটে পিলার উঠে গেছে। তলার টানেল দিয়ে এদিক থেকে ওদিকে কোমর ভাঁজ করে চলে যাওয়া যায়। মেঝেতে একটা সুরঙ্গের মুখ। এটার অন্য মুখ নাকি আছে বর্ধমানের রাজবাড়িতে। গোয়েন্দা গণ্ডালু থাকলে ওরা নিশ্চয়ই ঢাকনা সরিয়ে সুরঙ্গের ভেতর নেমে পরত গুজবের সত্যতা যাচাই করতে। এই পোড়ামাটির কাঠামোটা আসলে একটা ওয়াচ টাওয়ারের ধ্বংসাবশেষ। এখানে বসে বর্ধমানের রাজারা ভালুক শিকার করত। আর তাই থেকেই জায়গাটার নাম ভালকি মাচান (Bhalki Machan) । এখন সে রাজাও নেই, সে ভাল্লুকও নেই। তাদের বদলে পেলাম এক যুগলকে ওয়াচ টাওয়ারের সামনে সাইকেল দাঁড় করিয়ে যারা প্রেমালাপে মগ্ন। ওদেরকেই অনুরোধ করলাম আমাদের দুজনের একটা ছবি তুলে দিতে।


"ভালকি" নামটার উৎস সম্বন্ধে অন্যরকম গল্পও চালু আছে। এরকম একটা গল্প হল এক ভল্লুকী জঙ্গলে একটা মানুষের বাচ্ছাকে কুড়িয়ে পায় ও তাকে মাতৃস্নেহে পালন করে। সেই ছেলেটি পরে রাজা হয়। তাদের বংশই হয়ত ভল্লু রাজবংশ হিসেবে পরিচিত হয় এবং বর্ধমান রাজা নয়, এই ওয়াচ টাওয়ারটা ছিল সেই ভল্লু রাজাদের। আরেকটি বিশ্বাসযোগ্য কাহিনী বলছে একদা এই এলাকায় ঋষি ভল্লুপাদ ঘাঁটি গেড়েছিলেন। তারপর তাঁর আশ্রমকে কেন্দ্র করে ভালকি গ্রাম গড়ে ওঠে। 

খিদেয় চুঁইচুই পেট নিয়ে যখন ঘরে ফিরলাম বেহালার দল ততক্ষণে চলে গেছে। জঙ্গল আবার ফিরে যাচ্ছে তার শান্ত গাম্ভীর্য্যের ট্রেডমার্কে। দুপুরের খাওয়াটা বেশ ভালোই হল, ভাত, ডাল, আলুভাজা, মাছ, ... বেশ ঘরোয়া রান্না। রাত্তিরে হয়েছিল মুরগীর মাংস। গেস্ট হাউসের সামনেই একটা পুকুরকে ঘিরে সুন্দর ফুল আর নানা গাছের বাগান। বিকেলের দিকে ওখানে বসেই সময় কেটে গেল। কখন যে সুয্যিমামা ডুব দিয়েছে আর ঘুটঘুটে অন্ধকার নেমে এসেছে খেয়ালই করিনি। মোবাইলের আলোতে ঘরে এলাম। এখানে বিদ্যুৎ নেই। হোটেল চলে জেনারেটরে।


পরদিন ঘুম ভাঙল শিশিরের শব্দে। তাড়াতাড়ি সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেলাম ছাদে। প্রচণ্ড ঠাণ্ডা। ফুল সোয়েটারের ওপর জ্যাকেট চাপিয়ে ঠকঠক করে কাঁপছি। চারধার কুয়াশায় ঢেকে গেছে। টুপটাপ করে শিশির পরছে। মাঝে মাঝে পাখি ডাকছে। একটাই পাখি। সেও বোধহয় আমাদের মত শহর থেকে হয়ত বা পথ ভুলেই এসে পড়েছে। তাই বাসায় ঘুমিয়ে না থেকে শীতে কাঁপতে কাঁপতে আনন্দে শিষ দিচ্ছে। আস্তে আস্তে কুয়াশা কাটল, আলো ফুটল, গেস্ট হাউসের লনে লোকের আনাগোনা দেখা গেল। আমরা নামলাম, চানটান করে নিতে হবে, গরম জল চাইলেই মিলবে। লুচি তরকারি দিয়ে ব্রেকফাস্ট সারব। তারপর গাড়ী আসবে, একটু এদিক ওদিক ঘুরে ফেরার ট্রেন ধরব। 



প্রয়োজনীয় তথ্যঃ কলকাতা থেকে ভালকির দুরত্ব ১৬০ কিমি। কলকাতা থেকে গাড়ীতে বা ট্রেণে যাওয়া যাবে। নিকটবর্তী স্টেশন বর্ধমান-আসানসোল লাইনের মানকর। থাকার জায়গা বলতে অরণ্য সুন্দরী (ফোনঃ ৯৪৩৪৫৩৭৫৪৫)। দেখে নিতে পারেন ভালকি গ্রামে কিছু পুরনো মন্দিরের ধংসাবশেষ, যমুনাদিঘী মৎস প্রকল্প, ইছাই ঘোষের দেউল (৬০ কিমি)। চাইলে অরণ্য সুন্দরীর সামনের পুকুরটায় বোটিং করতে পারেন বা আদিবাসীদের নাচ দেখতে পারেন। লজের কর্মীদের বললে তারাই সব ব্যবস্থা করে দেবে।

ছবিঃ শ্রীরূপা ও অতনু

Wednesday, 18 June 2014

চার ধাম

মারদাঙ্গা নেই, খুন নেই, হট নায়িকা নেই, সৎ পুলিস অফিসার বা দুর্নীতিগ্রস্থ রাজনৈতিক নেতা নেই। এমনকি প্যানপ্যানে সুরে রবীন্দ্রসঙ্গীত বা অসংলগ্ন কথায় সাজানো আধুনিক গান, বা রদ্দিমার্কা আঁতলামি দিয়ে গল্পের দুর্বলতাকে ঢাকার চেষ্টা নেই। এককথায় বলা যায় সমাজচেতনা, যুগচেতনা আর যৌনচেতনার যথেষ্ট অভাব রয়েছে "চার" ছবিতে। কিন্তু যা আছে তা হল গল্প। সম্পূর্ণ আলাদা মেজাজের চারটে নিটোল ছিমছাম গল্প। রবিবাবুর কথায় "সহস্র বিস্মৃতিরাশি, প্রত্যহ যেতেছে ভাসি, তারই দু-চারিটি অশ্রুজল।" পরশুরামের "বটেশ্বরের অবদান", সত্যজিৎ রায়ের "দুই বন্ধু", "কাগ্তাড়ুয়া" আর শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের "পরীক্ষা"। চারটে গল্পই পড়া, গল্পের মোচড়গুলোও জানা। শুকনো পাতার ওপর টাইটেল কার্ড আর মন কেমন করা আবহ্সঙ্গীতে শুরুতেই স্মৃতিমেদুর হয়ে পড়লাম। ডায়েরির ভাঁজে রেখে দেওয়া পাতার মত বহুদিন আগে পড়া গল্পগুলো মনের পর্দায় ভেসে উঠল। ছোটগল্পকে পরদায় ফেলা সহজ কাজ নয়। একটা ছোট্ট গল্পকে অযথা টেনে বাড়িয়ে তিনঘন্টার সিনেমা বানালে তার রসটাই মাটি হয়ে যায়। সন্দীপ রায় তাই সেদিকে না গিয়ে চারটে গল্পকে পরপর বলে গেছেন মাত্র পৌনে দুইঘন্টায়। বাংলা সাহিত্যের তিন ডন পরশুরাম, সত্যজিৎ আর শরদিন্দু কাজটা আগেই গুছিয়ে রেখেছিলেন। পরিচালক আর কোন বাহাদুরির চেষ্টা করেননি। একদিক দিয়ে অবশ্য তাঁর সুবিধে আছে, তিনজনের লেখাই সিনেম্যাটিক। চলচ্চিত্র জগতের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত থাকা সত্যজিৎ আর শরদিন্দুর গল্পকে অনায়াসে চিত্রনাট্য বলে চালিয়ে দেওয়া যায়। পরিচালক আর অভিনেতারা কেরামতি দেখাতে গিয়ে কিভাবে অসাধারণ গল্পেরও সর্বনাশ করতে পারেন তা দেখা হয়ে গেছে "মিশর রহস্য" আর "চাঁদের পাহাড়"এ। এই ছবিতে নায়ক যদি কাউকে বলতে হয় তো সে হল মানবিক সম্পর্ক। তাই অভিনেতাদের কোন হিরোইজম দেখানোর সুযোগ নেই। মনে হচ্ছে তাঁরা একেবারে বইয়ের পাতা থেকেই উঠে এসেছেন। সঙ্গে বাড়তি পাওনা "পরীক্ষা" গল্পে পুরনো দিনের রোম্যান্টিক বাংলা ছবির আমেজ।

তবে দুটো কথা আছে। প্রথমতঃ "বটেশ্বরের অবদান" গল্পটিকে ২০১৩ তে না এনে "পরীক্ষা"র মত পিরিয়ড ফিল্ম করলেই ভালো হত। দ্বিতীয়ত "দুই বন্ধু" গল্পে দেখা যাচ্ছে দীর্ঘ ২৫বছর পর চুক্তি অনুযায়ী দেখা করতে চলেছে মহিম আর প্রতুল। এতদিন পর হঠাৎ করে চুক্তির কথা মনে পড়ল তা হতে পারেনা। সত্যজিত ও লিখেছেন, "মহিমের সন্দেহ হয়েছিল সে ব্যাপারটা এতদিন মনে রাখতে পারবে কি না; কিন্তু আশ্চর্য -এই বিশ বছরে একদিনের জন্যও সে চুক্তির কথাটা ভোলেনি"। অথচ সিনেমায় দেখা যাচ্ছে দেখা করতে যাওয়ার দিন সকালেই মহিম বৌ-কে বলছে ঘটনাটার কথা। তাছাড়া গল্পটাকে যখন ২০১৩ তে-ই আনা হয়েছে তখন মহিম ফেসবুকে একবারও প্রতুলকে খোঁজার চেষ্টা করলনা এটা খানিক বিস্ময়কর। সব মিলিয়ে বলতে পারি চারধাম যাত্রায় মন খুশি হয়ে গেল। বাংলা ছোটগল্পের আরো মণিমাণিক্য পর্দায় উঠে আসুক।

গল্পগুলো যাঁরা পড়েননি তাঁরা চটপট নীচের বইগুলো জোগাড় করে ফেলুন। তবে সিনেমাটা দেখার আগে পড়বেন না।
(১) পরশুরাম গল্পসমগ্র/ রাজশেখর বসু/ এম সি সরকার এন্ড সন্স
(২) গল্প ১০১/ সত্যজিৎ রায়/ আনন্দ পাবলিশার্স
(৩) গল্পসংগ্রহ/ শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়/ আনন্দ পাবলিশার্স




Tuesday, 15 April 2014

বিভাজনের রাজনীতি ও বাঙালী

ঘনাদা বললেন রাজনৈতিক লেখা দিতে। বলার তো আছে অনেক কিছুই, কিন্তু নানান চক্করে সেগুলোকে আর নামানো হয়ে উঠছিল না। এদিকে দেখি পয়লা বৈশাখ এগিয়ে আসছে, তার সঙ্গে দিল্লীর গদি দখলের লড়াই। কিন্তু কি কাণ্ড, সমস্ত সমীক্ষা যাকে সরকার গড়ার দৌড়ে এগিয়ে রেখেছে, যারা ভোটের ছমাস আগে প্রধাণমন্ত্রীর নাম ঘোষণা করে দিয়েছে, সেই ভারতীয় জনতা পার্টির তো দেখি ইশতেহারের দেখাই নেই! শেষমেশ একদফার ভোট মিটে যাওয়ার পর তারা ঝুলি থেকে ইশতেহার বের করল। তবে এতে আমি খানিক স্বস্তি পেলাম। শেষমুহূর্তে ইশতেহার দেখেও যদি আমজনতা পদ্মফুলে ছাপ দেন তবে আমার লেখাটা আর যাই হোক দেরীর জন্যে নিশ্চয়ই বাতিল হবে না!

ইশতেহারটি দেখে খানিক অবাক হলাম। সেই রামমন্দির নির্মাণ, ৩৭০ ধারা বিলোপ, গোহত্যা নিবারণী আইন, ...। অথচ কয়েক বছর ধরেই শোনা যাচ্ছিল বিজেপি না কি হিন্দুত্বের বদলে "সুশাসন" আর "উন্নয়ন"কেই অগ্রাধিকার দিতে চলেছে। গুজরাটকে দেশের মডেল রাজ্য হিসেবে তুলে ধরার জন্য প্রচারের অন্তঃ ছিল না নামীদামি কাগজ আর টিভি চ্যানেলগুলোর। অবশ্য একটু পরিসংখ্যান ঘেঁটে তলিয়ে দেখলেই প্রচারের ফানুস ফাটতে সময় লাগে না। স্বাধীনতার আগে থেকেই ব্যবসা বাণিজ্যে এগিয়ে থাকা গুজরাতের আর্থিক বৃদ্ধির হার যে নরেন্দ্র মোদীর শাসনকালে শ্লথ হয়েছে, মানবোন্নয়নে গুজরাতের হাল যে অত্যন্ত খারাপ সেটাকে অস্বীকার করার জো নেই। অবশ্য বিজেপি নেতারা সে চেষ্টা করছেনও না। অত্ত সংখ্যা আর তথ্যের কচকচির চাইতে ঐ "আব কি বার মোদী সরকার" টাইপের স্লোগান পাবলিক খায় বেশী। মোদীর থিঙ্ক-ট্যাঙ্কের অন্যতম অরুণ জেটলি সার কথাটা বলে দিয়েছেন, "উন্নয়ন নিয়ে বক্তৃতা দিলে মানুষ ততটা হাততালি দেয়না, কিন্তু যখন জয় শ্রীরাম ধ্বনি ওঠে তখন কর্মীদের উৎসাহ দেখার মত।" তবে বিজেপি ক্যাডাররা উৎসাহিত হলেও শিক্ষিত, মধ্যবিত্ত সমাজকে জয় শ্রীরাম স্লোগান দিয়ে আকৃষ্ট করা কঠিন। তাই সুশাসন, উন্নয়নের গপ্পো শোনানো দরকার। আর হিন্দুত্বের পোস্টারবয় নরেন্দ্র মোদীকে তুলে ধরলে কট্টর হিন্দু ভোট এমনিতেই ঝুলিতে পড়বে। 

আসলে জাত-ধর্ম বা আঞ্চলিকতার ভিত্তিতে মানুষকে উত্তেজিত করা যতটা সহজ, অর্থনৈতিক ভিত্তিতে সংগঠিত করা ততটাই কঠিন। ভারতের রাজনৈতিক বিন্যাসের দিকে তাকালে ব্যাপারটা সহুজেই বোঝা যায়। কংগ্রেস আর বামপন্থীদের বাদ দিলে (এখন আপকেও ধরতে হবে) প্রায় সব দলই জাত, ধর্ম বা আঞ্চলিকতার ওপর প্রতিষ্ঠিত। কংগ্রেস ঐতিহাসিক দল। মূলতঃ বৃটিশদের উদ্যোগে ভারতবাসীর ক্ষোভ-অসন্তোষের সেফটি ভাল্ভ হিসেবে কংগ্রেসের জন্ম হয়েছিল, কংগ্রেস বারবার স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে এসব কথা মেনে নিয়েও বলতে হয় স্বাধীনতার আগে নানা ভাষা, নানা মত, নানা পরিধান বিশিষ্ট ভারতবর্ষের জাতীয় মঞ্চ ছিল কিন্তু কংগ্রেসই। অন্যদিকে কংগ্রেসের নরমপন্থী দরকষাকষির রাজনীতি আর বিপ্লবীদের সশস্ত্র সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের বাইরে শ্রমিক-কৃষক-মধ্যবিত্তের অর্থনৈতিক সংগ্রামকে রাজনীতির মূল ধারার সঙ্গে যুক্ত করে তৃতীয় পথের সন্ধান গতি পায় রাশিয়ায় নভেম্বর বিপ্লবের সাফল্যে। একটা সময় গোটা দেশেই কমিউনিস্টদের যথেষ্ট শক্তি ও প্রভাব ছিল। স্বাধীনতার পর দুর্নীতি, কোন্দল, পরিবারতান্ত্রিকতায় ডুবে যাওয়া কংগ্রেস যত জমি হারালো, দেশের মাটিতে মার্কসবাদের সৃজনশীল প্রয়োগের বদলে রাশিয়া-চীনের অন্ধ অনুকরণ করতে গিয়ে কমিউনিস্টরা যত দুর্বল হল, ততই দাপট বাড়ল জাত, ধর্ম ও আঞ্চলিকতার ভিত্তিতে তৈরী দলগুলোর। তবে ভাষা, জাতিসত্তা বা আঞ্চলিকতার ওপর দাঁড়িয়ে কোন দল একটা রাজ্যে ক্ষমতায় আসতে পারে, কিন্তু জাতীয় রাজনীতিতে নির্ণায়ক হওয়া সম্ভব নয়। তার জন্য দরকার দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ লোকের যেটা ধর্ম, সেই হিন্দুত্বকে আঁকড়ে ধরা। এখানেই মুলায়ম-মায়াবতী-জয়ললিতাদের চেয়ে নরেন্দ্র মোদির অ্যাডভান্টেজ। 

অথচ গোটা ভারতের এই প্রবণতার মধ্যে বাংলা এক মূর্তিমান ব্যতিক্রম। জাত-ধর্ম ভিত্তিক রাজনীতি কোনদিনই বাংলায় বিশেষ কল্কে পায়নি। বৃটিশরা ধর্মের ভিত্তিতে বাংলা ভাগ করতে গিয়ে হাত পুড়িয়েছিল। শেষঅবধি অবশ্য দেশভাগের সঙ্গে বাংলা ভাগ হলই। দেশনেতাদের দ্রুত ক্ষমতালাভের তাড়া আর ৪৬এর স্মৃতিভারাক্রান্ত বাঙালীর ঝামেলা না বাড়ানোর তাগিদ না থাকলে ইতিহাস হয়ত অন্যরকমও হতে পারত। সোরাবর্দী-কিরণশঙ্কর রায়-শরৎ বসুরা একটা চেষ্টা করেছিলেন বাঙলাকে অবিভক্ত রাখার। সে চেষ্টা সফল না হলেও বাংলার দুই অংশেই সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদীরা কখনোই নির্ণায়ক শক্তি হয়ে উঠতে পারেনি। বরং ওপারের বাঙালীদের প্রথমে রাষ্ট্রভাষা বাংলা ও বাংলা ভাষার রাষ্ট্র অর্জনের মরণপণ লড়াই দ্বিজাতিতত্ত্বকেই অর্থহীন করে দেয়। একথা ঠিকই জামাত-ই-ইসলামির মত মৌলবাদী ও মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী দলের দাপট বাংলাদেশে কম নয়, কিন্তু তারাও একার শক্তিতে ক্ষমতা দখল করতে পারেনি। বিএনপির (কখনো আওয়ামি লীগেরও) লেজুর হয়েই থাকতে হয়েছে। বাংলাদেশে হিন্দু-নির্যাতন আর দলে দলে হিন্দুদের দেশত্যাগের ঘটনাকেও অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু বাংলাদেশ থেকে যে শুধু হিন্দুরা ভারতে আসছেন তাই নয়, অনেক মুসলমানও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাঁটাতার পেরোচ্ছেন। তাই বাংলাদেশী অনুপ্রবেশের পিছনে শুধু ধর্মীয় নয়, অর্থনৈতিক কারণও রয়েছে। 

যদি এপার বাংলার দিকে তাকাই তাহলেও দেখবো যে হিন্দু মৌলবাদীরা পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে সুবিধে করে উঠতে পারেনি। অথচ এমনটা হওয়ার কথা নয়। দেশভাগের ধাক্কায় অগণিত মানুষ ভিটেমাটি হারিয়ে সর্বস্বান্ত হয়ে চলে এসেছিলেন এপারে। তাঁরা যাঁদের হাতে সম্পত্তি খুইয়েছিলেন, প্রিয়জনকে হারিয়েছিলেন তাঁরা ধর্মে মুসলমান। ৪৬এর দাঙ্গার স্মৃতিও তখন দগদগে। সাম্প্রদায়িক রাজনীতির কারবারিদের কাছে এমন পরিস্থিতি তো সোনায় সোহাগা! স্বাধীনতার ৪ বছর পর আজকের বিজেপির পূর্বসূরী, আরএসএসের রাজনৈতিক শাখা জনসঙ্ঘের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন একজন বাঙালী, শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। শিক্ষাবিদ ও রাজনীতিবিদ হিসেবে শ্যামাপ্রসাদের যোগ্যতা তাঁর ঘোর বিরোধীরাও অস্বীকার করতে পারবে না। সম্পূর্ন ভিন্ন রাজনীতির লোক ফজলুল হক ও জওহরলাল নেহরু তাঁদের মন্ত্রীসভায় অন্তর্ভূক্ত করেছিলেন শ্যামাপ্রসাদকে। এ হেন শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ও কিন্তু পরিস্থিতির সদ্ব্যবহার করে বাংলার মাটিতে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির গোড়াপত্তন করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। বরং উদ্বাস্তুদের পাশে দাঁড়িয়ে, তাঁদের এই অবস্থার জন্য যাঁরা অনেকটাই দায়ী সেই কংগ্রেসের দিকে ক্ষোভকে চালনা করে মাটি শক্ত করেছিলেন কমিউনিস্টরা। এরপরে পশ্চিমবঙ্গে অনেক রাজনৈতিক পালাবদল ঘটেছে, কিন্তু বিজেপি সুবিধে করতে পারেনি। একটা-দুটো আসনের জন্য তাদের কখনো তৃণমূল কংগ্রেস, কখনো বা গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার হাত ধরতে হয়েছে। শুধু ধর্মের সাম্প্রদায়িকতা নয়, আমরা বাঙালী টাইপের রাজনীতিও এখানে হালে পানি পাবে না। অন্য রাজ্য থেকে পেটের ধান্দায় আসা মানুষ ক্রমে এখানে মিশে গেছেন।       

এর কারণ হিসেবে অনেকেই বলেন বাঙালী আসলে সংকর জাতি, তাই তারা স্বভাবতই বহুত্ববাদী ও প্রগতিশীল। "দিবে আর নিবে, মিলাবে মিলিবে"  এই হল বাঙালীর রাস্তা। জাতপাতের বেড়া ভাঙাই হোক, সতীপ্রথার বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণাই হোক আর রাজনীতির চেনা পথকে বাতিল করে গ্রাম দিয়ে শহর ঘিরতে ঝাঁপিয়ে পরাই হোক নতুন পথের সন্ধান তো বাঙালীরাই বারবার দিয়েছে। তাই গোলওয়ালকরের হিন্দুত্ব নয় চৈতন্য-রামকৃষ্ণের হিন্দুত্বই বাঙালির পছন্দ। এপ্রসঙ্গে বন্ধু ব্লগার শাক্যমুনির কিছু কথা উদ্ধৃত না করে পারছিনাঃ 

এই এত বছর পরে এত রকমের রক্ত মেশাবার পরেও আমরা বাঙালীরা বাকিদের থেকে অনেকটাই আলাদা, অনেকটাই প্রোগ্রেসিভ। কারণ আমরা চিরকালই রোম্যান্টিক, রেবেলিয়াস, রঙিন। গোঁড়ামি কে আমরা কোনোকালেই পাত্তা দিইনি (গোঁড়ামি সে ধর্মীয় বলুন বা রাজনৈতিক), তাই ধর্মের রুক্ষ পাষাণ বেদী থেকে দেবতা কে আমরা নামিয়ে এনেছি ঘরের উঠোনে, শিব ঠাকুর কে জামাই বানিয়ে বিয়ে দিয়েছি ঘরের মেয়ে উমার সঙ্গে আর কেষ্ট ঠাকুরের মামিমা রাধার সঙ্গে অবৈধ প্রেম নিয়ে আমরা বেঁধেছি প্রাণের গান, ভক্তিরসের উন্মাদনায় কাতর হয়েছি, পাগল হয়েছি, বিপ্লবী হয়েছি আমরা, পৈতে ছেড়ে গলায় দিয়েছি কণ্ঠীর মালা। প্রেম ও যৌনতার ট্যাবু কে অবলীলায় ছিন্ন করে তাকে জুড়ে দিয়েছি রিচুয়াল প্র্যাকটিসের সঙ্গে। কট্টর মৌলবিদের চোখ রাঙানি কে উপেক্ষা করে আমরা পরিধান করেছি বেশরিয়ত ফকিরের আলখাল্লা।

কিন্তু বাঙালী কি সম্পূর্ণ অসাম্প্রদায়িক? ট্রেণে-বাসে-রকে-ফেসবুকে কান পাতলেই বোঝা যাবে তা নয়। অন্তত বাঙালিদের মধ্যে একটা বড় অংশ আছে যারা ঘোরতর সাম্প্রদায়িক। আজও বেশীরভাগ জায়গায় হিন্দু, মুসলমান আলাদা পাড়ায় থাকে। পাশে মসজিদ থাকলে বাড়ি কেনেন না হিন্দু শিক্ষক, ভিনধর্মে প্রেম-বিয়ে মোটেই সহজ ব্যাপার নয়। তাহলে কি বাঙালী শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে বিশ্বাসী? অর্থাৎ হিন্দু হিন্দুর মত থাক, মুসলমান মুসলমানের মত, কেউ কাউকে না ঘাঁটালেই হল?
পশ্চিমবঙ্গের শাসকরাও বোধহয় সেই নীতিতেই বিশ্বাসী। সাধারণভাবে ধর্মনিরপেক্ষ হলেও ভোটের স্বার্থে তাঁরা ধর্মীয় গোঁড়ামির গোড়ায় টান দিতে আগ্রহী নন। বামফ্রন্টের তসলিমা বিতাড়ন, তৃণমূলের ইমামভাতা তারই উদাহরণ মাত্র। আগে বলেছিলাম কংগ্রেস আর বামপন্থীরা জাত-ধর্মের ভিত্তিতে রাজনীতি করেননা। এই তালিকায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল কংগ্রেসকেও রাখা যেতে পারে। তিনি যদিও একাধিকবার বিজেপির সঙ্গে ঘর করেছেন, গুজরাত গণহত্যার পর নরেন্দ্র মোদী ভোটে জিতলে ফুল পাঠিয়েছেন। তবু দেরিতে হলেও বুঝেছেন বিজেপি সঙ্গ তাঁর পক্ষে আদৌ লাভজনক নয়। কিন্তু তাঁর সরকারের নানারকম কাজকর্মে যে সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলো উৎসাহিত হচ্ছে সেবিষয়ে তিনি অবগত নন? পরিবর্তনের পর এরাজ্যে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের সদস্য উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। বিজেপির ভোট যে বাড়ছে সে কি শুধু মোদী হাওয়া?

বাংলায় জাত-ধর্মের ভিত্তিতে রাজনীতি হয়না বলেছিলাম বটে কিন্তু একথা আর কতদিন খাটবে? ওদিকে গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা, আদিবাসী বিকাশ পরিষদ, কামতাপুর পিপলস পার্টির আত্মপরিচয়ের রাজনীতি মাথা চাড়া দিচ্ছে, এদিকে রেজ্জাক মোল্লা দলিত+মুসলিম সমীকরণে নতুন দল খুলছেন। আর বিজেপির বিষ তো আছেই। পশ্চিমবাংলাও কি তাহলে গড্ডালিকায় গা ভাসাবে? শ্রীলঙ্কায় তামিলদের ওপর নারকীয় অত্যাচার চালাচ্ছে উগ্র সিংহলী জাতীয়তাবাদী রাজাপক্ষ সরকার, পাকিস্তানে ক্ষমতায় এসেছে তালিবানদের প্রতি সহানুভূতিশীল নওয়াজ শরিফের দল, নেপালের গণপরিষদ নির্বাচনে চমকপ্রদ সাফল্য পেয়েছে হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্রীয় প্রজাতন্ত্র পার্টি, বাংলাদেশে জামাতী-হেফাজতীদের সঙ্গে সম্মুখ সমরে রক্ত ঝরাচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ তরুণরা। ভারতের জমি হাঙড় আর ধান্দাবাজ কর্পোরেটরা প্রাণপাত করছে এমন একজন একনায়ককে ক্ষমতায় আনতে যিনি যেকোন প্রতিবাদ, বিরোধিতাকে দুরমুশ করতে পারেন। গুজরাত নরমেধ যজ্ঞের পৌরহিত্য করে, সোহরাবুদ্দিন, তুলসী প্রজাপতি, ইশরাত জহানকে খতম করে তিনি যোগ্যতার প্রমাণ রেখেছেন। পশ্চিমবাংলা কি করবে? হিংসা-বিদ্বেষের মোদী হাওয়ায় গা ভাসাবে না কি বহুত্ব ও ঐক্যের মশাল জ্বালিয়ে পথ দেখাবে বাকি ভারতকে?

প্রথম প্রকাশঃ লেখালেখি ই ম্যাগাজিন, বৈশাখ ১৪২১

Thursday, 20 March 2014

গোপাল না রাখাল?

একটা সময় প্রত্যেক ভোটের আগে বামফ্রন্টকে ভোট দেওয়ার আবেদন জানিয়ে একটা বিবৃতি বেরোত, যাতে সই থাকত বাংলার প্রায় সমস্ত প্রথম সারির শিল্পী-সাহিত্যিক-সঙ্গীতজ্ঞ-চলচিত্রকর্মীদের। বুদ্ধিজীবিরা তাঁদের স্বভাবজনিত সংবেদনশীলতার জন্য বামপন্থী মতাদর্শে বিশ্বাসী বলে ধরে নেওয়া হত। কখনো সখনো মৃদুমন্দ সমালোচনা করলেও যেকোন বড় ইস্যুতে তাঁরা বামফ্রন্ট তথা সিপিএমের পাশেই দাঁড়াতেন। অবশ্য বিরোধী ও নিন্দুকরা বারবারই অভিযোগ করত বুদ্ধিজীবিরা সিপিএমের পাশে আছেন কোন আদর্শের তাড়নায় নয় স্রেফ ক্ষমতার মধু চাটার জন্য। সংস্কৃতিবান বুদ্ধদেববাবু মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর বুদ্ধিজীবিদের বাম-ঘনিষ্ঠতা আরো নিবিড় হয়। নিন্দুকরা তাঁদের নাম দেন "বুদ্ধজীবি"। দ্বিখণ্ডিত নিষিদ্ধকরণের মত চরম বাকস্বাধীনতা বিরোধী পদক্ষেপের সমর্থনেও যুক্তি দিতে তাঁদের বাধেনি। একবার জনযুদ্ধ গোষ্ঠী ও তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল সমাজকর্মীদের ওপর রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সরব হলে "আমাদের সাহায্য নিয়ে ওদের মদত" করার জন্য বুদ্ধিজীবিদের কড়কে দিয়েছিলেন তৎকালীন সিপিএম সম্পাদক অনিল বিশ্বাস। বুদ্ধিজীবিদের বামপ্রেমে ধাক্কা লাগে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের সময় থেকে। পাবলিকের মারে সিপিএম যত বেসামাল হল, ততই দলে দলে বুদ্ধিজীবি শিবির ছাড়তে শুরু করলেন। তাঁদের মধ্যে স্পষ্ট দুটো ভাগ হল, "বুদ্ধজীবি" আর "পরিবর্তনপন্থী"। দ্বিতীয়গোষ্ঠীকে সুশীল সমাজ, নাগরিক সমাজ ইত্যাদি নামে ডাকা হত। চ্যানেলে চ্যানেলে দুপক্ষের তরজা আমজনতা গোগ্রাসে গিলল আর বাংলা সিরিয়ালগুলোর টিআরপি নেমে গেল। একদল তখনো শিল্পায়নের নামে সিঙ্গুরের বহুফসলী জমি জবরদখল, তাপসী মালিকের নৃশংস হত্যা, নন্দীগ্রামে পুলিস-ক্যাডার যৌথবাহিনীর অপারেশন সূর্যোদয়ের সমর্থনে সাফাই গাইছেন আর অন্যদল সরকারের পরিবর্তনের সওয়াল করছেন। ক্রমশ প্রথমদলের গলার আওয়াজ মিইয়ে এলো আর দ্বিতীয়দল "পরিবর্তনপন্থী" থেকে "মমতাপন্থী"তে উত্তীর্ণ হলেন। পরিবর্তনের পর দ্বিতীয়দল থেকে অনেকেই সাংসদ, বিধায়ক, মন্ত্রী বা বিভিন্ন সরকারি সংস্থা বা কমিটির পদাধিকারী হলেন। কবীর সুমন, সুনন্দ সান্যালের মত কয়েকটা অবাধ্য রাখাল অবশ্য সব জমানাতেই ছিল। তবে সুবোধ কবি, সুশীল অভিনেতা, সুবেশ গায়কদের মত গোপালের সংখ্যাই বেশী যারা চট করে বাপ বদলে ফেলতে পারে। এবারের লোকসভা ভোটে দেখা গেল সেইসব প্রাক্তন "বুদ্ধজীবি"রা কেউ সরাসরি তৃণমূলের টিকিট পেলেন, কেউ বা বন্ধুতার দোহাই পেড়ে প্রচারে নামলেন ভবিষ্যতের জমিটা তৈরী রাখার স্বার্থে। স্বনাম ও বাপের নামধন্য জাদুকর অবশ্য ছোট জায়গায় নাড়া বাঁধতে নারাজ। তিনি সাক্ষাৎ হনুমানের অবতার নরেন্দ্র মোদীর শরণাপন্ন হয়েছেন। এঁরা অনেকেই হয়ত পদ্মবিভূষণ বা বঙ্গবিভূষণে সন্মানিত হবেন। তবে সিপিএম তাঁদের বঙ্গবিভীষণ শিরোপা দেবে কি না জানা নেই।

গোপাল আর রাখালের গল্পটা কেবল বুদ্ধিজীবিদের মধ্যে খুঁজলে ভুল হবে। নন্দীগ্রাম যুদ্ধের আঁচ এসে পড়েছিল বামফ্রন্টের অন্দরেও। নীতিভ্রষ্টতার অভিযোগ তুলে সরব হয়েছিল ফরোয়ার্ড ব্লক, আরএসপির মত শরিকরা। তখন বাধ্য গোপালের মত ল্যাজ নেড়ে গেছিলেন কিরণময় নন্দ। পরিণামে ক্ষিতি গোস্বামীর মত নেতাদের তীব্র আক্রমণের মুখে পড়তে হয়েছিল। ফব, আরএসপিকে বাদ দিয়ে কিরণময়ের সমাজবাদী পার্টিকে ফ্রন্টের মেজ শরিক বানানোর তত্ত্ব হাজির করেছিল সিপিএম। ক্ষিতিবাবুরা এখনো ফ্রন্টেই আছেন। কিন্তু কিরণময়বাবুরা এখন ফেডারেল ফ্রন্টের গল্প শুনিয়ে তৃণমূল নেত্রীর কাছে আশ্রয় চাইছেন। তাঁদের নেতা মুলায়মের যা মতিগতি তাতে ভোটের পর কংগ্রেস এমন কি বিজেপির হাত ধরাটাও তাঁর পক্ষে খুব কঠিন নয়।

"দুঃখের দিনের বন্ধুই আসল বন্ধু", একথা সবাই জানি তবু কার্যক্ষেত্রে মনে রাখিনা। যেসব বামপন্থী রাজনীতিবিদ, অর্থনীতিবিদ, সমাজকর্মীরা বামফ্রন্ট সরকারের দক্ষিণপন্থীদের চেয়েও দক্ষিণপন্থী হওয়ার প্রচেষ্টার নিন্দা করেছিলেন তাঁরা আজ অনেকেই  রাজ্য ও কেন্দ্রে স্বৈরাচারী ও ফ্যাসিবাদী শক্তিকে আটকাতে সেই "পচাগলা" বামপন্থীদেরই আঁকড়ে ধরতে চাইছেন। কিন্তু তোষামোদ কে বঙ্গোপসাগরে ফেলে দিয়ে যুক্তিসঙ্গত সমালোচনাকে সাদরে গ্রহণ করার সাহস আর সিপিএমের নেই। নীতিগত বিষয়ে প্রশ্ন তোলার জন্য প্রসেনজিৎ বসু, রেজ্জাক মোল্লার প্রতি, জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতাদের প্রতি যে আচরণ করা হল তা বোঝায় কূয়োর ব্যাং হয়ে থাকাকেই সিপিএম ভবিতব্য বলে ধরে নিয়েছে। আদ্যন্ত দক্ষিণপন্থী আম আদমি পার্টি যেভাবে বিভিন্ন সামাজিক আন্দোলনের শক্তিকে রাজনীতির ময়দানে নিয়ে আশার চেষ্টা করছে তা থেকে শিক্ষা নিয়ে ছোট বামপন্থী দল ও সংগঠনকে একত্রিত করার বদলে সুবিধাবাদী আঞ্চলিক দলগুলোকে নিয়ে তৃতীয় ফ্রন্টের অলীক মরীচিকার পেছনে দৌড়ানো হচ্ছে। তবে কি না এখনো সময় আছে। সুবোধ সুশীল ও কিরণময়দের কাপড় উন্মোচন থেকে কি সিপিএম শিক্ষা নেবে? গোপালদের ত্যাজ্যপুত্তুর করে রাখালদের বুকে টেনে নিতে পারবে? কূয়ো থেকে বেরিয়ে সমুদ্রে যাওয়ার হিম্মত কি হবে? প্রশ্নগুলো সহজ, উত্তরটা ... 

চর্যাপদ লিঙ্ক

Friday, 3 January 2014

পকেটমারের পাল্লায়

পকেটমারদের যে আমি খুব পেয়ার করি এমনটা নয়। কিন্তু ব্যাপার হল ইস্কুলের মাস্টারমশাই থেকে হবু অর্ধাঙ্গিনী সবারই মত আমি নাকি মারাত্মক রকমের অন্যমনস্ক আর ভুলো। তারা খুব ভুল কিছু বলে এমন দাবী আবার আমি জোরগলায় করতে পারিনা। ফলতঃ পকেটমাররা যে আমাকে বেজায় পছন্দ করবে তাতে আশ্চর্য্যের কিছু নেই। আর ট্রেনে বাসে নিত্য যাতায়াত করলে, তাদের সঙ্গে মোলাকাৎ না করে উপায় কি! প্রথম তাদের পাল্লায় পড়ি বাইপাসের ওপর ভূতল পরিবহনের ন্যানোবাসে। সেই প্রথম বাড়ি ছেড়ে হোস্টেলে থাকতে এসেছি। দাদা একটা নোকিয়া ১১০০ ফোন কিনে দিয়েছিল, সঙ্গে একটা ক্লিপ-ফিতে। "এটা দিয়ে মোবাইলটাকে জামার সঙ্গে আটকে রাখলে আর চিন্তা নেই"। চিন্তা যে পকেটমারদেরও নেই তা বুঝলাম যখন দেখলাম বুকপকেট থেকে ফোনবাবাজি ফিতেশুদ্দু নিরুদ্দেশ হয়েছেন। এপর্যন্ত আমি যা খুইয়েছি তার মধ্যে আছে দুটো মোবাইল, দুটো মানিব্যাগ, একটা পেনড্রাইভ আর হ্যাঁ একটা ল্যাপটপ। শেষোক্তটাকে অবশ্য পকেটমারি বলা যায়না। কিন্তু কি যে বলা যায় তা আজও রহস্য। ওটার কথায় পরে আসছি। তবে এটা ঠিক যে এখন আমি অনেক সতর্ক, বাসে যত ভীড়ই থাকুকনা কেন, রডটা ধরি একহাত দিয়েই, আর একটা হাত রাখি পকেটের কাছে, যেখানে মোবাইল, মানিব্যাগ ইত্যাদি থাকে। বলতে নেই, বছরদুয়েকের মধ্যে পকেটমাররা আমার কাছে নিরাশই হয়েছে। 
মোবাইল প্যান্টের পকেটে রাখতে শুরু করি অবশ্য প্রথম ফোনচুরির পর থেকেই। তবে তাতেও যে সবসময় পকেটমারদের টেক্কা দেওয়া যাবে এমন নয়। আমার দ্বিতীয় মোবাইলটা তো গেছিল প্যান্টের পকেট থেকেই। এল-২৩৮ বাসটা দৈত্যকুলে প্রহ্লাদবিশেষ, মানে প্রাইভেট বাস হয়েও জনগণের দাবীতে যেখানে সেখানে দাঁড়ায়না, ফলে ভীড়ও হয় তেমনি আর কে না জানে ভীড় মানেই পকেটমারদের পোয়াবারো। এমনকি ওরা কাজের সুবিধার্থে ইচ্ছাকৃতভাবে ভীড় তৈরী করে এমন একটা কথাও শোনা যায়। তাই পকেটমারদের দাপটের জন্যও এল-২৩৮এর খ্যাতি আছে। সেদিন কোনরকমে পা-দানি থেকে উঠে দরজায় দাঁড়িয়েছি, এমন সময় সিটের ধারে দাঁড়িয়ে থাকা একজন টাকমাথা বেঁটেখাটো নিরীহ ভদ্রলোক বললেন, "আপনি এখানে দাঁড়িয়ে যান, আমি নেমে যাই।" তাঁকে ধন্যবাদ দিয়ে এগিয়ে গেলাম আর তিনি ভীড়ের জন্যই হয়ত বা অনেকক্ষণ ধরে আমার গা ঘেঁষে বেরোলেন। উল্টোডাঙা আসতেই বাস হালকা, আমার পকেটও। আমার বন্ধু মৈনাকেরও একই অভিজ্ঞতা হয়েছিল। উল্টোডাঙায় পকেটে হাত দিয়ে হাহাকার করে উঠতে কন্ডাকটার রাস্তার দিকে আঙুল দেখিয়ে বলে, "আগে বলবেন তো, ঐ দেখুন চলে যাচ্ছে ..." তখন আর কে কাকে দেখে! মৈনাক তো হাঁ, "আপনি জানতেন বাসে পকেটমার আছে??" কন্ডাক্টারের উত্তর, "জলে নেমে কি কুমীরের সঙ্গে বিবাদ করা চলে দাদা!" কন্ডাক্টাররা সাধারণত পকেটমারদের চেনে, এবং তাদের দেখলে নানারকম ইঙ্গিত দিয়ে যাত্রীদের সাবধান করার চেষ্টা করে থাকে, কিন্তু কখনোই তাদের ধরিয়ে দেয় না।
বুঝতেই পারছেন আমি দেখে শেখার চেয়ে ঠেকে শেখাতেই বেশী আগ্রহী। তাই মানিব্যাগটাও রাখতাম প্যান্টের পেছনের পকেটে, যতদিন না ট্রেনে এক পকেটমার বাবাজি আমায় উচিৎ শিক্ষা দিলেন। তিনি যে কখন তাঁর কাজ করেছেন টের পাইনি, হুঁশ ফিরল যখন সামনে থেকে চিৎকার শুনলাম, "এখানে কার মানিব্যাগ? অতনু কুমার কার নাম?" বাবাজি ভদ্রলোক, টাকাপয়সা বের করে নিয়ে মান্থলি আর এটিএম কার্ডসমেত মানিব্যাগটা ট্রেনের দরজার মুখেই রেখে গেছিলেন। আরেকবার মানিব্যাগ খুইয়েও উদ্ধার করেছিলাম। সেটা ছিল চুঁচুড়া-শ্রীরামপুর রুটের ২নং বাসে। বসেছিলাম একবারে পিছনে। বিহারি মহিলাদের ক্যাচোড় ম্যাচোড় ঠেলে কোনরকমে বের হয়ে নামতে যাব, তখুনি খেয়াল করলাম পকেটে মানিব্যাগ নেই। সঙ্গে সঙ্গে ইউ টার্ন হয়ে বীরদর্পে পিছনদিকে এগিয়ে গেলাম, "আমার পার্স কই? পার্স কোথায় গেল?" একজন ভেটকি মাছের মত মুখ করে বলল, "এই তো তলায় পড়ে আছে"। তার দিকে তাচ্ছিল্যের দৃষ্টি হেনে মানিব্যাগ উদ্ধার করে বাস থেকে নামলাম।
কলেজে পড়ার সময় অভিযান পত্রিকায় এক পকেটমারকে নিয়ে একটা গল্প লিখেছিলাম। তখন অবশ্য ডেইলী প্যাসেঞ্জার ছিলাম না, তাই তাদের সঙ্গে সরারসরি মোলাকাৎ হয়নি। জানিনা সেই অতিক্ষুদ্র লিটল ম্যাগাজিনটা কোন আসল পকেটমারের চোখে পড়েছিল কি না আর তার জন্যেই আমার ওপর এত ভালবাসা কি না! 
শেষ গপ্পোটা অবশ্যই ল্যাপটপের। সেদিন একটু দেরি হয়ে গিয়েছিল। ৮টা ৪৭এর বর্ধমান লোকালে ফিরছি। বসার জায়গা পাইনি তাই ল্যাপটপের ব্যাগটা বাঙ্কারে তুলে দিলাম। কয়েকটা স্টেশন পার হল, গাড়ী ফাঁকা হল আর বাঙ্কারের দিকে তাকিয়ে দেখি পাখি ফুড়ুৎ। ঐ ব্যাগে ল্যাপটপ ছাড়াও ছিল এটিএম সমেত পার্স, পেনড্রাইভ, পেন, খাতা আর ছাতা। ব্যান্ডেল জিআরপিতে গিয়ে নালিশ করতে ওসি বললেন, "এত কিছু হারালেন আর মোবাইলটা রেখে দিলেন! মোবাইলটা হারালে বরং আমাদের ট্র্যাক করতে সুবিধে হত।" কেন যে মোবাইলটা চোরের হাতে তুলে দিলাম না সে নিয়ে আফশোস করতে করতেই দু দিন বাদে উত্তরটা পেয়ে গেলাম। আগের পেনড্রাইভটা হারানোর পর এটার খাপের ওপর আমার ফোন নাম্বারটা লিখে রেখেছিলাম। তার সূত্র ধরেই হারানো মাণিকের খোঁজ পেলাম। বর্ধমান থেকে এক পাঞ্জাবী ভদ্রলোক জানালেন তাঁর প্রতিবেশী একটি ছেলে ট্রেনে ব্যাগটা "কুড়িয়ে পেয়েছিল"। ব্যাগে যা টাকা ছিল তাই দিয়ে স্টেশনে বসে মিষ্টি খাওয়ার পর সেটাকে বাড়িতে নিয়ে আসে কিন্তু ব্যাগের ভেতরে বোম থাকতে পারে সন্দেহে বাড়ির লোক ওটাকে ঘরে ঢোকাতে দেয়নি। শেষে বোমাতঙ্ক দূর হলে ব্যাগ রহস্য ভেদ করা হয়। তারা না কি মালটা বেচে দেওয়ারই তাল করছিল, ঐ পাঞ্জাবী ভদ্রলোকই বুঝিয়ে সুঝিয়ে রাজি করিয়েছেন। এরপর বর্ধমান গিয়ে ল্যাপটপ উদ্ধার তো নেহাতই সময়ের ব্যাপার।অভিরূপ আর অনির্বাণ বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে রইল, আমি চোরমহল্লায় ঘেরাও হয়ে পড়লে উদ্ধার করার জন্য। আর কোন বিপত্তি হয়নি অবশ্য। খালি পিন্টুর (যে ল্যাপটপটা পেয়েছিল) মা যখন বলল, "আপনার বিবি তো বহুৎ খুবসুরৎ", এমন চমকে উঠলাম যে হাতের কাপ থেকে খানিকটা চা চলকে পড়ল! আমার বিবি আছে আমি নিজেই জানিনা, তো এরা কোত্থেকে জানল!! "বিয়ের ছবি দেখলাম তো!", হাঁফ ছাড়লাম "ওহ তাই বলুন, ওটা আমার এক বান্ধবীর বিয়ের ছবি।" 
গপ্পোটা এখানেই শেষ নয়। বাড়ি ফিরে ল্যাপটপ চালু করতেই চমকে চ! আমার আগের ওয়ালপেপারটার জায়গায় চমৎকার একটা বাঘের ছবি। উইন্ডোস এক্সপ্লোরারটা খুলতে তো ভিরমি খাবার জোগাড়। এসে গেছে দুটো হিন্দি সিনেমা, "দিল্লী বেল্লী" আর "মার্ডার ২" আর বেশ কয়েকটা গেম!