Tuesday, 12 July 2022

জেঠুকে যা দেখেছি

করোনায় তালাবন্দী হওয়ার আগে যেকোন সাপ্তাহিক কাজের দিনে সকালের দিকে আমাদের বাড়ির সামনে কেউ এলে হয়ত একটা দৃশ্য দেখতে পেতেন৷ বাড়ির অদূরে একটা ছেলেদের আর একটা মেয়েদের স্কুল৷ ছোট ছেলেমেয়েরা স্কুল থেকে ফিরছে, বড়রা স্কুলে যাচ্ছে৷ আমাদের বাড়ির চাতালে লম্বা দাড়িওলা, টাকমাথা এক বৃদ্ধ বসে আছেন৷ ছেলেমেয়েরা প্রত্যেকে যাওয়ার সময় "দাদু টাটা" বলে হাত নাড়িয়ে যাচ্ছে, দাদুও "টা টা" বলে হাত নাড়ছেন৷ কেউ বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করতে করতে বেখেয়ালে এগিয়ে এলে আবার পিছিয়ে এসে "টা টা" দিয়ে যাচ্ছে৷ সামনে "দাদু" বলে সম্বোধন করলেও বাচ্ছারা আড়ালে তাঁকে ডাকত "রবীন্দ্রনাথ" বলে৷ তিনি আমার জেঠু, অরিন্দম কুমার, যিনি গত ৭ই জুলাই, ২০২২ অষ্টআশি বছর বয়সে মারা গেলেন৷

নিঃসঙ্গ জীবনে ঐ ছেলেমেয়েগুলো ছিল তার একমুঠো অক্সিজেন৷ নিঃসঙ্গতা, মানসিক বৈকল্য নিয়েও জেঠু হার মানিয়ে দিয়েছিল সময় কে৷ আমি জন্ম থেকে জেঠুকে যেভাবে দেখছি, মৃত্যুর আগে অবধি তার খুব বেশী পরিবর্তন হয়নি৷ শুধু বাহ্যিক চেহারার জন্য নয়, মনের ভেতরেও জেঠু বেঁচে ছিল তার নিজের সময়ে৷ উত্তম সুচিত্রার সিনেমা, হেমেন্দ্রকুমার রায়, নীহাররঞ্জন গুপ্ত আর সত্যজিৎ রায়ের বই, রবীন্দ্রনাথের গান-কবিতা, দিনে গোটাছয়েক বিড়ি, রোববারের লুচি-আলুর দম, খাটের ওপর হরেক জিনিস দিয়ে ডিজাইন সাজানো আর শৈশব, কৈশোর এর কর্মকাণ্ডের স্মৃতি রোমন্থন - এই নিয়েই তো জেঠু কাটিয়ে দিল৷ ডাই হার্ড ফ্যান ছিল মোহনবাগানের। কোনদিন মোহনবাগান হারলে মনমরা হয়ে থাকত।  মোবাইল বা ল্যান্ড কোন ফোনই নিজের হাতে ব্যবহার করেনি৷ প্যান আধার কোন কার্ডই ছিল না, সেগুলোকে লিঙ্ক করতে কেউ তাড়াও দেয়নি৷ মাস্ক না পরে, ভ্যাকসিন না নিয়েও তিনটে ওয়েভকে জানলার বাইরে থেকেই বিদায় দিয়ে দিলো৷ ওমিক্রনে যখন গোটা বাড়ি কাঁপছে, জেঠু তখন দিব্যি সুস্থ৷ নিজের গৃহবন্দী জীবনকে মেনেই নিয়েছিল৷ এখনও পুলিস নজরবন্দী করে রেখেছে এই ধারণা ছিল বদ্ধমূল৷ ইচ্ছে ছিল খালি একবার বর্ধমান মানে মামাবাড়ির দেশে যাওয়ার - সে ইচ্ছা আর পুরণ হল না৷

দিল্লীর মুঘল স্থাপত্যগুলো আরেকবার ঘুরে দেখারও খুব ইচ্ছে ছিল৷ বিশেষ করে তাজমহল৷ জানি না বন্দী সম্রাট শাজাহান এর সঙ্গে নিজের মিল খুঁজে পেত কি না৷ তবে শাজাহান নয়, নিজেকে বলত বাবর৷ আর আমি হুমায়ূন৷ দিল্লী যেতে না পারলেও অবশ্য চিন্তা ছিল না৷ জেঠুর নিজের ছড়াতেই তো আছেঃ "দয়ালবাবুকা বিল্লী/ এহি তো হ্যায় দিল্লী!" দয়ালবাবু বলতে আমার দাদু দয়াল কুমার৷ আর বিল্লী হল বিল্ডিং এর অপভ্রংশ! কৈলাসে কেলেঙ্কারি উপন্যাসে ফেলুদা রা "বিবি কা মকবরা" দেখতে গিয়েছিল৷ কৈলাসে কেলেঙ্কারি ছবিটা আগ্রহ নিয়ে দেখেছিল ঐ বিবি কা মকবরা একঝলক দেখার জন্য৷


জেঠুর জীবনের প্রথম সিকিভাগে নানাবিধ রাজনৈতিক ও সামাজিক ঘটনার ঘনঘটা৷ আর বাকিটা কেটেছে মনোবিকলনের চিকিৎসা ও তারপর কিছুটা সুস্থ ও স্থিতিশীল অবস্থায় ঘরে বসে৷ ঐ প্রথমের সিকিভাগটুকুই জেঠুর মাথায় ধরা ছিল৷ গান্ধী হত্যার পর খালি পায়ে মিছিল করে শ্মশানে যাওয়া থেকে শুরু করে নাবালক অবস্থায় কারাবন্দী হওয়া
, দমদম জেলে অনশন ধর্মঘটে অংশ নেওয়া, কারামুক্তির পর শ্রমিকদের সংগঠিত করতে ভিলাই যাওয়া ইত্যাদি নানা গল্প জেঠুর কাছে শুনেছি৷ ভিলাই তে হিন্দু মহাসভার লোকেরা জেঠুকে প্রচণ্ড মারধর করে মৃত ভেবে নর্দমায় ফেলে চলে যায়৷ প্রাণে বেঁচে গেলেও মস্তিস্ক বিকৃতির অসুখ জেঠুর বাকি জীবনের সঙ্গী হয়ে ওঠে৷ জেঠুকে কোনদিন ভোট দিতে দেখিনি, কিন্তু পার্টির প্রতি আনুগত্য ছিল সীমাহীন৷ একবার বলেছিলঃ "মা কে জিজ্ঞাসা করেছিলাম আমার জায়গা পার্টির ভেতরে না বাইরে? মা জবাব দিলেন বাইরে৷"

জেঠুর একটা প্রিয় খেলা ছিল একটা শব্দের মধ্য থেকে অক্ষরগুলো কে ভেঙেচুড়ে আরেকটা অর্থপূর্ণ শব্দ বের করা৷ ইংরেজিতে যাকে Anagram বলে, খানিকটা সেইরকম৷ আরেকটা খেলা ছিল নানা মানুষের জন্ম ও মৃত্যুদিন মেলানো মেশানো৷ এইভাবে নেপোলিয়ন বোনাপার্ট, কার্ল মার্কস আর এলবার্ট আইনস্টাইনকে মিলিয়েছিল৷ নেপোলিয়নের মৃত্যুদিন ৫ই মে, যেদিনটা মার্কসের জন্মদিন৷ মার্কসের মৃত্যুদিন ১৪ই মার্চ, যেটা আবার আইনস্টাইনের জন্মদিন৷ এমনিতে আমার সালতারিখ মনে থাকে না, কিন্তু জেঠুর কাছে এগুলো এতবার শুনেছি, যে ভোলার জো নেই৷

মৃত্যুর ছ দিন আগে রথযাত্রা ছিল৷ তখন আর নিজে ওঠা বসা করার ক্ষমতা নেই কথাগুলোও জড়িয়ে যায়, ভালো বোঝা যায় না৷ বিকেলে চা এনে চেয়ারে বসিয়ে দিয়েছি৷ জানলা দিয়ে দেখা যাচ্ছে বাচ্ছারা ছোট ছোট রথ সাজিয়ে টানতে বেরিয়েছে৷ বললাম, "জেঠু আজ রথ"৷ জেঠু একবার জানলার দিকে তাকিয়ে, অস্পষ্ট উচ্চারণে কিন্তু একটুও না থেমে বলে গেলঃ

                                         "রথযাত্রা লোকারণ্য মহা ধূমধাম

ভক্তরা লুটায়ে পথে করিছে প্রণাম

পথ ভাবে আমি দেব, রথ ভাবে আমি,

মূর্তি ভাবে আমি দেব, হাসেন অন্তর্যামী৷"

 



Saturday, 1 May 2021

স্মৃতিতে সত্যজিৎ

সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় নন্দনে৷ সে বছর তিরিশেক আগের কথা৷ খালি এটুকু মনে আছে যে হঠাৎ ঘুম ভেঙে উঠে দেখলাম একটা বড় অন্ধকার ঘরে বসে আছি আর সামনের পর্দায় কিছু একটা হচ্ছে! আসলে সে দিন বাবা মা দাদার সঙ্গে ঘুরতে গেছিলাম৷ চিড়িয়াখানা, যাদুঘর, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল দেখে নন্দনে যখন "হীরক রাজার দেশে"র স্পেশাল শো তে গিয়ে বসলাম তখন আর জেগে থাকতে পারিনি৷ ঘুম ভেঙেছিল একদম দড়ি ধরে মারো টান এর পরে৷ বলাবাহুল্য সেদিনের ঘোরাঘুরির কিছুই আমার মনে নেই৷ সবটাই পরে শোনা৷ কিন্তু ঐ অন্ধকার হলের মধ্যে ঘুম ভেঙে ওঠাটা দিব্যি মনে আছে৷

স্মৃতি ব্যাপারটা বেশ গোলমেলে৷ "যখন ছোট ছিলাম" এ সত্যজিৎ লিখেছেনঃ "পাঁচ বছর বয়সে আমি চিরকালের মতো আমার জন্মস্থান গড়পার রোডের বাড়ি ছেড়ে ভবানীপুরে চলে আসি৷ এই পুরনো বাড়ি থেকে নতুন বাড়ি চলে আসার দিনটা আমি বেমালুম ভুলে গেছি, কিন্তু গড়পারে থাকতে আমাদের রাঁধুনী বামনীর ছেলে হরেনের বিষয় একটা খুব সাধারণ স্বপ্ন দেখেছিলাম সেটা আজও স্পষ্ট মনে আছে৷" স্মৃতির রহস্য এতটাই গভীর যে সে রহস্য ভেদ করার জন্য প্রোফেসর শঙ্কুর ওপরও ভরসা করতে পারেননি তাঁর স্রষ্টা৷ কয়েক মিনিটে হারানো স্মৃতি ফেরানোর যন্ত্র "রিমেমব্রেন" আবিষ্কার করেও প্রোফেসর শঙ্কু তাঁর ডায়েরি তে লিখতে বাধ্য হন, "স্মৃতির গূঢ় রহস্যটা এখনও বিজ্ঞানের ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে৷"

কাশবনের মধ্য দিয়ে অপু দুর্গার রেলগাড়ি দেখতে যাওয়া, তুফান এক্সপ্রেসের কামরায় জটায়ুর আবির্ভাব, বাঁশবনে গুপি-বাঘার সঙ্গে ভূতের রাজার মোলাকাৎ এই সব দৃশ্যগুলোই অন্য সবার মত আমার কাছেও ভীষণ প্রিয়৷ বহুবার দেখার পরও টিভিতে দেখানো হলে চোখটা আটকে যাবেই৷ তেমনই পঞ্চাশবার পড়ার পরেও পুরনো হয়না ফেলুদা বা শঙ্কুর  অ্যাডভেঞ্চার৷ কিন্তু অদ্ভুতভাবে "সত্যজিৎ রায়" নামটা শুনলে আমার মাথায় প্রথমেই আসে একদমই ভিন্ন তিনটি চরিত্রের কথা৷ আজ সেই তিনজনের কথা বলব৷

প্রথমজন হলেন পটলবাবু৷ ছোটবেলা থেকেই যাত্রা, থিয়েটারের নেশা৷ যুদ্ধের বাজারে চাকরি খুইয়ে পেটের ধান্দায় নেমে পড়ে সেই নেশায় ইতি৷ হঠাৎ বাহান্ন বছর বয়সে একটা সিনেমায় অভিনয়ের প্রস্তাব পেলেন, যখন তিনি লোহালক্করের দোকানে ঘোরাঘুরি করছেন একটা কাজের আশায়৷ স্বভাবতই প্রচণ্ড উত্তেজিত হয়ে পটলবাবু শুটিং এর জায়গায় পৌঁছে জানতে পারলেন তাঁর ভূমিকা একজন পথচারীর৷ ব্যস্তসমস্ত নায়কের সঙ্গে ধাক্কা লাগবে আর তিনি বিরক্তিতে "আঃ" বলে বেরিয়ে যাবেন৷ প্রথমে হতাশ হয়ে চলে যাওয়ার কথা ভাবলেও তারপর তাঁর নাট্যগুরু গগন পাকড়াশির উপদেশ মাথায় এলো৷ তিনি উপলব্ধি করলেন ঐ ছোট্ট দৃশ্য আর সংলাপটার মধ্যেও কতরকম সম্ভাবনা লুকিয়ে আছে৷

"আঃ কথাটাই নানান সুরে নানাভাবে বললে মানুষের মনের নানান অবস্থা প্রকাশ করছে৷ চিমটি খেলে মানুষে যেভাবে আঃ বলে, গরমে ঠাণ্ডা খেয়ে মোটেই সেভাবে আঃ বলে না৷ এ দুটো আঃ একেবারে আলাদা রকমের; আবার আচমকা কানে সুড়সুড়ি খেলে বেরোয় আরো আরেক রকম আঃ৷ এছাড়া কতরকম আঃ রয়েছে - দীর্ঘশ্বাসের আঃ, তাচ্ছিল্যের আঃ, অভিমানের আঃ, ছোট করে বলা আঃ, লম্বা করে বলা আ—ঃ, চেঁচিয়ে বলা আঃ, মৃদুস্বরে আঃ, চড়া গলায় আঃ, খাদে গলায় আঃ, আবার আ-টা খাদে শুরু করে বিসর্গটায় সুর চড়িয়ে আঃ— আশ্চর্য! পটলবাবুর মনে হল তিনি ওই একটি কথা নিয়ে একটা আস্ত অভিধান লিখে ফেলতে পারেন৷"

পটলবাবু নিজেই আধঘন্টা একটা নির্জন গলিতে রিহার্সাল দিলেন৷ তারপর ক্যামেরার সামনে নিজের আবেগ, নিষ্ঠা আর পরিশ্রমের ফসল দশ আনা বিরক্তির সঙ্গে তিন আনা বিস্ময় আর তিন আনা যন্ত্রণা মিশিয়ে আঃ উচ্চারণ করে পরিচালককে খুশি করে দিলেন৷ কিন্তু ফিল্মের লোকজন সম্মানদক্ষিণা দিতে গিয়ে পটলবাবু কে আর খুঁজে পেল না৷ পটলবাবুর শিল্পীমনের কদর ফিল্মের দল করতে পারবে বলে তাঁর মনে হয়নি৷

  

দ্বিতীয় যে চরিত্রটার কথা বলব সে হল ব্রাউনি৷ ব্রাউনি মানুষ নয়, কুকুর৷ ব্রাউনিকে যিনি হাসিমারার রাস্তায় এক ভূটানির থেকে কিনেছিলেন সেই অসমঞ্জবাবুর চরিত্রটা অবশ্য সত্যজিতের গল্পে বিরল নয়৷ অসমঞ্জবাবুর মত সাধারণ নিম্নমধ্যবিত্ত বা মধ্যবিত্ত একা মানুষরা ঘুরে ফিরে এসেছে তাঁর লেখায়৷ ফেলুদা, শঙ্কু, তারিনীখুড়োও এই দলে পড়েন৷ তিনজনের কেউই বিয়ে করেন নি৷ লালমোহনবাবুর সঙ্গে আলাপ না হলে ফেলুদার কোন বন্ধু কে খুঁজেই পাওয়া যেত না৷ দেশে দেশে বিবিধ সম্মানে ভূষিত হয়ে প্রোফেসর শঙ্কুর নিশ্চিন্তির ঠিকানা গিরিডিতে উশ্রী নদীর ধারের বাড়িটা, প্রহ্লাদ, নিউটন৷ তারিনীখুড়ো যৌবনে দেশের নানা প্রান্তে বিচিত্র অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে বাকি জীবনটা কলকাতার কিছু বাচ্ছা ছেলেকে গল্প বলেই কাটিয়ে দেন৷ ব্রাউনির বিশেষত্ব হল সে হাসে৷ হাসি মানে হায়েনার হাসি নয়৷ হাসির কারণ ঘটলে তবেই হাসে৷ সে কারণ ঝড়ের মধ্যে মারোয়ারি ব্যবসায়ীর ছাতা উল্টে যাওয়া হতে পারে, সাংবাদিকের তোতলামো হতে পারে বা অসমঞ্জবাবুর চেয়ার ভেঙে পড়ে যাওয়াও হতে পারে৷ কারণ না থাকলে হাসে পাগলে। ব্রাউনি পাগল নয়। তাই কুকুর বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক থেকে পশুচিকিৎসক কারো কাছেই ব্রাউনির হাসির প্রমাণ দেখাতে পারেন না অসমঞ্জবাবু, আর তাঁরা একবাক্যে রায় দিয়ে দেন যে “কুকুর হাসতে পারে না।” এখন টিভি তে নানারকম “রিয়েলিটি শো” হয়, যেখানে দেখা যায় একজন মানুষ স্টেজে দাঁড়িয়ে একটা করে কথা বলছে আর অনুষ্ঠানের সঞ্চালক থেকে শুরু করে বিচারকমণ্ডলী হেসে লুটোপুটি খাচ্ছে। পাছে তাতেও দর্শকের হাসি না পায় তাই ব্যাকগ্রাউন্ডে অদৃশ্য দর্শকের হাসির আওয়াজ শোনানো হয়। ব্রাউনী কে এরকম কোন প্রোগ্রামের সামনে বসিয়ে দিলে সে-ও হয়ত হেসে ফেলত, টিভিওয়ালাদের জোর করে হাসানোর প্রচেষ্টা দেখে।

শেষে এক মার্কিন ধনকুবের হাজির হয়ে নানারকম অঙ্গভঙ্গী করে হাসানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। সে বলে যে অসমঞ্জবাবু যদি তার কুকুরকে হাসিয়ে দেখাতে পারেন তাহলে সে ব্রাউনির জন্য বিশ হাজার ডলার অবধি খরচ করতে রাজি। আর তখনই অট্টহাস্য করে ওঠে ব্রাউনী। সে হাসির অর্থ অসমঞ্জবাবু ছাড়া কারো পক্ষে বোঝা সম্ভব হয় না। কুবের মহাশয় পকেট থেকে চেকবই বের করে নাম লিখতে যাবে, তখন অসমঞ্জবাবু খোলসা করলেন ব্রাউনীর হাসির কারণ- সাহেব ভাবছে টাকা থাকলেই সবকিছু কেনা যায়! সাহেবের সঙ্গে যে বাঙালী ট্যুরিস্ট ম্যানেজার এসেছিল, সে ব্যঙ্গের স্বরে প্রশ্ন করে, “আপনার কুকুর বুঝি দার্শনিক?” এই জীবনদর্শনও আসলে যে আসলে স্রষ্টা সত্যজিতের তা বুঝতে অসুবিধা হয় না৷ সেক্রেটারি পরশ পাথর গিলে ফেলার পর পরেশ বাবুকে দেখা যায় গিন্নী আর চাকরকে নিয়ে নিশ্চিন্তে হাওয়া খেতে। হাল্লার কারাগারে বন্দী গুপি বাঘা গান গেয়ে রাজা কে পরামর্শ দেয়, সোনার সিংহাসন ত্যাগ করে মাঠে নেমে হাওয়া খেতে। নায়ক অরিন্দম কে দেখি টাকার চোরাবালিতে ডুবে গিয়ে বাঁচার জন্যে কাতর আর্তনাদ করতে।



তৃতীয় জনের নাম জানি না৷ পেশায় হাল্লার গুপ্তচর৷ গুপি গাইন বাঘা বাইন ছবিতে বার দুয়েক তাকে হাল্লার মন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতে দেখা গেছে৷ হাল্লার মন্ত্রী চরিত্রটা আমাদের ভীষণ চেনা৷ সে আগে ডাকাত ছিল, এখন মন্ত্রী হয়েছে৷ প্রজাদের না খাইয়ে রেখে নিজে গাণ্ডেপিণ্ডে গেলে৷ যেনতেন প্রকারেণ প্রজাদের অত্যাচার করা আর যুদ্ধ করে অন্য রাজ্য দখল করাতেই তার আনন্দ৷ প্রজাদের ওপর অত্যাচার করার নেশা তার এতই বেশী যে মহামারীতে মূক হয়ে যাওয়া শুণ্ডির প্রজাদের মুখে সে কথা ফিরিয়ে দিতে চায় শুধু এই উদ্দেশ্যে যে কথা না বললে তারা কি চায় জানা যাবে না, তার উল্টো কাজটাও করা যাবে না! যাদের মাধ্যমে সে অত্যাচার করে সেই সৈনিক, কারারক্ষী, গুপ্তচর - এদেরকেও সে না খাইয়ে রাখে৷ তো গুপ্তচর যখন শুণ্ডিতে যায় চরবৃত্তি করতে তার নিজের রাজ্যের অবস্থাটাও নিশ্চয়ই মাথায় থাকে৷ হাল্লার মন্ত্রী জিজ্ঞেস করে, "শুণ্ডিতে যুদ্ধের সাজ সরঞ্জাম কিরম দেখলে?” গুপ্তচর জানায়, “কিচ্ছু নেই। অস্ত্র-শস্ত্র নেই, সৈন্য নেই।” মন্ত্রী অবাক হয়ে বলে, “লোকেরা করে কি? ওরা কি ঘোড়ার ঘাস কাটে?” গুপ্তচর বলে, শুণ্ডিতে ঘোড়া নেই, হাতি নেই, উটও নেই। মন্ত্রী হাসতে হাসতে সিংহাসন থেকে উঠে পড়ে, “হাঃ হাঃ হাঃ! উটও নেই? বাঃ বাঃ! চমৎকার! যুদ্ধের কোন ব্যবস্থাই নেই! … তাহলে আছে টা কি শুনি?” গুপ্তচর তৃপ্তির হাসি হেসে বলে, “ক্ষেতে ফসল আছে। গাছে ফল আছে, ফুল আছে, পাখি আছে …” মন্ত্রীর তাচ্ছিল্যের “হুঁঃ” কে পাত্তা না দিয়ে সে বলে চলে, “দেশে শান্তি আছে, সুখ আছে, হাসি আছে..." সত্যজিৎ বলেছিলেন “গুপি গাইন বাঘা বাইন” নেহাতই একটা ছোটদের রূপকথা। রূপকথা তো বটেই। সেই দেশ “ভালো দেশ’ নয়, যেদেশে অস্ত্র-শস্ত্র, সেনাবাহিনীর সমারোহ করে প্রতিবেশীর সঙ্গে যুদ্ধজিগির তোলা হয়; সেই দেশই ভালো দেশ, যেখানে লোকে পেটভরে খেতে পায়, সুখে শান্তি তে থাকে - রাষ্ট্রের বেতনভুক গুপ্তচরের এই উপলব্ধি রূপকথা ছাড়া কোথায় হতে পারে?


তিনজনের কথাই বলব বলে বসেছিলাম৷ অথচ লিখতে লিখতে ভিড় করে এল আরো কত চরিত্র৷ মগনলালের প্রাইভেট সার্কাসে বন্দী প্রতিভাবান নাইফ থ্রোয়ার অর্জুন, "পণরক্ষা" আবৃত্তি করে মেডেল জেতা শশাঙ্ক সান্যাল, ক্রেনিয়াস গ্রহের অ্যাং এর বন্ধু বঙ্কুবাবু, কাঞ্চনজঙ্ঘার অশোক, যতদিন জান থাকবে ততদিন গান গাওয়ার অঙ্গীকার করা চরণদাস, মন্দিরের জলদূষণ নিয়ে আওয়াজ তুলে "গণশত্রু"র তকমা পাওয়া ডাঃ অশোক গুপ্ত৷ আর সবার শেষে সিধুজ্যাঠার সেই অমোঘ উপদেশঃ "মনের জানলাটাকে বন্ধ করে রেখো না ফেলু৷" আর রাজার আদেশে পাঠশালা বন্ধ হয়ে যাওয়ার মুহূর্তে উদয়ন পণ্ডিতের সেই প্রত্যয়, "এতদিন ধরে যা শিখিয়েছি, তোমরা তা ভুলবে না তো?" আজ লালমোহনবাবু থাকলে বলতেন, "একশো বছর? ছোহ!"

Wednesday, 7 October 2020

ব্ল্যাক হোল আর নোবেলঃ অপেক্ষার অবসান

কৃষ্ণগহ্বর (black hole) শব্দটা সংবাদমাধ্যমের কল্যানে আমজনতার কাছে একেবারেই অপরিচিত নয়৷ একশো বছরেরও বেশী সময় ধরে জিনিসটার রহস্য বিজ্ঞানী, কল্পবিজ্ঞান লেখক থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষকে রোমাঞ্চিত করেছে৷ কিন্তু নোবেল পুরস্কারের তালিকায় উঠতে কৃষ্ণগহ্বরের লেগে গেল ২০২০ সাল৷ এবারে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কারের অর্ধেক পাচ্ছেন রবার্ট পেনরোজ৷ তিনি দেখিয়েছেন, কৃষ্ণগহ্বর হল সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ তত্ত্বের অমোঘ ভবিষ্যৎবাণী৷ বাকি অর্ধেক ভাগ করে নিচ্ছেন রেনার্ড গেঞ্জেল এবং আন্দ্রে ঘেজ৷ তাঁরা আকাশগঙ্গা ছায়াপথের কেন্দ্রে একটি অতি ভারী ঘনবস্তু আবিষ্কার করেছেন৷ বলা বাহুল্য ঐ বস্তুটি কৃষ্ণগহ্বর ছাড়া অন্য কিছু হতে পারে না৷ 



ব্ল্যাকহোল নামটা তুলনামূলকভাবে নতুন হলেও ব্ল্যাকহোলের মত কিছু একটা বস্তুর অস্তিত্ত্ব কল্পনা করা হয়েছিল উনবিংশ শতকের আটের দশকে৷ আমরা যদি একটা ঢিলকে ওপর দিকে ছুঁড়ি, সেটা এক সময় নীচে নেমে আসবে৷ যদি আরো জোরে ছুঁড়ি, সেটা আরো ওপরে উঠে আরো একটু দেরিতে মাটিতে পড়বে৷ কিন্তু এতটাও জোরে কি ছুঁড়তে পারি, যাতে করে ঢিলটা আর ফিরে আসবে না, পৃথিবীর অভিকর্ষের মায়া কাটিয়ে মহাশূণ্যে হারিয়ে যাবে? হ্যাঁ পারি, এবং সেই বেগকে বলা হয় মুক্তিবেগ৷ পৃথিবীপৃষ্ঠের ওপর মুক্তিবেগের মান ১১.২ কিমি/সেকেন্ড৷ তো এমন কোন নক্ষত্র যদি থেকে থাকে যার পৃষ্ঠের ওপর মুক্তিবেগ আলোর বেগের চেয়ে বেশী, তাহলে তো সবকিছুই, এমনকি আলোও, আটকে পড়বে ঐ নক্ষত্রের টানে! যদিও সেই কল্পনাকে বাস্তব রূপ দেওয়া যায়নি৷ তারপর ১৯১৫ সালে আইনস্টাইন সাধারণ আপেক্ষিককতার তত্ত্ব ( General Theory of Relativity) বাজারে আনলেন আর সঙ্গে সঙ্গেই সোয়ার্জচাইল্ড একটা নিখুঁত সুষম বৃত্তাকার বস্তুর জন্য আইনস্টাইন সমীকরণের খুব সুন্দর একটা সমাধান বের করে ফেললেন৷ সোয়ার্জচাইল্ডের সমাধানে একটা বিন্দু পাওয়া গেল যেখানে গিয়ে আর পদার্থবিজ্ঞানের কোন জানা নিয়ম কাজ করে না৷ ঐ বিন্দুই হল অনন্যতা (singularity)৷ দেখা গেল অনন্যতাকে ঘিরে ঘটনা দিগন্ত (event horizon) নামে এক বৃত্তাকার তল আছে, যেখান দিয়ে বাইরে থেকে ভেতরে জিনিসপত্র ঢুকবে, কিন্তু ভেতর থেকে কিছু বাইরে বেরোবে না৷ আলোও না৷ পরে আরো অনেক বিজ্ঞানী আইনস্টাইন সমীকরণের সমাধান বের করলেন৷ কেউ ধরলেন ঐ নিখুঁত বৃত্তাকার বস্তুটার ভরের সঙ্গে কিছু আধানও আছে, কেউবা আবার ধরলেন বস্তুটা একটা অক্ষের চারদিকে বনবন করে ঘুরছে৷ মোদ্দাকথা এটাই যে সমাধানগুলো কিছু বিশেষ প্রতিসাম্যের (symmetry) উপস্থিতি ধরে নিয়ে করা৷ তা না করলে অরৈখিক (non linear) আর অত্যন্ত জটিল আইনস্টাইন সমীকরণকে বাগ মানানো যেত না৷ কিন্তু ঘটনা হল ঐরকম নিখুঁত প্রতিসম বস্তু তৈরী হওয়া কার্যত অসম্ভব৷ যত দক্ষ কারিগরই হোক, যত ভালো যন্ত্রই থাকুক একদম নিখুঁত গোলক তৈরী করা আদৌ সম্ভব নয়৷ সৌরজগতে যে গ্রহগুলো আছে বা যেসব নক্ষত্রকে আমরা মোটামুটি ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করতে পেরেছি তারা কেউই নিখুঁত গোলক নয়, সুষম তো নয়ই৷ যাঁরা ভগবান টগবানে বিশ্বাস করেন, ইদানীং তাঁরাও বলেন যে ভগবানের কোন সৃষ্টিই আর যাই হোক, "পারফেক্ট" নয়৷ একদম নিখুঁত প্রতিসাম্য অতএব নেহাত দুর্ঘটনা ছাড়া ঘটা সম্ভব নয়৷ তাই যদি হয়, তো ব্ল্যাকহোল বলেও আসলে কিছু হয় না৷ সোয়ার্জচাইল্ড ও অন্যান্যদের নিখুঁত গোলকের কল্পনা থেকে অঙ্ক কষেই ঐরকম বিজাতীয় বস্তু পাওয়া যাচ্ছে৷ 

অন্তত ষাটের দশক অবধি বিজ্ঞানীরা এটাই মনে করতেন৷ তারপর রবার্ট পেনরোজ এবং স্টিফেন হকিং এর অনন্যতা উপপাদ্য (singularity theorem) তাঁদের নিশ্চিন্তির ঘুমে ব্যাঘাত ঘটাল৷ (হকিং জীবিত থাকলে নিশ্চিতভাবেই নোবেল পুরস্কারে ভাগ বসাতে হাজির হয়ে যেতেন) পেনরোজ এবং হকিং দেখালেনঃ যদি মহাকর্ষই একমাত্র চালিকাশক্তি হয় আর আইনস্টানের সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ মহাকর্ষের সঠিক ব্যাখ্যা হয় আর পদার্থের চরিত্র বিদঘুটে (যেমন বিকর্ষণধর্মী মহাকর্ষ) কিছু না হয় তাহলে অনন্যতা অবশ্যম্ভাবী৷ সংশ্লিষ্ট তারাটির গঠনে নিখুঁত প্রতিসাম্য থাকল কি না তাতে কিছু আসে যায় না৷ 

আকাশগঙ্গা ছায়াপথ

পেনরোজ, হকিং অঙ্ক কষে কৃষ্ণগহ্বরের অস্তিত্বকে নিশ্চিৎ করেছিলেন৷ কৃষ্ণগহ্বরের উপস্থিতির প্রত্যক্ষ প্রমাণ দিলেন রেনার্ড গেঞ্জেল এবং আন্দ্রে ঘেজের নেতৃত্বে দুদল গবেষক৷ এখন আমরা কোন বস্তুকে দেখতে পাই কারণ সেই বস্তুতে প্রতিফলিত হয়ে আলো আমাদের চোখে আসে৷ দৃশ্যমান আলো না হলেও এক্স রে ব্যবহার করে শরীরের ভেতরের হাড়ের ছবি বা ইনফ্রা রেড ক্যামেরায় অন্ধকারেও কোন প্রাণীর ছবি তোলা যায়৷ কিন্তু ব্ল্যাকহোল থেকে যেহেতু কোন বিকিরণই বাইরে আসে না, তাই তাকে সরাসরি দেখা সম্ভব নয়৷ কিন্তু ব্ল্যাকহোলের আশেপাশের বস্তুগুলোর গতিবিধি থেকে ব্ল্যাকহোলের অস্তিত্ব জানা সম্ভব৷ বহুদিন আগেই ধনুরাশির মধ্যের একটি তারা Sagittarius A* থেকে তীব্র রেডিও সিগন্যাল পাওয়া গেছিল এবং সেই তারাটি যে আকাশগঙ্গা ছায়াপথের কেন্দ্রস্থলে আছে তাও বোঝা গেছিল৷ আমাদের ছায়াপথটা একটা জিলিপির মত৷ যে জিলিপির এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে আলো পৌঁছতে এক লক্ষ বছর সময় লেগে যায়৷ গেঞ্জেল এবং ঘেজের নেতৃত্বে গবেষকরা দেখলেন ঐ জিলিপির একদম কেন্দ্রের আশেপাশের কিছু নক্ষত্র প্রচণ্ড গতিতে কেন্দ্রকে প্রদক্ষিণ করছে৷ মেলা বা সার্কাসে একটা খেলা দেখেছিঃ একটা বৃত্তাকার ঘরের ভেতরের দেয়ালের মধ্যে কয়েকজন বাইক আরোহী প্রচণ্ড গতিতে ছোটাছুটি করছে, কিন্তু কেউ কারোকে ধাক্কা মারছে না৷ খেলাটার নাম ছিল মৃত্যুকূপ৷ ছায়াপথের কেন্দ্রের তারাগুলোর আচরণও ঐরকম৷ আর সূর্যের মত তারাগুলো কেন্দ্র থেকে অনেক দূরে, জিলিপির প্যাঁচের ওপর বসে হেলেদুলে কেন্দ্রকে প্রদক্ষিণ করছে৷ সার্কাসের তাঁবুর চারদিকে হেঁটে হেঁটে ঘোরার মত৷ S2 নামে একটা কেন্দ্রস্থলের একটা তারা মাত্র ১৬ বছরে ছায়াপথের কেন্দ্রকে প্রদক্ষিণ করে৷ অন্যদিকে আমাদের সূর্য, যে কেন্দ্র থেকে যার দূরত্ব ছাব্বিশ হাজার আলোকবর্ষ, তার এক পাক ঘুরতে সময় লাগে ২০ কোটি বছর! ঐ সময়টাকে যদি একবছর বলি, তাহলে বলবঃ "এই তো গেল বছর টিরেনোসরাসটা ঐ পুকুরপারে ডিম পেড়ে গেল৷" এখন সৌরজগতের ক্ষেত্রেও আমরা দেখেছি সূর্যের কাছের গ্রহগুলো যেমন বুধ, শুক্র এরা পাক খায় খুব তাড়াতাড়ি৷ আবার যত সৌরজগতের বাইরের দিকে যাওয়া যায় তত প্রদক্ষিণকাল বাড়তে থাকে৷ বুধের এক বছর হয় ৮৮ দিনে, বামন গ্রহ প্লুটোর ৯০ হাজার দিনে৷ এর কারণ সৌরজগতের প্রায় পুরো ভরটাই কেন্দ্রে সূর্যের মধ্যে জমা হয়ে আছে৷ যে গ্রহ সূর্যের যত কাছে, তার ওপর সূর্যের টান তত বেশী আর তার প্রদক্ষিণের গতিও তত বেশী৷ ছায়াপথের ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার৷ নক্ষত্রগুলোর গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করে বোঝা গেল আকাশগঙ্গা ছায়াপথের ঠিক কেন্দ্রে সূর্যের ভরের চল্লিশ লক্ষগুণ ভারী কোন অদৃশ্য বস্তু অর্থাৎ ব্ল্যাক হোল রয়েছে৷ এত ভারী ব্ল্যাক হোলের সৃষ্টি কিভাবে হল সে ব্যাপারে অবশ্য বিজ্ঞানীরা এখনও নিশ্চিৎ নন৷

ইভেন্ট হরাইজন টেলিস্কোপে তোলা ব্ল্যাকহোলের ছবি

একটা প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক৷ পেনরোজের অনন্যতা উপপাদ্য তো সেই ষাটের দশকের ব্যাপার৷ আর রেনার্ড গেঞ্জেল, আন্দ্রে ঘেজদের পর্যবেক্ষণ নব্বইএর দশকের৷ তাহলে নোবেল পুরস্কার আসতে এত দেরি হল কেন? আসলে কোন প্রত্যক্ষ পরীক্ষালব্ধ প্রমাণ ছাড়া শুধুমাত্র তাত্ত্বিক গবেষণার জন্য নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয় না৷ বছরখানেক আগে সাড়ে পাঁচ কোটি আলোকবর্ষ দূরের M87 ছায়াপথের কেন্দ্রীয় কৃষ্ণগহ্বরের ছবি তুলেছে ইভেন্ট হরাইজন টেলিস্কোপ৷ ২০১৫ তে দুই কৃষ্ণগহ্বরেরর সংঘর্ষের খবরও মিলেছে মহাকর্ষীয় তরঙ্গের হাত ধরে৷ কৃষ্ণগহ্বর এখন আর তত্ত্ব আর অঙ্কের বিষয় নয়, ঘোর বাস্তব৷

২০১১ সালে মহাবিশ্বের ক্রমবর্ধমান প্রসারণের হার (Accelerated Exapasion of the Universe), ২০১৭ তে মহাকর্ষীয় তরঙ্গ (Gravitational Waves), ২০১৯ এ বিশ্বতত্ত্ব ( Cosmology) ও বহির্গ্রহ (Exoplanet) আর ২০২০ তে কৃষ্ণগহ্বর - একবিংশ শতকের দ্বিতীয় দশকে পদার্থবিজ্ঞানের নোবেল পুরস্কারের প্রায় অর্ধেক এল আছে মহাকাশ থেকে৷ এমন কি ২০১৩ তে হিগস বোসনের (Higgs Boson) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে মহাবিশ্বের রহস্য সমাধানে৷ শেষ করার আগে একজন মানুষের কথা বলে যাই৷ পঞ্চাশের দশকে কলকাতার Indian Association for the Cultivation of Science এর এক গবেষক, প্রচণ্ড প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে বসে একটা পেপার লিখলেন৷ সেই পেপারের উপপাদ্য একটা সমীকরণ, যা এখন জেনারেল রিলেটিভিটির যেকোন টেক্সটবই য়ে অবশ্যপাঠ্য৷ গবেষকটির নাম অমলকুমার রায়চৌধুরী, একেআর নামেই যিনি সমধিক পরিচিত৷ রায়চৌধুরী সমীকরণের ওপর ভিত্তি করেই হকিং ও পেনরোজ তাঁদের অনন্যতা উপপাদ্যে উপনীত হন৷ 

সত্যেন দত্ত থাকলে হয়ত লিখতেনঃ
"অন্ধকূপের আগল ভাঙিল বাঙালীর উপপাদে,
বিধাতার কাজ সাধিবে বাঙালী ধাতার আশীর্বাদে৷"
অমলকুমার রায়চৌধুরী


 

Saturday, 20 June 2020

সূর্যগ্রহণ নিয়ে কিছু কথা।

আজ আকাশে করোনা দেখা যেতে পারে৷ না, করোনা ভাইরাস নয়৷ সূর্যের মুকুট অর্থাৎ বায়ুমণ্ডলের সবচেয়ে বাইরের অংশ হল করোনা৷ সাধারণ সময়ে আমরা সূর্যের যে অংশটা দেখি তা হল ফটোস্ফিয়ার৷ তার বাইরে ক্রোমোস্ফিয়ার এবং করোনা ফটোস্ফিয়ারের থেকে অনেক বেশী উত্তপ্ত হলেও পদার্থের ঘনত্ব খুব কম হওয়ার কারণে ঐ অঞ্চলগুলোর উজ্জ্বলতাও কম৷ তাই করোনাকে দেখা সম্ভব যদি ফটোস্ফিয়ারকে পুরোপুরি আড়াল করে দেওয়া যায়৷ পুরোপুরি না হলেও কাল ফটোস্ফিয়ারকে প্রায় ৩৯ সেকেন্ডের জন্য অনেকখানি ঢেকে দেবে চাঁদ৷ এত ভ্যানতাড়া করে যেটা বললাম সেটা হল আজ সূর্যগ্রহণ৷ বলয়গ্রাস সূর্যগ্রহণ৷ তিনটে মহাজাগতিক ঘটনা যুগপৎ ঘটলে বলয়গ্রাস সূর্যগ্রহণ ঘটতে পারে৷ (১) সূর্য ও চাঁদ উভয়েই পৃথিবীর একই দিকে থাকবে (যা প্রতি অমাবস্যাতেই ঘটে), (২) সূর্য, পৃথিবী ও চাঁদ একই তলে থাকবে, (৩) পৃথিবী থেকে চাঁদের দূরত্ব সর্বাধিক হবে৷ এর মধ্যে প্রথম দুটো শর্ত পূরণ হলেই সূর্যগ্রহণ ঘটে৷ কিন্তু বলয়গ্রাস অর্থাৎ আগুণের আংটি দেখার জন্য চাই তৃতীয় শর্তটাও৷ তৃতীয় শর্ত পূরণ না হলে চাঁদ গোটা সূর্যটাকেই ঢেকে ফেলবে, যাকে আমরা বলি পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ৷ পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণের সময়েই অবশ্য করোনা কে ভালোভাবে দেখা যায়৷ আজ আমরা পশ্চিমবঙ্গ থেকে সেই আগুণের আংটি দেখতে পাবো না৷ সূর্যের কেন্দ্রর সঙ্গে চাঁদের কেন্দ্রকে যদি একটা সরলরেখা দিয়ে যুক্ত করা হয়, সেই সরলরেখা পৃথিবীর ওপর যে রাস্তা দিয়ে যাবে, সেই রাস্তা থেকে বলয়গ্রাস সূর্যগ্রহণ দেখা যাবে৷ ভারতের মধ্যে বলয়গ্রাসের রাস্তাটা পাকিস্তান থেকে ঢুকে রাজস্থান, হরিয়ানা, উত্তরাখণ্ডের ওপর দিয়ে তিব্বতের দিকে চলে যাবে৷ তবে আমাদের একেবারে হতাশ হওয়ার কিছু নেই৷ বলয়গ্রাস না হলেও আংশিক সূর্যগ্রহণ আমরা দেখতে পাবো সকালে পৌনে এগারোটা থেকে দুপুর সওয়া দুটো পর্যন্ত৷ সাড়ে বারোটা নাগাদ চাঁদ সূর্যের প্রায় ৬৫% ঢেকে যাবে৷

এতক্ষণ যা বকবক করলাম তা মোটামুটি সবাই ছোটবেলায় ভূগোল বইয়ে পড়েছেন৷ তবু ঐ জানা কথাগুলো বলার উদ্দেশ্য হল এটা আরেকবার বুঝে নেওয়া যে সূর্যগ্রহণ একেবারেই একটা মহাজাগতিক জ্যামিতির খেলা৷ হিন্দু পুরাণে ও জ্যোতিষশাস্ত্র অনুযায়ী সূর্যগ্রহণের সময় রাহু নামক একটা দৈত্য সূর্যকে গিলে ফেলে৷ শাস্ত্রের নির্দেশঃ গ্রহণ চলাকালীন কিছু খাওয়া যাবে না, রান্না করা খাবার ফেলে দিতে হবে, গ্রহণ শেষ হয়ে গেলে বাসনপত্র ভালো করে মাজতে হবে, বাইরে বেরনোর জামাকাপড় কেচে ফেলতে হবে৷ গর্ভবতী মহিলারা গ্রহণের সময় বাইরে বেরোলে গর্ভের শিশু বিকলাঙ্গ হয়ে যাবে ইত্যাদি৷ ইসরো যখন চাঁদে মহাকাশযান পাঠাচ্ছে আর সেই খবর ভারতবাসী গর্বের সঙ্গে শেয়ার করছে, সেই সময়ে দাঁড়িয়ে লোকে এইসবে বিশ্বাস করবে - এটা মানতে মন চায় না৷ তবু বাস্তব বড় বিচিত্র৷ বহু উচ্চশিক্ষিত মানুষও জন্মলগ্নে সূর্য কোন রাশির সামনে ছিল তার ওপর নিজের ভাগ্য নির্ভর করে, আঙুলে কিছু পাথর ধারণ করে সেই ভাগ্যকে বদলে ফেলা যায় বলে বিশ্বাস করেন! তারওপর এখন এইসমস্ত কুসংস্কারকে হাজির করা হচ্ছে বিজ্ঞানের মোড়কে! সূর্যগ্রহণের সময় নাকি সূর্যের আলো কমে যাওয়ার কারণে জীবাণুদের দাপট বেড়ে যায়৷ তাই যদি হত তাহলে তো মনুষ্যপ্রজাতি কবেই বিলুপ্ত হয়ে যেত! প্রতিদিন তো বারোঘন্টা করে সূর্যের আলো থাকে না, মেঘ করলে দিনের বেলায়ও সূর্যের আলো কমে যায়! জনৈক "বিজ্ঞানী" শুনলাম বলেছেন যে সূর্যগ্রহণের সঙ্গে সঙ্গেই করোনা ভাইরাস পৃথিবী থেকে বিদায় নেবে৷ এইসব মহাজাগতিক ঘটনার সঙ্গে যে মানুষের বা জীবজগতের বিন্দুমাত্র সম্পর্ক নেই তা জোরের সঙ্গে বলা দরকার৷ তাই নির্ভয়ে যেকোন জায়গায় যান, পছন্দের খাবার খেতে খেতে সূর্যগ্রহণ দেখুন৷

তার মানে অবশ্য এটা নয় যে সূর্যগ্রহণের সময় কোনরকম সতর্কতার প্রয়োজন নেই৷ ভুলেও খালিচোখে বা রোদচশমা দিয়ে সূর্যগ্রহণ দেখতে যাবেন না৷ সূর্যের আলো সরাসরি চোখে পড়লে রেটিনার স্থায়ী ক্ষতি হতে পারে৷ সূর্যগ্রহণ দেখুন সোলার ফিল্টারের সাহায্যে বা পিনহোল ক্যামেরা বানিয়ে৷ আর সূর্যগ্রহণ দেখার উৎসাহে স্যোসাল ডিস্ট্যান্সিং ভাঙবেন না৷ সূর্যের করোনা পৃথিবীর করোনা কে নিকেশ করতে পারবে না৷


আজকের দিনটা আরেকটা কারণেও বিশিষ্ট৷ আজ কর্কট সংক্রান্তি৷ সূর্য উত্তরায়ণ শেষ করে দক্ষিণপন্থী হবে৷ সূর্যের আলো পৃথিবীর ওপর সবচেয়ে তেরছা ভাবে পড়বে৷ যার ফলে উত্তর গোলার্ধে আজ সবচেয়ে বড় দিন আর সবচেয়ে ছোট রাত্রি৷ একটা দিন নাহয় ধর্ম, বর্ডার, ডিপ্রেশন এইসব তুচ্ছ জিনিস ভুলে মহাকাশের কাণ্ডকারখানা অনুভব করার চেষ্টা করি৷

ছবিতে রইল পিনহোল ক্যামেরায় তোলা গ্রহণ চলাকালীন সূর্যের ছবি। ফেসবুক লিঙ্ক

Friday, 12 June 2020

বিষ্ণুপুরঃ ক্যাপশন স্টোরি (প্রথম পর্ব)

বছর চারেক আগের কথা। পুজোয় বেড়ানোর প্রোগ্রাম তো প্রতিবারই থাকে। সেইবছরও ছিল। ভাইজাগ-আরাকু ভ্যালির টিকিট কাটা। কিন্তু কলেজে ন্যাক ভিজিটের কারণে পুজোর ছুটি সংক্ষিপ্ত হয়ে গেল। তাই বাধ্য হয়ে টিকিট ক্যানসেল করতে হল। কিন্তু তাই বলে পুজোর বেড়ানোটা একেবারে বাদ যাবে, তা তো হতে দেওয়া যায় না। তাই নাকের বদলে নরুণের মত মুকুটমণিপুর আর বিষ্ণুপুর। অবশ্যি গিয়ে বুঝলাম নরুণটাও ফেলনা নয়। এমন নরুণ পেলে নাক ত্যাগ করতে খুব বেশি কষ্ট হবে না। যাওয়ার সময় আমরা হুল এক্সপ্রেসে গিয়ে নামলাম দুর্গাপুরে। সেখান থেকে বাসে মুকুটমণিপুর। দুদিন কাটিয়ে গাড়ি ভাড়া করে এলাম বিষ্ণুপুর। রাজ্য পর্যটন দপ্তরের ট্যুরিস্ট লজে বুকিং ছিল। বিকেলের দিকে লজ থেকে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে রাসমঞ্চের দিকে যেতেই গাইড মিঠু ভুঁই মশাই পাকড়াও করলেন। সেদিন এবং তার পরের দিন তাঁর সঙ্গে টোটো করে ঘুরে বেড়ালাম বাংলার মধ্যযুগের ইতিহাসের আনাচ কানাচ দিয়ে।


মৃণ্ময়ী মন্দির

মৃণ্ময়ী মন্দির, বিষ্ণুপুর
আজকের বিষ্ণুপুর, সেদিনের ছিল অতীতের মল্লভূম রাজ্যের রাজধানী। কেউ কেউ বলেন মল্লরাজারা রাজপুতানা থেকে এসেছিলেন। আমাদের গাইডও তাই বললেন। আবার কিছু ঐতিহাসিকের মতে মল্লরাজারা স্থানীয় আদিবাসীদের বংশধর ছিলেন। 

মৃণ্ময়ী মন্দির, বিষ্ণুপুর
মল্লরাজ জগৎমল্ল মৃণ্ময়ী অর্থাৎ দুর্গার মন্দিরটি তৈরী করেন ৯৯৭ সালে। বৈষ্ণব হওয়ার আগে মল্লরাজারা শিব ও শক্তির উপাসক ছিলেন। এখনো রাজপরিবারের সদস্যদের তত্ত্বাবধানে দুর্গাপুজো হয় এখানে। 


মল্লেশ্বর মন্দির

মল্লেশ্বর মন্দির
মল্লেশ্বর মানে শিব। মল্লরাজা বীরহাম্বির এটার নির্মাণকার্য শুরু করেন। আচার্য শ্রীনিবাস গোস্বামীর কাছে বৈষ্ণবধর্মে দীক্ষিত হওয়ার পর তিনি এই মন্দিরের নির্মাণ কাজ বন্ধ রাখেন। পরে বীরসিংহ সম্পূর্ণ করেন। নির্মাণকাল আনুমানিক ১৬২২।

গাজনের মেলায় এগুলোয় চড়ে খেলা দেখানো হয়। মল্লেশ্বর মন্দিরের ভিতরেই রাখা আছে।

 অভিনেতা অভি ভট্টাচার্যের বাড়ি ও নাটমন্দির। মল্লেশ্বর মন্দিরের পাশেই।


শ্রীনিবাস গোস্বামীর সমাধি


ষোড়শ শতকে বৃন্দাবনের গোস্বামীরা গরুর গাড়িতে করে অনেকগুলো বৈষ্ণব পুঁথি পাঠাচ্ছিলেন। পথে মল্লভূমের গোপালপুর গ্রামে বইগুলো লুঠ হয়। লুন্ঠিত গ্রন্থের মধ্যে কৃষ্ণদাস কবিরাজ রচিত "শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত"র আসল পাণ্ডুলিপিও ছিল বলে শোনা যায়। গাড়িতে ধনরত্ন আছে মনে করে রাজা বীরহাম্বিরই ওগুলো লুঠ করিয়েছিলেন। বইগুলোর সন্ধানে রাজসভায় উপস্থিত হয়ে শ্রীনিবাস আচার্য দেখলেন এক পণ্ডিত পুঁথিগুলো পাঠ করছেন এবং ভুল ব্যাখ্যা দিচ্ছেন। তখন শ্রীনিবাস আচার্য এগিয়ে আসেন এবং সঠিক ব্যাখ্যা করে বীরহাম্বিরকে আকৃষ্ট করেন। তারপর এই শ্রীনিবাস আচার্যর কাছেই বীরহাম্বির বৈষ্ণবধর্মে দীক্ষিত হন।


শ্রীনিবাস গোস্বামীর সমাধি, বিষ্ণুপুর


রাসমঞ্চ 

রাসমঞ্চ, বিষ্ণুপুর

বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত হওয়ার পর বীর হাম্বির এই রাসমঞ্চটি প্রতিষ্ঠা করেন ১৬০০ সালে। তলায় মাকড়া পাথরের বর্গাকার বেদী। ওপরের স্থাপত্য ইঁটের। সৌধের চূড়াটা মিশরের পিরামিডের মত, মাঝে বাংলার চালা আর তলায় ইসলামিক স্থাপত্যের খিলান।

রাসমঞ্চ, বিষ্ণুপুররাসমঞ্চ, বিষ্ণুপুর

রাসমঞ্চে মোট ১০৮টা খিলান আছে। রাস উৎসবের সময় বিভিন্ন মন্দির থেকে বিগ্রহগুলোকে নিয়ে আসা হত।
  
 রাসমঞ্চের দেওয়ালের ভাস্কর্য। বাঁদিকে চৈতন্য মহাপ্রভু কে দেখা যাচ্ছে।

খিলানের মাথায় প্রস্ফুটিত পদ্মের মত ছবি।


শ্যামরায় পঞ্চরত্ন মন্দির

শ্যামরায় পঞ্চরত্ন মন্দির, বিষ্ণুপুর

রত্ন অর্থে চূড়া। বাঁকানো চারচালা বাংলাঘরের ওপর চারকোণে চারটে দেউল। মাঝখানে একটা ছয়চালাবিশিষ্ট দেউলের ওপর একটা গম্বুজ। আমাদের গাইড বললেন চারটে ছোট দেউল যথাক্রমে বাংলার চালাঘর, উড়িষ্যার মন্দির, বৌদ্ধ ও জৈন স্থাপত্যের অনুকরণে নির্মিত। আর মাঝখানের গম্বুজটায় তো ইসলামিক স্থাপত্যের ছাপ স্পষ্ট।মন্দিরের প্রবেশপথের ঠিক ওপরে খোদাই করা আছেঃ 
"শ্রীরাধাকৃষ্ণমুদে শশাঙ্ক বেদাঙ্ক যুক্তে নবরত্নম,
 শ্রীবীরহম্বীর নরেশ সূনুর্দদৌ নৃপঃ শ্রী রঘুনাথ সিংহ।। 
মল্ল সকে ৯৪৯। শ্রীরাজা বীরসিংহ।" 
অর্থাৎ রাধাকৃষ্ণের আনন্দের জন্য নরেশ বীর হাম্বীরের পুত্র রঘুনাথ সিংহ এই মন্দিরটি দান করলেন ৯৪৯ মল্লাব্দে (১৬৪৩ খৃষ্টাব্দে)। ৬৯৪ সালে আদি মল্লের সিংহাসনারোহণের সময় থেকে মল্লাব্দের শুরু।

শ্যামরায় পঞ্চরত্ন মন্দির, বিষ্ণুপুর
বিষ্ণুপুরের যে সমস্ত মন্দিরে টেরাকোটার কাজ রয়েছে সেগুলোর মধ্যে অন্যতম শ্যামরায় পঞ্চরত্ন মন্দির।

শ্যামরায় পঞ্চরত্ন মন্দির, বিষ্ণুপুর
রাজস্থানী স্থাপত্যের অনুকরণে নকল দরজা।

শ্যামরায় পঞ্চরত্ন মন্দির, বিষ্ণুপুর
রাম রাবণের যুদ্ধ।

শ্যামরায় পঞ্চরত্ন মন্দির, বিষ্ণুপুর
কৃষ্ণের রাসলীলা।

রাসচক্র।


জোড়বাংলা মন্দির 

জোড়বাংলা মন্দির, বিষ্ণুপুর
জোড়বাংলা বা কেষ্ট রায় মন্দিরটি নির্মিত হয়েছিল ১৬৫৫ সালে, মল্লরাজা রঘুনাথ সিংহের সময়ে। দুটো দোচালা বাংলা ঘর জুড়ে তৈরী হয়েছে বলে এর নাম জোড়বাংলা। মাঝখানে একটা চারচালার চূড়া।

জোড়বাংলা মন্দির, বিষ্ণুপুর
ভীস্মের শরশয্যা।

জোড়বাংলা মন্দির, বিষ্ণুপুর
ওপরে পশুপালকদের গরু, ছাগল চড়ানোর দৃশ্য। মাঝে বালি-সুগ্রীবের যুদ্ধ; রামচন্দ্র পেছন থেকে অন্যায় যুদ্ধে বালিকে হত্যা করছে। তলায় একজন মানুষ বাঘ শিকার করছে।

জোড়বাংলা মন্দির, বিষ্ণুপুর
ওপরে ঘরোয়া জীবনযাত্রার ছবি। মাঝখানে মোগল সম্রাট পায়রা ওড়াচ্ছেন। তলায় হাতি, ঘোড়া, উটের পিঠে চেপে যুদ্ধযাত্রায় বেরোচ্ছে মোগল সেনা

জোড়বাংলা মন্দির, বিষ্ণুপুর
সুজাতা বুদ্ধদেবকে পায়েস খাওয়াচ্ছে।

জোড়বাংলা মন্দির, বিষ্ণুপুর
যুদ্ধ, শিকার, সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ছবি, রামায়ণ-মহাভারতের গল্প - সবই রয়েছে জোড়বাংলা মন্দিরের দেওয়ালে। কিছু নষ্ট হয়ে গেছে। আবার অনেকগুলোই টিকে আছে।

জোড়বাংলা মন্দির, বিষ্ণুপুর
কৃষ্ণের মন্দিরে ইসলামিক স্থাপত্য।
 

লালজী মন্দির

লালজী মন্দির, বিষ্ণুপুর
রাধা ও কৃষ্ণকে আনন্দ দেওয়ার জন্য দ্বিতীয় বীরসিংহ ১৬৫৮ সালে এই একরত্ন মন্দিরটি প্রস্তুত করেন। মূলত রাজপরিবারের মহিলারা এখানে পুজো দিতে আসতেন। মন্দিরের সঙ্গে নাটমঞ্চ ও ভোগ রান্নার ঘর রয়েছে।

লালজী মন্দিরের পাশের এই মাঠটায় চৈত্র সংক্রান্তিতে গাজনের মেলা বসে। এখন অবশ্য ক্রিকেট খেলা চলছে।

বড় পাথর দরজা 

বড় পাথর দরজা, বিষ্ণুপুর
বিষ্ণুপুরের প্রাচীন দুর্গের উত্তরদিকের প্রবেশপথ হল মাকড়া পাথরের তৈরী বড় দরজাটা। বীরসিংহ সপ্তদশ শতকের মধ্যভাগে এটা তৈরী করেন। দরজার সামনে একটা পরিখা রয়েছে।

বড় পাথর দরজা, বিষ্ণুপুর
বড় পাথর দরজার তোরণের প্রবেশপথের দুপাশে সৈন্যদের লুকিয়ে থাকার জায়গা রয়েছে। তলায় ছোট ছোট গর্ত দিয়ে শত্রুর দিকে তীর বা গুলি ছোঁড়া হত।


মদনমোহন মন্দির 

মদনমোহন মন্দির, বিষ্ণুপুর
দুর্জন সিংহর আমলে ১৬৯৪ সালে এই একরত্ন ইঁটের মদনমোহন মন্দির তৈরী হয়েছিল। এখনও রাস ও দোল খেলা হয় এখানে।নিত্যসেবাও হয়ে থাকে। ভোগ রান্নার ঘরে রান্নার কাঠও দেখতে পেলাম।
 
মদনমোহন মন্দির, বিষ্ণুপুর
মদনমোহন মন্দিরের নাটমঞ্চ


 মদনমোহন মন্দির, বিষ্ণুপুর  
অষ্টধাতুর কৃষ্ণ আর কষ্টিপাথরের রাধা। এই মূর্তিটাকে নিয়ে একটা রোমাঞ্চকর গল্প আছে। সেটা নিয়ে এক্কবার জমিয়ে লিখেছিলাম। আগ্রহ থাকলে এখানে পড়তে পারেনঃ মদনমোহনের কীর্তিকলাপ। 

মদনমোহন মন্দির, বিষ্ণুপুর
বিষ্ণূপুরের মন্দিরগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভালো পোড়ামাটির কাজ রয়েছে মদনমোহন মন্দিরে।

মদনমোহন মন্দির, বিষ্ণুপুর
নব নারী কুঞ্জর। ন জন মহিলা মিলে একটা হাতির রূপ তৈরী করেছে। এই ন জন নারী হল রাধা ও তার অষ্টসখী। কৃষ্ণের সঙ্গে ছল করে তাকে পিঠে নিয়ে জঙ্গলে ঘোরার জন্য রাধা সখীদের নিয়ে এই কাণ্ডটা করেছিলেন। দাশরথি রায়ের পাঁচালীতে আছেঃ
তোমরা ত অষ্টসখী, আমি এক জন । 
নয় জনে একত্রেতে হইব মিলন ॥
নব নারী মিলে হব অপূৰ্ব্ব কুঞ্জর।
কুঞ্জর রূপেতে রব কুঞ্জের ভিতর ॥
করী -রূপে প্রাণকান্তে পৃষ্ঠেতে করিয়া
ব্রজের বিপিন মাঝে বেড়াব ভ্ৰমিয়া ॥
মদনমোহন মন্দির, বিষ্ণুপুর
চীনা ড্রাগনের অনুকরণে স্থাপত্য।

মদনমোহন মন্দির, বিষ্ণুপুর
বালী ও সুগ্রীবের যুদ্ধের বিভিন্ন মুহূর্ত। তলায় দেখা যাচ্ছে ঘাপটি মেরে বসে আছে রামচন্দ্র। সুযোগ বুঝে পেছন থেকে তীর মারছে।

মদনমোহন মন্দির, বিষ্ণুপুর
নৃসিংহ অবতারে হিরণ্যকশিপুকে বধ করছে বিষ্ণু।

মদনমোহন মন্দির, বিষ্ণুপুর
বিষ্ণুর বরাহ অবতার। দশ অবতারেরই ছবি পাওয়া যাবে এই মন্দিরের দেয়ালে।

মদনমোহন মন্দিরের সামনে পোড়ামাটির জিনিসের পসরা। বাজারের চেয়ে এখানেই সস্তায় পাওয়া যাবে।

 

মুরলীমোহন মন্দির 

মাকড়া পাথরনির্মিত মুরলীমোহন মন্দিরের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বীরসিংহের রাণী শিরোমণিদেবী। অন্য মন্দিরগুলোর থেকে এই মন্দিরটা একটু দূরে অবস্থিত। এটা খুঁজে পেতে গাইড আর টোটোচালকমশাই বেশ নাজেহাল হলেন।  

দলমাদল

দলমাদল, বিষ্ণুপুর
৪ মিটার দীর্ঘ, ৩০ সেন্টিমিটার ব্যাস ও ৩০০ মন ওজন বিশিষ্ট এই কামানটা আগে বসানো ছিল বড় পাথর দরজার সামনে। ১৭৪২ সালে ভাস্কর রাওয়ের নেতৃত্বে মারাঠারা হামলা চালালে এই কামান থেকে গোলা বর্ষণ করে বর্গীদের দলকে মর্দন করা হয়। লোকের বিশ্বাস নগরপ্রাকারে দাঁড়িয়ে কামান দেগেছিলেন স্বয়ং মদনমোহন! দল মর্দন থেকে অপভ্রংশ হয়ে দলমাদল নামটা দাঁরিয়েছে।

লালবাঁধ

 
বাঁধ অর্থে তিনদিকে ঘেরা জলাশয়। একদিক ঢালু করা থাকে। সেখান দিয়ে জল এসে জলাশয়ে জমা হয়। বিষ্ণুপুরে অনেকগুলো বাঁধ আছে তার মধ্যে লালবাঁধ বিশিষ্ট অষ্টাদশ শতকের একটা মর্মান্তিক ঘটনার জন্য। পাঠান সর্দার রহিম খাঁর মহল থেকে লালবাঈকে তুলে নিয়ে আসেন মল্লরাজা দ্বিতীয় রঘুনাথ সিংহ। লালবাঈএর থাকার জন্য যে নতুনমহল তিনি তৈরী করে দিয়েছিলেন তার ধ্বংসাবশেষও গাইডমশাই আমাদের দেখালেন। লালবাঈএর গর্ভে দ্বিতীয় রঘুনাথ সিংহের এক পুত্রসন্তানও জন্মগ্রহণ করে। লালবাঈ ও তার পুত্র রাজত্বের দখল নিয়ে নেবে এই আশঙ্কায় রাজার প্রথমা স্ত্রী চন্দ্রভামা দেবী প্রথমে রাজাকে বিষপ্রয়োগে হত্যা করেন, তারপর লালবাঈ ও তার পুত্রকে একটা নৌকোয় বেঁধে তার ওপর বড় বড় পাথর চাপিয়ে এই জলাশয়ে ডুবিয়ে মারেন। চন্দ্রভামা দেবী নিজে অবশ্য রাজত্ব ভোগ করতে পারেননি। রাজার চিতায় তাঁকে সহমরণে যেতে হয়।

রাধাশ্যাম মন্দির

রাধেশ্যাম মন্দির, বিষ্ণুপুর
১৭৫৮ সালে মাকড়া পাথর নির্মিত এই গম্বুজাকৃতি একরত্ন মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন মল্লরাজ চৈতন্য সিংহ। এই মন্দিরে রাধাশ্যাম, জগন্নাথ ও গৌর নিতাই ের মূর্তি আছে। তুলসীমঞ্চ, নাটমঞ্চ, ভোগ রান্নার ঘর, প্রবেশপথে নহবৎখনা ্ররয়েছে।
 
রাধেশ্যাম মন্দির, বিষ্ণুপুর
মন্দিরের প্রবেশদ্বারে ইঁটের নহবৎখানা। একসময় এখানে সানাই ও বাদ্যযন্ত্র বাজানো হত।

রাধেশ্যাম মন্দির, বিষ্ণুপুর 
ভোগ রান্নার ঘর।

রাধেশ্যাম মন্দির, বিষ্ণুপুর
পঙ্খের কাজে ফুটে উঠেছে নানা পৌরাণিক কাহিনী।

রাধেশ্যাম মন্দির, বিষ্ণুপুর
গৌর-নিতাইএর এই মূর্তিদুটো আগে মহাপ্রভু মন্দিরে ছিল। সংরক্ষণের অভাবে সেটার ভগ্নপ্রায় দশা। তাই গৌর নিতাই ঠাঁই নিয়েছেন এই মন্দিরে।


গুমঘর 

গুমঘর, বিষ্ণুপুর
মল্লরাজা বীরসিংহ এই ইঁটের ঘরটি বানিয়েছিলেন। কারো মতে এটা রাজা দের শস্যাগার ছিল আবার কেউ বলেন এর ওপর থেকে ফেলে অপরাধীদের শাস্তি দেওয়া হত। ঐতিহাসিকরা অনেকে মনে করেন এটা জলের ট্যাঙ্ক ছিল, কারণ আশেপাশে অনেক পোড়ামাটির পাইপ পাওয়া গিয়েছিল।


পাথরের রথ 

পাথরের রথ, বিষ্ণুপুর

আনুমানিক সপ্তদশ শতকে মাকড়া পাথর নির্মিত মাটিতে গাঁথা এই রথ কি কাজে লাগত বোঝা গেল না। এটার তলার অংশটা রাসমঞ্চের মত আর ওপরটা বিষ্ণুপুরের মন্দিরের মত। চার ধারে তিনটে করে পাথরের চাকা দেখা যাচ্ছে। 


ছবিগুলো সবই আমার বা শ্রীরূপার তোলা। খালি শ্যামরায় পঞ্চরত্ন মন্দিরের সামনে দুজনের ছবিটা তুলে দিয়েছেন গাইড মহাশয়। সঙ্গের তথ্যগুলো মূলতঃ গাইড মশাই এর কাছ থেকে শোনা বা বিষ্ণুপুর গাইড বুক এবং মন্দির চত্বরে ভারতীয় পুরাতত্ত্ব বিভাগের সাইনবোর্ড এ পড়া। এছাড়া বিনয় ঘোষের "পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি (প্রথম খণ্ড)" এবং "পশ্চিমবঙ্গ" পত্রিকার বাঁকুড়া জেলা সংখ্যার সাহায্য ও নিয়েছি। সরকারী গাইড মিঠু ভুঁই এর যোগাযোগ নম্বরঃ 9474452992