Thursday, 22 October 2020

বন্ধুত্বের ভাইরাস

 কল্পাণু গল্প "বন্ধুত্বের ভাইরাস", প্রকাশিত হয় শারদীয় কল্পবিশ্ব ২০২০ তে। সম্পূর্ণ গল্পের লিঙ্কঃ 

কল্পবিশ্ব পত্রিকা, শারদীয় ২০২০, কল্পাণু গল্প






Wednesday, 7 October 2020

ব্ল্যাক হোল আর নোবেলঃ অপেক্ষার অবসান

কৃষ্ণগহ্বর (black hole) শব্দটা সংবাদমাধ্যমের কল্যানে আমজনতার কাছে একেবারেই অপরিচিত নয়৷ একশো বছরেরও বেশী সময় ধরে জিনিসটার রহস্য বিজ্ঞানী, কল্পবিজ্ঞান লেখক থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষকে রোমাঞ্চিত করেছে৷ কিন্তু নোবেল পুরস্কারের তালিকায় উঠতে কৃষ্ণগহ্বরের লেগে গেল ২০২০ সাল৷ এবারে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কারের অর্ধেক পাচ্ছেন রবার্ট পেনরোজ৷ তিনি দেখিয়েছেন, কৃষ্ণগহ্বর হল সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ তত্ত্বের অমোঘ ভবিষ্যৎবাণী৷ বাকি অর্ধেক ভাগ করে নিচ্ছেন রেনার্ড গেঞ্জেল এবং আন্দ্রে ঘেজ৷ তাঁরা আকাশগঙ্গা ছায়াপথের কেন্দ্রে একটি অতি ভারী ঘনবস্তু আবিষ্কার করেছেন৷ বলা বাহুল্য ঐ বস্তুটি কৃষ্ণগহ্বর ছাড়া অন্য কিছু হতে পারে না৷ 



ব্ল্যাকহোল নামটা তুলনামূলকভাবে নতুন হলেও ব্ল্যাকহোলের মত কিছু একটা বস্তুর অস্তিত্ত্ব কল্পনা করা হয়েছিল উনবিংশ শতকের আটের দশকে৷ আমরা যদি একটা ঢিলকে ওপর দিকে ছুঁড়ি, সেটা এক সময় নীচে নেমে আসবে৷ যদি আরো জোরে ছুঁড়ি, সেটা আরো ওপরে উঠে আরো একটু দেরিতে মাটিতে পড়বে৷ কিন্তু এতটাও জোরে কি ছুঁড়তে পারি, যাতে করে ঢিলটা আর ফিরে আসবে না, পৃথিবীর অভিকর্ষের মায়া কাটিয়ে মহাশূণ্যে হারিয়ে যাবে? হ্যাঁ পারি, এবং সেই বেগকে বলা হয় মুক্তিবেগ৷ পৃথিবীপৃষ্ঠের ওপর মুক্তিবেগের মান ১১.২ কিমি/সেকেন্ড৷ তো এমন কোন নক্ষত্র যদি থেকে থাকে যার পৃষ্ঠের ওপর মুক্তিবেগ আলোর বেগের চেয়ে বেশী, তাহলে তো সবকিছুই, এমনকি আলোও, আটকে পড়বে ঐ নক্ষত্রের টানে! যদিও সেই কল্পনাকে বাস্তব রূপ দেওয়া যায়নি৷ তারপর ১৯১৫ সালে আইনস্টাইন সাধারণ আপেক্ষিককতার তত্ত্ব ( General Theory of Relativity) বাজারে আনলেন আর সঙ্গে সঙ্গেই সোয়ার্জচাইল্ড একটা নিখুঁত সুষম বৃত্তাকার বস্তুর জন্য আইনস্টাইন সমীকরণের খুব সুন্দর একটা সমাধান বের করে ফেললেন৷ সোয়ার্জচাইল্ডের সমাধানে একটা বিন্দু পাওয়া গেল যেখানে গিয়ে আর পদার্থবিজ্ঞানের কোন জানা নিয়ম কাজ করে না৷ ঐ বিন্দুই হল অনন্যতা (singularity)৷ দেখা গেল অনন্যতাকে ঘিরে ঘটনা দিগন্ত (event horizon) নামে এক বৃত্তাকার তল আছে, যেখান দিয়ে বাইরে থেকে ভেতরে জিনিসপত্র ঢুকবে, কিন্তু ভেতর থেকে কিছু বাইরে বেরোবে না৷ আলোও না৷ পরে আরো অনেক বিজ্ঞানী আইনস্টাইন সমীকরণের সমাধান বের করলেন৷ কেউ ধরলেন ঐ নিখুঁত বৃত্তাকার বস্তুটার ভরের সঙ্গে কিছু আধানও আছে, কেউবা আবার ধরলেন বস্তুটা একটা অক্ষের চারদিকে বনবন করে ঘুরছে৷ মোদ্দাকথা এটাই যে সমাধানগুলো কিছু বিশেষ প্রতিসাম্যের (symmetry) উপস্থিতি ধরে নিয়ে করা৷ তা না করলে অরৈখিক (non linear) আর অত্যন্ত জটিল আইনস্টাইন সমীকরণকে বাগ মানানো যেত না৷ কিন্তু ঘটনা হল ঐরকম নিখুঁত প্রতিসম বস্তু তৈরী হওয়া কার্যত অসম্ভব৷ যত দক্ষ কারিগরই হোক, যত ভালো যন্ত্রই থাকুক একদম নিখুঁত গোলক তৈরী করা আদৌ সম্ভব নয়৷ সৌরজগতে যে গ্রহগুলো আছে বা যেসব নক্ষত্রকে আমরা মোটামুটি ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করতে পেরেছি তারা কেউই নিখুঁত গোলক নয়, সুষম তো নয়ই৷ যাঁরা ভগবান টগবানে বিশ্বাস করেন, ইদানীং তাঁরাও বলেন যে ভগবানের কোন সৃষ্টিই আর যাই হোক, "পারফেক্ট" নয়৷ একদম নিখুঁত প্রতিসাম্য অতএব নেহাত দুর্ঘটনা ছাড়া ঘটা সম্ভব নয়৷ তাই যদি হয়, তো ব্ল্যাকহোল বলেও আসলে কিছু হয় না৷ সোয়ার্জচাইল্ড ও অন্যান্যদের নিখুঁত গোলকের কল্পনা থেকে অঙ্ক কষেই ঐরকম বিজাতীয় বস্তু পাওয়া যাচ্ছে৷ 

অন্তত ষাটের দশক অবধি বিজ্ঞানীরা এটাই মনে করতেন৷ তারপর রবার্ট পেনরোজ এবং স্টিফেন হকিং এর অনন্যতা উপপাদ্য (singularity theorem) তাঁদের নিশ্চিন্তির ঘুমে ব্যাঘাত ঘটাল৷ (হকিং জীবিত থাকলে নিশ্চিতভাবেই নোবেল পুরস্কারে ভাগ বসাতে হাজির হয়ে যেতেন) পেনরোজ এবং হকিং দেখালেনঃ যদি মহাকর্ষই একমাত্র চালিকাশক্তি হয় আর আইনস্টানের সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ মহাকর্ষের সঠিক ব্যাখ্যা হয় আর পদার্থের চরিত্র বিদঘুটে (যেমন বিকর্ষণধর্মী মহাকর্ষ) কিছু না হয় তাহলে অনন্যতা অবশ্যম্ভাবী৷ সংশ্লিষ্ট তারাটির গঠনে নিখুঁত প্রতিসাম্য থাকল কি না তাতে কিছু আসে যায় না৷ 

আকাশগঙ্গা ছায়াপথ

পেনরোজ, হকিং অঙ্ক কষে কৃষ্ণগহ্বরের অস্তিত্বকে নিশ্চিৎ করেছিলেন৷ কৃষ্ণগহ্বরের উপস্থিতির প্রত্যক্ষ প্রমাণ দিলেন রেনার্ড গেঞ্জেল এবং আন্দ্রে ঘেজের নেতৃত্বে দুদল গবেষক৷ এখন আমরা কোন বস্তুকে দেখতে পাই কারণ সেই বস্তুতে প্রতিফলিত হয়ে আলো আমাদের চোখে আসে৷ দৃশ্যমান আলো না হলেও এক্স রে ব্যবহার করে শরীরের ভেতরের হাড়ের ছবি বা ইনফ্রা রেড ক্যামেরায় অন্ধকারেও কোন প্রাণীর ছবি তোলা যায়৷ কিন্তু ব্ল্যাকহোল থেকে যেহেতু কোন বিকিরণই বাইরে আসে না, তাই তাকে সরাসরি দেখা সম্ভব নয়৷ কিন্তু ব্ল্যাকহোলের আশেপাশের বস্তুগুলোর গতিবিধি থেকে ব্ল্যাকহোলের অস্তিত্ব জানা সম্ভব৷ বহুদিন আগেই ধনুরাশির মধ্যের একটি তারা Sagittarius A* থেকে তীব্র রেডিও সিগন্যাল পাওয়া গেছিল এবং সেই তারাটি যে আকাশগঙ্গা ছায়াপথের কেন্দ্রস্থলে আছে তাও বোঝা গেছিল৷ আমাদের ছায়াপথটা একটা জিলিপির মত৷ যে জিলিপির এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে আলো পৌঁছতে এক লক্ষ বছর সময় লেগে যায়৷ গেঞ্জেল এবং ঘেজের নেতৃত্বে গবেষকরা দেখলেন ঐ জিলিপির একদম কেন্দ্রের আশেপাশের কিছু নক্ষত্র প্রচণ্ড গতিতে কেন্দ্রকে প্রদক্ষিণ করছে৷ মেলা বা সার্কাসে একটা খেলা দেখেছিঃ একটা বৃত্তাকার ঘরের ভেতরের দেয়ালের মধ্যে কয়েকজন বাইক আরোহী প্রচণ্ড গতিতে ছোটাছুটি করছে, কিন্তু কেউ কারোকে ধাক্কা মারছে না৷ খেলাটার নাম ছিল মৃত্যুকূপ৷ ছায়াপথের কেন্দ্রের তারাগুলোর আচরণও ঐরকম৷ আর সূর্যের মত তারাগুলো কেন্দ্র থেকে অনেক দূরে, জিলিপির প্যাঁচের ওপর বসে হেলেদুলে কেন্দ্রকে প্রদক্ষিণ করছে৷ সার্কাসের তাঁবুর চারদিকে হেঁটে হেঁটে ঘোরার মত৷ S2 নামে একটা কেন্দ্রস্থলের একটা তারা মাত্র ১৬ বছরে ছায়াপথের কেন্দ্রকে প্রদক্ষিণ করে৷ অন্যদিকে আমাদের সূর্য, যে কেন্দ্র থেকে যার দূরত্ব ছাব্বিশ হাজার আলোকবর্ষ, তার এক পাক ঘুরতে সময় লাগে ২০ কোটি বছর! ঐ সময়টাকে যদি একবছর বলি, তাহলে বলবঃ "এই তো গেল বছর টিরেনোসরাসটা ঐ পুকুরপারে ডিম পেড়ে গেল৷" এখন সৌরজগতের ক্ষেত্রেও আমরা দেখেছি সূর্যের কাছের গ্রহগুলো যেমন বুধ, শুক্র এরা পাক খায় খুব তাড়াতাড়ি৷ আবার যত সৌরজগতের বাইরের দিকে যাওয়া যায় তত প্রদক্ষিণকাল বাড়তে থাকে৷ বুধের এক বছর হয় ৮৮ দিনে, বামন গ্রহ প্লুটোর ৯০ হাজার দিনে৷ এর কারণ সৌরজগতের প্রায় পুরো ভরটাই কেন্দ্রে সূর্যের মধ্যে জমা হয়ে আছে৷ যে গ্রহ সূর্যের যত কাছে, তার ওপর সূর্যের টান তত বেশী আর তার প্রদক্ষিণের গতিও তত বেশী৷ ছায়াপথের ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার৷ নক্ষত্রগুলোর গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করে বোঝা গেল আকাশগঙ্গা ছায়াপথের ঠিক কেন্দ্রে সূর্যের ভরের চল্লিশ লক্ষগুণ ভারী কোন অদৃশ্য বস্তু অর্থাৎ ব্ল্যাক হোল রয়েছে৷ এত ভারী ব্ল্যাক হোলের সৃষ্টি কিভাবে হল সে ব্যাপারে অবশ্য বিজ্ঞানীরা এখনও নিশ্চিৎ নন৷

ইভেন্ট হরাইজন টেলিস্কোপে তোলা ব্ল্যাকহোলের ছবি

একটা প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক৷ পেনরোজের অনন্যতা উপপাদ্য তো সেই ষাটের দশকের ব্যাপার৷ আর রেনার্ড গেঞ্জেল, আন্দ্রে ঘেজদের পর্যবেক্ষণ নব্বইএর দশকের৷ তাহলে নোবেল পুরস্কার আসতে এত দেরি হল কেন? আসলে কোন প্রত্যক্ষ পরীক্ষালব্ধ প্রমাণ ছাড়া শুধুমাত্র তাত্ত্বিক গবেষণার জন্য নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয় না৷ বছরখানেক আগে সাড়ে পাঁচ কোটি আলোকবর্ষ দূরের M87 ছায়াপথের কেন্দ্রীয় কৃষ্ণগহ্বরের ছবি তুলেছে ইভেন্ট হরাইজন টেলিস্কোপ৷ ২০১৫ তে দুই কৃষ্ণগহ্বরেরর সংঘর্ষের খবরও মিলেছে মহাকর্ষীয় তরঙ্গের হাত ধরে৷ কৃষ্ণগহ্বর এখন আর তত্ত্ব আর অঙ্কের বিষয় নয়, ঘোর বাস্তব৷

২০১১ সালে মহাবিশ্বের ক্রমবর্ধমান প্রসারণের হার (Accelerated Exapasion of the Universe), ২০১৭ তে মহাকর্ষীয় তরঙ্গ (Gravitational Waves), ২০১৯ এ বিশ্বতত্ত্ব ( Cosmology) ও বহির্গ্রহ (Exoplanet) আর ২০২০ তে কৃষ্ণগহ্বর - একবিংশ শতকের দ্বিতীয় দশকে পদার্থবিজ্ঞানের নোবেল পুরস্কারের প্রায় অর্ধেক এল আছে মহাকাশ থেকে৷ এমন কি ২০১৩ তে হিগস বোসনের (Higgs Boson) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে মহাবিশ্বের রহস্য সমাধানে৷ শেষ করার আগে একজন মানুষের কথা বলে যাই৷ পঞ্চাশের দশকে কলকাতার Indian Association for the Cultivation of Science এর এক গবেষক, প্রচণ্ড প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে বসে একটা পেপার লিখলেন৷ সেই পেপারের উপপাদ্য একটা সমীকরণ, যা এখন জেনারেল রিলেটিভিটির যেকোন টেক্সটবই য়ে অবশ্যপাঠ্য৷ গবেষকটির নাম অমলকুমার রায়চৌধুরী, একেআর নামেই যিনি সমধিক পরিচিত৷ রায়চৌধুরী সমীকরণের ওপর ভিত্তি করেই হকিং ও পেনরোজ তাঁদের অনন্যতা উপপাদ্যে উপনীত হন৷ 

সত্যেন দত্ত থাকলে হয়ত লিখতেনঃ
"অন্ধকূপের আগল ভাঙিল বাঙালীর উপপাদে,
বিধাতার কাজ সাধিবে বাঙালী ধাতার আশীর্বাদে৷"
অমলকুমার রায়চৌধুরী


 

Thursday, 17 September 2020

এগারোর গেরো

দুদিন বাদেই মহালয়া৷ মহালয়ার শাস্ত্রীয় তাৎপর্য যাই হোক, বাঙালীর কাছে মহালয়া মানে ভোর চারটেয় উঠে রেডিওতে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রর মহিষাসুরমর্দিনী শোনা আর হিসেব কষে দেখে নেওয়া, ঠিক সাতদিন বাদেই পুজোর ঢাকে কাঠি পড়বে। এবারের পুজো নানা কারণেই স্বতন্ত্র৷ একে তো করোনার কামড়ে পুজোর পনেরো আনাই মাটি। তাছাড়া আরেকটা ব্যাপারও রয়েছে। এবার আর সাতদিন নয়, মহালয়ার পাক্কা ৩৫ দিন পর আসছে দুর্গাপুজোর ষষ্ঠী৷ ভদ্রমশাই বেঁচে থাকলে হয়ত বাণীকুমারের লেখাটা একটু পালটে নিয়ে বলতেনঃ "কার্তিকের হেমন্তপ্রাতে সেজে উঠেছে আলোকমঞ্জির ..."। এই সৃষ্টিছাড়া কাণ্ডের গোড়াটা খুঁজতে গিয়ে বিগত বছরগুলোর মহালয়া আর পুজোর দিনক্ষণ তল্লাশ করতে বসলাম। পুরনো ক্যালেন্ডারগুলোর ধূলো ঝেড়ে, কিছু আবার বইয়ের মলাট থেকে খুলে নিয়ে শেষ পাঁচ বছরের তারিখগুলো দাঁড়ালো এইরকমঃ 



মহালয়া আর ষষ্ঠী দুটোই প্রতি বছর ১১ দিন করে এগিয়ে আসছে৷ আর এক বা দু বছর অন্তর লাফ দিয়ে ১৮ বা ১৯ দিন পিছিয়ে যাচ্ছে৷ ২০১৭ সালে মহালয়া আর ষষ্ঠী, দুটোই ১১ দিন এগিয়েছে৷ আবার ২০১৮ সালে দুটোই ১৯ দিন পিছিয়েছে৷ বেশীরভাগ সময় দুটো একইরকমভাবে এগোয় বা পেছোয় বলে ঐ সাতদিনের গ্যাপটা বজায় থাকে৷ যদিও ২০১৯ এ গ্যাপটা দাঁড়িয়েছিল ৬ দিনে৷ কিন্তু এই বছর তাদের গাঁটছড়া ভেঙেছে। মহালয়া এগারো দিন এগিয়েছে ঠিকই, কিন্তু ষষ্ঠী ১৮ দিন পিছিয়ে গেছে৷ তাহলে মহালয়া আর ষষ্ঠীর ব্যবধান দাঁড়ালো ১১+১৮+৬=৩৫৷ অঙ্ক নাহয় মিলল, কিন্তু আঠেরো আর এগারোর গেরোটা ছাড়ানো যায় কিভাবে? হিন্দুধর্মের অন্যান্য উৎসবগুলোর দিকে যদি তাকাই তাহলে দেখছি সেখানেও ঐ এগারো আর আঠেরোয় চু কিৎ কিৎ খেলা চলছে৷ শুধু হিন্দুধর্ম নয়, বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের ক্ষেত্রেও এই একই ব্যাপার দেখা যাবে৷ উদাহরণ হিসেবে জন্মাষ্টমী আর বুদ্ধপুর্ণিমার তারিখগুলোয় চোখ বুলানো যাকঃ



খেয়াল করার বিষয়, যে এগারো দিনের পিছানোর কথা বলেছিলাম সেটা কখনও দশ বা বারো দিন হচ্ছে৷ আবার ঐ এক বা দু বছর অন্তর লাফটাও আঠারো বা উনিশের জায়গায় কখনও সখনও কুড়ি দিনের হচ্ছে৷ এক দু দিনের আগুপিছু নিয়ে পরে ভাবা যাবে৷ আপাতত এগারো আর আঠারো নিয়ে পড়া যাক৷ আচ্ছা একটা কথা বোধহয় বললাম। হিন্দুধর্মের সব উৎসবেই ঐ এগারো-আঠেরোর গেরো আছে এই কথাটা পুরোপুরি ঠিক না। এইবছরই তো মহালয়া শুনেই ছাতে লাটাই নিয়ে ছোটার দিন। বিশ্বকর্মা পুজো হিন্দুধর্মের সেই বিরল উত্সবগুলোর মধ্যে একটা, যার তারিখ নির্দিষ্টঃ ১৭ই সেপ্টেম্বর৷ তবে ঐ বলে না " এক্সেপশন প্রুভস দ্য ল এটসেট্রা এটসেট্রা ... হিন্দুধর্ম ছেড়ে এবার যদি একটু ইসলাম ধর্মের তাকাই, তাহলে দেখব ইসলাম ধর্মের পরবগুলোর তারিখও প্রতি বছর ১১ বা ১২ দিন করে এগিয়ে আসছে৷ কিন্তু হিন্দুধর্মের মত ১৮/১৯ দিন পেছানোর ব্যাপারটা নেই৷ ঈদ-উল-ফিতর আর আশুরা বা মহরমের তারিখগুলো দেখে নেওয়া যাকঃ


যেকোন ক্যালেন্ডারেই সময়ের তিনটে একক থাকেঃ দিন, মাস ও বছর৷ এর মধ্যে "দিন" নিয়ে বিতর্ক নেই৷ সূর্য যতক্ষণ পর পর ঠিক মাথার ওপর আসে, সেই সময়ের ব্যবধানটাই হল এক সৌরদিন৷ এক সৌরদিনের দৈর্ঘ্য সমান থাকে না৷ কিন্তু ছয় ঋতুর গড় নিয়ে আমরা গড় সৌরদিন হিসাব করতে পারি। এই গড় সৌরদিনকে ২৪ দিয়ে ভাগ করে ঘন্টা, তারপর সেখান থেকে মিনিট, সেকেন্ড ইত্যাদি পাওয়া যায়৷ নক্ষত্রদিন অর্থাৎ পৃথিবীর নিজের অক্ষের চারদিকে পূর্ণ আবর্তন করতে আসলে যে সময় লাগে তার মাপ ২৪ ঘন্টার চেয়ে মিনিট চারেক কম৷ তবে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে নক্ষত্রদিনের ভূমিকা নেই বলে ওটা নিয়ে আপাতত মাথা ঘামাচ্ছি না৷ এরপর এল মাস৷ দুটো পূর্ণিমা কিংবা দুটো অমাবস্যার মধ্যের গড় ব্যবধান ২৯.৫ দিন৷ আসলে যদিও চাঁদ পৃথিবীর চারদিকে পাক খেতে ২৭ দিন সময় নেয়, কিন্তু ঐ সময়ের মধ্যে পৃথিবী আবার নিজের কক্ষপথ বরাবর খানিক এগিয়ে যায়। তাই পরের পূর্ণিমা আসতে আরো আড়াই দিন লেগে যায়৷ তাহলে এক চান্দ্রমাসের দৈর্ঘ্য দাঁড়াল ২৯.৫ দিন৷ ভগ্নাংশ নিয়ে কাজ করা অসুবিধে বলে একমাস ২৯ দিন তো  পরের মাস ৩০ দিন এইভাবে ধরা হয়৷ এভাবে যদি বারোটা মাস পার করা যায় তাহলে আবার আগের আবহাওয়া ফিরে আসে৷ সুতরাং বারোটা চান্দ্রমাস বা এক চান্দ্রবছরের মাপ হল গিয়ে ১২X২৯.৫=৩৫৪ দিন৷ এইভাবে যে ক্যালেন্ডার তৈরী হল তাকে আমরা বলি চান্দ্র ক্যালেন্ডার (lunar calendar)৷

কিন্তু এই চান্দ্রবছর ক্রান্তীয় বছর নয়৷ ঋতুচক্র সম্পূর্ণ হওয়ার ১১ দিন আগেই চান্দ্রবছর শেষ হয়ে যায়৷ মানুষ যতদিন যাযাবর ছিল, পশুপালন করত, ততদিন চান্দ্রবছর নিয়ে সমস্যা ছিল না৷ বরং তীপ্র তাপদাহ এড়ানোর জন্য রাত্রে পাড়ি দিতে হত বলে চাঁদের গুরুত্ব ছিল অনেক বেশী। তাছাড়া আকাশে সূর্যের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করার চেয়ে চাঁদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করা তুলনামূলকভাবে সহজ ছিল৷ কিন্তু মানুষ যত থিতু হতে শুরু করল, চাষবাস শিখল, তত চাঁদ দেখে দিনগোণার অসুবিধেগুলো প্রকট হতে শুরু করল৷ ফসল বোনা, ফসল তোলা এ সবই হয় ঋতু মেনে৷ দূরের নক্ষত্রমণ্ডলীর প্রেক্ষাপটে সূর্যের ঘুরে আসতে যে সওয়া ৩৬৫ দিন সময় লাগে ততদিনে সেটাও সেকালের জ্যোতির্বিদরা গণনা করে ফেলেছেন৷ তাই বছরের মাপ আর ঋতুচক্রের গরমিল মেটাতে প্রতি দ্বিতীয় বা তৃতীয় বছরে একটা করে মাস ঢুকিয়ে দেওয়া হল৷ ফলতঃ সেই বছরে দিনের সংখ্যা হল ৩৮৩ (যদি বাড়তি মাসের দৈর্ঘ্য ২৯ দিন হয়) বা ৩৮৪ (যদি বাড়তি মাসের দৈর্ঘ্য ৩০ দিন হয়)৷ তাহলে পাঁচবছরের বছরের দিনসংখ্যার গড় হয়ে গেলঃ (৩৫৪+৩৮৩+৩৫৪+৩৫৪+৩৮৩)÷৫=৩৬৫.৮ বছর৷ অর্থাৎ ক্রান্তীয় বছরের অনেকটা কাছাকাছি৷ এইরকম ক্যালেন্ডারকে আমরা বলি সৌরচান্দ্র ক্যালেন্ডার (lunisolar calendar)৷

ওপরের দুধরণের ক্যালেন্ডারের মধ্যে চান্দ্র ক্যালেন্ডার ব্যবহার করেন মুসলিমরা, তাঁদের ধর্মীয় রীতিনীতি পালনের জন্য৷ আর সৌরচান্দ্র ক্যালেন্ডার দেখে পূজো পার্বণ ঠিক করেন হিন্দু, বৌদ্ধ, ইহুদি রা৷ কিন্তু জাতিধর্ম নির্বিশেষে আমরা কাজের জন্য যে ক্যালেন্ডার ব্যবহার করি তা উপরোক্ত কোন ভাগেই পড়েনা৷ হালখাতার সময় মিষ্টির প্যাকেটের সঙ্গে যেটা নিয়ে বাড়ি ফিরি সেই বাংলা ক্যালেন্ডারই হোক বা ভুলভাবে যাকে "ইংরেজি ক্যালেন্ডার" বলি সেই গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার, যেটা দেখে আমি লেখার শুরুতেই বিভিন্ন ধর্মীয় উৎসবের তারিখগুলো লিখেছি - এগুলো সবই হল সৌর ক্যালেন্ডারের (solar calendar) উদাহরণ৷ এখানে চাঁদের কোন ভূমিকা নেই৷ এই ক্যালেন্ডারে বছরের দৈর্ঘ্য ৩৬৫ দিন৷ পৃথিবীর পরিক্রমণ কালের সঙ্গে মেলানোর জন্য লিপ ইয়ার দিয়ে ম্যানেজ করা হয়৷ আর ৩৬৫ দিনকে ভাগ করে দেওয়া হয় বারোটা মাসের মধ্যে৷ ফলে মাসের দৈর্ঘ্য দাঁড়িয়ে গেল ৩০ বা ৩১ দিন৷ ফেব্রুয়ারি টা ব্যতিক্রম৷

ইসলামিক চান্দ্র ক্যালেন্ডার বা হিজরি ক্যালেন্ডারের মহরম মাসের দশ তারিখে আশুরা পালিত হয়৷ যেহেতু চান্দ্রবছর সৌরবছরের ১১ দিন আগেই শেষ হয়ে যায়, তাই মহরম মাসের দশ তারিখটা গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারে প্রতি বছর ১১ দিন করে এগিয়ে আসে। হিন্দু বা বৌদ্ধদের তিথিগুলোর ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার ঘটে। কিন্তু সেগুলো যেহেতু সৌরচান্দ্র ক্যালেন্ডার মান্য করে তাই যে যে বছর একটা ২৯ দিনের বাড়তি মাস ঢুকে যায়, সেই সেই বছর একটা তিথি ১১ দিন এগনোর পাশাপাশি ২৯ দিন পিছিয়ে যায়। তাহলে কাটাকুটি করে কত পেছালো? ২৯-১১=১৮। হিন্দু সৌরচান্দ্র ক্যালেন্ডারে এই বাড়তি মাসটাকে বলা হয় অধিক মাস বা মল মাস। এবার অধিক মাসটা কোন বছরে ঢুকবে তা কি পঞ্জিকাকারদের খেয়ালখুশির ওপর নির্ভর করে? একেবারেই না। তারও একটা নির্দিষ্ট নিয়ম আছে। বৌদ্ধ বা ইহুদিদের ক্যালেন্ডারে অধিক মাস ঢোকানো হয় একটা নির্দিষ্ট মাসের পর। হিন্দু ক্যালেন্ডারের ব্যাপারটা একটু অন্যরকম। 


আমাদের দেয়ালে বা কব্জিতে যেমন একটা ঘড়ি আছে, তেমনি আকাশেও একটা ঘড়ি আছে। দেয়াল বা কব্জির ঘড়ি ২৪ ঘন্টার সময় মাপে, আর আকশের ঘড়ি মাপে ১ বছর। সেই ঘড়ির কাঁটা হল সূর্য আর সংখ্যা গুলো হল বারোটা নক্ষত্র মণ্ডলী, যাদের আমরা রাশিচক্র বলে থাকি। সূর্য এক মাস করে এক একটা রাশির ঘরে থাকে। এই রাশিচক্র কে ব্যবহার করে একশ্রেণির লোক মানুষকে প্রতারিত করে ব্যবসা চালায় এই বলে যে রাশিচক্রের ওপর নাকি মানুষের ভাগ্য নির্ভর করে। অনেক উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তি এইসমস্ত বুজরুকিতে বিশ্বাসও করেন। বাস্তবে প্রাচীনযুগে কাল ও দিক নির্ণয় এবং জ্যোতির্বিজ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে এই রাশিচক্রের কল্পনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেও ভাগ্যের সঙ্গে এগুলোর কোন যোগাযোগ নেই। সে কথা থাক, ঐ যে বললাম সূর্য একমাস করে এক একটা রাশির ঘরে থাকে, এই মাস হল সৌরবছরের মাস, যার দৈর্ঘ্য চান্দ্রমাসের থেকে বেশী। অর্থাৎ একটা সৌরমাসের মধ্যে একটা গোটা চান্দ্রমাস ঢুকে যেতে পারে। সেরকম হলে ঐ চান্দ্রমাসে সূর্য একটা রাশিতেই থেকে যাবে, অন্য রাশিতে যাবেনা। সেই মাসটাকেই বলা হবে অধিক মাস। এইবছর হিন্দু ক্যালেন্ডারের ভাদ্র মাসের পরের মাসটা ১৮ই সেপ্টেম্বর থেকে ১৬ই অক্টোবর এইরকমই একটা অধিক মাস। এর নাম হল অধিক আশ্বিন। অধিক আশ্বিনের পরে আসবে আসল আশ্বিন, যে মাসে এবার দুর্গাপুজো হবে। বাংলা সৌরক্যালেন্ডারে অবশ্য ততদিনে অশ্বিন পেরিয়ে কার্তিক মাস চলে আসবে। তাহলে ১১ আর ১৮র গেরোটা বোঝা গেল। 

বাকি রইল ১-২ দিনের তারতম্য। অধিক মাস যদি ৩০ দিনের হয় তাহলে ১৮ দিনের বদলে ১৯ দিন পিছবে। আবার গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের বছরটা অধিবর্ষ হলে একটা তিথি ১১ দিনের বদলে ১২ দিন এগোবে। সুতরাং এইবছর হিন্দু সৌরচান্দ্র ক্যালেন্ডারে দুটো আশ্বিন মাসঃ একটা অধিক আশ্বিন, আরেকটা আসল বা নিজ আশ্বিন। কিন্তু দুর্গাপুজো যদি নিজ আশ্বিনে না হয়ে অধিক আশ্বিনে হত তাহলেই তো আর এই মহালয়ার পর একমাস অপেক্ষা করার কারণ থাকত না। এর কারণ অবশ্য এই কুসংস্কার যে অধিক মাসটা মলমাস, এই মাসে কোন শুভ অনুষ্ঠান করতে নেই। বাস্তবে যদিও আমরা দেখলাম যে "অধিক মাস" এর উদ্দেশ্য সৌরচান্দ্র ক্যালেন্ডারের সঙ্গে ঋতুচক্রের সামঞ্জস্যবিধান। এর সঙ্গে মানুষের শুভ অশুভের কোন সম্পর্ক নেই।

এবার বিশ্বকর্মা পুজোর কথায় আসি। হিন্দুধর্মের অন্যান্য উৎসবের মত বিশ্বকর্মা পুজো সৌরচান্দ্র ক্যালেন্ডার অনুযায়ী পালিত হয় না। সূর্য যখন সিংহ রাশি ছেড়ে কন্যা রাশিতে প্রবেশ করে সেই দিনটাই বিশ্বকর্মা পুজোর জন্য নির্ধারিত। এবং এই দিনটা গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারে ১৭ই সেপ্টেম্বরের আশেপাশেই পরে। বিশ্বকর্মা শিল্প-স্থাপত্যের দেবতা। হিন্দুরা যতদিনে কৃষিকাজের পাশাপাশি শিল্পকর্মেও পারদর্শী হতে শুরু করেছিল ততদিনে সম্ভবত আকাশে সূর্যের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করা শিখে গিয়েছিল আর বর্ষ গণনার জন্য সূর্যের গুরুত্বও বুঝেছিল। তাই বিশ্বকর্মা পুজো হয় সৌর ক্যালেন্ডার মেনে। বিশ্বকর্মা পুজোর মতই আরেকটা পুজোও আছে যেটা সৌর ক্যালেন্ডার মান্য করে। কার্তিক পুজো হয় বাংলা কার্তিক মাসের সংক্রান্তিতে অর্থাৎ ৩০শে কার্তিক। গ্রেগোরিয়ান ক্যালেন্ডারে তারিখটা নভেম্বর মাসের ১৬-১৭ নাগাদ পড়ে। অন্য কারো মনে হয় কি না জানি না, কিন্তু আমার তো বিশ্বকর্মা ঠাকুরের মুখের সঙ্গে কার্তিক ঠাকুরের মুখের বেশ মিল লাগে। দুই ভাই বলে দিব্যি চালিয়ে দেওয়া যায়! 

অনেকগুলো ধর্মের উৎসবের তারিখ নিয়ে বকবক করলাম। খ্রিষ্টধর্ম বাদ গেল কেন? ষোড়শ শতাব্দীতে রোমান সম্রাট জুলিয়াস সিজার প্রবর্তিত ক্যালেন্ডারের সংশোধন করেছিলেন পোপ দ্বিতীয় গ্রেগরি। প্রোটেস্টান্টরা গোড়ায় এই ক্যাথলিক সংস্কারকে মানতে পারেনি। ব্রিটেন গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারকে গ্রহণ করেছিল দুশো বছর পরে, অষ্টাদশ শতকে। তবু আমরা এটাকে "ইংরেজি ক্যালেন্ডার" বলে থাকি! সে যাই হোক খ্রিস্টধর্মের উৎসবগুলোর বেশীরভাগই গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী পালিত হয়। তাই বড়দিন হয় প্রতি বছরই ৩১শে ডিসেম্বর। হ্যালোউইনের তারিখ ৩১শে অক্টোবর। তবে কিছু উৎসব আছে, যেমন ইস্টার, যেগুলোর তারিখ হিব্রু সৌরচান্দ্র ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ঠিক হয়। 

শেষ করার আগে একটা কথা বলে রাখা জরুরী। মানুষের আত্মা বলে যদি কিছু থেকেও থাকে তা শারীরিক মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই ধ্বংস হয়ে যায়। দেহের অতীত আত্মা বলে কিছু হয় না। মহালয়ার সকালে গঙ্গার ধারে তর্পণ করলে তা পূর্বপুরুষের কানে পৌঁছানোর কোন সম্ভাবনা নেই। মহিষাসুর বধের কাহিনীর পেছনে যদি কোন সত্যি যুদ্ধের ইতিহাস থেকেও থাকে সেই যুদ্ধের কুশীলবরা সব মানুষই ছিল, কোন দেবতা বা অসুর নয়। নির্ঘন্ট মেনে পুজোআচ্চা পৈতাধারী কিছু লোকের উপার্জনের রাস্তা মাত্র। অমুক ষষ্ঠী, তমুক একাদশী বা গোটা রমজান মাস জুড়ে উপবাসে কোন পুণ্য সঞ্চয় হয় না। নিজ পথে স্থিত থেকে শাসকের প্রতিহিংসার শিকার হওয়া যিশুখ্রিষ্ট বা ইমাম হোসেন অবশ্যই শ্রদ্ধার পাত্র। আজকের যুগে যাঁরা ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়িয়ে ক্ষমতামদমত্ত শাসকের রোষের শিকার হচ্ছেন, যিশুখৃষ্ট বা ইমাম হোসেনের লড়াই থেকে তাঁরা প্রেরণা পেতেই পারেন। কিন্তু যিশুর পুনর্জন্ম যে গাঁজাখুড়ি গপ্পো মাত্র, ইমাম হোসেনের শোকে নিজদেহকে রক্তাক্ত করার পেছনে যে কোন যুক্তি নেই এই কথাগুলো মনে রাখা প্রয়োজন। সমস্ত ধর্মীয় প্রথা যুক্তিহীন অন্ধবিশ্বাসের ওপর প্রতিষ্ঠিত হলেও সেইসব প্রথার দিনক্ষণ কিন্তু ঠিক হয় একদম জ্যোতির্বিজ্ঞানের অঙ্ক মেনেই। 

তথ্যসূত্রঃ অধ্যাপক পলাশ বরণ পালের বিভিন্ন ভাষণ, অনুষ্টুপ পঞ্জিকা সংখ্যা ২০১৬, উইকিপিডিয়া। অনুপ্রেরণায় শ্রীরূপা ঘোষ কুমার।

Saturday, 20 June 2020

সূর্যগ্রহণ নিয়ে কিছু কথা।

আজ আকাশে করোনা দেখা যেতে পারে৷ না, করোনা ভাইরাস নয়৷ সূর্যের মুকুট অর্থাৎ বায়ুমণ্ডলের সবচেয়ে বাইরের অংশ হল করোনা৷ সাধারণ সময়ে আমরা সূর্যের যে অংশটা দেখি তা হল ফটোস্ফিয়ার৷ তার বাইরে ক্রোমোস্ফিয়ার এবং করোনা ফটোস্ফিয়ারের থেকে অনেক বেশী উত্তপ্ত হলেও পদার্থের ঘনত্ব খুব কম হওয়ার কারণে ঐ অঞ্চলগুলোর উজ্জ্বলতাও কম৷ তাই করোনাকে দেখা সম্ভব যদি ফটোস্ফিয়ারকে পুরোপুরি আড়াল করে দেওয়া যায়৷ পুরোপুরি না হলেও কাল ফটোস্ফিয়ারকে প্রায় ৩৯ সেকেন্ডের জন্য অনেকখানি ঢেকে দেবে চাঁদ৷ এত ভ্যানতাড়া করে যেটা বললাম সেটা হল আজ সূর্যগ্রহণ৷ বলয়গ্রাস সূর্যগ্রহণ৷ তিনটে মহাজাগতিক ঘটনা যুগপৎ ঘটলে বলয়গ্রাস সূর্যগ্রহণ ঘটতে পারে৷ (১) সূর্য ও চাঁদ উভয়েই পৃথিবীর একই দিকে থাকবে (যা প্রতি অমাবস্যাতেই ঘটে), (২) সূর্য, পৃথিবী ও চাঁদ একই তলে থাকবে, (৩) পৃথিবী থেকে চাঁদের দূরত্ব সর্বাধিক হবে৷ এর মধ্যে প্রথম দুটো শর্ত পূরণ হলেই সূর্যগ্রহণ ঘটে৷ কিন্তু বলয়গ্রাস অর্থাৎ আগুণের আংটি দেখার জন্য চাই তৃতীয় শর্তটাও৷ তৃতীয় শর্ত পূরণ না হলে চাঁদ গোটা সূর্যটাকেই ঢেকে ফেলবে, যাকে আমরা বলি পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ৷ পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণের সময়েই অবশ্য করোনা কে ভালোভাবে দেখা যায়৷ আজ আমরা পশ্চিমবঙ্গ থেকে সেই আগুণের আংটি দেখতে পাবো না৷ সূর্যের কেন্দ্রর সঙ্গে চাঁদের কেন্দ্রকে যদি একটা সরলরেখা দিয়ে যুক্ত করা হয়, সেই সরলরেখা পৃথিবীর ওপর যে রাস্তা দিয়ে যাবে, সেই রাস্তা থেকে বলয়গ্রাস সূর্যগ্রহণ দেখা যাবে৷ ভারতের মধ্যে বলয়গ্রাসের রাস্তাটা পাকিস্তান থেকে ঢুকে রাজস্থান, হরিয়ানা, উত্তরাখণ্ডের ওপর দিয়ে তিব্বতের দিকে চলে যাবে৷ তবে আমাদের একেবারে হতাশ হওয়ার কিছু নেই৷ বলয়গ্রাস না হলেও আংশিক সূর্যগ্রহণ আমরা দেখতে পাবো সকালে পৌনে এগারোটা থেকে দুপুর সওয়া দুটো পর্যন্ত৷ সাড়ে বারোটা নাগাদ চাঁদ সূর্যের প্রায় ৬৫% ঢেকে যাবে৷

এতক্ষণ যা বকবক করলাম তা মোটামুটি সবাই ছোটবেলায় ভূগোল বইয়ে পড়েছেন৷ তবু ঐ জানা কথাগুলো বলার উদ্দেশ্য হল এটা আরেকবার বুঝে নেওয়া যে সূর্যগ্রহণ একেবারেই একটা মহাজাগতিক জ্যামিতির খেলা৷ হিন্দু পুরাণে ও জ্যোতিষশাস্ত্র অনুযায়ী সূর্যগ্রহণের সময় রাহু নামক একটা দৈত্য সূর্যকে গিলে ফেলে৷ শাস্ত্রের নির্দেশঃ গ্রহণ চলাকালীন কিছু খাওয়া যাবে না, রান্না করা খাবার ফেলে দিতে হবে, গ্রহণ শেষ হয়ে গেলে বাসনপত্র ভালো করে মাজতে হবে, বাইরে বেরনোর জামাকাপড় কেচে ফেলতে হবে৷ গর্ভবতী মহিলারা গ্রহণের সময় বাইরে বেরোলে গর্ভের শিশু বিকলাঙ্গ হয়ে যাবে ইত্যাদি৷ ইসরো যখন চাঁদে মহাকাশযান পাঠাচ্ছে আর সেই খবর ভারতবাসী গর্বের সঙ্গে শেয়ার করছে, সেই সময়ে দাঁড়িয়ে লোকে এইসবে বিশ্বাস করবে - এটা মানতে মন চায় না৷ তবু বাস্তব বড় বিচিত্র৷ বহু উচ্চশিক্ষিত মানুষও জন্মলগ্নে সূর্য কোন রাশির সামনে ছিল তার ওপর নিজের ভাগ্য নির্ভর করে, আঙুলে কিছু পাথর ধারণ করে সেই ভাগ্যকে বদলে ফেলা যায় বলে বিশ্বাস করেন! তারওপর এখন এইসমস্ত কুসংস্কারকে হাজির করা হচ্ছে বিজ্ঞানের মোড়কে! সূর্যগ্রহণের সময় নাকি সূর্যের আলো কমে যাওয়ার কারণে জীবাণুদের দাপট বেড়ে যায়৷ তাই যদি হত তাহলে তো মনুষ্যপ্রজাতি কবেই বিলুপ্ত হয়ে যেত! প্রতিদিন তো বারোঘন্টা করে সূর্যের আলো থাকে না, মেঘ করলে দিনের বেলায়ও সূর্যের আলো কমে যায়! জনৈক "বিজ্ঞানী" শুনলাম বলেছেন যে সূর্যগ্রহণের সঙ্গে সঙ্গেই করোনা ভাইরাস পৃথিবী থেকে বিদায় নেবে৷ এইসব মহাজাগতিক ঘটনার সঙ্গে যে মানুষের বা জীবজগতের বিন্দুমাত্র সম্পর্ক নেই তা জোরের সঙ্গে বলা দরকার৷ তাই নির্ভয়ে যেকোন জায়গায় যান, পছন্দের খাবার খেতে খেতে সূর্যগ্রহণ দেখুন৷

তার মানে অবশ্য এটা নয় যে সূর্যগ্রহণের সময় কোনরকম সতর্কতার প্রয়োজন নেই৷ ভুলেও খালিচোখে বা রোদচশমা দিয়ে সূর্যগ্রহণ দেখতে যাবেন না৷ সূর্যের আলো সরাসরি চোখে পড়লে রেটিনার স্থায়ী ক্ষতি হতে পারে৷ সূর্যগ্রহণ দেখুন সোলার ফিল্টারের সাহায্যে বা পিনহোল ক্যামেরা বানিয়ে৷ আর সূর্যগ্রহণ দেখার উৎসাহে স্যোসাল ডিস্ট্যান্সিং ভাঙবেন না৷ সূর্যের করোনা পৃথিবীর করোনা কে নিকেশ করতে পারবে না৷


আজকের দিনটা আরেকটা কারণেও বিশিষ্ট৷ আজ কর্কট সংক্রান্তি৷ সূর্য উত্তরায়ণ শেষ করে দক্ষিণপন্থী হবে৷ সূর্যের আলো পৃথিবীর ওপর সবচেয়ে তেরছা ভাবে পড়বে৷ যার ফলে উত্তর গোলার্ধে আজ সবচেয়ে বড় দিন আর সবচেয়ে ছোট রাত্রি৷ একটা দিন নাহয় ধর্ম, বর্ডার, ডিপ্রেশন এইসব তুচ্ছ জিনিস ভুলে মহাকাশের কাণ্ডকারখানা অনুভব করার চেষ্টা করি৷

ছবিতে রইল পিনহোল ক্যামেরায় তোলা গ্রহণ চলাকালীন সূর্যের ছবি। ফেসবুক লিঙ্ক

Friday, 12 June 2020

বিষ্ণুপুরঃ ক্যাপশন স্টোরি (প্রথম পর্ব)

বছর চারেক আগের কথা। পুজোয় বেড়ানোর প্রোগ্রাম তো প্রতিবারই থাকে। সেইবছরও ছিল। ভাইজাগ-আরাকু ভ্যালির টিকিট কাটা। কিন্তু কলেজে ন্যাক ভিজিটের কারণে পুজোর ছুটি সংক্ষিপ্ত হয়ে গেল। তাই বাধ্য হয়ে টিকিট ক্যানসেল করতে হল। কিন্তু তাই বলে পুজোর বেড়ানোটা একেবারে বাদ যাবে, তা তো হতে দেওয়া যায় না। তাই নাকের বদলে নরুণের মত মুকুটমণিপুর আর বিষ্ণুপুর। অবশ্যি গিয়ে বুঝলাম নরুণটাও ফেলনা নয়। এমন নরুণ পেলে নাক ত্যাগ করতে খুব বেশি কষ্ট হবে না। যাওয়ার সময় আমরা হুল এক্সপ্রেসে গিয়ে নামলাম দুর্গাপুরে। সেখান থেকে বাসে মুকুটমণিপুর। দুদিন কাটিয়ে গাড়ি ভাড়া করে এলাম বিষ্ণুপুর। রাজ্য পর্যটন দপ্তরের ট্যুরিস্ট লজে বুকিং ছিল। বিকেলের দিকে লজ থেকে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে রাসমঞ্চের দিকে যেতেই গাইড মিঠু ভুঁই মশাই পাকড়াও করলেন। সেদিন এবং তার পরের দিন তাঁর সঙ্গে টোটো করে ঘুরে বেড়ালাম বাংলার মধ্যযুগের ইতিহাসের আনাচ কানাচ দিয়ে।


মৃণ্ময়ী মন্দির

মৃণ্ময়ী মন্দির, বিষ্ণুপুর
আজকের বিষ্ণুপুর, সেদিনের ছিল অতীতের মল্লভূম রাজ্যের রাজধানী। কেউ কেউ বলেন মল্লরাজারা রাজপুতানা থেকে এসেছিলেন। আমাদের গাইডও তাই বললেন। আবার কিছু ঐতিহাসিকের মতে মল্লরাজারা স্থানীয় আদিবাসীদের বংশধর ছিলেন। 

মৃণ্ময়ী মন্দির, বিষ্ণুপুর
মল্লরাজ জগৎমল্ল মৃণ্ময়ী অর্থাৎ দুর্গার মন্দিরটি তৈরী করেন ৯৯৭ সালে। বৈষ্ণব হওয়ার আগে মল্লরাজারা শিব ও শক্তির উপাসক ছিলেন। এখনো রাজপরিবারের সদস্যদের তত্ত্বাবধানে দুর্গাপুজো হয় এখানে। 


মল্লেশ্বর মন্দির

মল্লেশ্বর মন্দির
মল্লেশ্বর মানে শিব। মল্লরাজা বীরহাম্বির এটার নির্মাণকার্য শুরু করেন। আচার্য শ্রীনিবাস গোস্বামীর কাছে বৈষ্ণবধর্মে দীক্ষিত হওয়ার পর তিনি এই মন্দিরের নির্মাণ কাজ বন্ধ রাখেন। পরে বীরসিংহ সম্পূর্ণ করেন। নির্মাণকাল আনুমানিক ১৬২২।

গাজনের মেলায় এগুলোয় চড়ে খেলা দেখানো হয়। মল্লেশ্বর মন্দিরের ভিতরেই রাখা আছে।

 অভিনেতা অভি ভট্টাচার্যের বাড়ি ও নাটমন্দির। মল্লেশ্বর মন্দিরের পাশেই।


শ্রীনিবাস গোস্বামীর সমাধি


ষোড়শ শতকে বৃন্দাবনের গোস্বামীরা গরুর গাড়িতে করে অনেকগুলো বৈষ্ণব পুঁথি পাঠাচ্ছিলেন। পথে মল্লভূমের গোপালপুর গ্রামে বইগুলো লুঠ হয়। লুন্ঠিত গ্রন্থের মধ্যে কৃষ্ণদাস কবিরাজ রচিত "শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত"র আসল পাণ্ডুলিপিও ছিল বলে শোনা যায়। গাড়িতে ধনরত্ন আছে মনে করে রাজা বীরহাম্বিরই ওগুলো লুঠ করিয়েছিলেন। বইগুলোর সন্ধানে রাজসভায় উপস্থিত হয়ে শ্রীনিবাস আচার্য দেখলেন এক পণ্ডিত পুঁথিগুলো পাঠ করছেন এবং ভুল ব্যাখ্যা দিচ্ছেন। তখন শ্রীনিবাস আচার্য এগিয়ে আসেন এবং সঠিক ব্যাখ্যা করে বীরহাম্বিরকে আকৃষ্ট করেন। তারপর এই শ্রীনিবাস আচার্যর কাছেই বীরহাম্বির বৈষ্ণবধর্মে দীক্ষিত হন।


শ্রীনিবাস গোস্বামীর সমাধি, বিষ্ণুপুর


রাসমঞ্চ 

রাসমঞ্চ, বিষ্ণুপুর

বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত হওয়ার পর বীর হাম্বির এই রাসমঞ্চটি প্রতিষ্ঠা করেন ১৬০০ সালে। তলায় মাকড়া পাথরের বর্গাকার বেদী। ওপরের স্থাপত্য ইঁটের। সৌধের চূড়াটা মিশরের পিরামিডের মত, মাঝে বাংলার চালা আর তলায় ইসলামিক স্থাপত্যের খিলান।

রাসমঞ্চ, বিষ্ণুপুররাসমঞ্চ, বিষ্ণুপুর

রাসমঞ্চে মোট ১০৮টা খিলান আছে। রাস উৎসবের সময় বিভিন্ন মন্দির থেকে বিগ্রহগুলোকে নিয়ে আসা হত।
  
 রাসমঞ্চের দেওয়ালের ভাস্কর্য। বাঁদিকে চৈতন্য মহাপ্রভু কে দেখা যাচ্ছে।

খিলানের মাথায় প্রস্ফুটিত পদ্মের মত ছবি।


শ্যামরায় পঞ্চরত্ন মন্দির

শ্যামরায় পঞ্চরত্ন মন্দির, বিষ্ণুপুর

রত্ন অর্থে চূড়া। বাঁকানো চারচালা বাংলাঘরের ওপর চারকোণে চারটে দেউল। মাঝখানে একটা ছয়চালাবিশিষ্ট দেউলের ওপর একটা গম্বুজ। আমাদের গাইড বললেন চারটে ছোট দেউল যথাক্রমে বাংলার চালাঘর, উড়িষ্যার মন্দির, বৌদ্ধ ও জৈন স্থাপত্যের অনুকরণে নির্মিত। আর মাঝখানের গম্বুজটায় তো ইসলামিক স্থাপত্যের ছাপ স্পষ্ট।মন্দিরের প্রবেশপথের ঠিক ওপরে খোদাই করা আছেঃ 
"শ্রীরাধাকৃষ্ণমুদে শশাঙ্ক বেদাঙ্ক যুক্তে নবরত্নম,
 শ্রীবীরহম্বীর নরেশ সূনুর্দদৌ নৃপঃ শ্রী রঘুনাথ সিংহ।। 
মল্ল সকে ৯৪৯। শ্রীরাজা বীরসিংহ।" 
অর্থাৎ রাধাকৃষ্ণের আনন্দের জন্য নরেশ বীর হাম্বীরের পুত্র রঘুনাথ সিংহ এই মন্দিরটি দান করলেন ৯৪৯ মল্লাব্দে (১৬৪৩ খৃষ্টাব্দে)। ৬৯৪ সালে আদি মল্লের সিংহাসনারোহণের সময় থেকে মল্লাব্দের শুরু।

শ্যামরায় পঞ্চরত্ন মন্দির, বিষ্ণুপুর
বিষ্ণুপুরের যে সমস্ত মন্দিরে টেরাকোটার কাজ রয়েছে সেগুলোর মধ্যে অন্যতম শ্যামরায় পঞ্চরত্ন মন্দির।

শ্যামরায় পঞ্চরত্ন মন্দির, বিষ্ণুপুর
রাজস্থানী স্থাপত্যের অনুকরণে নকল দরজা।

শ্যামরায় পঞ্চরত্ন মন্দির, বিষ্ণুপুর
রাম রাবণের যুদ্ধ।

শ্যামরায় পঞ্চরত্ন মন্দির, বিষ্ণুপুর
কৃষ্ণের রাসলীলা।

রাসচক্র।


জোড়বাংলা মন্দির 

জোড়বাংলা মন্দির, বিষ্ণুপুর
জোড়বাংলা বা কেষ্ট রায় মন্দিরটি নির্মিত হয়েছিল ১৬৫৫ সালে, মল্লরাজা রঘুনাথ সিংহের সময়ে। দুটো দোচালা বাংলা ঘর জুড়ে তৈরী হয়েছে বলে এর নাম জোড়বাংলা। মাঝখানে একটা চারচালার চূড়া।

জোড়বাংলা মন্দির, বিষ্ণুপুর
ভীস্মের শরশয্যা।

জোড়বাংলা মন্দির, বিষ্ণুপুর
ওপরে পশুপালকদের গরু, ছাগল চড়ানোর দৃশ্য। মাঝে বালি-সুগ্রীবের যুদ্ধ; রামচন্দ্র পেছন থেকে অন্যায় যুদ্ধে বালিকে হত্যা করছে। তলায় একজন মানুষ বাঘ শিকার করছে।

জোড়বাংলা মন্দির, বিষ্ণুপুর
ওপরে ঘরোয়া জীবনযাত্রার ছবি। মাঝখানে মোগল সম্রাট পায়রা ওড়াচ্ছেন। তলায় হাতি, ঘোড়া, উটের পিঠে চেপে যুদ্ধযাত্রায় বেরোচ্ছে মোগল সেনা

জোড়বাংলা মন্দির, বিষ্ণুপুর
সুজাতা বুদ্ধদেবকে পায়েস খাওয়াচ্ছে।

জোড়বাংলা মন্দির, বিষ্ণুপুর
যুদ্ধ, শিকার, সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ছবি, রামায়ণ-মহাভারতের গল্প - সবই রয়েছে জোড়বাংলা মন্দিরের দেওয়ালে। কিছু নষ্ট হয়ে গেছে। আবার অনেকগুলোই টিকে আছে।

জোড়বাংলা মন্দির, বিষ্ণুপুর
কৃষ্ণের মন্দিরে ইসলামিক স্থাপত্য।
 

লালজী মন্দির

লালজী মন্দির, বিষ্ণুপুর
রাধা ও কৃষ্ণকে আনন্দ দেওয়ার জন্য দ্বিতীয় বীরসিংহ ১৬৫৮ সালে এই একরত্ন মন্দিরটি প্রস্তুত করেন। মূলত রাজপরিবারের মহিলারা এখানে পুজো দিতে আসতেন। মন্দিরের সঙ্গে নাটমঞ্চ ও ভোগ রান্নার ঘর রয়েছে।

লালজী মন্দিরের পাশের এই মাঠটায় চৈত্র সংক্রান্তিতে গাজনের মেলা বসে। এখন অবশ্য ক্রিকেট খেলা চলছে।

বড় পাথর দরজা 

বড় পাথর দরজা, বিষ্ণুপুর
বিষ্ণুপুরের প্রাচীন দুর্গের উত্তরদিকের প্রবেশপথ হল মাকড়া পাথরের তৈরী বড় দরজাটা। বীরসিংহ সপ্তদশ শতকের মধ্যভাগে এটা তৈরী করেন। দরজার সামনে একটা পরিখা রয়েছে।

বড় পাথর দরজা, বিষ্ণুপুর
বড় পাথর দরজার তোরণের প্রবেশপথের দুপাশে সৈন্যদের লুকিয়ে থাকার জায়গা রয়েছে। তলায় ছোট ছোট গর্ত দিয়ে শত্রুর দিকে তীর বা গুলি ছোঁড়া হত।


মদনমোহন মন্দির 

মদনমোহন মন্দির, বিষ্ণুপুর
দুর্জন সিংহর আমলে ১৬৯৪ সালে এই একরত্ন ইঁটের মদনমোহন মন্দির তৈরী হয়েছিল। এখনও রাস ও দোল খেলা হয় এখানে।নিত্যসেবাও হয়ে থাকে। ভোগ রান্নার ঘরে রান্নার কাঠও দেখতে পেলাম।
 
মদনমোহন মন্দির, বিষ্ণুপুর
মদনমোহন মন্দিরের নাটমঞ্চ


 মদনমোহন মন্দির, বিষ্ণুপুর  
অষ্টধাতুর কৃষ্ণ আর কষ্টিপাথরের রাধা। এই মূর্তিটাকে নিয়ে একটা রোমাঞ্চকর গল্প আছে। সেটা নিয়ে এক্কবার জমিয়ে লিখেছিলাম। আগ্রহ থাকলে এখানে পড়তে পারেনঃ মদনমোহনের কীর্তিকলাপ। 

মদনমোহন মন্দির, বিষ্ণুপুর
বিষ্ণূপুরের মন্দিরগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভালো পোড়ামাটির কাজ রয়েছে মদনমোহন মন্দিরে।

মদনমোহন মন্দির, বিষ্ণুপুর
নব নারী কুঞ্জর। ন জন মহিলা মিলে একটা হাতির রূপ তৈরী করেছে। এই ন জন নারী হল রাধা ও তার অষ্টসখী। কৃষ্ণের সঙ্গে ছল করে তাকে পিঠে নিয়ে জঙ্গলে ঘোরার জন্য রাধা সখীদের নিয়ে এই কাণ্ডটা করেছিলেন। দাশরথি রায়ের পাঁচালীতে আছেঃ
তোমরা ত অষ্টসখী, আমি এক জন । 
নয় জনে একত্রেতে হইব মিলন ॥
নব নারী মিলে হব অপূৰ্ব্ব কুঞ্জর।
কুঞ্জর রূপেতে রব কুঞ্জের ভিতর ॥
করী -রূপে প্রাণকান্তে পৃষ্ঠেতে করিয়া
ব্রজের বিপিন মাঝে বেড়াব ভ্ৰমিয়া ॥
মদনমোহন মন্দির, বিষ্ণুপুর
চীনা ড্রাগনের অনুকরণে স্থাপত্য।

মদনমোহন মন্দির, বিষ্ণুপুর
বালী ও সুগ্রীবের যুদ্ধের বিভিন্ন মুহূর্ত। তলায় দেখা যাচ্ছে ঘাপটি মেরে বসে আছে রামচন্দ্র। সুযোগ বুঝে পেছন থেকে তীর মারছে।

মদনমোহন মন্দির, বিষ্ণুপুর
নৃসিংহ অবতারে হিরণ্যকশিপুকে বধ করছে বিষ্ণু।

মদনমোহন মন্দির, বিষ্ণুপুর
বিষ্ণুর বরাহ অবতার। দশ অবতারেরই ছবি পাওয়া যাবে এই মন্দিরের দেয়ালে।

মদনমোহন মন্দিরের সামনে পোড়ামাটির জিনিসের পসরা। বাজারের চেয়ে এখানেই সস্তায় পাওয়া যাবে।

 

মুরলীমোহন মন্দির 

মাকড়া পাথরনির্মিত মুরলীমোহন মন্দিরের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বীরসিংহের রাণী শিরোমণিদেবী। অন্য মন্দিরগুলোর থেকে এই মন্দিরটা একটু দূরে অবস্থিত। এটা খুঁজে পেতে গাইড আর টোটোচালকমশাই বেশ নাজেহাল হলেন।  

দলমাদল

দলমাদল, বিষ্ণুপুর
৪ মিটার দীর্ঘ, ৩০ সেন্টিমিটার ব্যাস ও ৩০০ মন ওজন বিশিষ্ট এই কামানটা আগে বসানো ছিল বড় পাথর দরজার সামনে। ১৭৪২ সালে ভাস্কর রাওয়ের নেতৃত্বে মারাঠারা হামলা চালালে এই কামান থেকে গোলা বর্ষণ করে বর্গীদের দলকে মর্দন করা হয়। লোকের বিশ্বাস নগরপ্রাকারে দাঁড়িয়ে কামান দেগেছিলেন স্বয়ং মদনমোহন! দল মর্দন থেকে অপভ্রংশ হয়ে দলমাদল নামটা দাঁরিয়েছে।

লালবাঁধ

 
বাঁধ অর্থে তিনদিকে ঘেরা জলাশয়। একদিক ঢালু করা থাকে। সেখান দিয়ে জল এসে জলাশয়ে জমা হয়। বিষ্ণুপুরে অনেকগুলো বাঁধ আছে তার মধ্যে লালবাঁধ বিশিষ্ট অষ্টাদশ শতকের একটা মর্মান্তিক ঘটনার জন্য। পাঠান সর্দার রহিম খাঁর মহল থেকে লালবাঈকে তুলে নিয়ে আসেন মল্লরাজা দ্বিতীয় রঘুনাথ সিংহ। লালবাঈএর থাকার জন্য যে নতুনমহল তিনি তৈরী করে দিয়েছিলেন তার ধ্বংসাবশেষও গাইডমশাই আমাদের দেখালেন। লালবাঈএর গর্ভে দ্বিতীয় রঘুনাথ সিংহের এক পুত্রসন্তানও জন্মগ্রহণ করে। লালবাঈ ও তার পুত্র রাজত্বের দখল নিয়ে নেবে এই আশঙ্কায় রাজার প্রথমা স্ত্রী চন্দ্রভামা দেবী প্রথমে রাজাকে বিষপ্রয়োগে হত্যা করেন, তারপর লালবাঈ ও তার পুত্রকে একটা নৌকোয় বেঁধে তার ওপর বড় বড় পাথর চাপিয়ে এই জলাশয়ে ডুবিয়ে মারেন। চন্দ্রভামা দেবী নিজে অবশ্য রাজত্ব ভোগ করতে পারেননি। রাজার চিতায় তাঁকে সহমরণে যেতে হয়।

রাধাশ্যাম মন্দির

রাধেশ্যাম মন্দির, বিষ্ণুপুর
১৭৫৮ সালে মাকড়া পাথর নির্মিত এই গম্বুজাকৃতি একরত্ন মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন মল্লরাজ চৈতন্য সিংহ। এই মন্দিরে রাধাশ্যাম, জগন্নাথ ও গৌর নিতাই ের মূর্তি আছে। তুলসীমঞ্চ, নাটমঞ্চ, ভোগ রান্নার ঘর, প্রবেশপথে নহবৎখনা ্ররয়েছে।
 
রাধেশ্যাম মন্দির, বিষ্ণুপুর
মন্দিরের প্রবেশদ্বারে ইঁটের নহবৎখানা। একসময় এখানে সানাই ও বাদ্যযন্ত্র বাজানো হত।

রাধেশ্যাম মন্দির, বিষ্ণুপুর 
ভোগ রান্নার ঘর।

রাধেশ্যাম মন্দির, বিষ্ণুপুর
পঙ্খের কাজে ফুটে উঠেছে নানা পৌরাণিক কাহিনী।

রাধেশ্যাম মন্দির, বিষ্ণুপুর
গৌর-নিতাইএর এই মূর্তিদুটো আগে মহাপ্রভু মন্দিরে ছিল। সংরক্ষণের অভাবে সেটার ভগ্নপ্রায় দশা। তাই গৌর নিতাই ঠাঁই নিয়েছেন এই মন্দিরে।


গুমঘর 

গুমঘর, বিষ্ণুপুর
মল্লরাজা বীরসিংহ এই ইঁটের ঘরটি বানিয়েছিলেন। কারো মতে এটা রাজা দের শস্যাগার ছিল আবার কেউ বলেন এর ওপর থেকে ফেলে অপরাধীদের শাস্তি দেওয়া হত। ঐতিহাসিকরা অনেকে মনে করেন এটা জলের ট্যাঙ্ক ছিল, কারণ আশেপাশে অনেক পোড়ামাটির পাইপ পাওয়া গিয়েছিল।


পাথরের রথ 

পাথরের রথ, বিষ্ণুপুর

আনুমানিক সপ্তদশ শতকে মাকড়া পাথর নির্মিত মাটিতে গাঁথা এই রথ কি কাজে লাগত বোঝা গেল না। এটার তলার অংশটা রাসমঞ্চের মত আর ওপরটা বিষ্ণুপুরের মন্দিরের মত। চার ধারে তিনটে করে পাথরের চাকা দেখা যাচ্ছে। 


ছবিগুলো সবই আমার বা শ্রীরূপার তোলা। খালি শ্যামরায় পঞ্চরত্ন মন্দিরের সামনে দুজনের ছবিটা তুলে দিয়েছেন গাইড মহাশয়। সঙ্গের তথ্যগুলো মূলতঃ গাইড মশাই এর কাছ থেকে শোনা বা বিষ্ণুপুর গাইড বুক এবং মন্দির চত্বরে ভারতীয় পুরাতত্ত্ব বিভাগের সাইনবোর্ড এ পড়া। এছাড়া বিনয় ঘোষের "পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি (প্রথম খণ্ড)" এবং "পশ্চিমবঙ্গ" পত্রিকার বাঁকুড়া জেলা সংখ্যার সাহায্য ও নিয়েছি। সরকারী গাইড মিঠু ভুঁই এর যোগাযোগ নম্বরঃ 9474452992