Wednesday, 18 June 2014

চার ধাম

মারদাঙ্গা নেই, খুন নেই, হট নায়িকা নেই, সৎ পুলিস অফিসার বা দুর্নীতিগ্রস্থ রাজনৈতিক নেতা নেই। এমনকি প্যানপ্যানে সুরে রবীন্দ্রসঙ্গীত বা অসংলগ্ন কথায় সাজানো আধুনিক গান, বা রদ্দিমার্কা আঁতলামি দিয়ে গল্পের দুর্বলতাকে ঢাকার চেষ্টা নেই। এককথায় বলা যায় সমাজচেতনা, যুগচেতনা আর যৌনচেতনার যথেষ্ট অভাব রয়েছে "চার" ছবিতে। কিন্তু যা আছে তা হল গল্প। সম্পূর্ণ আলাদা মেজাজের চারটে নিটোল ছিমছাম গল্প। রবিবাবুর কথায় "সহস্র বিস্মৃতিরাশি, প্রত্যহ যেতেছে ভাসি, তারই দু-চারিটি অশ্রুজল।" পরশুরামের "বটেশ্বরের অবদান", সত্যজিৎ রায়ের "দুই বন্ধু", "কাগ্তাড়ুয়া" আর শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের "পরীক্ষা"। চারটে গল্পই পড়া, গল্পের মোচড়গুলোও জানা। শুকনো পাতার ওপর টাইটেল কার্ড আর মন কেমন করা আবহ্সঙ্গীতে শুরুতেই স্মৃতিমেদুর হয়ে পড়লাম। ডায়েরির ভাঁজে রেখে দেওয়া পাতার মত বহুদিন আগে পড়া গল্পগুলো মনের পর্দায় ভেসে উঠল। ছোটগল্পকে পরদায় ফেলা সহজ কাজ নয়। একটা ছোট্ট গল্পকে অযথা টেনে বাড়িয়ে তিনঘন্টার সিনেমা বানালে তার রসটাই মাটি হয়ে যায়। সন্দীপ রায় তাই সেদিকে না গিয়ে চারটে গল্পকে পরপর বলে গেছেন মাত্র পৌনে দুইঘন্টায়। বাংলা সাহিত্যের তিন ডন পরশুরাম, সত্যজিৎ আর শরদিন্দু কাজটা আগেই গুছিয়ে রেখেছিলেন। পরিচালক আর কোন বাহাদুরির চেষ্টা করেননি। একদিক দিয়ে অবশ্য তাঁর সুবিধে আছে, তিনজনের লেখাই সিনেম্যাটিক। চলচ্চিত্র জগতের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত থাকা সত্যজিৎ আর শরদিন্দুর গল্পকে অনায়াসে চিত্রনাট্য বলে চালিয়ে দেওয়া যায়। পরিচালক আর অভিনেতারা কেরামতি দেখাতে গিয়ে কিভাবে অসাধারণ গল্পেরও সর্বনাশ করতে পারেন তা দেখা হয়ে গেছে "মিশর রহস্য" আর "চাঁদের পাহাড়"এ। এই ছবিতে নায়ক যদি কাউকে বলতে হয় তো সে হল মানবিক সম্পর্ক। তাই অভিনেতাদের কোন হিরোইজম দেখানোর সুযোগ নেই। মনে হচ্ছে তাঁরা একেবারে বইয়ের পাতা থেকেই উঠে এসেছেন। সঙ্গে বাড়তি পাওনা "পরীক্ষা" গল্পে পুরনো দিনের রোম্যান্টিক বাংলা ছবির আমেজ।

তবে দুটো কথা আছে। প্রথমতঃ "বটেশ্বরের অবদান" গল্পটিকে ২০১৩ তে না এনে "পরীক্ষা"র মত পিরিয়ড ফিল্ম করলেই ভালো হত। দ্বিতীয়ত "দুই বন্ধু" গল্পে দেখা যাচ্ছে দীর্ঘ ২৫বছর পর চুক্তি অনুযায়ী দেখা করতে চলেছে মহিম আর প্রতুল। এতদিন পর হঠাৎ করে চুক্তির কথা মনে পড়ল তা হতে পারেনা। সত্যজিত ও লিখেছেন, "মহিমের সন্দেহ হয়েছিল সে ব্যাপারটা এতদিন মনে রাখতে পারবে কি না; কিন্তু আশ্চর্য -এই বিশ বছরে একদিনের জন্যও সে চুক্তির কথাটা ভোলেনি"। অথচ সিনেমায় দেখা যাচ্ছে দেখা করতে যাওয়ার দিন সকালেই মহিম বৌ-কে বলছে ঘটনাটার কথা। তাছাড়া গল্পটাকে যখন ২০১৩ তে-ই আনা হয়েছে তখন মহিম ফেসবুকে একবারও প্রতুলকে খোঁজার চেষ্টা করলনা এটা খানিক বিস্ময়কর। সব মিলিয়ে বলতে পারি চারধাম যাত্রায় মন খুশি হয়ে গেল। বাংলা ছোটগল্পের আরো মণিমাণিক্য পর্দায় উঠে আসুক।

গল্পগুলো যাঁরা পড়েননি তাঁরা চটপট নীচের বইগুলো জোগাড় করে ফেলুন। তবে সিনেমাটা দেখার আগে পড়বেন না।
(১) পরশুরাম গল্পসমগ্র/ রাজশেখর বসু/ এম সি সরকার এন্ড সন্স
(২) গল্প ১০১/ সত্যজিৎ রায়/ আনন্দ পাবলিশার্স
(৩) গল্পসংগ্রহ/ শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়/ আনন্দ পাবলিশার্স




Tuesday, 15 April 2014

বিভাজনের রাজনীতি ও বাঙালী

ঘনাদা বললেন রাজনৈতিক লেখা দিতে। বলার তো আছে অনেক কিছুই, কিন্তু নানান চক্করে সেগুলোকে আর নামানো হয়ে উঠছিল না। এদিকে দেখি পয়লা বৈশাখ এগিয়ে আসছে, তার সঙ্গে দিল্লীর গদি দখলের লড়াই। কিন্তু কি কাণ্ড, সমস্ত সমীক্ষা যাকে সরকার গড়ার দৌড়ে এগিয়ে রেখেছে, যারা ভোটের ছমাস আগে প্রধাণমন্ত্রীর নাম ঘোষণা করে দিয়েছে, সেই ভারতীয় জনতা পার্টির তো দেখি ইশতেহারের দেখাই নেই! শেষমেশ একদফার ভোট মিটে যাওয়ার পর তারা ঝুলি থেকে ইশতেহার বের করল। তবে এতে আমি খানিক স্বস্তি পেলাম। শেষমুহূর্তে ইশতেহার দেখেও যদি আমজনতা পদ্মফুলে ছাপ দেন তবে আমার লেখাটা আর যাই হোক দেরীর জন্যে নিশ্চয়ই বাতিল হবে না!

ইশতেহারটি দেখে খানিক অবাক হলাম। সেই রামমন্দির নির্মাণ, ৩৭০ ধারা বিলোপ, গোহত্যা নিবারণী আইন, ...। অথচ কয়েক বছর ধরেই শোনা যাচ্ছিল বিজেপি না কি হিন্দুত্বের বদলে "সুশাসন" আর "উন্নয়ন"কেই অগ্রাধিকার দিতে চলেছে। গুজরাটকে দেশের মডেল রাজ্য হিসেবে তুলে ধরার জন্য প্রচারের অন্তঃ ছিল না নামীদামি কাগজ আর টিভি চ্যানেলগুলোর। অবশ্য একটু পরিসংখ্যান ঘেঁটে তলিয়ে দেখলেই প্রচারের ফানুস ফাটতে সময় লাগে না। স্বাধীনতার আগে থেকেই ব্যবসা বাণিজ্যে এগিয়ে থাকা গুজরাতের আর্থিক বৃদ্ধির হার যে নরেন্দ্র মোদীর শাসনকালে শ্লথ হয়েছে, মানবোন্নয়নে গুজরাতের হাল যে অত্যন্ত খারাপ সেটাকে অস্বীকার করার জো নেই। অবশ্য বিজেপি নেতারা সে চেষ্টা করছেনও না। অত্ত সংখ্যা আর তথ্যের কচকচির চাইতে ঐ "আব কি বার মোদী সরকার" টাইপের স্লোগান পাবলিক খায় বেশী। মোদীর থিঙ্ক-ট্যাঙ্কের অন্যতম অরুণ জেটলি সার কথাটা বলে দিয়েছেন, "উন্নয়ন নিয়ে বক্তৃতা দিলে মানুষ ততটা হাততালি দেয়না, কিন্তু যখন জয় শ্রীরাম ধ্বনি ওঠে তখন কর্মীদের উৎসাহ দেখার মত।" তবে বিজেপি ক্যাডাররা উৎসাহিত হলেও শিক্ষিত, মধ্যবিত্ত সমাজকে জয় শ্রীরাম স্লোগান দিয়ে আকৃষ্ট করা কঠিন। তাই সুশাসন, উন্নয়নের গপ্পো শোনানো দরকার। আর হিন্দুত্বের পোস্টারবয় নরেন্দ্র মোদীকে তুলে ধরলে কট্টর হিন্দু ভোট এমনিতেই ঝুলিতে পড়বে। 

আসলে জাত-ধর্ম বা আঞ্চলিকতার ভিত্তিতে মানুষকে উত্তেজিত করা যতটা সহজ, অর্থনৈতিক ভিত্তিতে সংগঠিত করা ততটাই কঠিন। ভারতের রাজনৈতিক বিন্যাসের দিকে তাকালে ব্যাপারটা সহুজেই বোঝা যায়। কংগ্রেস আর বামপন্থীদের বাদ দিলে (এখন আপকেও ধরতে হবে) প্রায় সব দলই জাত, ধর্ম বা আঞ্চলিকতার ওপর প্রতিষ্ঠিত। কংগ্রেস ঐতিহাসিক দল। মূলতঃ বৃটিশদের উদ্যোগে ভারতবাসীর ক্ষোভ-অসন্তোষের সেফটি ভাল্ভ হিসেবে কংগ্রেসের জন্ম হয়েছিল, কংগ্রেস বারবার স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে এসব কথা মেনে নিয়েও বলতে হয় স্বাধীনতার আগে নানা ভাষা, নানা মত, নানা পরিধান বিশিষ্ট ভারতবর্ষের জাতীয় মঞ্চ ছিল কিন্তু কংগ্রেসই। অন্যদিকে কংগ্রেসের নরমপন্থী দরকষাকষির রাজনীতি আর বিপ্লবীদের সশস্ত্র সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের বাইরে শ্রমিক-কৃষক-মধ্যবিত্তের অর্থনৈতিক সংগ্রামকে রাজনীতির মূল ধারার সঙ্গে যুক্ত করে তৃতীয় পথের সন্ধান গতি পায় রাশিয়ায় নভেম্বর বিপ্লবের সাফল্যে। একটা সময় গোটা দেশেই কমিউনিস্টদের যথেষ্ট শক্তি ও প্রভাব ছিল। স্বাধীনতার পর দুর্নীতি, কোন্দল, পরিবারতান্ত্রিকতায় ডুবে যাওয়া কংগ্রেস যত জমি হারালো, দেশের মাটিতে মার্কসবাদের সৃজনশীল প্রয়োগের বদলে রাশিয়া-চীনের অন্ধ অনুকরণ করতে গিয়ে কমিউনিস্টরা যত দুর্বল হল, ততই দাপট বাড়ল জাত, ধর্ম ও আঞ্চলিকতার ভিত্তিতে তৈরী দলগুলোর। তবে ভাষা, জাতিসত্তা বা আঞ্চলিকতার ওপর দাঁড়িয়ে কোন দল একটা রাজ্যে ক্ষমতায় আসতে পারে, কিন্তু জাতীয় রাজনীতিতে নির্ণায়ক হওয়া সম্ভব নয়। তার জন্য দরকার দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ লোকের যেটা ধর্ম, সেই হিন্দুত্বকে আঁকড়ে ধরা। এখানেই মুলায়ম-মায়াবতী-জয়ললিতাদের চেয়ে নরেন্দ্র মোদির অ্যাডভান্টেজ। 

অথচ গোটা ভারতের এই প্রবণতার মধ্যে বাংলা এক মূর্তিমান ব্যতিক্রম। জাত-ধর্ম ভিত্তিক রাজনীতি কোনদিনই বাংলায় বিশেষ কল্কে পায়নি। বৃটিশরা ধর্মের ভিত্তিতে বাংলা ভাগ করতে গিয়ে হাত পুড়িয়েছিল। শেষঅবধি অবশ্য দেশভাগের সঙ্গে বাংলা ভাগ হলই। দেশনেতাদের দ্রুত ক্ষমতালাভের তাড়া আর ৪৬এর স্মৃতিভারাক্রান্ত বাঙালীর ঝামেলা না বাড়ানোর তাগিদ না থাকলে ইতিহাস হয়ত অন্যরকমও হতে পারত। সোরাবর্দী-কিরণশঙ্কর রায়-শরৎ বসুরা একটা চেষ্টা করেছিলেন বাঙলাকে অবিভক্ত রাখার। সে চেষ্টা সফল না হলেও বাংলার দুই অংশেই সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদীরা কখনোই নির্ণায়ক শক্তি হয়ে উঠতে পারেনি। বরং ওপারের বাঙালীদের প্রথমে রাষ্ট্রভাষা বাংলা ও বাংলা ভাষার রাষ্ট্র অর্জনের মরণপণ লড়াই দ্বিজাতিতত্ত্বকেই অর্থহীন করে দেয়। একথা ঠিকই জামাত-ই-ইসলামির মত মৌলবাদী ও মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী দলের দাপট বাংলাদেশে কম নয়, কিন্তু তারাও একার শক্তিতে ক্ষমতা দখল করতে পারেনি। বিএনপির (কখনো আওয়ামি লীগেরও) লেজুর হয়েই থাকতে হয়েছে। বাংলাদেশে হিন্দু-নির্যাতন আর দলে দলে হিন্দুদের দেশত্যাগের ঘটনাকেও অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু বাংলাদেশ থেকে যে শুধু হিন্দুরা ভারতে আসছেন তাই নয়, অনেক মুসলমানও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাঁটাতার পেরোচ্ছেন। তাই বাংলাদেশী অনুপ্রবেশের পিছনে শুধু ধর্মীয় নয়, অর্থনৈতিক কারণও রয়েছে। 

যদি এপার বাংলার দিকে তাকাই তাহলেও দেখবো যে হিন্দু মৌলবাদীরা পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে সুবিধে করে উঠতে পারেনি। অথচ এমনটা হওয়ার কথা নয়। দেশভাগের ধাক্কায় অগণিত মানুষ ভিটেমাটি হারিয়ে সর্বস্বান্ত হয়ে চলে এসেছিলেন এপারে। তাঁরা যাঁদের হাতে সম্পত্তি খুইয়েছিলেন, প্রিয়জনকে হারিয়েছিলেন তাঁরা ধর্মে মুসলমান। ৪৬এর দাঙ্গার স্মৃতিও তখন দগদগে। সাম্প্রদায়িক রাজনীতির কারবারিদের কাছে এমন পরিস্থিতি তো সোনায় সোহাগা! স্বাধীনতার ৪ বছর পর আজকের বিজেপির পূর্বসূরী, আরএসএসের রাজনৈতিক শাখা জনসঙ্ঘের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন একজন বাঙালী, শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। শিক্ষাবিদ ও রাজনীতিবিদ হিসেবে শ্যামাপ্রসাদের যোগ্যতা তাঁর ঘোর বিরোধীরাও অস্বীকার করতে পারবে না। সম্পূর্ন ভিন্ন রাজনীতির লোক ফজলুল হক ও জওহরলাল নেহরু তাঁদের মন্ত্রীসভায় অন্তর্ভূক্ত করেছিলেন শ্যামাপ্রসাদকে। এ হেন শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ও কিন্তু পরিস্থিতির সদ্ব্যবহার করে বাংলার মাটিতে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির গোড়াপত্তন করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। বরং উদ্বাস্তুদের পাশে দাঁড়িয়ে, তাঁদের এই অবস্থার জন্য যাঁরা অনেকটাই দায়ী সেই কংগ্রেসের দিকে ক্ষোভকে চালনা করে মাটি শক্ত করেছিলেন কমিউনিস্টরা। এরপরে পশ্চিমবঙ্গে অনেক রাজনৈতিক পালাবদল ঘটেছে, কিন্তু বিজেপি সুবিধে করতে পারেনি। একটা-দুটো আসনের জন্য তাদের কখনো তৃণমূল কংগ্রেস, কখনো বা গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার হাত ধরতে হয়েছে। শুধু ধর্মের সাম্প্রদায়িকতা নয়, আমরা বাঙালী টাইপের রাজনীতিও এখানে হালে পানি পাবে না। অন্য রাজ্য থেকে পেটের ধান্দায় আসা মানুষ ক্রমে এখানে মিশে গেছেন।       

এর কারণ হিসেবে অনেকেই বলেন বাঙালী আসলে সংকর জাতি, তাই তারা স্বভাবতই বহুত্ববাদী ও প্রগতিশীল। "দিবে আর নিবে, মিলাবে মিলিবে"  এই হল বাঙালীর রাস্তা। জাতপাতের বেড়া ভাঙাই হোক, সতীপ্রথার বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণাই হোক আর রাজনীতির চেনা পথকে বাতিল করে গ্রাম দিয়ে শহর ঘিরতে ঝাঁপিয়ে পরাই হোক নতুন পথের সন্ধান তো বাঙালীরাই বারবার দিয়েছে। তাই গোলওয়ালকরের হিন্দুত্ব নয় চৈতন্য-রামকৃষ্ণের হিন্দুত্বই বাঙালির পছন্দ। এপ্রসঙ্গে বন্ধু ব্লগার শাক্যমুনির কিছু কথা উদ্ধৃত না করে পারছিনাঃ 

এই এত বছর পরে এত রকমের রক্ত মেশাবার পরেও আমরা বাঙালীরা বাকিদের থেকে অনেকটাই আলাদা, অনেকটাই প্রোগ্রেসিভ। কারণ আমরা চিরকালই রোম্যান্টিক, রেবেলিয়াস, রঙিন। গোঁড়ামি কে আমরা কোনোকালেই পাত্তা দিইনি (গোঁড়ামি সে ধর্মীয় বলুন বা রাজনৈতিক), তাই ধর্মের রুক্ষ পাষাণ বেদী থেকে দেবতা কে আমরা নামিয়ে এনেছি ঘরের উঠোনে, শিব ঠাকুর কে জামাই বানিয়ে বিয়ে দিয়েছি ঘরের মেয়ে উমার সঙ্গে আর কেষ্ট ঠাকুরের মামিমা রাধার সঙ্গে অবৈধ প্রেম নিয়ে আমরা বেঁধেছি প্রাণের গান, ভক্তিরসের উন্মাদনায় কাতর হয়েছি, পাগল হয়েছি, বিপ্লবী হয়েছি আমরা, পৈতে ছেড়ে গলায় দিয়েছি কণ্ঠীর মালা। প্রেম ও যৌনতার ট্যাবু কে অবলীলায় ছিন্ন করে তাকে জুড়ে দিয়েছি রিচুয়াল প্র্যাকটিসের সঙ্গে। কট্টর মৌলবিদের চোখ রাঙানি কে উপেক্ষা করে আমরা পরিধান করেছি বেশরিয়ত ফকিরের আলখাল্লা।

কিন্তু বাঙালী কি সম্পূর্ণ অসাম্প্রদায়িক? ট্রেণে-বাসে-রকে-ফেসবুকে কান পাতলেই বোঝা যাবে তা নয়। অন্তত বাঙালিদের মধ্যে একটা বড় অংশ আছে যারা ঘোরতর সাম্প্রদায়িক। আজও বেশীরভাগ জায়গায় হিন্দু, মুসলমান আলাদা পাড়ায় থাকে। পাশে মসজিদ থাকলে বাড়ি কেনেন না হিন্দু শিক্ষক, ভিনধর্মে প্রেম-বিয়ে মোটেই সহজ ব্যাপার নয়। তাহলে কি বাঙালী শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে বিশ্বাসী? অর্থাৎ হিন্দু হিন্দুর মত থাক, মুসলমান মুসলমানের মত, কেউ কাউকে না ঘাঁটালেই হল?
পশ্চিমবঙ্গের শাসকরাও বোধহয় সেই নীতিতেই বিশ্বাসী। সাধারণভাবে ধর্মনিরপেক্ষ হলেও ভোটের স্বার্থে তাঁরা ধর্মীয় গোঁড়ামির গোড়ায় টান দিতে আগ্রহী নন। বামফ্রন্টের তসলিমা বিতাড়ন, তৃণমূলের ইমামভাতা তারই উদাহরণ মাত্র। আগে বলেছিলাম কংগ্রেস আর বামপন্থীরা জাত-ধর্মের ভিত্তিতে রাজনীতি করেননা। এই তালিকায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল কংগ্রেসকেও রাখা যেতে পারে। তিনি যদিও একাধিকবার বিজেপির সঙ্গে ঘর করেছেন, গুজরাত গণহত্যার পর নরেন্দ্র মোদী ভোটে জিতলে ফুল পাঠিয়েছেন। তবু দেরিতে হলেও বুঝেছেন বিজেপি সঙ্গ তাঁর পক্ষে আদৌ লাভজনক নয়। কিন্তু তাঁর সরকারের নানারকম কাজকর্মে যে সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলো উৎসাহিত হচ্ছে সেবিষয়ে তিনি অবগত নন? পরিবর্তনের পর এরাজ্যে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের সদস্য উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। বিজেপির ভোট যে বাড়ছে সে কি শুধু মোদী হাওয়া?

বাংলায় জাত-ধর্মের ভিত্তিতে রাজনীতি হয়না বলেছিলাম বটে কিন্তু একথা আর কতদিন খাটবে? ওদিকে গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা, আদিবাসী বিকাশ পরিষদ, কামতাপুর পিপলস পার্টির আত্মপরিচয়ের রাজনীতি মাথা চাড়া দিচ্ছে, এদিকে রেজ্জাক মোল্লা দলিত+মুসলিম সমীকরণে নতুন দল খুলছেন। আর বিজেপির বিষ তো আছেই। পশ্চিমবাংলাও কি তাহলে গড্ডালিকায় গা ভাসাবে? শ্রীলঙ্কায় তামিলদের ওপর নারকীয় অত্যাচার চালাচ্ছে উগ্র সিংহলী জাতীয়তাবাদী রাজাপক্ষ সরকার, পাকিস্তানে ক্ষমতায় এসেছে তালিবানদের প্রতি সহানুভূতিশীল নওয়াজ শরিফের দল, নেপালের গণপরিষদ নির্বাচনে চমকপ্রদ সাফল্য পেয়েছে হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্রীয় প্রজাতন্ত্র পার্টি, বাংলাদেশে জামাতী-হেফাজতীদের সঙ্গে সম্মুখ সমরে রক্ত ঝরাচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ তরুণরা। ভারতের জমি হাঙড় আর ধান্দাবাজ কর্পোরেটরা প্রাণপাত করছে এমন একজন একনায়ককে ক্ষমতায় আনতে যিনি যেকোন প্রতিবাদ, বিরোধিতাকে দুরমুশ করতে পারেন। গুজরাত নরমেধ যজ্ঞের পৌরহিত্য করে, সোহরাবুদ্দিন, তুলসী প্রজাপতি, ইশরাত জহানকে খতম করে তিনি যোগ্যতার প্রমাণ রেখেছেন। পশ্চিমবাংলা কি করবে? হিংসা-বিদ্বেষের মোদী হাওয়ায় গা ভাসাবে না কি বহুত্ব ও ঐক্যের মশাল জ্বালিয়ে পথ দেখাবে বাকি ভারতকে?

প্রথম প্রকাশঃ লেখালেখি ই ম্যাগাজিন, বৈশাখ ১৪২১

Thursday, 20 March 2014

গোপাল না রাখাল?

একটা সময় প্রত্যেক ভোটের আগে বামফ্রন্টকে ভোট দেওয়ার আবেদন জানিয়ে একটা বিবৃতি বেরোত, যাতে সই থাকত বাংলার প্রায় সমস্ত প্রথম সারির শিল্পী-সাহিত্যিক-সঙ্গীতজ্ঞ-চলচিত্রকর্মীদের। বুদ্ধিজীবিরা তাঁদের স্বভাবজনিত সংবেদনশীলতার জন্য বামপন্থী মতাদর্শে বিশ্বাসী বলে ধরে নেওয়া হত। কখনো সখনো মৃদুমন্দ সমালোচনা করলেও যেকোন বড় ইস্যুতে তাঁরা বামফ্রন্ট তথা সিপিএমের পাশেই দাঁড়াতেন। অবশ্য বিরোধী ও নিন্দুকরা বারবারই অভিযোগ করত বুদ্ধিজীবিরা সিপিএমের পাশে আছেন কোন আদর্শের তাড়নায় নয় স্রেফ ক্ষমতার মধু চাটার জন্য। সংস্কৃতিবান বুদ্ধদেববাবু মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর বুদ্ধিজীবিদের বাম-ঘনিষ্ঠতা আরো নিবিড় হয়। নিন্দুকরা তাঁদের নাম দেন "বুদ্ধজীবি"। দ্বিখণ্ডিত নিষিদ্ধকরণের মত চরম বাকস্বাধীনতা বিরোধী পদক্ষেপের সমর্থনেও যুক্তি দিতে তাঁদের বাধেনি। একবার জনযুদ্ধ গোষ্ঠী ও তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল সমাজকর্মীদের ওপর রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সরব হলে "আমাদের সাহায্য নিয়ে ওদের মদত" করার জন্য বুদ্ধিজীবিদের কড়কে দিয়েছিলেন তৎকালীন সিপিএম সম্পাদক অনিল বিশ্বাস। বুদ্ধিজীবিদের বামপ্রেমে ধাক্কা লাগে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের সময় থেকে। পাবলিকের মারে সিপিএম যত বেসামাল হল, ততই দলে দলে বুদ্ধিজীবি শিবির ছাড়তে শুরু করলেন। তাঁদের মধ্যে স্পষ্ট দুটো ভাগ হল, "বুদ্ধজীবি" আর "পরিবর্তনপন্থী"। দ্বিতীয়গোষ্ঠীকে সুশীল সমাজ, নাগরিক সমাজ ইত্যাদি নামে ডাকা হত। চ্যানেলে চ্যানেলে দুপক্ষের তরজা আমজনতা গোগ্রাসে গিলল আর বাংলা সিরিয়ালগুলোর টিআরপি নেমে গেল। একদল তখনো শিল্পায়নের নামে সিঙ্গুরের বহুফসলী জমি জবরদখল, তাপসী মালিকের নৃশংস হত্যা, নন্দীগ্রামে পুলিস-ক্যাডার যৌথবাহিনীর অপারেশন সূর্যোদয়ের সমর্থনে সাফাই গাইছেন আর অন্যদল সরকারের পরিবর্তনের সওয়াল করছেন। ক্রমশ প্রথমদলের গলার আওয়াজ মিইয়ে এলো আর দ্বিতীয়দল "পরিবর্তনপন্থী" থেকে "মমতাপন্থী"তে উত্তীর্ণ হলেন। পরিবর্তনের পর দ্বিতীয়দল থেকে অনেকেই সাংসদ, বিধায়ক, মন্ত্রী বা বিভিন্ন সরকারি সংস্থা বা কমিটির পদাধিকারী হলেন। কবীর সুমন, সুনন্দ সান্যালের মত কয়েকটা অবাধ্য রাখাল অবশ্য সব জমানাতেই ছিল। তবে সুবোধ কবি, সুশীল অভিনেতা, সুবেশ গায়কদের মত গোপালের সংখ্যাই বেশী যারা চট করে বাপ বদলে ফেলতে পারে। এবারের লোকসভা ভোটে দেখা গেল সেইসব প্রাক্তন "বুদ্ধজীবি"রা কেউ সরাসরি তৃণমূলের টিকিট পেলেন, কেউ বা বন্ধুতার দোহাই পেড়ে প্রচারে নামলেন ভবিষ্যতের জমিটা তৈরী রাখার স্বার্থে। স্বনাম ও বাপের নামধন্য জাদুকর অবশ্য ছোট জায়গায় নাড়া বাঁধতে নারাজ। তিনি সাক্ষাৎ হনুমানের অবতার নরেন্দ্র মোদীর শরণাপন্ন হয়েছেন। এঁরা অনেকেই হয়ত পদ্মবিভূষণ বা বঙ্গবিভূষণে সন্মানিত হবেন। তবে সিপিএম তাঁদের বঙ্গবিভীষণ শিরোপা দেবে কি না জানা নেই।

গোপাল আর রাখালের গল্পটা কেবল বুদ্ধিজীবিদের মধ্যে খুঁজলে ভুল হবে। নন্দীগ্রাম যুদ্ধের আঁচ এসে পড়েছিল বামফ্রন্টের অন্দরেও। নীতিভ্রষ্টতার অভিযোগ তুলে সরব হয়েছিল ফরোয়ার্ড ব্লক, আরএসপির মত শরিকরা। তখন বাধ্য গোপালের মত ল্যাজ নেড়ে গেছিলেন কিরণময় নন্দ। পরিণামে ক্ষিতি গোস্বামীর মত নেতাদের তীব্র আক্রমণের মুখে পড়তে হয়েছিল। ফব, আরএসপিকে বাদ দিয়ে কিরণময়ের সমাজবাদী পার্টিকে ফ্রন্টের মেজ শরিক বানানোর তত্ত্ব হাজির করেছিল সিপিএম। ক্ষিতিবাবুরা এখনো ফ্রন্টেই আছেন। কিন্তু কিরণময়বাবুরা এখন ফেডারেল ফ্রন্টের গল্প শুনিয়ে তৃণমূল নেত্রীর কাছে আশ্রয় চাইছেন। তাঁদের নেতা মুলায়মের যা মতিগতি তাতে ভোটের পর কংগ্রেস এমন কি বিজেপির হাত ধরাটাও তাঁর পক্ষে খুব কঠিন নয়।

"দুঃখের দিনের বন্ধুই আসল বন্ধু", একথা সবাই জানি তবু কার্যক্ষেত্রে মনে রাখিনা। যেসব বামপন্থী রাজনীতিবিদ, অর্থনীতিবিদ, সমাজকর্মীরা বামফ্রন্ট সরকারের দক্ষিণপন্থীদের চেয়েও দক্ষিণপন্থী হওয়ার প্রচেষ্টার নিন্দা করেছিলেন তাঁরা আজ অনেকেই  রাজ্য ও কেন্দ্রে স্বৈরাচারী ও ফ্যাসিবাদী শক্তিকে আটকাতে সেই "পচাগলা" বামপন্থীদেরই আঁকড়ে ধরতে চাইছেন। কিন্তু তোষামোদ কে বঙ্গোপসাগরে ফেলে দিয়ে যুক্তিসঙ্গত সমালোচনাকে সাদরে গ্রহণ করার সাহস আর সিপিএমের নেই। নীতিগত বিষয়ে প্রশ্ন তোলার জন্য প্রসেনজিৎ বসু, রেজ্জাক মোল্লার প্রতি, জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতাদের প্রতি যে আচরণ করা হল তা বোঝায় কূয়োর ব্যাং হয়ে থাকাকেই সিপিএম ভবিতব্য বলে ধরে নিয়েছে। আদ্যন্ত দক্ষিণপন্থী আম আদমি পার্টি যেভাবে বিভিন্ন সামাজিক আন্দোলনের শক্তিকে রাজনীতির ময়দানে নিয়ে আশার চেষ্টা করছে তা থেকে শিক্ষা নিয়ে ছোট বামপন্থী দল ও সংগঠনকে একত্রিত করার বদলে সুবিধাবাদী আঞ্চলিক দলগুলোকে নিয়ে তৃতীয় ফ্রন্টের অলীক মরীচিকার পেছনে দৌড়ানো হচ্ছে। তবে কি না এখনো সময় আছে। সুবোধ সুশীল ও কিরণময়দের কাপড় উন্মোচন থেকে কি সিপিএম শিক্ষা নেবে? গোপালদের ত্যাজ্যপুত্তুর করে রাখালদের বুকে টেনে নিতে পারবে? কূয়ো থেকে বেরিয়ে সমুদ্রে যাওয়ার হিম্মত কি হবে? প্রশ্নগুলো সহজ, উত্তরটা ... 

চর্যাপদ লিঙ্ক

Friday, 3 January 2014

পকেটমারের পাল্লায়

পকেটমারদের যে আমি খুব পেয়ার করি এমনটা নয়। কিন্তু ব্যাপার হল ইস্কুলের মাস্টারমশাই থেকে হবু অর্ধাঙ্গিনী সবারই মত আমি নাকি মারাত্মক রকমের অন্যমনস্ক আর ভুলো। তারা খুব ভুল কিছু বলে এমন দাবী আবার আমি জোরগলায় করতে পারিনা। ফলতঃ পকেটমাররা যে আমাকে বেজায় পছন্দ করবে তাতে আশ্চর্য্যের কিছু নেই। আর ট্রেনে বাসে নিত্য যাতায়াত করলে, তাদের সঙ্গে মোলাকাৎ না করে উপায় কি! প্রথম তাদের পাল্লায় পড়ি বাইপাসের ওপর ভূতল পরিবহনের ন্যানোবাসে। সেই প্রথম বাড়ি ছেড়ে হোস্টেলে থাকতে এসেছি। দাদা একটা নোকিয়া ১১০০ ফোন কিনে দিয়েছিল, সঙ্গে একটা ক্লিপ-ফিতে। "এটা দিয়ে মোবাইলটাকে জামার সঙ্গে আটকে রাখলে আর চিন্তা নেই"। চিন্তা যে পকেটমারদেরও নেই তা বুঝলাম যখন দেখলাম বুকপকেট থেকে ফোনবাবাজি ফিতেশুদ্দু নিরুদ্দেশ হয়েছেন। এপর্যন্ত আমি যা খুইয়েছি তার মধ্যে আছে দুটো মোবাইল, দুটো মানিব্যাগ, একটা পেনড্রাইভ আর হ্যাঁ একটা ল্যাপটপ। শেষোক্তটাকে অবশ্য পকেটমারি বলা যায়না। কিন্তু কি যে বলা যায় তা আজও রহস্য। ওটার কথায় পরে আসছি। তবে এটা ঠিক যে এখন আমি অনেক সতর্ক, বাসে যত ভীড়ই থাকুকনা কেন, রডটা ধরি একহাত দিয়েই, আর একটা হাত রাখি পকেটের কাছে, যেখানে মোবাইল, মানিব্যাগ ইত্যাদি থাকে। বলতে নেই, বছরদুয়েকের মধ্যে পকেটমাররা আমার কাছে নিরাশই হয়েছে। 
মোবাইল প্যান্টের পকেটে রাখতে শুরু করি অবশ্য প্রথম ফোনচুরির পর থেকেই। তবে তাতেও যে সবসময় পকেটমারদের টেক্কা দেওয়া যাবে এমন নয়। আমার দ্বিতীয় মোবাইলটা তো গেছিল প্যান্টের পকেট থেকেই। এল-২৩৮ বাসটা দৈত্যকুলে প্রহ্লাদবিশেষ, মানে প্রাইভেট বাস হয়েও জনগণের দাবীতে যেখানে সেখানে দাঁড়ায়না, ফলে ভীড়ও হয় তেমনি আর কে না জানে ভীড় মানেই পকেটমারদের পোয়াবারো। এমনকি ওরা কাজের সুবিধার্থে ইচ্ছাকৃতভাবে ভীড় তৈরী করে এমন একটা কথাও শোনা যায়। তাই পকেটমারদের দাপটের জন্যও এল-২৩৮এর খ্যাতি আছে। সেদিন কোনরকমে পা-দানি থেকে উঠে দরজায় দাঁড়িয়েছি, এমন সময় সিটের ধারে দাঁড়িয়ে থাকা একজন টাকমাথা বেঁটেখাটো নিরীহ ভদ্রলোক বললেন, "আপনি এখানে দাঁড়িয়ে যান, আমি নেমে যাই।" তাঁকে ধন্যবাদ দিয়ে এগিয়ে গেলাম আর তিনি ভীড়ের জন্যই হয়ত বা অনেকক্ষণ ধরে আমার গা ঘেঁষে বেরোলেন। উল্টোডাঙা আসতেই বাস হালকা, আমার পকেটও। আমার বন্ধু মৈনাকেরও একই অভিজ্ঞতা হয়েছিল। উল্টোডাঙায় পকেটে হাত দিয়ে হাহাকার করে উঠতে কন্ডাকটার রাস্তার দিকে আঙুল দেখিয়ে বলে, "আগে বলবেন তো, ঐ দেখুন চলে যাচ্ছে ..." তখন আর কে কাকে দেখে! মৈনাক তো হাঁ, "আপনি জানতেন বাসে পকেটমার আছে??" কন্ডাক্টারের উত্তর, "জলে নেমে কি কুমীরের সঙ্গে বিবাদ করা চলে দাদা!" কন্ডাক্টাররা সাধারণত পকেটমারদের চেনে, এবং তাদের দেখলে নানারকম ইঙ্গিত দিয়ে যাত্রীদের সাবধান করার চেষ্টা করে থাকে, কিন্তু কখনোই তাদের ধরিয়ে দেয় না।
বুঝতেই পারছেন আমি দেখে শেখার চেয়ে ঠেকে শেখাতেই বেশী আগ্রহী। তাই মানিব্যাগটাও রাখতাম প্যান্টের পেছনের পকেটে, যতদিন না ট্রেনে এক পকেটমার বাবাজি আমায় উচিৎ শিক্ষা দিলেন। তিনি যে কখন তাঁর কাজ করেছেন টের পাইনি, হুঁশ ফিরল যখন সামনে থেকে চিৎকার শুনলাম, "এখানে কার মানিব্যাগ? অতনু কুমার কার নাম?" বাবাজি ভদ্রলোক, টাকাপয়সা বের করে নিয়ে মান্থলি আর এটিএম কার্ডসমেত মানিব্যাগটা ট্রেনের দরজার মুখেই রেখে গেছিলেন। আরেকবার মানিব্যাগ খুইয়েও উদ্ধার করেছিলাম। সেটা ছিল চুঁচুড়া-শ্রীরামপুর রুটের ২নং বাসে। বসেছিলাম একবারে পিছনে। বিহারি মহিলাদের ক্যাচোড় ম্যাচোড় ঠেলে কোনরকমে বের হয়ে নামতে যাব, তখুনি খেয়াল করলাম পকেটে মানিব্যাগ নেই। সঙ্গে সঙ্গে ইউ টার্ন হয়ে বীরদর্পে পিছনদিকে এগিয়ে গেলাম, "আমার পার্স কই? পার্স কোথায় গেল?" একজন ভেটকি মাছের মত মুখ করে বলল, "এই তো তলায় পড়ে আছে"। তার দিকে তাচ্ছিল্যের দৃষ্টি হেনে মানিব্যাগ উদ্ধার করে বাস থেকে নামলাম।
কলেজে পড়ার সময় অভিযান পত্রিকায় এক পকেটমারকে নিয়ে একটা গল্প লিখেছিলাম। তখন অবশ্য ডেইলী প্যাসেঞ্জার ছিলাম না, তাই তাদের সঙ্গে সরারসরি মোলাকাৎ হয়নি। জানিনা সেই অতিক্ষুদ্র লিটল ম্যাগাজিনটা কোন আসল পকেটমারের চোখে পড়েছিল কি না আর তার জন্যেই আমার ওপর এত ভালবাসা কি না! 
শেষ গপ্পোটা অবশ্যই ল্যাপটপের। সেদিন একটু দেরি হয়ে গিয়েছিল। ৮টা ৪৭এর বর্ধমান লোকালে ফিরছি। বসার জায়গা পাইনি তাই ল্যাপটপের ব্যাগটা বাঙ্কারে তুলে দিলাম। কয়েকটা স্টেশন পার হল, গাড়ী ফাঁকা হল আর বাঙ্কারের দিকে তাকিয়ে দেখি পাখি ফুড়ুৎ। ঐ ব্যাগে ল্যাপটপ ছাড়াও ছিল এটিএম সমেত পার্স, পেনড্রাইভ, পেন, খাতা আর ছাতা। ব্যান্ডেল জিআরপিতে গিয়ে নালিশ করতে ওসি বললেন, "এত কিছু হারালেন আর মোবাইলটা রেখে দিলেন! মোবাইলটা হারালে বরং আমাদের ট্র্যাক করতে সুবিধে হত।" কেন যে মোবাইলটা চোরের হাতে তুলে দিলাম না সে নিয়ে আফশোস করতে করতেই দু দিন বাদে উত্তরটা পেয়ে গেলাম। আগের পেনড্রাইভটা হারানোর পর এটার খাপের ওপর আমার ফোন নাম্বারটা লিখে রেখেছিলাম। তার সূত্র ধরেই হারানো মাণিকের খোঁজ পেলাম। বর্ধমান থেকে এক পাঞ্জাবী ভদ্রলোক জানালেন তাঁর প্রতিবেশী একটি ছেলে ট্রেনে ব্যাগটা "কুড়িয়ে পেয়েছিল"। ব্যাগে যা টাকা ছিল তাই দিয়ে স্টেশনে বসে মিষ্টি খাওয়ার পর সেটাকে বাড়িতে নিয়ে আসে কিন্তু ব্যাগের ভেতরে বোম থাকতে পারে সন্দেহে বাড়ির লোক ওটাকে ঘরে ঢোকাতে দেয়নি। শেষে বোমাতঙ্ক দূর হলে ব্যাগ রহস্য ভেদ করা হয়। তারা না কি মালটা বেচে দেওয়ারই তাল করছিল, ঐ পাঞ্জাবী ভদ্রলোকই বুঝিয়ে সুঝিয়ে রাজি করিয়েছেন। এরপর বর্ধমান গিয়ে ল্যাপটপ উদ্ধার তো নেহাতই সময়ের ব্যাপার।অভিরূপ আর অনির্বাণ বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে রইল, আমি চোরমহল্লায় ঘেরাও হয়ে পড়লে উদ্ধার করার জন্য। আর কোন বিপত্তি হয়নি অবশ্য। খালি পিন্টুর (যে ল্যাপটপটা পেয়েছিল) মা যখন বলল, "আপনার বিবি তো বহুৎ খুবসুরৎ", এমন চমকে উঠলাম যে হাতের কাপ থেকে খানিকটা চা চলকে পড়ল! আমার বিবি আছে আমি নিজেই জানিনা, তো এরা কোত্থেকে জানল!! "বিয়ের ছবি দেখলাম তো!", হাঁফ ছাড়লাম "ওহ তাই বলুন, ওটা আমার এক বান্ধবীর বিয়ের ছবি।" 
গপ্পোটা এখানেই শেষ নয়। বাড়ি ফিরে ল্যাপটপ চালু করতেই চমকে চ! আমার আগের ওয়ালপেপারটার জায়গায় চমৎকার একটা বাঘের ছবি। উইন্ডোস এক্সপ্লোরারটা খুলতে তো ভিরমি খাবার জোগাড়। এসে গেছে দুটো হিন্দি সিনেমা, "দিল্লী বেল্লী" আর "মার্ডার ২" আর বেশ কয়েকটা গেম!