করোনায় তালাবন্দী হওয়ার আগে যেকোন সাপ্তাহিক কাজের দিনে সকালের দিকে আমাদের বাড়ির সামনে কেউ এলে হয়ত একটা দৃশ্য দেখতে পেতেন৷ বাড়ির অদূরে একটা ছেলেদের আর একটা মেয়েদের স্কুল৷ ছোট ছেলেমেয়েরা স্কুল থেকে ফিরছে, বড়রা স্কুলে যাচ্ছে৷ আমাদের বাড়ির চাতালে লম্বা দাড়িওলা, টাকমাথা এক বৃদ্ধ বসে আছেন৷ ছেলেমেয়েরা প্রত্যেকে যাওয়ার সময় "দাদু টাটা" বলে হাত নাড়িয়ে যাচ্ছে, দাদুও "টা টা" বলে হাত নাড়ছেন৷ কেউ বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করতে করতে বেখেয়ালে এগিয়ে এলে আবার পিছিয়ে এসে "টা টা" দিয়ে যাচ্ছে৷ সামনে "দাদু" বলে সম্বোধন করলেও বাচ্ছারা আড়ালে তাঁকে ডাকত "রবীন্দ্রনাথ" বলে৷ তিনি আমার জেঠু, অরিন্দম কুমার, যিনি গত ৭ই জুলাই, ২০২২ অষ্টআশি বছর বয়সে মারা গেলেন৷
নিঃসঙ্গ জীবনে ঐ ছেলেমেয়েগুলো ছিল তার একমুঠো অক্সিজেন৷ নিঃসঙ্গতা, মানসিক বৈকল্য নিয়েও জেঠু হার মানিয়ে দিয়েছিল সময় কে৷ আমি জন্ম থেকে জেঠুকে যেভাবে দেখছি, মৃত্যুর আগে অবধি তার খুব বেশী পরিবর্তন হয়নি৷ শুধু বাহ্যিক চেহারার জন্য নয়, মনের ভেতরেও জেঠু বেঁচে ছিল তার নিজের সময়ে৷ উত্তম সুচিত্রার সিনেমা, হেমেন্দ্রকুমার রায়, নীহাররঞ্জন গুপ্ত আর সত্যজিৎ রায়ের বই, রবীন্দ্রনাথের গান-কবিতা, দিনে গোটাছয়েক বিড়ি, রোববারের লুচি-আলুর দম, খাটের ওপর হরেক জিনিস দিয়ে ডিজাইন সাজানো আর শৈশব, কৈশোর এর কর্মকাণ্ডের স্মৃতি রোমন্থন - এই নিয়েই তো জেঠু কাটিয়ে দিল৷ ডাই হার্ড ফ্যান ছিল মোহনবাগানের। কোনদিন মোহনবাগান হারলে মনমরা হয়ে থাকত। মোবাইল বা ল্যান্ড কোন ফোনই নিজের হাতে ব্যবহার করেনি৷ প্যান আধার কোন কার্ডই ছিল না, সেগুলোকে লিঙ্ক করতে কেউ তাড়াও দেয়নি৷ মাস্ক না পরে, ভ্যাকসিন না নিয়েও তিনটে ওয়েভকে জানলার বাইরে থেকেই বিদায় দিয়ে দিলো৷ ওমিক্রনে যখন গোটা বাড়ি কাঁপছে, জেঠু তখন দিব্যি সুস্থ৷ নিজের গৃহবন্দী জীবনকে মেনেই নিয়েছিল৷ এখনও পুলিস নজরবন্দী করে রেখেছে এই ধারণা ছিল বদ্ধমূল৷ ইচ্ছে ছিল খালি একবার বর্ধমান মানে মামাবাড়ির দেশে যাওয়ার - সে ইচ্ছা আর পুরণ হল না৷
দিল্লীর মুঘল স্থাপত্যগুলো আরেকবার ঘুরে দেখারও খুব ইচ্ছে ছিল৷ বিশেষ করে তাজমহল৷ জানি না বন্দী সম্রাট শাজাহান এর সঙ্গে নিজের মিল খুঁজে পেত কি না৷ তবে শাজাহান নয়, নিজেকে বলত বাবর৷ আর আমি হুমায়ূন৷ দিল্লী যেতে না পারলেও অবশ্য চিন্তা ছিল না৷ জেঠুর নিজের ছড়াতেই তো আছেঃ "দয়ালবাবুকা বিল্লী/ এহি তো হ্যায় দিল্লী!" দয়ালবাবু বলতে আমার দাদু দয়াল কুমার৷ আর বিল্লী হল বিল্ডিং এর অপভ্রংশ! কৈলাসে কেলেঙ্কারি উপন্যাসে ফেলুদা রা "বিবি কা মকবরা" দেখতে গিয়েছিল৷ কৈলাসে কেলেঙ্কারি ছবিটা আগ্রহ নিয়ে দেখেছিল ঐ বিবি কা মকবরা একঝলক দেখার জন্য৷
জেঠুর জীবনের প্রথম সিকিভাগে নানাবিধ রাজনৈতিক ও সামাজিক ঘটনার ঘনঘটা৷ আর বাকিটা কেটেছে মনোবিকলনের চিকিৎসা ও তারপর কিছুটা সুস্থ ও স্থিতিশীল অবস্থায় ঘরে বসে৷ ঐ প্রথমের সিকিভাগটুকুই জেঠুর মাথায় ধরা ছিল৷ গান্ধী হত্যার পর খালি পায়ে মিছিল করে শ্মশানে যাওয়া থেকে শুরু করে নাবালক অবস্থায় কারাবন্দী হওয়া, দমদম জেলে অনশন ধর্মঘটে অংশ নেওয়া, কারামুক্তির পর শ্রমিকদের সংগঠিত করতে ভিলাই যাওয়া ইত্যাদি নানা গল্প জেঠুর কাছে শুনেছি৷ ভিলাই তে হিন্দু মহাসভার লোকেরা জেঠুকে প্রচণ্ড মারধর করে মৃত ভেবে নর্দমায় ফেলে চলে যায়৷ প্রাণে বেঁচে গেলেও মস্তিস্ক বিকৃতির অসুখ জেঠুর বাকি জীবনের সঙ্গী হয়ে ওঠে৷ জেঠুকে কোনদিন ভোট দিতে দেখিনি, কিন্তু পার্টির প্রতি আনুগত্য ছিল সীমাহীন৷ একবার বলেছিলঃ "মা কে জিজ্ঞাসা করেছিলাম আমার জায়গা পার্টির ভেতরে না বাইরে? মা জবাব দিলেন বাইরে৷"
জেঠুর একটা প্রিয় খেলা ছিল একটা শব্দের মধ্য থেকে অক্ষরগুলো কে ভেঙেচুড়ে আরেকটা অর্থপূর্ণ শব্দ বের করা৷ ইংরেজিতে যাকে Anagram বলে, খানিকটা সেইরকম৷ আরেকটা খেলা ছিল নানা মানুষের জন্ম ও মৃত্যুদিন মেলানো মেশানো৷ এইভাবে নেপোলিয়ন বোনাপার্ট, কার্ল মার্কস আর এলবার্ট আইনস্টাইনকে মিলিয়েছিল৷ নেপোলিয়নের মৃত্যুদিন ৫ই মে, যেদিনটা মার্কসের জন্মদিন৷ মার্কসের মৃত্যুদিন ১৪ই মার্চ, যেটা আবার আইনস্টাইনের জন্মদিন৷ এমনিতে আমার সালতারিখ মনে থাকে না, কিন্তু জেঠুর কাছে এগুলো এতবার শুনেছি, যে ভোলার জো নেই৷
মৃত্যুর ছ দিন আগে রথযাত্রা ছিল৷ তখন আর নিজে ওঠা বসা করার ক্ষমতা নেই। কথাগুলোও জড়িয়ে যায়, ভালো বোঝা যায় না৷ বিকেলে চা এনে চেয়ারে বসিয়ে দিয়েছি৷ জানলা দিয়ে দেখা যাচ্ছে বাচ্ছারা ছোট ছোট রথ সাজিয়ে টানতে বেরিয়েছে৷ বললাম, "জেঠু আজ রথ"৷ জেঠু একবার জানলার দিকে তাকিয়ে, অস্পষ্ট উচ্চারণে কিন্তু একটুও না থেমে বলে গেলঃ
"রথযাত্রা লোকারণ্য মহা ধূমধাম
ভক্তরা লুটায়ে পথে করিছে প্রণাম।
পথ ভাবে আমি দেব, রথ ভাবে আমি,
মূর্তি ভাবে আমি দেব, হাসেন অন্তর্যামী৷"