Friday, 28 March 2025

মনবেড়ি

চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে টিভি টা চালাতেই সেই মানুষগুলো কে দেখা গেল, মুষ্টিবদ্ধ হাত মাথার ওপর ছুঁড়ে দিয়ে মিছিল করে এগিয়ে যাচ্ছে। কয়েক সপ্তাহ ধরেই নন্দিতা মানুষগুলোকে টিভি তে দেখছে। সেও তো চেয়েছিল ঐ হাজারো মুখের মধ্যে একটা মুখ হতে। 

গত রবিবার নন্দিতাদের স্কুলের প্রাক্তন ছাত্রীদের পদযাত্রায় যাওয়ার জন্য অনেকবার বলেছিল পৌলমী। কিন্তু তখন তো সাত্যকিকে টিউশনে নিয়ে যাওয়ার সময়। শুভময় কে অবশ্য বলা যেত একটা দিন সাত্যকিকে দিয়ে আসার জন্য। কিন্তু বলা আর হয়ে ওঠেনি। 

মিছিলের কন্ঠ টিভি থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ছে ঘরে। সেই স্বাধীনতা দিবসের রাতেও “উই ওয়ান্ট জাস্টিস” স্লোগানে মুখরিত হয়েছিল তাদের মফঃস্বল শহরের প্রাণকেন্দ্র। পৌলমীর পাঠানো ভিডিওতে দেখেছিল নন্দিতা। শুভময়কে যাওয়ার কথা বলতে সে বলেছিল, “যাদের সারাদিন কোনও কাজ নেই তারা রাত দখল টখল করুক। আমরা খেটে রোজগার, ওসব পোষায় না।” টোটো চালায় পাড়ার যে ছেলেটা সে তো বলেই রেখেছে রাতবিরেতে যেকোনও দরকারে ফোন করতে। তবু একা মেয়ে হয়ে কি সে মাঝরাতে টোটো করে বেরোতে পারে! 

টিভিতে এখন অন্য একটা জায়গার ছবি, হাতে হাত ধরে মানববন্ধন হচ্ছে। বুধবার শান্তিলতাকে ডাক্তার দেখিয়ে ফেরার সময় রাস্তার ধারে অনেক মানুষকে এভাবেই হাতে হাত ধরে দঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিল নন্দিতা। ভাবল একবার বলে, চলুন না মা, আমরাও একটু ওদের সাথে গিয়ে দাঁড়াই। তার আগেই শান্তিলতা বললেন, “এই এখন এক হুজুগ উঠেছে। এত প্রতিবাদ করে হবে টা কী?” আর কিছু বলা হল না।  

মোবাইলের পিং শব্দে চিন্তা ছিঁড়ে গেল। পৌলমী মেসেজ করেছেঃ “সন্ধ্যা সাতটায় চিকিৎসকদের লড়াইএ সংহতি জানিয়ে দশ মিনিট আলো বন্ধ রাখুন।“ ঘড়িতে ছটা আটান্ন। নিজের ঘরের আর বারান্দার আলো নিভিয়ে দিল নন্দিতা। সুখময় ভেতর থেকে চেঁচিয়ে উঠলেন, “আলো নিভে গেল কেন বৌমা? ল্যাম্পটা খারাপ হল নাকি?” সুখময় কানে ভালো শোনেন না। কাছে গিয়ে ল্যাম্প খারাপ হওয়ার কথাই বলবে বলে সুখময়দের ঘরে ঢুকল নন্দিতা। কিন্তু ল্যাম্প নয়, নন্দিতার গলাটাই বোধয় বিগড়ে গিয়ে আওয়াজ বেরলোঃ “মেয়েটাকে যারা বিচ্ছিরিভাবে মারল তাদের শাস্তি চেয়ে সবাই আলো বন্ধ করে প্রতিবাদ জানাচ্ছি বাবা।“



সহজিয়া ঈদ সংখ্যা ২০২৫ এ প্রকাশিত


Tuesday, 21 January 2025

সংশয়ে মিলায় সত্য?

ফেলুদার গল্পে অলৌকিক বা অতিপ্রাকৃত বিষয়ের অবতারণা পাঠকের সংশয়ী মনে প্রশ্ন তোলে। মুকুল কি সত্যিই জাতিস্মর ছিল? সিদ্ধেশ্বর মল্লিক কি সত্যিই ফাঁসি হয়ে যাওয়া আসামিদের সঙ্গে কথা বলতেন? নয়নের আশ্চর্য ক্ষমতার কি কোনও বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা থাকা সম্ভব? ফেলুদার ষাট বছরে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজার উদ্দেশ্যেই এই লেখা। সম্পূর্ণ লেখাটা পড়া যাবে চার নম্বর প্ল্যাটফর্মেঃ

সংশয়ে মিলায় সত্য?, অতনু কুমার, চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম, ২২শে জানুয়ারি ২০২৫




Tuesday, 26 December 2023

জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপঃ ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে

জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ (James Webb Space Telescope) নিয়ে এই প্রবন্ধটা প্রকাশিত হয়ে ছিল সহজিয়া শারদ সংখ্যা ২০২২ এ। সম্পূর্ণ লেখাটা পড়া যাবে https://sohojia.baarta.in/ পোর্টালেঃ  

জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপঃ ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে, অতনু কুমার, সহজিয়া বার্তা, ২৭শে ডিসেম্বর ২০২৩




Tuesday, 12 July 2022

জেঠুকে যা দেখেছি

করোনায় তালাবন্দী হওয়ার আগে যেকোন সাপ্তাহিক কাজের দিনে সকালের দিকে আমাদের বাড়ির সামনে কেউ এলে হয়ত একটা দৃশ্য দেখতে পেতেন৷ বাড়ির অদূরে একটা ছেলেদের আর একটা মেয়েদের স্কুল৷ ছোট ছেলেমেয়েরা স্কুল থেকে ফিরছে, বড়রা স্কুলে যাচ্ছে৷ আমাদের বাড়ির চাতালে লম্বা দাড়িওলা, টাকমাথা এক বৃদ্ধ বসে আছেন৷ ছেলেমেয়েরা প্রত্যেকে যাওয়ার সময় "দাদু টাটা" বলে হাত নাড়িয়ে যাচ্ছে, দাদুও "টা টা" বলে হাত নাড়ছেন৷ কেউ বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করতে করতে বেখেয়ালে এগিয়ে এলে আবার পিছিয়ে এসে "টা টা" দিয়ে যাচ্ছে৷ সামনে "দাদু" বলে সম্বোধন করলেও বাচ্ছারা আড়ালে তাঁকে ডাকত "রবীন্দ্রনাথ" বলে৷ তিনি আমার জেঠু, অরিন্দম কুমার, যিনি গত ৭ই জুলাই, ২০২২ অষ্টআশি বছর বয়সে মারা গেলেন৷

নিঃসঙ্গ জীবনে ঐ ছেলেমেয়েগুলো ছিল তার একমুঠো অক্সিজেন৷ নিঃসঙ্গতা, মানসিক বৈকল্য নিয়েও জেঠু হার মানিয়ে দিয়েছিল সময় কে৷ আমি জন্ম থেকে জেঠুকে যেভাবে দেখছি, মৃত্যুর আগে অবধি তার খুব বেশী পরিবর্তন হয়নি৷ শুধু বাহ্যিক চেহারার জন্য নয়, মনের ভেতরেও জেঠু বেঁচে ছিল তার নিজের সময়ে৷ উত্তম সুচিত্রার সিনেমা, হেমেন্দ্রকুমার রায়, নীহাররঞ্জন গুপ্ত আর সত্যজিৎ রায়ের বই, রবীন্দ্রনাথের গান-কবিতা, দিনে গোটাছয়েক বিড়ি, রোববারের লুচি-আলুর দম, খাটের ওপর হরেক জিনিস দিয়ে ডিজাইন সাজানো আর শৈশব, কৈশোর এর কর্মকাণ্ডের স্মৃতি রোমন্থন - এই নিয়েই তো জেঠু কাটিয়ে দিল৷ ডাই হার্ড ফ্যান ছিল মোহনবাগানের। কোনদিন মোহনবাগান হারলে মনমরা হয়ে থাকত।  মোবাইল বা ল্যান্ড কোন ফোনই নিজের হাতে ব্যবহার করেনি৷ প্যান আধার কোন কার্ডই ছিল না, সেগুলোকে লিঙ্ক করতে কেউ তাড়াও দেয়নি৷ মাস্ক না পরে, ভ্যাকসিন না নিয়েও তিনটে ওয়েভকে জানলার বাইরে থেকেই বিদায় দিয়ে দিলো৷ ওমিক্রনে যখন গোটা বাড়ি কাঁপছে, জেঠু তখন দিব্যি সুস্থ৷ নিজের গৃহবন্দী জীবনকে মেনেই নিয়েছিল৷ এখনও পুলিস নজরবন্দী করে রেখেছে এই ধারণা ছিল বদ্ধমূল৷ ইচ্ছে ছিল খালি একবার বর্ধমান মানে মামাবাড়ির দেশে যাওয়ার - সে ইচ্ছা আর পুরণ হল না৷

দিল্লীর মুঘল স্থাপত্যগুলো আরেকবার ঘুরে দেখারও খুব ইচ্ছে ছিল৷ বিশেষ করে তাজমহল৷ জানি না বন্দী সম্রাট শাজাহান এর সঙ্গে নিজের মিল খুঁজে পেত কি না৷ তবে শাজাহান নয়, নিজেকে বলত বাবর৷ আর আমি হুমায়ূন৷ দিল্লী যেতে না পারলেও অবশ্য চিন্তা ছিল না৷ জেঠুর নিজের ছড়াতেই তো আছেঃ "দয়ালবাবুকা বিল্লী/ এহি তো হ্যায় দিল্লী!" দয়ালবাবু বলতে আমার দাদু দয়াল কুমার৷ আর বিল্লী হল বিল্ডিং এর অপভ্রংশ! কৈলাসে কেলেঙ্কারি উপন্যাসে ফেলুদা রা "বিবি কা মকবরা" দেখতে গিয়েছিল৷ কৈলাসে কেলেঙ্কারি ছবিটা আগ্রহ নিয়ে দেখেছিল ঐ বিবি কা মকবরা একঝলক দেখার জন্য৷


জেঠুর জীবনের প্রথম সিকিভাগে নানাবিধ রাজনৈতিক ও সামাজিক ঘটনার ঘনঘটা৷ আর বাকিটা কেটেছে মনোবিকলনের চিকিৎসা ও তারপর কিছুটা সুস্থ ও স্থিতিশীল অবস্থায় ঘরে বসে৷ ঐ প্রথমের সিকিভাগটুকুই জেঠুর মাথায় ধরা ছিল৷ গান্ধী হত্যার পর খালি পায়ে মিছিল করে শ্মশানে যাওয়া থেকে শুরু করে নাবালক অবস্থায় কারাবন্দী হওয়া
, দমদম জেলে অনশন ধর্মঘটে অংশ নেওয়া, কারামুক্তির পর শ্রমিকদের সংগঠিত করতে ভিলাই যাওয়া ইত্যাদি নানা গল্প জেঠুর কাছে শুনেছি৷ ভিলাই তে হিন্দু মহাসভার লোকেরা জেঠুকে প্রচণ্ড মারধর করে মৃত ভেবে নর্দমায় ফেলে চলে যায়৷ প্রাণে বেঁচে গেলেও মস্তিস্ক বিকৃতির অসুখ জেঠুর বাকি জীবনের সঙ্গী হয়ে ওঠে৷ জেঠুকে কোনদিন ভোট দিতে দেখিনি, কিন্তু পার্টির প্রতি আনুগত্য ছিল সীমাহীন৷ একবার বলেছিলঃ "মা কে জিজ্ঞাসা করেছিলাম আমার জায়গা পার্টির ভেতরে না বাইরে? মা জবাব দিলেন বাইরে৷"

জেঠুর একটা প্রিয় খেলা ছিল একটা শব্দের মধ্য থেকে অক্ষরগুলো কে ভেঙেচুড়ে আরেকটা অর্থপূর্ণ শব্দ বের করা৷ ইংরেজিতে যাকে Anagram বলে, খানিকটা সেইরকম৷ আরেকটা খেলা ছিল নানা মানুষের জন্ম ও মৃত্যুদিন মেলানো মেশানো৷ এইভাবে নেপোলিয়ন বোনাপার্ট, কার্ল মার্কস আর এলবার্ট আইনস্টাইনকে মিলিয়েছিল৷ নেপোলিয়নের মৃত্যুদিন ৫ই মে, যেদিনটা মার্কসের জন্মদিন৷ মার্কসের মৃত্যুদিন ১৪ই মার্চ, যেটা আবার আইনস্টাইনের জন্মদিন৷ এমনিতে আমার সালতারিখ মনে থাকে না, কিন্তু জেঠুর কাছে এগুলো এতবার শুনেছি, যে ভোলার জো নেই৷

মৃত্যুর ছ দিন আগে রথযাত্রা ছিল৷ তখন আর নিজে ওঠা বসা করার ক্ষমতা নেই কথাগুলোও জড়িয়ে যায়, ভালো বোঝা যায় না৷ বিকেলে চা এনে চেয়ারে বসিয়ে দিয়েছি৷ জানলা দিয়ে দেখা যাচ্ছে বাচ্ছারা ছোট ছোট রথ সাজিয়ে টানতে বেরিয়েছে৷ বললাম, "জেঠু আজ রথ"৷ জেঠু একবার জানলার দিকে তাকিয়ে, অস্পষ্ট উচ্চারণে কিন্তু একটুও না থেমে বলে গেলঃ

                                         "রথযাত্রা লোকারণ্য মহা ধূমধাম

ভক্তরা লুটায়ে পথে করিছে প্রণাম

পথ ভাবে আমি দেব, রথ ভাবে আমি,

মূর্তি ভাবে আমি দেব, হাসেন অন্তর্যামী৷"

 



Saturday, 1 May 2021

স্মৃতিতে সত্যজিৎ

সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় নন্দনে৷ সে বছর তিরিশেক আগের কথা৷ খালি এটুকু মনে আছে যে হঠাৎ ঘুম ভেঙে উঠে দেখলাম একটা বড় অন্ধকার ঘরে বসে আছি আর সামনের পর্দায় কিছু একটা হচ্ছে! আসলে সে দিন বাবা মা দাদার সঙ্গে ঘুরতে গেছিলাম৷ চিড়িয়াখানা, যাদুঘর, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল দেখে নন্দনে যখন "হীরক রাজার দেশে"র স্পেশাল শো তে গিয়ে বসলাম তখন আর জেগে থাকতে পারিনি৷ ঘুম ভেঙেছিল একদম দড়ি ধরে মারো টান এর পরে৷ বলাবাহুল্য সেদিনের ঘোরাঘুরির কিছুই আমার মনে নেই৷ সবটাই পরে শোনা৷ কিন্তু ঐ অন্ধকার হলের মধ্যে ঘুম ভেঙে ওঠাটা দিব্যি মনে আছে৷

স্মৃতি ব্যাপারটা বেশ গোলমেলে৷ "যখন ছোট ছিলাম" এ সত্যজিৎ লিখেছেনঃ "পাঁচ বছর বয়সে আমি চিরকালের মতো আমার জন্মস্থান গড়পার রোডের বাড়ি ছেড়ে ভবানীপুরে চলে আসি৷ এই পুরনো বাড়ি থেকে নতুন বাড়ি চলে আসার দিনটা আমি বেমালুম ভুলে গেছি, কিন্তু গড়পারে থাকতে আমাদের রাঁধুনী বামনীর ছেলে হরেনের বিষয় একটা খুব সাধারণ স্বপ্ন দেখেছিলাম সেটা আজও স্পষ্ট মনে আছে৷" স্মৃতির রহস্য এতটাই গভীর যে সে রহস্য ভেদ করার জন্য প্রোফেসর শঙ্কুর ওপরও ভরসা করতে পারেননি তাঁর স্রষ্টা৷ কয়েক মিনিটে হারানো স্মৃতি ফেরানোর যন্ত্র "রিমেমব্রেন" আবিষ্কার করেও প্রোফেসর শঙ্কু তাঁর ডায়েরি তে লিখতে বাধ্য হন, "স্মৃতির গূঢ় রহস্যটা এখনও বিজ্ঞানের ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে৷"

কাশবনের মধ্য দিয়ে অপু দুর্গার রেলগাড়ি দেখতে যাওয়া, তুফান এক্সপ্রেসের কামরায় জটায়ুর আবির্ভাব, বাঁশবনে গুপি-বাঘার সঙ্গে ভূতের রাজার মোলাকাৎ এই সব দৃশ্যগুলোই অন্য সবার মত আমার কাছেও ভীষণ প্রিয়৷ বহুবার দেখার পরও টিভিতে দেখানো হলে চোখটা আটকে যাবেই৷ তেমনই পঞ্চাশবার পড়ার পরেও পুরনো হয়না ফেলুদা বা শঙ্কুর  অ্যাডভেঞ্চার৷ কিন্তু অদ্ভুতভাবে "সত্যজিৎ রায়" নামটা শুনলে আমার মাথায় প্রথমেই আসে একদমই ভিন্ন তিনটি চরিত্রের কথা৷ আজ সেই তিনজনের কথা বলব৷

প্রথমজন হলেন পটলবাবু৷ ছোটবেলা থেকেই যাত্রা, থিয়েটারের নেশা৷ যুদ্ধের বাজারে চাকরি খুইয়ে পেটের ধান্দায় নেমে পড়ে সেই নেশায় ইতি৷ হঠাৎ বাহান্ন বছর বয়সে একটা সিনেমায় অভিনয়ের প্রস্তাব পেলেন, যখন তিনি লোহালক্করের দোকানে ঘোরাঘুরি করছেন একটা কাজের আশায়৷ স্বভাবতই প্রচণ্ড উত্তেজিত হয়ে পটলবাবু শুটিং এর জায়গায় পৌঁছে জানতে পারলেন তাঁর ভূমিকা একজন পথচারীর৷ ব্যস্তসমস্ত নায়কের সঙ্গে ধাক্কা লাগবে আর তিনি বিরক্তিতে "আঃ" বলে বেরিয়ে যাবেন৷ প্রথমে হতাশ হয়ে চলে যাওয়ার কথা ভাবলেও তারপর তাঁর নাট্যগুরু গগন পাকড়াশির উপদেশ মাথায় এলো৷ তিনি উপলব্ধি করলেন ঐ ছোট্ট দৃশ্য আর সংলাপটার মধ্যেও কতরকম সম্ভাবনা লুকিয়ে আছে৷

"আঃ কথাটাই নানান সুরে নানাভাবে বললে মানুষের মনের নানান অবস্থা প্রকাশ করছে৷ চিমটি খেলে মানুষে যেভাবে আঃ বলে, গরমে ঠাণ্ডা খেয়ে মোটেই সেভাবে আঃ বলে না৷ এ দুটো আঃ একেবারে আলাদা রকমের; আবার আচমকা কানে সুড়সুড়ি খেলে বেরোয় আরো আরেক রকম আঃ৷ এছাড়া কতরকম আঃ রয়েছে - দীর্ঘশ্বাসের আঃ, তাচ্ছিল্যের আঃ, অভিমানের আঃ, ছোট করে বলা আঃ, লম্বা করে বলা আ—ঃ, চেঁচিয়ে বলা আঃ, মৃদুস্বরে আঃ, চড়া গলায় আঃ, খাদে গলায় আঃ, আবার আ-টা খাদে শুরু করে বিসর্গটায় সুর চড়িয়ে আঃ— আশ্চর্য! পটলবাবুর মনে হল তিনি ওই একটি কথা নিয়ে একটা আস্ত অভিধান লিখে ফেলতে পারেন৷"

পটলবাবু নিজেই আধঘন্টা একটা নির্জন গলিতে রিহার্সাল দিলেন৷ তারপর ক্যামেরার সামনে নিজের আবেগ, নিষ্ঠা আর পরিশ্রমের ফসল দশ আনা বিরক্তির সঙ্গে তিন আনা বিস্ময় আর তিন আনা যন্ত্রণা মিশিয়ে আঃ উচ্চারণ করে পরিচালককে খুশি করে দিলেন৷ কিন্তু ফিল্মের লোকজন সম্মানদক্ষিণা দিতে গিয়ে পটলবাবু কে আর খুঁজে পেল না৷ পটলবাবুর শিল্পীমনের কদর ফিল্মের দল করতে পারবে বলে তাঁর মনে হয়নি৷

  

দ্বিতীয় যে চরিত্রটার কথা বলব সে হল ব্রাউনি৷ ব্রাউনি মানুষ নয়, কুকুর৷ ব্রাউনিকে যিনি হাসিমারার রাস্তায় এক ভূটানির থেকে কিনেছিলেন সেই অসমঞ্জবাবুর চরিত্রটা অবশ্য সত্যজিতের গল্পে বিরল নয়৷ অসমঞ্জবাবুর মত সাধারণ নিম্নমধ্যবিত্ত বা মধ্যবিত্ত একা মানুষরা ঘুরে ফিরে এসেছে তাঁর লেখায়৷ ফেলুদা, শঙ্কু, তারিনীখুড়োও এই দলে পড়েন৷ তিনজনের কেউই বিয়ে করেন নি৷ লালমোহনবাবুর সঙ্গে আলাপ না হলে ফেলুদার কোন বন্ধু কে খুঁজেই পাওয়া যেত না৷ দেশে দেশে বিবিধ সম্মানে ভূষিত হয়ে প্রোফেসর শঙ্কুর নিশ্চিন্তির ঠিকানা গিরিডিতে উশ্রী নদীর ধারের বাড়িটা, প্রহ্লাদ, নিউটন৷ তারিনীখুড়ো যৌবনে দেশের নানা প্রান্তে বিচিত্র অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে বাকি জীবনটা কলকাতার কিছু বাচ্ছা ছেলেকে গল্প বলেই কাটিয়ে দেন৷ ব্রাউনির বিশেষত্ব হল সে হাসে৷ হাসি মানে হায়েনার হাসি নয়৷ হাসির কারণ ঘটলে তবেই হাসে৷ সে কারণ ঝড়ের মধ্যে মারোয়ারি ব্যবসায়ীর ছাতা উল্টে যাওয়া হতে পারে, সাংবাদিকের তোতলামো হতে পারে বা অসমঞ্জবাবুর চেয়ার ভেঙে পড়ে যাওয়াও হতে পারে৷ কারণ না থাকলে হাসে পাগলে। ব্রাউনি পাগল নয়। তাই কুকুর বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক থেকে পশুচিকিৎসক কারো কাছেই ব্রাউনির হাসির প্রমাণ দেখাতে পারেন না অসমঞ্জবাবু, আর তাঁরা একবাক্যে রায় দিয়ে দেন যে “কুকুর হাসতে পারে না।” এখন টিভি তে নানারকম “রিয়েলিটি শো” হয়, যেখানে দেখা যায় একজন মানুষ স্টেজে দাঁড়িয়ে একটা করে কথা বলছে আর অনুষ্ঠানের সঞ্চালক থেকে শুরু করে বিচারকমণ্ডলী হেসে লুটোপুটি খাচ্ছে। পাছে তাতেও দর্শকের হাসি না পায় তাই ব্যাকগ্রাউন্ডে অদৃশ্য দর্শকের হাসির আওয়াজ শোনানো হয়। ব্রাউনী কে এরকম কোন প্রোগ্রামের সামনে বসিয়ে দিলে সে-ও হয়ত হেসে ফেলত, টিভিওয়ালাদের জোর করে হাসানোর প্রচেষ্টা দেখে।

শেষে এক মার্কিন ধনকুবের হাজির হয়ে নানারকম অঙ্গভঙ্গী করে হাসানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। সে বলে যে অসমঞ্জবাবু যদি তার কুকুরকে হাসিয়ে দেখাতে পারেন তাহলে সে ব্রাউনির জন্য বিশ হাজার ডলার অবধি খরচ করতে রাজি। আর তখনই অট্টহাস্য করে ওঠে ব্রাউনী। সে হাসির অর্থ অসমঞ্জবাবু ছাড়া কারো পক্ষে বোঝা সম্ভব হয় না। কুবের মহাশয় পকেট থেকে চেকবই বের করে নাম লিখতে যাবে, তখন অসমঞ্জবাবু খোলসা করলেন ব্রাউনীর হাসির কারণ- সাহেব ভাবছে টাকা থাকলেই সবকিছু কেনা যায়! সাহেবের সঙ্গে যে বাঙালী ট্যুরিস্ট ম্যানেজার এসেছিল, সে ব্যঙ্গের স্বরে প্রশ্ন করে, “আপনার কুকুর বুঝি দার্শনিক?” এই জীবনদর্শনও আসলে যে আসলে স্রষ্টা সত্যজিতের তা বুঝতে অসুবিধা হয় না৷ সেক্রেটারি পরশ পাথর গিলে ফেলার পর পরেশ বাবুকে দেখা যায় গিন্নী আর চাকরকে নিয়ে নিশ্চিন্তে হাওয়া খেতে। হাল্লার কারাগারে বন্দী গুপি বাঘা গান গেয়ে রাজা কে পরামর্শ দেয়, সোনার সিংহাসন ত্যাগ করে মাঠে নেমে হাওয়া খেতে। নায়ক অরিন্দম কে দেখি টাকার চোরাবালিতে ডুবে গিয়ে বাঁচার জন্যে কাতর আর্তনাদ করতে।



তৃতীয় জনের নাম জানি না৷ পেশায় হাল্লার গুপ্তচর৷ গুপি গাইন বাঘা বাইন ছবিতে বার দুয়েক তাকে হাল্লার মন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতে দেখা গেছে৷ হাল্লার মন্ত্রী চরিত্রটা আমাদের ভীষণ চেনা৷ সে আগে ডাকাত ছিল, এখন মন্ত্রী হয়েছে৷ প্রজাদের না খাইয়ে রেখে নিজে গাণ্ডেপিণ্ডে গেলে৷ যেনতেন প্রকারেণ প্রজাদের অত্যাচার করা আর যুদ্ধ করে অন্য রাজ্য দখল করাতেই তার আনন্দ৷ প্রজাদের ওপর অত্যাচার করার নেশা তার এতই বেশী যে মহামারীতে মূক হয়ে যাওয়া শুণ্ডির প্রজাদের মুখে সে কথা ফিরিয়ে দিতে চায় শুধু এই উদ্দেশ্যে যে কথা না বললে তারা কি চায় জানা যাবে না, তার উল্টো কাজটাও করা যাবে না! যাদের মাধ্যমে সে অত্যাচার করে সেই সৈনিক, কারারক্ষী, গুপ্তচর - এদেরকেও সে না খাইয়ে রাখে৷ তো গুপ্তচর যখন শুণ্ডিতে যায় চরবৃত্তি করতে তার নিজের রাজ্যের অবস্থাটাও নিশ্চয়ই মাথায় থাকে৷ হাল্লার মন্ত্রী জিজ্ঞেস করে, "শুণ্ডিতে যুদ্ধের সাজ সরঞ্জাম কিরম দেখলে?” গুপ্তচর জানায়, “কিচ্ছু নেই। অস্ত্র-শস্ত্র নেই, সৈন্য নেই।” মন্ত্রী অবাক হয়ে বলে, “লোকেরা করে কি? ওরা কি ঘোড়ার ঘাস কাটে?” গুপ্তচর বলে, শুণ্ডিতে ঘোড়া নেই, হাতি নেই, উটও নেই। মন্ত্রী হাসতে হাসতে সিংহাসন থেকে উঠে পড়ে, “হাঃ হাঃ হাঃ! উটও নেই? বাঃ বাঃ! চমৎকার! যুদ্ধের কোন ব্যবস্থাই নেই! … তাহলে আছে টা কি শুনি?” গুপ্তচর তৃপ্তির হাসি হেসে বলে, “ক্ষেতে ফসল আছে। গাছে ফল আছে, ফুল আছে, পাখি আছে …” মন্ত্রীর তাচ্ছিল্যের “হুঁঃ” কে পাত্তা না দিয়ে সে বলে চলে, “দেশে শান্তি আছে, সুখ আছে, হাসি আছে..." সত্যজিৎ বলেছিলেন “গুপি গাইন বাঘা বাইন” নেহাতই একটা ছোটদের রূপকথা। রূপকথা তো বটেই। সেই দেশ “ভালো দেশ’ নয়, যেদেশে অস্ত্র-শস্ত্র, সেনাবাহিনীর সমারোহ করে প্রতিবেশীর সঙ্গে যুদ্ধজিগির তোলা হয়; সেই দেশই ভালো দেশ, যেখানে লোকে পেটভরে খেতে পায়, সুখে শান্তি তে থাকে - রাষ্ট্রের বেতনভুক গুপ্তচরের এই উপলব্ধি রূপকথা ছাড়া কোথায় হতে পারে?


তিনজনের কথাই বলব বলে বসেছিলাম৷ অথচ লিখতে লিখতে ভিড় করে এল আরো কত চরিত্র৷ মগনলালের প্রাইভেট সার্কাসে বন্দী প্রতিভাবান নাইফ থ্রোয়ার অর্জুন, "পণরক্ষা" আবৃত্তি করে মেডেল জেতা শশাঙ্ক সান্যাল, ক্রেনিয়াস গ্রহের অ্যাং এর বন্ধু বঙ্কুবাবু, কাঞ্চনজঙ্ঘার অশোক, যতদিন জান থাকবে ততদিন গান গাওয়ার অঙ্গীকার করা চরণদাস, মন্দিরের জলদূষণ নিয়ে আওয়াজ তুলে "গণশত্রু"র তকমা পাওয়া ডাঃ অশোক গুপ্ত৷ আর সবার শেষে সিধুজ্যাঠার সেই অমোঘ উপদেশঃ "মনের জানলাটাকে বন্ধ করে রেখো না ফেলু৷" আর রাজার আদেশে পাঠশালা বন্ধ হয়ে যাওয়ার মুহূর্তে উদয়ন পণ্ডিতের সেই প্রত্যয়, "এতদিন ধরে যা শিখিয়েছি, তোমরা তা ভুলবে না তো?" আজ লালমোহনবাবু থাকলে বলতেন, "একশো বছর? ছোহ!"

Sunday, 4 April 2021

ভোট ভাবনা

২০২১ সালে পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনের প্রেক্ষাপটে এই লেখাটা প্রকাশিত হয়েছিল চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম ওয়েবপত্রের ৫ই এপ্রিল ২০২১ সংখ্যায়। সম্পূর্ণ লেখাটি পড়ার লিঙ্কঃ

ভোট ভাবনা, অতনু কুমার, চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম, ৫ই এপ্রিল ২০২১




Saturday, 13 March 2021

পাগলা জগাই

"পাগলা জগাই" গল্পটি জয়ঢাক বসন্ত ২০২১ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল। সম্পূর্ণ গল্পটি পড়ার লিঙ্কঃ

পাগলা জগাই, অতনু কুমার, জয়ঢাক, বসন্ত ২০২১