Thursday, 17 September 2020

এগারোর গেরো

দুদিন বাদেই মহালয়া৷ মহালয়ার শাস্ত্রীয় তাৎপর্য যাই হোক, বাঙালীর কাছে মহালয়া মানে ভোর চারটেয় উঠে রেডিওতে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রর মহিষাসুরমর্দিনী শোনা আর হিসেব কষে দেখে নেওয়া, ঠিক সাতদিন বাদেই পুজোর ঢাকে কাঠি পড়বে। এবারের পুজো নানা কারণেই স্বতন্ত্র৷ একে তো করোনার কামড়ে পুজোর পনেরো আনাই মাটি। তাছাড়া আরেকটা ব্যাপারও রয়েছে। এবার আর সাতদিন নয়, মহালয়ার পাক্কা ৩৫ দিন পর আসছে দুর্গাপুজোর ষষ্ঠী৷ ভদ্রমশাই বেঁচে থাকলে হয়ত বাণীকুমারের লেখাটা একটু পালটে নিয়ে বলতেনঃ "কার্তিকের হেমন্তপ্রাতে সেজে উঠেছে আলোকমঞ্জির ..."। এই সৃষ্টিছাড়া কাণ্ডের গোড়াটা খুঁজতে গিয়ে বিগত বছরগুলোর মহালয়া আর পুজোর দিনক্ষণ তল্লাশ করতে বসলাম। পুরনো ক্যালেন্ডারগুলোর ধূলো ঝেড়ে, কিছু আবার বইয়ের মলাট থেকে খুলে নিয়ে শেষ পাঁচ বছরের তারিখগুলো দাঁড়ালো এইরকমঃ 



মহালয়া আর ষষ্ঠী দুটোই প্রতি বছর ১১ দিন করে এগিয়ে আসছে৷ আর এক বা দু বছর অন্তর লাফ দিয়ে ১৮ বা ১৯ দিন পিছিয়ে যাচ্ছে৷ ২০১৭ সালে মহালয়া আর ষষ্ঠী, দুটোই ১১ দিন এগিয়েছে৷ আবার ২০১৮ সালে দুটোই ১৯ দিন পিছিয়েছে৷ বেশীরভাগ সময় দুটো একইরকমভাবে এগোয় বা পেছোয় বলে ঐ সাতদিনের গ্যাপটা বজায় থাকে৷ যদিও ২০১৯ এ গ্যাপটা দাঁড়িয়েছিল ৬ দিনে৷ কিন্তু এই বছর তাদের গাঁটছড়া ভেঙেছে। মহালয়া এগারো দিন এগিয়েছে ঠিকই, কিন্তু ষষ্ঠী ১৮ দিন পিছিয়ে গেছে৷ তাহলে মহালয়া আর ষষ্ঠীর ব্যবধান দাঁড়ালো ১১+১৮+৬=৩৫৷ অঙ্ক নাহয় মিলল, কিন্তু আঠেরো আর এগারোর গেরোটা ছাড়ানো যায় কিভাবে? হিন্দুধর্মের অন্যান্য উৎসবগুলোর দিকে যদি তাকাই তাহলে দেখছি সেখানেও ঐ এগারো আর আঠেরোয় চু কিৎ কিৎ খেলা চলছে৷ শুধু হিন্দুধর্ম নয়, বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের ক্ষেত্রেও এই একই ব্যাপার দেখা যাবে৷ উদাহরণ হিসেবে জন্মাষ্টমী আর বুদ্ধপুর্ণিমার তারিখগুলোয় চোখ বুলানো যাকঃ



খেয়াল করার বিষয়, যে এগারো দিনের পিছানোর কথা বলেছিলাম সেটা কখনও দশ বা বারো দিন হচ্ছে৷ আবার ঐ এক বা দু বছর অন্তর লাফটাও আঠারো বা উনিশের জায়গায় কখনও সখনও কুড়ি দিনের হচ্ছে৷ এক দু দিনের আগুপিছু নিয়ে পরে ভাবা যাবে৷ আপাতত এগারো আর আঠারো নিয়ে পড়া যাক৷ আচ্ছা একটা কথা বোধহয় বললাম। হিন্দুধর্মের সব উৎসবেই ঐ এগারো-আঠেরোর গেরো আছে এই কথাটা পুরোপুরি ঠিক না। এইবছরই তো মহালয়া শুনেই ছাতে লাটাই নিয়ে ছোটার দিন। বিশ্বকর্মা পুজো হিন্দুধর্মের সেই বিরল উত্সবগুলোর মধ্যে একটা, যার তারিখ নির্দিষ্টঃ ১৭ই সেপ্টেম্বর৷ তবে ঐ বলে না " এক্সেপশন প্রুভস দ্য ল এটসেট্রা এটসেট্রা ... হিন্দুধর্ম ছেড়ে এবার যদি একটু ইসলাম ধর্মের তাকাই, তাহলে দেখব ইসলাম ধর্মের পরবগুলোর তারিখও প্রতি বছর ১১ বা ১২ দিন করে এগিয়ে আসছে৷ কিন্তু হিন্দুধর্মের মত ১৮/১৯ দিন পেছানোর ব্যাপারটা নেই৷ ঈদ-উল-ফিতর আর আশুরা বা মহরমের তারিখগুলো দেখে নেওয়া যাকঃ


যেকোন ক্যালেন্ডারেই সময়ের তিনটে একক থাকেঃ দিন, মাস ও বছর৷ এর মধ্যে "দিন" নিয়ে বিতর্ক নেই৷ সূর্য যতক্ষণ পর পর ঠিক মাথার ওপর আসে, সেই সময়ের ব্যবধানটাই হল এক সৌরদিন৷ এক সৌরদিনের দৈর্ঘ্য সমান থাকে না৷ কিন্তু ছয় ঋতুর গড় নিয়ে আমরা গড় সৌরদিন হিসাব করতে পারি। এই গড় সৌরদিনকে ২৪ দিয়ে ভাগ করে ঘন্টা, তারপর সেখান থেকে মিনিট, সেকেন্ড ইত্যাদি পাওয়া যায়৷ নক্ষত্রদিন অর্থাৎ পৃথিবীর নিজের অক্ষের চারদিকে পূর্ণ আবর্তন করতে আসলে যে সময় লাগে তার মাপ ২৪ ঘন্টার চেয়ে মিনিট চারেক কম৷ তবে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে নক্ষত্রদিনের ভূমিকা নেই বলে ওটা নিয়ে আপাতত মাথা ঘামাচ্ছি না৷ এরপর এল মাস৷ দুটো পূর্ণিমা কিংবা দুটো অমাবস্যার মধ্যের গড় ব্যবধান ২৯.৫ দিন৷ আসলে যদিও চাঁদ পৃথিবীর চারদিকে পাক খেতে ২৭ দিন সময় নেয়, কিন্তু ঐ সময়ের মধ্যে পৃথিবী আবার নিজের কক্ষপথ বরাবর খানিক এগিয়ে যায়। তাই পরের পূর্ণিমা আসতে আরো আড়াই দিন লেগে যায়৷ তাহলে এক চান্দ্রমাসের দৈর্ঘ্য দাঁড়াল ২৯.৫ দিন৷ ভগ্নাংশ নিয়ে কাজ করা অসুবিধে বলে একমাস ২৯ দিন তো  পরের মাস ৩০ দিন এইভাবে ধরা হয়৷ এভাবে যদি বারোটা মাস পার করা যায় তাহলে আবার আগের আবহাওয়া ফিরে আসে৷ সুতরাং বারোটা চান্দ্রমাস বা এক চান্দ্রবছরের মাপ হল গিয়ে ১২X২৯.৫=৩৫৪ দিন৷ এইভাবে যে ক্যালেন্ডার তৈরী হল তাকে আমরা বলি চান্দ্র ক্যালেন্ডার (lunar calendar)৷

কিন্তু এই চান্দ্রবছর ক্রান্তীয় বছর নয়৷ ঋতুচক্র সম্পূর্ণ হওয়ার ১১ দিন আগেই চান্দ্রবছর শেষ হয়ে যায়৷ মানুষ যতদিন যাযাবর ছিল, পশুপালন করত, ততদিন চান্দ্রবছর নিয়ে সমস্যা ছিল না৷ বরং তীপ্র তাপদাহ এড়ানোর জন্য রাত্রে পাড়ি দিতে হত বলে চাঁদের গুরুত্ব ছিল অনেক বেশী। তাছাড়া আকাশে সূর্যের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করার চেয়ে চাঁদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করা তুলনামূলকভাবে সহজ ছিল৷ কিন্তু মানুষ যত থিতু হতে শুরু করল, চাষবাস শিখল, তত চাঁদ দেখে দিনগোণার অসুবিধেগুলো প্রকট হতে শুরু করল৷ ফসল বোনা, ফসল তোলা এ সবই হয় ঋতু মেনে৷ দূরের নক্ষত্রমণ্ডলীর প্রেক্ষাপটে সূর্যের ঘুরে আসতে যে সওয়া ৩৬৫ দিন সময় লাগে ততদিনে সেটাও সেকালের জ্যোতির্বিদরা গণনা করে ফেলেছেন৷ তাই বছরের মাপ আর ঋতুচক্রের গরমিল মেটাতে প্রতি দ্বিতীয় বা তৃতীয় বছরে একটা করে মাস ঢুকিয়ে দেওয়া হল৷ ফলতঃ সেই বছরে দিনের সংখ্যা হল ৩৮৩ (যদি বাড়তি মাসের দৈর্ঘ্য ২৯ দিন হয়) বা ৩৮৪ (যদি বাড়তি মাসের দৈর্ঘ্য ৩০ দিন হয়)৷ তাহলে পাঁচবছরের বছরের দিনসংখ্যার গড় হয়ে গেলঃ (৩৫৪+৩৮৩+৩৫৪+৩৫৪+৩৮৩)÷৫=৩৬৫.৮ বছর৷ অর্থাৎ ক্রান্তীয় বছরের অনেকটা কাছাকাছি৷ এইরকম ক্যালেন্ডারকে আমরা বলি সৌরচান্দ্র ক্যালেন্ডার (lunisolar calendar)৷

ওপরের দুধরণের ক্যালেন্ডারের মধ্যে চান্দ্র ক্যালেন্ডার ব্যবহার করেন মুসলিমরা, তাঁদের ধর্মীয় রীতিনীতি পালনের জন্য৷ আর সৌরচান্দ্র ক্যালেন্ডার দেখে পূজো পার্বণ ঠিক করেন হিন্দু, বৌদ্ধ, ইহুদি রা৷ কিন্তু জাতিধর্ম নির্বিশেষে আমরা কাজের জন্য যে ক্যালেন্ডার ব্যবহার করি তা উপরোক্ত কোন ভাগেই পড়েনা৷ হালখাতার সময় মিষ্টির প্যাকেটের সঙ্গে যেটা নিয়ে বাড়ি ফিরি সেই বাংলা ক্যালেন্ডারই হোক বা ভুলভাবে যাকে "ইংরেজি ক্যালেন্ডার" বলি সেই গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার, যেটা দেখে আমি লেখার শুরুতেই বিভিন্ন ধর্মীয় উৎসবের তারিখগুলো লিখেছি - এগুলো সবই হল সৌর ক্যালেন্ডারের (solar calendar) উদাহরণ৷ এখানে চাঁদের কোন ভূমিকা নেই৷ এই ক্যালেন্ডারে বছরের দৈর্ঘ্য ৩৬৫ দিন৷ পৃথিবীর পরিক্রমণ কালের সঙ্গে মেলানোর জন্য লিপ ইয়ার দিয়ে ম্যানেজ করা হয়৷ আর ৩৬৫ দিনকে ভাগ করে দেওয়া হয় বারোটা মাসের মধ্যে৷ ফলে মাসের দৈর্ঘ্য দাঁড়িয়ে গেল ৩০ বা ৩১ দিন৷ ফেব্রুয়ারি টা ব্যতিক্রম৷

ইসলামিক চান্দ্র ক্যালেন্ডার বা হিজরি ক্যালেন্ডারের মহরম মাসের দশ তারিখে আশুরা পালিত হয়৷ যেহেতু চান্দ্রবছর সৌরবছরের ১১ দিন আগেই শেষ হয়ে যায়, তাই মহরম মাসের দশ তারিখটা গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারে প্রতি বছর ১১ দিন করে এগিয়ে আসে। হিন্দু বা বৌদ্ধদের তিথিগুলোর ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার ঘটে। কিন্তু সেগুলো যেহেতু সৌরচান্দ্র ক্যালেন্ডার মান্য করে তাই যে যে বছর একটা ২৯ দিনের বাড়তি মাস ঢুকে যায়, সেই সেই বছর একটা তিথি ১১ দিন এগনোর পাশাপাশি ২৯ দিন পিছিয়ে যায়। তাহলে কাটাকুটি করে কত পেছালো? ২৯-১১=১৮। হিন্দু সৌরচান্দ্র ক্যালেন্ডারে এই বাড়তি মাসটাকে বলা হয় অধিক মাস বা মল মাস। এবার অধিক মাসটা কোন বছরে ঢুকবে তা কি পঞ্জিকাকারদের খেয়ালখুশির ওপর নির্ভর করে? একেবারেই না। তারও একটা নির্দিষ্ট নিয়ম আছে। বৌদ্ধ বা ইহুদিদের ক্যালেন্ডারে অধিক মাস ঢোকানো হয় একটা নির্দিষ্ট মাসের পর। হিন্দু ক্যালেন্ডারের ব্যাপারটা একটু অন্যরকম। 


আমাদের দেয়ালে বা কব্জিতে যেমন একটা ঘড়ি আছে, তেমনি আকাশেও একটা ঘড়ি আছে। দেয়াল বা কব্জির ঘড়ি ২৪ ঘন্টার সময় মাপে, আর আকশের ঘড়ি মাপে ১ বছর। সেই ঘড়ির কাঁটা হল সূর্য আর সংখ্যা গুলো হল বারোটা নক্ষত্র মণ্ডলী, যাদের আমরা রাশিচক্র বলে থাকি। সূর্য এক মাস করে এক একটা রাশির ঘরে থাকে। এই রাশিচক্র কে ব্যবহার করে একশ্রেণির লোক মানুষকে প্রতারিত করে ব্যবসা চালায় এই বলে যে রাশিচক্রের ওপর নাকি মানুষের ভাগ্য নির্ভর করে। অনেক উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তি এইসমস্ত বুজরুকিতে বিশ্বাসও করেন। বাস্তবে প্রাচীনযুগে কাল ও দিক নির্ণয় এবং জ্যোতির্বিজ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে এই রাশিচক্রের কল্পনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেও ভাগ্যের সঙ্গে এগুলোর কোন যোগাযোগ নেই। সে কথা থাক, ঐ যে বললাম সূর্য একমাস করে এক একটা রাশির ঘরে থাকে, এই মাস হল সৌরবছরের মাস, যার দৈর্ঘ্য চান্দ্রমাসের থেকে বেশী। অর্থাৎ একটা সৌরমাসের মধ্যে একটা গোটা চান্দ্রমাস ঢুকে যেতে পারে। সেরকম হলে ঐ চান্দ্রমাসে সূর্য একটা রাশিতেই থেকে যাবে, অন্য রাশিতে যাবেনা। সেই মাসটাকেই বলা হবে অধিক মাস। এইবছর হিন্দু ক্যালেন্ডারের ভাদ্র মাসের পরের মাসটা ১৮ই সেপ্টেম্বর থেকে ১৬ই অক্টোবর এইরকমই একটা অধিক মাস। এর নাম হল অধিক আশ্বিন। অধিক আশ্বিনের পরে আসবে আসল আশ্বিন, যে মাসে এবার দুর্গাপুজো হবে। বাংলা সৌরক্যালেন্ডারে অবশ্য ততদিনে অশ্বিন পেরিয়ে কার্তিক মাস চলে আসবে। তাহলে ১১ আর ১৮র গেরোটা বোঝা গেল। 

বাকি রইল ১-২ দিনের তারতম্য। অধিক মাস যদি ৩০ দিনের হয় তাহলে ১৮ দিনের বদলে ১৯ দিন পিছবে। আবার গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের বছরটা অধিবর্ষ হলে একটা তিথি ১১ দিনের বদলে ১২ দিন এগোবে। সুতরাং এইবছর হিন্দু সৌরচান্দ্র ক্যালেন্ডারে দুটো আশ্বিন মাসঃ একটা অধিক আশ্বিন, আরেকটা আসল বা নিজ আশ্বিন। কিন্তু দুর্গাপুজো যদি নিজ আশ্বিনে না হয়ে অধিক আশ্বিনে হত তাহলেই তো আর এই মহালয়ার পর একমাস অপেক্ষা করার কারণ থাকত না। এর কারণ অবশ্য এই কুসংস্কার যে অধিক মাসটা মলমাস, এই মাসে কোন শুভ অনুষ্ঠান করতে নেই। বাস্তবে যদিও আমরা দেখলাম যে "অধিক মাস" এর উদ্দেশ্য সৌরচান্দ্র ক্যালেন্ডারের সঙ্গে ঋতুচক্রের সামঞ্জস্যবিধান। এর সঙ্গে মানুষের শুভ অশুভের কোন সম্পর্ক নেই।

এবার বিশ্বকর্মা পুজোর কথায় আসি। হিন্দুধর্মের অন্যান্য উৎসবের মত বিশ্বকর্মা পুজো সৌরচান্দ্র ক্যালেন্ডার অনুযায়ী পালিত হয় না। সূর্য যখন সিংহ রাশি ছেড়ে কন্যা রাশিতে প্রবেশ করে সেই দিনটাই বিশ্বকর্মা পুজোর জন্য নির্ধারিত। এবং এই দিনটা গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারে ১৭ই সেপ্টেম্বরের আশেপাশেই পরে। বিশ্বকর্মা শিল্প-স্থাপত্যের দেবতা। হিন্দুরা যতদিনে কৃষিকাজের পাশাপাশি শিল্পকর্মেও পারদর্শী হতে শুরু করেছিল ততদিনে সম্ভবত আকাশে সূর্যের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করা শিখে গিয়েছিল আর বর্ষ গণনার জন্য সূর্যের গুরুত্বও বুঝেছিল। তাই বিশ্বকর্মা পুজো হয় সৌর ক্যালেন্ডার মেনে। বিশ্বকর্মা পুজোর মতই আরেকটা পুজোও আছে যেটা সৌর ক্যালেন্ডার মান্য করে। কার্তিক পুজো হয় বাংলা কার্তিক মাসের সংক্রান্তিতে অর্থাৎ ৩০শে কার্তিক। গ্রেগোরিয়ান ক্যালেন্ডারে তারিখটা নভেম্বর মাসের ১৬-১৭ নাগাদ পড়ে। অন্য কারো মনে হয় কি না জানি না, কিন্তু আমার তো বিশ্বকর্মা ঠাকুরের মুখের সঙ্গে কার্তিক ঠাকুরের মুখের বেশ মিল লাগে। দুই ভাই বলে দিব্যি চালিয়ে দেওয়া যায়! 

অনেকগুলো ধর্মের উৎসবের তারিখ নিয়ে বকবক করলাম। খ্রিষ্টধর্ম বাদ গেল কেন? ষোড়শ শতাব্দীতে রোমান সম্রাট জুলিয়াস সিজার প্রবর্তিত ক্যালেন্ডারের সংশোধন করেছিলেন পোপ দ্বিতীয় গ্রেগরি। প্রোটেস্টান্টরা গোড়ায় এই ক্যাথলিক সংস্কারকে মানতে পারেনি। ব্রিটেন গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারকে গ্রহণ করেছিল দুশো বছর পরে, অষ্টাদশ শতকে। তবু আমরা এটাকে "ইংরেজি ক্যালেন্ডার" বলে থাকি! সে যাই হোক খ্রিস্টধর্মের উৎসবগুলোর বেশীরভাগই গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী পালিত হয়। তাই বড়দিন হয় প্রতি বছরই ৩১শে ডিসেম্বর। হ্যালোউইনের তারিখ ৩১শে অক্টোবর। তবে কিছু উৎসব আছে, যেমন ইস্টার, যেগুলোর তারিখ হিব্রু সৌরচান্দ্র ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ঠিক হয়। 

শেষ করার আগে একটা কথা বলে রাখা জরুরী। মানুষের আত্মা বলে যদি কিছু থেকেও থাকে তা শারীরিক মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই ধ্বংস হয়ে যায়। দেহের অতীত আত্মা বলে কিছু হয় না। মহালয়ার সকালে গঙ্গার ধারে তর্পণ করলে তা পূর্বপুরুষের কানে পৌঁছানোর কোন সম্ভাবনা নেই। মহিষাসুর বধের কাহিনীর পেছনে যদি কোন সত্যি যুদ্ধের ইতিহাস থেকেও থাকে সেই যুদ্ধের কুশীলবরা সব মানুষই ছিল, কোন দেবতা বা অসুর নয়। নির্ঘন্ট মেনে পুজোআচ্চা পৈতাধারী কিছু লোকের উপার্জনের রাস্তা মাত্র। অমুক ষষ্ঠী, তমুক একাদশী বা গোটা রমজান মাস জুড়ে উপবাসে কোন পুণ্য সঞ্চয় হয় না। নিজ পথে স্থিত থেকে শাসকের প্রতিহিংসার শিকার হওয়া যিশুখ্রিষ্ট বা ইমাম হোসেন অবশ্যই শ্রদ্ধার পাত্র। আজকের যুগে যাঁরা ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়িয়ে ক্ষমতামদমত্ত শাসকের রোষের শিকার হচ্ছেন, যিশুখৃষ্ট বা ইমাম হোসেনের লড়াই থেকে তাঁরা প্রেরণা পেতেই পারেন। কিন্তু যিশুর পুনর্জন্ম যে গাঁজাখুড়ি গপ্পো মাত্র, ইমাম হোসেনের শোকে নিজদেহকে রক্তাক্ত করার পেছনে যে কোন যুক্তি নেই এই কথাগুলো মনে রাখা প্রয়োজন। সমস্ত ধর্মীয় প্রথা যুক্তিহীন অন্ধবিশ্বাসের ওপর প্রতিষ্ঠিত হলেও সেইসব প্রথার দিনক্ষণ কিন্তু ঠিক হয় একদম জ্যোতির্বিজ্ঞানের অঙ্ক মেনেই। 

তথ্যসূত্রঃ অধ্যাপক পলাশ বরণ পালের বিভিন্ন ভাষণ, অনুষ্টুপ পঞ্জিকা সংখ্যা ২০১৬, উইকিপিডিয়া। অনুপ্রেরণায় শ্রীরূপা ঘোষ কুমার।

No comments:

Post a Comment